আঁধারিয়া অম্বর পর্ব-০৩

0
1127

#আঁধারিয়া_অম্বর
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
৩।

ঠিক তখনি খট করে খুলো গেলো দরজা আর ভিতরে প্রেবশ করলেন ৬০/৬৫ বছর বয়সের একজন বৃদ্ধা। থলথলে মোটা শরীর, চোখে মুখে বিজ্ঞ বিজ্ঞ ভাব।মুখে বরাবরের মতোই কাঠিন্যে ভরপুর । সাদা চুল। পরনে সাদা কালো দামি শাড়ি। আমি পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলাতেই ভয়ে গলা শুকিয়ে গেলো। এই বৃদ্ধাকে দেখে চিনতে একটু সমস্যা হলো না। এ যে রাজনীতিবিদ মি. ইজহানের দাদিজান আলিয়া এবং এই এলাকার সাবেক মন্ত্রী। আর তার সাথেই দাঁড়িয়ে আছে লাস্যময়ী এক রমনী। এটি উনার সাথে আমার প্রথম পরিচয় নয়, এর আগেও হয়েছিলো দেখা আজ থেকে ১২ বছর আগে।তখনও যেমন ছিলো উনার অভিব্যক্তি এখনো তেমনি আছে। চুল পর্যন্ত পরিবর্তন নেই। উনি কঠিন গলায় বললেন,

“এইখানে কেন এসেছো? আমার নাতির ঘাড়েতো চরেই বসেছো! এবার কি অফিসে-ও ভাগ নিতে চাও নাকি? তোমাদের মতো মেয়েদের না.. আমি হারে হারে চিনি। ছি.. টাকার জন্য বিছানায় যেতেও লজ্জা লাগে না? তোমার থেকেতো প্রস্টিটিউট ভালো! অবশ্য ঠিকি আছে যেমন মা তার তেমন মেয়েই হবে কিনা!”

আমার কান ঝা ঝা করে উঠলো। এত অপমান সহ্য করা কষ্টকর।এই মহিলাটি বদলায়নি। অহংকারে আগাগোড়া মোড়ানোই আছে। না হয় আমাকে যা খুশি বলুক। কিন্তু আমার মাকে কেন উল্টো পাল্টা বলবে? যে নেই তাকে কেন টানবে? আমার সহ্য হলো না। ধরে এলো কন্ঠ,

“দেখুন দাদিজান! আমাকে যা ইচ্ছে বলে যান। আমার মাকে টানবেন না!”

আলিয়া ধমকে উঠলেন,

“মেডাম… মেডাম ডাকবে আমাকে। শুধুই মেডাম। আর এত সাহস হয় কিভাবে হ্যাঁ? আমার মুখের উপর কথা? এত সাহস?”

আমি অবাক হয়ে দেখতে লাগলাম তাকে। আমি কোথায় মুখের উপর কথা বললাম? আমি কিছু বলার জন্য মুখ খুলবো তখনি উপস্থিত হয় মি. ইজহান। ঘরের মাঝে তখন একটা ঠান্ডা আবহাওয়া গরম আবহাওয়াকে গিলে নিলো। পকেটে দু হাত গুঁজে, ঠান্ডা শীতল চাহনি নিক্ষেপ করলেন আমার দিকে। বরাবরের মতো ভাবলেশহীন দাম্ভিক মুখখানায়। উনি গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

“এখানে কি হচ্ছে?”

মুহূর্তেই দাদিজানের মুখের ভাব পরিবর্তন হয়ে গেলো। কাঁদো কাঁদো মুখে বলল,

“দাদাভাই, দেখ…দেখ কালকেই বিয়ে করেছিস আর আজ এই মেয়ে আমাকে কত কটুবাক্য শুনিয়ে যাচ্ছে? তুই বল মেহরিন কিছু!”

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বললেন।আমি হকচকিয়ে গেলাম। এতো সুক্ষ্ম অভিনয়? ভাবা যায়? জল টলমল করছে চোখে। এখনি যেন টুপ করে পড়বে। আমি সাথে সাথে বললাম,

“না.. না.. মি. ইজহান আমি কিছু বলিনি মেডামকে। আমি তো শুধু…”

কথা কেটে দাদিজান বললেন,

“হ্যাঁ হ্যাঁ আমি মিথ্যা বলছি? বিয়ের একদিন-ও হয়নি আর আমি পর হয়ে গেলাম!”

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেহরিন তাল দিয়ে বলল,

“এ কেমন কথা ইজহান? তুই দাদিজানকে অবিশ্বাস করছিস?”

আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিলো। চলছে কি এসব? এরা যা নয় তাই বলে চলেছে, আমিতো কিছুই বললাম না। আমি মি. ইজহানের দিকে তাকালাম। তার চোখে রাগ, ক্ষোভ স্পষ্ট। তা দেখেই একটা অচেনা ভয় এবার আমার গোটা শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠলো। আমি বহু কষ্ট ঠোঁট দুটি ভাজ করে বললাম,

“দেখুন মি. ইজহান..”

আবারো থামিয়ে দেওয়া হলো আমাকে। গম্ভীর কাঠিন গলায় রাগ প্রকাশ পেলো,

“দাদিজান আপনি বাহিরে জান!”

কথাটা স্বাভাবিক ভাবে বললেও আমার বুঝতে বাকি নেই, কতটা অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটতে চলেছে। আমি ভয়ে ভয়ে তাকালাম মি. ইজহানের দিকে। উনি তাকিয়ে আছেন ঠিক আমার দিকে। চোখে মুখে রাগ। দাদিজান হাসলেন চাপা। পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা মি. ইজহান দেখতে পেলো না। দাদিজান চলে গেলেন মেহরিনকে নিয়ে। আমি অসহায় ভাবে তাকিয়ে বললাম,

“মি. ইজহান আমার কথা…”

আবারো কথা থামিয়ে দিলেন।আমার কথা শুনতেই নারাজ যেন উনি। মুহূর্তে একদম কাছে চলে এলেন। এবং চেপে ধরলে টেবিলের সাথে। আত্মাকে উঠলাম আমি। চোখ বন্ধ করে নিলাম। তখনি বললেন উনি,

” হাউ ডেয়ার ইউ? তুমি জানো না? সে আমার দাদিজান? তার মুখে উপর কথা বলার অধিকার কে দিয়েছে? ভুলে যেও না তুমি শুধু আমার রক্ষিতা, বউ না..!”

আমি স্তম্ভিত হলাম। অশ্রু সিক্ত চোখে তাকালাম। কানের মাঝে বারবার বাজছে ‘রক্ষিতা’ শব্দটি। আমার ভিতরটা পুড়িয়ে ছাড় খাড় করে দিচ্ছে। এই মুহূর্তে উনি টেবলের সাথে আমাকে চেপে ধরেছেন। টেবিলের কোনা আমার কোমড়ে গিথে যাচ্ছে। বড্ড ব্যথা হচ্ছে শরীরে। তার থেকে ১০০ গুন বেশি ব্যথা হচ্ছে বুকের মাঝে। নিস্প্রভ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। বললাম,

“আমি ভুলিনি মি. ইজহান। ভুলিনি। বার বার মনে করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন নেই। আমি আমার লিমিট জানি!”

উনি তাতেও সন্তুষ্ট নয় যেন। আমার গালে এক হাতে জোরে চাপ দিয়ে বলল,

“এমন ভুল আমি দ্বিতীয় বার সহ্য করবো না। এ পৃথিবীতে আমার দাদিজান সব। উনি মনে কষ্টে পেলে পৃথিবী ধংস করে ফেলবো। মাইন্ড ইট।”

আমি মাথা নাড়ালাম। উনি এবার আমাকে ছেঁড়ে দূরে গিয়ে দাঁড়ালেন। আগের মতোই পকেটে হাত গুঁজে বললেন,

“এখানে কি জন্য এসেছো? ”

আমি চোখের জল মুছে নিলাম। ভাগ্যের সাথে সমঝাতা করে নিলাম। বললাম,

“আপনি কি আমাকে মারতে চান?”

মি. ইজহান ভ্রু কুচকে চাইলেন,

“তোমার কি মনে হয়?”

“আমার তাই মনে হয়! আপনি আমাকে মারতে চান!”

মি. ইজহান দু কদম এগিয়ে এলেন। কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললেন,

“মারতে তো চাই, আমার রাগের দহনে পুড়ে ছাই করে নদীর বুকে ভাসিয়ে দিতে চাই!”

আমি ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইলাম। বদ্ধ ঘরটিতে অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা বয়ে যাচ্ছে। শুধু ভেসে আসছে এসির খট খট শব্দ। পুঙ্খানুপুঙ্খ নিরবতা আমার গায়ে কাঁপিয়ে তুলছে। আমি কাঁপা কন্ঠে বললাম,

“আপনার… আপনার মতলবটা কি? কি চান আমার কাছে?”

মি. ইজহান হেসে ফেললেন। পরমুহূর্তেই গম্ভীর হয়ে ক্রুদ্ধ কন্ঠে বললেন,

“গেট লস্ট! ”

কথাটি খানিকটা জোরেই বললেন উনি। যার ফলে চমকে উঠলাম আমি। মনের কথা গুলো টুপ করে গিলে নিলাম। এক পলক চোরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে নিলাম এই অতি সুদর্শন লোকটিকে। তারপর বেড়িয়ে পড়লাম নিজের গন্তব্যে। শুধু শুধু লোকটির সামনে মাথা মেরে লাভ নেই। উনি যা বুঝেন তাই করবেন। আমি দীর্ঘ শ্বাস ফেললাম। কোমড়ের পাশটা ভালোই চোট লেগেছে। বড্ড জ্বালা হচ্ছে। আমি আর সেদিকে পাত্তা না দিয়ে,একটা সি এন জি ডেকে চলে এলাম অফিসে। ভিতরে ঢুকতেই জাহিদ ছুটে এলো। কন্ঠে তার উৎকন্ঠা,,

“বইনা কই ছিলি? খুশির সংবাদ আছেরে। আমরা এতদিন ধরে যে মাফিয়া গ্যাং টার খোঁজ নিচ্ছিলাম আজ তা সাফল্য পেতে চলেছে! ”

আমার বিষন্ন মনটা এবার একটু খুশির ছোঁয়া পেল। হেসে বললাম,

“তো চল ভাই কাজে লেগে পড়ি। তা কোথায় আসচ্ছেন তারা?”

“বোর্ড ক্লাব আজ রাত ১০ টায়। গোপন তথ্য জেনেছি, আজ নাকি তারা কজন নারীকে নিলামে তুলবে, দেশের নামি দামি লোকেরাও থাকবে এখানে, তবে খুব সচেতন ভাবে করতে হবে কাজটুকু।”

নারীকে নিলামে তুলবে শুনে মনটা আবার বিষিয়ে উঠলো। দেশ স্বাধীন আমাদের ঠিকি কিন্তু নারীর স্বাধীনতা নেই।এই লোকেদের মুখোশ উম্মোচন তো করেই ছাড়বো আমি। কাল সকালের হেডলাইন হবে এরা। এসব ভেবেই জাহিদের সাথে প্ল্যান করতে লাগলাম। ঠিক তখনি খড় খড়ে কন্ঠে বলে উঠলেন শান্তনু,

“এত খুশি হয়োও না মেয়ে, যে খেলায় নামতেছো তুমি? জানটাও যেতে পারে তোমার! বাকিটা জীবনতো এখনো পড়ে আছে। ”

আমি হাসলাম। এই নরকীয় জীবনের থেকে মৃত্যু শ্রেয়ো! আমার এই বিষাদময় জীবনের বিনিময়ে যদি সেই নারীরা একটা সুন্দর জীবন পায়, তাহলে ক্ষতি কি?

——————-

সন্ধ্যা সাতটা বেজে কুঁড়ি।
বাহিরে আজ বৃষ্টি পড়ছে টুপটাপ করে। চারিদিকে নিস্তব্ধতা। দূরে কোথা থেকে ভেসে আসছে কোলা ব্যাঙের ডাক। শহরে তখন ঝাপিয়ে নেমেছে অন্ধকার।রাস্তার স্ট্রিটলাইটের হলদে আলোয় দেখা যাচ্ছে বৃষ্টির ফোঁটা । তার সাথে ধাপিয়ে নামছে থেকে থেকে স্ব স্ব শীতল বাতাস। আমি মাত্রই পা বাড়ালাম মি. ইজহানের রাজ্যে। বাসার ভিতরটা আজ কেমন যেন গুমোট বাতাবরণ হচ্ছে। গা যেন ছমছম করে উঠেছে। আমি ধীরে ধীরে এগিয়ে এলাম। উপর থেকে ভেসে আসছে কিছু ভাঙ্গার শব্দ। আমার মাথা কাজ করছিলো না। কি হচ্ছে উপরে? সিড়ির পাশেই ভয়ে জড়সড় হয়ে আছে নিপা। আমাকে দেখেই ভয়ে ভয়ে বলল,

“মেডাম উপরে যাবেন না আজ!”

আমি জিজ্ঞেস করলাম,

“কিন্তু কেনো?”

নিপা মাথা নত করে বললো,

“স্যারের বাবা এসেছিলেন তাই!”

আমি বিস্ময় বুঁদ কিছু বলবো তার আগেই ভেসে এলো এক আর্তনাদ। আমি দাঁড়াতে পাড়লাম না। এক ছুটে উপরে আসতেই। পিছন থেকে নিপা বলে উঠলো,

“মেডাম যাবেন না, প্লিজ। ”

কিন্তু নিপার কথা আমার মানতে ইচ্ছে করলো না। আমি এক ছুটে রুমে আসলাম মি. ইজহানের। একি ঘরে অবস্থা? একটা ছোট্ট ঝড় যেন এই ঘরটির উপর বয়ে চলে গেলো।ঘরের আসবাব উল্টো পাল্টে আছে, দামি ফুলদানি ভেঙ্গে গড়াগড়ি খাচ্ছে দামি কার্পেটে। ড্রেসিং টেবিলের আয়নার কাজ গুলো টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মাটিতে। আমি ডান দিকে তাকালাম, সোফায় বসে আছেন মি. ইজহান। চোখ মুখে বিষন্ন উদাসীন। উস্ক খুস্ক চুল। হাত থেকে টুপ টুপ করে রক্ত পড়ছে। বুঝতে বাকি নেই উনি হাত দিয়ে ঘুসি মেরে ভেঙ্গেছেন আয়না। কেন জানি এমন অবস্থায় তাকে দেখে বড্ড মায়া হলো। তার হাতের রক্ত গড়িয়ে পড়া দেখে বুকের মাঝে মোচর দিয়ে উঠলো আমার। আচ্ছা? তার বাবা এসেছিলেন বলে এত তান্ডব চলালো কেন? মনের মাঝে এক গাদা প্রশ্ন বাসা বাঁধতে লাগলো। আমি সব ভাবনা বাদ দিয়ে এবার এগিয়ে গেলাম তার দিকে।পাশে বসে কেটে যাওয়া হাতটি ধরলাম। কাচের টুকরো গিলো নির্মম ভাবে গেথে আছে সুন্দর হাতে। আমি ফাস্টেড বক্স নিয়ে এলাম। কাচ গুলো সরিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিলাম। কাচ গুলো যতবার সরিয়ে দিচ্ছিলাম মনে হচ্ছেলো আমার শরীরেই গিঁথে আছে। আমি এবার সাহস করে ডাকলাম,

“মি. ইজহান? আর ইউ ওকে? আপনি ঠি.. ঠিক আছেন?”

মি. ইজহান চাইলেন আমার দিকে। দৃষ্টিতে আগুন ঝড়ছে, সটান দাঁড়িয়ে গেলেন উনি।এতক্ষণ যেন হুশ ছিল না। আমার ডাকে যেন হুশ ফিরলো। হতবিহবল হয়ে আমি-ও দাঁড়ালাম। আমার এখন কি করা উচিত এ মুহূর্তে? ভেবে পাচ্ছি না। তার অভিব্যক্তি বুঝতে অক্ষম বরাবরের মতোই। আমার কন্ঠ নালিতে আটকে গেছে কথা। বললাম,

“আপনার হা… হাত!”

বলতেই উনি হুংকার ছাড়লেন। টকটকে লাল হয়ে উঠলো চোখ জোড়া। আমার বাহু চেপে ধরে ফেলে দিলেন বিছানার উপর। পরমুহূর্তেই উনি নিজেও উঠে এলেন আমার উপরে, রাগে ফোসতে ফোসতে শরীরের কাপড় খুলে নিতে লাগলেন। একটি কথাই আওড়াতে লাগলেন,

” সব তোমার জন্য হয়েছে, তোমার দোস, আই হেইট ইউ!”

বলেই আমার উপর ঝাপিয়ে পড়লেন। মনের আক্রোশ কামুকতায় পরিণত হলো। মিটাতে লাগলেন দেহের স্বাদ। আর আমি? কেঁদে কুটে রক্ষে হলো না। ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে আমার দেহ, মন। কি এমন দোষ করেছি যার শাস্তি এভাবে দিচ্ছেন উনি। আমি চিৎকার করলাম। কিন্তু কেউ এলো না, না আসবে, আগের দুবারের মতো এবারো সহ্য করতে হলো মরণ যন্ত্রণা।

চলবে,