আকাশেও অল্প নীল পর্ব-৭+৮

0
192

#আকাশেও_অল্প_নীল
#পর্বঃ০৭
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

১৯,
“উনি এই বাসায় কি করছে আপা?”

সবে শপিং শেষ করে বাসায় ঢুকেছে দিগন্ত। ঢুকতেই নিজের মা মিসেস আমিরাকে দেখে স্নেহাকে প্রশ্ন করে দিগন্ত। স্নেহা মিসেস আমিরার পাশে সিঙ্গেল সোফায় বসে ফোন দেখছিলো। ড্রইং রুমের দরজা খোলা ছিলো বিধায় দিগন্ত এসে দরজা খোলার ঝামে”লায় পরতে হয়নি। সেজন্য স্নেহা খেয়াল করেনি দিগন্ত এসেছে। ফোনে ব্যস্ত ছিলো মাহাদের সাথে কথা বলায়। দিগন্তের প্রশ্নে স্নেহা ফোন টা রেখে দেয়। এরপর দিগন্তের প্রশ্নের উত্তরে বলে,

“আমার চিন্তা নিজের কাঁধে নিয়েছিস না? সামলে নে। আমি রুমে গেলাম।”

স্নেহা চলে যায়। সে চলে যেতেই মিসেস আমিরা উঠে এসে ছেলেকে জড়িয়ে ধরতে হাত বাড়ান। দিগন্ত কয়েক পা এগিয়ে পাশ কা’টিয়ে সেন্টার টেবিলের উপর হাতের ব্যাগ গুলো রেখে দেয়। এরপর সোফায় পায়ের উপর পা দিয়ে বসলো। আমিরা বেগম অবাক হয়ে ছেলের দিকে ফিরে তাকান। দিগন্ত আমিরার দিকে তাকিয়ে বলে,

“তো মিসেস আমিরা শেখ! আপনার কি চাই এখানে? আবার কোন উদ্দেশ্যে এসেছেন?”

“আচ্ছা তুমি আমার গর্ভের সন্তান হয়ে কি করে আমার সাথে এই আচরণটা করো বলোতো?”

আমিরা বেগম প্রশ্নাত্মক চাহনীতে তাকিয়ে দিগন্তকে প্রশ্ন করে। দিগন্ত একটু হাসলো। এরপর তাচ্ছিল্যের সহিত বলে,

“আমি আপনার গর্ভের সন্তান? এটা মনে আছে আপনার?”

“থাকবেনা কেনো? আছে বলেই দেখতে আসি আমি।”

“না আসতেন! আপনি ব্যতিত আমরা তো পরে নেই বা ম”রেও যাইনি। অবশ্য ম” রে গেলে সব চুকে যেতো তাইনা?”

“তুমি তোমার লিমিট ক্রস করে ফেলছো দিগন্ত।”

“লিমিটের কথা তুলবেন না একদম। আমি আমার লিমিট জানি। বরং আপনি আপনার লিমিট ক্রস করে বেশি অধিকারবোধ দেখিয়ে ফেলছেন আমাদের উপর।”

“দিগন্ত!”

দিগন্তের উপর কিছুটা চেঁচিয়ে উঠেন মিসেস আমিরা। দিগন্ত নিজের হাতের মুঠো শক্ত করে উঠে দাড়ায়। রাগের সহিত বলে,

“আমি আমার উপর চেঁচানো একদম পছন্দ করিনা মিসেস আমিরা শেখ। চুপচাপ চলে যান বাসা থেকে। ২য় বার আমার চোখের সামনে আপনাকে যেনো না দেখি ”

মিসেস আমিরা আশ্চর্যের সহিত তাকিয়ে আছে দিগন্তের দিকে। নিজের পেটের ছেলে তাকে সহ্য করতে পারেনা। বিষয়টা মেনে নিতে উনার কষ্টই হচ্ছে। এমন টা আজ নতুন নয়। দিগন্ত আগে থেকেই বোধবুদ্ধি হওয়ার পর থেকে তার মা-কে সহ্য করতে পারেনা। যতোবার দেখেছে ততোবার নিরব থেকেছে কথা বলেনি। কিন্তু আজ নিজের ভেতরের সব রাগ উগরে দিচ্ছে যেনো। মিসেস আমিরা দিগন্তের দিকে কয়েক পা এগিয়ে যান। দিগন্তের গালে স্নেহের পরশ বুলিয়ে দিতে হাত বাড়াম ছেলের দিকে। দিগন্ত মাথা পিছিয়ে চোখের ইশারা না বুঝান। মিসেস আমিরার চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পরে। দিগন্ত তা দেখে একটু শব্দ করেই হেসে ফেললো। মিসেস আমিরা অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন,

“তুমি হাসছো দিগন্ত?”

“হাসি পেলো। কি করবো বলুন তো! কিছু মানুষ থাকে তো সিরিয়াস মোমেন্টে হাসি পায়। আপনাকে দেখে আমারও এই সিরিয়াস মোমেন্টে হাসি পেলো।”

“তুমি আমায় এতোটা ঘৃণা করে?”

“কি জানি! মা-কে ঘৃণা করা যায়! কিন্তু আপনার প্রতি আমার মন উঠে গেছে মিসেস আমিরা শেখ। আপনি আমার আর আমার আপার জীবনে আপনার ছায়া অব্দি না মা”ড়ালে ভালো হতো। আমার আপাকে আমি দিবোনা আপনার ওখানে। আমি সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি। আর সেই খবর কানে যেতেই আপনি দৌড়ে এসেছেন আমি জানি। খুব শীঘ্রই সব সমস্যা আমি মিটিয়ে ফেলবো, আই প্রমিজ।”

মিসেস আমিরা চোখ মুছেন। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফেলে বলেন,

“আমায় নিচে নামতে বাধ্য করবে?”

“আপনি আমার চোখে যথেষ্ট নিচে নেমে গেছেন। আপনি যা খুশি করতে পারেন। সব সমস্যা মিটানোর মতো সামর্থ্য আমার হয়ে গিয়েছে। সেজন্য আর ভয় নেই। এখন আপনি যেতে পারেন।”

মিসেস আমিরা আ”হত চাহনীতে দিগন্তের দিকে তাকান। ভাঙা গলায় বলেন,

“আমার মা ডাক শুনতে ভীষণ ইচ্ছে করে দিগন্ত। প্লিজ আমার থেকে স্নেহাকে আলাদা করার চেষ্টা করো না।”

“মা ডাক শোনার অধিকার খুইয়ে ফেলেছেন। চলে যাবেন আপনি? নাকি আমি বের করে দিতে বাধ্য হবো?”

মিসেস আমিরা কান্না করতে করতে চলে যান বাসা থেকে৷ দিগন্ত ধপ করে সোফায় বসে পরে। চোখ বন্ধ করতেই দুফোঁটা জল গড়িয়ে পরে দিগন্তের গাল বেয়ে। বিরবির করে বলে,

“আপনার থেকেও আমি বেশি কেঁদেছি মিসেস শেখ। আমি কখনও ক্ষমা করবোনা আপনাকে। কখনও না।”

২০,
শার্লিনদের বাসায় শার্লিনের রুমে বিছানায় গুটিশুটি হয়ে বসে আছে রাইমা। কান্নার দমকে মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে সে। শার্লিন রাইমার এই অবস্থায় রাইমাকে একা ছাড়তে চায়নি। রাইমার মায়ের কাছে ফোন দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে সে, রাইমা তার সাথে তার বাসায় থাকবে। শার্লিন দুহাতে দু মগ কফি নিয়ে রুমে ঢুকে৷ বাসায় এসেই আগে ফ্রেশ হয়ে রাইমাকেও ফ্রেশ হতে বলে চলে গিয়েছিলো কফি বানাতে৷ ইফরাদ বাসার সামনে নামিয়ে দিয়েই চলে গিয়েছে। রাইমা ফ্রেশ না হয়ে এখনও যেভাবে বসিয়ে গিয়েছিলো, সেভাবেই বসে আছে দেখে শার্লিন রাইমার পাশে বসে। কফির মগ দুটো বেড সাইড টেবিলে রাখে। রাইমাকে জড়িয়ে ধরে পিঠে হাত দিয়ে আস্তে আস্তে চাপড় দেয়। ধীর স্বরে বলে,

“শান্ত হ বলছি। আমি জানি তুই শক্ত মনের মেয়ে। চাইলেই পরিস্থিতি টা শান্ত করতে পারবি। তাই অনুরোধ করি, শান্ত হ। তোর কান্না আমার ভেতরে ভেঙেচুরে দিচ্ছে রাই।”

শার্লিনের এই কথায় রাইমা কিছু টা শান্ত হয়। শার্লিন কফির মগ এগিয়ে দিয়ে বলে,

“কান্না করে তো মাথা ব্যথা করছে নিশ্চিত। কফিটুকু পান কর৷ আশা করি ভালো লাগবে। এরপর না হয় ফ্রেশ হোস।”

রাইমা শান্ত বাচ্চার মতো শার্লিনের কথা শোনে। কফির মগ নিয়ে চুমুক দেয়। শার্লিনও নিজের জন্য আনা কফির মগ হাতে নিয়ে চুমুক দেয়। তখনই রাইমা কফি মগে চুমুক দেওয়ার পাশাপাশি বলে প্রশ্ন করে উঠে,

“ইফরাদ ভাইয়ের সাথে তোর পরিচয় কি করে?”

“তার আগে এটা বল তোদের মাঝে হয়েছিলো কি? গেলি ভালো মানুষ, ওকে দেখতেই কেঁদেকেটে অস্থির! থামছিলিই না।”

“আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দে।”

“ইফরাদের সাথে আমার ফেসবুকে পরিচয়। এরপর কথা বলা, ভালো লাগা একটু একটু। এজন্য আজ মীট করতে চেয়েছিলাম। মীট তো হলো কিন্তু ঠিকমতো কথাই তো বলতে পারলাম না।”

“শুধু মাত্র ভার্চুয়ালে বিশ্বাস করেই একটা মানুষের সাথে দেখা করতে চলে গিয়েছিলি? তোর ভয় লাগেনি? মনে হয়নি ক্ষতি হতে পারে।”

“সেজন্য তোকে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমি জানি তুই আমায় সেইফলি যাই হোক বাসায় আনতে পারবি।”

“কনফিডেন্স ভালো ওভার কনফিডেন্স নয়। আমিও একজন মেয়ে। তোর ক্ষতি হলে আমি ঠেকাতাম কি করে?”

“লেট ইট বি রাই। আমি ভরসা করেছিলাম, ভিডিও কলেও দেখেছি আগে। সেজন্য দেখা করা৷ আর ঢাকা শহরেই থাকে। সমস্যা ছিলো না।”

“আচ্ছা বাদ দিলাম। কিন্তু এটা তুই ঠিক করিসনি আমার থেকে লুকিয়ে। ভার্চুয়ালে মানুষকে দেখায় যেমন, বাস্তবে বেশিরভাগ তেমনই হয়না। ভার্চুয়াল ছিলো বিনোদনের জায়গায়, এখন তা হয়েছে নাট্যমঞ্চের মতো। ফোনের আড়ালে একেকটা মানুষ একেক রকম নাটক করে চলেছে৷ কে জানে, যদি মানুষ ইফরাদ না হয়ে অন্য কেউ হতো! কোনো ঠকবাজের পাল্লায় যদি পরতি?”

রাইমা কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে কথাটা বলে। কফি শেষ করে উঠে দাড়ায়। চুলগুলো হাতখোপা করে পা বাড়ায় ওয়াশরুমে। শার্লিন মাথা নিচু করে রাইমার কথার উত্তরে বলে,

“তোর কাছে লুকোতে চাইনি। ভেবেছিলাম নিজেই আগে নিশ্চিত হই, ভালোবাসি কিনা! তবে তোকে জানাবো। এজন্য আগেই কিছু বলিনি।”

“বেশ ভালো৷”

রাইমা ওয়াশরুমে ঢুকে পরে। ফ্রেশ হয়ে তোয়ালে দিয়ে হাতমুখ মুছে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়৷ শার্লিন এরমাঝে কফির মগ দুটো রেখে এসেছে৷ সেও রাইমার পাশে হাত পা ছড়িয়ে টান টান হয়ে শুয়ে পরে। চোখ বুঝে প্রশ্ন করে,

“তুই বললি না তো ইফরাদকে চিনিস কি করে?”

২১,
রাইমা চোখ বুঝা অবস্থাতেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে৷ ভাগ্যের উপর তার হাসি পেলো। ঠোঁটের কোণায় হাসি ঝুলিয়ে বলে,

“ইফরাদ ভাই মাফিনের ভাই। যে বাসায় আজ তোরা আছিস, চার বছর দুমাস আগে এই বাসায় ইফরাদ ভাই ও তার পরিবার থাকতো।”

“হোয়াট?”

শার্লিন রাইমার উত্তরে চমকে উঠে বসে। চোখে মুখে বিস্ময় প্রকাশ পায়৷ সে রাইমার দিকে দৃষ্টি ফেলে। রাইমা চোখ বন্ধ করে এখনও শুয়ে আছে। শার্লিন নিজের আগ্রহ দমন করতে না পেরে ফের প্রশ্ন করে,

“মাফিন! মাফিন টা কে?”

“মাফিন! আমার পাগলির মতো একটা বোন৷ রক্তের নয় আত্মার সম্পর্ক ছিলো তার সাথে। ঠিক তোর মতো। তার নাম মাফিন নয়, মাহিশা নাম তার। মাফিন কেক খুব পছন্দ করতো। আমি মজা করে ডাকতাম মাফিন। এখন এটা জিগাসা করিস না মাহিশা কে? ইফরাদ ভাইয়ের বোন।”

রাইমা শান্তস্বরে কথাগুলো বলে। শার্লিন ভাবুক দৃষ্টি মেলে রাইমাকে বলে,

“মাহিশা নামটা শুনেছি তার মুখে। মাফিন নামটাও শুনেছিলাম বোধ হয় ২-১বার। কিন্তু খেয়াল করতে পারছিলাম না। কিন্তু ইফরাদ তো বলে তার বোন নেই, হারিয়ে গিয়েছিলো খুজে পায়নি। সবাই ধরে নিয়ে মারা গে”ছে। বর্তমানে সে একাই বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান।”

রাইমা মৃদু হাসে। শোয়া থেকে উঠে বসে শার্লিনের মুখোমুখি। এরপর বলে,

“মাফিন মা’রা যায়নি। ও নিজেও এই শহরেই আছে। আমি দেখেছি ওকে। আমি যদি ভুল না হই, মাফিনকেই দেখেছিলাম আমি। কিন্তু ওকে ধরতে পারিনি আমি। তার আগেই গাড়িতে শো করে চলে গেলো! দৌড়ে ছুটে গিয়েও ওকে পেলাম না। উল্টো পরিচয় হলো দিগন্ত আহসানের সাথে। বিরক্তিকর লোক একটা৷”

“মানে? সব একটু ক্লিয়ার করে বলবি তুই?”

“তুই যেদিন বাসায় ডাকলি মেসেজ করে তার আগের দিন সকালে, ব্রাশ করতে করতে ব্যালকনিতে দাড়িয়ে নিচে রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। কেনো জানি আবছা আবছা মাফিনের মতো একটা মেয়েকে দেখেছি মনে হলো। ছুটে নিচে নামলাম। গাড়ি ছেড়ে দিলো। পিছনে পিছনে দৌড়ে গিয়ে দিগন্ত আহসানের বাড়ির সামনে যেতেই গাড়ি হাওয়া। আর নজরে পরলো না। তখনই আবার খালামনির কল আসে, আম্মুর সাথে কথা বলবে। আম্মুর ফোনে নাকি কল ঢুকছেনা৷ খালামনিকে জানালাম আমি বাইরে, আর এতো সকালে বাইরে কেনো কতো প্রশ্ন। খালামনিকে ম্যানেজ করতে গিয়ে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পরলাম। তো দিগন্ত লোকটা কোথাও একটা যাচ্ছিলো, গেটের সামনে দাড়িয়ে ছিলাম। সেজন্য কতো কথা শোনালো আমায়। এরপর হলো ঝ”গরা। রাগ উঠে গিয়েছিলো। এরমাঝেই আবার আম্মুর কল আসে। ফোনের জন্য ঝগড়া হলো। আবারও কল আসা দেখে অযথা ভা’ঙলাম ফোন। এরপর আর উনাকে দেখলেন আমার রা”গ উঠে অকারণে। উনি আমায় অপমান করেছিলেন। এর শোধ তো আমি তুলবোই দেখিস।”

শার্লিন গালে হাত দিয়ে মনোযোগ দিয়ে রাইমার কথা শুনছিলো। রাইমা থামতেই সে বলে,

“সে শোধ না হয় তুলিস পরে দেখা যাবে। আগে এই মাফিন, ইফরাদ এদের ঘটনা ক্লিয়ার কর৷ আমার মাথায় সব প্যাচ লেগে যাচ্ছে।”

মাফিনের প্রসঙ্গ আসতেই রাইমা চুপসে গেলো। ঘনঘন কয়েকটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,

“মাফিন কে ওর পরিবার হারানোর পিছনে আমার দায় আছে।”

“মানে?”

শার্লিন অবাক হয়ে প্রশ্ন করে। রাইমা ফের টেনেটেনে কয়েকটা নিঃশ্বাস ফেলে। মাফিনের কথা মনে আসতেই তার হাসফাস লাগে। যন্ত্রণা হয়, কষ্টটা দু”মড়ে মুচ”ড়ে দেয় ভেতর থেকে৷ সবসময় ভালোবাসা জনিত কষ্টই মানুষের হয়না। তার থেকেও বড়ো কষ্ট হয় নিজের বোনের মতে বা ভাইয়ের মতো সেরা একজন বন্ধুকে হারানোয়৷

চলবে?

#আকাশেও_অল্প_নীল
#পর্বঃ০৮
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

২১,
“মাহিশা আর আমার বন্ধুত্বের শুরুটা আমি যখন ক্লাস সিক্সে, তখন থেকে। ওরা এই মহল্লায় নতুন ভাড়াটিয়া হিসেবে তোরা যেই বাসায়, যেই ফ্লোরে আছিস, এখানেই আসে। আমি যে স্কুলে পড়তাম সেখানেই ভর্তি হয়। সেখান থেকেই পরিচয়, বন্ধুত্ব। আমাদের সম্পর্ক এতোটা গভীর হয় যে আমাদের দুইজনের পরিবারের মাঝেও একটা গাড় সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। ওর বাসায় আমরা যেতাম, ওরা আমাদের বাসায় আসতো। ভালো মন্দ কিছু হলে দুই পরিবার দুই পরিবারকে সাপোর্ট দিতো, দেখতো। এমন অবস্থা হয়ে গিয়েছিলো মাহিশার সাথে আমি দিনে দুদণ্ড কথা না হলে চলতো না। কেমন একটা ফাঁকা ফাঁকা লাগতো। সময়টা যখন ইন্টার ১ম বর্ষে উঠলাম। মাহিশার বাবা ওর বিয়ের কথা তুললেন। ওর বাবার অফিস কলিগের ছেলে। যেহেতু ওর পড়াশোনা চলছিলো, আংটি বদল করে রাখতে চেয়েছিলো সবাই। কিন্তু সবার অজান্তেই মাহিশা সম্পর্কে জড়িয়েছিলো কলেজের ওয়ান ইয়ার সিনিয়র একজন ভাইয়ের সাথে। আমি সবই জানতাম, বুঝিয়েছিলাম। ও সম্পর্ক থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। বিয়ের কথা উঠতেই ও কেমন একটা পাগলামি শুরু করলো। রিলেশনের কথা বাসায় জানালো। সেইম এজ ছিলো প্রায়। ২বছরের ছোটো বড়ো। সবাই মানতে নারাজ। রিলেশনের কথা আসতেই আংকেল আন্টি ভুল বুঝলেন আমায়। আমি জেনেশুনে ওকে আটকাইনি কেনো? ওতো রিলেশনে জড়িয়ে আমায় জানিয়েছিলো। আমি আমার মতো বুঝিয়েছিলাম, ও শোনেনি। প্রেম ভালোবাসা তো মনের ব্যাপার শুনতাম। কারের মনের উপর কি জোড় চলে! আমি জোড় করে তো ওকে আটকাতে পারিনি। তবুও ওর পরিবার ওকে শাসন করে কলেজে যাওয়ায় বাধা দিলো। আংটিবদল হয়েওছিলো। এরপর কি হলো! নরমালই সবাইকে বিশ্বাস করালো ও রিলেশন ভেঙে দিয়েছে। কলেজে যাওয়া শুরু হলো। ২য় বর্ষে উঠলাম দুজনেই। একদিন সকালে ওকে ডাকতে গিয়ে শুনি ও নেই, কোথাও খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। সকাল করে আমাদের নতুন কোচিং শুরু হয়েছে, এই কথা বলে বাসা থেকে বের হয়েছিলো। আংকেল-আন্টি, ইফরাদ ভাই ধারণা করেন, আমি সব জানতাম কিন্তু উনাদের বলিনি। পুরো ঢাকা শহর একমাসের মতো তন্নতন্ন করে খুজেও মাহিশার খোজ পাওয়া যায়নি। আসলে যে লুকিয়ে থাকে, তাকে পাওয়া মুশকিল। হারালে তো ইজিলিই পাওয়া যেতো। মাহিশা আড়ালে রেখেছে নিজেকে। যার ফলাফল আজও ওকে পাইনি। তখন এক বিপদের মাঝে আরেক বিপদ৷ মাহাদ ভাই বাইক এক্সিডেন্ট করে ছোটো খাটো। মাহাদ ভাই খালামনির একমাত্র ছেলে জানিসই। আর কোনো সন্তান খালামনির হয়নি। একমাত্র ছেলের বিপ’দে খালামনি ভে’ঙে পরলে ওখানে যাওয়া টাও জরুরী ছিলো। গেলাম ওখানে আম্মুর সাথে। দুদিন পর এসে ইফরাদ ভাইয়ের কাছে ছুটে আসছিলাম সেদিন যে মাহিশার খোজ পাওয়া গেলো কিনা! ওরে ছাড়া যে আমার একটা সেকেন্ডও শান্তিতে যাচ্ছিলো না। অথচ দেখ, চার চারটা বছর পেরিয়ে দুমাস চলছে, তার চেহারাও আমি দেখছিনা। আমার যে ভেতরে ভেতরে কি অবস্থা আমি জানি আর আমার উপরওয়ালা জানেন। কান্না এমনি এমনি আসে না। ওর স্মৃতি আমায় তাড়া করে বেড়ায়। সবাই বলে শূণ্য জায়গা শূন্য থাকেনা। বালুকণা এসে হলেও পূর্ণ করে। রোজ আল্লাহর কাছে বলতাম, আমার একটু শান্তি চাই। শান্তি দাও। তুই আসলি, তোকে পেলাম। মাহিশার জায়গায় তোকে না বসাতে পারলেও তুই তোর মতো করে জায়গা তৈরি করে নিয়েছিস। ওরা বাসা ছেড়ে গেলে তোরা আসলি। ইফরাদ ভাইকে ডাকতে এসে দরজা খুললি তুই। তাদের না পেয়ে কান্নায় ভে’ঙে পরলাম আমি। সামলানোর চেষ্টা করলি তুই, যেভাবে মাহিশা করতো আমার কিছু হলেই। এরপর টুকটাক তোর সাথে কথাবার্তা দেখা হলে। এক ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়া। এরপর তো চলছে দিন, যেভাবে চলার। আর দিনদিন তোর জায়গা আমার জীবনে শক্ত একটা খুঁটির মতো হয়ে বসলো। জীবনটা যে শুধু ভালোবাসলেই, সেই সম্পর্কে কিছু হলেই কান্না পায়না! মাঝে মাঝে আত্মায় মিশে থাকা মানুষগুলোর অভাবেও কান্না পায়। সেই ঘটনার পর ইফরাদ ভাই আর আংকেল আন্টির খোজ পাইনি। আমায় ভুল বুঝে আর যোগাযোগও করেননি। তোর উছিলায় ইফরাদ ভাইকে দেখলাম এতগুলো দিন, মাস, বছর পর৷ মানুষ টা তোর জন্য ভুল নয়, ঠিকই আছে। শুধু যা করার পরিবারকে মানিয়ে করিস প্লিজ। মাহিশার মতো তুইও হারাস না। আমি শান্তিতে বাচতে পারবোনা।”

২১,
বেশ কয়েকবার দম নিয়ে ধীরেসুস্থে কথাগুলো বললো রাইমা। সবকিছু শুনে তো শার্লিন নিস্তব্ধ, বিমূঢ় হয়ে বসে আছে। এই মেয়েটা ভেতরে ভেতরে না পাওয়ার যন্ত’ণা আর মিথ্যা অপবাদের বোঝা বয়ে হাসিখুশি ভাবে সবার মাঝে চলাফেরা করছে। অথচ কেউ টেরও পাচ্ছেনা তার ভেতরে ভেতরে কি হয়ে যাচ্ছে। শার্লিন চট করে রাইমাকে জড়িয়ে ধরে। কান্না কান্না স্বরে বলে,

“এসব হয়েছে তোর জীবনে, আগে একবারও আমায় বলিসনি। এই আমি তোর আত্মার মানুষ!”

“কিছু নতুনত্বে পুরোনো সম্পর্কের প্রভাব ফেলতে হয়না। যা হচ্ছে হতে দে। আজও তোর জানা হতো না। যদি না ইফরাদ ভাইকে দেখতাম।”

“আমি ইফরাদকে বোঝানোর চেষ্টা করি? যেটা হয়েছে, তাতে তো তোর হাত নেই।”

“এসব নিয়ে আর কিছু বলার দরকার নেই। আমি মাহিশাকে যেদিন পাবো খুজে, সেদিনই সবকিছু পরিস্কার হয়ে যাবে।”

শার্লিন রাইমাকে ছেড়ে বিছানা থেকে উঠে দাড়ায়। কফির মগ নিয়ে যাওয়ার আগে বলে,

“ঐ ছেলের বাসায় কি খোজ নেওয়া হয়নি? যার সাথে মাহিশার সম্পর্ক ছিলো।”

“হয়েছিলো খোজ নেওয়া। মাহিশা ঐ ছেলের সাথেও পালায়নি। পুলিশ কেস অব্দি হয়েছিলো, কিন্তু সব তদন্তের পর কোনো কূল কিনারা বের হয়নি। পরে পুলিশ এই কেস ক্লোজ করে দিয়েছিলো বোধ হয়। আমি সেদিন খুব বেশি ভুল না হলে মাফিনকেই দেখেছি৷ এতোদিন পর যখন ওর ছায়া দেখেছি, আশা করা যায় খুব শিগগিরই আমি ওকে পেয়ে যাবো।”

রাইমা উত্তর দেয়। শার্লিন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চলে যায় রুম থেকে। সেদিন আর দুজনের কেউই রাতের খাবার খায়নি। রাত জেগে আড্ডা দিয়েই কাটিয়ে দিয়েছে। পরদিন সকালবেলায় রাইমা নিজের বাসায় চলে আসে।

২২,
বিকেলবেলায়, দিগন্তদের বাসার ড্রইং রুমে বসে আছে, মাহাদ, মাহাদের মা সাহিরা বেগম, শাহনাজ বেগম আর রাইমা। এতো বড়ো একটা বাসা, অথচ মানুষজনের বালাই নেই। শুধু দিগন্তকে একবার দেখেছে রাইমা। দিগন্ত বাসার মেইডদের সাহায্যে নাস্তা পানি দিয়ে বোনকে ডাকতে সেই যে গিয়েছে, দুই ভাইবোনের কারোর আসার খবর নেই। রাইমা কয়েক পিস আপেল নিয়ে চিবুতে চিবুতে বিরক্ত হয়ে ফোন দেখায় ব্যস্ত হয়ে পরে। মাহাদ অধীর আগ্রহে বসে আছে স্নেহাকে দেখাটর আশায়। মিসেস সাহিরা মেয়ের তাদের সামনে আসতে দেরি হচ্ছে দেখে মাহাদের হাটুতে খোঁচা দিয়ে ফিসফিস করে জিগাসা করলেন,

“আমার হবু ছেলের বউটা কোথায় রে? এতো সময় কেনো নিচ্ছে সামনে আসতে? আধঘন্টা হয়ে গেলো।”

“মা একটু ধৈর্য ধরো। জানোই তো সব, ওর মা বা বাসায় হেল্পিং হ্যান্ড কেউ নেই। ওর একাই সব গোছাতে হয়েছে। সেজন্য রেডি হতে হয়তো সময় নিচ্ছে।”

মাহাদ আর সাহিরা বেগমের কথার মাঝেই স্নেহার রুম থেকে স্নেহা আর দিগন্ত বের হয়৷ দিগন্ত বোনের পাশাপাশি দাড়িয়ে সযত্নে বোনকে ধরে ধরে আনছে। যেনো কাচের পুতুল, টোকা লাগলেই ভেঙে যাবে। স্নেহা আসছে দেখে শাহনাজ বেগম মেয়েকে আস্তে করে বললেন,

“এবার অন্তত ফোন টা রাখো। তোমার হবু ভাবী এসেছে পরেছে।”

রাইমা ফোন রেখে চোখ তুলে তাকায়। স্নেহা ধীরেসুস্থে এসে সবার উদ্দেশ্যে সালাম দিলো। রাইমা তাকাতেই দিগন্তের সাথে বেশ ভালো ভাবেই চোখাচোখি হয়ে গেলো। অসস্থিতে হিজাবের মাঝে চোখের চশমাটা ভালো করে নেওয়ার ছুতোয় চোখ নামিয়ে নেয়৷ স্নেহাকে দেখে মাহাদ মুগ্ধতায় বুদ হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। দিগন্ত মাহাদের শাহনী দেখে বড়োদের মাঝেই বলে,

“ব্রো, আমার বোন হারিয়ে যাচ্ছে না। একটু তো চারদিকে তাকিয়ে এরপর আমার বোনের দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকো।”

মাহাদ বিষম খেয়ে যায় দিগন্তের কথায়। রাইমা ভ্রু কুচকে তাকায়। শার্লিনের হাওয়া লেগেছে নাকি এই লোকের গায়ে? শার্লিনের মতো যেখানে সেখানে ভুলভাল কথা বলে বসছে দেখছি! রাইমা আনমনে এটাই ভাবে। সাহিরা এবং শাহনাজ বেগম মিটমিটিয়ে হাসলেন। মাহাদ আর স্নেহা দুজনই লজ্জায় মাথা নিচু করে নিয়েছে। দিগন্ত দাঁত বের করেই হাসছে। রাইমা কটমটিয়ে দিগন্তকে দেখে। কি রকম নির্লজ্জের মতো হাসছে দেখো! সাহিরা বেগম পরিস্থিতি সামলাতে বলেন,

“দাড়িয়ে আছো কেনো মা! এসো আমার পাশে এসে বসো।”

স্নেহা উনার কথায় পাশে বসে। হালকা কলাপতা রঙের শাড়ি পরেছে সে। সাথে হালকা সাজগোজ। এজন্য একটু সময় লাগলো স্নেহার। আগে কখনও সালোয়ার সুটের বদলে শাড়ি পরে দেখেনি সে। প্রথম শাড়ি পড়ার ঝামেলাই অন্য রকম, সাথে অনুভূতিও। আর সেই শাড়ি পড়াটা যদি হয় প্রিয় মানুষের জন্য! তাহলে তো তার চোখে মুগ্ধতা আশা করা যেতেই পারে। আর আশা অনুযায়ীই মাহাদ স্নেহাকে মুগ্ধতার সহিত দেখলো। ভাবতেই কেমন লজ্জা লজ্জা অনুভব হচ্ছিলো স্নেহার। সাহিরা বেগম হবু পুত্রবধূর থুতুনিতে হাত দিয়ে মুখটা উচু করে ধরে বলেন,

“মাশাল্লাহ, আমার ছেলের পছন্দ আছে তবে। শুনেছিলাম ওর কাছে তোমার গল্প। আজ সত্যি হওয়াতে এসেছি সেই গল্পটাকে। আমার ছেলে রোজ দুবেলা বায়না করে আমার কাছে তোমায় মেনে নেওয়ার আবদার করতো। তোমায় এনে দেওয়ার আবদার করে রোজ বাচ্চাদের মতো কেদেও দিয়েছে মাঝে মাঝে, যখন তোমাদের ঝগড়া হতো। শেষে এসে শুনেছিলাম, তুমিই নাকি ওকে বিয়ে করতে রাজী হচ্ছো না। সে যাই হোক, এখন তোমার আপত্তি নেই তো মা?”

স্নেহা সাহিরা বেগমের কথা শুনে জল ভরা দৃষ্টিতে একবার মাহাদের দিকে তাকায়। একটা ছেলে জতোটা ভালোবাসলে মায়ের কাছে তার জন্য এরকম বাচ্চাদের মতো বায়না ধরতে পারে? স্নেহা দুদিকে মাথা এলিয়ে বোঝায় তার আপত্তি নেই। দিগন্ত খুশিমনে বোনের সুখে দেখছে। কতোটা যে শান্তি লাগছে তার, বলে বোঝানের মতো নয়। রাইমাও নিরবে সবার আড়ালে চোখের জল মুছে নিলো। অবশেষে, তার বড়ো ভাইয়ের ছায়া দেওয়ার মানুষটা তার মানুষকে আপন করে পাচ্ছে। ভাবতেই খুশি খুশি লাগছে রাইমার। সাহিরা বেগম এবং শাহনাজ বেগম হাসিখুশি ভাবেই স্নেহাকে দুয়া করে আংটি পরিয়ে দিলেন। দিগন্তকে সাহিরা বেগম বললেন,

“সামনের শুক্রবারেই বিয়েটা হোক?”

দিগন্ত বললো,

“আন্টি তার পরের শুক্রবারে বিয়েটা হলে ভালো হতো না?”

“এতো লেইট কেনো?”

রাইমা মাঝখানে ফোড়ন কেটে প্রশ্ন টা করে। দিগন্ত রাইমার দিকে একবার তাকিয়ে তার প্রশ্ন এড়িয়ে সাহিরা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললেন,

“আমার কিছু স্বপ্ন আছে আন্টি, আপার বিয়েকে ঘিরে। সেগুলো যদি পূরণ করার একটা সুযোগ দিতেন! তার জন্য আমার একটু সময় প্রয়োজন সব গুছিয়ে নেওয়ার৷”

মাহাদ বললো,

“কি স্বপ্ন শুনি? আমাদেরও বলো। আমরাও চেষ্টা করবো সহোযোগিতা করার।”

চলবে?