আঁধারিয়া অম্বর পর্ব-০৪

0
1034

#আঁধারিয়া_অম্বর
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
৪।

রাত ১১ টা….
বিছানার বাম পাশেই সাদা চাদরে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে শ্যামা। গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে ইজহান তার দিকে। মেয়েটির জোড়ভ্রু যুগল কুচকে আছে।যেন রাজ্যের চিন্তা এই মেয়েটির মাথায়।খাঁড়া নাক, সুন্দর ঠোঁট জোড়ায় দেওয়া ইজহানের ক্ষত স্পষ্ট । ফর্সা পিঠে এলো মেলো হয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে চুল। ফর্সা মুখে ব্যথার আভাস। ইজহানের বুকের কোথাও একটা ধক করে উঠলো যেনো। পুতুলের মতো দেখতে তুলতুলে মেয়েটির শরীরের কি হাল করেছে সে! পরক্ষণেই মনের গহিন থেকে কিছু কথা নাড়া দেয় মস্তিষ্কে,

“ভুলে গেছিস? এই সেই মেয়ে? যে তোর ফিলিংস নষ্ট করেছে, তোর বিশ্বাস ভেঙ্গেছে, ওর পরিবারের জন্যই তোর গোটা পরিবার তছনছ হয়ে গেছে? তার জন্য সত্যি তোর মায়া হয়? সেইম ওন ইউ!”

মনের কোনো জমে থাকা চাপা রাগ ধপ করে জ্বলে উঠলো। উদাসীন হয়ে গেলো দৃষ্টি। বিষিয়ে উঠা মন নিয়ে বিছনা ত্যাগ করলো। এ মূহুর্তে তিক্ততা ভরে যাচ্ছে ভিতরটা এই মেয়েটিকে দেখে। এক পলক ঘুমন্ত শ্যামার মুখ দেখে বেড়িয়ে গেলো রুম থেকে ইজহান।

——-

নিস্তব্ধতা রুমটিতে ফোনের বীপ বীপ শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেলো। এলার্ম বেজে ওঠেছে। আমি ফোনটি তুলে বন্ধ করে নিলাম। চোখ বুলালাম ঘড়ির কাঁটায় ১২ টা ছুঁই ছুঁই।চমকে উঠলাম আমি। জাহিদ আমার অপেক্ষা করছে নিশ্চই? আমি ধড়ফড় করে বিছনা থেকে নামতে নিলাম। ঠিক তখনি পুরো শরীরে তীব্র ব্যথায় “আহ্” শব্দটি বের হয়ে গেলো মুখ দিয়ে। মনে পড়ে গেলো, কিছু ঘন্টা আগের কথা। মি. ইজহান আমার সাথে কি করেছিলো। একটা.. একটা খেলার পুতুল বানিয়ে ফেলেছেন যেনো উনি। যখন ইচ্ছে খেলছে, যখন ইচ্ছে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে।মনের ভেতরটা আমার বিতৃষ্ণায় ভরে গেলো। গাল ফুলিয়ে ছোট শ্বাস বের করলাম। বিছনা ছেড়ে ধীরে পায়ে ওয়াশরুমে গেলাম। একটা হট শাওয়ার নিয়ে বেড়িয়ে আসলাম বাহিরে। শরীরের তীব্র ব্যথা থেকে নিস্তার পেতে পেইন কিলার খেয়ে নিলাম। চট জলদি রেডি হয়ে নিচে নেমে এলাম। তখন মধ্যে রাত কেউ জেগে নেই। লিভিং রুমটায় হালকা আলো হালকা আধাঁরের মাঝে যেন লুকোচুরি খেলছে। আমি ধীরে পায়ে নিজে নামে মেইন দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম। গেইট খুলবো তখনি ফকফক করে উঠলো আলোয়। খানিকটা চমকে গেলাম। পিছন থেকে ভেসে এলো ঠান্ডা একটি কন্ঠ,

“এত রাতে কোথায় যাওয়া হচ্ছে?”

আমি পিছনে তাকিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই ঠোঁট ভাজ করে বললাম,

“কাজ আছে।”

মি. ইজহান যেন আমার কথাতে সন্তুষ্ট নয়। ভ্রু কুচকে বিরক্তি মাথা চোখে চেয়ে আছেন আমার দিকে। আমি পূর্ণ দৃষ্টি মেলে দেখলাম মানুষটাকে, শরীরে দামি টিশার্ট আর টাউজার। বরাবরের মতোই বিষন্ন, উদাসীন, অনুভূতি শূন্য মুখ করে বসে আছে সোফার উপর। টেবিলের উপর ছড়িয়ে আছে ফাইল। হয়ত কাজ করছিলেন। আমাকে বললেন,

“এত রাতে মেয়ে মানুষের আবার কিসের কাজ?”

এবার বিরক্ত হবার পালা যেনো আমার। আমি সোজাসাপটা বললাম,

“মেয়ে মানুষ বলে কাজ থাকতে পারে নাকি?”

উনি ভাবলেশহীন ভাবে গম্ভীর ঠান্ডা কন্ঠে বললেন,

“অবশ্যই থাকে। যারা রাতের পরি হয়! আই থিংক তুমি তা নই?”

আমি অবাক! কি বলেছেন উনি? আমি.. আমি রাতের পরি? উনি আমাকে অন্ধকার জগতের মেয়েদের সাথে তুলনা করছেন? ছিঃ… এতটা নিচ ভাবে উনি আমাকে? আমি..আমি এতটাই ফেলনা! বুকের মাঝে মুহূর্তেই ধলা পাকিয়ে গেলো একটা চাপা কষ্ট। ধরে এলো গলা। বেইমান চোখের পানিটুকু স্বার্থপরের মতো বেড়িয়ে আসতে চাইছে এই লোকটির সামনে? কেনো? যে মানুষটা আমাকে মানুষ বলেই ভাবে না তার সামনে কিসের এতো আদিখ্যেতা? আমি নিজেকে শক্ত করতে চাইলাম। কঠিন কন্ঠে তাকে উপেক্ষা করে বললাম,

“আমি একজন রিপোটার। আমার কাজের জন্য রাত দিন ডাজেন্ট মেটার। আপনার উদ্ভট কথা শেষ হয়েছে? এবার আমি যাবো। ”

কথাটুকু বলেই তাকালাম মি. ইজহানের দিকে। থমকে গেলাম। মি. ইজহানের চোখের রক্তিম চাহনি কাঁপিয়ে দিতে লাগলো আমার দেহখানি। মানুষটা বিন্দু মাত্র পরিবর্তন হয় নি। ১২ বছর আগেও যেমন ছিলো, ঠিক তেমনি আছে, গম্ভীর, রাগী। আমি শুকনো ঢুক গিললাম। এক প্রকার পালিয়ে বেরিয়ে যেতে চাইলাম। কিন্তু আটকে গেলাম। একটা.. একটা ঠান্ডা বলিষ্ঠ হাত পিছন থেকে হেঁচকা টান মেরে তার দিকে ঘুরিয়ে ফেললো। বাহুর উপর হাতের বল প্রয়োগ করে চেপে ধরলো। শীতল কন্ঠে তাচ্ছিল্য ছুঁড়ে দিয়ে বলল,

“ভুলে যেয়ো না, তুমি আমার মিস্ট্রেস। ”

আমি চকিতে তাকালাম মানুষটার দিকে। কি চায় উনি? কেন বারবার বারবার আমার কাজে বাঁধা দেন? কেন?

“দেখুন আমি আমার দায়িত্ব ভুলিনি। কিন্তু তাই বলে এই নয় আপনি আমার কাজে হস্তক্ষেপ করবেন।”

মি. ইজহান আমাকে টেনে আরো কাছে নিয়ে এলেন। বললেন,

” তুমি এখান থেকে এক পা নাড়বে না। এটা আমার অর্ডার। ভুলে যেয়ো না তোমার বাবার চিকিৎসা এখনো শেষ হয় নি!”

আমি এবার অসহায় দৃষ্টি তাকালাম মি. ইজহানের দিকে। কতটা হেল্পলেস আমি। একজনের বাঁধা দাসী হয়ে জীবন পার করতে হচ্ছে। বিয়ের দুটো দিন পাড় হলো না, সম্পর্ক টা গলার কাঁটার মতো বিঁধছে কি করবো আমি? কি করার আছে? তখনি উনার গর্জন শোনা গেলো,

” রুমে যাও।”

আমি বাধ্য মেয়ের মতো চলে গেলাম উপরে। রাগে দুঃখ জোরে দরজা লাগিয়ে দিলাম। নিজেকে খাঁচার বন্ধী পাখি মনে হচ্ছে। ঠিক সেই মুহূর্তে বেজে উঠলো ফোনের রিং টোন। জাহিদ ফোন করেছে, ফোনটা তুলতেই, ওপাশ থেকে খেঁকিয়ে উঠলো জাহিদ,

“শালি কই তুই? মশার কামড় খাইয়া ত্যানা ত্যানা হইতাছে আমার পা। কই তুই? তোর খাটাশ বর আসতে দিচ্ছে না বুঝি!”

আমি হতাশ হলাম। আমার আর মি. ইজহানের ডিলের কথা একমাত্র জাহিদ জানে। তাই বললাম,

“আমার লাইফটা তেজপাতা। কি করি কয় তো? আমি চাই না, এই সুযোগ হাত ছাড়া করি। এই মাফিয়ার গ্যাং লিডারকে এখন পর্যন্তে কেউ দেখেনি। আর আজ এত বড় সুযোগ পেয়ে এই বেটার জন্য হাত ছাড়া হচ্ছে। ”

আমার কথা শুনে জাহিদ খানিক চুপ থেকে স্বরযন্ত্র করার মতো বলল,

“এক কাজ কর, তোর বেলকনি দিয়ে নেমে পর। আমি গাড়ি নিয়ে রেডি থাকবো।”

আমি অমত করলাম না। এটাই এক মাত্র রাস্তা। আমি ফোন কেঁটে রুমের দরজাটা ভালো করে লাগিয়ে নেমে পড়লাম বেলকনি দিয়ে। বাহিরে তখন ঠান্ডা আবহাওয়া বইছে। সন্ধ্যার বৃষ্টির ফেলে জায়গায় জায়গায় পানি জমে আছে। আমি খুব সাবধানে লুকিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। গেটের বাহিরে থাকা জাহিদের গাড়িতে চট করে উঠে বসতেই ওই একটান দিলো। আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম।

আর এদিকে পাশের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে শ্যামার করার সবটুকু কাজ দেখেছে ইজহান। শরীরের মাঝে ক্রোধ ধাপিয়ে বেড়াচ্ছে। শ্যামাকে অন্য কোনো ছেলের সাথে এভাবে লুকিয়ে বের হতে দেখে মাথা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ইজহানের। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে গাড়িটা যতক্ষণ না চোখের আড়াল হয়। হাত দুটি মুষ্টি বদ্ধ। যেন শ্যামাকে পেলেই এখনি ভস্ম করে দেয় তার রাগের দহনে। কেন শুনে না শ্যামা তার কথা? ১২ বছর আগেও এই মেয়েটি ছিলো উড়নচণ্ডী। আর এখনো? তখনও মেয়েটি তার এক ফোঁটা কাথার দাম দেয়নি, আর আজ-ও না। কেন?

———

এদিকে আধঘন্টার মাঝে পৌছে গেলাম আমরা বোড ক্লাব। গায়ে জড়িয়ে নিলাম ওয়েটার ড্রেস কোড।এক বুক সাহস নিয়ে পা বাড়ালাম সামনে। কিন্তু কে জানতো? আমার জন্য অজানা এক বিপদ অপেক্ষা করছিলো…..

চলবে,