আঁধারিয়া অম্বর পর্ব-০৭

0
972

#আঁধারিয়া_অম্বর
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
০৭।

সকালের মিষ্টি রোদের ছোঁয়ায় ঘুম ভেঙে যায় শ্যামার। চোখ পিটপিট করে তাকায় এদিক ওদিক। মি. ইজহান নেই। পরক্ষণেই মনে পরে কাল রাতের কথাটুকু। তিক্ততায় বিষিয়ে উঠলো মন। মনের সাথে লড়াই করে, হতাশার শ্বাস ছেড়ে নেমে পড়লো বিছনা থেকে। রেডি হয়ে বেড়িয়ে গেলো নতুন এক সূচনার পিছনে।

নিউজ এজেন্সি পৌঁছাতে জাহিদ হেসে বলল,

“মামা এই কাগজটা দেখ, আমাদের শান্তনু স্যারর খুঁজে এনেছে। শ্যামা কাগজটি হাতে নিলো। তারপর হো হো করে হেসে উঠলো। গাল ব্যথা করার উপক্রম যেন। শ্যামা জোরে জোরে পড়লো,

” পাত্রি চাই, সুন্দর, দেখতে যেন ক্যাটরিনা কাইফ হয়, বডি ফিগার দীপিকা পাডুকোন, লম্বায় কারিনা কাপুর। হাসলে যেন গালে টোল পড়ে। ”

এতটুকু তাো যেন চলে, কিন্তু এরপরে ছেলেটির ছবি দেখে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লো চেয়ার থেকে। লোকটি বেটে, মাথায় মোটা, চউড়া টাক, এক হাত পেট বেড়িয়ে, বয়সে ৬০/৬৫ হবে। এর এমন সাধ দেখে হো হো করে হেসে উঠলো আবার। শ্যামার তো চোখেই জল। বলল,

“শান্তনু স্যার এই প্রাণীদের কই থেকে আমদানি করে রে? মানে? এগুলো কোনো কোনো নিউজ? এগুলো পড়ে পাঠকদের না গালি খাইতে হয়!”

তখনি জাহিদ দু হাত তুলে বলে,

“আমিতো একদম চাই এই শান্তনু গালি খাক। খাইশটা বেটা!”

বলে দুজন আবার হেসে উঠলো। তখনি পিছন থেকে সতর্ক ভাবে কেশে উঠলো শান্তনু। তাকে দেখেই চমকে গেলো দুজন। এবং চাপা হেসে ক্যাবলাকান্তের মতো বলল দুজনেই,

“স্যার আপনি?”

শান্তনু চশমার পিছনে লুকানো চোখ দুটো দিয়ে সরু করে চাইলো। থমথমে কন্ঠে বলল,

“মজা করা যদি শেষ হয়! কাজে লেগে পড়েন। এই কদিনতো কোন কাজ আপনারা তেমন করেন নি। যদি কাজে বদলে মজাই করতে ইচ্ছে হয়, তাহলে কোনো কমেডি সোতে জয়েন হন। আমি ও বরং হাফ ছেড়ে বাঁচি। যতসব আবাঙ্গাল!”

শেষ কথাটি চিবিয়ে চিবিয়ে বলল শান্তনু। এবং একটি কাগজ এগিয়ে দিয়ে চলে গেলো ধপাধপ পায়ে। এদিকে মুখ টিপে দুজন হেসে কাজে লেগে পড়লো। শান্তনুর দিয়ে যাওয়া কাগজটি দেখে নিলো। একটি গল্প লিখা তাতে। এটি ছাপানো হবে কালকের কাগজে। শ্যামা ছোট থাকতে এমন গল্পের কত যে ওয়েট করে থাকতো। আর এখন সে নিজেই এসব করে। হালকা হেসে মাউসের উপর হাত রেখে ক্লিক করবে, ঠিক তখনি পুরোনো দিনের একটি স্মৃতি ডায়েরির পাতা উল্টালো।

কল্পনা….

এসএসসি পরীক্ষা সবেই শেষ হয়েছে শ্যামার। বোরিং সময় পাড় করে চলেছিলো সে। বাড়ির ভিতরে লাইব্রেরিখানার মোটামুটি সব বই পড়া শেষ তার। কি করবে, কি করবে ভাবতে ভাবতে বরাবরের মতো পেপার হাতে তুলে নিলো। খবরের কাগজের মাঝে কিছু কিছু মজার গল্প থাকে, যা শ্যামা খুব অগ্রহ সহকারে পড়ে। আজোও তার ব্যতিক্রম হলো না। ১৬ বছর বয়সী মেয়েটি বরাবরের মতোই পড়তে লাগলো গল্প। গল্প শেষে পেপার ভাজ করার সময় চোখে পড়লো একটি বিজ্ঞাপন।

“প্রেমিকা চাই। প্রেম করতে চাইলে ফোন করুন নিচের নাম্বারে!
নামঃ সুফিয়ান দ্যা সিক্রেট বয়। (ছদ্মনাম), ফোন নাম্বারঃ*****

শ্যামা থ মেরে বসে রইলো। এমনো কি কখনো হয় নাকি বিজ্ঞাপন? কিছুক্ষণ ভাবলো। তারপর খিলখিল করে হেসে উঠলো। কিশোরী হাসি শুনে পাশেই বসে থাকা ছোট বোন জান্নাত ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে দেখলো। তার বড়পু এভাবে হাসচ্ছে কেন? কিছু বুঝে উঠলো না সে। শ্যামা তখন আপন মনে কাগজটি কেঁটে নিলো। বান্ধবীদের দেখাবে বলে। মনে মনে ভাবলো,

” একটা বার ফোন করে দেখাই যাক না এই বেকুব টা কে? না হয় বান্ধবীরা মিলে প্রেম করার শখ ঘুচিয়ে দিব!”

আবার খিলখিল করে আসলো। ঘরময় মিষ্টি খিলখিল হাসি ঝমঝম করে উঠলো। কিন্তু সে কি আদৌ জানে? তার ভাগ্য তাকে কোথায় নিয়ে যাবে?

সেদিন ঠিকি ফোন করেছিলো গুনে গুনে পাঁচ বার রিং হওয়ার পর ফোনটা অপাশ থেকে তুলে কেউ। একটা ঝংকার তুলা কন্ঠ বেজে উঠলো ওপাশ থেকে। শ্যামা সহ তার বান্ধবীরাও হা হয়ে গেছিলো। ফোন তখন লোডে দিয়া ছিলো। শ্যামার বাবা এস এস সি পরীক্ষা পাশ করাতে শ্যামাকে নোকেয়া বাটন ফোন কিনে দেয়। তখন টার্চ ফোন চালানো অহরহ ছিলো না। চালালেও অ্যান্ড্রয়েড ছিলো না। না এত আপডেট ছিলো সব। শ্যামা সেদিন সেই কন্ঠ শুনে এক প্রকার হারিয়ে গেছিলো অজানা জগতে। মজার ছলে করা এই ফোন কলটি পরবর্তীতে তার জীবনের একটি অংশ হয়ে যায়।

শ্যামার বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। সুফিয়ান দ্যা সিক্রেট বয়, সিক্রেটি রয়ে গেলো। আজ জানতে পারলো না৷ ওই পছন্দের মানুষটির কথা।

————-

অফিস থেকে বের হতে হতে প্রায় সন্ধ্যাই হতে চলেছে। একে একে সবাই বাসার দিকে পা বাড়াচ্ছে। শ্যামা নিজের কাজ গুছিয়ে নিচে নেমে এলো। অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে রিকশা খুঁজতে লাগলো। আজ জাহিদ বিকেলেই ছুটি নিয়ে চলে গেছে। তার গার্ল ফ্রেন্ড বাড়ি চলে যাবে গুড বায় জানতে হবে বলে। নয়তো প্রতিবার জাহিদ তাকে রিকশায় তুলে দিয়ে বাইক নিয়ে সটান করে চলে যায়। এদিকে মাগরিবের আজানে চারপাশে সুন্দর সুর তুলেছে। শ্যামা মাথার কাপড় ভালো করে টেনে দিয়ে আবার চোখ ঘুরালো। নাহ্, কোথাও নেই খালি রিকশা, যা আসচ্ছে সব কটাতেই প্যাসেঞ্জারে ঠাসা। এরি মাঝে একটি সাদা গাড়ি খুব জোড়ে ব্রেক কসলো শ্যামার সামনে। শ্যামা ভয় পেয়ে গেলো। বুকে মাঝে থুতু দিয়ে কিছু কথা বলার জন্যই মুখ তুলতেই চক্ষু চড়কগাছ। মুখের মাস্ক আর সানগ্লাস খুলে ওয়েস্টার্ণ একটি ড্রেস পড়ে, হিলের কটকট শব্দ তুলে এগিয়ে আসচ্ছে একটি মেয়ে। কিছুটা কাছে আসতেই শ্যামা বলল,

” একি…. মিস. চৈতি যে। এ আবার এখানে কেনো?”

শ্যামা ভাবছিলোই তখনি চৈতি এসে দাঁড়ালো তার সামনে। মেজাজ খারাপ করে বলল,

” হাউ ডেয়ার ইউ? আমার সম্পর্কে এসব গুজব ছড়িয়ে দিচ্ছো কেন মেয়ে?”

শ্যামা প্রথমে বুঝতে না পাড়লেও এবার ঠিকি বুঝতে পেরেছে, চৈতি আসার কারণ। সে শক্ত কন্ঠে বলল,

“আপনি কি ড্রাগস নিন না? এটা কি মিথ্যা? ”

চৈতি কিড়মিড় করে উঠলো,

“শোনো মেয়ে আজেবাজে বকবে না। তোমার চাকরি খেতে আমার এক মিনিট ও লাগবে না। সো ডোন্ট ওভার স্মার্ট। তোমাদের মতো মেয়েদের আমার চেনা আছে। টাকার ভুক্ষা সব।”

শ্যামার গায়ে জ্বলন্ত কয়লা যেন লাগিয়ে দিলো কেউ। বলল,

” এক্সকিউজমি? আমার মতো মেয়ে মানে? কি বলতে চাইছেন? আর টাকার ভুক্ষা মানে কি? এসবের যদি ইচ্ছেই থাকতো, আপনার মতো আমিও হয়তো কোনো ধনী ব্যাক্তি বা মাফিয়াদের কোলে বসে থাকতাম।”

খোঁচা টা যেন জায়গায় মতো লেগে গেছে। আগুনের পিন্ডর মতো চোখ করে ঠাস করে এক চড় মারলো শ্যামাকে। শ্যামা মোটেও এর জন্য প্রস্তুত ছিলো না। থাকলে হয়তো নিজেকে রক্ষা করতে পাড়তো সে। শ্যামা নিজের গালে হাত দিলো। ব্যথায় টনটন করে উঠলো ডান পাশের গালে। সে অবাক হয়ে চাইলো চৈতির দিকে। চৈতি গগনবিদারী চিৎকার করে বলে উঠলো,

” আমি বুঝেছি, তুই রিদকে কেড়ে নিতে চাস তাই না? তা কখনো হবে না। কখনো না। রিদ শুধুই আমার। আমি… আমি তোকে দেখে নিবো!”

বলতে বলতে গাড়িতে চড়ে বসলো চৈতি। শ্যামা তখন থ কিছুই বুঝতে পারছেনা সে। রিদের সাথে যার তার সাথে সম্পর্ক তাক তাতে শ্যামার কি? যা চলে গেছে তা তো ফিরে আসার কোনো পথ থাকে না। আর এখন তো আরো নেই, কারণ শ্যামা তো কারো কাছে বন্দী। এসব ভাবতে ভাবতেই শ্যামা রিকশা করে বাসায় চলে এলো।

এদিকে এতক্ষণে হয়ে যাওয়া সব টুকু ঘটনা স্ব চোখে দেখেছে ইজহান। গাড়ির স্টিয়ারিং এ শক্ত করে ধরে আছে হাত। এই মুহূর্তে মনে যাইছে চৈতিকে সে খুন করে ফেলতে। কত বড় সাহস তার? তার শ্যামার গায়ে হাত তুলে? কঁপালের রগ দাঁড়িয়ে গেলো ইজহানের। চৈতির গাড়ি পিছনে ছুটলো এবার। ওভার ব্রীজে উঠতেই চৈতির গাড়ির পিছন থেকে ধাম করে ধাক্কা বসালো ইজহান। ভয়ে আর্তনাদ করে উঠলো চৈতি। ড্রাইভার রীতিমতো গাড়ির দরজা খুলে ছিটকে পড়েছে রাস্তার কিনারে। ইজহান রাগে হতবুদ্ধি। আরেক ধাক্কায় একেবারে গাড়ি চলে যায় রেলিং এর সিমেন্ট ভেঙ্গে অর্ধেক বাহিরে। চৈতি তখন একাই ভিতরে বসে। কঁপাল, নাক ফেঁটে রক্ত ঝড়ছে। বহু কষ্টে গাড়ি থেকে বের হতেই গাড়িটি নিজে পড়ে গেলো সাথে সাথে। চৈতি হাউ মাউ করে কেঁদে দিলো প্রাণে বেঁচেছে বলে। ভয়ে ভয়ে যখন পিছনে তাকালো তখনি চোখে পড়লো একটি ব্ল্যাক কার। ভিতরে কে? বুঝা যাচ্ছে না। ঠিক তখনি হালকা করে নেমে গেলো কাঁচ ভিতর থেকে তখন কেউ একজন বলে উঠলো,

“এটা শুধু ট্রেইলার ছিলো। ফিল্ম দেখতে না চাইলে, শ্যামার থেকে দূরে থাকবে। নয়তো……!”

গাড়ির কাচটি উঠে গেলো। এবং স্বাই করে চলে গেলো। চৈতি স্তম্ভিত হয়ে রইলো। মাথার মাঝে কিছুই ঢুকছে না তার। যেন ট্রমায় আছে সে। কিছুতেই বুঝতে পাড়ছে না, সামন্য নিউজ এজেন্সির একটি কর্মচারির গায়ে হাত তোলায়, তার জানটাই চলে গেছিলো প্রায়? কে এই ব্যক্তি??

চলবে,