আঁধারিয়া অম্বর পর্ব-০৬

0
933

#আঁধারিয়া_অম্বর
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
৬।

এসব ভাবার মাঝেই ফোনের রিং বেজে উঠলো। ফোনের উপর ভেসে উঠলো, “মি হাসবেন্ড ” নামটি। কিন্তু উনি হঠাৎ কল কেন করলেন? বুঝতে পারছে না শ্যামা। তখনি মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ স্ব তেজ হলো। কালকের পানিশমেন্ট দেয়ার জন্য নয়তো?শ্যামা ভয়ে ভয়ে রিসিভ করতেই, ওপাশ থেকে শোনা গেলো মি ইজহানের ঠান্ডা, শীতল কন্ঠ…

“কোথায় তুমি?”

দুটো শব্দ। দুটো শব্দেই যেন জমে গেলো শ্যামা। এত গরমের মাঝে অনুভব করলো তার শরীরের কাঁপ। এত, এত ঠান্ডা গম্ভীর কন্ঠ যে কারোই হাড়কাঁপানোর জন্য যথেষ্ট। শ্যামা শুকনো ঢুক গিললো বলল,

” আ.. আমি, অফিসে!”

ওপাশ থেকে সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এলো,

“বাড়ি এসো, ইন ফিফটি মিনিট’স!”

শ্যামা ফোনের এপাশে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে রইলো। ঠিক তখনি জাহিদ এসে বলল,

” কিরে মুখ এমন পাংশুটে বানিয়ে আছিস কেন?”

শ্যামা ছোট শ্বাস ফেলে বলল,

“বাড়ি যেতে হবেরে!”

“ঠিক আছে যা। চিন্তা করিস না সামলে নিবো আমি এদিকটা।”

“কিন্তু শান্তনু স্যার?”

জাহিদ আশ্বাস দিয়ে বলল,

“মে হু না…!”

ফিক করে হেসে দিলো শ্যামা। জাহিদকে বিদায় জানিয়ে বেড়িয়ে পড়লো বাসার উদ্দেশ্যে।

এদিকে অনেকক্ষণ যাবত বসে আছে মি. ইজহান। ঘরের নিয়ন আলো জ্বলছে। এই টুকু আলোতেই ইজহানের মসৃণ মুখখানা দেখা যাচ্ছে। দৃষ্টি বাহিরের সন্ধ্যা হয়ে হয়ে আশা আকাশটার দিকে। বিক্ষিপ্ত মনে হাজারটা প্রশ্ন, রাগ, অভিমান পুশে আছে। ডান হাতের দু আগুনের ভাজে জ্বলন্ত সিগারেট ধরে আছে। কিছুক্ষণ পর পর পুরে নিচ্ছে নিজের ঠোঁটের ভাজে। তামাকে তীব্র গন্ধ বিষাদ করে দিচ্ছে ভিতর টা। একটা.. একটা ঘোরের মাঝে আছে যেন ইজহান। ঠিক তখনি খট করে দরজাটি খুলে গেলো ঘরের। গুটিশুটি পায়ে ভিতরে ঢুকলো শ্যামা। কঁপালের মাঝে দুটো ভাজ শ্যামার। এই অসময়ে মি. ইজহানের বাসায় থাকার তো কথা না.. তাহলে? সত্যিই কি পানিশমেন্ট দিতে চান? শ্যামা কঁপালে এবার ঘাম বিন্দু বিন্দু জমতে লাগলো। সে ঠোঁট ভাজ করে বলল,

“মি. ইজহান?”

ইজহান পূর্ণ দৃষ্টি মেলে চাইলো আলুথালু চুলের মেয়েটির দিকে। পড়নে লাল টপ, নেভি চিন্স, গলায় ঝোলানো স্কার্ফ। সে বলল,

“বসো এখানে!”

শ্যামা বিনা বাক্যে বসে গেল। সুক্ষ্ম ভাবে তাকিয়ে রইলো সামনের ব্যক্তিটির অভিব্যক্তি বুঝতে। কিন্তু ব্যর্থ বরাবরের মতোই, ঠান্ড, গম্ভীর তার দৃষ্টি। শ্যামা লক্ষ করলো, এই যুবকটিকে এই মুহূর্তে ভিষণ সুন্দর লাগছে। তার তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে। তবে কি শ্যামা তাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে? মি. ইজহান যখন চলচ্চিত্রের সাথে যুক্ত ছিলো, সবার মতোই সেও তাকে বড্ড পছন্দ করতো। কিন্তু ভাগ্য আজ তার বউ উর্ফে রক্ষিতা বানিয়ে দিয়েছে। যত যাই হোক, লোকটি তার বর। কিন্তু লোকটি তাকে একটি বারের জন্য কি তার সহধর্মিণী মেনেছে? শ্যামা অনুভব করলো এবার তার বুকের কোনে তীব্র ব্যথা করছে। নিজেকে সামলে লোকটিকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলো,

“আপনি কি আমাকে পানিশমেন্ট দিতে ঢেকেছেন?”

মি. ইজহান ম্যামার পা থেকে মাথা পর্যন্ত এক নজর চোখ বুলিয়ে উঠে দাঁড়ালো। অর্ধেক সিগারেট খাওয়া অংশটি মাটিতে ফেলে মারিয়ে ফেললো। জ্বলন্ত সিগারেট ধপ করেই নিভে গেলো যেন। পাশের টেবিল থেকে একটা ওয়াইনের গ্লাস তুলে চুমক দিয়ে এগিয়ে এলো শ্যামার কাছে। বলল,

“তোমার কি মনে হয়?”

শ্যামা ভয়ে চোখ ছোট ছোট হয়ে এলো। বলল,

“দেখুন আমার কাজটাই এমন, যখন তখন যেখানে সেখানে যেতে হয়, আপনি আমাকে তা নিয়ে বাঁধা দিতে পারেন না!”

ইজহান বাঁকা হাসলো। বলল,

“তোমার কি তাই ধারণা?”

শ্যামা চুপ করে গেলো। অবশ্যই সে কখনোই পাড়বে না মি. ইজহানের সাথে। সেই ক্ষমতা তার নেই আজ। আজ তার বাবা যাই যাই অবস্থা নয়তো মি. ইজহানের মুখ পর্যন্ত দেখতো না সে। শ্যামা আবার ভাবলো মি. ইজহান কি কোনো প্রকার রাগ তার প্রতি? শুধুইকি রাতে বাহিরে যাওয়ার জন্যই উনি রেগে? নাকি তার পিছনে আমাকে অপছন্দ, ঘৃণা করার কারণ। তবে শ্যামা বুঝতেই পারছেনা মি. ইজহান কেন, কেন তাকে অপমান করেন? শ্যামা উল্টো প্রশ্ন করলো,

“আপনি কি কোনো কারণে অসন্তুষ্ট আমার উপর?”

মি. ইজনাম থেমে গেলেন যেন কিছুক্ষণ। পরমুহূর্তেই আরো কাছে এগিয়ে এলো শ্যামার দিকে। শ্যামা বসে ছিলো। এভাবে এগিয়ে আসতে দেখে দাঁড়িয়ে গেলো। মি. ইজহান যত এগিয়ে আসচ্ছে, ততোই ঢিপঢিপ করে বেজে চলছে হৃদপিণ্ড। এক সময় থেমে গেলো শ্যামা। পিছনেই মি. ইজহানের নরম তুলতুলে বিছানা। মি. ইজহান তখন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেলো শ্যামার। হাতের ওয়াইনের গ্লাসটি ঢেলে দিলো শ্যামার গালে, ঠোঁটে, ঘাড়ে। শ্যামা চমকে উঠলো একেবারে। কন্ঠ তখন বড্ড কাঁপছে। শ্যামা বুঝে না, কেন ইজহানের সামনে এলেই তার কন্ঠ কাঁপে, কথা বলা বন্ধ হয়ে যায়, দলা পাকিয়ে বসে থাকে গলার মধ্যান্য। শ্যামা বলল,

“এ.. কি করছেন মি. ইজহান?”

মি. ইজহান ভাবলেশহীন, ঠান্ডা তার দৃষ্টি। শ্যামার গা হীম করে উঠলো। কেমন অদ্ভুত ভাবে একটা হাসি দিয়ে গালে হাত ছোঁয়ালো শ্যামার। গায়ে লোম দাঁড়িয়ে গেলো। শ্যামা নিভু নিভু চোখে চেয়ে আছে। মি. ইজহান তখন অল্প আওয়াজে বলল,

“আগে চেষ্টা করি, তারপর নাহয় বুঝবো আমি সন্তুষ্ট নাকি অসন্তুষ্ট! ”

শ্যামা অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম, মি ইজহানের কথায়। কিছু বুঝে উঠার আগেই ধাক্কা দিলেন। টাল সামলাতে না পেরে বিছানায় পড়ে গেলো শ্যামা। মুখ দিয়ে কিছু বলবে তার আগেই মি. ইজহান তার হাত, মুখ বেঁধে দিলো শ্যামার গলার স্কার্ফ দিয়ে। শ্যামা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো মি. ইজহানের দিকে। ইজহান বাঁকা হাসচ্ছে। মনে হচ্ছে ইজহান রূপি কোনো দৈত্য এ মুহূর্তে হামলে পড়েছে শ্যামার উপর। পরনের কাপড় টেনে টেনে খুলে মাটিতে ফেলে দিচ্ছে। হিংস্র হায়না যেমন খাবার পেলে ছিঁড়ে খুঁড়ে খায়, মি. ইজহান এখন তাই করছে। শ্যামা চিৎকার করতে চাইছে, বলতে চাইছে,,

” আমাকে.. আমাকে ছেঁড়ে দিন, আমি আর পারছি না…”

কিন্তু কোনো শব্দ বের করতে পারছেনা সে। বের হচ্ছে শুধু গোঙ্গানির চাপা আওয়াজ, আর চোখের জল।

কিছুক্ষণ আগের ঘটনা। মি. ইজহান তার অফিস কেবিনে বসে ছিলো। ঠিক তখনি তার ইন্সটাতে একটি মেসেজ আসে। এই মেসেজ দাতাকে সে চিনে। এ আর কেউনা তারই বন্ধু, ঠিক বন্ধু বললে ভুল হবে, বিশ্বাস ঘাতক বন্ধু রিদোয়ান খান। বরাবরের মতোই সে মনে করিয়ে দেয়, তার ভালোবাসার মানুষটিকে সে কিভাবে কেঁড়ে নিয়েছিলো। আজ-ও তাই করেছে। লিখেছে,

“আমার জানে জিগার দোস্ত। কেমন আছিস? জানিস আমি শ্যামাকে পেয়ে গেছি। খুব শীঘ্রই আমার বুকে থাকবে সে। মনে আছে? সে দিনের কথা? স্কুলের শেষ দিনটিতে আমাকে কিভাবে শ্যামা চুমু খেয়েছিলো? এবার আমিও খাবো সেভাবেই চুমু, তার পুরো শরীরে। আর তুই তখন দেখেই গিয়েছিস, এবারো দেখেই যাবি। তোর ধারা কিছুই হবার নয় বাছা। এ জম্মে শ্যামা কিন্তু আমার।”

মেসেজটি পড়েই মাথা গরম হয়ে যায় ইজহানের।সেদিনটি সে কিভাবে ভুলবে? সে দিনটি সে কখনোই ভুলতে পারবেনা। চোখের সামনে এখনো ভাসে যেন মি. ইজহানের। দুটো ছেলে মেয়ে একটি ক্লাসে ঢুকে গেলো। পরক্ষণেই বন্ধ হয়ে গেলো দরজা। এইটুকু দেখেই ইজহানের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পরে। এক মুহূর্ত দেড়ি না করে চলে আসে বাসায়, পছন্দের গিটারটি ভেঙ্গে ফেলে, ভেঙ্গে ফেলে দামি আসবাব। ঝনঝন করে গুঞ্জন হয় পুরো রুমে। আজ যেন তার তাই করতে মন চাইছিলো, সব ভাঙ্গিয়ে, গুড়িয়ে জ্বালিয়ে দিতে চাইছিলো। কিন্তু তার মাথায় তখন চলল অন্য খেলা। রক্তিম হয়ে উঠা চোখ জোড়া দিয়ে ফোনটি একবার দেখে নিয়ে কল করলো শ্যামাকে।

এসব ভেবেই রাগ আরো দিগুণ হলো যেন ইজহানের। নিজের শরীরের সবটুকু দিয়ে ছিন্নভিন্ন করতে চাইলো শ্যামার শরীর। ঘন্টাখানেক যেতেই ছেড়ে দিলো শ্যামাকে, হাতের বাঁধন, মুখের বাঁধন খুলে দিলো সে। শ্যামা এবার ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলো। শ্যামাকে ছেঁড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো সে। ঠিক কি ভেবে আবার থেমে গেলো। শ্যামার কাছে ফিরে এসে আবারো ঝুঁকে পড়লো। শ্যামা ভয়ে আধমরা। তখনি নরম আওয়াজে অদ্ভুত হাসি দিয়ে বলল মি. ইজহান,

“এখন আমি সন্তুষ্ট, তা বলতে পাড়ি!”

শ্যামা স্তম্ভিত হয়ে গেলো। মি. ইহানের কথা গুলো বারবার কানে বাজতে লাগলো। সে এবার সন্তুষ্ট। শ্যামার মনে এবার প্রশ্ন উঁকি দিলো,

“মি. ইজহানের কি তাহলে শরীরিক চাহিদাটাই সব?”

মি. ইজহান দরজাটি স্ব শব্দ বন্ধ করে চলে গেলেন। সে রাতে আর উনি ফিরলেন না। শ্যামা শরীরের ব্যথায় জ্বর এসে গেলো। কিছুটা খাবার খেয়ে ঔষধ খেলো। এবং ঘুমনের জন্য বিছনায় যেতেই ওর ফোনটা একটা মেসেজ এলো। এত রাতে কে মেসেজ করেছে? ভেবেই কৌতূহলে ফোনটা হাতে তুলে নিলো। একটা আননোন নাম্বার থেকে একটা মেসেজ এসেছে। ফোন স্ক্রল করতেই জ্বলজ্বল করে উঠলো,

“আই লাভ ইউ জান! সি ইউ সুন…..!”

শ্যামা থমকালো। এমন একটি মেসেজ তাকে কে পাঠালো? ভেবেই গা হীম করে উঠলো। কিছুক্ষণ ভাবতেই ঠোঁট দুটি নেড়ে, ভয়ে মাথা কন্ঠে উচ্চারণ করল,

“র..রি..দ!

চলবে,

(ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন)