অলীকডোরে চন্দ্রকথা পর্ব-১৯+২০+২১

0
222

#অলীকডোরে চন্দ্রকথা। (পর্ব-১৯)
#আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা।

রৌদ্রজ্বল তপ্ত দুপুর। শেখ বাড়ির বসার ঘরে গল্পে মত্ত দুই নারী। চায়ের কাপে আলাপ চলছে তারিনার আর সুরমা বেগমের। কেন্দ্রের বাইরে দেখা দুজনার। ইতঃপূর্বে দেখা কিংবা কথা কোনটাই হয়নি। আজই প্রথম আলাপ বলা যায়। ছেলের বন্ধুদের সাথে বেশ সখ্যতা আছে উভয়ের। সৈকতের আসা যাওয়া যেমন শেখ বাড়িতে হয়, তেমনি রুবাবের যাওয়াও হয় সৈকতের গ্রামের বাড়িতে। কিন্তু মায়েদের আলাপ হয়নি। কেন্দ্রের বাইরে অপেক্ষারত অবস্থায় রুবাবই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল দুই মায়ের। সেখানে টুকটাক আলাপ হলো। সুরমার অমায়িক ব্যবহারে তারিনার বেশ আপনই লাগল। যখন শুনলেন, সুরমা হোটেলে উঠবেন, তখন বেজায় আপত্তি জানালেন। সমাদরে নিয়ে এলেন নিজ বাড়িতে। তারপর আপ্যায়নের ঝুলি খুলে বসেছেন। দুই নারীর গল্প আজ যেন শেষ হবার নয়।

প্রেমিক, ভাই দুজনার অপেক্ষায় বেলা কাটাবার ইচ্ছে হলেও সেই ইচ্ছে পূরণ হলো না মুনের। সৈকতের মায়ের সাথে আসতে হলো তাকে। কুশল বিনিময়ের পর রান্নায় ঢুকেছে। বাড়িতে শুধু সুরমা নয়, সিফাত ও আছে। দুই বাবা হলের দিকেই আছে।
মুন ওদের মুখোমুখি হচ্ছে না। মূলত, সুরমার সামনে যেতে লজ্জা লাগছে মুনের। সদ্য প্রেমিকের মাকে কিভাবে ট্রিট করবে তা ভেবে কূল পাচ্ছে না। তাছাড়া সিফাতের ভয়টিও আছে। সকালে যেভাবে লম্বা সালাম দিল, পাজি ছেলেটা দেখলেই মজা করবে। মুন যতটুকু ধারণা করেছে, মুনের পাত্র হিসেবে সৈকতকে পছন্দ করেছে রুবাব। ব্যাপারটা পারিবারিকভাবে এগায়নি। সৈকতের বিসিএস হলে রুবাব সৈকতে অনুমতি দিবে প্রস্তাব আনার। ভাইয়ের বন্ধু, আর সিফাতই জানে। এখন বাবা মা যদি টের পেয়ে যায়! ভয় থেকে অস্বস্তিই বেশি হচ্ছে। সেই অস্বস্তি নিয়েই রান্নাঘরে লুকিয়েছে মুন।

বেলা গড়াতেই মুনের ডাক পড়ল। না গিয়ে পারা গেল না। বসার ঘরে যেতেই তারিনা বললেন,
“আপা জার্নি করে এসেছে। একটু রেস্টের ব্যবস্থা করে দে।”

মুন চাপা অস্বস্তি নিয়ে সুরমাকে নিয়ে গেল। বিছানা ঝেড়ে শোবার ব্যবস্থা করে দিল। সুরমা সহাস্যে বললেন,
“এত ব্যস্ত হতে হবে না, মেয়ে। ”

মুনের ব্যস্ততা গেল না। বিছানা ঝেড়ে, ফ্যান ছেড়ে দিল। জগে পানি ভরে দিল। আযান দিয়েছে অনেকক্ষণ হলো। সুরমা নামাজ পড়বেন। মুন ওয়াশরুমের লাইট জ্বালিয়ে, জায়নামাজ ও বিছিয়ে দিল। এটা ওটা করতে লাগল। নামাজ শেষ হতেই বলল,
“আন্টি আপনার কিছু লাগলে নির্দ্বিধায় আমাকে বলবেন।”

সুরমা হাসলেন। জায়নামাজ গুটিয়ে বিছানায় বসলেন। মেয়েটা কী মিষ্টি দেখতে! হাত টেনে পাশে বসিয়ে বললেন, “কিছুই লাগবে না আমার। তুমি একটু আমার সাথে বসো। তোমার সাথে তো কথাই হলো না। ”

মুন নম্র হয়েই বসল। সুরমা ওর সম্পর্কে নানান প্রশ্ন করলেন। কী করে, কিসে পড়ে এসব। মুন উত্তর দিল। সুরমার কোমল ব্যবহারে মুনের জড়তা কমে এলো খানিকেই। মুন খুব করে চাইছিল, সুরমার থেকে সৈকতের গল্প শুনতে। তার অজানা কোন গল্প। মন ভরা কৌতুহল, অথচ মুখে প্রশ্ন আসছে না। হুট করে সৈকতের সম্পর্কে প্রশ্ন করলে উনি কী না কী ভাবেন। মুনকে বেশি একটা অপেক্ষা করতে হলো না। সুরমা নিজ থেকেই কথায় কথায় ছেলের গল্প জুড়লেন। তার গল্পের সারমর্ম হলো, ছেলে তার ভীষণ সহজ সরল, ভদ্র নম্র। ছেলের উপর বেজায় গর্ব তার। মুনের শুনতে ভালো লাগছিল। তবে সরল উপাধিতে বেশ আপত্তি করল। মনে মনে বলল,
” আপনি যাকে ভদ্র বলছেন, সে এমন এমন কথা বলতে পারে যা সামনের মানুষের অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে তুলে। আর যাই হোক আপনার ছেলে অন্তত সহজ সরল না আন্টি। ভয়ংকর পাজি ।”

কিন্তু মনের কথা তো মুখে বলতে পারল না। কেবল মুখ চেপে হাসল। সায় জানাল,
“হ্যাঁ, ভাইয়া ও খুব সুনাম করে উনার।”

সুরমা প্রসন্ন হলেন। কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে বললেন,
“ভাবতেছি, ছেলেটার বিয়ে করাব। তোমার বান্ধবী টান্ধবী কেউ আছে না কি!”

মুন বিষম খেল। আকস্মিক কথায় কাশতে লাগল। হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল। ঠিক সেইক্ষণে সৈকতের গলা শুনা গেল। পরীক্ষা শেষে আসবার ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও বাবা মায়ের জন্য আসতে হলো। শেখ বাড়িয়ে এসে সর্বপ্রথম মায়ের খোঁজ করল। ক্লান্তিতে শরীর নুয়ে পড়ছে। দরজার বাইরে থেকে মৃদু স্বরে ডাকতে ডাকতে আসছে। সুরমা জবাব দিলেন, “এখানে আমি।”

শব্দের উৎস খুঁজে সেদিকে আগাল। দরজার কাছে এসে ভেতরে মায়ের পাশে থাকা নারীকে দেখে কিঞ্চিৎ চমকাল বটে। বাহ্! দুই নারী একসাথে! গলা খাঁকারি দিয়ে ভেতরে ঢুকল। মুন বিস্ময় নিয়ে চাইল। এরা কখন এলো! চোখাচোখি হলো দুজনার। সৈকত স্মিত হাসল। মুন তার ক্লান্ত মুখখানার দিকে মায়া মায়া চোখে তাকিয়ে রইল।

সুরমা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “এসে গেছিস! পরীক্ষা কেমন হলো?”

সৈকত ক্লান্ত স্বরে বলল, “ভালো।”

সুরমা ছেলের মাথায় হাত বুলালেন, “কেমন শুকিয়ে গেছিস তুই? কী ছেলে আমার কী হয়েছে?” আফসোসে ভাসল সুরমার মুখ। সৈকত চোখ মেলে চাইল মুনকে। ওর দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ হেসে বলল,
“খেয়াল রাখার মানুষের কাছে থাকার অভাবে হচ্ছে এমন।”

বলে চাপা হাসল সৈকত। সুরমা বললেন, “আমরা থাকি গ্রামে। তুই এখানে একা পড়ে থাকিস। বললাম, বিয়ে করে নে। তাও রাজি হলি না। বিয়ে করলে বউ খেয়াল রাখতে পারতো।”

সৈকত সরাসরি চাইল মুনের দিকে। ওর চেহারায় ক্লান্তির প্রলেপ ছড়ানো, অথচ স্বরে, চোখে স্পষ্ট কৌতুক। মায়ের কথায় মজা পাচ্ছে সে। মুনের দিকে তাকিয়ে ইশারা করল। ওমনি মুন বুঝে গেল, এই ছেলে এখন লাগামহীন কিছু বলে ফেলবে। মুন ঝটপট উঠে দাঁড়াল। কিছু শেষ রক্ষা হলো না। সৈকত হাসিমুখে বলল,
“যা দেখছি এবার বউ ঘরে তুলতেই হবে। একলা শহরে ব্যাচেলর থাকা যাচ্ছে না। ”

সৈকতের ঠোঁটে গভীর হাসি। সুরমা টের না পেলেও দূরে দাঁড়ানো মুন ঠিকই টের পেল সৈকতের মনের গভীর ভাবনা। মায়ের অগোচরে কেমন ভয়ংকর হাসি দিচ্ছে তার দিকে। মুন নাক ফুলিয়ে অন্যদিকে চেয়ে বিড়বিড় করল, “অসভ্য।”

সুরমা প্রসন্ন হলেন। অবশেষে ছেলে বিয়ের জন্য মত দিল। তিনি খুশি হয়ে বললেন,
“মেয়ে দেখব না কি!”

মুন ধীরে পাশ কাটতে নিল। সৈকত আকস্মিক ডেকে উঠল,
“এই দাঁড়াও।”

গম্ভীরমুখের আদেশবানীতে থেমে গেল মুন। বুক কাঁপছে ওর। এই ছেলে কী করবে এখন! কথারঢং বিশেষ একটা সুবিধার না। মায়ের সামনে কী না কী বলবে, শেষে ওকে লজ্জা পেতে হবে। কিঞ্চিৎ ভয় নিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল মুন। সুরমা এতক্ষণ ছেলেকে দেখছিলেন। মুনকে দেখছিলেন না। এবার মুনের দিকে চাইলেন, দেখলেন ওকে।
ছেলের মনোবাসনা বুঝলেন না। কেবল শুনলেন ছেলের কথা ,
” মা, ওর সাথে পরিচয় হয়েছে তোমার? ও রুবাবের ছোটোবোন মুন। আর কদিন বাদে.. ……

মুন ধরে ফেলল সৈকত কী বলবে। সে তড়িঘড়ি করে বলল, ” মা, ডাকছে। আমি আসছি। ”

বলে এক প্রকার পালিয়ে বাঁচল। রুমের বাইরে এসে হাঁফ ছাড়ল। সৈকত ওর পালানো দেখে অনেক কষ্টে হাসি চেপে রাখল। তারপর বলল,
“কদিন বাদে সেমিস্টার ফাইনাল দিবে। ”

সুরমা সহজ সরল মানুষ। কথার প্যাচ ধরতে পারলেন না। সরল মনে বললেন, “ভারি মিষ্টি মেয়ে!”

_____________

সৈকতকে বকতে বকতে করিডোর পার হচ্ছিল মুন। সুরমাকে দোতলার একটা ঘরে থাকতে দিয়েছে সে। সবাই নিচে, এখানটায় কেউ নেই। করিডোর পেরিয়ে সিড়ি। অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছিল মুন, আকস্মিক কাধে হাত রাখল কেউ। আঁতকে উঠল । চমকে চিৎকার দিতে যাবে তার আগেই একটা পুরুষকন্ঠ বলল,
” হ্যালো সিফাতের ভাবি!”

পরিচিত স্বর শুনে চমকে চাইল মুন। কাছেপাশে সৈকতকে দেখে বিস্ময়ের পারত বাড়ল। প্রথমে বিস্ময় নিয়ে চাইল, পরপরই তা রূপ নিল রাগে। অগ্নিচোখে চাইল। একটু আগে মায়ের সামনে ওকে অস্বস্তিতে পেলে শান্তি হয়নি, আবার এসেছে ভয় দেখাতে। ওর রাগচক্ষুতে বিশেষ একটা ভাবান্তর হলো না সৈকতের। বরং ভ্রু নাড়িয়ে বলল,
” তুমি কি আমার উপর রেগে আছো?”

কী নিষ্পাপ ভঙ্গি সৈকতের! যেন ওর চেয়ে নিরীহ মানুষ দুটো নেই। মুন আবার চোখ রাঙাল। সৈকত শান্ত কন্ঠে বলল,
” আমাকে দেখার জন্য কত লুকোচুরি তোমার। অথচ যেই আমি সামনে এলাম, এখন রাগ দেখাচ্ছো!”

মুনের নাকের ডগায় তখন রাগ। বলল, “বেশ করেছি। আপনি আন্টির সামনে ওসব কী বলছিলেন!”

” কী বলছিলাম?” অজানার ভান করল সৈকত। যেন কিছু জানেই না। মুন চোখ রাঙাল।
মুনের এত রাগ ইতঃপূর্বে দেখেনি সৈকত। আগের সম্পর্কটা রাগবার মতো ছিলই না। ওত অধিকার ও ছিল না। সৈকত চাপা হেসে বলল,
“মায়ের জানা উচিত, একটা মেয়ে তার ছেলের জন্য পাগল হয়ে গেছে। ওই পাগল মেয়েটার সাথে তার ছেলের বিয়ে দেয়া উচিত। আমি এমন কিছু জানাতেই চেয়েছিলাম, তুমিই দিলে না।”

মুন সাত পাঁচ না ভেবে প্রতিবাদ করল, “আমি মোটেও আপনার জন্য পাগল হইনি। ”

সৈকত অবাক হয়ে বলল, “আমি তো একবারো তোমার নাম নিলাম না।”
থেমে বলল, “তারমানে তুমি আমার জন্য পাগল হচ্ছো?”

ঠোঁট কামড়ে হাসছে সৈকত। মুন নিজের কথায় নিজেই ফেঁসে গেছে। বুঝেও অস্বীকার করল, “মোটেও না।”

“তাহলে আমাকে ওমন লুকিয়ে লুকিয়ে দেখো কেন?”

মুন প্রশ্নবিদ্ধ চোখে চাইল। সে বুঝল না সৈকত কিসের কথা বলছে। আজ সকালের কথা কী? যাচাই করতে বলল, ” কখন দেখেছি আপনাকে?”

” টাইম টেবিল নেই, আমার মনে হয় তুমি সারাদিনই আমাকে দেখো। ” মিটমিট হাসছে সৈকত। মুন তীক্ষ্ম চোখে চাইল। সৈকত কোন দেখার কথা বলছে! ওর চোখের প্রশ্ন ধরতে পারল সৈকত। কিছুটা কাছে এসে ক্ষীণ স্বরে বলল,
“আমাকে দেখতে ইচ্ছে হলে বলবে, আমি এসে হাজির হবো। ওমন লুকোচুরি করে আমার ইন্সটা একাউন্টে পড়ে থাকতে হবে না। ”

মুনের চোখে বিস্ময় দেখা গেল। ও যে দেখে, তা সৈকত কিভাবে বুঝতে পারল? সে তো সৈকতকে ফলো ও করে না। মুনের যে ইস্টাগ্রাম একাউন্ট আছে এটা তেমন কেউ জানে না। সৈকত জানল কিভাবে? না কি আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ছে? হতেও পারে। যা দুরন্ত ছেলে। অসম্ভব না। মুন লুকোচুরিতে সৈকতকে দেখাটা সৈকত টের পাওয়ার কোন পথ দেখল না। ভেবে নিল, সৈকতের ফন্দি মাত্র। নিজের মিইয়ে যাওয়া মন জিইয়ে দৃঢ় স্বরে বলল,
” মোটেও না। আপনি বানিয়ে বলছেন। ”

সৈকত আরেকটু কাছে এলো। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, ” তুমি আমাকে এতটা বিভোর হয়ে দেখছিলে যে দুই দুটো ছবিতে রিয়েক্ট পড়ে গেছে। তাও দু’বছর আগের ছবি। আমাকে দেখতে গিয়ে আমার কাছেই ধরা দিয়ে দিয়েছো চন্দ্রকথা।”

এতখানি কাছাকাছি প্রেমিকপুরুষ। তার উপর গভীর স্বরে কথায় শিউরে উঠল মুন। নিজের উপরই বিরক্ত হলো। এতটা ভুল কিভাবে হলো! দু’বছর আগের দুই একটা ছবি বেশ ভীষণ সুন্দর এসেছিল। মুন বারবার বিভোর হয়ে ওই ছবিগুলো দেখছিল, তখনই বোধহয় হাতের চাপ লেগে গেছে। সে টেরই পায়নি। একটু সাবধান হওয়া উচিত ছিল। এখন সৈকত এটা নিয়ে খুব মজা নিবে। ধরা পড়ে জব্দ হয়ে গেল মুন। বিরক্তি আর লজ্জায় মুখ কুঁচকে ফেলল। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে হাঁটা ধরল। সৈকত হাসতে হাসতে পিছন থেকে বলল,
“আরে, আমি কিছু মনে করিনি তো। তুমি আমার গুণে গুণে পাঁচদিনের প্রেমিকা, দেখতেই পারো। এভাবে, ওভাবে সব অ্যাঙ্গেলে দেখতে পারো। সব মানে সব। ”

কুটিল হাসি সৈকত। না তাকিয়েও সৈকতের মনোবাসনা ধরতে পারল মুন। সে কদম চালাতে চালাতে বলল, “অসভ্য।”

মুন হনহন করে চলে গেল। সৈকত পিছু দাঁড়িয়ে আনমনে হাসতে লাগল।

_____________

বসার ঘরে এলোমেলো হয়ে বসে আছে চারবন্ধু। ক্লান্তিতে এসেই চিৎ হয়ে শুয়ে পড়েছে রুবাব। নিজের রুম অবধি ও যায়নি। পাশে আয়েশ করে বসা অন্তর নাহিদ। ওরা কথা বলছে। সিঙ্গেল সোফাটায় চোখ বুজে বসা সৈকত। এক হাতে কপাল চেপে ধরা। মাথা ব্যাথা করছে বোধহয়। চোখেমুখে তীব্র ক্লান্তি। নিষ্প্রাণ হয়ে গেছে যেন। আগে থেকে করে রাখা ফ্রিজের ঠান্ডা লেমনেড নিয়ে আসতেই সৈকতের মুখখানা চোখে পড়ল মুনের। দেখেই মায়া হলো! একটু আগেও কত প্রাণবন্ত লাগছিল, অথচ এখন একবারে নির্জীব লাগছে। খানিক আগের সেই দীপ্তিতা নেই চেহারায়। কী ভীষণ ক্লান্ত লাগছে! নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে কটাদিন যা পরিশ্রম গেল, এটা তারই ফল। শান্ত চোখে এক পল চেয়ে রইল, কে বলবে এই ক্লান্ত চেহারার পেছনে এক প্রাণবন্ত চেহারা লুকিয়ে আছে!

মুন ট্রে নিয়ে ভেতরে গেল। ভাইকেও খেয়াল হলো। চেহারায় ক্লান্তির ঘাটতি নেই তারও। কেমন নুয়ে পড়েছে! মুন মৃদু ডাকল,
“ভাইয়া?”
রুবাব নড়ে উঠল। মুনকে দেখে এক চিলতে হাসল। মুন একটা গ্লাস তুলে ভাইয়ের দিকে বাড়িয়ে বলল, “এটা নাও, রিফ্রেশ লাগবে।”

রুবাব তুষ্ট হাসল। এই মুহুর্তে এটার দরকার ছিল। এক গ্লাস তুলে নিয়ে চুমুক দিতে প্রাণ জুড়াল। মুন নিজ উদ্যোগে নাহিদের দিকে বাড়িয়ে দিল,
“নাহিদ ভাইয়া, আপনার লেমনেড। ”

নাহিদ নিল বিনাবাক্যে। তারপর অন্তরের দিকে বাড়িয়ে দিল, “অন্তর ভাইয়া, এটা আপনার।”

বিপত্তি ঘটল পরের কদমে, যখন তার পা এসে থামল সৈকতের সামনে। সৈকতের চোখ বন্ধ
। নড়চড় ও নেই। ভাইয়ের উপস্থিতিতে প্রেমিককে ডাকতে অস্বস্তি হচ্ছে ওর। ডাকবে কি ডাকবে না সেই দ্বিধায় পড়ল। মুন কাঁচুমাচু করে উঠল।

রুবাব মনোযোগ দিয়ে ফোন দেখছে। এদিকে খেয়াল নেই। খেয়াল নেই নাকি দিচ্ছে না কে জানে? অন্তর আর নাহিদ লেমনেডের গ্লাস হাতে মিটমিটিয়ে হাসছে। তবে এদিকে তাকাচ্ছে না।
মুন অপ্রস্তুত ভঙিতে দাঁড়িয়ে আছে। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে একবার, আবার সৈকতের দিকে তাকাচ্ছে। অনেকক্ষণ চেয়ে ও ডাকতে পারল না। শেষে ট্রে টা সেন্টার টেবিলে রাখবার মনস্থির করল। রাখবার সময়ই রুবাব উঠে গেল। বন্ধুদের উদ্দেশ্যে বলল,
” ফ্রেশ হবি না? রুমে চল। আমি যাচ্ছি।”

বলে সিড়ির দিকে এগুলো। দ্রুত পায়ে উঠে গেল। ভাই যেতেই হাঁফ ছাড়ল মুন। রেখে দেয়া গ্লাসটা হাতে তুলে নিল। আবার ফিরে গেল সৈকতের কাছে। শান্ত সৈকতকে দেখেই খানিক আগে ওকে জব্দ করবার কথা মনে পড়ে গেল। ভাবল, এক আধটু জব্দ তারও করা উচিত। সে বাঁকা হেসে, গলা ঝেড়ে বলল,
“সৈকত ভাইয়া আপনার লেমনেড। ”

অন্তর এতক্ষণে এদিকে তাকাল। হাসতে হাসতে বলল, “ভাইয়া থেকে সাঁইয়্যা হয়ে কদিন বাদে মাইয়্যার বাপ হয়ে যাবে, এখনো তুমি সৈকতকে ভাইয়া ডাকছো মুন!”

মুন লজ্জা পেলেও দমল না। ফিরতি ডাকতে গেল, “সৈকত ভা….

” ডোন্ট ইউ ডেয়ার।”

পুরো শব্দ উচ্চারণ করবার আগেই একটা ধমক এসে লাগল কানে। ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে গেল মুন। এতক্ষণের ঘুমন্ত মানবকে রেখে উঠতে দেখে থমকে গেল। সে কল্পনাও করেনি সৈকত হঠাৎ ওমন ধমকে উঠবে। ‘ভাইয়া’ ডাকটা আর উচ্চারিত হলো না। মাঝ পথেই থেমে গেল। হাত থেকে লেমনেড ফসকে পড়ল সৈকতের গায়ে।

শুধু মুন নয় চমকেছে নাহিদ অন্তর ও। এক মুহুর্ত থেমে পরমুহূর্তে হেসে উঠল। মুন নিশ্চুপ চেয়ে রইল সৈকতের দিকে। একটু আগে ওকে কত কী বলে জব্দ করেছে, এখন ও সামান্য ভাইয়া ডেকেছে বলে এত জোরে ধমক দিতে হবে! অভিমান হলো ওর। অর্ধেক পড়া লেমনেডের গ্লাসটা টেবিলে রেখেই চলে গেল।

খেতে বসার পর দেখে হলেও মুখ ফুলিয়ে রইল। তাকাল ও না। সৈকত দুই একবার কথা বলার চেষ্টা করে ও কাজ হলো। চাপা শ্বাস ফেলে সৈকত বলল,
” জীবনের এই পর্যায়ে এসে বুঝলাম, ভাইয়া ডাকা মেয়েদের সাথে প্রেম করা উচিত না। কিছু বলাও যাবে না, সহ্য করাও যাবে না। প্রেমিককে ডাকার মতো এত হাজার শব্দ থাকতেও এদের ভাইয়াই ডাকতে হবে। ”

চলবে…..

#অলীকডোরে চন্দ্রকথা। (পর্ব-২০)
#আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা।

সোনালী আলোর পড়ন্ত বিকেল। শেখ বাড়ির চৌকাঠে দাঁড়িয়ে রাগে ফোঁসফোঁস করছে মুন। দৃষ্টি সদর গেইটের দিকে। খানিক আগে এ পথ ধরে বেরিয়ে গেছে তার প্রেমিকপুরুষ। দুপুরবেলা ওমন ধমকে অভিমানে জমেছিল তার মনে। সেই অভিমানে এড়িয়ে গেছে প্রেমিককে। কয়েকবার কথা বলবার চেষ্টাকে ব্যর্থ করেছে নিমিষেই। এর রেশ নিয়েই বিদায় নিয়েছে প্রেমিক সৈকত। এতেই বেজায় আপত্তি মুনের। না হয় সে একটু রেগে ছিল, তাই বলে না মানিয়ে চলে যাবে? না হয় সে ঘরে লুকিয়ে ছিল, তাই বলে খুঁজবে না? প্রেমের সম্পর্কের পর প্রথম রাগল সে, একটু তোষামোদ তো আশা করাই যায়। সে তো রুমে অপেক্ষায় ছিল, কল দিয়ে একটাবার স্যরি বলে নিচে নামতে বললে নেমে ধরা দিবে। তাকে অপেক্ষার সাগরে ডুবিয়ে সৈকত চলে গেছে। মুনের মনে অভিমান হলো। শপথ নিল, তাকে পাত্তা দিল না তো? সে ও দিবে না।

মন শপথ নিলেও চোখ ঠিকই খুঁজল ফোন। সৈকতের কল ম্যাসেজের অপেক্ষায় পথ চেয়ে রইল। কিন্তু তাকে হতাশ হতে হলো। সৈকতের কোন খবর নেই। না একটা কল, আর না ম্যাসেজ। অপেক্ষাতে রাত কাটল, ঘুমটুম ও হলো না ঠিকঠাক। ভোরের দিকে ঘুম নামল। উঠতে বেশ বেলা হলো। চোখ মেলেই তাড়াহুড়ো করে ছুটল ভার্সিটি। প্রচন্ড তাড়াতেও গেইট পেরুবার সময় আশপাশ চাইতে ভুলল না। নাহ, আসেনি। ক্ষেপে গিয়ে দ্রুত পা চালাল মুন।
ক্লাস শেষে উদাস হয়েই হাঁটা ধরল। আজ বান্ধবীদের সাথে রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করার প্ল্যান। সৈকত এলেও বিশেষ একটা কাজ হবে না। ভার্সিটির কাছেই রেস্টুরেন্ট আছে। ওরা সেদিকেই হাঁটছিল। বান্ধবীরা কথা বলছে, মাঝে থাকা মুন চুপচাপ শুনছে। আকস্মিক কেউ একজন এসে দাঁড়াল সামনে। ওরা সবাই চমকে উঠল। চমক বাড়ল যখন দেখল, ওদের সামনে এক সুদর্শন যুবক দাঁড়ানো। হাঁপাতে হাঁপাতে চঞ্চল গলায় বলল,
“কতক্ষণ ধরে ডাকছিলাম, একটু দাঁড়াবে না?”

আগন্তুকের আগমন প্রথমে একটু বিব্রত করল ওদের। পরক্ষণেই স্বাভাবিক হলো মুনের দুই বান্ধবী।
তারা জানে মুন একটা রিলেশনশীপে আছে। মুনের জন্য ব্যাকুল হয়ে গেইটে দাঁড়িয়ে থাকতে বহুবার দেখেছে । তাই চিনতে খুব একটা অসুবিধা হলো না কারো। মুখ চেপে হাসল তারা। চোখেচোখে ইশারা করল একে অপরের সাথে। সম্পর্কে দুলাভাই, এক আধটু মজা করাই যায়। ওরা বিস্ময়ের সাথে বলল,
“এক্সকিউজ মি! আপনাকে তো চিনলাম না!”

সৈকত হাতঘড়িতে সময় দেখল। ব্যস্তভঙিতে বলল,
“স্যরি গার্লস, খুব অল্প সময় নিয়ে এসেছি। অন্য একদিন সময় নিয়ে এসে পরিচিত হবো। এই অল্প সময়ে পরিচিত হতে গেলে, যে বিশেষ পরিচিত তার জন্য সময় হবে না। আজ বরং তার সাথেই আমার অল্প সময়টা কাটুক। ”

বলে চোখ ফেলল মুনের পানে। মুন বোধহয় এতক্ষণ এদিকেই তাকিয়ে ছিল। সৈকত তাকাতেই চোখ ফেরাল। খানিকবাদে আবার আড়চোখে তাকাল। আজ আর উদ্ভ্রান্তের মতো বাসার পোশাকে আসেনি। থ্রি-কোয়ার্টার, এলোমেলো চুল কিছুই নেই। তার পরিবর্তে আজ বেশ পরিপাটি লাগছে। ক্যাজুয়াল আউটফিট পরনে তার। কালো টি-শার্টের উপর লাল কালো চেইক শার্ট। শুভ্র দেহে রংটা বেশ মানিয়েছে। মাথায় সিল্কি চুল ব্রাশ করা, হাত দিয়েই করেছে বোধহয়। কয়েকটা এলোমেলো হয়ে এসে পড়েছে কপালে। চোয়ালে একটা প্রসন্নতা ঝিলিক দিচ্ছে, ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলে আছে। সুন্দর সুদর্শন লাগছে। ওমন সৌন্দর্য চোখে লাগল খুব, মনে আলোড়ন তুলল। কিন্তু বহিঃপ্রকাশ করল না। কাল থেকে খবর নেই, পুরো একদিন পেরিয়ে যাবার পর এখন এসেছে। তাও এসে ব্যস্ততা দেখাচ্ছে! তার ও এখন রাজ্যের ব্যস্ততা। আজ কথাই বলবে না। হুহ! অন্যদিকে তাকিয়ে ভেঙচি কাটল মুন।

সৈকত মুনের দিকে তাকিয়ে ছিল। মুনের ওমন মুখ বাঁকানো দেখে আকস্মিক হেসে ফেলল। শব্দহীন হাসি। মুনের দৃষ্টিগোচর হলো না তা। তবে বান্ধবীদের চোখ এড়াল না। ওরা খেয়াল করছিল দুজনকেই। সৈকতের কথার ভঙ্গি, তাকানো, সবটায় সুন্দর একটা ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠেছে। দেখতে শুনতে ভালোই লাগল ওদের। মুনের এক বান্ধবী মিথি টিপ্পনী কেটে বলল,
“তা আপনার পরিচিত জন কে? কাকে চান?”

সৈকতের জবাব দিতে দেরি হলো না। সুন্দর হেসে জবাব দিল, মুনের দিকে ইশারা করে,
“আপনাদের এই বান্ধবীকেই তো চেয়ে এসেছি এতকাল, এখনো ওকেই চাইছি। যদি একটু ছাড় দেন, তবে ওকে সাথে করে নিয়ে যেতে চাই।”

অকপটে, সুন্দর নিবেদন করল সৈকত। ওর দৃষ্টি আটকে মুনেই। চোখে তার প্রগাঢ় প্রেম। কন্ঠে চঞ্চলতা। মুন যে মানুষটার কাছে কতটা কাছের, কতটা প্রেমের তা নিমিষেই আন্দাজ করে নিল ওরা। সৈকত এরই মাঝে ঘড়ি দেখল কয়েকবার। যাবার তাড়া আন্দাজ করে কথা বাড়াল না। মিথিরা হেসে বলল,
“দিলাম ছাড়, তবে ছেড়ে দিইনি। ট্রিট কিন্তু আমাদের প্রাপ্য, দুলাভাই।” রসিকতার ভান ওদের।

“দুলাভাই ” সম্বোধনে সৈকত শব্দ করে হেসে ফেলল। সায় জানিয়ে বলল, ” বউকে আগে পাই, তারপরই না হয় শালিকামহলের আবদার নিয়ে বসব।”

মুনের পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে সৈকতের ওমন হাসিঠাট্টায়। ছ’দিনের প্রেমের একদিন বিরহেই কেটেছে, প্রেমিক হয়ে প্রেম নিবেদন করার পরিবর্তন ধমক নিবেদন করছে! এখন এসে বউ বউ করা হচ্ছে! সামান্য মজায় যে ধমক দিতে পারে, তাকে বিয়ে করতে মুনের বয়েই গেছে! অন্যদিকে চেয়ে নাক ফুলাল মুন। সৈকত আড়চোখে ওসব দেখে মুখ চেপে হাসছে। মুনের বান্ধবীদের বলল,
“আপনাদের ট্রিট পেয়ে যাবেন। আপাতত আপনাদের বান্ধবীকে একটু ছাড় দেন।”

বান্ধবীরা বিদায় নিয়ে পা বাড়াল সামনে। সৈকত গিয়ে মুনের পাশে দাঁড়াল। মুন অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। সৈকতের দিকে তাকাচ্ছে না। সৈকত বলল,
” শালা, শালিকা সব পেয়ে গেলাম। আসল বউটাই পেলাম না এখনো। কবে যে তুমি বউ হবে, চন্দ্রকথা!”

ভীষণ আক্ষেপ করে বলল সৈকত। যেন মুনকে বউ করতে না পারার আক্ষেপে ম রে যাচ্ছে সে। সৈকতের মুখে বারবার, ‘বউ’ শব্দটা শুনে মুনের হৃদপিণ্ড কেঁপে ওঠছে। সে বউ হবে? সৈকতের বউ?ভাবতেই লজ্জায় মুখ লাল হলো। হার্টবিট বেড়ে গেল। সৈকতের সামনে প্রকাশ পাওয়ার আগেই হাঁটা ধরল। সৈকত দ্রুত কদম বাড়িয়ে বলল,
“আরে হাঁটা ধরলে কেন?”

লজ্জা চেপে মুন গম্ভীর হলো। ভরাট কন্ঠে বলল, “তো কী করব?”

ভ্রু নাঁচিয়ে চমৎকার ভঙ্গিতে সৈকত বলল,
“বউ হবে?”

মুনের অন্তরাত্মা বহিরাত্মা কেঁপে উঠল। হৃদপিণ্ড ছলকে উঠল। কন্ঠ রোধ হয়ে এল। কিছু বলতে পারল না। লজ্জায় কাবু হলো। সৈকত শান্ত স্বরে বলল,
“বউ হবার কথা বললে লজ্জা পাও, অথচ অনায়েসে ‘ভাইয়া’ ডেকে যাও। তোমার একটুও বাঁধে না? ”

কিছু সময়ের জন্য কালকের ধমকের কথা ভুলে বসেছিল মুন। এই ক্ষণে মনে পড়ল। রাগটা ফিরে এলো। সে রাগ নিয়ে বলল,
” কিসের বউ? আমি আপনাকে বিয়েই করব না।”

সৈকত হতাশ শ্বাস ফেলে বলল, “তাহলে কী আর করার? আমিই নাহয় বিয়ে করে নিব। ”

মুন দিক বেদিক না ভেবে চড়াও হলো, “কাকে বিয়ে করবেন আপনি!”

অগ্নিদৃষ্টিতে চাইল মুন। সৈকত চাপা হাসিটা আর চাপা রইল না। মুনের রাগ দেখে শব্দসহযোগে বেরিয়ে এলো। হাসতে হাসতে বলল,
” আরে রেগে যাচ্ছো কেন? আমি তো তোমাকেই বিয়ে করার কথা ভাবছিলাম। কিন্তু তোমার এই ‘ভাইয়া’ সম্বোধনের জন্য ভাবনা বাদ দিতে হলো। যে ভাইয়া ডাকে তাকে বোন বানানো যায়, বউ বানানো যায় না। আমি তাকেই বিয়ে করব, যে আমায় ভাইয়া ডাকবে না। এখন তুমি যদি আমায় ‘ভাইয়া’ না ডাকার কথা দাও, তবে তোমাকে বিয়ে করার কথা ভেবে দেখব।”

মুন হাঁটা ধরল। সৈকত গিয়ে ওর পথ ঘিরে দাঁড়াল। মুন চোখে রাগ মিশিয়ে বলল,
“কী চাই?”

সৈকত কুটিল হাসল, “যা চাইব, তা দিবে?”
মুনের বিষম খাওয়ার জোগাড়। ওই ছেলে যা লাগামহীন, নিশ্চিত ভয়ংকর কিছু চেয়ে বসবে। কোন জড়তা নেই তার। মুখে যা আসবে বলে ফেলবে। মুন ওকে সুযোগই দিল না। রাগ নিয়ে বলল,
” ইম্পসিবল। ”

ওর ভঙ্গি দেখে সৈকতের হাসির পারত বাড়ল। অবাক হয়ে বলল, ” তোমার কথার টোন তো অন্যদিকে ইঙ্গিত দিচ্ছে। আমি তো এখনো কিছুই চাইনি। তুমি কী ভেবে অসম্ভব বললে? বলো!”

নিজে কথায় জড়িয়ে আবার নিজেই মজা নিচ্ছে। সে যা ভেবেছে তা বলা যাবে না। অসম্ভব। মুন বিব্রত পায়ে হাঁটা ধরল। সোজা বাড়ি যাবার মনস্থির তার। কয়েক পা আগাবার পর আকস্মিক হাত টেনে ধরল সৈকত। মুন থেকে গেল ওখানেই। প্রেমিকের প্রথম স্পর্শে শিহরিত হলো। চমকে তাকাল। সৈকত শান্ত ভঙ্গিতে রাস্তা পার হওয়ার প্রস্তুতি নিল। মুন বাস্তবে ফিরল। ওর মনে পড়ল সৈকত এসে থেকে হাসিঠাট্টা করছে। একটাবারও কালকের জন্য স্যরি বলে নি। স্যরি না বলা অবধি সে মানবে না। মুন হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল,
” ছাড়ুন, আমি বাসায় যাব।”

রাস্তায় অসংখ্য গাড়ি পারাপার হচ্ছে। সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে না। নিজে হলে দৌড় দিয়ে পার হওয়া যেতে। পাশে প্রিয়তমা থাকায় কোন প্রকার রিস্ক নিল না সৈকত। একটু অপেক্ষায় করল। হাত ছাড়ল না, বরং শক্ত করে ধরল আরও। শান্ত স্বরে বলল,
“আমার সাথে লাঞ্চ করে, তারপর যাবে।”

মুন তবুও হাত ছাড়ার চেষ্টা করল। যার অর্থ সে যাবে না। সৈকত চাপা শ্বাস ফেলল। রাস্তা একটু পাঁকা হতেই মুনকে টেনে নিয়ে রাস্তা পার হলো। অপজিটেই একটা রেস্টুরেন্ট। রেস্টুরেন্টে ঢুকল হাতটা ধরেই। লিফটের কাছে আসতেই মুন বলল,
“আমি বাসায় যাব।”

লিফট বাটন চেপে সৈকত ক্লান্ত স্বরে বলল, ” সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। পড়ার চাপে সময় হয়নি। একটু সময় বের করে বেরিয়েছি, তোমার সাথে লাঞ্চ করব বলে। এভাবে ফিরিয়ে দিবে?”

সৈকতের উপোষ পেটের গল্পে কাজ হলো। মুন শান্ত হলো। নিশ্চুপ লিফটে ঢুকল। সৈকত থেকে দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়াল, অন্যদিকে চেয়ে।

সৌভাগ্যক্রমে লিফট ফাঁকা। সৈকত ওর অপজিটে দাঁড়িয়ে ছিল, ওর দিকে চেয়ে। বোধ হলো, মুনকে কাল ওভাবে ধমকানো ঠিক হয়নি। এ যাবতকালে রুবাবকে কখনো দেখেনি মুনের সাথে উঁচু গলায় কথা বলতে। বড্ডো আদরের বোন তার। ভাই হয়ে এত বছরে রুবাব উঁচু বাক্য করেনি, সেখানে দু’দিন হয়নি মুনের জীবনে এসে, এর মাঝে সে ধমকও দিয়ে দিয়েছে। ব্যাপারটা ঠিক হয়নি। সৈকত গম্ভীর হলো। হলো কোমলও। মুনের দিকে তাকিয়েই কোমল গলায় ডাকল,
“চন্দ্রকথা?”

এমন হৃদয়ছোঁয়া ডাকের পর মুনের ভাবনা থেমে গেল। চোখ তুলে চাইল। সৈকত ওর পাশে এসে দাঁড়াল। একবারে পাশেকাছে। ওর চোখে চোখ রেখে প্রগাঢ় প্রেম নিয়ে বলল, “ভালোবাসি ।”

শেষ.. মুনের রাগ অভিমান ভাবনা সব শেষ। ভাবনারা থেমে গেছে। থেমে গেছে ওর নিঃশ্বাস ও। শ্বাস আটকে গেছে স্তব্ধতায়। হৃদপিণ্ড কেঁপে গলায় উঠে এসেছে যেন। একদিনের রাগ একটা শব্দে জলাঞ্জলি দিয়েছে। মুন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আছে। পলক অবধি ফেলতে ভুলে গেছে। কানে বাজল কথাটা। চারদিকে হুশ নেই। লিফট খুলে গেছে। সৈকত পাশ থেকে ওকে যেতে বলছে, অথচ ওর কানেই যাচ্ছে না। এক প্রকাণ্ড ভালো লাগা ওকে ঘিরে আছে। চেহারায় বিস্ময়ের পাশাপাশি ঠায় নিয়েছে সুখের লেশ। ঠোঁটের কোণে হাসি, গাল ভরা লজ্জা। সেই ক্ষণে সৈকত এগিয়ে এলো। কোমল সুরে বলল,
“কালকের জন্য স্যরি। তুমি প্লিজ আর ও সম্বোধন করো না! সম্পর্ক বদলেছে। এখন সম্বোধন ও বদলাও। ”

_____________________

রেস্টুরেন্টে মুখোমুখি বসা মুন-সৈকত। মুন মনোযোগ দিয়ে মেন্যু কার্ড দেখছে। মূলত লজ্জা নিবারণের চেষ্টা। তখনকার ব্যাপারটা নিয়ে এখনো লজ্জা পাচ্ছে। সৈকত সম্মুখের সিঙ্গেল সোফায় আয়েশ করে বসা, দেখছিল ওকেই। সোফায় গা লাগতেই রাজ্যের ক্লান্তি এসে ভর করল সৈকতের মাঝে। পিঠ ব্যাথা উপলব্ধি করল। বিশ্রামহীন দিনের ক্লান্তি সারাশরীরে। এমন আরাম করে বসা হয়নি অনেক সময়। ঠিকমতো ঘুমানো হয়নি। মাথা ব্যাথা করছে ভীষণ। এক প্রকার নিজের সাথে লড়াই করেই এখান অবধি এসেছে। ভেতরটা যেন আর সায় দিচ্ছে না। একটু আরাম চাইছে, চাইছে ঘুম। রিটেন শেষ হওয়া অবধি মিলবে না আরাম। কাল আবার পরীক্ষা আছে, এখান থেকে যেয়ে আবার পড়তে বসতে হবে। ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল সৈকত। চোখ বন্ধ করে মাথাটা হেলিয়ে দিল সোফায়।

মেন্যু থেকে চোখ সরিয়ে সৈকতের দিকে তাকাতেই সৈকতের চেহারায় ভেসে ওঠা ক্লান্তিবোধ চোখে পড়ল। এবারও ভীষণ মায়া হলো। সে শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“রাতে ঘুমাননি?”

মুনের কথা শুনে নড়ে ওঠল সৈকত। চোখ মেলে সোজা হয়ে বসল। মুখে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
” সময় কোথায়?”

মুন অবাক হলো, ” কাল পরীক্ষা দিয়ে কত ক্লান্ত ছিলেন। একটু বিশ্রাম তো দরকার। একটুখানি সময়ের জন্য ঘুমিয়ে নিতেন। ”
থেমে প্রশ্ন করল, “শেষ কবে ঘুমিয়েছেন?”

সৈকত ঘাড়ে হাত বুলাল,” মনে পড়ছে না। দুই তিনদিন হবে বোধহয়। ”

মুনের চোয়ালে চিন্তার আভা। কেমন উদ্ধিগ্ন হয়ে বলল, ” একটু বিশ্রামও নিবেন না? এমন করলে তো অসুস্থ হয়ে যাবেন। ”

ওর ওমন চিন্তা দেখে সৈকত হাসল। মুন অবাক, এত পরিশ্রমের পরও হাসি বেরুচ্ছে! সে হলে তো বোধহয় পাগলই হয়ে যেত। সবসময় শুনে এসেছে বিসিএস এ প্রচুর চাপ। কিন্তু সেভাবে গ্রাহ্য করেনি। এখন সৈকতকে দেখে বিশ্বাস হচ্ছে। কী পরিমাণ শ্রম দিচ্ছে পড়ার পেছনে! এমন করে মানুষ বিসিএস ক্যাডার হয়!

মুনের ভাবনার মাঝে সৈকত ভ্রু নাড়িয়ে বলল, ” এত কষ্ট সব তোমার জন্য। ”

মুনের বিস্ময় নিয়ে বলল, “আমার জন্য! ”

সৈকত অকপটে বলল, “নয়তো কী? তোমাকে বিয়ে করার জন্যই আমাকে এত কষ্ট করতে হচ্ছে। একবার বিয়েটা হতে দাও, তারপর সব কষ্টের শোধ নিব। ”

সৈকতের চোখে রাগ নেই। কোমলতা আছে। তবুও মুন আতঙ্কিত হলো,
“আপনি আমাকে কষ্ট দিবেন?”

সৈকত স্মিত হাসিতে বলল, “শোধ কষ্টে নয়, ভালোবাসায় নিব। ”

মুন লজ্জা পেল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“এখানে না এসে রেস্ট নিতে পারতেন।”
” আমার মনে হয়েছিল, ঘুম থেকে চন্দ্রকথার রাগ ভাঙানোটা বেশি জুরুরি। রেস্ট থেকে চন্দ্রকথা আমাকে মনোবল বেশি দিতে পারবে। মনের শান্তি দিতে পারবে। ”

সৈকতের কথা চমৎকার। প্রতিটি কথা প্রেম মাখানো। মুন মুগ্ধ হয়। অনুভব করে। প্রতিটা কথায় নিজের প্রতি ভালোবাসা অনুভব করে। পড়ার প্রেশারে একটুখানি জিরানোর জো নেই, অথচ তার জন্য সময় বের করে দেখা করতে এসেছে। মানুষটা এত কেন ভালোবাসে ওকে!

মুন নিজ উদ্যোগে খাবার অর্ডার দিল। খেয়ে যাবার কাছে অনুরোধের সুরে বলল, “এখান থেকে যেয়ে এক ঘন্টা হলেও ঘুমিয়ে নিবেন, প্লিজ!”

মুনের মুখে মন খারাপের আভা। চোখ টলমল। সৈকতের চিন্তায় অস্থির সে। সৈকত প্রাণবন্ত হেসে বলল, ” আমি ঠিক আছি। চিন্তা করো না।”

মুন গরম গলায় বলল, “কী ঠিক আছেন? আয়নায় নিজের চেহারা দেখেছেন! কেমন বিধ্বস্ত লাগছে। আমার সাথে আর দেখা করতে আসতে হবে না। আমি কিছু মনে করব না। প্লিজ নিজের খেয়াল রাখুন। আপনাকে এভাবে দেখতে ভালো লাগে না আমার।”

মুনের স্বর চঞ্চল হলো। আদর্শ প্রেমিকার মতো সঙ্গ দিচ্ছে প্রেমিকের। শাসন করছে। সৈকত মুগ্ধতায় কিছু বলতে পারছে না। কেবল হাসছে। মুন একটু দ্বিধা করল। তারপর সাহস করে সৈকতের হাত ধরল। কোমল গলায় বলল,
” আমার জন্য এত প্রেশার নিবেন না। আমি আপনাকে ছেড়ে যাব না। বিসিএস না হলেও পাশে থাকব। একটু নিজের খেয়াল রাখুন, আমার জন্য?”

ওরা তখন লিফটে। সৌভাগ্যক্রমে আজ আসা যাওয়া দুই পথেই লিফট ফাঁকা। ওরাই কেবল। মুনের কথায় সৈকতের মনে প্রশান্তির জোরাল বাতাস বয়ে গেল। এত শান্তি শেষ কবে লেগেছে জানা নেই। সুখ প্রশান্তিতে মনটা ভরে গেল। দুজনার মাঝে কিছুটা দূরত্ব ছিল। আবেশে সৈকত মুনকে টেনে কাছে নিল। কপালে অধর পরশ দিয়ে ফের বলল,
” আমার আর কিছু চাই না। শুধু এভাবেই তোমাকে পাশে চাই, সারাকাল।”

চলবে……

#অলীকডোরে চন্দ্রকথা। (পর্ব- ২১)
#আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা।

আলোকোজ্জ্বল প্রভাতে রিক্সা চলছে ভার্সিটির দিকে। পথের বাঁকে বড্ড আশা নিয়ে চেয়ে আছে মুন। ওইতো দূরে বিল্ডিংটা দেখা যাচ্ছে। ওখানেই থাকে সৈকত। কী করছে এখন? পড়ছে নিশ্চয়ই। কাল তো আবার পরীক্ষা। চাপা শ্বাস ফেলল মুন। সৈকতদের বাসার রাস্তা হয়ে যাবার সময় হুট করেই মনটা উতলা হলো, সৈকতকে দেখার জন্য। কয়েকদিন দেখা হয়নি। মুনের ভার্সিটির গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস থাকায় কেন্দ্রে যেতে পারেনি। রুবাব পরীক্ষা দিয়ে শেখ বাড়িতে উঠেছিল বলে তার দেখা পেয়েছে, কিন্তু সৈকত সোজা ফিরেছে ব্যাচেলর বাসাটায়। চার বন্ধুর মাঝে সবচেয়ে বেশি পড়ায় শ্রম দিচ্ছে সৈকত। তারপর নাহিদ। এরা দুজন নাওয়া খাওয়া ভুলে পড়ছে। বাকি দুজন ও জোরদার প্রস্তুতি নিচ্ছে, তবে কিঞ্চিৎ ঢিলেমো আছেই। রুবাব অন্তর ঠিকমতো খাচ্ছে দাচ্ছে। রাতে এক আধটু ঘুমিয়েও নিচ্ছে। রুবাব তো সময় করে বাড়ি ঘুরে আসছে, সেঁজুতির সাথে বেরুচ্ছে। কিন্তু সৈকত এক ঘরে একবারে। সেদিনের পর আর দেখা ও করেনি ওর সাথে। আলাপ বলতে দুই একবার ম্যাসেজে কথা হয়েছে। মানুষটার জন্য বড্ড চিন্তা হয় মুনের। একটুও নিজের খেয়াল রাখেনা। কী অবস্থা এখন কে জানে? মুন একবার ভাবল, কল দিয়ে বাসার নিচে আসতে বলবে। পরক্ষণেই ভাবল, পড়ায় ব্যাঘাত ঘটে যদি! আবার ভাবল, বাসায় গিয়ে দেখে আসবে। সেই ভাবনাও বাদ দিল, যখন মনে পড়ল ভাই ও আছে ও বাসায়। প্রেমিকের জন্য মন উতলা হলো। হতাশ হলো দেখা না পাবার খবরে। মলিন শ্বাস ফেলল মুন। রিক্সা রুবাবদের বাসার কাছ দিয়ে পেরুবার সময় কী ভীষণ করুণ চোখে তাকিয়ে রইল মুন! তাকে দেখার ইচ্ছে হলে সৈকত হুটহাট গিয়ে সামনে হাজির হতে পারে, সে পারে না কেন?

রিক্সা একটু একটু করে পেরিয়ে গেল সে পথ। পথের সাথে বাড়ল দুঃখের লহর। মুন মন খারাপ করে বসে রইল। কিছুদূর যাবার পরেই আকস্মিক চেঁচিয়ে উঠল,
“মামা, মামা? থামুন! আমি নামব।”

রিক্সাচালক হকচকিয়ে গেল। মুন তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চোখের পলকে নেমে গেল। ভাড়া মিটিয়ে উলটো পথে দৌড় দিল। হতবাক চোখে চেয়ে রইল রিক্সাচালক।

এক দৌড়ে সৈকতদের বিল্ডিংয়ের নিচে এসে থামল মুন। মনের কাছে পরাস্থ সে। সৈকতের জন্য মনটা অস্থির লাগছে। বারবার চোখে ভাসছে সেদিন রেস্টুরেন্টে সোফায় মাথা হেলিয়ে দেয়া ক্লান্ত মুখটা। সেই মুখের এখন কী হাল তা দেখতে ইচ্ছে হলো। মন এত উত্তাল হলো যে না দেখলে দমবন্ধ হয়ে যাবে। প্রেমের শুরুর দিকে অনুভূতি ওমন মাতাল মাতাল হয় কি না!

একতলা বেয়ে উঠবার পর আকস্মিক খেয়াল হলো, রুবাব যদি জিজ্ঞেস করে কেন এসেছে, তবে কী উত্তর দিবে? ভাইয়ের জবাবদিহিতার ভয়ে থেমে গেল। ভাবনায় মত্ত হলো। তারপর আবার যেভাবে এসেছে সেভাবে ফিরে গেল।

___________________

পড়ার টেবিলে বসা ছিল অন্তর। আকস্মিক কলিংবেলের শব্দ কানে ধাক্কা খেতেই বিরক্তির আভা খেলে গেল মুখে। এই সকাল সকাল কে এসেছে?কিছুটা বিরক্ত হয়েই দরজা খুলল অন্তর। সামনে দাঁড়ানো মানুষটাকে দেখে কপালের বিরক্তির ভাঁজ মিলিয়ে গেল। চোখ মুখে স্নেহের আভা দেখা গেল। প্রসন্ন হেসে বলল,
” হ্যালো পিচ্চি! ”
মুন একটু হেসে বলল, “হাই ভাইয়া!”

অন্তর কুশল বিনিময় করল। মুন বলল, “ভাইয়া নেই বাসায়?”
অন্তর চাপা হেসে বলল, “আছে। তবে আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, আজ পিচ্চি তার ভাইয়ের সাথে দেখা করতে আসেনি।”

কথার ইঙ্গিত ধরতে পেরে মুন লাজুক হেসে বলল, “নাহ, আপনাদের জন্য খাবার নিয়ে এসেছিলাম।”

তবুও মুনের সুপ্ত মনের ভাব বুঝতে অসুবিধা হলো না অন্তরের। সে বিজয়ী হাসল। তারপর আফসোসের সুরে বলল,
” বুঝলে মুন, কদিন ধরে আমি অনেকবার নিজে নিজে প্র‍্যাকটিস করছিলাম, ‘মুন ভাবি’ মুখে আনার । কিন্তু আসছে না। পারলাম না তোমাকে ভাবি ডাকতে। সো স্যরি! ”

মুন আড়ষ্ট হয়ে ছোটো করে বলল, ” ভাবি ডাকা লাগবে না।”

অন্তর যেন স্বস্তি পেল এমন ভান করে বলল,
“আচ্ছা, ভাবি টাবি বাদ। তুমি বরং আমার পিচ্চি বোন হয়েই থাকো।”

অন্তরের স্নেহসম্বোধনে মুন প্রসন্ন হাসল। সায় জানিয়ে বলল, “ঠিক আছে ভাইয়া। ”

অন্তর দরজা ছেড়ে বলল, “বাসায় আসো।”

মুন ওখানে দাঁড়িয়েই আমতা-আমতা করে বলল,
“উনি নেই?”

অন্তর মজা পেল। হেসে বলল, “দুলাভাই বাসায় আছে।”

মুন বুঝল না, “কার কথা বলছেন?”

অন্তর সরল গলায় বলল, ” আমি সর্বদা কনেপক্ষ। তুমি আমার বোন হলে সৈকত আমার দুলাভাই হবে না? ”

থেমে বলল, “দাঁড়ান আপা, দুলাভাইকে ডেকে দিচ্ছি।”

অন্তর ‘দুলাভাই’ দুলাভাই’ ডাকতে ভেতরে চলে গেল। মুন অবাক হয়ে চেয়ে রইল। তারপর হেসে ফেলল।

অন্তর ফিরেও এলো খানিক বাদে। হতাশ স্বরে বলল,
“সৈকতের রুমের দরজা লক। বেচারা সারারাত পড়ে সবে একটু শুয়েছে বোধহয়। ”

মুনের চোখে মুখে খুশির ঝলক দেখা গেল। উৎফুল্ল হয়ে বলল, ” ঘুমোচ্ছে!”

অন্তর সৈকতের ঘরের দিকে তাকিয়ে বলল, “ডাকলাম সাড়া দিচ্ছে না। বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। ওয়েট, আমি আবার ডাকছি।”

মুন তড়িৎ বলল, ” না, না! ডাকবেন না। ঘুমাক।”

মুনকে প্রাণবন্ত দেখাচ্ছে। তাকে ভীষণ খুশি দেখাচ্ছে। অন্তর অবাকই হলো। সে ভেবেছিল সৈকতকে না পেয়ে মুন হতাশ হবে। অথচ সৈকত ঘুমাচ্ছে শুনে মেয়েটা খুশি হয়ে গেছে ! কেন? অন্তর সন্দিহান হয়ে বলল,
” তুমি কি সৈকতের সাথে দেখা করতে চাইছো না?”

মুন উত্তর দেবার আগে রুবাব এসে হাজির হলো। রুবাব অবাক হলো হুট করে ওকে দেখে। বিস্ময় নিয়ে বলল,
“তুই হঠাৎ! ”
মুন খাবারের প্যাকেট তুলে দিয়ে বলল, ” সকালে ব্রেকফাস্ট করে আসিনি। বেরিয়ে ব্রেকফাস্ট করতে বসে তোমার কথা মনে পড়ল। তাই খাবার নিয়ে এলাম।”

রুবাব সন্দিহান চোখে তাকাল। বোনের কথা যে সে বিশ্বাস করেনি তা স্পষ্ট। তবুও অগ্রাহ্য করে বলল,
“ভেতরে আয়!”

মুন ভেতরে ঢুকল। ভাইকে খাবার পরিবেশন করে খাওয়ালো। সৈকতের ঘরে নাহিদ ছিল। দরজা মেলে সে বেরিয়ে এলো। খোলা দরজায় দৃশ্যমান হলো, ভেতরে ফ্লোরিং বেডে শোয়া ঘুমন্ত সৈকতকে। মুন স্থির চোখ কিছুক্ষণ চেয়ে রইল ওর মুখ পানে। এই কটাদিনে একবারে শুকিয়ে গেছে সৈকত। চোখের নিচে কালি পড়েছে। ভীষণ রুগ্ন লাগছে। দেখেই বুক কাঁপল মুনের। কান্না পেল যেন। চোখ সরাল সে। খেয়ে উঠে রুবাব বলল,
“যাবার সময় ডাকিস।”

মুন চাপা শ্বাস ফেলে বলল, ” এখনই উঠছি।”

রুবাব চোখ তুলে তাকাল। নাহিদ অন্তরের চোখে বিস্ময়। সৈকতের সাথে দেখা না করেই চলে যাবে! রুবাব আগে আগে দরজার কাছে গেল। নাহিদ ধীরে বলল,
“এসেছো যখন সৈকতের সাথে দেখা করে যাও!”

“না, থাক। উনি ঘুমাক।” আরেকবার চাইল ঘুমন্ত সৈকতকে। তারপর ত্রস্ত পায়ে বেরিয়ে গেল।

_________________

এলার্মের শব্দে চোখ থেকে ঘুম ছাড়ল সৈকতের। ঘন্টা দেড়েকের ন্যাপ নিতে এলার্ম দিয়ে শুয়েছিল। শরীরটা আর চলছিল না বলেই ঘুমটা দেয়া। ক্লান্তির বহরে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই চোখে ঘুম নেমেছে।
কানের কাছে এলার্ম বাজতেই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল। ওর মস্তিষ্ক স্মরণ করিয়ে দিল, কাল পরীক্ষা, পড়তে হবে। অন্তর টেবিলে বসে ওকে জাগতে দেখল। ঠাট্টার স্বরে বলল,
“দুলাভাই, চাঁদ সূর্য তোমার দুয়ারে আইস্যা হাজির, আর তুমি ঘুমাও ! সব তো মিস করে ফেললা।”

ঘুমজড়ানো মনে কিছু বুঝল না সৈকত। আকস্মিক বন্ধুকে ‘দুলাভাই’ ডাকতে শুনে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকাল। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে ভ্রু কুঁচকে চাইল, “কী আবোলতাবোল বকতেছস?

অন্তর হেসে বলল, ” আবোলতাবোল না। আপা আইছিল। আমরা কথাবার্তা বলে দেবর ভাবির অপশন বাদ দিয়ে ভাই-বোন অপশন বাইছ্যা নিছি। সো, আজ থেকে তুমি আমার দুলাভাই।”

শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে। শাওয়ার নিয়ে রিল্যাক্স লাগছে। ভালোভাবে পড়তে পারবে। এই ভেবে শাওয়ার নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল সৈকত। কাধে টাওয়াল নিয়ে পা বাড়িয়েছিল, অন্তরের কথায় থেমে গেল। তড়িৎ পেছন ফিরে অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে বলল,
“চ…মানে মুন এসেছিল?”

ওর উদ্বিগ্নতা দেখে অন্তর হাসল। সায় জানাল, “একটু আগেই বের হলো।”

সৈকত রাগ নিয়ে বলল, “আমারে জাগাসনাই ক্যান!”

“ডাকতে চাইছি, মুন দেয়নাই। কিচ্ছু বুঝলাম না। ও আইল,তোরে খুঁজল, বললাম তুই ঘুমাইতাছস। তোর ঘুমের কতা শুনে এত খুশি হইল! আমি নাহিদ দুজনেই তোকে জাগাতে চাইলে , ও নিষেধ করল। দেখা না করেই চলে গেল। অথচ আমার মনে হইছিল, মুন তোর লগে দেখা করার জন্যই আসছিল এখানে। বুঝলাম না, তোর ঘুমের কথা শুনে এত খুশি হইল ক্যান? ”

সৈকত মনোযোগ দিয়ে শুনল। নিশ্চুপ রইল এক পল। কেউ ধরতে না পারলেও সৈকত ঠিকই ধরে ফেলল মুনের খুশির কারণ। বুঝতেই ওর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল। স্মিত হেসে গেল। একটা অভিযোগ ও করল না। নাহিদ এসে সন্দিহান হয়ে বলল, “তোদের ঝগড়া মিটেনি? পিচ্চি তোরে ইগনোর করতে চাইতেছিল না কি!”

সৈকত প্রসন্ন হেসে বলল, “নো। শী ওয়াজ টেকিং কেয়ার অফ মি।”

দেখা কর‍তে না চাওয়া কেমন যত্ন? বুঝল না ওরা। সৈকত বাথরুমের দিকে হাঁটা ধরল। অন্তর পিছু ডাকল, ” একটা ফোন তো দিবি না কি!”

সৈকত হাঁটতে হাঁটতে বলল, ” এখন ফোন দিলে মন খারাপ করবে। ”

সৈকত ওয়াশরুমে ডুকল। নাহিদ অন্তর হতবুদ্ধি হয়ে চেয়ে রইল। সবটা ওদের মাথার উপর দিয়ে গেল। একজন এসে দেখা না করে চলে গেল। অন্যজন শুনে ও নির্বিকার। বলে কিনা এখন ফোন দিলে মন খারাপ করবে। এ কেমন কথা!

ঘটনা বুঝা গেল অনেকসময় বাদে। সৈকত শাওয়ার নিয়ে ফিরেও কল দিল না মুনকে। ফোন ছুঁয়ে ও দেখল না। স্নিগ্ধ মনে পড়তে বসল। একটানা অনেকক্ষণ পড়ল। তারপর ক্লান্তির শ্বাস ফেলে ফোন হাতে নিল। তখন সকাল গড়িয়ে দুপুরে পড়েছে।

ফোন বাজতেই রিসিভ হয়ে গেল। যেন ওর ফোনের অপেক্ষাতেই ছিল মুন। ধরেই উদ্বিগ্ন স্বরে বলল,
“উঠে গেছেন! সবেই তো ঘুমালেন! এত তাড়াতাড়ি উঠলেন কেন?”

ওর চিন্তিত স্বর শুনে সৈকতের মন প্রাণ ভরে গেল। সে সজীব হাসল। মুনের কথা হাওয়ায় মাড়িয়ে বলল,
“এসে দেখা না করে গেলে কেন?”

মুন রাগ নিয়ে বলল, “এটা আমার কথার উত্তর নয়।”

সৈকত গলা নরম হলো, “সকাল গড়িয়ে দুপুর, আর কত ঘুমাব?”
“সবে তিন ঘন্টা হয়েছে। আপনার প্রোপার ঘুমের দরকার। মিনিমাম পাঁচ ঘন্টা। এমন করেই তো এ হাল করেছেন। ” মুনের স্বরটা বেশ মলিন।

সৈকত চাপা শ্বাস ফেলল, তিনঘণ্টার কথায় এমন করছে, যদি শুনে সে যাবার পরপরই সৈকত উঠে গেছে তখন কী করবে! ভাগ্যিস বুদ্ধি করে দেরিতে ফোন দিয়েছে। সৈকত হেসে বলল,
” তুমি একটু বেশি চিন্তা করছো। আমি ঠিক আছি।”

“কেমন অসুস্থ দেখাচ্ছিল আপনাকে। ” মুন পারলে কেঁদে দিবে এমন ভাব। মুনের কোমলতা দেখে সৈকত মুগ্ধ। মেয়েটা এত কোমলমতী! সে কৌতুক করে বলল,
“তোমার ভাই শর্ত মানতে হলে, এক আধটু চাপ তো নিতেই হবে। এখানে আমার দোষ নেই।”

ভাইয়ের কথায় মলিনতা ভুলে তেঁতে উঠল মুন, “একদম ভাইয়ার দোষ দিবেন না! আপনি ভাইয়ার কথার বালাই করেছেন? ভাইয়ার কথায় আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করেছেন? করেননি, উলটো আমার সাথে প্রেম করছেন। এখন এমনভাবে বলছেন যেন ভাইয়ার কথা সব অক্ষরে অক্ষরে মেনেছেন।”

মুনের কথায় সৈকত ওট্টোহাসি দিল। হো হো করে হেসে গেল অনেকক্ষণ। ওর হাসির শব্দে নাহিদ ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল। রুবাব আর অন্তর পড়া বন্ধ করে বিস্ময় নিয়ে চাইল।

সৈকতের সেদিকে খেয়াল নেই। সে হেসেই যাচ্ছে। ওর হাসি শুনে মুন বিরক্তি নিয়ে বলল,
“একদম হাসবেন না! আমার রাগ হচ্ছে। স্ট্রেস নিতে নিতে ছ্যাঁকাখোর বাপ্পারাজের মতো চেহারা বানানোর পর ও হাসি আসছে কিভাবে আপনার?”

সৈকতের হাসি কমার বদলে বেড়ে গেল। ওকে দেখতে না কি বাপ্পারাজের মতো লাগছে। কী হাস্যকর কথা! হাসির জন্য কথা বলতে পারছে না সৈকত। হাসতে হাসতে সৈকতের চোখে পানি চলে আসার জোগাড়। ওদিকে ওর হেয়ালিতে মুন রেগে আগুন। এই বিশ্রামের জন্য ও দেখা অবধি করেনি, এই যে এখন একসাথে কোথাও বসতে ইচ্ছে করছে সেই আবদার ও করেনি। অথচ যার জন্য এসব সেই উদাসীন।

সৈকত প্রাণবন্ত স্বরে আশ্বস্ত করল, ” তুমি একটু বেশিই চিন্তা করছো। না ঘুমিয়ে থাকার অভ্যাস আছে আমার। অনিদ্রায় অসুস্থ হবো না। যতটুকু ঘুমিয়েছি, তাতেই এনাফ। আর একদিনেরই তো ব্যাপার। কাল পরীক্ষা শেষ হলে টানা এক সপ্তাহ ঘুমাব। ঘুম ভাঙলে দেখবে আমি বাপ্পারাজ থেকে সাকিব খান হয়ে গেছি।”

চারপাশের খেয়াল নেই সৈকতের। কথার টোনটা একটু জোরেই হয়ে গেল। বাসায় থাকা তিন বন্ধুর কানে গেল কথাটা। রুবাব বিশেষ একটা অবাক হলো না। তার বোনটার মাঝে মা মা একটা ভাব আছে। সবাইকে শাসন করবে। খাওয়া ঘুম নিয়ে দিন তিনবার ফোন দিয়ে তাকেও সাবধান করে। বাড়িতে মেডিসিন নিতে দেরি হলে বাবা মাকে ও শাসন করে। মেয়েটা তার জীবনে থাকা আপন মানুষ সবারই ভীষণভাবে খেয়াল রাখে। অল্পতেই মানুষকে ভীষণ আপন করে নেয়। আগলে নেয়, খেয়াল রাখে। মুনের স্বভাবই এমন। রুবাব একবার সৈকতের পানে চেয়ে আবার পড়ায় মন দিল।

ও নির্বিকার থাকলে ও অন্তর রইল না। সে ওঠে এগিয়ে গেল নাহিদের কাছে। নাহিদ অন্তরের প্রশ্নরা এতক্ষণে উত্তর পেল। তারা স্পষ্ট বুঝল, সৈকতের সুস্থতার কথা ভেবেই মুন ঘুমের জন্য খুশি হয়েছে। অন্তত স্থির চোখ বন্ধুকে দেখল। সৈকত এখন উঠে খাবার ঘরের দিকে পা বাড়িয়েছে। এতক্ষণ খায়নি। বোধহয় এর জন্য ও বকা পড়েছে। নাহিদ ধীর স্বরে বলল,
” অনেক সাধনার পর বেচারার ভাগ্যে জুটল তবে চন্দ্রকথার ভালোবাসা! এত সাধনা সার্থক হইছে।”

অন্তর সে কথা গ্রাহ্য করল না। আফসোসের সুরে বলল, ” এতক্ষণে বুঝলাম, আমার বিসিএস প্রিপারেশন ভালো হচ্ছে না কেন? আমার ঘুম, খাওয়ার চিন্তা করার মতো বন্ধুর বোন যে নেই আমার জীবনে। ”

থেমে নাহিদের দিকে তাকাল। ঝলমলে মুখে বলল, ” এ্যাই তোর একটা বোন আছে না? ”

নাহিদ চোখ গরম করে বলল, ” আমার বোনের দিকে নজর দিলে লা থি মে রে চান্দে থেইক্যা পাঠাইয়্যা দিমু। ”

ওর হুমকিতে ভাবান্তর হলো না অন্তরের। ভয় তো পেল না, উলটো কাছে এসে মানানোর ভঙিতে নরম স্বরে বলল,
“এমন করিস কেন? দুলাভাই কইরা নে আমায়।রুবাবের মতো তুই ও আমাকে তোর বোনের জন্য পছন্দ করে ফেল। লা থি মা র লে আমার লগে তোর বোন রে ও মা রিস। চান্দের জার্নি ইনজয়বেল হবে। তার আগে কলার টলার ধরলেও ধরতে পারিস, আমি কিছু মনে করব না। কিন্তু শেষে তুই শর্ত দিবি, বিসিএস ছাড়া বোন পাবি না। এক হাতে বিসিএস সার্টিফিকেট, অন্য হাতে বোনের হাত। আমি ও জেদ ধরে এমন না ঘুমিয়ে পড়ব। তারপর তোর বোন আমার ঘুমের চিন্তায় অস্থির হয়ে যাবে। দেখা করতে এসে আমি ঘুমাচ্ছি শুনলে খুশি হবে। তারপর জেদ ধরে আমি বিসিএস ক্যাডার হয়ে যাব। কী দারুণ হবে না? ”

নাহিদ বিরক্ত হয়ে ধমকাল, ” দূরে গিয়া রাস্তা মাপ।”

” বন্ধুর বোনের অভাবে জীবনটাই থাইমা আছে। রাস্তা টাস্তা মাপা হবে না। হয়ে যা না নাহিদ, বি মাই শা লা?” অন্তর হেসে হাত বাড়িয়ে প্রস্তাব দিল। ও ভীষণ সিরিয়াস। মুখে হাসি নেই। অথচ নাহিদ জানে এই ছেলের পেটে শয়তানি । হেয়ালি ছাড়া কিচ্ছু নাই।

______________________

আজ বিসিএস রিটেনের শেষ পরীক্ষা। পরীক্ষা চলছে এখন। চারদিকে নিরব নিস্তব্ধ। টিকটিক ঘড়ির কাটা এগুচ্ছে। সেই সাথে কমছে এতকাল ভীষণ চাপ নেয়া বিসিএস রিটেনের চিন্তা। গভীর মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা দিচ্ছে সৈকতরা।

কেন্দ্রের বাইরে কপালের চিন্তার ভাঁজ ফেলে অপেক্ষারত দুই রমনী। একজনের গায়ে শাড়ি। অন্যজনের গায়ে সেলোয়ার-কামিজ। দুজনের মাঝে চলছে গল্পালাপ। টুকটাক কথা বলছে, অথচ ওদের মনোযোগ হলের দিকে। কখন পরীক্ষা শেষ হবে, আর বেরিয়ে আসবে কাঙ্ক্ষিত মুখগুলো। তারা দেখতে পাবে, একটু সময় পাবে। দূর থেকে এদের দেখে যে কেউ বান্ধবী ভেবে বসবে। অথচ কাছে গেলে বুঝা যাবে এরা বান্ধবী নয়, বরং ননদ ভাবি। তাও হবু। দুজনার মাঝে সখ্যতা বেশ। আলাপচারিতার এক পর্যায়ে ননদ ভাবিকে জিজ্ঞেস করল,
” ভাইয়ার এক্সাম তো শেষ। এরপরের প্ল্যান কী?”

ভাবি উদাস হয়ে উত্তর দিল, ” জানি না, কপালে কী আছে।”
“ভাইয়া অলরেডি বাবা মাকে তোমার কথা বলে ফেলেছে। পরীক্ষা শেষ হবার অপেক্ষায় ছিল। পারলে আজই বিয়ে করে ফেলে। তোমাদের বাসায় আমন্ত্রণ করছো কবে?”

সেঁজুতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ” তোমার ভাইয়া একটা চাকরি বাকরি জুটানোর আগে সুযোগ দেখছি না। যেমন পরীক্ষা দিল, তাতে রিটেনে হবে কি না সন্দেহ। আর রিটেনের রেজাল্ট অবধি অপেক্ষাও করবে না ভাইয়া। বিয়ের প্রেশার দিবে।”

মুন ভাইয়ের ভালোবাসাকে অভয় দিল, ” রিটেনের রেজাল্টের আশা না ধরে চাকরি একটা জুটিয়ে নিবে এবার। বাবার রেফারেন্স আছে, হয়ে যাবে। চিন্তা করো না। ”

সেঁজুতি বলল, “তোমার কথা বলো। শুনলাম, নতুন মানুষের আগমন ঘটেছে জীবনে।”

মুন বিস্ময় নিয়ে বলল, “তোমাকে কে জানাল?”

সেঁজুতি চাপা হাসল। ননদকে বলল না, তোমার ভাই যখন সৈকতকে মানছিল না তখন তাকে মানানোর দায়িত্ব আমিই নিয়েছিলাম। কেবল বলল,
” গুজ চয়েজ, বাই দ্যা ওয়ে। চমৎকার মানুষ বেছে নিয়েছো।”

মুন বিজয়ী হাসল। ঘন্টা বাজল যেন ছুটির। দলে দলে শিক্ষার্থীরা বেরিয়ে এলো। শ লোকের ভীড়ে ওরা খুঁজছিল তাদের প্রিয় মুখ দুটোকে।

তখনি চার বন্ধুর হাস্যজ্বল মুখ চোখে পড়ল। কথা বলতে বলতে বেরুচ্ছে। খুব চটপটে আলাপ চলছে তাদের। পরীক্ষা সম্পর্কিত আলোচনা বোধহয়। কিছু একটা নিয়ে হাসি ঠাট্টা করছে। মুন দূর থেকে চেয়ে রইল তার মানুষটার দিকে। মানুষটার দিকে তাকালেই ওর মায়া লাগে। ওই রুগ্ন মুখটার দিকে তাকালে কান্না পায়। রুগ্ন মুখে হাসি দেখলে অবাক লাগে, সাথে প্রসন্নতাও। চিন্তা হয়, এই পরীক্ষায় নিজের যে হাল করেছে, এই হাল ঠিক হতে কতদিন লাগে। আবার না হুট করে অসুস্থ হয়ে পড়ে।

সৈকত কথা বলছিল বন্ধুদের সাথে। আকস্মিক প্রিয় একটা মুখ দেখে থমকে গেল। শাড়ি পরিহিতার রূপসীর রূপে বিমোহিত হয়ে গেল। হার্টবিট মিস হলো। মেরুণ আর সফেদা কালারের মিশ্রণের সুতি শাড়ি পরেছে মেয়েটা। চুলগুলো পণিটেইল বেঁধেছে। মুখে হালকা প্রসাধনীর ছোঁয়া। ঠোঁটের কোণে স্নিগ্ধ হাসি। গলায় আইডি কার্ড ভার্সিটি থেকে এসেছে তা স্পষ্ট । ভার্সিটির ফাংশন বা প্রেজেন্টেশন কিছু একটা ছিল বোধহয়। কী সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে! ঘোর লেগে যাচ্ছে সৈকতের। ওর চোখেমুখে মুগ্ধতা দেখা গেল। সেই সাথে বিস্ময়ও। মুনকে এখানে একদমই আশা করেনি সে। প্রথমদিন এসেছে সকালবেলা। ফিরতি পথে আসেনি কখনো। আজ এলো, কেন? তার জন্য?
দূর থেকে হাজার লোকের ভীড়ে দুটো মানুষের চোখাচোখি হলো। থমকে রইল দুজনই। ঠোঁটের চমৎকার হাসি লেগে আছে দুজনেরই। সৈকত কিভাবে চেয়ে আছে ওর দিকে, মুনের লজ্জা লাগছে। ওর পানে চেয়ে লাজুক হাসল। ওই হাসিটাই সৈকতকে বুঝিয়ে দিল যে, তার চন্দ্রকথা তার জন্যই এসেছে।

সৈকতের হঠাৎ রদবদল চোখে পড়ল বন্ধুদের। দৃষ্টি অনুসরণ করে চাইল ওদিকে। কিন্তু হাজার লোকের ভীড়ে কার দিকে তাকিয়ে আছে তা বুঝা গেল না। তখনই ওদিক থেকে কেউ একজন হাত নাড়িয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করল। সেদিকে তাকাতেই চোখে পড়ল সেঁজুতিকে। পরপরই তার পাশে দাঁড়ানো মুনকে। মুনের দৃষ্টি তখন অবশ্য এদিকে নেই। তবুও ওরা বুঝল। ওরা ধীর পায়ে এগিয়ে এলো। সেঁজুতি ভীষণ উৎফুল্ল হয়ে রুবাবকে জিজ্ঞেস করল,
“পরীক্ষা কেমন হলো? সব অ্যান্সার করেছো তো? না কি অলসতা করে রেখে এসেছো?”

বলে রুবাবের কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ওর প্রশ্ন দেখতে লাগল। রুবাব হাসল সেঁজুতির ভাব দেখে। বলল,
“এতই যখন আগ্রহ তবে নিজেও প্রস্তুতি নেয়া শুরু করো। তোমাকেও দেয়াব বিসিএস।”

সেঁজুতি হেয়ালি করে হাসল, “আগে নিজে তো
টিকে যাও। মনে রেখো, এই বিসিএস না হলে আমাকে পাচ্ছো না তুমি!”

রুবাব বোন আর সৈকতের সামনে কিছুটা বিব্রতবোধ করল। নতুন সম্পর্কের কারণে বোধহয়। সৈকত আনন্দিত স্বরে বলল,
“ভাবি আপনি এভাবেই অনড় থাকুন। আমি আছি আপনার সাথে। শা লা খুব জ্বালাচ্ছে আমায়।”

কথার ইঙ্গিত ধরতে পারল সবাই। মুখ চেপে হাসল। রুবাব ঝেড়ে কেশে বোনের উদ্দেশ্যে বলল,
“ভার্সিটি থেকে এসেছিস?”
“হ্যাঁ। মা বলেছে তোমাকে নিয়েই ফিরতে।”

রুবাব অনিহা প্রকাশ করে বলল, ” মাকে বলিস, কাল ফিরব। আজ বন্ধুরা মিলে ঘুরতে যাব।”

মুনের মাঝে মা মা ভাব ফিরে এলো এরপরেই, “একদম না। এতদিন পরীক্ষার জন্য বিশ্রাম নিতে পারোনি। আগামী দু’দিন সম্পূর্ণ বেডরেস্টে থাকবে। এসব চিল ফিলের কথা মাথায় ও আনবে না।”

ভাইকে বলে সৈকতের দিকে তাকাল। এরমানে কথাটা একজন নয় দুজনের জন্যই প্রযোজ্য। সৈকত স্মিত হাসল অন্যদিকে চেয়ে। মুনের সাথে তাল মেলাল সেঁজুতি। দুই নারীর কঠোর সাবধানী বাণীতে ঘুরাঘুরি পরিকল্পনা বাদ দিতে হলো। তবে লাঞ্চটা একসাথেই কথা হলো।

ওরা তখন রাস্তার দিকে হাঁটছিল। আজ গাড়ি নেই। গাড়ির অপেক্ষা না করে হাঁটা ধরেছে। বাকিরা আগে হাঁটছিল। সেঁজুতি আর মুন পেছনে আসছিল। আকস্মিক সৈকত হাঁটার গতি ধীর করল। বাকিরা এগিয়ে গেল। ও পিছনে রয়ে গেল। সেঁজুতিদের পাশ কাটার সময় মুনের হাত ধরে ফেলল। মুন ভাইয়ের দিকে ইশারা করে চোখ রাঙাল। সৈকত হেসে সেঁজুতির উদ্দেশ্যে বলল,
“ভাবি…

বাকিটা বলার আগে সেঁজুতি হেসে বলল, ” বুঝতে পেরেছি। রুবাবের কাছে যেতে হবে।”

কৃতজ্ঞ হাসল সৈকত। সেঁজুতি চলে গেল। মুন রাগ নিয়ে বলল,
“আপনার মাঝে ভয়ডর, সঙ্কোচ, লজ্জা কিচ্ছু নাই?”

সৈকত ব্যাকুল হয়ে বলল, “সব তোমার কাছে এসে ফিকে পড়ে।”

মুন চাইল ওর পানে। চোখ থেকে রাগ সরে গেল ওর। ধীরে জিজ্ঞেস করল,
“পরীক্ষা কেমন হয়েছে?”
“ভালো হয়েছে।”
“পরীক্ষা তো শেষ। এবার?”

“এক বি শেষ, এবার বাকি বি/ভি এর পালা।”

“কিসের পালা?” বুঝল না মুন। সৈকত দুষ্টু হেসে বলল,
” এবার ভাইভা, ভালোবাসা, বিয়ে, বাসরের পালা।’

মুনের কোমলতা লাজে রূপ নিল। ক্ষীণ স্বরে বলল, ” সারাক্ষণ এসবই ঘুরে আপনার মাথায়?”

“এভাবে শাড়ি পরে বউ সেজে সামনে এসে ঘোর লাগিয়ে দেয়ার পর এমন প্রশ্ন করা সাঁজে না সুন্দরী। ” গভীর স্বরে বলল সৈকত।

রাস্তার মাঝে অনেক মানুষ। পরীক্ষার্থীরা হুড়োহুড়ি করে বেরিয়ে হাঁটা ধরেছে সব। মানুষের ভীড়ে ওরা কাছাকাছি ঘেঁষে হাঁটছে। মুনের হাত ধরে রেখেছে সৈকত। মুন লাজুক হাসল। সেই হাসির পারত বাড়িয়ে প্রেমিক ভরা রাস্তায় কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“শাড়িতে ভীষণ সুন্দর লাগছে আমার চন্দ্রকথাকে। চোখের ঘোর লেগে যাচ্ছে। ”

চলবে……