অ্যাডিক্টেড টু ইউ পর্ব-০১

0
615

#অ্যাডিক্টেড_টু_ইউ
#অরনিশা_সাথী
#সূচনা_পর্ব

সাড়ে দশটা নাগাদ আপির ডাকে ধরফরিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলাম। আপি কোমড়ে হাত গুজে রাগী চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আপির রাগ ভাঙানোর জন্য কিউট করে একটা হাসি দিলাম। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হলো না। আপি রাগী স্বরে বললো,
–“এত ঘুমোতে কি করে পারিস তুই? কটা বাজে সেই খেয়াল আছে?”

–“রেগে যাচ্ছো কেন? আজকে তো অফ ডে ঘুমোলে কিচ্ছু হবে না।”

কথাটা বলে আবারো শোয়ার প্রস্তুতি নিতেই আপি বাহু ধরে টেনে বিছানা থেকে নামিয়ে দিলো। আগের ন্যায় আরো বেশি রাগী সুরে বললো,
–“একদম ঘুমানো চলবে না। চুপচাপ ওয়াশরুমে গিয়ে শাওয়ার নিয়ে আসো। ফাস্ট।”

–“এত তাড়াতাড়ি শাওয়ার___”

–“নো মোর ওয়ার্ড। চুপচাপ যাও বলছি।”

কথাটা বলেই আপি আমাকে ঠেলে ঠেলে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে দিলো। আপির এহেন কর্মকান্ডের কারন বুঝলাম না। চুপচাপ গোসল সেরে মাথায় থেকে তোয়ালা খুলে বিছানায় রেখে রুম থেকে বের হয়ে গেলাম। সোফায় গিয়ে ধপ করে বসে টিভি অন করে একের পর এক চ্যানেল পাল্টাচ্ছি। কলিংবেলের শব্দে দরজা খোলার জন্য উঠতে গেলেই দেখলাম আপি গিয়ে দরজা খুলে দিলো। আমার একমাত্র ফুপ্পি মানে আপির আম্মু আর বড় চাচি এসেছেন৷ কিছুক্ষণ বাদে লক্ষ্য করলাম খালামনি আর মামি এসেও হাজির। সাথে দাদার বাড়ী মামার বাড়ীর পুরো কাজিনমহল তো আছেই। হুট করে সবার একসাথে আসার কারন খুঁজে পেলাম না। বাড়িতে কি কোনো অনুষ্ঠান আছে আজ? এইসব ভেবে আপিকে খুঁজতে লাগলাম চারদিকে। দশ মিনিট বাদে আপি নিজেই খাবার প্লেট নিয়ে আমার পাশে বসলো আমাকে খাইয়ে দিতে। আপির দিকে ঘুরে জিজ্ঞেস করলাম,
–“আজকে সবাই মিলে একসাথে আমাদের বাসায় যে? কোনো অনুষ্ঠান আছে কি?”

আমার প্রশ্নের জবাবে আপি ছোট্ট করে ‘হুম’ বলে আমাকে খাইয়ে দিতে শুরু করলো৷ আমি খেতে খেতে আবারো জিজ্ঞেস করলাম,
–“কই আমি কিছু জানি না তো৷ কিসের অনুষ্ঠান আজ বাড়িতে?”

–“সেটা সন্ধ্যায় দেখতে পাবে। এখন চুপচাপ খেয়ে নেও। এখনো অনেক কাজ পড়ে আছে।”

আমি আরো কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারলাম না আপির চোখ রাঙানো দেখে৷ আমাকে খাইয়ে দিয়ে আপি উঠে চলে গেলো৷ আমিও আমার বাকী কাজিনদের সাথে আড্ডা দিতে চলে গেলাম। আমি রাশফিয়াদ রুহি। আব্বু আম্মুর একমাত্র মেয়ে। ফুপ্পির দুই মেয়ে। নীলাদ্রি আর হিমাদ্রি। নীলাদ্রিকেই আপি ডাকি আমি। আমাদের বাসা থেকে আপির ভার্সিটির যাতায়াত সুবিধা হওয়াতে আপি আমাদের সাথেই থাকে। খালামনির এক মেয়ে এক ছেলে। ফারাবী আর ফাইজা। ফারাবী ভাইয়া স্টাডি শেষ করে আংকেলের সাথে বিজনেসে যোগ দিয়েছেন। আমি হিমাদ্রি ফাইজা তিনজনেই এইবার এইচএসসি দিয়ে বিন্দাস লাইফ কাটাচ্ছি। আমরা তিনজনে কাজিন কম বেস্টফ্রেন্ড বেশি। আর মামির তিন বছরের ছোট্ট একটা ছেলে হিয়াজ। এই হচ্ছে আমার পুরো কাজিন মহল।

ফারাবী ভাইয়া শুয়ে শুয়ে ফোন গুতোচ্ছে। আর আমি হিমাদ্রি ফাইজা তিনজনে মিলে জম্পেশ আড্ডা দিচ্ছি। কিছুক্ষণ বাদে হিয়াজ দৌড়ে এসে আমার কোলে বসে পড়লো। আমিও ওকে জড়িয়ে রেখে আড্ডায় মত্ত। ফারাবী ধমকে বলে উঠলেন,
–“এই তোরা থামবি? চুপচাপ বসে থাক নয়তো অন্য কোথাও গিয়ে তোদের এই বকবকানি কান্টিনিউ কর।”

ফারাবী ভাইয়াকে জাস্ট ইগনোর করে আমরা আমাদের মতো আড্ডা চালিয়ে গেলাম। ভাইয়া শেষে বিরক্ত হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। আড্ডার একপর্যায়ে আমি বললাম,
–“আজ বাসায় কিসের এত আয়োজন চলছে রে? জানিস তোরা?”

আমার কথায় ওরা দুজনে কিছুক্ষণ মুখ চাওয়াচাওয়ি করে ফাইজা বললো,
–“কই কিছু নেই তো। আজকে অফডে বলে সকলে একত্রিত হয়েছে।”

ফাইজার কথার প্রত্যুত্তরে আমি আর কিছু বললাম না। হিয়াজকে নিয়ে খেলায় মগ্ন হলাম। দুপুরের লাঞ্চ সেরে সকলে মিলে সোফায় বসে আড্ডা দিচ্ছিলো। আমি হিমাদ্রি ফাইজা তিনজনে এক কোনে বসে ফোনে ফানি ভিডিও দেখছিলাম আর একটু পরপর উচ্চস্বরে হেসে উঠছিলাম। ফলে সকলেই বেশ ক’বার রাগী চোখে আমাদের দিকে তাকিয়েছে। কিন্তু আমরা সেদিকে পাত্তা দেইনি। কলিংবেলের শব্দে ধ্যান ভাঙলো সকলের। আমি মেইন ডোরের কাছাকাছি থাকায় দরজা খোলার জন্য উদ্যত হতেই আম্মু আমাকে থামিয়ে দিয়ে দরজা খুলে দিলেন। আব্বু আম্মুর বয়সী দুজন ব্যক্তি বাসায় ঢুকেই সকলের সাথে কুশলাদি বিনিময় করলেন। সাথেই পনেরো/ষোল বছরের একজন মেয়ে। ফুপ্পি আমার কাছে এসে বললেন,
–“রুহি আম্মু ভিতরে যাও তুমি।”

–“কেন ফুপ্পি? হিমাদ্রি ফাইজা সকলেই তো এখানে আছে তাহলে আমি একা__”

–“হিমাদ্রি আর ফাইজাও তোমার সাথে ভিতরেই যাবে। হিমাদ্রি ভিতরে নিয়ে যাও রুহিকে।”

আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ফুপ্পি বলে উঠলো।আমি আর কিচ্ছু না বলে চুপচাপ আমার রুমে চলে এলাম। কারা এরা? কেন এসেছেন আমাদের বাসায়? আর উনারা আসতেই আমাকে ভিতরে পাঠিয়ে দেওয়া হলো কেন? মাথায় অনেকগুলো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে বাট একটার আন্সারও আমার জানা নেই। বিছানায় বসে বসে পা দুলাচ্ছি আর গুনগুন করে গান গাইছি। তখনই আপি রুমে এলো। বিছানার উপর একটা শাড়ি আর কিছু অর্নামেন্টস রাখতেই আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। আপি আমাকে তাড়া দিয়ে বললো,
–“রুহি ফাস্ট এদিকে আসো। রেডি হতে হবে তোমাকে।”

–“মানে কি? আমি কেন এইসব শাড়ি জুয়েলারি পড়ে রেডি হবো?”

–“দেখতে এসেছে তোমাকে। দেখতে এসেছে বললে ভুল হবে আজ তোমার এনগেজমেন্ট প্লাস বিয়ের রেজিস্ট্রি করা হবে।”

আমি গান বন্ধ করে চমকে তাকালাম আপির দিকে। আপি একমনে শাড়ির ভাজ খুলছে৷ আমি কিছুটা চিল্লিয়ে বললাম,
–“হোয়াট? কি বলছো এসব? মাথা ঠিক আছে তোমার?”

–“রুহি এখন এত কথা বলার সময় নেই। উনারা অনেকটা সময় যাবত অপেক্ষা করছে।”

আপির কথায় পাত্তা না দিয়ে আমি কিছুটা জোরেই আম্মুকে ডাকতে ডাকতে রুম থেকে বের হচ্ছিলাম। আপি তাড়াতাড়ি এসে আমার হাত ধরে আমায় থামিয়ে দিয়ে বললো,
–“বাইরে উনারা সকলে আছেন। তুমি এভাবে চেঁচাচ্ছো কেন? কি মনে করবেন সবাই? বুদ্ধিশুদ্ধি কি সব লোপ পেলো তোমার?”

–“আম্মুকে ডাকো।”

–“মামি ব্যস্ত আছে ওখানে। তুমি এখন চুপচাপ দাঁড়াবে।”

কথাটা বলে আপি আমাকে শাড়ি পড়াতে গেলেই আমি আপির হাত থেকে শাড়িটা নিয়ে বিছানায় ছুঁড়ে মারলাম। এবং বললাম,
–“আমার বিয়ের তোড়জোড় করছো সকলে মিলে একবারো জানিয়েছো আমায়? জানাওনি তো। আমার পছন্দ অপছন্দের কোনো মূল্যায়ন করেছো? আজ কোনো রেজিস্ট্রি ফেজিস্ট্রি হবে না এখানে। রেজিস্ট্রি পেপারে সিগনেচার করবো না আমি।”

কথাগুলো বলতে বলতেই কেঁদে দিলাম আমি।আপি আমার পাশে বসে আমাকে একপাশ থেকে জড়িয়ে নিয়ে বললো,
–“ডোন্ট ক্রাই সোনা। কাঁদে না এভাবে। ছেলে খুব ভালো মামা মামি ইভেন সকলেরই খুব পছন্দ হয়েছে।”

–“আমার পছন্দ অপছন্দ বলেও একটা কথা আছে। তাছাড়া যার সাথে সারাজীবন থাকবো সে কেমন ভালো না খারাপ কিছুই তো জানি না আমি।”

–“ছেলেটা খুব ভালোবাসে তোমাকে। তিন বছর ধরে মামার পিছু পড়ে ছিলো তোমাকে পাওয়ার জন্য তোমার প্রতি ছেলেটার এমন পাগলামি দেখে লাস্ট ছ’মাস আগে মামা রাজি হইছে।”

এরকম আরো অনেক কথাই আপি বলছে। কিন্তু আমার কানে কিছুই যাচ্ছে না। আমি একইভাবে বসে চোখের পানি ফেলছি। আপি উঠে আমাকে দাঁড় করিয়ে বললো,
–“এখন চুপচাপ এখানে দাঁড়াবে৷”

আমি কিছু না বলে আবারো বিছানার অন্যপাশে গিয়ে বসে চোখের পানি ফেলছি। আপিকে ডাকতে ডাকতে আম্মু রুমে এলো। আপিকে শাড়ি হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আম্মু বললো,
–“নীলাদ্রি রুহিকে এখনো রেডি করাওনি?”

–“মামি তোমার মেয়েকে আমি বোঝাতে পারছি না। দেখো না বসে বসে কাঁদছে। তাদের সামনে নাকি যাবে না ও।”

আম্মু আমার দিকে একবার তাকালো৷ তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমার পাশে বসে বললো,
–“কাঁদছো কেন এভাবে? ওরা আজকেই তো আর তোমাকে নিয়ে যাচ্ছে না। তোমার স্টাডি শেষ হলেই অনুষ্ঠান হবে। আপাতত__”

–“আমি কি তোমাদের কাছে বোঝা হয়ে গেছি আম্মু? যার কারনে এখনই তাড়ানোর বন্দবস্ত করছো।”

আম্মু আমাকে জাপটে ধরে কেঁদে ফেললো। আমিও আম্মুকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কাঁদছি। কিছুক্ষণ বাদে আব্বুর গলার আওয়াজ পেয়ে আম্মু আমাকে ছেড়ে দিয়ে চোখের পানি মুছে দিলেন। তারপর বললেন,
–“আমরা কখনো তোর খারাপ চাই না মা। তোর আব্বু নিজে অনেকটা সময় যাচাই-বাছাই করে রাজি হয়েছে। তোর আব্বুর উপর একটু ভরসা রাখ মা।”

কথাগুলো বলে আম্মু আমার কপালে একটা চুমু খেয়ে আপিকে বললেন আমাকে রেডি করে দিতে। তারপর নিঃশব্দে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন৷ আমি পাথরের ন্যায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। আপি আমাকে শাড়িটা পড়িয়ে দিয়ে চোখে কাজল আর ঠোঁটে নুড কালার লিপস্টিক লাগিয়ে দিলো। চুলগুলো হাতখোপা করে কাটা লাগিয়ে সামনে কিছুটা চুল বের করে দিলো। আমি পুতুলের ন্যায় বসে আছি। কিছুক্ষণ বাদে আব্বু গলা ঝেড়ে রুমে প্রবেশ করলেন। গুটিগুটি পায়ে আমার পাশে এসে বসলেন। অভিমানে আব্বুর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলাম আমি। আব্বু আমায় নিজের দিকে ঘুরিয়ে কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে দিয়ে বললেন,
–“আব্বুর উপর অভিমান করে আছো তাই না? তোমাকে না জানিয়ে এতবড় একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য? কাল রাতে হুট করেই সব ঠিক হয়। তুমি ঘুমিয়ে ছিলে তাই আর ডাকিনি। এমন একদিন আসবে যে দিন তুমি নিজে আমার এই সিদ্ধান্তের জন্য খুশি হবে দেখো আম্মু।”

আমি তারপরও কিছু বললাম না। চুপচাপ মাথা নিচু করে চোখের পানি ফেলছি। আব্বু আবারো বললেন,
–“আমি ভেবেছিলাম আমার মেয়ের আমার উপর আস্থা আছে। ভরসা করে আমাকে। আমার সিদ্ধান্তে সে খুশি হবে। কিন্তু আমি কি ভুল ছিলাম আম্মু? আমি তাহলে গিয়ে না করে দিচ্ছি। তোমায় যেতে হবে না কারো সামনে।”

কথাটা বলে আব্বু চলে যেতে নিলেই আমি আব্বুকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিলাম। কাঁদতে কাঁদতেই বললাম,
–“তোমার উপর আমার বিশ্বাস ভরসা আস্থা বাকী সবার থেকে খুব বেশি। কিন্তু আব্বু এখনই কেন? এখনই বিয়ের জন্য এত তাড়াহুড়ো কেন করছো? আমি কি তোমাদের কাছে বোঝা হয়ে গেছি?”

–“এখনই তোমাকে যেতে দিচ্ছি না আমি৷ তোমার স্টাডি শেষ হবে তারপর ওই বাসায় যাবা তুমি। উনারা অস্থির হয়ে আছে রেজিস্ট্রি করার জন্য৷ তাই একপ্রকার বাধ্য হয়েই এখন___যাই হোক বাদ দাও এসব। আর একটা কথা মেয়েরা সবসসময় বাবার কাছে রাজকন্যা হয়ে থাকে। বাবারা কখনো মেয়েকে বোঝা মনে করে না৷”

কথাটা বলে আব্বু উঠে চলে গেলেন। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আবার আমার দিকে ঘুরে বললেন,
–“তোমার মন যেটা বলে সেটাই করো। তোমার যদি আমার উপর আস্থা থাকে তাহলে নীলাদ্রির সাথে বাইরে এসো। আর যদি মনে হয় এতে তুমি ভালো থাকবে না তাহলে___”

–“আসছি আমি।”

চোখের পানিটা মুছে কথাটা বললাম আব্বুকে। আব্বু মুচকি হেসে বেরিয়ে গেলেন। কান্না করার জন্য চোখের কাজল লেপ্টে গেছে তাই আপি আমাকে রাগারাগি করে আবারো কাজল ঠিক করে দিলো। তারপর আম্মু ডাকতেই আমাকে নিয়ে বের হয়ে গেলো আপি। ভয় লাগছে খুব। শরীর হাত-পা প্রচন্ড রকমের কাঁপছে। কেমন হবে মানুষটা? বুঝবে তো আমাকে? এসব ভাবতে ভাবতেই আপি আমাকে নিয়ে সোফায় বসিয়ে দিলো। সেই মেয়েটা এসে আমাকে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,
–“ও মাই গড! ভাবী তুমি ছবির থেকে বাস্তবে আরো বেশি কিউট। ইশ্ ভাইয়া আগে যে কেন তোমার সাথে আমার দেখা করালো না।”

আমি চুপচাপ বসে আছি৷ আর মেয়েটির কথা বোঝার চেষ্টা করছি। তখনই আন্টি এসে আমার গালে হাত দিয়ে বললেন,
–“মাশা-আল্লাহ। আমার আদ্রর চয়েজ আছে বলতে হবে।”

এই বলে তিনি ব্যাগ থেকে একজোড়া বালা বের করে আমার হাতে পড়িয়ে দিলেন। আংকেলও এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে দোয়া করলেন। তারপর কয়েকটা হাজার টাকার নোট আমার হাত গুজে দিলেন। আপি আমাকে নিয়ে আবার রুমে চলে এলো। ছেলে এখনো আসেনি। কি একটা কাজে নাকি আটকে গেছে। ছেলে আসার পর আংটি বদল আর রেজিস্ট্রি হবে। হিমাদ্রি আর ফাইজা আমার দুই পাশে বসে বললো,
–“রুহি ভাইয়ার নামটা কি রে?”

আমি চোখ রাঙিয়ে তাকালাম ফাইজার দিকে। রাগী সুরেই বললাম,
–“আমাকে জিজ্ঞেস করছিস কেন? আমি কিভাবে জানবো? এর কিছুই তো আমি জানি না। কিন্তু তোরা তো শুরু থেকেই সবটা জানতিস।”

হিমাদ্রি আমাকে জড়িয়ে নিয়ে বললো,
–“আহ সোনা রাগ করছিস কেন? তোর রিয়্যাকশন কেমন হয় সেটাই দেখতে চেয়েছিলাম তাই কিচ্ছু জানাইনি।”

ফাইজা চট করে দাঁড়িয়ে বললো,
–“তোরা বস আমি গিয়ে ফারাবী ভাইয়ার থেকে ভাইয়ার নামটা জেনে আসি।”

ফাইজা রুম থেকে বের হয়েছে আধ ঘন্টা হতে চললো। এখনো আসার নাম নেই। নিশ্চয়ই ওখানে গিয়ে গল্প জুড়ে দিয়েছে। কিছুক্ষণ বাদে ফাইজা অলস ভঙ্গিতে রুমে এসে আমার পাশে বসলো। হিমাদ্রি রাগী স্বরে বললো,
–“নাম জানতে তোর আধ ঘন্টা সময় লাগলো তাই না?”

–“ফারাবী ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করতেই একটা রামধমক দিয়েছে। তাই তো মাইশার সাথে ভাব জমাতে হলো। তারপর ইনিয়েবিনিয়ে নাম জিজ্ঞেস করেছি আর ও আমাকে ভাইয়ার ছবিও দেখিয়েছে। ইশ! কি কিউট ভাইয়া। আমি তো ক্রাশ খেয়ে গেছি।”

হিমাদ্রি কিছুটা ধমকের সুরে বললো,
–“ভাইয়ার নাম জানতে চেয়েছি তুই ক্রাশ খাইছিস না বাঁশ খাইছিস এটা জানতে চাইনি।”

ফাইজা আমার পাশ ঘেঁষে বললো,
–“মুশফিকান আদ্র। কি কিউট না নামটা?”

–“হ্যাঁ খুব সুন্দর। কিন্তু তুই আমাকে রেখে কেন ভাইয়াকে দেখলি?”

এভাবেই এক কথায় দুই কথায় হিমাদ্রি আর ফাইজার মাঝে কথা কাটাকাটি শুরু হলো। হিমাদ্রির একটাই কথা ফাইজা কেন ওকে রেখেই আদ্রর ছবি দেখেছে? আর ফাইজা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে চুপটি করে বসে আছে। আর এদিকে উনার নাম শুনেই আমার অবস্থা নাজেহাল। মুশফিকান আদ্র। তখন আন্টিও আদ্র বলেই সম্বোধন করেছিলেন তারমানে নিকনেম আদ্র? আদ্র! দুই অক্ষরের ছোট্ট একটা নাম। নামটা নিজের মনেই একবার আওড়ালাম। হঠাৎই বুকটা কেঁপে উঠলো। দ্রুত বুকে হাত রাখলাম। হার্টবিট লাফাচ্ছে। আমি পরপর জোরে কয়েকটা শ্বাস নিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলাম। আমাদের এপার্টমেন্ট আট তলা বিশিষ্ট। থার্ড ফ্লোরে আমাদের ফ্ল্যাট। নিচে একটা গাড়ি এসে থামতেই ফাইজা আর হিমাদ্রি ঝগড়া বন্ধ করে দিলো। ফাইজা বললো,
–“নিশ্চয়ই আদ্র ভাইয়া এসেছে।”

এই বলে দুজনেই বিছানায় উঠে জানালার কাছ ঘেঁষে বসলো। ফাইজা বললো,
–“ইশ্ কত্ত কিউট। এই রুহি তুই পালিয়ে যা তোর জায়গায় বসে আমি আদ্র ভাইয়াকে বিয়েটা করে ফেলি।”

হিমাদ্রি ফাইজার মাথায় একটা চাটি মেরে বললো,
–“বিয়েও করতে চাচ্ছিস আবার ভাইয়াও বলছিস স্টুপিড। জিজু হয় সো জিজু জিজু নজরে দেখা শুরু কর।”

ফাইজা মাথায় হাত দিয়ে রাগী চোখে তাকালো হিমাদ্রির দিকে। কিন্তু হিমাদ্রি সেদিকে পাত্তা না দিয়ে আমাকে বললো,
–“রুহি ভাইয়া সেই হ্যান্ডসাম। এই সুযোগে একটু দেখে নে। পরে কিন্তু ভাইয়ার সামনে লজ্জায় তাকাতে পারবি না।”

–“তোরাই দেখ। আমার দেখার কোনো ইচ্ছে নেই।”

–“দেখ না একটু৷ না দেখলেই মিস করবি।”

কথাটা বলে হিমাদ্রি আমাকে টেনে জানালার কাছে নিয়ে বাইরে মুখ ঘোরালো। হিমাদ্রির ইচ্ছেটা পূরন হলো না। আমি তাকানোর আগেই আদ্র ভিতরে ঢুকে গেছে। আমি আবার আগের জায়গায় বসে চুপচাপ বালাজোড়া নেড়েচেড়ে দেখছিলাম। এভাবেই কেটে গেলো বেশ কিছু সময়। বাইরে থেকে আপি হিমাদ্রি আর ফাইজাকে ডেকে বললো আমাকে নিয়ে যেতে। আগের থেকে এবার আমার বেশি নার্ভাস লাগছে। প্রচন্ড গতিতে হাত পা কাঁপছে। ওরা দুজন আমাকে ড্রয়িংরুমে নিয়ে যেতেই আন্টি আদ্রর পাশ থেকে সরে গিয়ে উনাদের দুজনের মাঝে বসার জায়গা করে দিলেন আমাকে। আন্টি নিজেই আমার হাত টেনে উনার আর আদ্রর মাঝে বসিয়ে দিলেন। এবার যেন কাঁপা-কাঁপি আরো একশোগুন বেড়ে গেলো। আদ্রর থেকে যথেষ্ট দূরত্ব রেখে আমি আন্টির সাথে একদম লেগে বসলাম। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আন্টি মুচকি হেসে বললো,
–“লজ্জা লাগছে? এত কাঁপছো কেন? নার্ভাস হওয়ার কিচ্ছু নেই মা। আমার ছেলেটা কিন্তু তোমাকে খুব ভালোবাসে। প্রতিদিন সকালে ওর ঘুম ভাঙে তোমার___”

আন্টি এতটুকু বলতেই আমার অন্যপাশ থেকে আদ্র গলা ঝেড়ে বললো,
–“আম্মু থামবে?”

ব্যাস। উনার এই দুটো শব্দেই আন্টি চুপ হয়ে গেলেন। তারপর আমার দিকে ঝুকে ফিসফিস করে বললেন,
–“পরে একসময় সব বলবো তোমায়। আমার ছেলে তোমাকে পাওয়ার জন্য কি কি না করেছে।”

আন্টির ফিসফিসানো কথা শুনে আমি চমকে মাথা তুলে তাকালাম আন্টির দিকে। আন্টি তখনো হাসছেন। কথাবার্তা শেষ করে রেজিস্ট্রি পেপার এগিয়ে দিলেন আদ্রর দিকে। আদ্র একটুও সময় না নিয়ে ফটাফট সাইন করে দিলো। যেন এটার অপেক্ষাতেই ছিলেন উনি এতদিন। আংকেল পেপার আর পেন আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। আমি কাঁপাকাঁপা হাতে পেন নিয়ে বসে রইলাম। চোখদুটো ছলছল করছে। আব্বুর আম্মুর দিকে বারবার তাকাচ্ছি। আন্টি আমাকে একপাশ থেকে জড়িয়ে নিয়ে বললেন,
–“কাঁদছো কেন বোকা মেয়ে? একদম কাঁদে না। তোমার তো খুশি হওয়ার কথা তুমি আরো দুটো বাবা-মা পাচ্ছো।”

আমি কিছু না বলে মাথা নিচু করে চুপচাপ কান্না করছি। সবাই বলছে সাইন করে দিতে। কিন্তু আমার সেদিকে কোনো ধ্যান নেই। শুধু মনে হচ্ছে এই সাইন করলেই আমি অন্যের অধীনে চলে যাবো। আগের মতো লাইফটা আর কখনো পাবো না। আমার লাইফে এরপর থেকে অন্য একজন তার অধিকার খাটাবে। হঠাৎ করেই বা হাতে কারো স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠলাম আমি। আমার বা পাশে তো আদ্র বসা। তাহলে কি উনিই আমার হাত ধরেছেন? হার্টবিট দ্রুত লাফাচ্ছে। কাঁপা-কাঁপি বেড়ে গেলো আমার। মনে হচ্ছে শরীর ঠান্ডা বরফ হয়ে যাচ্ছে। আব্বু বললেন,
–“আম্মু? সবাই অপেক্ষা করছে তো। সিগনেচারটা করে ফেলো।”

আমি ছলছল চোখে আব্বুর দিকে তাকালাম। আব্বু সাইন করার জন্য ইশারা করলো আমাকে। কাঁপা-কাঁপা হাতে সিগনেচার করে দিলাম। এবার রিং পড়ানোর পালা। আপি এসে আমাকে দাঁড় করালো। আদ্র দাঁড়াতেই আন্টি উনার হাতে রিং দিলেন। আমি দুহাতে শাড়ি খামচে ধরে দাঁড়িয়ে আছি। আদ্র আমার দিকে হাত বাড়ানোর পরেও আমি যখন হাত এগিয়ে দিলাম না তখন উনি নিজেই আমার বা হাত টেনে এনে অনামিকা আঙুলে রিং পড়িয়ে দিলেন। রিং পড়িয়ে হাতটা ছেড়ে দিতেই আপি আমার দিকে রিং এগিয়ে দিলো। কাঁপা-কাঁপা হাতে রিং তুললাম। উনি আমার দিকে তার হাত বাড়িয়ে আছে। হাত কাঁপছে আমার। আপি আমার হাত ধরে উনার আঙুলে রিংটা পড়িয়ে দিলেন। সাথে সাথেই সবাই করতালি দিয়ে উঠলো।

রুমে এসে বুক ভরে শ্বাস নিলাম আমি। এতক্ষণ দমবন্ধ একটা অবস্থায় ছিলাম। আর কিছুক্ষণ ওখানে থাকলে মনে হয় আমার প্রানপাখিটাই উড়ে যেতো। আমার শান্তি যেন হিমাদ্রি আর ফাইজার কিছুতেই পছন্দ হচ্ছিলো না৷ তাই তো আমাকে জ্বালাতে আবার দুটোতে চলে এসেছে সাথে আবার আদ্রকেও নিয়ে এসেছে। উনাকে দেখেই নিজেকে গুটিয়ে নিলাম। হিমাদ্রি উনাকে টেনে এনে আবারো আমার পাশেই বসিয়ে দিলো। আমায় আর আদ্রকে মাঝে বসিয়ে ওরা দুজন দুপাশে বসে পড়লো। ফাইজা আর হিমাদ্রি টুকটাক কথা বলছে উনার সাথে। আমি চুপ করে শুধু শুনছি। হিমাদ্রি আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার কানের কাছে মুখ এনে বললো,
–“জানু এখনি এত লজ্জা পাচ্ছিস আর যে হারে কাঁপছিস বাসর রাতে তুই কি করবি সেই নিয়ে আমি চিন্তায় আছি।”

হিমাদ্রির হাত খামচে ধরলাম আমি। পাশেই উনি বসা যদি শুনতে পেয়ে যায়? ইশ্ কি লজ্জা! হিমাদ্রির কথায় আদ্র খানিকটা কেশে উঠলো। তারমানে নিশ্চয়ই শুনেছেন সবটা। আমি হিমাদ্রির দিকে রাগী চোখে তাকাতেই ও ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ বাদে আপি রুমে এসে ওদের বললো,
–“তোমরা এখন রুহি আর আদ্রকে একা টাইম স্পেন্ড করতে দাও। ওরা দুজনে কথা বলে স্বাভাবিক হোক। বিশেষ করে রুহি ওর জড়তা ভাবটা কাটিয়ে তুলুক। তোমরা পরেও সময় পাবে ওদের সাথে কথা বলতে।”

কথাগুলো বলে আপি চলে গেলো। আপির পিছন পিছন ফাইজা আর হিমাদ্রিও চলে যাচ্ছে। আমি হিমাদ্রির হাত ধরে আটকাতেই ও থেমে গেলো। আমি ইশারায় ওকে থাকতে বললাম। কিন্তু ও তা না করে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বাঁকা হেসে বললো,
–“আমরা থাকলে ভাইয়া তোর সাথে আলাদা টাইম স্পেন্ড করবে কিভাবে? আপাতত তোমরা আলাদা টাইম স্পেন্ড করো সোনা৷ আমরা আবার পরে আসছি।”

কথাগুলো বলেই হিমাদ্রি আর ফাইজা বের হয়ে গেলো রুম থেকে। যাওয়ার আগে অবশ্য দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে গেছে। আমি উনার থেকে যথেষ্ট দূরত্ব রেখে বিছানার এক কোনে গিয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসলাম।

চলবে~