আঁধারিয়া অম্বর পর্ব-০৯

0
890

#আঁধারিয়া_অম্বর
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
০৯

ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি নেমে গাছ-পালার শরীরের জমা ধুলোর স্তপ ধুয়ে দিচ্ছে। রাস্তার ধারের গর্ত গুলোও ভরে আছে। সন্ধ্যার টিমটিম আলোয় বৃষ্টির লিলা খেলায় ব্যস্ত শহর থমকে গেছে কিছুক্ষণের জন্য। কেউ কেউ আশ্রয় নিয়ে দূরের টি স্টলে আব্র কেউ কেউ মাথা ঠাই করেছে বন্ধ হয়ে যাওয়া দোকানপাঠে। আবার কেউ কেউ রিকশা, অটো, সি এন জি চাপিয়ে চলে যাচ্ছে নিজের গন্তব্যে। এসব মানুষের মাঝে এক মাত্র ব্যস্ততা নেই শ্যামার। রাস্তার ধারেই ছোট একটি পার্ক। সেখাই সিমেন্টের তৈরি বসার জায়গায় বসে আছে। ভিজে চুবুচুবু অবস্থা। সাজের আলোয় ফ্যাকাসে হয়ে আসার ঠোঁট জোড়া কাঁপছে শ্যামার। তবুও সে বসেই আছে। এর মাঝেই ওর ফোনটি স্ব শব্দে চিৎকার করে উঠলো। ফোনটি বের করতেই ফ্যাকাসে ঠোঁটে হাসির রেখা দেখা গেলো। শ্যামা কানে ফোন চাঁপলো। খুশি খুশি কন্ঠে বলল,

“ছুটকি? ”

ওপাশ থেকে ভেসে এলো শ্যামার ছোট বোন জান্নাতের অসংখ্য অভিযোগ জড়ানো কন্ঠ,

“আপুই কই তুই? আমি কতক্ষণ বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকবো?”

বড্ড অবাক হলো শ্যামা, কঁপালের মাঝে সুক্ষ্ম ভাজ ফেলে অনুসন্ধানী কন্ঠে বলল,

“তুই কোথায়?”

“কোথায় আবার? বাসার বাহিরে দাঁড়িয়ে আছি। ”

চোখ বড় বড় হয়ে গেলো শ্যামার। বলল,

“জান তুই দাঁড়া আমি এখনি আসচ্ছি!”

বলেই কল কেটে একটা রিকশা নিয়ে ছুটলো তার বাড়ির দিকে। রাস্তায় রিকশা দাঁড় করিয়ে কিছু বাজারো করে নিলো সে। দশ মিনিটের মাথায় পৌঁছে গেলো তাদের বাড়ি। পুরোনো একটি দোতলা বাড়ি। এক সময় ঝাঁকঝমক থাকলেও এখন জীর্ণশীর্ণ অবস্থা। রিকশা থেকে বেগ নামি যেই বাড়ির ভিতরে পা দিলো। ওমনি ছুটে এলো জান্নাত শ্যামার কাছে। শ্যামাও পরমযত্নে বোনকে বুকের সাথে আগলে নিলো। ভালো-মন্দ কথা বলতে বলতে ভিতরে চলে এলো। জান্নাত নিজের রুমে চলে গেলো চেঞ্জ করতে। এর মাঝেই শ্যামা কাপড় পাল্টে লেগে পড়লো বোনের পছন্দ মতো খাবার বানাতে। অনেক দিন পর ছোট বোনকে নিজ হাতে খাইয়ে দিবে সে।

এদিকে মেহরাব বাড়ি রাণী রূপে সাজানো হয়েছে। চারিদিকে মেহমানদের সমাগম গিজগিজ করছে। বড় বড় সেলিব্রিটিদের দেখা যাচ্ছে জায়গায় জায়গায় গোল করে গল্প গুজব করতে। বিশাল লিভিং রুমে নিয়ন হলদে আলো। সবাই অপেক্ষা করছে বার্থ ডে বয়ের জন্য। চলচ্চিত্র জগতে এক যুগ রাজ্যত্ব করা কিং এর জন্য। এদিকে দাদিজান বার বার নিপাকে এটা সেটা বলেই যাচ্ছে। এর মাঝেই রেলমন্ত্রী আরাফ হোসাইন তার সুন্দরী তরণী মেয়েকে নিয়ে হাজির হয়েছে। মেয়েটি টাইটফিট আউট ফিটে , এক গাদা মেকাপ করে এসেছে। আরাফ এসেই কুষল বিনিময় করে বলল,

“ইজহান বাবা জি বুঝি এখন আসে নি?”

দাদিজান চাপা হেসে বললেন,

“কিছুক্ষণের মাঝে চলে আসবে। আর একি আপনার মেয়ে নাকি?”

আরাফ হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ায়। দাদিজান আবারো চাপা হেসে বলে,

“বাহ্ ভাড়ি মিষ্টি মেয়ে তো! নাম কি তোমার?”

মেয়েটি লাস্যময়ী ভঙ্গিতে হেসে বলল,

“মৌপ্রিয়া!”

দাদিজান বললেন,

“বাহ্ সুন্দর নাম!”

এর মাঝে আরো কিছু কথা বললেন তারা। তার পর চলে গেলেন ভিতরে। একে একে সবাই এসে পড়েছেন। সবার সাথেই এসেছে বিয়ের বয়সি মেয়ে। সবার একই ধান্দা। ইজহানের গলায় ঝুলে পড়ার। কিন্তু তা কি আদো সম্ভব? দাদিজান জানে ভালো করে, এদের সকলের চিন্তায় এক গাদা বালি ছিটিয়ে দিবে তার নাতি। এরি মাঝে স্বা করে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করে একটি কালো গাড়ি। বরাবরের মতোই মেয়েদের বুক কাঁপানো লুকে নেমে আসে ইজহান। তখনি দাদিজান এসে পাশে দাঁড়ালো। আশেপাশের মিডিয়ার লোকজন ফটফট করে ছবি তুলতে লাগলো। ইজহানের সেদিকে মাথা ব্যথা নেই। সে ভিড়ের মাঝে চোখ বুলিয়ে দেখে নিলো তার পরিচিত মুখখানা দেখা যায় কি না, এত রিপোটারের ভিতরে। কিন্তু নাহ্। শ্যামা নেই। তাহলে সে কই? সে কি পার্টির ভিতরে আছে??

বড় বড় পা ফেলে ইজহান ভিতরে ঢুকলো। নাহ্ নেই। শ্যামা নেই। তার শরীরের গ্রাণ নেই এই ঝাঁক ঝমক মহলে। তাহলে? তাহলে সে কই? ইজহান দাদিজানের কাছে গেলো, ঠান্ডা গম্ভীর কন্ঠে বলল,

“শ্যামা কই দাদিজান?”

দাদিজান সোজাসাপটা উত্তর দিলেন,

“আজ ওকে বাসায় আসতে না করে দিয়েছি আমি!”

ইজহান এতে আহত হলো খুব। বলল,

“দাদিজান সে আমার স্ত্রী, সে এখানে না আসলে যাবে কোথায়?”

দাদিজান চোখ মুখ শক্ত করে বললেন,

“জাহান্নামে যাক, একটা রক্ষিতার জন্য এত দরদ ভালো না!”

ইজহান দাদির দিকে ঠান্ডা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। এতে দাদিজানের কিছুই যায় আসে না। উনি উনার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ঠিক সেই সময় কেউ এসে জড়িয়ে ধরলো ইজহানকে, ইজহান চমকে পিছনে তাকাতেই একটা পুরুষালি কন্ঠ বলে উঠলো,

“হেপি বার্থ ডে ভাই!”

ইজহান খুশিতে ভাইকে বুকে টেনে বলল,

“তুই কবে দেশে এলি?”

“আজ সকালেই! কিন্তু তুমি তো ছিলেই না..”

” হ্যাঁ একটা জরুরি কাজে গেছিলাম! ”

“নিজের বার্থ ডে তেও কাজে? চলো এবার কেক কাঁটা যাক। মাম্মা পাপা ওয়েট করছে তোমার জন্য!”

ইজহান মলিন হাসলো। ভাইকে টেনে নিয়ে কেক কাটলো সে। কিন্তু তার মন? তাতো অন্য কোথাও। কেক কাটা শেষ হতেই বাসা থেকে বেড়িয়ে গেলো। এত এত মানুষের মাঝে কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। শুধু মনে হচ্ছে, একটি বার, একটি বার তার শ্যামাকে দেখা চাই। সে গাড়িতে চড়ে বসলো। কানের মাঝে ব্লুটুথ লাগিয়ে কল করলো শ্যামাকে। শ্যামার নাম্বার বন্ধ। এতে আরো টেনশনে পড়ে যায় ইজহান। সে এখন কোথায় খুঁজবে শ্যামাকে? এসব ভাবতেই মাথায় আসে শ্যামার আগের ঠিকানার কথা। চট জলদি সেখানে চলে আসে ইজহান। বাসার বাহিরে গাড়ির ভিতর বসে এক দৃস্টিতে তাকিয়ে থাকে সামনের প্লাস্টার উঠে যাওয়া, রং নষ্ট হয়ে যাওয়া বাড়িটির দিকে।

এদিকে শ্যামা বোনকে খাইয়ে দিচ্ছে আর বোনের নানান কথা শুনছে। জান্নাত আজ এত এত গল্পের ঝুঁড়ি খুলে বসে আছে। কার সাথে ক্লাসে কি হলো? ভার্সিটি কোচিং-এ কোন ভাইয়াকে তার ভালো লাগে, কোন ভাইয়াটা বিরক্ত কর। এসব আর কত কি…! শ্যামা এক মনে শুনে যাচ্ছে। আর নলা পুরে দিচ্ছে মুখে। তখনি বলল আবার,

“জানো আপুই, একদিন কে যেন আমাকে বক্স ভর্তি করে চকলেট পাঠিয়েছিলো। পরে সবাই শেয়ার করে খেয়েছি!”

শ্যামার মাথায় কথাটি ঝংকার তুললো,

“চকলেট? কি দিলো এই চকলেট??”

শ্যামা ভ্রু কুচকে বলল,

“খবর নিসনি পড়ে কে দিলো?”

“নিয়েছি, কিন্তু ব্যক্তিটা কে খুঁজে পায়নি।”

শ্যামার মাথায় চিন্তার ভাজ পড়লো। এই আননোন ব্যক্তিটি আবার রিদ নয় তো?ভাবতেই আত্মকে উঠলো শ্যামা। নিজেকে সামলে বোনকে সময় দিলো। এবং ঘুম পারিয়ে দিতে লাগলো জান্নাতকে। বাহিরে আবার ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। ইজহান গাড়ি সাথে হেলে এখনো এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দোতলার আলো জ্বলা ঘরটিতে। বৃষ্টির পানিতে ভিজে গেছে একদম। সুন্দর চুল গুলো চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে পানি। এরি মাঝে ইজহানের মেনেজার এসে ছাতি দাঁড়ায় তার পাশে। বলে,

“ইজহান, বড় স্যার তোমাকে ইমিডিয়েটলি যেতে বলেছে।”

ইজহান গম্ভীর কন্ঠে বলল,

“উনাকে বলো দাও আমি এখন বিজি আছি!”

অধিরাজ বলল,

“ইট’স ইট’স আর্জেন্ট। ”

ইজহান আবার বলল,

“এই মুহূর্তে এটি ছাড়া আমার কাছে ইমপোর্টেন্ট কিছুই না।”

অধিরাজ হাল ছেড়ে দিলো। ইজহান কিছুখন সেখানে দাঁড়িয়ে পা বাড়ালো ম্যামার বাসার দিক। অধিরাজ এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো তার স্যারের দিকে।

জান্নাতকে ঘুম পাড়িয়ে নিচে নেমে আসে শ্যামা। অফিসের কিছু কাজ করে সে ও ঘুমাতে যাবে। তখনি দরজায় খটখট শব্দ হয়। শ্যামা ভয় পেয়ে যায় কিছুটা! এত রাতে তার বাড়ি কেউ আসার মতো কোনো লোক তো নেই, তাহলে কে এলো? শ্যামার ভাবার মাঝে আবারো দরজা নক করলো কেউ। একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো সারা গায়ে। শ্যামা টেবিলের উপর থেকে একটি স্টিলের চামচ তুলে নিলো। ভয়ে ভয়ে দরজার কাছে এসে বলল,

“ক…কে? ক…কে বাহিরে?”

কোনো শব্দ নেই। থমথমে গুমাটে একটি পরিবেশ সৃষ্টি হলো মুহূর্তেই। শ্যামা আবার জিজ্ঞেস করলো। তখন সব নিস্তব্ধত। শ্যামার মাথায় এর মাঝেই বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা যাচ্ছে। শব্দ বন্ধ হওয়াতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে দুকদম পিছিয়ে যেতেই আবারো শব্দ করে উঠলো। শ্যামা মনে সাহস করে দরজা খুলতে চোখ বড় বড় করে তাকালো….

চলবে,

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। 🙈🙈