অলীকডোরে চন্দ্রকথা পর্ব-২+৩+৪

0
227

#অলীকডোরে চন্দ্রকথা। (পর্ব-২)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

অনুভূতির আলোড়ন বুকে নিয়ে সিড়ি বেয়ে নামছে সৈকত। দৃষ্টি নিবদ্ধ সম্মুখে। ওই তো দেখা যাচ্ছে তার স্বপ্নবধূ চন্দ্রকথাকে। ব্যস্ত পায়ে এক প্রকার দৌড়ে সিড়ি বেয়ে নামছে। সৈকতের আকস্মিক ভয় হলো, মেয়েটা যদি পড়ে যায়? সে উদ্ধিগ্ন স্বরে ডেকে উঠল,
‘চন্দ্রকথা!’

সেই ডাকটা চন্দ্রকথার কর্ণকুহরে পৌঁছাল ঠিকই কিন্তু সে ফিরল না। এই নামের মালিকতো সে নয়, তবে পিছু ফিরবে কেন! সে অবিচল গতিতে ছুটল। সৈকত হতাশ শ্বাস ফেলল। বন্ধুর এই বোনটার স্বভাব বরাবরই শান্ত, চাঞ্চল্য তার ধাঁতে নেই। আজ তবে চঞ্চল হলো কেন! তাকে অশান্ত করবার জন্যই কী! সৈকত পায়ের গতি বাড়াল। সে যতক্ষণে নিচে নামল ততক্ষণে মুন উঠোন পেরিয়ে গেছে ।

সৈকতের আগে মুন পৌঁছল ডেলিভারিম্যানের কাছে। পাঁচ জনের কয়েকপদের খাবারের ভারি ব্যাগের ভার বইতে পারল না মুন। ভারে মুখ কুঁচকে ফেলল। সেই মোক্ষম সময়ে এক জোড়া সাহায্যের হাত এগিয়ে এলো। মুন মুখ তুলে চাইল। অপ্রত্যাশিত মানুষকে দেখে যারপরনাই অবাক হলো। হকচকিয়ে গেল কিছুটা!
‘আমি পারব তো!’

সৈকত প্রতিত্তোরে রা করল না। কী বলবে, কী সম্বোধন করবে তার জড়তা ভীষণ। চোখে চোখ ও রাখল না, আর না কিছু বলল। কেবল দায়িত্ব পালন করল। মুনকে বিস্ময়ের মাঝে রেখেই নিঃশব্দে আলতো করে সবগুলো ব্যাগ তুলে নিল নিজ হাতে। তারপর মুনকে যাবার ইশারা করে পা বাড়াল।

রাস্তায় কাজ চলছে। রাস্তা জুড়ে ছড়ানো ছিটানো কংক্রিটের। ওতগুলো ভারি ব্যাগ নিয়ে চলতে বেগ পেতে হচ্ছে সৈকতের। মুন তা খেয়াল করে সৈকতের পাশে এসে বলল,
‘আমাকে কয়েকটা প্যাকেট দিন, ভাইয়া!’

এ পর্যায়ে চোখ তুলে তাকাল সৈকত। বেরুবার সময় মাথায় কাপড় টেনে এসেছে মুন। লাল ঘোমটায় ওকে বউ বউ লাগছে সৈকতের কাছে। মেয়েটা বউ বউ হয়ে ঘুরছে নাকি ওর কাছেই লাগছে! চোখ সরাল সৈকত। বিরক্তির শ্বাস ফেলল। কাল রাতে ওর স্বপ্নে এসে বিয়েশাদি করে আজ ভাইয়া ডাকছে! সম্বোধনটা ভালো লাগল না সৈকতের। খেয়াল করে দেখল এই ক্ষণে এই মেয়েটাকে সে বন্ধুর বোনের চোখে দেখতে পারছে না। একবারেই না। কাল স্বপ্নে আসবার পর সব এলোমেলো হয়ে গেছে। অনুভূতির আলোড়ন এক পক্ষীয় বলেই বোধহয় সৈকত বিরক্তি প্রকাশ করতে পারল না। কেবল গম্ভীরমুখে বলল,
‘ নো।’

মুন খানিকক্ষণ চুপ রইল। কয়েক কদম এগিয়ে থেমে গেল। কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে বলল,
‘ এতগুলো প্যাকেট আপনার একার নিতে কষ্ট হচ্ছে, আমাকে প্লিজ দিন কয়েকটা! ‘

উদ্ধিগ্নতা আর আকুতি নিয়ে বলা কথাটা শুনে সৈকতের গম্ভীরতায় ভাটা পড়ল। সে স্বর নরম করে বলল,
‘ আই এম ফাইন। রাস্তায় কংক্রিট, দেখে শুনে হাঁটো। পায়ে লাগবে। ‘

মুন জোর করল, ‘প্লিজ!’

সৈকত এবার কিছুটা জোরে বলল, ‘ নো, চন্দ্রকথা!’

বলে নিজেই আক্কেলগুড়ুম হলো। কী বলে ফেলল এটা! এক দলা অস্বস্তি এসে চেপে বসল চোয়ালে। সে কেশে উঠল। মুন ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘চন্দ্রকথা কে ভাইয়া?’

সৈকত ভীষণ বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ল। বলতে পারল না, আমার স্বপ্নেদেখা বধূ তুমিই আমার চন্দ্রকথা। ইতস্তত করল। কী উত্তর দিবে ভেবে পেল না। খানিকটা সময় নিয়ে বলল,
‘স্যরি ফর স্লিপ অফ টাং।’

মুন সন্দিহান চোখে তাকাল। তারপর স্মিত হাসল। সে ধারণা করল, ‘চন্দ্রকথা’ সৈকতের প্রেমিকা। ভুলে ডেকে ফেলেছে। চন্দ্রকথা! এমন নাম হয়! হয় না, নিশ্চয়ই সৈকতের দেয়া নাম। ভ্রু নাড়াল সে, সৈকত ভাইয়া তো ভালোই রসিক। কারো ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে প্রশ্ন করা উচিত নয় বলে প্রশ্ন করল না। সুপ্রতিভ হেসে বলল,
‘ ইট’স ওকে, ভাইয়া!’

বাকিপথ কথা হলো না। নিচতলার ডাইনিং এ খাবার প্যাকেট গুলো রাখল সৈকত। মুন চওড়া হেসে বলল, ‘থ্যাঙ্কিউ ভাইয়া!’

সুন্দর, হৃদয়গ্রাহী, ঝলমলে হাসি দেখে সৈকতের চিত্ত নড়ে উঠল যেন। সৈকত স্থির চোখে পরখ করল হাসিটা। ওর অবচেতন মনের ইচ্ছে হলো বলতে,
‘থ্যাঙ্কিউ লাগবে না। ‘ভাইয়া’ ডাকা বন্ধ করে দাও, তাহলেই হবে।’

যে ইচ্ছেদের লাই দিলে বন্ধুত্বে আঁচ পডবে সেই ইচ্ছেদের লাই দিতে নেই। সৈকত চাপা শ্বাস ফেলে হাঁটা ধরল। মুন খাবার বাড়তে বাড়তে বলল,
‘ফ্রেশ হয়ে আসুন। আমি খাবার দিচ্ছি।’

সৈকত থেমে গেল, ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল। কাচের প্লেটে টুংটাং শব্দ তুলে খাবার বাড়ছে মুন। ভঙ্গিতে গিন্নি, মাথায় ঘোমটা, চোয়ালে ব্যস্ততা, স্বরে সম্বোধন। ভাবখানা এমন যেন অফিসফেরত সৈকতের বিবাহিত বউ তাকে খেতে ডাকছে। মেয়েটা অজানায় বউ বউজনক আচরণ করে সৈকতের দহন বাড়ানোর পায়তারা করছে। নাহ্! এই মেয়ের সামনে বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। সৈকত একসাথে খেতে বসতে অপারগ হয়ে বলল,
‘ রুবাব তো নিচে আসতে পারবে না। ‘

মুন প্রশ্নবিদ্ধ স্বরে বলল, ‘আমি তো ভাইয়ার খাবার রুমে নিয়ে যাবার কথা ভেবেছিলাম। তাহলে সবার খাবার রুমে দিব?’

সৈকত সায় জানিয়ে হাঁটা ধরল। মুন টেবিলে পরিবেশন করা খাবার আবার গুছিয়ে নিতে শুরু করল। সৈকত যেতে গিয়ে থেমে গেল। ইচ্ছে হলো মুনকে হাতে হাতে সাহায্য করতে। কিন্তু দুজন একসাথে খাওয়ার নিয়ে গেলে ব্যাপারটা রুবাবের চোখে দৃষ্টিকটু লাগে না কি এই ভয়ে সাহায্য করল না। অবিচল হেঁটে গেল।

খানিক বাদেই প্লেট নিয়ে মুন এলো উপরে। রুবাব ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘এসব এখানে আনতেছিস ক্যান?’

মুন বলল, ‘তুমি তো নিচে যেতে পারবে না, তাই।’

অন্তর বলল, ‘ পিচ্চি, তোমাকে এত কষ্ট করতে হবে না, কী কী আনতে হবে বলো। আমরা নিয়ে আসছি।’

মুন মানা করল। অন্তর আর নাহিদ নিজ থেকেই একে একে খাবার সরঞ্জাম উপরে আনতে লাগল। সৈকত জড়তা নিয়ে বসে ছিল রুবাবের পাশে। ওর দৃষ্টি রুবাবের দিকে। আনমনে কী যেন ভেবে চলেছে। ওর ওমন চাহনি দেখে রুবাব কেশে বলল,
‘ আমার দিকে এমন কইরা চাইয়্যা আছোস ক্যান? আমার রূপ কি বেয়ে বেয়ে পড়তেছে?’

সৈকতের ধ্যান ভাঙল। জড়তা কাটিয়ে আকস্মিক হেসে উঠল। কৌতুকের সুরে বলল, ‘ দেখতেছি, তোর রূপ যে বেয়ে বেয়ে কোথায় গিয়ে পড়ে?’

রুবাব মিচে রাগ দেখাল, ‘আমার রূপ বেয়ে বেয়ে কোথায় পড়ে সেটা সেঁজুতি দেখবে। তুই আমারে ওমন নজরে দেখবি ক্যান! তুই কি আমারে ভালো টালো ভাইসা ফেলছস? আমি কিন্তু আগেই বলে দিচ্ছি, আই এম ইনটারেস্টেড ইন ওমেন, নট ম্যান।’

বন্ধুর ওমন ইঙ্গিত শুনে মাথা ভোঁ ভোঁ করে উঠল সৈকতের। চোখ রাঙিয়ে বলল, ‘ আসতাগফিরুল্লাহ! আমি তোরে বন্ধুর নজরে দেখতেছিলাম। আমার না তোর মতলব খারাপ। সকাল বিকেল তাওবা কর। ‘

রুবাব সন্দেহী চোখে বলল, ‘সত্যি তুই অন্য কোন নজরে দেখস নাই তো? ওই যে গালে দাঁড়ি গোঁফের সাথে মেকাপ করে, ফাউট করে সেলফি নেয় যে কতগুলো ছেলে চায় যে ওদের নজরে? সত্যি কইরা ক!’ বলতে বলতে রুবাব দূরে সরে গেল।

‘ বাজে বকিস না। আমার নেচার ঠিক আছে। ‘ সৈকত যেন বিব্রতবোধ করছে। তার বন্ধুমহলে এই বন্ধুটি লাগামহীন। ঠাট্টার স্থলে ভয়ংকর কথা বলে ফেলে। রুবাব হাফ ছাড়ল,
‘ভয় পাইছিলাম! ওমন হলে তোরে ধরে মূত্রপুকুরে বিসর্জন করতাম।’

‘শালা তোর মাথা গেছে।’

রুবাব ঠাট্টার সুরে বলল,
‘শালা ডাকবি না। তোর কাছে আমার বোন বিয়া দিব না।’

সৈকতের স্বপ্ন ভাবনায় বিয়ে হলেও বাস্তবিক ভাবনা বিয়ে অবধি যায় নি। সে ঠাট্টার স্থলে বলল,
‘ যেভাবে বলতেছিস, যেন তোর বোনকে বিয়া করার জন্য আমি শনি মঙ্গলবার চিড়া মুড়ি খেয়ে তোর বাড়ির দরজায় বসে অনশন করতেছি?’

‘চিড়া মুড়ি খেয়ে অনশন তো দূরে থাক, ছক্কা মেরে অক্কা পেয়ে বসলে ও বন্ধু বান্ধবের কাছে বোন বিয়া দিব না, আমি।’ হাসতে হাসতে বলল রুবাব।

নাহিদ আর অন্তর মিলে সব খাবার রাখল। সবশেষে পানির জগ নিয়ে উপরে এলো মুন। রুবাব বলল,
‘ তুই ও বসে যা, আমার সাথে?’
‘না, আমার ক্ষিধে নেই। পরে খাব।’

রুবাব চাইল বোনের পানে। বোনটা বোধহয় তার বন্ধুদের সাথে খেতে অপারগ। রুবাব সব আইটেম থেকে একটু একটু নিয়ে একটা প্লেটে রাখল। তারপর প্লেটটা বোনের হাতে দিয়ে বলল,
‘ মুভি ছেড়ে খেতে বসার অভ্যাস গেল না তোর! নে, ধর! পুরো প্লেট শেষ করবি। আমি রুমে গিয়ে চেক করব কিন্তু! ‘

সৈকত মুনের পানে চেয়ে মনে করল খানিক আগে ঠাট্টার স্থলে বলা রুবাবের কঠিন কথাটা। ভাবল, এই মেয়েটাকে কখনো তার চাইতে হবে রুবাবের কাছ থেকে? এমন দিন আসবে? নাহ্! না আসুক। তাকে কখনো চাইতেই না হোক।

বাকি বন্ধুরা বিকেল অবধি থাকলেও লাঞ্চের পর টিউশনের বাহানায় বিদায় নিল সৈকত। টিউশন নয়, মূলত মুনের ভাবনা তাকে তাড়া করছিল।

______________

ঘড়ির কাটায় রাত বারোটা। পা টিপেটিপে বাড়ি থেকে বেরুচ্ছে রুবাব। উদ্দেশ্য, প্রেমিকার বাড়ি। কাল ওমন ধরা খাওয়ার পর থেকে সেঁজুতিকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। মেয়েটা কেমন আছে কে জানে? অস্থির লাগছে রুবাবের। মনে হচ্ছে, এই ক্ষণে প্রেয়সীর মুখখানা দেখা বাধ্যতামূলক। না দেখা অবধি এই অস্থিরতা কমবে না। ঘুমটি নামবে না, শান্তি পাবে না। কথা বলা লাগবে না, শুধু দূর থেকে এক পলক তাকে সুস্থ সুন্দর দেখতে পেলেই রুবাবের বুক কাঁপুনি থামবে। ঠিকমতো হাঁটতে পারছে না সে। পায়ে চাপ লাগলেই ভীষণ ব্যাথা লাগছে। এক পায়ে ভর দিয়ে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। তবুও এই কষ্টটা তুচ্ছ মনে হচ্ছে রুবাবের। শরীরী কষ্ট থেকে মনের কষ্টের ভার বেশি। মনের কষ্ট সইতে পারবে না সে। আজ না গিয়ে পরে গেলে যদি দেখে জোর টোর করে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে সেঁজুতিকে! নাহ্ ! এটা হতে দেয়া যাবে না। মেয়েটা তার মনের পুরোটা জুড়ে। তাকে হারালে পাগল হয়ে যাবে রুবাব। হারানোর ভয় কাজ করতেই পায়ের গতি বাড়াল রুবাব।

পুলিশ শ্যালকের ভয়ডর ভুলে জান হাতে নিয়ে রুবাব চলল প্রেমিকার সন্ধানে। সেঁজুতির বাসার কাছে যখন পৌঁছল তখন ঘড়ির কাটায় রাত ১টা ছুঁইছুঁই। রুবাব নিঃশ্চুপ দাঁড়াল বহুতল ভবনের সামনে। আটতলা ভবনের পঞ্চমতলায় থাকে সেঁজুতির পরিবার। বাবার অবর্তমানে ভাইয়ের হাতে গোটা সংসার। দুই ভাই, এক বোন আর মাকে নিয়ে পরিবার। বড়ো ভাই সাদাত ভীষণ কঠোর মানুষ। পুলিশী অবতার ঘরে বাইরে সবখানে থাকে।

রুবাব খানিকক্ষণ চেয়ে রইল পঞ্চম তলার উত্তর দিকের বারান্দায়। যোগাযোগের তো উপায় নেই, মেয়েটাকে কিভাবে জানাবে, সে এসেছে? রুবাব আশায় রইল, নিজ থেকে আসুক সেঁজুতি। কিন্তু সে এলো না। রুবাব এবার আশপাশ খুঁজে একটা ইটের কনা খুঁজে নিল। কিয়ৎক্ষণ অপচয় না করে ছুঁড়ে মারল উপরে। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে ঢিল গন্তব্যে গেল না। পাঁচতলায় না গিয়ে লাগল চারতলার জানালায়। ঝনঝন করে বিকট শব্দ হলো। ঢিলমারা জানালা খুলে উঁকি দিলেন এক ভদ্রলোক। আশপাশ উপর-নিচ সবটা পরখ করতে লাগলেন।

শীট! বলে মুখ কুঁচকে লুকিয়ে পড়ল রুবাব। ভদ্রলোক জানালা বন্ধ করলেন খানিক বাদে। রুবাব আবার ঢিল ছুঁড়ল। এবার গিয়ে পড়ল পঞ্চম তলার দক্ষিণ দিকে। ঘটনা পুনরাবৃত্তি হলো। তৃতীয়বারের সময় এক লোক দেখে ফেলল। ভদ্রলোক বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিলেন। মুখে মাস্ক পরা একটা ছেলেকে ঢিল ছুঁড়তে দেখে চেঁচিয়ে উঠলেন,
‘এই ছেলে! কে তুমি! দারোয়ান! দেখেতো কে ওখানে! ‘

দারোয়ানের চোখে সবে ঘুম ভর করেছিল! চিৎকার শুনে তড়িৎ উঠে বসল। হকচকিয়ে বলল, ‘কে কে!’

রুবাব চটজলদি কাছাকাছি একটা আম গাছের আড়ালে লুকাতে গেল। হলো আরেক বিপত্তি। গাছের শেকড়ে বসে কেউ মূত্র বিসর্জন করেছিল বোধহয়। পা দিতেই ঝপাৎ করে ছড়িয়ে পড়ল। এ পা, ও পা, ব্যান্ডেজে লেগে একাকার। স্যাঁতসেঁতে আর দুর্গন্ধ নাকে আসতেই ঘটনা বোধগম্য হলো রুবাবের। গা রি রি করে উঠল । সরতে চাইল পারল না। দারোয়ান তখন টহল দিচ্ছে চারপাশে। দেখলেই বিপদ। রুবাব গা গুলানো অনুভূতি নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কী ভয়ানক দৃশ্য! রুবাব অসহায় চোখে চাইল পাঁচ তলার বারান্দায়। আনমনে বলল,
‘ তোমার জন্য জীবনে না হওয়া গু’ময় অনুভূতি ও হয়ে গেল, সেঁজুতি! এই গু’ময় অনুভূতির বিনিময়ে হলেও একবার দেখা দাও! ‘

সেঁজুতি দেখা দিল না। টের পেল না, তার প্রেমিক তার দর্শনে এসে কীসের কীসের দর্শন পাচ্ছে। মিনিট দশেক ঘুরে ফিরে দেখল দারোয়ান। কারো দেখা না পেয়ে আবার গিয়ে বসল সিটে। রুবাব সচকিত চেয়ে বেরিয়ে এলো। সেঁজুতির বারান্দার দিকে তাকিয়ে হাঁটতে লাগল। গেঁটের পাশে বাঁধা ছিল একটা ট্রেনড কুকুর। সাদাতের আদেশে রুবাবকে ধরার কাজে নিয়োজিত ছিল কুকুরটা। রুবাবকে দেখেই চিনে ফেলল। স্বজোরে ডেকে তেড়ে এলো। রুবাব মূত্রমাখানো পায়ের গতি বাড়াল। অন্ধকারে কাউকে সরে যেতে দেখে দারোয়ান চেঁচিয়ে উঠল, ‘চোর? চোর?

তড়িঘড়ি গেট খুলে ধাওয়া করল। দারোয়ানের আগে ছুটল সাদাতের প্রশিক্ষিত কুকুর। দ্বিতীয়বারের মতো প্রাণের ভয় কাজ করল রুবাবের। প্রেমিকা, হাতের সেলাই, পায়ের নখ সব কিছুর মায়া ভুলে ছুটল প্রাণের মায়ায়। প্রাণপণে ছুটতে লাগল। উঁৎ পেতে থাকা সাদাত এলো বন্দুক হাতে। ততক্ষণে শোরগোল পড়ে গেছে, চোর এসেছে মহল্লায়। ছেলেবুড়ো সবাই লাঠি হাতে বেরিয়ে এসেছে। সবাই ছুটছে দারোয়ানের পেছনে। রুবাব ছুঁটতে ছুটতে পিছু ফিরে দেখল, তার পিছনে একটা কুকুর, কুকুরের পেছনে লাঠি হাতে দারোয়ান। দারোয়ানের পেছনে বন্দুকধারী সাদাত, সাদাতের পেছনে এলাকাবাসী। কী কঠিন দৃশ্য! রুবাব যেন এদের মাঝে নিজের প্রাণের বিনাশ দেখল। শরীর হাঁপিয়ে উঠেছে। হাতে পায়ের ব্যাথা ভীষণ বেড়েছে। আর দৌড়ানো যাচ্ছে না। রুবাব আকস্মিক রাস্তার পাশের এক গলিতে ঢুকে গেল।

মহল্লাবাসী হন্য হয়ে খুঁজছে রুবাকে। রুবাব দুই ভবনের চিপায় দাঁড়িয়ে আল্লাহর নাম জপছে। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলতেছে। কোন এক বাসা থেকে কিঞ্চিৎ আলো এসে পড়ছে পায়ে। মূত্রে মাখো মাখো পা নজরে আসতেই রুবাব চাপা শ্বাস ফেলে বলল,
‘ দেখা করতে আসলাম তোমার শনে। তোমার দেখা না পেয়ে পেলাম, জানালাদর্শন, মূত্রদর্শন, দারোয়ান দর্শন, কুকুর দর্শন, চোর দর্শন আর কীসের কীসের দর্শন। যদি তুমি জানতে সেঁজুতি! ‘

_______________

গভীর রাত। কপালে বিরক্তির ভাঁজ ফেলে এক কাপ চা নিয়ে টেবিলে বসেছে সৈকত। বিসিএস প্রস্তুতিপর্বে আসার পর তার পুরোরাত কাটছে পড়ার টেবিলে। সারারাত না ঘুমিয়ে একটানা পড়ে। ফজর নামাজ পড়ে একবারে ঘুমায়। তাও তিন চার ঘন্টা। আটটা কি নয়টায় ওঠে আবার বসে পড়তে। বিসিএসের এক সমুদ্র সিলেবাসে আয়ত্ত্ব করতে হলে দিনরাত পড়তে হয়। সৈকত একাগ্রচিত্তে পড়ছে মাসখানেক যাবত। বেশ মনোযোগী ছাত্র সৈকত। অনায়েসে ঘন্টার পর ঘন্টা পড়তে পারে, মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটে না। আজ হঠাৎ করে মনোযোগে বিঘ্ন হচ্ছে তার। কিছুতেই পড়ায় কনসেনট্রেশান দিতে পারছে না। খেয়ালে মুন আসছে খুব করে। পড়া আয়ত্ত করতে পারছে না। আজ মুনকে দেখবার পর যেন স্বপ্নটা পাকাপোক্ত হয়ে বসেছে মনে। বারবার স্মরণে আসছে। মুনের সাথে আজকের কথোপকথন কানে বাজছে। কীভাবে মুনকে ‘চন্দ্রকথা’ ডেকে ফেলল সেই প্রশ্ন জাগছে! আচ্ছা, মেয়েটা কি টের পেয়ে গেছে কিছু! চন্দ্রকথার মানে জেনে গেছে? ওটা যে স্লিপ ওফ টাং ছিল না, তা টের পেল কী করবে মেয়েটা? রুবাবকে বলে দিবে? কত প্রশ্ন মনে আসছে সৈকতের।
এত খেয়ালের ভীড়ে বিরক্ত লাগছে ওর। নিজের উপর, নিজের বিয়ে আর বউ কেন্দ্রীক ভাবনার উপর।

আশ্চর্য! কী হচ্ছে সৈকতের সাথে! স্বপ্ন ভুলতে পারছে না, পড়ায় মনোযোগ দিতে পারছে না। এমন তো কখনো হয় না। কী হলো হঠাৎ ওর! মন মস্তিষ্কে এলোমেলো হলো কেন! ইচ্ছেরা আবার আবদার জুড়ে বসল, মুনকে দেখার। মুনকে নিয়ে ভাবার।

ওর ভাবনার মাঝে অন্তর এসে দাঁড়াল দরজায়। ওরা তিনবন্ধু একটা বাসা ভাটা নিয়ে থাকে। তিনজনই রাত জেগে পড়ছে। অন্তর এসে তাড়া দিয়ে বলল,
‘ সৈকত, শীগগির চল!’

সৈকতের ধ্যান ভাঙল, ‘ এত রাতে কোথায় যাব?’

‘রুবাব আজ আবার ধরা খাইছে। টয়লেটের ডোবায় ঝাপ দিছে না কি!’

নাহিদ হাতে দড়ি নিয়ে এসে বলল, ‘মানুষ রিলেশনে গিয়া প্রেমিকার প্রেম সাগরে হাবুডুবু খায়, রুবাব রিলেশনে গিয়া প্রেম সাগরের বদলে মূত্রপুকুরে হাবুডুবু খাচ্ছে! শা লা সেই এক কপাল পাইছে ! ‘

সৈকত হতভম্ব হয়ে গেল। প্রেমিকার সাথে দেখা করতে গিয়ে প্রেমিকার ভাইয়ের কাছে ধরা খেয়ে টয়লেটের ডোবায় ঝাপ দিয়েছে! কী সাংঘাতিক কথা! সে যদি মুনের সাথে প্রেম করে তবে রুবাবের ভয়ে তাকেও মুনের প্রেমের বদলে এমন মুত্রপুকুরে হাবুডুবু খেতে হবে। ভাবতেই ভীত ঢোক গিলে নিজের উপর প্রেম নিষিদ্ধ করল সৈকত। এমন প্রেমের চেয়ে চিরকাল একা প্রেমবঞ্চিত থাকা ঢের ভালো।

চলবে…

#অলীকডোরে চন্দ্রকথা। (পর্ব-৩)
#আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা।

মাঝরাত্তিরে বাউণ্ডুলে সাজে ঘুরছে তিন যুবক। পরনে বাসায় কাপড়, থ্রি-কোয়ার্টার , এলোমেলো চুল, চোখে মুখে আতঙ্ক। বুক কাঁপছে ঢিপঢিপ। উদ্ভ্রান্তের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছে প্রাণপ্রিয় বন্ধুকে। মারমুখী হয়ে জনতা খুঁজছে রুবাবকে। বন্ধু যদি এলাকাবাসীর হাতে পড়ে, তবে বলি হতে হবে। এই যাত্রায় সাদাতের হাতে পড়লে রক্ষা নেই। ভয়ানক রেগে আছে সাদাত, চোখ মুখ লাল। নাকের ডগা ফুলিয়ে ফোঁসফোঁস করছে। কেবল সে জানে ছেলেটা তার বোনের সাথে দেখা করতে এসেছে। বাকিরা চোর হিসেবে ধারণা করেছে। বোনের বদনাম হবে বলে কারো ভুল ভাঙাল না সে। কেবল নিজ মনেই ক্ষেপে রইল।
কালকের ওমন ধরা খাওয়ার পরেও আজ আবার এসেছে ছেলেটা! কত বড়ো স্পর্ধা! একবার হাতের নাগালে পেলে জন্মের প্রেম ছুটিয়ে জেলে পুরবে, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল সাদাত। তার ভাবভঙ্গি পরখ করে অন্তর হিসহিসিয়ে বলল,
‘ এই ব্যাটাকে দ্যাখ, কেমন সাপের মতো ফোঁসফোঁস করছে ! গেলবার বাসায় যাবার পর দেখেছিলাম ভাবি একটা হিন্দি সিরিয়াল দেখতেছিল, যেখানে একটা মেয়ে এমন ফোঁসফোঁস করছিল। তারপর দেখি চোখের পলকে সাপ হয়ে গেছে। এটাকে না কি ইচ্ছাধারী নাগিন বলে। এই ব্যাটাকে দেখে সুবিধার লাগতেছে না। নাগ টাগ নয় তো! আমাদের কাছে তো বিন টিন ও নেই! ‘

নাহিদ ধমকে উঠল, ‘ সাপের বিন না খুঁজে মূত্রপুকুর খুঁজ। ব্যাটার মাঝে এনাকোন্ডা এনাকোন্ডা একটা ভাইব আছে। টের পেল আস্ত গিলে ফেলবে, একটু চিবাবে ও না।’

আতঙ্কিত চোখে সবাই টয়লেটের ডোবা খুঁজতে লাগল। আবাসিক এলাকায় ওমন ডোবা চোখে পড়ছে না। খুঁজতে খুঁজতে হয়রান তিন বন্ধু। অনুসন্ধানী চোখে খুঁজতে খুঁজতে সৈকত বলল,
‘ বাবা গ্রাম থেকে শহরে পাঠাল, ভালো ক্যারিয়ারের খোঁজে। এদিকে আমি ক্যারিয়ার আর বউ খোঁজার বয়সে মূত্রপুকুর খুঁজতেছি। সবই কপাল!’

দূর থেকে হালকা আলোয় পানি চিকচিক করতে দেখে আশাভরা স্বরে অন্তর বলল, ‘ওই তো পানি দেখা যাচ্ছে।’

উৎফুল্ল হয়ে সবাই এগুলো সেদিকে। গিয়ে দেখল, ওটা একটা ছোটো গর্ত। কোথা থেকে কিঞ্চিৎ আলো গর্তের পানির উপর পড়ায় ঝলমল করছে। সবাই হতাশ শ্বাস ফেলল। অন্তর বিরক্তির সুরে বলল,

‘এমন কইরা বউ খুঁজলে বউ ও পাইয়্যা যাইতাম। এই শালার মূত্রপুকুর গেছে কই? রুবাবরের ম্যাসেজ দিয়ে বল, লোকেশন অন করতে।’

নাহিদ ফোন দিয়ে দেখল ঢুকছে না। সে বলল,’ ওর সাথে সাথে ওর ফোন ও মূত্রপুকুর হাবুডুবু খাচ্ছে। নেটওয়ার্ক পাবে কোথায়? ‘

উৎসুক জনতার দল খানিকটা দূরেই। রাস্তায় মানুষ গিজগিজ করছে, যেন পুরো মহল্লা উঠে এসেছে। ওই দলের দিকে এগুলো ওরা। রাস্তার পাশে পড়ে থাকা লাঠি দেখে সৈকত বলল,

‘সবাই লাঠি নে।’

‘কেন! লাঠি দিয়া কী করবি?’ ভ্রু কুঁচকাল নাহিদ।

‘এলাকাবাসী যে পরিমাণ ক্ষেপে আছে। কিঞ্চিৎ সন্দেহ হলে আমাদের উপর চড়াও হবে। আমাদের বুঝাতে হবে যে, আমরা এলাকাবাসী। লাঠি নিয়ে চোর খুঁজতে বেরিয়েছি। ‘ একটা লাঠি তুলে নিতে নিতে বলল সৈকত।

সবাই লাঠি হাতে ভীড়ের মাঝে ঢুকে গেল। এমন ভাব করল যেন ওরা এলাকার ছেলেপুলে। ঘুম থেকে উঠে এসেছে চোর ধরতে। অন্তর হাই দিতে দিতে এক লোককে জিজ্ঞেস করল,
‘আংকেল চোর দেখেছেন?’

ভদ্রলোক হতাশ স্বরে বললেন, ‘ না দেখি নাই। কোনদিকে ডুইক্যা গেছে কে জানে! ওই দিকে খুইজা দেখো।’

নাহিদ লাঠি নাড়াতে নাড়াতে দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করল , ‘ওদিকে তো নেই। আপনি দেখছিলেন, কোনদিকে গেছে?’

যেহেতু একই সময় রাস্তায় মহল্লার সব ছেলে উপস্থিত । তাই দারোয়ান বিশেষ একটা গ্রাহ্য করল না। গলির দিকে তাক করলেন,
‘এই দিকে আইসা উধাও হইয়্যা গেছে। ‘

সৈকত এসে সুকৌশলে প্রশ্ন করল, ‘চেহারা দেখছিলেন? দেখতে কেমন? জানতে পারলে ধরতে সুবিধা হবে।’

দারোয়ান হতাশ সুরে বলল, ‘মুখে মাস্ক পইরা আছি। চেহারা দেহি নাই। গায়ে নীল গেঞ্জি পইরা আছিল।’

তিন বন্ধুর বুক চিরে স্বস্তির শ্বাস বেরুল। চোখে মুখে আশার আলো দেখা গেল। কিছুটা দূরে এসে নাহিদ বলল, ‘ রুবাব জীবনে যদি একটা ভালো কাজ করে থাকে, তবে সেটা হলো মাস্ক পরা। দারোয়ান চেহারা চিনেনি ভালোই হলো। এবার ভালোয় ভালোয় কেটে পড়া যাবে।’

অন্তর চিন্তা নিয়ে বলল, ‘ দারোয়ান না চিনলেও সাদাত চিনে। বি কেয়ারফুল।’

দারোয়ানের ইঙ্গিত দেয়া পথের দিকে এগুলো ওরা। খুঁজতে থাকল হন্য হয়ে। কোথাও যদি মূত্রপুকুরের দেখা পাওয়া যায়! কিছু না মূত্রপুকুরের দেখা মিলছে আর না মূত্রেমাখা বন্ধুর।

আধঘন্টার মতো হন্য হয়ে খুঁজেও রুবাবের দেখা পেল না। ওদিকে মহল্লাবাসী চোর পালিয়েছে বলে বাসায় ফিরে যাচ্ছে। সাদাত টহল দিচ্ছে বন্ধুক হাতে। এখন ওদের ও ফিরতে হবে, ঘুর ঘুর করতে দেখলে সাদাত না আবার সন্দেহ করে বসে। চোখে সর্ষে ফুল দেখল ওরা। কোথায় খুঁজবে রুবাবকে! হাত পায়ের কাটাছেঁড়া নিয়ে কেমন আছে কে জানে! চিন্তার ভাঁজ পড়ল তিন বন্ধুর। চিন্তা, হতাশা, ভয় চেপে বসল চোয়ালে।
নাহিদ হাতে থাকা লাঠি ছুঁড়ে মারল রাস্তায়। বিরক্তির সাথে কিছুটা জোরেই বলল, ‘ শালা কই গিয়া লুকাইছে, আল্লাহ জানে।’

লাঠিটা শব্দ করে গিয়ে পড়ল দূরে। সেই শব্দ থামার খানিক বাদেই ভীতসন্ত্রস্ত একটা ধীর স্বরের ডাক ভেসে এলো, ‘নাহিদ!’

শব্দটা কানে যেতেই ওর চলতি পা থেমে গেল। চেহারায় আশার ঝিলিক দিল। সচকিত চাইল। রাস্তার দুইপাশে দেয়াল ছাড়া কোন মানুষ চোখে পড়ল না। নাহিদ কাঁপা স্বরে ডাকল,’রুবাব?’

রুবাব পরপর তিনবার তিন বন্ধুর নাম ধরে ডেকে বুঝাল এটা সে, ‘নাহিদ?
সৈকত?
অন্তর?’

আর কিছু বলল না। বলতে হলো না। বন্ধুরা সুকৌশলে খুঁজে নিল ওকে। দুই ভবনের মাঝের চিপায় একরাশ আতঙ্ক নিয়ে হেলে আছে। বিধ্বস্ত অবস্থা। ঠিকমতো দাঁড়াতে পারছে না। রুবাব কল দিয়ে নাহিদকে বলেছিল, ‘ তোরা একটু আয় তো!’

নাহিদ জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আজ আবার ধরা খাইছস? আছোস কই?’
রুবাবের বিরক্তি নিয়ে উত্তর দিয়েছিল, ‘গু’য়ে ডুবে বসে আছি।’

নাহিদ এটাকে টয়লেটের ডোবায় ডুবে বসে থাকা বলে ধারণা করেছিল।

রুবাবকে দেখে যেন প্রাণ ফিরে পেল বন্ধুরা। ওর পায়ে লেগে থাকা মলমূত্রের দিকে ধ্যান না দিয়ে বন্ধুকে আগলে নিল। উদ্ধিগ্ন হয়ে বলল, ‘ঠিক আছিস তুই? ‘

হাত পায়ের অসহনীয় যন্ত্রণা ঠেলে রুবাব হেসে বলল, ‘ আমার গায়ে ময়লা, লাগিস না তো!’

নাহিদ হেসে বলল, ‘আমি ভাবছিলাম, তোর জন্য মূত্রপুকুরে ঝাপ দিতে হইব। যাক বাঁচলাম। আয় ধুঁয়ে দিই?’

বিল্ডিংয়ের কোণায় একটা পানির লাইন ছিল। তিন বন্ধু নিঃশব্দে রুবাবকে ধরে নিয়ে গেল সেখানে, যত্ন করে পায়ের ময়লা ধুয়ে দিল। রুবাব মুগ্ধ চোখে উপভোগ করল বন্ধুদের যত্ন, দেখে গেল মূত্র দেখে গা ঝাড়া দেয়া বন্ধুদের ময়লায় গা ভাসানো। পায়ের অবস্থা তখন করুণ! কাটাছেঁড়া পায়ে ময়লা ঢুকে যাওয়া, সেই অবস্থায় দৌঁড়ানোর ফলে ফুলেফেঁপে একাকার। এ ছাড়া আরও কয়েক জায়গায় কেটে গেছে। অন্ধকার চিপায় ভাঙা কাচ ছিল, হুলস্থুল হয়ে পালাতে গিয়ে কাচ বিধে গেছে, কেটে রক্তারক্তি অবস্থা। পানি দিতেই জ্বলে উঠল, স্পষ্ট হয়ে উঠল রক্তের অস্তিত্ব। যন্ত্রণায় চোখ মুখ খিচে এলো রুবাবের। বন্ধুদের চেহারায় মেঘ নামল নিমিষেই। উদ্বিগ্ন হলো, কেউ একচোট গালি দিল সাদাতকে। শা লা কে দেখে নিব!
উঠ! হাসপাতালে যাব। ইনফেকশন না হয়ে যায় আবার।
দাঁড়া আমি দেখে আসি, বাইরে কেউ আছে কি না। বলে নাহিদ গেল উঁকি দিতে। রুবাব দাঁড়াতে পারছে না। বাকি দুই বন্ধু ওর ভার নিল নিজেদের কাধে।

পড়ায় প্রভার পড়বে বলে এক রাতের জন্য নিজ বাসায় না যাওয়া ক্যারিয়ার কনসার্ন বন্ধুরা পড়া ছেড়ে ওর কাছে ছুটেছে। নিজের জীবন ঝুঁকি নিয়ে আগলে নিতে এসেছে বন্ধুকে। বন্ধুর বিপদে ঝাপিয়ে পড়েছে! এই দৃশ্য, এই বন্ধণ কী ভীষণ সুন্দর! রুবান তৃপ্ত চোখে দেখল বন্ধুত্বের সংজ্ঞা। এই বন্ধুরাই ওর শক্তি, সাহস, সুখ। ওর দিন রাঙানো মানুষ এরাই। রুবাবের মনে প্রশান্তি, ঠোঁটের কোণে হাসি।

সৈকত আকস্মিক শার্টের বোতাম খোলা শুরু করল। রুবাব আতঙ্কিত হয়ে বলল, ‘এই চিপায় শার্ট খুলতেছিস ক্যান! আমি আগেই আন্দাজ করছিলাম, তোর মতলব খারাপ। শা লা কাল তাওবা করতে বললাম করোস নাই! এখন কিছু হইলে আমি মানুষের কাছে মুখ দেখাব ক্যামনে! শালাবাবু দেখলে বোন বিয়ে দিবে না। প্লিজ ভালো হয়ে যা! ‘

বাইরে বন্দুক হাতে টহল দিচ্ছে শালাবাবু। এদিকে হাত পায়ের ব্যাথায় প্রাণ ওষ্ঠাগত। এমন করুণ আর গম্ভীর মুহুর্তে ও রুবাবকে কৌতুক করতে দেখে অবাক চোখে চাইল দুই বন্ধু। অন্তরের আর সৈকতের মুখ থেকে গম্ভীরতা সরে গেল। চট করে পরিস্থিতি উৎফুল্ল হয়ে গেল যেন। অন্তর মুখ চেপে হাসল। সৈকত নিঃশব্দে হাসতে হাসতে শার্টের বাকি বোতাম খুলতে লাগল। রুবাব এবার অন্তরের দিকে তাকিয়ে অসহায় চোখে চেয়ে বলল,
‘ অন্তর, ওরে বুঝা, গু’ময় অনুভূতির পর ও আমি সেঁজুতিরে ভালোবাসি। এই বদ মতলবি যাতে আমার দিকে নজর না দেয়! আমার ভয় লাগতাছে!’

অন্তর হাসি থামিয়ে বলল, ‘ রাত বিরাতে মূত্রপুকুরের নাম করে বাসা থেকে ডেকে এনে তোরা কী খেল দেখাচ্ছিস , ভাই!’

সৈকত শার্ট খুলে ফেলল। ভেতরে একটা টি-শার্ট আছে। ভাগ্যিস, আসবার কালে শার্ট চাপিয়েছিল। শার্টটা রুবাবকে পরিয়ে দিল। শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে হেসে বলল,
‘ আমার দিনকাল এতটাও খারাপ আসে নি, শা লা। নেহাৎ দারোয়ান তোর টি-শার্ট চিনে ফেলেছে। নয়তো কে দিতো! খুলে তিনবার আসতাগফিরুল্লাহ পড়ে ধুয়ে ফেরত দিবি। ‘

রুবাব চওড়া হাসল। এটা কৌতুকের নয়, প্রশান্তির। হেসে বলল, ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করে লাভ হবে না।’

নাহিদ এসে গেল, ‘ সবাই চলে গেছে। এবার চল।’

____________

হাসপাতালে করিডোরে বসে আছে তিন বন্ধু। ভেতরে রুবাবের চিকিৎসা চলছে। বিষাদী ছায়া সবার চোখে মুখে। পিনপতন নীরবতা টেনে প্রহর গুনছে কখন ডাক্তার বের হবে। অপেক্ষার প্রহর শেষে ডাক্তার বেরুলো। জানাল, কয়েক জায়গায় কাচ বিঁধে গভীর ক্ষত হয়েছে। তা ছাড়া নখে ইনফেকশন হবার সম্ভাবনা আছে। কোনভাবে পা নড়াচড়া করা যাবে না। প্রপার ট্রিটমেন্ট আর ড্রেসিং লাগবে। এক দুইদিন হাসপাতালে থাকতে হবে। ফর্মালিটি পূরণ করে সবাই রুবাবের কাছে গেল।

উদাস হয়ে বসে আছে রুবাব। ওকে ভীষণ চিন্তিত আর বিমর্ষ দেখাচ্ছে। বন্ধুরা কারণ হিসেবে সেঁজুতির বিরহ ধরে নিল। নাহিদ কাঁধ চাপড়ে বলল,
‘একটু সময় দে, দেখবি সেঁজুতি নিজ থেকে যোগাযোগ করবে তোর সাথে। ‘

অন্তর বলল, ‘ চাপ নিস না, আমরা আছি না। ‘

রুবাব অস্ফুট স্বরে বলল, ‘ আমার বোনটা পুরো বাড়িতে একা।’

এতক্ষণে রুবাবের অস্থিরতার কারণ ধরতে পারল সবাই। রুবাব বলল,
‘আমার ফোনে চার্জ নেই। তোদের কারো ফোন দে তো!’

সৈকত বলল, ‘ ও পুরো বাড়িতে একা জানলে ভয় পাবে, ও তো জানে না। অলরেডি চারটা বাজে। কিছুক্ষণ পরেই সকাল হয়ে যাবে। এখন জানাতে গেলে হিতে বিপরীত হবে, তোর অবস্থার কথা শুনলে কান্নাকাটি জুড়ে দিবে। তারচেয়ে ভালো, জানাস না। ‘
বন্ধুরা সায় জানাল, ‘ তুই নেই টের পেলে ও ফোন দিবে। তখন কিছু একটা বলে দিস। কাল তো এমনিতেও আংকেল আন্টি ফিরবে। তুই আমাদের বাসায় চলে যাস। তাহলে কেউ টের পাবে না।’

দুদিন আগে ওর সামনে পায়ের রক্ত দেখে মুনের কান্নার কথা স্মরণে এলো রুবাবের। মেয়েটা শুনলে ভেঙে পড়বে। বন্ধুদের পরামর্শ গ্রহন করল।

ওদের সমস্ত পরিকল্পনা ভেস্তে গেল সকাল হতেই। সাত সকালে সৈকতের ফোনে কল এলো মুনের। ভাইকে ফোনে দিয়ে না পেয়ে ভাইয়ের বন্ধুদের ফোন দিয়েছে। নাহিদ আর অন্তরের ফোন সাইলেন্ট থাকায় টের পায়নি তারা।

ফোন তুলতেই সুরেলা গলায় বলল, ‘হ্যালো? সৈকত ভাইয়া? চিনতে পেরেছেন? আমি মুন। রুবাবের বোন।’ এক নাগাড়ে কথা বলে থামল মুন।

ওই স্বর কানে যেতেই সৈকতের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল আকস্মিক। সে ঢোক গিলল। কিছুটা সময় নিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ। কিছু বলবে মুন?’

চটজলদি প্রশ্ন করল মুন, ‘ ভাইয়া বাসায় নেই, ফোন ও তুলছে না। ভাইয়া কি আপনাদের সাথে?’

সায় জানিয়ে ফোনটা রুবাবের দিকে বাড়িয়ে দিল সৈকত। রুবাব ফোন কানে ধরতেই জেরা শুরু করল।
‘সকাল সকাল কোথায় গেছো ভাইয়া? তোমার ফোন কোথায়? তুমি ঠিক আছো?’

রুবাব হেসে বলল, ‘আমি একদম ঠিক আছি। সৈকতদের বাসায় আছি। চিন্তা করিস না।’

এতে নিশ্চিন্ত হবার কথা থাকলেও মুনের চিন্তা কমল না। ভাইয়ের স্বর শুনেই সে আন্দাজ করে ফেলেছে। সে চিন্তিত স্বরে বলল,
‘ তোমার কথা কেমন যেন শুনাচ্ছে। তুমি সত্যি ঠিক আছো ভাইয়া? ‘

রুবাব আত্মপক্ষ সমর্থনে কিছু বলতে গেল। নাহিদ ক্যান্টিন থেকে নাস্তা নিয়ে ফিরল সেই ক্ষণে। অবচেতন মনে বলতে বলতে ডুকল,
‘ রুবাব উঠ! নাস্তা সেরে মেডিসিন নিয়ে রেস্ট নিস। আবার ডাক্তার আসবে ড্রেসিং করতে।’

রুবাব, সৈকত, অন্তর মুখ বিকৃত করে ফেলল। শীট! ওদিকে মুন জেরা শুরু করেছে আবার। কী হলো না হলো! অগত্যা রুবাবকে সত্যটা বলতে হলো। ভাই হাসপাতালে শুনেই কেঁদে ফেলল মুন। জানাল এখনই যাবে হাসপাতালে। রুবাবের হাজার মানা শুনল না, সে অনড়, সে যাবেই।

ঘড়ির কাটায় তখন ভোর ছ’টা। রাস্তাঘাট ফাঁকা। ওদের বাড়ি থেকে এদিকের রাস্তা একবারেই বিপরীত। গাড়ি পাওয়া যায় না, তেমন। মুন এদিকের রাস্তা চিনে না। একা আসবে কিভাবে! চিন্তায় পড়ল রুবাব। ভাবনাচিন্তার পর সমস্যা সমাধান হলো, কেউ একজন গিয়ে নিয়ে আসবে মুনকে। সেই কেউটা ও এ যাত্রায় সৈকত হলো।

স্বপ্নবধূ থেকে পালাতে চাওয়া সৈকতকে আবার পড়তে হলো চন্দ্রকথার সামনে, বসতে হলো পাশে।

চলবে…

#অলীকডোরে চন্দ্রকথা। (পর্ব-৪)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

ঋতুতে বর্ষার আগমন ঘটেছে দিন তিনেক হলো। অথচ বৃষ্টিকন্যার দেখা নেই। দুপুর, বিকেল সাঁঝ লগ্ন পেরিয়ে নুপুর পায়ে টাপুর টাপুর শব্দ তুলে বৃষ্টিকন্যা এলো এই সাত সকালে। সৈকত তখন শেখ বাড়ির দরজায়। পকেটে হাত গুজে আশপাশ পরখ করছে।
পুরো বাড়িতে কেবল মুনের উপস্থিতি বলে ভেতরে যায়নি সৈকত। অস্বস্তি লাগছে তার। মুনকে ম্যাসেজ করে বেরুতে বলে গেইটের বাইরে অপেক্ষা করছে। মিনিট দুয়েক হয়ে যাচ্ছে, স্বপ্নকন্যা এলো না। এলো বৃষ্টিকন্যা। অকালবর্ষণে চমকে গেল সৈকত, এক চটা বৃষ্টি এসে পড়ল তার মুখে, গায়ে।

শেখ বাড়ির গেইটটা বিশাল। পুরনো আমলের বাড়ি। সিমেন্ট দিয়ে তৈরি উঁচু পিলারের ছাদনাতলা। মাঝে লোহার গেইট। সৈকত তড়িঘড়ি করে গেইটের নিচে আশ্রয় নিল। কপালে বিরক্তির ভাঁজ টেনে টি-শার্ট ঝাড়তে লাগল। বৃষ্টিটাকে এখুনি আসতে হলো! একে তো ভোর, তারউপর বৃষ্টি। ফিরতি পথে বেশ কসরত করতে হবে। ওর বিরক্তিলগ্নে বৃষ্টিকন্যার সাথে দৃশ্যমান হলো স্বপ্নকন্যা। খট করে গেইট খোলার শব্দে ফিরে তাকাল সৈকত। সেই পলকে আটকাল সে।

সদ্য ঘুমভাঙা নারীর মুখখানা বড়োই মায়াবী লাগে। ঘুমজড়ানো ফোলা চোখ, শুস্ক ঠোঁটে একটা আকর্ষণ কাজ করে। সৈকত এই আকর্ষণ টের পেল। কোমল চোখে চাইল এক পলক। তারপর চোখ পেরাল। মুন তাড়া দিয়ে বলল, ‘চলুন, ভাইয়া!’

বলে সৈকতের দিকে না তাকিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে তালা লাগাতে শুরু করল। ভাইয়ের চিন্তা তাকে বাকি সব ভুলিয়ে দিচ্ছে। মুখটা থমথমে। অস্থিরতায় তালা লাগাতে পারছে না সে। সৈকত এগিয়ে এসে নিজ উদ্যোগে তালা লাগিয়ে দিল। বৃষ্টির বেগ বেড়ে গেছে অনেকখানি। সৈকত কোমল স্বরে বলল,
‘ এই বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বের হওয়া ঠিক হবে না। গাড়ি পাওয়া যাবে না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বৃষ্টি কমলে বের হই!’

এক রত্তি দাঁড়াবার ইচ্ছে নেই মুনের। সৈকতের বেশভূষা দেখে তার অস্থিরতা বাড়ছে। নিশ্চয় বড়ো কিছু হয়েছে, নয়তো সৈকত ভাইয়া এই বেশে বের হতো! এত বছরের তো কখনো এভাবে আসতে দেখেনি। ভাইয়ের জন্য মন কাঁদছে ওর, চোখের কোণে জল জমছে। ভাইকে সে ভীষণ ভালোবাসে। না দেখা অবধি শান্তি পাবে না। মুন বৃষ্টি মাথায় নিয়েই হাঁটা ধরল।

ওর অবাধ্যতা দেখে হতাশ শ্বাস ফেলল সৈকত। ভাইয়ের চিন্তায় বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়ে গেছে মেয়েটা। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে যেতে পারবে! গা ভিজে কেমন দেখাবে! তারউপর রাস্তায় কংক্রিটে ভরা। বৃষ্টির পানিতে পিচ্ছিল হয়ে আছে। মেয়েটা উদাস হয়ে যেভাবে হাঁটছে এখনি উলটে পড়বে, তখন রুবাবের পরিবর্তে মুনকে নিয়ে দৌড়াতে হবে। সবচেয়ে বড়ো কথা মুন এখন সৈকতের আমানত। আসবার কালে রুবাব বলেছিল,
‘আমার বোনটাকে তোর কাছে আমানত দিলাম। সহি সালামতে নিয়ে আসিস।’

দায়বদ্ধতার খাতিরে সৈকত বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বেরুল। দ্রুত পা ফেলে মুনের কাছে গেল। তারপর খপ করে হাত ধরল মুনের। পাশের একটা গেটের চাউনিতে নিয়ে দাঁড় করাল। কিছুটা আদেশের সুরে বলল,
‘ বৃষ্টি থামা অবধি অপেক্ষা করো। আমি দেখি উবার পাই কি না।’

আদেশের সুরে বলা কথার পরে পা বাড়ানোর সাহস পেল না মুন। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। সৈকতের খেয়াল হলো হাতের দিকে। ও হাত ধরে আছে মেয়েটার! ঝট করে ছেড়ে দিল। অনুতপ্ত হয়ে বলল, “স্যরি!’

মুন কিছু বলল না। উদাস চোখে চেয়ে রইল বৃষ্টির পানে। সৈকত ফোন বের করে উবাব চেক করতে লাগল। মুন আকস্মিক প্রশ্ন করে বসল, ‘কাল কী হয়েছিল ভাইয়ার?’

রুবাব মুনকে এত কিছু বলেনি। শুধু বলেছে সে হাসপাতালে। বন্ধু প্রেমিকার সাথে দেখা করতে গিয়ে চোর অপবাদে ধাওয়া মুত্রে ডুবেছে এটা মুনকে বলতে দ্বিধা হলো সৈকতের। কিছুটা সময় নিয়ে বলল,
” রাতে বেরিয়েছিল ও। এই তো এই গলির রাস্তার কংক্রিটের উপর পড়ে গেছে। ”

মুন ব্যাথাতুর চোখে চেয়ে বলল, “আমাকে না ডেকে আপনাদের ডাকল কেন?’

সৈকত ধীরে জবাব দিল, ‘তুমি ঘুমাচ্ছিলে বলে রুবাব জাগাতে চায়নি। ‘

মুনের চোখ ভরে গেল জলে। দুই এক ফোঁটা চোখ ভেদ করে গড়াল গালে। ওর মুখে বৃষ্টির চটা। বৃষ্টি ফোটা আর অশ্রু ফোটার পার্থক্য ধরতে পারল না সৈকত। অশ্রুকে বৃষ্টি বলেই ধরে নিল। টের পেল যখন অশ্রুফোটা জলপ্রপাতের মতো ঝরতে লাগল। সৈকত হকচকিয়ে গেল। সান্ত্বনাসূচক বাণী ছুঁড়ল, কোমল স্বরে,
‘ বেশি চোট পায়নি। জাস্ট আগের নখে আঘাত লেগেছে, সকালে ড্রেসিং করতে হবে বলে রাতটা রেখে দিয়েছি। চিন্তার কারণ নেই।’

সান্ত্বনায় মুনের কান্নার বেগ কমলেও বন্ধ হলো না। চোখ ভরতি জলে ভাটা পড়ল না। স্বপ্নবধূর অশ্রুভেজা চোয়াল ভালো ঠেকল না সৈকতের। সে অনুধাবন করল, মুনের কান্না তার অসহ্য লাগছে। এটা বিরক্তি নয়, এটা খারাপ লাগার অনুভূতি। তার মন কাঁদতে নয়, হাসতে দেখতে চাইছে মুনকে। সৈকত কোমল সুরে বলল,
‘ রুবাব ঠিক আছে তো! আজই রিলিজ দিবে। কাঁদছো কেন! প্লিজ কেঁদো না, চন্দ্রকথা!’

বিষাদের চাপে মুনের খেয়াল হলো না, আজও আনমনে সৈকত ওকে ‘চন্দ্রকথা’ সম্বোধন করেছে। মুন বিষন্ন হয়ে রইল। ওর এই বিষন্নতা আজ কাঁটার বিঁধল সৈকতের। সে রুবাবকে কল দিল। ফোন তুলতেই আগ বাড়িয়ে জানিয়ে দিল সে কী কী বাহানা দিয়েছে। সেই সাথে বলল,
‘ধর, তোর বোনকে বুঝা তুই ঠিক আছিস। মেয়েটা মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে কাঁদছে।’

রুবাব স্মিত হাসল। ১৯বছর বয়সী তার এই বোনটা একটু বেশিই ইমোশনাল, তা সে বেশ জানে। বোনের এই কান্না ঠেকাতেই জানায় নি। রুবাব কোমল স্বরে কতশত বলে কান্না থামাল বোনের।

বৃষ্টি ঝাপটা কমে এলো। উবার পেয়ে ওরা হাসপাতালে চলে গেল। ঘরের বেশভূষায় একটা নারীর পাশে বসে থাকতে সৈকতের অস্বস্তি হচ্ছিল বটে। ভাইয়ের সান্ত্বনায় মুন কিছুটা শান্ত হলেও হাসপাতালে গিয়ে ভাইকে দেখেই অশান্ত হয়ে গেল । হাতে পায়ে ব্যান্ডেজে একাকার। আগে এক পা ছিল, এখন দুই পায়ে ব্যান্ডেজ়। মুন শব্দ করে কেঁদে ফেলল,
‘কী হাল করেছো নিজের! বেরুতে মানা করেছিলাম। একটা কথাও শুনোনা। আমি মা বাবাকে সব বলে দিব। ‘
অশ্রু ঝরাতে ঝরাতে বকা দিয়ে গেল মুন। রুবাব হেসে বোনের মাথায় হাত রেখে বলল, ‘কাঁদছিস কেন! আমি ঠিক আছি তো!’

মুন নাক টেনে বলল, ‘আমাকে ডাকলে না কেন! সকালে উঠে তোমাকে না দেখে আমার ভীষণ চিন্তা হচ্ছিল।’

মুন একাধারে ভাইকে শাসন করতে লাগল। ডাক্তার কী বলল, কী ওষুধ দিল, ওষুধ খেয়েছে কি না! কত খোঁজ তার!
রুবাবের ঠোঁটের কোণে হাসিটা সরছে না। বোনের উদ্ধিগ্নতা দেখে কী ভীষণ ভালো লাগছে তার! পৃথিবীতে মায়ের পরে বোনেরা ছেলেদের সবচেয়ে বেশি যত্ন করে। বোনের ভালোবাসার সাথে কোন ভালোবাসার তুলনা হয় না। বড়ো হোক কিংবা ছোটো প্রতিটা ভাইয়ের জন্য বোনের অফুরন্ত ভালোবাসা আর যত্ন বরাদ্দ থাকে।

মুগ্ধ চোখে তিন যুবক দেখছে ভাই-বোনের খুনসুটিময় চমৎকার দৃশ্যখানা। সৈকতের চোখের ভাষা ভিন্ন। ওর বোন নেই। ওরা দুই ভাই। বোনের ভালোবাসা, যত্ন পায়নি। এই ক্ষণে মুনের যত্নবোধ দেখে আফসোস হলো, ওর যদি একটা বোন থাকতো তবে খুব ভালো হতো। আগে হলে সেই বোনের জায়গা মুনকেই দিতে পারতো। কিন্তু আজকাল মুন বোনের জায়গা থেকে সরে গিয়ে মনের দিকে ওগুচ্ছে। এই যে এখনো চেয়ে আছে মেয়েটার পানে, বাকি দুই বন্ধুর চেয়ে ভিন্ন দৃষ্টিতে। মেয়েটাকে দেখতে ভালো লাগছে ওর, বারবার দেখতে ইচ্ছে করছে। ও কী চন্দ্রকথার প্রেমে পড়ে যাচ্ছে! ভেতরে ঝাঁকি দিল। এটা ঠিক না। রুবাব মানবে না। সৈকত বলল,
‘আমি দেখে আসি, ডাক্তার এলো কি না।’

রুবাব বলল, ‘ সৈকত তুই বরং বাসায় চলে যা। ভিজে গেছিস, আবার ঠান্ডা লেগে যাবে। রাতে ও ঘুমাসনি, ফ্রেশ হয়ে ঘুম দিস।’

সৈকত বেরিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘ চিল! কিছু হবে না। সবাই একসাথেই যাই। ‘

বন্ধুকে এমতাবস্থায় ফেলে যেতে বড্ডো আপত্তি সৈকতের। মুন ও বলল, ‘এখন তো আমি আছি। আপনারা সবাই বাসায় চলে যান না হয়! ‘

নাহিদ বলল, ‘ আমরা থাকতে তুমি এত কষ্ট করবে কেন পিচ্চি! রুবাবের জন্য আমরা আছি, সবসময়। ওকে ফেলে কেউ যাচ্ছি না। একসাথে ফিরব।’

নির্দ্বিধায়, তীব্র অধিকারবোধ নিয়ে বলল নাহিদ। সবার চোখে চোখে ঘুম, শরীরে ক্লান্তি। নির্ঘুম রাতে ওমন দৌড়াদৌড়ির পর একটু ঘুম না হলেই নয়। তবু্ও তারা অনড়। বাকি সব গোল্লায় যাক, বন্ধুর পাশ ছাড়ছে না। রুবাব আবার মুগ্ধ হলো, ও ভুল কাউকে বন্ধু বানায়নি। ও যাদের বন্ধু বানিয়েছে, তারা পাশে থাকতে জানে, পাশে রাখতে জানে, বন্ধুত্ব জানে।

সকাল বেলা ডাক্তার এলো। চেকাপ করে, ড্রেসিং
করে রিলিজ দিল। তিনদিন বাদে আবার এনে ড্রেসিং করতে হবে। সাথে মেডিসিন দিল ।
সমস্যা বাঁধল বিদায় বেলা। রুবাব হেঁটে যেতে পারবে না। অন্তর হুইলচেয়ারের জন্য গেল, খালি পেল না। হতাশ হয়ে ফিরল। সৈকত বাঁকা হেসে বলল,
‘আয়, আমি তোরে কোলে নিই।’

রুবাব ভীত স্বরে বলল, ‘তোরে কোলে যাব না। তোর নজর আর মতলব, কোনটাই ভালা না।’

সৈকত রুবাবের ভাবভঙ্গি দেখে শব্দ করে হেসে ফেলল। বলল,
‘আমি কোনদিন কোন ছেলেরে কোলে নি নাই। আজ তোরে কোলে নিয়ে দেখব, ছেলেদের কোলে নিতে কেমন লাগে। আয়, প্লিজ!’

রুবাব কপট রাগ দেখিয়ে বলল, ‘দরকার হলে সারাজীবন হাসপাতালে থাইক্যা যাব। সেঁজুতিরে ডাইকা আইনা, এখানেই সংসার পাতব। জায়গায় অভাব হলে ওয়াশরুমে ডাইনিং টেবিল বসিয়ে ক্যান্ডেল লাইট ডিনার করব। তবুও তোর কোলে উইঠ্যা নিজেরে কলঙ্কিত করব না। ‘

থেমে বাকি দুই বন্ধুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দোস্ত আমারে বাঁচা! এই শা লা প্রেমিক প্রেমিক আচরণ করতেছে। আমার ভয় লাগছে।’

অন্তর আর নাহিদ মুখ চেপে হাসছে। মুন বোকার মতো চেয়ে আছে। অন্তর বলল, ‘রাত থেকে তোরা যা শুরু করছস। এখন ভয় আমার তোদের দুজনের উপরই লাগতেছে। ‘

নাহিদ উৎসুক হয়ে বলল, ‘রাতে কী কাহিনি হইছে? আমারে ক!’

অন্তর এবার শার্ট খোলার ব্যাপারটা রসিয়ে রসিয়ে বলতে লাগল। এ নিয়ে সে কী হাসাহাসি! ওরা যেন ভুলেই গেছে এখানে মুনের উপস্থিতি। আকস্মিক সৈকতের নজর পড়ল মুনের উপর। ভ্রু কুঁচকে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে চেয়ে আছে মেয়েটা। চোখে অবিশ্বাস! মুন ওকে নিয়ে কী ভাবছে! রুবাব যেভাবে একে উপস্থাপন করল তাতে যে অর্থ দাঁড়ায় সেটা ভাবতেই কেশে উঠল সৈকত। ভীষণ বিব্রতবোধ করল। সঙ্কোচে বেরিয়ে পড়ল রুম থেকে। ওর এহেন কান্ড দেখে হুঁশ হলো সবার। মুনের উপস্থিতি টের পেয়ে ইতস্ততবোধ করল। বোনের সামনে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলায় লজ্জাজনক পরিস্থিতি পড়ল রুবাব। বোকা হেসে বলল,
‘ তুই আছিস! আমি ভাবছি তুই নিচে চলে গেছিস।’

মুন ভাইয়ের দিকে অবিশ্বাসী চাহনি দিয়ে বেরিয়ে গেল। শেষ অবধি নাহিদ বন্ধুকে কোলে নিয়ে নিচে নামাল। মুনকে বাসায় পাঠিয়ে ওকে রুবাবকে নিয়ে ফিরল বন্ধুদের ফ্ল্যাটে। ভাইকে নিজ বাড়ি ছেড়ে বন্ধুদের বাসায় যেতে দিতে বেজায় আপত্তি মুনের। নাহিদ বুঝিয়ে বলল ওকে,
‘দেখো, রুবাবের শরীরের যা অবস্থা, তাতে দিন দশেক ওকে বেডরেস্ট নিতে হবে। কিন্তু ও বাসায় থাকলে রাত বিরাতে সেঁজুতির বাসার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাবে। আবার হোঁচট খেয়ে বাসায় ফিরবে। আন্টি আংকেল ব্যাপারটাকে খারাপভাবে নিবেন, কষ্ট পাবেন। সবচেয়ে বড়ো কথা, রুবাবের এখন সেঁজুতিদের এলাকায় যাওয়া সেইফ না। সেঁজুতির ভাই ওকে হন্য হয়ে খুঁজতেছে। হাতের নাগালে ফেলে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দিবে। এতে জীবন এবং ক্যারিয়ার দুটোই যাবে। তারচেয়ে ভালো আমাদের এখানে থাকুক, আমরা দেখে রাখব ওকে। কোন সমস্যা হবে না এখানে।’

মুন বুঝল পুরো ব্যাপারটা। ভাইয়ের উপর রাগ হলো, একটা মেয়ের জন্য এত পাগলামোর মানে হয়! রেগে বলল, ‘একদম শিকলে বেঁধে রাখবেন। না হয় আমাকে জানাবেন, আমি এসে বাঁধব।’
নাহিদ হাসল, ‘আচ্ছা।’

মুন নরম সুরে বলল, ‘ভাইয়া বুয়ার রান্না খেতে পারে না। আপনাদের বাসার রান্না তো বুয়া করে। ভাইয়া খেতে পারবে না। আমি ভাইয়ার জন্য খাবার নিয়ে যেতে পারব?’

নাহিদ আবার হাসল, ‘পারবে।’

মুন আবার বলল, ‘ভাইয়ার কাপড়চোপড় ও তো নেই। আপনারা একজন চলুন আমার সাথে, আমি ভাইয়ার জিনিসপত্র দিয়ে দিই।’

নাহিদ সায় জানিয়ে গেল। মুন আরও কত কী বলে বিদায় নিল। নাহিদ মুনের যাওয়ার পানে চেয়ে রইল। ওর মনে পড়ল নিজের বোনের কথা। তার ছোটো বোন ও মুনের বয়সী। নাম নুহা। গ্রামের বাড়িতে থাকে বাবা মায়ের সাথে। দুমাসে একবার গ্রামে যায় সে,দিন তিনেকের জন্য। সেদিন বোনটার কত যত্ন, কত জমানো গল্প। ওর কাপড় অবধি ধুয়ে দেয়। নাহিদ ফোন বের করে নুহার নাম্বার ডায়াল করল।

__________

পরদিন সকাল সকাল হাসির শব্দে ঘুম ভাঙল সৈকতের। কাঁচা ঘুম ভেঙে যাওয়ায় বেশ বিরক্ত হলো। সেই বিরক্তির মাত্রা বাড়ল, যখন দেখল মুন বসে আছে ওর থেকে কিছুটা দূরে। এই মেয়েটা আচ্ছা জ্বালাচ্ছে তো! শয়নে স্বপনে এসে হানা দিচ্ছে। ঠিকমতো মনোযোগ বসছে না পড়ায়। দু’দিন যাবত যে রঙে ঢঙে দেখা দিচ্ছে তাতে কেবল তারই খেয়াল আছে। যেন মাথা কিনে নিয়েছে। এটাও নিশ্চয় কল্পনা! নয়তো এই সাতসকালে ওর ঘরে কী করবে চন্দ্রকথা।

আবার ঘুমে ঘোরে ডুবল। আকস্মিক চোখ খুলল। ঘাড় ঘুরিয়ে একবার চাইল পাশে, তারপর নিজের দিকে তাকাল। নিজের উদাম গা আবিষ্কার করে তড়িৎ উঠে বসল।

চলবে…