আকাশেও অল্প নীল পর্ব-৫+৬

0
217

#আকাশেও_অল্প_নীল
#পর্বঃ০৫
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

১২,
পরেরদিন সকালবেলায়, নাস্তা খেয়ে রুমে বসে ফোন ঘাটছে রাইমা। তখনই শাহনাজ বেগম রুমে আসলেন। মা-কে দেখে ফোন রেখে রাইমা বললো,

“কিছু বলবে মা?”

শাহনাজ বেগম মেয়ের কাছে একপাশে বসলেন। মেয়ের গালে হাত রেখে বললেন,

“সেদিন একটু বেশিই বকাঝকা করে ফেলেছিলাম, তাইনা?”

“হঠাৎ এই প্রশ্ন করছো কেনো?”

রাইমা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে। শাহনাজ বেগম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,

“না হলে তুমি বাসা ছেড়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা কেনো করেছিলে?”

“ভুল বুঝছো মা। আমি বাসা ছেড়ে যাইনি সেদিন। এমনি মন খারাপ ছিলো, হাটতে বের হয়ে অনেকটা দূর চলে গিয়েছিলাম বেখেয়ালে।”

“কিন্তু তোমার চোখ তো মিথ্যা বলছে রাইমা। মায়ের কাছে কি লুকাচ্ছো? মায়েরা কিন্তু মিথ্যা ধরে ফেলতে পারে।”

রাইমা ভেতর থেকে কেঁপে উঠে মায়ের কথায়। আসলেই তো সে কথা লুকাচ্ছে। থাক না কিছু কথা, অন্তরালে। রাইমা মা-কে আশস্ত করতে হাসার চেষ্টা করে বলে,

“মাই মাদার বাংলাদেশ, আমি তোমার থেকে কিছু লুকাচ্ছি না। একটু বিশ্বাস করো আমায়।”

“আচ্ছা বিশ্বাস করলাম। কিন্তু তোমার খালামনি ফোন দিয়ে যে মাহাদের কার সাথে জানি সম্পর্ক আছে। সেই মেয়েকে দেখতে যাবে। তোমাকেও সাথে যেতে বলেছে নাকি সেই মেয়ে! আগামীকাল যাওয়ার সময় তোমার সাথে আমাকেও যেতে বললো তোমার খালামনি।”

মায়ের কথাতে স্নেহার পাশাপাশি যখনই মনে পরলো দিগন্ত স্নেহার ভাই, রাইমার মুখটা চুপসে গেলো। সে নিস্তেজ ভাবে বিছানায় আগের মতো হেলান দিয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করে বললো,

“আমার বদলে তুমিই চলে যেও মা। আমি যাবোনা। আগামীকাল আমার ইম্পরট্যান্ট ক্লাস আছে।”

“কিন্তু তোমার খালামনি যে বললো! না গেলে বিষয়টা কেমন একটা দেখায় না রাইমা! মেয়েটাও যেখানে তোমায় বলেছে!”

“আগামীকালের বিষয় আগামীকাল দেখা যাবে মা। আপাতত এসব নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করছেনা। তুমি রান্না করবেনা দুপুরের? চলো তোমায় সাহায্য করি!”

রাইমা কথা কা’টাতে রান্নার কথা তোলে। শাহনাজ বেগম উত্তরে বলেন,

“হ্যাঁ রান্না একটু করতে হতো৷ কিন্তু তোমার সাহায্য করতে হবে না। রেস্ট করো। সারা সপ্তাহ ভার্সিটিতে ছোটাছুটি করো। গতকালও মাহাদের সাথে দৌড়ে বেড়ালে। রেস্ট করো।”

“বাবা আর আরফান কোথায়?”

রাইমা প্রশ্ন করে। শাহনাজ বেগম উত্তরে বলেন,

“বাজারে গেছে একটু। তোমার ভাইয়ের কখন কি বায়না তার ঠিক থাকেনা। তুমি রেস্ট করো।”

শাহনাজ বেগম মেয়ের গালে হাত বুলিয়ে চলে গেলেন। রাইমা মুচকি হেসে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। চোখ বন্ধ করে কপালের উপর এক হাত দিয়ে শুয়ে পরে বিছানায়। চোখের পাতায় আবছা কিছু স্মৃতি। মনের ভেতর মোচর দিয়ে উঠে রাইমার। চোখের কার্ণিশে জলধারা বয়ে চলে। কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর রাইমা শার্লিনের কণ্ঠস্বর শুনতে পায়। ধরফরিয়ে উঠে বসে রাইমা। এই মেয়ে এখন এসে চোখে জল দেখলে নির্ঘাত কানের পোকা ভর্তা করে ছেড়ে দেবে। সে উঠে চোখ ভালো করে চোখ মুছেই ওয়াশরুমে যায় দৌড় দিয়ে। চোখমুখে জল ছিটায় ভালো করে। শার্লিন এদিকে রাইমার রুমে এসে হাঁক ছেড়ে রাইমাকে ডাকছে। রাইমা তোয়ালে দিয়ে চোখ মুখ মুছতে মুছতে রুমে এসে দেখে শার্লিন তার খাটে বসে আপেল খাচ্ছে। সে তোয়ালে ব্যালকনিতে মেলে দিয়ে এসে বসলো শার্লিনের পাশে। শার্লিন রাইমাকে দেখে ওর দিকে আপেল এগিয়ে দিয়ে বললো,

“আপেল খাবি?”

“তুই খাচ্ছিস খা, আমায় বলিস কেন?”

“কাঁদছিলি কেনো?”

রাইমা থমকে যায় শার্লিনের প্রশ্নে। চোখেমুখে বিস্ময় প্রকাশ পায় তার। সে বিস্মিত কণ্ঠে জিগাসা করে,

“কোথায় কাঁদলাম আমি? কি বলছিস?”

শার্লিন আপেলে আরও কয়েকটা কামড় দিয়ে শেষ করে। রাইমার ওড়নায় হাত মুছতে মুছতে বলে,

“আমার থেকে কথা আড়াল করতে শিখে গেছিস? বিষয়টা তোর সাথে যাচ্ছে না ঠিক।”

“কি সব যা তা বলছিস শালু!”

“এই ডাকলি শালু! তোর এতোটা প্রিয় এমনি এমনি হইনি, যতোটা হলে কেউ ভালোবেসে আমায় একটা ডাকনাম দিবে। ডাকনাম দেওয়ার জন্যও অফুরন্ত ভালোবাসা লাগে রাই। আর ভালোবাসার কাছ থেকেই আজকাল কথা লুকাস? বিষয়টা মেনে নিতে পারলাম না।”

১৩,
শার্লিনকে জড়িয়ে কাঁদছে রাইমা। হেঁচকি উঠে গেছে কাঁদতে কাঁদতে। শার্লিন কিছু সময় কাঁদার জন্য ছেড়ে দিয়ে যখন দেখলো কান্নার দমক বেড়ে যাচ্ছে, সে রাইমাকে ছাড়িয়ে সরিয়ে দিলো। চোখ মুছে দিয়ে বললো,

“আমি তোর বর নই যে জড়িয়ে কেঁদেই যাবি। আমার স্বপ্ন কিছু হলে আমার বরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদবো। কিন্তু তুই বাই এনি চান্স আমায় তোর বর ভেবে সেই স্বপ্ন পূরণ করছিস? তোর কপালে তো প্রেম ভালোবাসা নাই, তাই এমনটা ভাবতেও পারিস! বলে রাখি আমি কিন্তু ছেলে নই। চাইলে আমায় টেস্ট করে দেখতে পারিস আমি মেয়ে কিনা এটা নিয়ে সন্দেহ থাকলে।”

রাইমার মুহুর্তে কান্না থেমে হেঁচকি উঠে যায়। শার্লিন বেড সাইড টেবিল থেকে পানির গ্লাস নিয়ে রাইমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,

“খেয়ে নে। জানিনা আমি, আমার কথা শুনলেই তোর হেঁচকি কেনো উঠে?”

“তোর সাথে আমার বড্ড মিল বুঝলি শালু। এমনি এমনি তোকে আমার আত্মার সাথি বলি না। সবার জীবনে একটা ব্যক্তিগত মানুষ থাকা দরকার। সেই মানুষ যে শুধু ভালোবাসার মানুষই হবে, এমনটা নয়। এই তোর মতো আত্মার সাথী থাকলেই হবে। যে চট করে মন খারাপ ধরে ফেলব, অধিকার দেখিয়ে জানতে চাইবে কি হয়েছে, সময় দেবে। কানৃনা করার জন্য একটা ভরসার কাঁধ হবে। আর মুহুর্তে হাঁসাবে। সবার জীবনে এমন একটা মানুষ থাকে না। আমার ভাগ্য আমি তোকে পেয়েছি।”

রাইমা এক দমে কথাগুলো শার্লিনের উদ্দেশ্যে বলে। রাইমার ঠোঁটের কোণে হাসি। শার্লিন মুচকি হাসে, রাইমাকে জড়িয়ে ধরে বলে,

“আমারও ভাগ্য আমি তোকে পেয়েছি। কিন্তু বিশ্বাস কর তোকে আমার জীবনে আঁটকে রাখার বা তোর জীবনে আঁটকে থাকার কোনো ইচ্ছে নেই। আমরা দুজন দুজনের প্রতি আঁটকে থাকলে আমাদের বেচারা বরের কপাল পুড়”বে। ওদের কপালে বউ জুটবে না।”

রাইমা শার্লিনকে জড়িয়েই ওর পিঠে দুমদাম কয়েকটা কিল বসিয়ে দেয়। শার্লিন আরও শক্ত করে রাইমাকে জড়িয়ে ধরে। রাইমা হেসে জড়িয়ে ধরে বলে,

“তুই আর ভালো হলি না?”

“ভালো হলে তোকে কে হাসাবে রাই?”

“তোর ভালো হওয়ার দরকার নেই, এমনই থাকিস।”

“আচ্ছা এসব বাদ, কাঁদছিলি কেনো?”

“তুই বুঝলি কি করে আমি কাঁদছিলাম?”

“তোর চোখ মুখ বলে দেয়। তাছাড়া বাসায় এসে আগে তোর রুমেই উঁকি দিয়ে দেখলাম কাঁদছিস। এরপর আন্টির সামনে হইচই করে জানান দিয়ে দেখলাম, আমি এসেছি দেখে তুই কি করিস! কান্না প্রকাশ করিস, নাকি আড়াল করিস।”

রাইমা শার্লিনকে ছেড়ে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে বসে। মৃদু স্বরে বলে,

“বিকেলে চল ফুচকা খেতে যাই। সাথে একটু ঘুরাঘুরি করবো। এরপর বলবো।”

“ওকে ডান। বিকেলে রেডি থাকিস, আমি আসবো ডাকতে। এখন যাই।”

শার্লিন চলে যায় কথাটা বলেই। রাইমা ফোনে তাকিয়ে সময় দেখে নেয়। এরপর চলে যায় গোসল দিতে।

১৪,
দুপুরের খাবার পর একটু ঘুমিয়েছিলো স্নেহা। বিকেল চারটের সময় ঘুমটা ভেঙে যেতেই দেখে বাসার চেহারায় পাল্টে বসে আছে। পুরো ড্রইং রুম জুড়ে নতুন ফার্ণিচার আর সেগুলো সেট করছে কিছু লোকজন। দিগন্ত তাদের দিক নির্দেশনা দিচ্ছে কোথায় কি সাজাবে। আর পুরাতন গুলো বাসার বাইরে নিয়ে যাচ্ছে কিছু লোক। স্নেহা দিগন্তের এহেন কর্মে পুরোপুরি হতবাক। দিগন্ত বোনকে রুমের দরজার সামনে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বোনের পাশে দাড়িয়ে জিগাসা করে,

“আপা দেখ তো, সব পছন্দ হয় কিনা!”

“কিন্তু হঠাৎ সবকিছু এমন পাল্টে দিচ্ছিস কেনো?”

“আগামীকাল থেকে তোরও নতুন জীবনের সূচনা, আর আমারও। পুরোনো কোনো স্মৃতি আমাদের জীবনে না থাকুক।”

“সব পাল্টে দিলেই কি সব স্মৃতি মুছে যাবে দিগন্ত!”

দিগন্ত বোনের প্রশ্নে বোনের দিকে তাকিয়ে হাসে। স্নেহা অবাক হয়ে ভাইয়ের হাসি দেখে। প্রশ্ন করে,

“তুই হাসছিস?”

“হাসবো না তো কি করবো বলতো আপা! বাদ দে, তুই যে কেনো সব জেনেও মেনে নিয়ে মনে আঁটকে রাখিস! আমি জানিনা।”

“দিনশেষে এটাই মনে হয় উনি আমাদের জন্মদাত্রী মা।”

“মা শব্দ টার সম্মান উনি রেখেছেন?”

“বাদ দে তুই তোর কাজ কর।”

স্নেহা রুমে ঢুকে যায়। ফ্রেশ হওয়া জরুরী। দিগন্ত বোনের লুকোচুরি দেখে মৃদু হাসে। হাসতে হাসতেই গম্ভীর হয়ে যায়। হাত মুঠোবন্দি করে মনে মনে ভাবে,

‘জীবনেও উনাকে ক্ষমা করবোনা আমি, কখনও না৷’

“স্যার এই ল্যাম্পটা কোথায় রাখবো?”

যারা সবকিছু জায়গা মতো সেট করে দিচ্ছিলো, তাদেরই একজনের প্রশ্নে দিগন্ত সব ভাবনা চিন্তা ছেড়ে ওদের সাথে কাজে ব্যস্ত হয়ে পরে। অন্তত কাজের মাঝে থাকলে মানসিক শান্তি পাওয়া যায়।

চলবে?

#আকাশেও_অল্প_নীল
#পর্বঃ০৬
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

১৫,
যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে ফুচকার স্টলে দাড়িয়ে একসাথে ফুচকা খাচ্ছে রাইমা ও শার্লিন। ফুচকায় বেশি ঝাল দেওয়ার ফলে ঝালে দুজনের চোখ মুখের অবস্থা কাহিল। তবুও খাওয়া থামানোর নাম নেই কারোরই। দুজনেই ২প্লেট করে ৪প্লেট ফুচকা খেয়ে এরপর থামলো তাদের খাওয়া। ফুচকার বিল মিটিয়ে ফুচকার স্টল থেকে একটু দূরে গিয়ে শার্লিন রাইমার হাত চেপে দাড়িয়ে পরে। রাইমা শার্লিনের দিকে তাকিয়ে জিগাসা করে,

“কি হলো তোর?”

“আরও এক প্লেট ফুচকা খাই চল প্লিজ!”

শার্লিন রাইমার হাত ধরে অনুরোধের সুরে বলে। রাইমা চোখ রাঙায়। শাসনের স্বরে বলে,

“আর এক প্লেট কেনো একটা ফুচকাও যদি খেতে চেয়েছিস? তোরে উ’স্টা দিয়ে এখানেই ফেলে দিবো। পাজি মেয়ে, একগাদা ঝাল দিয়ে ফুচকা খাইয়ে ছাড়লি। সেটাও এক প্লেট না, দু প্লেট। আরও এক প্লেট খেয়ে নিজে তো ম”রবি। সাথে আমাকেও মা”রবি।”

“এমন করিস কেন তুই? চল না খাই।”

শার্লিন বাচ্চাদের মতো বায়না ধরে কথাটা বলে। রাইমা ঠোঁট টিপে হাসে শার্লিনের অবস্থা দেখে। হাসি লুকিয়ে রাইমা বলে,

“খাইলে তুই একা খা। আমি খাবো না। আমার ম”রার শখ নেই। অবশ্য ফুচকায় ঝাল দিয়ে খেয়ে কেউ ম”রেনা। শুধু সকালে ওয়াশরুমে গেলে ঝাল দিয়ে ফুচকা খাওয়ার রিয়েকশন টের পায়।”

শার্লিন রাইমার কথার প্যাচ বুঝতে পারে। সে কথা ঘোরাতে বলে,

“আচ্ছা খেলাম না চল। ম”রে লাভ নেই৷ এখনও শ্বশুর বাড়ি তো দূর যাওয়ার রাস্তাই দেখলাম না।”

“তোর বিয়ের কথা বলবো আংকেলকে। বিয়ে পাগল কোথাকার!”

“কোথাকার নই। তোরই বান্ধবী।”

“আচ্ছা আমরা রাস্তায় দাড়িয়ে বকবক করছি কেনো? ঘুরতে যাওয়ার কথা বলে টেনে আনলি এখানে। কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না।”

রাইমা চেয়েছিলো কোনো একটা পার্কে গিয়ে হাঁটাহাটি করতে করতে শার্লিনের সাথে কথা বলবে। কিন্তু শার্লিন তাকে ডাকতে গিয়ে বাসা থেকে বেরুনোর পর জানায় যমুনা ফিউচার পার্কে আসবে। তার কিছু দরকার আছে। তাই তাদের এখানে আসা। শার্লিন রাইমার কথার উত্তরে বলে,

“৫মিনিট ওয়েট কর। ১০মিনিটে এখানে আসার কারণ বুঝতে পারবি।”

“এটা কেমন কথা হলো? ৫মিনিট অপেক্ষা করে ১০মিনিটে যদি কারণ বুঝতে হয়। তবে ১০মিনিটই অপেক্ষা করা ভালো।”

“তার আগে চল ভেতরে যাই।”

১৬,
শার্লিন আর রাইমা পা বাড়ায় পার্কের ভেতরে ঢোকার জন্য। ভেতরে ঢুকে সোজা চলে যায় রাইমা আর শার্লিনের এই পুরো পার্কের ভেতরে তাদের সবথেকে প্রিয় জায়গা ইন্ডিয়ান ডোসা ঘরে। এখানে আসলে তারা প্রায়ই ইন্ডিয়ান খাবারগুলো টেস্ট করে। নিজ দেশের খাবার তো অনেক খায়, মাঝেমাঝে এখানে এসে খাবারের স্বাদ বদলায়। দুজনের ফুডকোর্টের ভেতরে বসে শার্লিন চটপট ওয়েটারকে ডেকে ইন্ডিয়ান রাজকাচুরী, ছোলা বাটুরা অর্ডার করে দেয়। দিয়ে অপেক্ষা করে যার জন্য এখানে আসা। ওয়েটার খাবার দিয়ে যেতেই শার্লিন খাবারের উপর হাম’লে পরার মতো খাওয়া শুরু করে। রাইমা তা দেখে বলে,

“বাড়ি থেকে বের করলি আমার কথা শুনবি বলে। কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে খাবার তোকে ডাকছিলো বলে বাইরে আসছিস। খাদক, পেটুক মেয়ে।”

“খেয়ে মাথাটা ঠান্ডা করি। এরপর শুনবো। না শুনে তো তোকে ছাড়বো না।”

শার্লিন হেসে কথাটা বলে। এরপর চামচ দিয়ে রাজকাচুরী মুখে পুরে নেয়। খেয়ে একটু থেমে পানি খায়। রাইমা আস্তে আস্তে খাচ্ছে আর শার্লিনের খাওয়া দেখছে। এতোগুলো ফুচকা খাওয়ার পর তো পেটে আর কিছু খাওয়ার জায়গা নেই। অথচ এই মেয়ে গপাগপ খেয়ে যাচ্ছে। এরপরও শার্লিন চিকন স্বাস্থ্যের অধিকারী। কিছু মানুষই থাকে, তারা প্লেটের পর প্লেট খাবার খেয়ে যায়, তবুও চিকনই থাকে। শার্লিন বোধ হয় সেই কিছু মানুষের একজন। রাইমা আনমনে এসব ভাবতেই মুচকি হাসে। এই মেয়েটাই তার মুচকি হাসির কারণ। সবসময় ভালোবাসাই যে হাসির কারণ হয়! এমনটা নয়। কিছু মানুষই থাকে এভাবে কারণে অকারণে হাসানোর জন্য।

“হেই শার্লিন।”

কারোর মুখে নিজের নাম শুনে শার্লিন খাওয়া থামিয়ে সামনের দিকে তাকায়। রাইমা উল্টোপিঠ করে বসেছিলো শার্লিনের মুখোমুখি হয়ে। শার্লিনের চাহনী লক্ষ্য করে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। এমনিই গলার স্বর শুনে ভেতরে ভেতরে কেমন একটা খচখচানি অনুভূতি অনুভব হচ্ছিলো। ঘাড় ঘুরিয়ে মানুষটিকে দেখতেই রাইমার ঠোঁটের কোণের হাসি মিলিয়ে যায়। তার সামনে দাড়িয়ে থাকা মানুষটিও বোধ হয় রাইমাকে আশা করেনি। সেজন্য সেও একপ্রকার থমকেই আছে। রাইমা ঘাড় ঘুরিয়ে নেয়। টেবিলের দিকে মাথা এলিয়ে জোড় কদমে কয়েকটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নেয়। এমনটা কি করে হলো! এই লোক এখানে কি করে? রাইমার মাথা ঘুরিয়ে উঠে। অনাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে কেমন একটা হাসফাস অনুভূতি হচ্ছে তার। শার্লিন এতোক্ষণে উঠে লোকটিকে শুভেচ্ছা জানিয়ে শার্লিনের পাশের চেয়ারটায় বসিয়েছে। রাইমা নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে। শার্লিন রাইমাকে মাথা নিচু করে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ব্যতিব্যস্ত হয়ে জিগাসা করে,

“তোর কি শরীর খারাপ লাগছে? এমন হাসফাস করছিস কেনো?”

“না আ’ম অলরাইট। আমার কিছু হয়নি। কিন্তু ইনি?”

রাইমা নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টায় হাসার চেষ্টা করে প্রশ্নটা করে। লোকটিও অবাক নয়নে রাইমাকে দেখে যাচ্ছে। শার্লিন হেসে বলে,

“তোরে আমার বাসায় ডেকেছিলাম যে কারণে, এই সেই কারণ। মিঃ ইফরাদ। যাকে শর্টে আমি ইফু ডাকি। যদিও ইফু নামটা মেয়ে মেয়ে লাগে। তবুও আমি এটাই ডাকি।”

রাইমা হালকা হাসার চেষ্টা করে শার্লিনের কথায়। শার্লিন ইফরাদের দিকে তাকিয়ে বলে,

“কি আপনি এখানে এসে বোবা হয়ে গেলেন? এমনিতে তো আমায় কল দিয়ে কানের পোকা নাড়িয়ে ফেলেন। এখন আমার বান্ধবীকে একটা হাই হ্যালো বলতেও আপনার সমস্যা হচ্ছে?”

“একচুয়ালি বিষয়টা তা নয় শার্লিন। তোমার বান্ধবী আমার চেনা মানুষ। ৪বছর পর দেখছি তো! তাই একটু শকড হয়ে বসে আছি।”

১৭,
রাইমার গলা শুকিয়ে যায়। বারবার ফাকা ঢোক গিলে ইফরাদের কথা শোনার পর। শার্লিন অবাক হয়ে দুজনের দিকে তাকিয়েই জিগাসা করে,

“মানে?”

“মানে তেমন কিছু নয়। তোমার বান্ধবী আমার বোনের বান্ধবী ছিলো একসময়। সেই থেকে চেনাজানা। এরপর আমরা এলাকা ছেড়ে চলে যাই। সেই থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। দেখাসাক্ষাৎ সেটাও হয়নি একপ্রকার। তো সেজন্য এতোদিন পর দেখে একটু অবাক হলাম।”

ইফরাদ মুচকি হেসে উত্তর দেয়। শার্লিন বললো,

“আপনার বোন আমার বান্ধবীর বান্ধবী ছিলো বলতে? আর যদি বান্ধবীই হতো! তবে যোগাযোগ দেখাসাক্ষাৎ কি করে বন্ধ হলো? আমায় একটু কেউ ক্লিয়ার করে বিষয়টা বলবে?

ইফরাদ রাইমার দিকে তাকিয়ে বলে,

“কি ব্যাপার রাই? আমায় দেখে এরকম চুপচাপ হয়ে গেলে কেনো? কিছু তো বলো! তোমার বান্ধবী তো কিছু বুঝতে পারছেনা।”

রাইমা মাথা নিচু করে নেয়। ভেতরে ভেতরে কান্নার দমক আঁটকে রাখার ফলে ইফরাদের কথার উত্তর দেওয়ার আগেই ফুপিয়ে কেঁদে উঠে রাইমা। শার্লিন অবাকের পর অবাক হচ্ছে। সে রাইমার কান্না দেখে উঠে আসে। রাইমার পাশে বসতেই রাইমা জাপ্টে ধরে শার্লিনকে। ফুপিয়ে ফুপিয়ে বলে,

“বাসায় চল। আমার কষ্ট হচ্ছে।”

শার্লিন অসহায় চোখে ইফরাদের দিকে তাকায়। ইফরাদ চোখের ইশারায় শার্লিনকে আশস্ত করে। বলে,

” চলো তোমাদের বাসায় পৌছে দিই!”

“চলুন।”

শার্লিন রাইমাকে ইশারায় উঠতে বলে। ফুডকোর্টের বিল দিয়ে দুজনের ধীরে ধীরে হেটে পার্কের ভিতর থেকে বের হয়। ইফরাদ ওদের পিছন পিছনই আসছিলো। রাইমা নিজেকে স্থির রাখতে পারছেনা। সময়ে সময়ে কেঁপে উঠছে। হালকা হালকা শীতের আবেশ থাকার জন্য রাইমার একটু ঠান্ডা ঠান্ডা অনুভব হচ্ছিলো। শার্লিন বুঝতে পারে, কিন্তু কিছু করার নেই। হাতে শুধু ছোট্ট পার্স এনেছে দুজনই। ফোন আর টাকা রাখার জন্য। এখন শাল কেনার কথা বললেও রাইমা বারণ করবে। শার্লিন ফোন বের করে ইফরাদকে টেক্সট করে বিষয়টা শেয়ার করে। এরপর ইফরাদের দিকে ইশারা করে ফোন চেইক করতে বলে। ইফরাদের ফোন হাতেই ছিলো। শার্লিন ইশারা করার আগেই সে টের পেয়েছে। সে শার্লিন আর রাইমার উদ্দেশ্যে বলে,

“তোমরা একটু অপেক্ষা করো। আমি ১০মিনিটে আসছি।”

“অপেক্ষা করার বদলে আমরা চলে যাই?”

রাইমা দুর্বল কণ্ঠে বলে। শার্লিন কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে,

“তুই একটু নিজেকে শক্ত করবি প্লিজ। আমার তোর এই অবস্থা দেখে কান্না পাচ্ছে। একটু অপেক্ষা করি। আমার একা একা ভয় করছে তোকে নিয়ে বাসায় যেতে। সন্ধ্যাও হয়ে আসবে যেতে যেতে। ইফরাদ যাক না আমাদের সাথে প্লিজ!”

“আচ্ছা অপেক্ষা করি। আপনি যান কি দরকার সেরে আসুন।”

১৮,
ইফরাদ চলে যায় রাইমার সম্মতি পেতেই। ইফরাদ সরে যেতেই রাইমার কান্নার গতি বেড়ে যায়। আশপাশের কিছু মানুষ অবাক নয়নে রাইমাকে দেখে চলে যাচ্ছে। শার্লিন একহাতে রাইমার হাত অন্যহাতে বাহু আকড়ে দাড়িয়ে আছে। রাইমা নিজেকে সামলাতে ফাকা হাতে নিজের পরণের জামা খামচে ধরে। তখনই ওদের সামনে কোথা থেকে জানি দিগন্ত এসে দাড়ায়। রাইমা নিচ দিকে জুতা পরা পা দেখে মাথা তুলে তাকায়। দিগন্তকে দেখে অস্ফুটস্বরে বলে,

“আপনি এখানে?”

“তার আগে এটা বলুন তো! রাইমা খন্দকারকে তেজের সহিত দেখলাম পরপর দুদিন। সেখানে আজ তাকে রাস্তার পাশে দাড়িয়ে কাঁদতে দেখে আমার মোটেও পছন্দ হচ্ছে না বিষয়টা। নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করছেন? নাকি লড়াই করার সৎ সাহস নেই?”

“দেখুন না ভাইয়া, আমি ওকে কিছু বুঝিয়ে সামলাতেই পারছি না। কেঁদেই যাচ্ছে।”

শার্লিন দিগন্তের কথার আগমাথা বুঝতে পারেনা। পর জানা যাবে এই ভেবে সে পাশ থেকে কথাটা বলে। দিগন্ত হেসে উঠে। রাইমার কান্নার গতি কমে এসেছে। শার্লিন অবাক হয়ে দিগন্তকে হাসতে দেখে প্রশ্ন করে,

“আপনি হাসছেন?”

“দুই ছিচকাদুনে এক জায়গায় হলে কারোর কথায় কি কারোর কান্না থামে?”

“আমরা মোটেও ছিচকাদুনে নই মি:। জাস্ট কিপ ইউর মাউথ শাট। আপনার সাথে কথা বলার মুড নেই আমাদের।”

রাইমা ঝাঁজালো স্বরে কথাটা বলে। দিগন্ত নিজের হাসির মাত্রা বাড়িয়ে বলে,

“পারেন তো শুধু তেজ দেখি এটাই বলতে। আর কোনো কথা মুখ দিয়ে বেরিয়েছে কিনা মনে পরছেনা আমার। আপনার কি মনে পরে? আপনি আমায় চুপ হতে বলা ব্যতিত আর কিছু বলেছেন?”

“আপনার সাথে মোটেও এখন রাস্তায় দাড়িয়ে ঝগড়া করার মতো এনার্জি নেই আমার। কি বলেছি না বলেছি ভালো করেই মনে আছে। সময় মতো সেটা বোঝা যাবে। এখন সামনে থেকে সরুন। যা করতে এসেছেন। তা করতে যান।”

“নিজেই বললেন এটা রাস্তা। তো সেই হিসেবে রাস্তায় চলাফেরা করুন। রাস্তায় ঝগড়া যদি শোভা না পায়। তবে কান্না করাও শোভা পায়না মিস রাইমা খন্দকার।”

রাইমা চুপ করে থাকে দিগন্তের এই কথায়। তার একটুও ভালো লাগছেনা কথা বাড়াতে। দিগন্ত নিজের চশমা ঘুরিয়ে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। যাওয়ার আগে বলে,

“নিজের দুর্বলতা যেখানে সেখানে দেখাতে নেই। আর একটা কথা। ইন ফিউচার সম্পর্কে আমার বেয়াইন সাহেবা হচ্ছেনা। চোখের জল জমিয়ে রাখুন। বলা তো যায়না কখন কাজে লেগে যায়। আমার কাছে নাকানিচুবানি খাওয়ার পরও তো জেদের চোটে কাঁদতে হবে।”

দিগন্ত চলে যায়। এসেছিলো বোনের জন্য শপিং করতে। তার আগেই রাইমাকে কাঁদতে দেখে তাদের সামনে এসে বাড়তি কথাগুলো বললো। কান্না দিগন্তের পছন্দ নয়। এজন্য আগ বাড়িয়ে কথা বললো। নতুবা তার কথা বলার প্রয়োজন ছিলো না। দিগন্ত চলে যেতেই রাইমা তেলে বেগুনে জ্ব’লে উঠার মতো মেজাজ নিয়ে শার্লিনকে বললো,

“দেখলি! দেখলি লোকটা কিভাবে অপমান করে চলে গেলো।”

“তার আগে এটা বল উনার সাথে দেখাই হলো একদিন। উনি বললে দুদিন তোদের দেখা হয়েছে। তারমানে পরিচয় হওয়ার আগ থেকেই চিনতি। গতকালের পর থেকে তুই বাসাতেই ছিলি যতোটুকু মনে হয়। এরপর আমার সাথে। তাহলে ২য় দেখা কি করে হলো?”

“আগে থেকেই চিনতাম। অ”সভ্য লোক একটা। আবার আমায় বলে অ’সভ্য।”

“আচ্ছা সব কাহিনী বাসায় গিয়ে শুনবো। আমার সব কেমন জট পাকিয়ে যাচ্ছে। ইফরাদ তোকে চিনে, দিগন্ত ভাইও চিনে। মাঝখানে আমি অবলা নারী, তোকে গতো ৪বছর ধরে চিনেও এখন অচেনা অচেনা লাগছে।”

শার্লিন মুখ গোমড়া করে কথাটা বলে। তখনই ইফরাদ শাল কিনে নিয়ে চলে আসে। এসে শার্লিনের হাতে তুলে দেয়। এরপর ব্যস্ত হয়ে পরে রিকশা খোজায়। শার্লিনের হাতে ব্যাগ দেখে রাইমা ভ্রু কুঁচকে জিগাসা করে,

“এটা গিফট দিলো নাকি? কি এটা?”

“ধুর গিফট না। তোর জন্য শাল আনালাম। তোর ঠান্ডায় কাঁপাকাপি উঠে গিয়েছে টের পেলাম। রিকশায় উঠলে আরও বাতাসে অবস্থা কাহিল হবে। সেজন্য ইফরাদকে আনতে আমিই বলেছিলাম।”

“এতোটাও ঠান্ডা নয়।”

রাইমা নাক মুখ কুঁচকে উত্তর দেয়। শার্লিন ধম’কের সুরে বলে,

“ভদ্র মেয়ের মতোন গায়ে জড়িয়ে নে।”

“রিকশা পেয়ে গেছি। আসো তোমরা।”

শার্লিন রাইমার শরীরে শাল জড়িয়ে দিতেই ইফরাদ এসে কথাটা বলে। দুটো রিকশা ঠিক করেছে সে। একটায় দু বান্ধবী উঠে বসে। অন্যটায় ইফরাদ। উঠে বসতেই এক রিকশা অন্য রিকশাকে অনুসরণ করে চলতে শুরু করে। ঠিকানা ইফরাদ আগেই বলে দিয়েছে। রাইমা রিকশায় বসে শার্লিনের কাধে মাথা এলিয়ে দেয়। চোখ বন্ধ করে থাকে সে। চোখের সামনে ভেসে উঠে খিলখিলিয়ে হেসে উঠা একজনের মুখ। রাইমার চোখ বন্ধ অবস্থায় কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে শার্লিনের কাধ ভিজিয়ে দেয়। শার্লিন টের পেয়েও কিছু বলেনা। বাসায় গিয়ে যা জানার জিগাসা করবে সে। আপাতত কেঁদে মন হালকা করুক। রাইমা বন্ধ চোখের পাতায় অস্পষ্ট মুখটা ক্রমশ পুরোপুরি ভেসে উঠে। রাইমার কন্ঠস্বর দিয়ে অস্ফুটস্বরে বেরিয়ে আসে,

“মাফিন।”

শার্লিন রাইমা আস্তে করে নামটা বললেও নামটা শুনতে পায়। নামটা কেমন তার কাছে চেনা চেনা লাগছে। কার কাছে শুনেছে! মনে করতে পারছেনা শার্লিন।

চলবে?