অশান্ত বসন্ত পর্ব-২৪+২৫+২৬

0
287

#অশান্ত বসন্ত।
(২৪ পর্ব)
জয়া চক্রবর্তী
***********************
কলেজ থেকে ফিরে মুখ- হাত-পা ধুয়ে ড্রেস পালটে নিলো পিউ। তারপর দাদাভাইয়ের মতো এক মাগ কফি বানিয়ে ব্যলকনিতে এসে বসলো। দাদাভাইয়ের ফ্ল্যাটের এই ব্যলকনিটা পিউয়ের দারুণ পছন্দের। কফির চুমুকের সাথেই মাকে ফোন করলো পিউ। রোজই এই সময়টা মায়ের সাথে ফোনে গল্প না করলে মন ভরেনা পিউয়ের।

পিউ জানে ও ব্যাঙ্গালোরে দাদাভাইয়ের কাছে থেকে যাওয়ার কারনে ওর মা বড্ড একা হয়ে পরেছে। পিউয়ের বাবা তো শুধু পিউ আর দাদাভাইয়ের বাবা নয়,মায়ের বাবার ভূমিকাটাও নিখুঁত ভাবে পালন করে চলেছে মানে সারাদিন শুধু খিটমিট।

অবশ্য পিউয়ের অন্য বন্ধুর বাবারা এইরকম খিটখিটে নয়।ওদের বাবারা কতো ফ্রেন্ডলি।সেই কারনে ওরাও মায়ের চাইতে বাবাকেই বেশি প্রাধান্য দেয় জীবনে।তবে ওদের দুই ভাইবোনের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আলাদা।মা ই ওদের সবচেয়ে কাছের জন।

ফোনটা একবার বাজতেই মায়ের মিষ্টি স্বর।’ তুমি কি ফোনের পাশেই বসেছিলে মা?’,সীমা বললো,’ ফোনটা হাতেই ছিলোরে।অঞ্জনা ফোন করেছিলো,তোর নাম্বার চাইলো’,পিউ বললো,’তুমি দাওনি তো?’,সীমা হেসে বললো,’কি বলে না বলতাম?অঞ্জনা তো শুধু আমার বন্ধু নয়।তোর হবু শ্বাশুড়ি বলে কথা’।

পিউ বললো,’কেন দিতে গেলে ফোন নাম্বার?ফোন করলে কি কথা বলবো আমি শুনি ?’,সীমা হেসে বললো,’কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিবি।তবে আমার মনে হয় সৃঞ্জয়কে দেবে তোর নাম্বার’।সৃঞ্জয় হয়তো অঞ্জনা মাসির ছেলের নাম!কথাটা মাথায় আসতেই পিউ লজ্জা পেলো একটু।তাও কপট রাগ দেখিয়ে মাকে বলে,’না দিলেই পারতে নাম্বারটা’।
সীমা হেসে বললো, ‘আমি চাই তুই সৃঞ্জয়কে একটু জেনেনে।তোর বাবার স্বভাবের মনে হলে জানাস আমায়। আমি নিজেই তখন উদ্যোগ নিয়ে বিয়ে ভেঙে দেবো’।

পিউ মায়ের কথা শুনে কি যেন ভেবে একটু উদাস হয়ে পরলো। তারপর বললো,’ঠিক আছে মা। সৃঞ্জয় ফোন করলে আমি পরিচিতিটা বাড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করবো’।আরো বেশ কিছু কথাবার্তার পর ফোন রেখে স্নানে ঢুকলো পিউ।

পুরো ফ্ল্যাটে এই সময়টা একাই থাকে পিউ। একলা দুপুর, স্মৃতির ভাড়ে মন খারাপ বয়ে আনে। পিউয়ের মনে পরে গেলো পরাগের শেষ কথা গুলো। ‘বড্ড সেকি তুমি।সেই মান্ধাতা আমলের মাসিমাদের মতো মানসিকতা তোমার।তোমার সাথে পোষাবে না আমার।আমি আধুনিক মানসিকতার মানুষ, আর তুমি পিছিয়ে পরা দলের’ ,পরাগের কথাগুলো মনে পরতেই চোখ ফেটে জল আসতে চাইছে পিউয়ের।কতোদিন আগের কথা,অথচ মনে হয় এই তো সেদিন।

একাদশ শ্রেণীতে উঠেই দাদাভাইয়ের থেকে নতুন স্মার্টফোন পায় ভাইফোঁটায়। আর একাউন্ট ও খোলে ফেসবুকে ।সেখানেই পিউ পরিচিত হয়েছিলো পরাগের সাথে। বাবা মায়ের চোখ এড়িয়ে রাতের দিকেই কথা হতো দুজনের। শুরুতে টুকটাক কথা, এই কে কোথায় থাকে? কি পড়াশোনা করে এসব। তারপর সেই টুকটাক কথা থেকেই হাজার কথার আদান-প্রদান।
আর তারপরেই একদিন এলো সেই মুহুর্ত টা যখন পরাগ জানালো,’ ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছি তোমায় পিউ”।ভালো লাগার পারদ বাড়ছিলো পিউয়ের দিক থেকেও। নতুন সম্পর্কটা পিউকে যেন রঙিন প্রজাপতি বানিয়ে দিলো।

পরাগ দেখা করতে চাইলো। বললো,প্লেটোনিক লাভে বিশ্বাসী নয় সে।তাই সম্পূর্ণ ভাবে পেতে চায় পিউকে।
পিউ অরাজী ছিলো এমন নয়,পিউ ও চাইতো পরাগকে।তবে একটু সময় চেয়েছিলো।
পরাগ বিরক্ত হলেও রাজি হয়েছিলো পিউয়ের কথায়। তবে যতো দিন যেতে থাকে পরাগের ব্যবহারে পিউয়ের মনে হচ্ছিলো পরাগ বোধহয় ওকে কাটাতে চাইছে। পরাগ সুযোগ পেলেই পিউকে জানাতো যে ওর আগের গার্লফ্রেন্ড অতীব সুন্দরী ছিলো।পিউ তার ধারেকাছেও যায়না।এমনকি তার ড্রেসিং সেন্স ও অনেক উন্নতমানের,পিউয়ের মতো নয়।

তাছাড়া মাঝেমাঝেই পিউ পরাগকে অনলাইনে দেখে মেসেজ করলেও পরাগ রিপ্লাই দিতো অনেক দেরিতে।মেসেজ চলাকালীন ও বারবার বেরিয়ে যেতো ইনবক্স থেকে।পিউ প্রশ্ন তুললে বলতো,’সন্দেহপ্রবন,পাগল, হিংসুটে’।

পিউ ভিতরে ভিতরে ভেঙে পরছিলো।বুঝতে পারছিলো কোথাও ভীষণ একটা ভুল করে ফেলেছে।কিন্তু তাও পরাগের ওপর অন্ধপ্রেমে আঁকড়ে ধরতে চাইছিলো ওকে। পিউ এটাও বুঝেছিলো,এই সম্পর্ক চলতে থাকলে ও নিজেকে হারিয়ে ফেলবে পরাগের ইচ্ছের তীব্রতার উন্মাদনায়।তবুও সরে যাওয়ার কথা ভুলেও ভাবতে পারছিলোনা।
কিন্তু যেদিন পরাগ পিউকে সেকি,মান্ধাতা আমলের বললো, সেদিন পিউ বুঝেছিলো আর বাড়িয়ে লাভ নেই সম্পর্কটা।

রাতের পর রাত বালিশ ভিজিয়েছে কিন্তু পরাগের কাছে আর যায়নি।পরাগকে মুক্তি দিয়ে সরে গিয়েছিল সম্পর্কটা থেকে।পরাগ খুঁজে পাক ওর নিজের মতো উদার আধুনিক মানসিকতার সুন্দর ড্রেসিং সেন্স আর আদিম উদ্দামতায় নিজেকে ভাসিয়ে দেওয়ার মতো সঙ্গিনী।

কলিংবেলটা বেজে উঠলো। পিউ ভেজা গায়েই ঢোলা টিশার্ট আর প্যান্ট পরে বেরিয়ে আসলো।দরজা খুলতেই পুরো হাঁ মুখ পিউয়ের।সামনে দাদাভাই আর বহ্নিদি দাঁড়িয়ে।পিউ বহ্নিকে বললো,’আজ অফিস যাওনি তোমরা? ‘পল্লব হেসে বললো,’আগে দরজা ছেড়ে ঢুকতে দে আমাদের’।পিউ হেসে বললো,”হ্যাঁ এসো’।

দরজা থেকে পিউ সরে দাঁড়াতেই,বহ্নি সোজা বাথরুমে গিয়ে হাত পা ধুয়ে টাওয়াল নিয়ে আসলো।পিউকে বললো,’এবার বুঝেছি তোর ঠান্ডা কেন লাগে!তুই তো চুলটাও মুছিস না স্নান সেরে’।তারপর আলতো হাতে পিউয়ের চুল মোছাতে থাকে।পিউয়ের মায়ের কথা মনে যাওয়াতে চোখ ছলছল করে ওঠে।বলে,’আসলে এগুলো তো মা খেয়াল রাখতো’।

পল্লব ব্যাপারটা খেয়াল করে।বলে,’আচ্ছা আগামীকাল থেকে সকালের দিকে কলেজ যাওয়ার আগে স্নান করিস,আমি না হয় তোর চুল মুছিয়ে দেবো।এবার চোখের জলটা মুছে একটা সিরিয়াস কথা শোন’।
পিউ বললো,’মোটেও কাঁদছিনা আমি।বল কি বলবি?’বহ্নি বললো,’আসলে দারুণ একটা সমস্যায় পরে গেছি, হঠাৎই আমাকে ছয় মাসের ট্রেনিং এ মুম্বাইতে পাঠানো হচ্ছে।’ দিদিয়াকে নিয়ে চিন্তায় পরে গেছি’।পিউ হেসে বললো,’এতে চিন্তার কি আছে?শিখাদি তো আমাদের সাথেই থাকতে পারবে’।

পল্লব বললো,’সেটা আমিও বলেছি। আর আমার মনে হয় আজ কালের মধ্যেই তোমরা এখানে শিফট হয়ে যাও।পরশুদিন আমিই তোমায় ফ্লাইট ধরিয়ে দেবো’।
পিউ বললো,’আচ্ছা শিখাদির থেরাপির কি হবে?’বহ্নি বললো,’বরুন সাহার সাথে আমরা কথা বলে নিয়েছি।তবে উনি ওনার সময় সুযোগ মতো আসবেন,নির্দিষ্ট সময় দিতে পারেননি’। ঠিক তখনই পিউয়ের ফোনটা বেজে উঠলো।

(চলবে)

#অশান্ত বসন্ত।
(২৫ পর্ব)
জয়া চক্রবর্তী
**********************
পল্লব দুচোখের পাতা এক করতে পারছেনা। এদিকে ঘড়ির কাঁটা বলছে এখন রাত সাড়ে তিনটে।
ঘন্টাখানেক আগে ডাইনিং এ বসে বহ্নিকে প্যাকিং এ সাহায্য করছিলো পল্লব। বহ্নি চাইছিলো বাকি রাতটা ব্যলকনিতে বসেই কাটিয়ে দেবে গল্প করে।

কিন্তু পল্লব রাজি হয়নি।বলেছে,’নতুন জায়গায় যাচ্ছো,সেখানে শরীর খারাপ হলে কে দেখবে?’

বহ্নি বলেছিলো,’অন্তত আধ ঘন্টা তো ব্যলকনিতে বসতেই পারি আমরা’। পল্লব আর না করেনি।
বহ্নিকে যেতে বলে রান্নাঘর থেকে দু-মাগ কফি
বানিয়ে এনেছিলো।

ব্যলকনিতে গিয়ে কফি মাগ দুটো রাখতেই বহ্নি পল্লবকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেছিলো। পল্লবের ও কাঁদতে ইচ্ছে করছিলো,অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করছিলো বহ্নিকে । কিন্তু ও শুধু বহ্নির চুলে হাত বুলিয়ে দিয়েছিলো, দুরন্ত প্রেমের অসহ্য আবেগের স্পন্দন বুকে চেপে রেখে।

কিছু সময় পরে বলেছিলো, ‘কফিটা খেয়ে নাও ঠান্ডা হয়ে যাবে’।

আসলে প্রেম যতই দেহ-নির্ভর হোক না কেন,শেষ পর্যন্ত মনের জগতেই তাঁর স্থায়ী স্বাক্ষর সে রেখে যায়। দুরন্ত অস্থির বলিষ্ঠ প্রেম নয় বরং অর্ধস্ফুট স্বপ্নময় প্রেমের পরিচয় করাতে চায় সে বহ্নির সাথে।

এমনিতেই যে বহ্নির নিজের বাবার কারনে পুরুষ জাতির ভালোবাসার উপর অবিশ্বাস জন্মে গেছে।
তাই সময় দিতে চায় বহ্নিকে। সম্ভব অসম্ভবের সীমানায় দাঁড়িয়ে আশায় বুক বাঁধে পল্লব।

যদি সম্পূর্ণভাবে নিজের করে না-ই বা পাওয়া যায় তাহলে হাতে হাত ছুঁয়ে,কথা দিয়ে মন হাতড়িয়ে, আংশিক পেয়ে লাভ কি!

পল্লব জানে অতীতের কিছু স্মৃতির কারনে বহ্নি বৈবাহিক জীবনে আসতে চায়না।ভুলতে চাইলেও সেই স্মৃতি থেকে বের হতে পারেনা।কিন্তু পল্লব আশাবাদী। পল্লব বিশ্বাস করে বিবাহের সেই শুভ মুহুর্তটা অবশ্যই আসবে তাদের জীবনে।

ছয়টার এলার্মে বহ্নির ঘুম ভাঙতেই দেখে দিদিয়া জানালার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। এই দুদিন পিউয়ের সাথেই দিদিয়ার বিছানা করে দিয়েছিলো পল্লব।বলেছিলো,যেহেতু বহ্নি ছয় মাস থাকবে না তাই শিখার সাথে পিউয়ের বন্ধুক্তটা জরুরি। নিজের বিছানাটা ছেড়ে দিয়েছিলো বহ্নির জন্য। আর ডাইনিং এ সোফা কাম বেডে পল্লব নিজের শোওয়ার ব্যবস্থা করেছিলো।

একটু বাদেই বেরিয়ে যেতে হবে ফ্লাইট ধরতে।বহ্নি বিছানা ছেড়ে উঠে দিদিয়ার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।দিদিয়াকে যে কি করে ছেড়ে থাকবে বহ্নি! দিদিয়ার পিঠে হাত রাখতেই অসহায় চোখে তাকালো দিদিয়া।

বহ্নি গতকালই জানিয়েছে দিদিয়াকে ওর ছয় মাস না থাকার কথাটা।তখন থেকেই দিদিয়ার মুখটা থমথমে। যদিও পল্লব আর পিউ বহ্নিকে ভরসা দিয়েছে যে ওরা দিদিয়াকে ভালো রাখবে।বরুন সাহার সাথে ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলবার পরে উনিও ভরসা দিয়েছেন বহ্নিকে।

ওনার সাজেশন মতো আজ থেকে শিখাকে আঁকা শেখাবার জন্য একজন আসবেন।সেই অনুযায়ী গতকালই আঁকার যাবতীয় সরঞ্জাম এনে রেখেছে বহ্নি।

পিউ বলেছে প্রতিদিন কলেজ যাওয়ার আগে ও রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে দিদিয়ার সাথে ভিডিও কলে দেখা করিয়ে দেবে বহ্নিকে।তবু বহ্নির কান্না পাচ্ছে খুব।
পল্লব সবার জন্য কফি বানিয়ে এনেছে।

একটু বাদে রান্নার দিদিও চলে আসবেন। পিউকে কলেজে ভর্তি করবার পর থেকেই ওনাকে রেখেছে পল্লব।

উনিই বেশি টাকা নিয়ে সাথে বাসন মাজা, ঘর মোছা, আর কাপড় কাচাটাও করে দিয়ে যাচ্ছেন।রাতের রান্না ও করে রেখে যান উনি।পল্লব শুধু ভাতটা বানিয়ে নেয় রাতে। ওনাকেও বহ্নি শিখার একটু খেয়াল রাখতে বলেছে এবং জানিয়েছে এরজন্য ফিরে আসার পর ওনাকে খুশি করে দেবেন।

বহ্নি দিদিয়ার শুকনো মুখটা দেখে দিদিয়াকে টাইট করে জড়িয়ে ধরলো।তারপর বললো,’আমি চেষ্টা করবো এর মাঝে যদি এক দুবার আসা যায়’।

পিউ পল্লবের মুখের দিকে তাকিয়ে ফিচেল হাসি হেসে বহ্নিকে বললো, ‘বহ্নিদি এই কথাটা দাদাভাইকেও একবার জড়িয়ে ধরে বলোনা ,মুখটা করে রেখেছে দেখো’। বহ্নি হেসে ফেললো,আর পল্লব ছুটলো পিউয়ের মাথায় গাট্টা মারতে।

(চলবে)

#অশান্ত বসন্ত
(২৬ পর্ব)
জয়া চক্রবর্তী।
********************
শিখাকে নিয়ে বেশ চিন্তায় পরে গেছেন বরুন সাহা।বহ্নি মুম্বাইয়ে চলে যাওয়ার পর থেকে গত সাতদিন ধরে তিনি পল্লবের ফ্ল্যাটে আসছেন থেরাপির জন্য। অথচ শিখা একেবারেই সহযোগিতা করছেনা ওনার সাথে।

থেরাপির সময়টাতেও উদাস দৃষ্টিতে জানালার বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকছে।এইভাবে তো লাভ কিছুই হচ্ছেনা। অনেক ভেবে একটা ছোট্ট সলিউশন বের করেছেন তিনি।

আসলে বৃহস্পতিবার করে অফডে থাকে বরুন সাহার। সেই অনুযায়ী পল্লবের কাছে অনুমতি নিয়ে নেন ওই দিন শিখাকে নিয়ে বাইরে বের হওয়ার। কারন মেয়েটা এতোটাই মন মরা হয়ে থাকছে যে থেরাপিটাও ওকে ঠিক ভাবে দেওয়া যাচ্ছেনা।

পল্লব পরিস্থিতি বুঝে আর না করেনি।সত্যিই কি বহ্নির ফাঁকটা তারা পূরণ করতে পারছে!বাড়ি ফিরে ও অফিসের কাজ করতে হচ্ছে পল্লবকে ।আর পিউয়ের কলেজে হঠাৎ সেমিস্টারের ডেট ফেলায় পিউও বাড়ি থাকলে বই মুখে করে বসে থাকছে। তাই বরুন সাহার প্রস্তাবটা না মেনে নেওয়ার কোনো কারন খুঁজে পায়নি পল্লব।

বরুন সাহা ঘুম থেকে উঠেই তৈরি হয়ে নেন।তারপর পল্লবকে একটা ফোন করেন।পল্লব জানায়, শিখাকে পিউ তৈরি করে দিয়ে কলেজে বেরিয়ে গেছে,বরুন সাহা আসার পর পল্লব ও অফিসে বের হবে।ফোণটা পকেটে রেখে বরুন সাহা গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করতে গেলেন।

‘একটু দেরি হয়ে গেলো আমার।রাস্তায় এতো যানজট ছিলো যে কি বলবো!’,বরুন সাহার কথায় পল্লব হেসে বললো,’না না ঠিক আছে,খুব একটা দেরি হয়নি।আমি শিখাকে ডেকে দিচ্ছি’।পল্লবের ডাকে শিখা ঘর থেকে বেরিয়ে আসলো।একটা পিঙ্ক রঙের সালোয়ার কামিজ শিখার গায়ে, বড়ো বড়ো চোখ দুটো আরো গভীর লাগছে কাজলে।ঠোঁটে পিঙ্ক শেডের লিপস্টিক। শিখার হাত ধরে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে বসান বরুন সাহা।

তারপর গাড়ি চালাতে চালাতে শিখার সাথে অনর্গল কথা বলতে শুরু করেন।যাতে শিখা স্বাভাবিক আচরণ করে।কিন্তু শিখার মধ্যে কোনো ভাবান্তর লক্ষ্য করা যায়না,এমনকি শুনছে নাকি তাও বোঝা যাচ্ছেনা। চুপচাপ বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে।

বরুন সাহা গতকাল রাতেই ঠিক করেছিলেন শিখাকে লালবাগ বোটানিক্যাল গার্ডেনে নিয়ে আসবেন।এই জায়গাটা ওনার বরাবরই খুব প্রিয়।প্রায় ২৮০ একর জায়গার ওপর গার্ডেন। চারিদিকে শুধুই সবুজের সমারোহ।গার্ডেন জুড়ে হাজার প্রজাতির ফুল ও ফলের গাছ।

এছাড়া পুরো গার্ডেন জুড়েই বানানো আছে অসংখ্য শিল্পকর্ম। কোথাও শিশুরা খেলা করছে,কোথাও বা মা দুধ পান করাচ্ছে শিশুকে,আছে অজগর সাপ,কুমির,উটপাখি, ময়ুর সহ অসংখ্য শিল্পকর্ম যা দেখে বোঝবার উপায় নেই সেগুলো কাঠের তৈরি।

বরুন সাহা বহু বছর ওনার মাকে নিয়ে ব্যাঙ্গালোরে থাকেন।বিয়ের দেড় বছরের মাথায় বাচ্চা হতে গিয়ে বৌ মারা যায়।তারপর থেকে নিজেকে আরো বেশি কাজের মধ্যে ডুবিয়ে দিয়েছেন তিনি। প্রতিটি পেশেন্টই তার কাছে একটা চ্যালেঞ্জ।পেশেন্টদের সাইকোলজি বুঝে সেই অনুযায়ী চিকিৎসা করেন তিনি।সেই কারনেই ওনার এতো নামডাক।ওনার থেরাপিতে খুব তাড়াতাড়ি আত্মবিশ্বাস ফিরে পায় পেশেন্ট।

গাড়ি পার্কিং-এ রেখে তিনি দুটো টিকিট কেটে শিখার হাত ধরে ভিতরে প্রবেশ করলেন।তারপর মোবাইল বের করে সাইনবোর্ডে দেওয়া ম্যাপের ছবি তুলে নিলেন।আসলে গার্ডেনের ভিতর অসংখ্য রাস্তা।ম্যাপ না থাকলে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে ।

সবুজের যে কতো বৈচিত্র্য হয় তা এখানে না আসলে বোঝাই যায় না।গার্ডেনের ভিতর ঢুকেই শিখার চোখে একটা চমক খেলা করতে থাকে।ঠিক যেমনটা বরুন সাহা চেয়েছিলেন। শিখা হাত ছাড়িয়ে এগিয়ে গেলো, ছুঁয়ে দেখতে থাকলো প্রকৃতিকে।তবে এতো পর্যটকের ভিড় যে একটু সময় পর নিজে থেকে এসেই বরুন সাহার হাত ধরলো।

এই গার্ডেনে আছে অসাধারণ সুন্দর একটি গ্লাস হাউজ।যার ভিতরেও বিভিন্ন প্রজাতির ফুলগাছ আছে। শিখাকে ঘুরিয়ে দেখাতে থাকেন বরুন সাহা।শিখা ও পরম বিস্ময়ে অপার মুগ্ধতা নিয়ে দেখতে থাকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ভান্ডার।

এরপর শিখাকে তিনি ঘুরে ঘুরে কাঠের শিল্পকর্ম গুলো দেখাতে লাগলেন।শিখা অপার বিষ্ময়ে ছুঁয়ে দেখতে লাগলো সেগুলো।গার্ডেন জুড়ে অসংখ্য পাখি উড়ছে,কিছু পাখি আবার খাঁচায় বন্দি।শিখাকে বরুন সাহা বন্দী পাখিদের নাম জানাতে থাকলেন,কখনো বা ফুলেদের নাম, কখনো বা গাছেদের নাম।

অনেকক্ষণ ধরে ঘুরে ঘুরে হেঁটে ক্লান্ত শিখা,সেটা বুঝতে পেরে শিখাকে নিয়ে একটা গাছের তলায় বসলেন তিনি।তারপর ব্যাগ থেকে জলের বোতল আর বিস্কুটের প্যাকেট বের করে শিখার হাতে দিলেন। নিজে আর একটা বোতল বের করে কিছুটা জল গলায় ঢেলে নিলেন।

শিখা নিজের হাতের বিস্কুটের প্যাকেটটা বরুন সাহার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,’খাও’।নিজে থেকে কথা বিনিময় শুরু করেছে শিখা।এটা লক্ষ্য করে বরুন সাহার মুখে হাসি খেলে গেলো।

(চলবে)