আকাশ মোড়ানো চিরকুট
লেখনী – সাইমা ইসলাম প্রীতি
২৭.
আকাশের ফালি ফালি মেঘের মাঝ দিয়ে সূক্ষ্ম একটুকরো হলুদ নরম আলো এসে পড়ে কুহেলীর মুখে। ঝলমলে সূর্য উঠেছে পূর্বে। ফর্সা মুখখানি জুড়ে সূর্যের প্রথম কিরণ এসে জায়গা করে নেয়ার মুহুর্তেই কুঁচকে আসে পরমা সুন্দরীর চিকন ভ্রুঁ যুগল। পৃথিবীতে নারী সবচেয়ে মোহময়ী ঘুম ভাঙ্গার পর কুঞ্চিত চেহারায়, মিটমিট করে মেলা চোখে! চোখের উপর হাত ঠেকিয়ে আরো খানিকটা সময় কাটিয়ে দেয় কুহেলী। তারপর চোখ মেলে আশেপাশে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায়, জানালায় বসেই ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। দ্রুত নিচে তাকিয়ে দেখে, নাহ সমারোহ নেই। বুকের চেপে ধরে কিছুক্ষণ বসে থাকে সে। ভাগ্যিস সমারোহ তাকে দেখেনি। ভ্যাবসা গরম পড়েছে চারিদিকে। কুহেলীর হাঁটু অব্দি লম্বা চুলে তেল দেয়া। ল্যাপ্টে আছে গাঁয়ের সঙ্গে। গরম তাই আরো বেশি লাগছে। গোসল সেরে নিচে খাওয়া-দাওয়া করতে গিয়ে খানিকটা অবাক হয় কুহেলী। দিনটা শুক্রবার। যদিও সমারোহ আর সান্দ্রর ফুল ডে ছুটি থাকে না তবে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সকালে বাড়ির সবার একসাথে খাওয়ার নিয়ম। সবাই আছে সেখানে একমাত্র সমারোহ ছাড়া। কুহেলী কাউকে জিজ্ঞেসও করতে পারে না। সবার আলাপচারিতায় অবশ্য জানতে পারে সমারোহ সকালেই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে। বেশ কিছুদিন আগে বি.সি.এস. পরীক্ষা দিয়েছিল সেটার পিলিতে টিকেছে। দুদিন পর ভাইভা হবে। এসবের কিছুই জানা ছিল না কুহেলীর। কেন যেন খুব করে রাগ হয় কুহেলীর সমারোহর প্রতি। একটাবার তাকে বলে গেলে কি হতো! অবশ্য সে কে যে তাকে বলে যেতে হবে? খাবারের মাঝেই সেঁজুতিকে কল করে হিরণ। খাবার প্লেটে রেখেই কথা বলতে উঠে যায় সে। সেঁজুতির কান্ড দেখে বাকিরা মুখ টিপে হাসে।
পরদিন কুহেলী সান্দ্রর সাথে আসে মেডিক্যাল কলেজে। বাড়ি থেকে মেডিক্যাল, কুহেলী এই প্রথম খেয়াল করে রাস্তাটা কতো বিস্তৃত! দেড় ঘণ্টার বেশি সময় লেগেছে আসতে কিন্তু ওর কাছে মনে হয়েছে যেন তিন-চার ঘন্টা। অথচ সমারোহর পাশে থাকলে মনে হতো এতো দ্রুত পৌঁছে যাচ্ছে কেনো? উত্তমকুমারের সেই গানটা যদি সত্যি হতো! সমারোহর সাথে চলার সময় যদি এই পথ সত্যিই শেষ না হতো তবে মন্দ হতো না! চলতে চলতে পৃথিবীর শেষ প্রান্তে পৌঁছে যেতো!
ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে গাড়ি থেকে নেমে কলেজের দিকে হাঁটা শুরু করে কুহেলী। দোতলায় পৌঁছানোর পর এক সিনিয়র ভাইয়া দূর থেকে ইশারায় ডাকে কুহেলীকে। বারান্দার এক কোণে ছয় সাত জন দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছিল তারা। কুহেলী তাদের কাউকেই খুব একটা চিনে না। কুহেলীর তিন ব্যাচ সিনিয়র। কুহেলী সেদিকে এগিয়ে যেতেই কালো শার্ট পড়া ভাইয়াটা প্রসস্ত হাঁসি হেঁসে বলে,
‘ কেমন আছো? পড়ালেখার কি অবস্থা?’
‘ভালো, আপনারা?’
‘ এই তো আছি। চেনো আমাকে? ‘
‘ নাম শুনেছি। ফোর্থ ইয়ারের আলিফ ভাইয়া।’
‘গুড। ধরো এটা তোমার জন্য। ‘
ছেলেটা একটা চিরকুট এগিয়ে দেয় কুহেলীর দিকে। কুহেলী ভ্রুঁ কুঞ্চিত করে চেয়ে থাকে ছেলেটার দিকে। মুখ থেকে কথা বের হয় না। হঠাৎ-ই খাপ করে চিরকুটটা নিয়ে খুলে হ্যান্ড রাইটিং দেখে নেয়। সেই একই হ্যান্ড রাইটিং। কুহেলী ভড়কে গিয়ে ছেলেটার দিকে তাকাতেই সে মুচকি করে হাসে। কুহেলীকে ধাতস্থ করে বলে,
‘ আমি দেই নি। তবে যে দিয়েছে তার পরিচয় দেয়া নিষেধ আছে। ‘
বলে বাঁকা হেঁসে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতেই কুহেলী হন্তদন্ত হয়ে বলে,
‘ এটা যে আপনি দেন নি সেটা কি করে বুঝবো? ‘
ছেলেটা ফিক করে হেঁসে পাশে দাঁড়ানো একটা মেয়েকে ইঙ্গিত করে দেখিয়ে বলে,
‘ আমার প্রেমিকা। মেডিক্যালের প্রায় সবাই জানে আমাদের ব্যাপারে। সো তোমাকে কেনো দিতে যাব প্রেমপত্র? ‘
কুহেলী সন্দিহান চোখে দেখে বলে,
‘ তাহলে এটা কে দিল বলতে সমস্যাটা কোথায়? ‘
‘ সিনিয়রকে এভাবে কোশ্চেন করছো তোমার তো সাহস কম না! ‘
ছেলেটা সামান্য চটে গিয়ে বলে কথাটা, তারপর দ্রুত পদক্ষেপে চলে যায়। কুহেলী শুধু বলদের মতো চেয়ে থাকে। চিরকুটটা পড়ার সময় আর হয়ে উঠে না। ক্লাসের সময় হয়ে গিয়েছে। ক্লাস শেষে ক্যান্টিনে বসে চন্দ্রিমার সাথে শেয়ার করে বিষয়টা। দুজন একসাথে বসে পড়ে চিরকুটটা,
‘ কৃষ্ণলতা!
যদিওবা তুমি কালো নও! তবু তোমায় কৃষ্ণলতা ডাকতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি আমি। কারণ হিসেবে কিছুই জানা নেই অবশ্য। তবে তুমি কালো হতে পারলে না কেনো? কুৎসিতও তো হতে পারতে! তাহলে হয়তো হাজার পুরুষের নজর তোমার উপর পড়তো না। তোমাকে কেবল আমিই দেখে যেতাম আজন্ম। তোমার কৃষ্ণ শরীর জুড়ে ফকফকে সাদা শাড়ি জড়িয়ে, ঘন কেশযুগলে কাঠগোলাপ গুঁজে যদি আমার সামনে এসে দাঁড়াতে! ইশঃ! আমি হয়তো পাগল হয়ে যেতাম। তোমার ভ্রুঁ’র শেষ প্রান্তে কিংবা গলার তিলটা না থাকলে হয়তো অনেকের মনে ঘন বর্ষা নামতো না যেমনটা আমার নামে। আমি হয়তো তোমার চেয়েও বড় ভয়ানক প্রেমে পড়েছি তোমার ওই সূক্ষ্ম তিলের। এসবের কিছুর অধিকারীনি তুমি না হলে তোমাকে কেবল আমার মাঝেই লুকিয়ে রাখতে পারতাম। কিন্তু তুমি তা নও। তুমি তো মায়াবিনী। ভয়ংকর সর্বনাশি ভুবন ভোলানো সুন্দরী!
কৃষ্ণলতা! বড্ড বেশিই লাজুক তুমি! তবে আমার কিন্তু লাজুক পরী-ই প্রিয়। কোনো এক অমাবস্যার গভীর রাতে জোনাকির মেলায় নিরব নদীর ধারে বসে তোমায় অপলক দেখে যাব তুমি লাজে নুইয়ে পড়বে আমার বুকে। নেশাতুর হাঁসি মাখা কোমল কন্ঠে বলবে, ‘ অত দেখার কি আছে? ওভাবে দেখবে না আমায়। সহ্য হয় না আমার। ‘ আমি কিন্তু শুনবো না একদম! আমার চোখে সেদিন হবে তোমার সর্বনাশ। যতো যন্ত্রণা তুমি আমায় দিচ্ছ না! সব সুদে আসলে বুঝে নেব সেদিন মনে রেখো। জানো প্রিয়, আমি তোমার থেকেও তোমার চোখ দুটোকে বেশি ভালোবাসি। প্রথম যেদিন তোমাকে দেখেছি সেদিন অপলক চেয়ে ছিলাম তোমার চোখে। তুমি হয়তো ঠাওর করে উঠতে পারোনি। শুধু তাই নয় আমার বুক নিংড়ে যতো প্রেম , মোহ আছে সব চুরি করে নিয়েছে ওই চোখ। এতো মায়া, এতো নেশা, এতো পবিত্রতা কি করে থাকতে পারে সেখানে! ভাগ্যিস তুমি এই আঁখিযুগল কাজলে মাখো না। মাখলে আমি হয়তো মারাই পড়তাম। এমনিতেও তুমি যা শুরু করেছো না, মনে হয় না আমাকে খুন করার আগ অবধি শান্ত হবে।
আচ্ছা তুমি কেমন দুষ্টু বলো তো! ভীষণ রাগী ছিলাম আমি। মেডিক্যাল আর পড়া ছিল আমার জীবনের মূলমন্ত্র। দিনে পড়া ছাড়া আর কোন ভাবনা মাথায় থাকত-ই না আমার। ব্যস্ত সময়গুলোর মাঝে হুট করেই কেমন ঠেলেঠুলে জায়গা করে নিলে তুমি! তোমার অদ্ভুত চিন্তা চেতনা এই টগবগে গম্ভীর যুবকের মনকে সহজেই ধরাশায়ী করে ফেললো। জানো, আমি নিজেরই মাঝে মাঝে বড্ড বেশি অবাক হয়ে যাই। এই গম্ভীর আমি তোমাকে নিয়ে ভাবতে গেলেই কেমন উপন্যাস লিখে ফেলি! প্রেমপত্র তাও আমি! এখন আমার ব্যস্ত জীবনের একটা বড় অংশ জুড়ে তুমি আছো আমার লাজুক কৃষ্ণলতা। আমি বারবার, হাজারবার চেষ্টা করেছি তোমার ফাঁদে পা না দিতে। দূরে সরে যেতে চেয়েছি। যতবার চেয়েছি ঠিক ততবার-ই তোমার অভিমানী চোখের চাহনির কাছে হেরে গেছি। উল্টো নিজেকেই হারিয়ে ফেলে নিঃস্ব হয়ে গিয়েছি বারে বারে। মেলে দিয়েছি আমার যা কিছু আছে সব। সবটাই তোমার। কেবলই তোমার। তবে তোমার সামনে এসে ভালোবাসা চাইতে আমি নারাজ। তোমাকে আমি মৃত্যুর আগ অব্দি ভালোবাসবো। কেবলই অপ্রকাশ্যে। আজ নাহয় একবার শুনেই নাও।
শুনো কৃষ্ণলতা, ভালোবাসি। ভালোবাসি ভালোবাসি ভালোবাসি এবং তোমাকেই ভালবাসি। ‘
কুহেলীর হাত অনবরত কাঁপছে। গলা শুকিয়ে কাঠ! মনের মাঝে উত্তাল সমুদ্রের বিশাল ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে বারংবার। একটা চিরকুট কিভাবে অনুভূতি শূন্য করে দিতে পারে কুহেলী জানে না। তবে এই মুহূর্তে কুহেলীর কিছু ভালো লাগছে না। কিচ্ছু না। মানুষটা কে? কেন তাকে এতো এতো ভালোবাসে? কুহেলী কি আদতেও এর যোগ্য। চোখের কার্ণিশে বিন্দু বিন্দু অশ্রু কণারা এসে জমা হয় মুহূর্তেই। অঝোর ধারায় ঝরে পড়তে চায়। ঠোঁট কামড়ে কোনো রকম নিজেকে সামলে নেয় কুহেলী। হাতের চিরকুট সামান্য মুচড়ে ফেলে। তবে এই অনুভূতি অন্যরকম। কিছু কিছু অপ্রত্যাশিত অনুভূতিও সুন্দর, অমোঘ মোহনীয় হয়। কুহেলীর আফসোস হয়।
চন্দ্রিমা ঘোর চিন্তায় পড়ে যায়। ব্যাপারটাকে ও এর আগে এতো বেশি সিরিয়াসলি নেয়নি। এখন মনে হচ্ছে সে যা ভেবেছে তার চেয়েও গভীর প্যাঁচ আছে। লেখাগুলো সমারোহ ভাইয়ার না হলে আর কে আছে যে কুহেলীকে এতো কাছ থেকে দেখে! কুহেলীর সব পদক্ষেপেই যে নজরদারি চলছে তা বেশ বুঝা যাচ্ছে। চন্দ্রিমা বেশ খানিকটা সময় চুপচাপ কাটিয়ে দিয়ে বলে,
‘ আলিফ ভাইয়ের দিকে একটু নজর রাখলেই বুঝা যাবে বুঝলি। সে তো অবশ্যই চিনে প্রেমপত্রের মালিককে। বাট বজ্জাতটা নাম বললো না কেন এই বুঝতে পারতেছি না। প্রেম করার হলে সামনাসামনি এসে বললেই তো হয়। এটা একটা পাগলামি না! তুই তো আর তাকে না দেখে শুনে প্রেমে পড়বি না। অদ্ভুত! ‘
কুহেলী কিছু বলে না। কুচকে যাওয়া চিরকুট খুব যত্নে ভাঁজ করে ব্যাগে রেখে দেয়। চিরকুটটা থেকে খুব সুন্দর একটা ঘ্রাণ পাওয়া যায়। এই ঘ্রাণ কুহেলীর চেনা। খুব পরিচিত। তবে ঠিক মনে করতে পারে না কোথায় পেয়েছিল এই মাদকতুল্য সুগন্ধি। কুহেলীর কেনো জানিনা এই প্রথম বড্ড আফসোস হয় সে অসুন্দর কেনো হলো না!
–
ভাইভা খুব বেশিই ভালো হয়েছে সমারোহর। সমারোহ সচকিত হয়েছে ভাইভা বোর্ডে গিয়ে তার প্রশংসা শুনে। একজন স্যার তার পূর্ব পরিচিত ছিলেন। সমারোহর সকল প্রশ্নের কনফিডেন্টলি জবাব দেয়া আর স্যারের প্রশংসায় সেই রুমে যে অবস্থা হয়েছিল তা মোটেই ভালো লাগেনি সমারোহর। পুরনো অনেক বন্ধুদের সাথে দেখা হয়েছে এখানে এসে। সেই পুরনো ক্যাম্পাস! প্রাণের মেডিক্যাল, এ কলেজে পড়ার জন্য কতো কতো সংগ্রাম! চান্স পাওয়ার পর ক্লাস, বন্ধুমহলে আড্ডা, হৈ হুল্লোড়, লাফিয়ে দাপিয়ে বেড়ানো আরো কতো কি! সবকিছু চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠে সমারোহর। সেই দিনগুলো হারিয়ে গেছে সময়ের অতল গহ্বরে। চাইলেও তাতে ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। খালি বুক কাঁপানো ব্যাথা নিয়ে হৃদয়ের গোপন কুঠুরিতে পরে আছে এক ছটাক স্মৃতি। সময়ের কাছে মানুষ সত্যিই অসহায়।
তিন-চার দিন বেশ ব্যস্ততার সাথে কেটেছে সমারোহর। এই ব্যস্ততার মাঝেও যেন কিছু শূন্যতা আছে। কুহেলী নামক শূন্যতা। ঢাকা আসার পর সমারোহ পরতে পরতে খেয়াল করেছে সে একটু না, খুব বেশিই মিস করছে কুহেলীকে। ব্যাকুল হয়ে উঠেছে মনটা ওই চোখ দুটি দেখার জন্য। কেনো? সমারোহ নিজের উপর কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলছে? মেয়েটা নিয়ন্ত্রণ করছে কি তাকে! ভয়ে বুক কুঁকড়ে আসে সমারোহর। সে তো সত্যিই কারো প্রেমে পড়তে চায়নি। যা হচ্ছে তাতে তার হাত নেই। নিজ থেকেই হচ্ছে। সমারোহ চাইছে না তারপরও সে করছে।
আজ রাতের ট্রেনে চিটাগাং ফিরে যাবে ভাবতেই খুশি খুশি লাগছে মনটা। সবার জন্য টুকটাক কেনাকাটা করার মাঝেই যেন ছিল অস্থিরতা । কিন্তু এটা হওয়ার কথা ছিল না। এর আগেও সমারোহ কয়েকবার এসেছে ঢাকা। ইনফ্যাক্ট যখন ঢাকা মেডিক্যালে পড়তো ছুটি পেয়ে বাড়ি যাওয়ার সময়ও এমনটা হতো না। আলো ছিল গোপালগঞ্জ মেডিক্যালের। তার সাথেও রোজ দেখা হতো না। আলোর সাথে দেখা করার দিনগুলোতেও এতো উত্তেজনা কাজ করতো না সমারোহর।
সমারোহ আনরুবা আর সারিকা জন্য ছাড়া ও শুধু কুহেলীর জন্য শাড়ি কিনেছে। কুচকুচে কালো পাতলা নেটের শাড়ি আর একজোড়া নূপুর। কিনে নিজেই দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেছে। কুহেলীকে এগুলো সে কিভাবে দিবে! আর কুহেলীর কি পছন্দ হবে এসব? সবার সামনে তো দেয়া যাবে না, তাহলে লজ্জার মুখে পড়তে হবে তাকে। হাজারটা ভাবনা চিন্তায় জর্জরিত হয়ে যায় সমারোহ। যতো না ভাবতে চায় ততই বেশি করে ভাবনায় তলিয়ে যায়।
–
পুরো বাড়ি খুব জাঁকজমকভাবে সাজানো হয়েছে। বাড়ির বাহিরে মরিচবাতি আর ভেতরে কৃত্রিম ফুল দিয়ে। বাগানের অংশ এখনো সাজানো বাকি আছে। বাড়ির পেছনের সুইমিং পুলটা সাজানো হয়েছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ভাবে। পানির নিচে লাইটিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ছোট্ট সুইমিং পুলের চারদিকে একটু পর পর রাখা হয়েছে নাম না জানা ফুলের টব। রাতে সেখানে তাজা ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে দেয়া হবে। মেহমান আসতে শুরু করেছে একটু একটু করে। জমজমাট হয়ে গিয়েছে জহির আহমেদের বাড়ি। সমারোহ আর সান্দ্রকে ইদানিং সারাক্ষণ-ই ব্যস্ত দেখা যায়। বাড়ির সবচেয়ে ছোট আর আদরের সদস্যের বিয়ে বলে কথা! বিয়ের সকল প্রকার মার্কেটিং এর দায়ভার পড়েছে সান্দ্রর উপর আর বাড়ি ডেকোরেশনের দায়িত্ব সমারোহর।
সকাল ছয়টা। ঘুম থেকে উঠে মুখ না ধুয়েই খালি পায়ে সারাবাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখে কুহেলী। এতো ভোর বেলাও চার দিকে মানুষের ছড়াছড়ি। বাড়ি সাজানো টা বেশ মন কাড়ে কুহেলীর। ছাদে গিয়ে দেখে সমারোহ খুব কড়া ভাবে ডেকোরেটরদের নির্দেশনা দিচ্ছে কে কি করবে না করবে। কেউ ভুল করলেও বকাবকি করছে না। কতো ধৈর্য্য! লোকটা কাজ করতে করতে ঘেমেনেয়ে একাকার। মুখটা কালচে বর্ণ ধারণ করেছে। পড়নের কালচে খয়েরী রঙের পাঞ্জাবি টা ঘামে ভিজে গায়ের সাথে ল্যাপ্টে আছে, হাতা ফোল্ড করে রাখা। বড় সিল্কি চুলগুলো কপালের উপর পড়ে আছে অবিন্যস্ত হয়ে। হাতে হিসাবের খাতা। হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলছে সমারোহ। গলার অ্যাডামস অ্যাপল অনবরত কেঁপে কেঁপে উঠছে। কুহেলী একবার ঢোক গিলে। এতো আকর্ষন কেনো করে লোকটা তাকে? যতো দিন যাচ্ছে ততই কি আরো বেশি করে সুদর্শন হয়ে যাচ্ছে! মেয়েদের নজর কাড়ার নিনজা টেকনিক। কথাগুলো আপন মনে ভেবে ভেংচি কাটে কুহেলী। তারপর ছাদের দরজায় ঠেস দিয়ে একহাত আরেক হাতে চেপে ধরে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে সমারোহর দিকে। সমারোহর সেদিকে খেয়াল নেই। কুহেলী তাই মন ভরে দেখে। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর নিচে চলে আসে চুপিসারে।
আজ সেঁজুতির গাঁয়ে হলুদ। আনরুবা, সারিকা আরো অনেকে মিলে বিভিন্ন রকম পিঠা বানাচ্ছে। তক্তের সাথে পাঠাবে বলে। কুহেলীকে দেখে আনরুবা হেসে বলেন,
‘ এতো সকালে উঠে পড়ছো? রাতে দেরী করে ঘুমাও আবার তাড়াতাড়ি উঠে পড়লে ঘুম কি হয় নাকি ঠিক মতো! যাও গিয়া হাত মুখ ধুয়ে খেয়ে ফেলো। ‘
কুহেলী মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। তারপর দোতলায় চলে আসে। নিজের রুমে যেতে ইচ্ছে করে না। সেখানে অনেকজন বসে আড্ডা দিচ্ছে। চট্টগ্রামের বিয়ে মানেই বিয়ের পূর্বেই হাজার হাজার মানুষের সমাগম। জমজমাট পরিবেশ, তাদের আতিথেয়তায় মুগ্ধ না হয়ে থাকা যায় না। তবে মানুষের মাঝে থাকতে কুহেলীর মোটেই ভালো লাগে না। পড়ালেখাও ঠিক মতো করা যায় না এতো হট্টগোলে। হঠাৎ কুহেলীর মাথায় আসে লাইব্রেরীতে তো কারো যাওয়া নিষেধ। সেই জায়গাটা ফাঁকা থাকবে এখন। লাইব্রেরীর বাইরের দরজা বন্ধ করে রেখেছে সমারোহ। কুহেলী চুপটি করে সমারোহর ঘর দিয়ে লাইব্রেরীতে চলে যায়। ফ্যান ছেড়ে দিয়ে জানালা খুলে বসে থাকে চেয়ারে। তার ঠিক সামনেই গ্রীলহীন জানালা। মৃদু মিষ্টি আলো গলে পড়ছে সেদিক থেকে। টেবিলের উপর দুই হাত তুলে হ্যাড-ডাউন করে রাখে কুহেলী। মানুষের কিচিরমিচিরে ঘুমটাও ঠিক মতো হলো না। এখন আবার ঘুম পাচ্ছে। কখন যে আবার ঘুমে তলিয়ে যায় টেরই পায় না কুহেলী।
অনেকটা সময় পর হঠাৎ কুহেলীর মনে হয় ঘাড়ে গরম বাতাস পড়ছে। চোখ বোজা অবস্থাতেই কপাল কিঞ্চিৎ কুঁচকে আসে কুহেলীর। কারেন্ট কি চলে গেল নাকি! কিছুক্ষণ চোখ বুঁজেই অনুভব করে কারো প্রগাঢ় গরম নিঃশ্বাস পড়ছে কুহেলীর কাঁধের উপর। অবাক হয় চোখ মেলতেই দেখে সমারোহর মুখখানি। খুব কাছাকাছি! ভড়কে উঠে কুহেলী। চোখ খুলেই এতো কাছাকাছি সমারোহকে দেখবে বলে আশা করেনি। সমারোহ একহাত কুহেলীর চেয়ারে আরেক হাত টেবিলে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে তাকে। কুহেলী মাথা উঠিয়ে ভয় পেয়ে জড়ানো কন্ঠে বলে,
‘ আপনি, আ-আমি আসলে বসে ছিলাম। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি…। ‘
কুহেলীর কাঁপা কন্ঠে হালকা হাসে সমারোহ। কুহেলী হিতাহিতজ্ঞান শূন্য হয়ে পড়ে। উঠতে নিলে টের পায় চেয়ার কিছুটা সমারোহর দিকে ঘুড়ানো, সমারোহর জন্য উঠাও যাচ্ছে না। কুহেলী জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে। গোল গোল চোখ করে অসহায় চোখে তাকায় সমারোহর দিকে। শরীর থেকে তার আত্তা এতোক্ষণে ভয়ে উবে গেছে। গলা শুকিয়ে বুকে খড়া শুরু হয়ে গেছে। সমারোহ উদ্বেগহীন মুগ্ধ চোখে চেয়ে আছে কুহেলীর দিকে। কুহেলী আড়ষ্টতায় কুঁকড়ে থাকে। সমারোহর এই চাহনিই তো তার সর্বনাশ করে ছেড়েছে। আরো একটু সর্বনাশ হলে দোষ কি! কুহেলীর দম আটকে এসেছে প্রায়। সে না পারতে কাচুমাচু হয়ে বলে,
‘ এভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো? ‘
সমারোহ কুহেলীর কথা শুনে এগিয়ে আসে কুহেলীর দিকে। কুহেলী ভয়ে চোখ খিঁচে বন্ধ করে নেয়। সমারোহর নিঃশ্বাস’টুকুও এবার কুহেলীর মুখে আছড়ে পড়ছে। কুহেলী শেষ! সে মারা পড়েছে।
সমারোহ কুহেলীর কানের কাছে গিয়ে নেশা মাখা কন্ঠে বলে,
‘ কেউ অমোঘ দৃষ্টিতে চেয়ে চেয়ে আমায় চোখ দিয়ে গিলে খেলেও কিছু হয় না। আমি দুমিনিট তাকে দেখলাম তাতেই যত দোষ! ‘
কুহেলী এবার ঢোক গিলে চোখ বড় বড় করে তাকায়। সমারোহ তো তাকে দেখেনি তখন। তাহলে! সমারোহর ঠোঁট, গলা, অ্যাডামস অ্যাপল এতো কাছে দেখে কুহেলী অস্বস্তিতে পড়ে যায়। মূলত সমারোহকে এতো কাছে দেখে কান্না করে দিতে ইচ্ছে করে কুহেলীর। শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায় নিমিষেই।মুখ দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নেয়। কপালে জমা হয়েছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। সমারোহ আরো একধাপ কুহেলীর কাছে গিয়ে বলে,
‘ আর কখনো মায়াবিনী চোখজোড়ায় এভাবে দেখবে না আমায়। আমি মাতলামি শুরু করলে আর আটকাতে পারবে না। সর্বনাশ হয়ে যাবে তোমার। ‘
কুহেলীর এবার হেঁচকি উঠে যায়। চোখ বড়বড় করে তাকায় সমারোহর দিকে। সমারোহর চাহনি অন্যান্য দিনের তুলনায় ভিন্ন। আরো ভয়াবহ। অনুভূতি, লজ্জা, ভয় সব ভুলে চোখ বুঁজে সমারোহর বুকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে উল্কাপিণ্ডের বেগে লাইব্রেরীর রুম থেকে বের হয় কুহেলী। সমারোহ কিছু বুঝে উঠার আগেই ঘটে ঘটনাটা। যখন ঠাওর করতে পারে হেঁসে ফেলে সে। দরজার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে ডান হাতে মাথার পিছনের চুল এলোমেলো করে দেয়। তারপর ঘরে এসে দেখে কুহেলী তখনও সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। সমারোহ তাকাতেই চোখ খোঁচ করে মুখ ফুলিয়ে বলে,
‘ এতো উপরের ছিটকিনিটা কেন লাগিয়েছেন? আমি খুলতে পারছি না। ‘
সমারোহ একবার কুহেলীর দিকে তাকায়, একবার দরজার লকের দিকে দেখে। কুহেলীর মাথা থেকে প্রায় দুই হাত উপরে সেটা। সমারোহর এবার পেট ফেটে হাসি আসে। সজোরে হেঁসে ফেলে সে। কুহেলী বাচ্চাদের মতো করে রেগে তাকায়। খানিকটা লজ্জাও পায়। সমারোহ অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে পেট চেপে ধরে কাউচে বসে বলে,
‘ তোমার হাইট কতো? ‘
‘ পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি। ‘
‘ এতো বাট্টু দেখেই পারো না। ‘
কুহেলী হাঁ হয়ে যায়। সে কিনা খাটো! কি আজব কথাবার্তা। কুহেলী অবাক হয়ে বলে,
‘ আমি খাটো? ‘
‘ অবশ্যই বাট্টু। আমার বুক বরাবর পরো। আর তা না হলে খোলো দরজা! ‘
‘ আমি একদম পারফেক্ট বুঝলেন। আপনার দরজাটাও আপনার মতোই খাম্বা। ‘
সমারোহ ভ্রুঁ কুঞ্চিত করে মুখ ছোট করে বলে,
‘ আমি খাম্বা! তুমি জানো সবাই আমার হাইট দেখে কতো প্রশংসা করে? ‘
কুহেলী মনে মনে ভেংচি কাটে। তারপর সন্দিহান কন্ঠে বলে,
‘ এতো উপরে কেনো ছিটকিনিটা। আর ওটাই কেন লাগাতে হবে নিচের গুলো লাগাতে পারেন না? ‘
সমারোহ বড় সহজ গলায় বলে,
‘ একটা বাট্টু মেয়ে বিয়ে করবো তারপর বউকে ঘরে আমার কাছে আটকে রাখবো তাই! ‘
কুহেলী মূর্ছা যায় সমারোহর কথা শুনে। মানুষের চিন্তা ধারা যে কি পরিমান আজব হতে পারে সমারোহকে না দেখলে তার জানাই হতো না। বউ কাছে রাখার জন্য দরজাও বড় মাপের হতে হয় বুঝি! কুহেলী আশ্চর্যের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়ে বলে,
‘ বউ আটকে রাখার জন্য বাড়িও দেখেশুনে বানিয়েছেন? ‘
‘ হ্যাঁ বানালাম। ‘
‘ তো এখন আটকালেন কেনো? ‘
‘ খুশিতে। ‘
কুহেলী চুপসে যায়। মুখ ভেংচি কাটে। সমারোহ সোফা থেকে উঠে বলে,
‘ মানুষের মাঝে থাকলে পড়া ঠিক মতো হবে না। বইপত্র নিয়ে এই রুমে এসে পড়তে বসো। এখানে কেউ আসার সাহস করবে না সো পড়ায় ডিস্টার্ব হবে না। এক্সামটা খারাপ হয়ে দেখুক খালি! ‘
কুহেলী ঢিপ ঢিপ চোখে দেখে সমারোহকে। ভালো লাগে সমারোহর শাসন। মাথা নিচু করে শুনে সব। সমারোহ দরজা খুলে দিয়ে বলে,
‘ যেমন দৌড়ে পালাও ঠিক তেমনি ফ্রেশ হয়ে খাওয়া-দাওয়া সেরে দৌড়ে এসে পড়তে বসো। আমি আসবো না ঘরে তোমার অসুবিধা হবে না। ‘
তারপর ওয়াশরুমে চলে যায় তোয়ালে নিয়ে। কুহেলী মুচকি হেসে ঘর ত্যাগ করে। বই নিয়ে ঘরে এসে দেখে সমারোহ ততক্ষণে চলে গেছে। গোসল করে গিয়েছে হয়তো। ভেজা পাঞ্জাবিটা কাঠের চেয়ারে রেখেই চলে গিয়েছে। কি ভুলুক্কুর মানুষরে বাবাহ! কুহেলী পাঞ্জাবিটা সেখান থেকে তুলে নেয় বেলকনিতে ছড়িয়ে দিবে বলে। পাঞ্জাবিটা নিয়ে মিনিট খানেক চেয়ে থাকে। হঠাৎই নাকের কাছে নিয়ে চোখ বুঁজে দীর্ঘ নিঃশ্বাস নেয়। তারপর দ্রুত সরিয়ে ফেলে। মনে হচ্ছিল সমারোহর সাথে ল্যাপ্টে ছিল যেন। সমারোহর শরীরে, জিনিসপত্রে, ঘরে সবসময় একটা ঘ্রাণ পায় কুহেলী। এই ঘ্রাণ আসক্ত করে ফেলার ক্ষমতা রাখে কুহেলীকে। নিজের কান্ডে নিজেই লজ্জা পেয়ে নাক, কান লাল হয়ে যায়। ঠোঁটে ফোঁটে লাজুক হাসি। হঠাৎ কি একটা যেন ভেবে চোখ মুখ কুঁচকে যায় কুহেলীর। গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে যায়।
চলবে.
আকাশ মোড়ানো চিরকুট
লেখনী – সাইমা ইসলাম প্রীতি
২৮.
বেলকনিতে রাখা বেতের মোড়াতে বসে আছে সমারোহ। গিটারে টুং টাং শব্দ তুলছে আর মাঝে মাঝে দু’এক লাইন গাইছে। ওয়েদার মনোরম সৌন্দর্য মাখা। কুয়াশা পড়েছে সামান্য। আকাশ স্পষ্ট নয়। তারার মেলা আজ লাজে রঙিন হয়ে লুকিয়েছে মেঘমালার আড়ালে। ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিয়ে দেখে নিচ্ছে পৃথিবীটাকে। গিটারে হাত রেখে এক দৃষ্টিতে আকাশের দিকে চেয়ে থাকে সমারোহ। বুকে ব্যাথা হচ্ছে। খুব করে ব্যাথা হচ্ছে। হৃৎপিণ্ডে যন্ত্রণারা খুঁড়ছে অবিরাম। দলা পাকানো ব্যাথা বুকে থেকে গলা অবধি উঠে এসেছে। ব্যাথার উৎপত্তি জানার চেয়ে এ ব্যাথা অনুভব করাতেই ভালোলাগা বেশি। কখনো এক সমুদ্র সমান মোহের ছায়ায় মনের আঁধার কাটে তো কখনো রৌদ্রতপ্ত খাঁ খাঁ নিরিবিলি দুপুরের ন্যায় এক ছটাক তিক্ত প্রখর বেদনার আক্ষেপে ভরে উঠে হৃদয়। এ চেতনা কেমন! এই খুব করে ভালোলাগে আবার হঠাৎই কোথায় যেন তাড়না দেয় একটা সূক্ষ্ম কষ্ট কিন্তু আছে। তবু কিছু কিছু অপ্রত্যাশিত অনুভূতি কষ্টের হলেও ভালোলাগার। সমারোহ কিছুতেই রেহাই পায়না এর থেকে। চোখের সামনে বারংবার ভেসে উঠে কুহেলীর পাতলা ঠোঁটের হাসি, মায়াবী চোখ। কুহেলী হাসলে তার চোখ দুটিও হাসে। মেয়েটা কি তাকে পাগল করে ছাড়বে! একটু আগে শেষ হয়েছে হলুদের অনুষ্ঠান। পুরো অনুষ্ঠান জুড়ে সমারোহ কুহেলীকে দেখে গেছে আর ছবি তুলে গেছে। কুহেলীর তা অজানা অবশ্য। হলুদ গ্রাউনে কি মনোমুগ্ধকর স্নিগ্ধ লাগছিল মেয়েটাকে! সমারোহ মনের সাথে শত চেষ্টা করেও নিজেকে সংযত রাখতে পারেনি। কেবল দেখেই গিয়েছে।
গিটার পাশে রেখে ঘরে গিয়ে আলমারি খুলে নূপুর জোড়া আর কালো শাড়িটা বের করে সমারোহ। শাড়িটা কিছু সময় দেখে প্রগাঢ় চুম্বন করে আবার জায়গা মতো রেখে দেয়। সেদিন শাড়ি, নূপুর কিছুই দেয়া হয়নি কুহেলীকে। মিথ্যে বলেছে যে কুহেলীর জন্য কিনতে ভুলে গিয়েছে। মেয়েটার মনটা খারাপ হয়েছিল যা এখনও পোড়ায় সমারোহকে। নূপুর পকেটে রেখে আবার বারান্দায় গিয়ে বসে একটা বই নিয়ে পড়তে শুরু করে সে।
–
বাগানের কর্ণারে চেয়ার নিয়ে চুপচাপ বসে আছে সেঁজুতি। কাঁদছে একাকী। জনাকীর্ণ এই বিয়ের মহলে তার জন্য আনন্দ পাওয়ার মানুষ আছে অনেক কিন্তু তার মনের খবর রাখার মানুষ নেই। সেঁজুতির পৃথিবীটাকে অসহ্য লাগে। বিরক্তি আসে সবকিছুর প্রতিই। জীতুকে একবার জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করে। সে কিভাবে যাবে অন্যের সংসারে? বাস্তবতা এতো কঠিন কেনো? পরিস্থিতি এতো নিষ্ঠুর কেনো? তার চিৎকার কি তার সৃষ্টিকর্তার কাছে পৌঁছাচ্ছে না? কোথায় খাদ আছে প্রার্থনার? সে তো মন থেকে প্রবল ভাবে চাচ্ছে।
সেঁজুতির মনে হয় এই মুহূর্তে সে পৃথিবীর সব অসাধ্য সাধন করে ফেলতে পারবে জীতুকে পেতে। কিন্তু তা আর সম্ভব না। জীতুকে একবার কল করতে নিয়ে হাত কাঁপে সেঁজুতির। নম্বরটা সে অনেক আগেই ব্লক লিস্টে ফেলে রেখেছে। ফেসবুক, ইমেইল, ইনস্টাগ্রাম সবখান থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে নিজেকে। জীতুকে বিয়েতে দাওয়াত দেয়ার সাহস তার হয়ে উঠেনি। কাল সেঁজুতি অন্য কারোর হবে জীতু জানবেই না। অবশ্য জেনেই কি করবে! হাসি পায় সেঁজুতির। বুক ফাটিয়ে হাসতে থাকে সে। কুৎসিত হাসি। হাসতে হাসতে কেঁদে ফেলে।
দুই হাতে মুখ ঢেকে নিজেকে ধাতস্থ করে চোখ মুছে সামনে কারো পায়ের দিকে চোখ যায়। সচকিত সেঁজুতি সমারোহকে দেখে দ্রুত চোখের জল মুছে ফেলার চেষ্টা করে। হয়তো সমারোহ আগেই তাকে কাঁদতে দেখে নিয়েছে তবুও। সমারোহ চুপটি করে বসে বোনের পাশে। তার পেছন পেছন সান্দ্র ও এসে বসে।
সেঁজুতি তার দুই পাশে দুই ভাইকে দেখে। তারা চোয়াল শক্ত করে আছে। আজো কি বকবে নাকি সেঁজুতিকে? কাল তো সে চলে যাবে সবাইকে ছেড়ে। সেঁজুতির মন আরো খারাপ হয়। সান্দ্র সন্দিহান কন্ঠে বলে,
‘ ভাই! এই পেত্নিরে হিরণ পছন্দ করছে কেমনে আমি না বুইঝ্যা পাইনা? ‘
সমারোহ শূন্যে তাকিয়ে বলে,
‘ আমার মনে হয় ওর হ্যান্ডসাম দুইটা ভাই আছে, পছন্দ না করলে কেলানি দিতে পারে সেই ভয়ে! ‘
সেঁজুতি অবাক হয়ে শুনে তাদের কথা। সান্দ্র সমারোহর দিকে ফিরে বলে,
‘ তবে আরেকটা কথা, রেডি থাকতে হইবো আমাদের। দেখ্যা গেল ওই বাড়িতে কেড়ামতি দেখাইতে যাইয়্যা সুস্বাদু খাবার রান্না করতে গিয়া খাবারের পাতিলে সেঁজুতি নামক বিষক্রিয়া সৃষ্টি কইরা ফেল্লে তো এই পেত্নীরে তার খাবার সুধ্যা ফিরত দিয়া যাইবো। ‘
‘ এইসব বিষক্রিয়া আমার পেটে হজম হবে না ভাই। তুই খাইস। ‘
সান্দ্র কিছু একটা বলতে যাবে ততক্ষণাৎ সেঁজুতির মুখের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে ছিটকে দূরে সরে যায়।
‘ও মা গো, পেত্নি দেখি রাক্ষসী রূপ ধারণ করছে! ‘
সেঁজুতি রাগে ফেটে পড়ে। কয়েকবার জোরে জোরে শ্বাস নেয়। নাকের পাটা ফুলে ওঠে। চোখ ছোট ছোট করে বলে,
‘ আমি এতো কুৎসিত না? আমি বিষক্রিয়া রান্না করি? তো আমার রান্না নিয়া মাইশা আপুরে খাওয়াইয়া বলতি কেন তুই রাঁধছোস? তোরা এতো দিন বিষক্রিয়া চেটেপুটে খাইতি কেন? ‘
সমারোহ তাচ্ছিল্য স্বরে বলে,
‘ হুর, জানতাম নাকি মহামান্য পেত্নী বিষক্রিয়া রান্না করছে? পাতিলের চেহারা দেখে বুঝার উপায় আছে! জানলে খাইতাম না। ‘
সেঁজুতি চোখ রাঙিয়ে বলে,
‘ ভাইয়া তুইও এই বদমাইশের দলে যোগ দিছোস?’
সমারোহ নাটকীয় ভঙ্গিমায় বলে,
‘ ওমা! আমি তো সত্যি কথা বললাম। এতো দিন ভয়ে বলতে পারিনাই। কি হয় কি হয়, গাঁ ছম ছম! ‘
ঠোঁট উল্টে ফেলে সমারোহ। সান্দ্র পাশের সোফায় ভীতু মুখ করে ভেংচি কেটে বলে,
‘ শোন শোন, ভালো করে শোন সত্য কথা বিষের মতোই লাগে। ‘
সেঁজুতি এবার রাগে ফুঁসতে থাকে। চোখ মুছে চিৎকার করে বলে,
‘ শয়তানের দল আর সব নিয়া যা খুশি বল, আমার রান্না নিয়া কিছু বলবি না বইল্লা দিলাম। আমি চেইত্যা যামু। ‘
সান্দ্র হুঁ হা করে হেঁসে উঠে বলে,
‘ এই বাড়ির পাতিল গুলাও মনে হয় কান্দে তোর চেহারা দেখলে এতো অত্যাচার নির্যাতন করছোস তুই। পাতিলের মান ইজ্জত নষ্ট কইরা ফেলাইছস। ‘
সেঁজুতি এবার ফুঁসতে ফুঁসতে বলে,
‘ যা বিয়ে দিয়ে দিছস না? আর আসমুই না আমি এই বাসায়। কোনো দিন না। জীবনেও না বইল্লা দিলাম। তোদের কপালে এমন বউ জুটবো দেখিস তোদের ঘর জামাই বানাইয়া রাখবো। সারাদিন রান্না করাইবো, ঘর মুছাইবো, বাসন মাজবি হুহ। ‘
সেঁজুতির কথা শুনে সমারোহ আর সান্দ্র হেঁসে ফেলে। সেঁজুতি রাগে গাল ফুলিয়ে একসময় সেও হেঁসে ফেলে। সমারোহ সেঁজুতিকে বুকের মাঝে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,
‘ আমার কলিজাটা। তোরে কুৎসিত বলার সাহস আছে নাকি কারো? ‘
সান্দ্র ভেংচি কাটে,
‘ দেখিস আবার তোর কলিজা নিয়া বিষক্রিয়া রাইন্ধা জামাইরে নিয়া খাওয়ায় দিব। ‘
সেঁজুতি আহ্লাদী সুরে সমারোহকে বলে,
‘ ভাইয়া দেখলা আবার! ‘
সমারোহ হাসে। সান্দ্র উঠে এসে টিটেবিলে সেঁজুতির কপালে চুমু খেয়ে বলে,
‘ আমার বোনের হাতে জাদু আছে। দুনিয়ার আর কেউ এমন অমৃত রান্না করতে পারে না আমার বোনের মতো। ‘
সেঁজুতি মুচকি হাসে। সমারোহ সেঁজুতির চোখের কার্ণিশে থাকা সামান্য জল মুছে দিয়ে বলে,
‘একা বসে কাঁদছিলি অথচ ভাই দুটোকে ডাকিসনি। একসাথে বসে কাঁদতাম বাড়ির সবাই। ‘
সেঁজুতি লজ্জা পেয়ে বলে,
‘ ধুর। ‘
সমারোহ সেঁজুতির দিকে ফিরে আলতো হাতে গাল চেপে ধরে বলে,
‘ এই ভাইয়েরা থাকতে রাজকুমারীর চোখের জল ঝরেছে এ তো মহা অন্যায়। এর শাস্তি হওয়া দরকার। শাস্তি হিসাবে রাজকুমারীর বিয়ের পর তার শ্বশুর বাড়ি গিয়ে একটু বিষক্রিয়া খেয়ে আসলে কেমন হয়! ‘
সেঁজুতি নাক ফুলিয়ে বলে, ‘ওফ ভাইয়াআ!’
সান্দ্র সেঁজুতির মাথায় হাত রাখে। সান্দ্রর চোখে জল চিকচিক করে উঠে। তা সেঁজুতির চোখ এড়ায় না। সেঁজুতি থমথমে গলায় বলে,
‘ ভাইয়া তুমি কাঁদছো?’
সান্দ্র দ্রতু চোখ সরিয়ে নেয় সেঁজুতির থেকে। উঠে যায় সেই জায়গা থেকে। সেঁজুতিও উঠতে নিলে সমারোহ সেঁজুতির হাত চেপে ধরে। গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
‘ তুই নিজেও জানিসনা জুঁতি, তুই আমাদের জন্য কতোটা স্পেশাল। সান্দ্র আর আমি তো পিঠাপিঠি তাই সব কিছুই আমাদের একজনের আগে অন্য জনের চাই। নয়না যেদিন হয়েছিল সান্দ্র আর আমি মারামারি লেগে গেছিলাম কে আগে কোলে নিব! আর তুই যেদিন পৃথিবীতে এসেছিলি, সন্ধ্যায় ঘরে কারেন্ট ছিল না। অন্ধকারে ডুবে ছিল সব। পৃথিবীতে এসেই স্বাগত হওয়ার বদলে আঁধার দেখে ভয়ে কেঁদে উঠেছিলি। আমি আর সান্দ্র দৌড়ে গিয়ে কোলে নিয়ে আমার ছোট্ট বোনটাকে বুকের সাথে চেপে ধরেছিলাম। সান্দ্র কেঁদে ফেলেছিল তোর কান্না দেখে। এই, এই ছোট্ট মুখটার চিৎকার আমাদের সহ্য হয়নি। তোকে কোলে নিয়ে ভালোবেসে বলেছিলাম সেঁজুতি। আমাদের ঘরের সন্ধ্যা প্রদীপ। ব্যস তুই কান্না থামিয়ে ফেল ফেল চোখে দেখলি। আমাদের বুক শীতল হলো। আমার, আমার এই বুকে প্রথম মাথা রেখে তুই ঘুমিয়ে ছিলি জানিস! আর কাল, কা-কাল এই বুক ছেড়ে…। ‘
আর বলতে পারলো না সমারোহ। চোখ ছাপিয়ে অশ্রুধারা নেমে আসতে চাইছে তার। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে নিজেকে কন্ট্রল করার চেষ্টা করে সে। উঠে গিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে অগোচরে মুছে নেয় চোখের জল টুকু। বুক ফেটে যাচ্ছে। আদরের বোনটা যে দূরে চলে যাচ্ছে। ফাঁকা হয়ে যাবে বাড়িটা। শূন্য মনে হবে পৃথিবীটা। সমারোহর মাথা ঝিমঝিম করে।
সেঁজুতি হুরহুর করে কাঁদতে থাকে। সত্যিই তার জীবনে ভালোবাসার অভাব নেই। জীতু এসবের কাছে তুচ্ছ। তার ভাই বোনেরা তাকে সর্বোচ্চটা দিয়েছে সবসময়। মনের সবচেয়ে সুরক্ষিত স্থানে আগলে রেখেছে তাকে। একটু আগের ভাবনাগুলোর জন্য নিজের উপরই রাগ হয় সেঁজুতির। এই মুহূর্তে তার জীতুকে নয়, নিজের পরিবারকে নিয়ে ভাবা উচিত। সেঁজুতি উঠে এসে সমারোহ কে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে, পিঠে মাথা রাখে। সমারোহ সেঁজুতির হাতটা শক্ত করে ধরে রাখে বুকের সাথে। সেঁজুতি আহ্লাদী সুরে বলে,
‘ আমাকে বিয়ে না দিলে হয় না? আমি আব্বা, আম্মা তোমাদের ছেড়ে যাব না। ‘
সমারোহ হাসে। পেছনে সেঁজুতির মাথায় চাটি মেরে বলে,
‘ ধুর পাগলি। তুই যাচ্ছিস তো কি! তোর সব কিছু আগের মতোই থাকবে। যখন খুশি চলে আসবি ভাইদের কাছে, কোনো বারণ আছে নাকি? ‘
সান্দ্র পেছন থেকে বলে,
‘ আর তোর জামাই না করলে খালি একবার কইবি। তারে সহ তুইল্যা নিয়া আসব। ‘
সেঁজুতি কাঁদে। রুদ্ধনিঃশ্বাস কাঁদা শুরু করে। সমারোহ দ্রতু পেছন ফিরে। সান্দ্র এসে সেঁজুতির মাথায় হাত রেখে বলে,
‘ কাঁদবি না একদম। এতো সুন্দরী পরীর চোখে জল মানায় নাকি? ‘
সেঁজুতির কান্নার বেগ আরো বাড়ে। দুই ভাইকে একসাথে জড়িয়ে ধরে বলে,
‘ আমি কালকে যাবই না। বিয়ে করে ঘর জামাই রাখবো। ‘
–
চিরকুটগুলো সমারোহর নয় যেনে মুখ গুমোট করে বসে আছে চন্দ্রিমা। একটু আগেই সেজেগুজে এসেছে সেঁজুতির বিয়েতে। একটু পরেই সেঁজুতি আর কুহেলীকে নিয়ে পার্লারে যাবে। নয়না অসুস্থ থাকায় সেঁজুতির পাশে ওদেরই থাকতে হচ্ছে। মাইশা ডিরেক্ট পার্লারে চলে যাবে তার বাসা থেকে। সেখানে দেখা হবে। পার্লারে গিয়ে বউ সাজানো প্রায় শেষের দিকে খেয়াল করে খোঁপায় গুঁজার জন্য তাজা ফুল কিনে আনা হয়নি। এখানে কোথায় ফুল পাওয়া যাবে তা কুহেলীর অজানা। তাই সান্দ্রকে কল করাতে সে বলে সমারোহ যাচ্ছে সেঁজুতিকে আনতে তাঁকে বলতে। কুহেলী দু-তিন বার ভাবে কি করবে। চন্দ্রিমা বেশ খুশি হয়ে যায়। সুযোগে কুহেলীর হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নিয়ে সমারোহকে মেসেজ করে দেয়,
‘ ভাইয়া আপুর খোঁপার জন্য ফুল কিনা হয়নি। শুনলাম আপনি আসছেন। কাছাকাছি থাকলে আমাকে যদি নিয়ে যেতেন তাহলে কিনে ফেলতে পারতাম। আমি রাস্তাঘাট তেমন চিনি না। ‘
কুহেলীর মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। চোখ রাঙিয়ে তাকায় চন্দ্রিমার দিকে। মেসেজ সেন্ড হয়ে গিয়েছে। কি বিশ্রী একটা অবস্থা হলো! কুহেলীর ইচ্ছা করছে চন্দ্রিমা রাস্তাঘাটের পাবলিক টয়লেটে আটকে রাখতে কিছুক্ষণ। বাজে গন্ধ খেলে সব শয়তানি বুদ্ধি উড়ে যাবে মাথা থেকে।
মেসেজ দেয়ার দশ মিনিটের মাথায় সমারোহ পৌঁছে যায় সেখানে। সমারোহ ততক্ষণে ঘেমে নেয়ে একাকার। মাথা বেয়ে টুপটপ করে ঘাম ঝড়ছে। ফর্সা চেহারাটা যেন ব্যস্ততার ফাঁকে আরো বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। সাদা পাঞ্জাবি বুকের সাথে লেপ্টে আছে। কুহেলী চোখ সরিয়ে নেয়। কখন জানি এই ঠোঁটকাটা নির্লজ্জ লোকটা আবার কি বলে বসে তাকে! সেঁজুতির সাঁজ দেখে হা করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সমারোহ ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বলে,
‘ হয়েছেই তো! একদম পরীর মতো লাগছে। আর কিছু লাগবে না। ‘
সেঁজুতি হাসে। চন্দ্রিমা চোখ মুখ উলটে ফেলে বলে,
‘ কি বলেন ভাইয়া? টাটকা ফুল ছাড়া ভালো লাগে নাকি? পুরো সাজটাই ইনকমপ্লিট থেকে যাবে। ‘
সমারোহ বোকা বনে যায়। হা হয়ে বলে,
‘ মাথায় তো উরনা দেয়া খোঁপায় ফুল আছে নাকি নেই কে দেখবে! ‘
চন্দ্রিমা ভেংচি কেটে বলে,
‘ মেয়েদের অতো সব সাজ আপনি বুঝেন নাকি? ওফ আপু তুমি বলো না! ‘
চন্দ্রিমা আড়চোখে কুহেলীর দিকে ইশারা করে সেঁজুতিকে। সেঁজুতি বাঁকা হেসে বলে,
‘ আমার ফুল লাগবেই। ভাইয়া তুমি কুহেলীকে নিয়ে যাও তো! ‘
সমারোহ এক পলক দেখে কুহেলীকে। তারপর বলে, ‘ ওকে। ‘
চলে যাওয়ার সময় হঠাৎ খেয়াল হয় সেঁজুতির মোবাইলটা তাকে দেয়া হয়নি। হন্তদন্ত হয়ে প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল বের করতে গেলে একটা নূপুরও তার সাথে বের হয়ে নিচে পড়ে যায়। সেঁজুতি আর চন্দ্রিমার চোখ এবার গোলগাপ্পার মতো বড় বড় হয়ে যায়। কুহেলী হা হয়ে চেয়ে থাকে। তার চোখে একগাদা আগ্রহ। আলোর জন্য নাকি নূপুর!
সমারোহকে ফোরণ কেটে সেঁজুতি বলে,
‘ ভাইয়া! তুই পকেটে করে নূপুর নিয়ে ঘুরিস! তো কে সেই ভাগ্যবতী হে?’
সমারোহ অস্বস্তিকর এক পরিবেশের মাঝে পড়ে গেল। সবার উৎসাহে ফেটে পড়া চোখ তখন তার উপর। সমারোহ নূপুরটা তুলে নিয়ে আমতা আমতা করে বলে,
‘ আসলে- ‘
সেঁজুতি সমারোহর মুখের কথা কেড়ে নিয়েই বলে,
‘ হ্যাঁ আসলে? কি? ‘
কুহেলী ভ্রুঁ সামান্য উঁচিয়ে চেয়ে থাকে। তার চোখে কিছুটা অভিমান। সমারোহ একবার ভড়কে গিয়ে ফরফরিয়ে বলে,
‘ তোর এতো জানতে হবে কেনো? ফোন ধর, আমি গেলাম। দ্রুত এসো কুহেলী। ‘
–
বেলা দুইটার ঝলমলে কড়া রোদে ফালি ফালি মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে আকাশ জুড়ে। বাতাস নেই তবুও মেঘ দ্রুত উড়ে চলেছে। গাঢ় নীল বর্ণের মাঝে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম সাদা হাওয়াই মিঠাই যেন! আকাশের দিকে ভ্রুঁ কুঁচকে তাকিয়ে দেখে কুহেলী। গরম বেশ! পার্লারে কাছাকাছি মার্কেটে গিয়ে সমারোহ আর কুহেলী। ঘুরে ঘুরে একটাও ভালো ফুলের দোকান পাওয়া যাচ্ছে না। যাও পাওয়া যাচ্ছে ফুলগুলো সব কেমন নেতিয়ে পড়েছে। গরমে আর মানুষের ভিড়ে যাচ্ছেতাই একটা অবস্থা। কড়া রোদে কুহেলীর মুখ লাল বর্ণ ধারণ করেছে। সমারোহ চলার ফাঁকে ফাঁকে বেশ কয়েকবার আড় চোখে দেখছে কুহেলীকে। অনেক ঘুরা ঘুরির পর মার্কেটের একদম শেষ প্রান্তে ফুলের দোকান পাওয়া যায়। টাটকা ফুল দিয়ে খোঁপার গাজরার সাথে তিনটা মালাও বানাতে বলে। দোকানে সামনে কোন ছাউনী নেই। মাথা ফাটা রোদেই দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। তপ্তশ্বাস ফেলে সমারোহ কুহেলীকে বলে,
‘ আমি গাড়ি নিয়ে আসি তুমি গাড়িতে গিয়ে বসো। ‘
‘ না না, আমিও দাঁড়াই! ‘
‘ মুখ লাল হয়ে গিয়েছে তোমার। ‘
‘ সমস্যা নেই। ‘
সমারোহ বিড়বিড় করে বলে, ‘ এজন্যই বেশি সুন্দর হতে নেই। ‘
কুহেলী হা হয়ে তাকিয়ে বলে,
‘ কিছু বললেন?’
‘ ঘেমে গেছো খুব। বাড়ি যাবে? ফ্রেশ হয়ে নিলে নাহয়! ‘
‘ আচ্ছা। ‘
‘ তাহলে মালা দিয়ে আসার পর আমার কিছু কাজ আছে। তারপর একসাথে যাব বাসায়। ‘
কুহেলী কিছু বলেনা। সমারোহ কুহেলীকে রেখে গিয়ে কোত্থেকে যেন একটা শক্ত কাগজের কার্ড নিয়ে এসে কুহেলীর মাথার উপর ধরে। কুহেলী হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে থাকে। সমারোহর দিকে তাকাতে সে হালকা হাসে। ভালো লাগে কুহেলীর। নিজের অবস্থা কাহিল, কখন যেন অজ্ঞান হয়েই পড়ে যায় অথচ কুহেলীর গাঁয়ে লাগা সামান্য রোদ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে সে!
সাজিয়ে রাখা ফুলগুলো অনেক ঘাঁটাঘাঁটি করে একটা বেলী ফুলের মালা নিয়ে কুহেলীর হাতে পেঁচিয়ে দেয় সমারোহ। খুব যত্ন সহকারে। কুহেলী অবাক হয়ে চেয়ে দেখে কেবল। মালা বানানো শেষ হলে সেখানের একটা রেস্টুরেন্টে বসেই হালকা নাস্তা করে নেয় দুজন। সকালের পর আর কারোরই খাওয়া হয়নি। সেঁজুতি আর চন্দ্রিমার জন্যও খাবার প্যাক করে নেয়।
কুহেলীর খুব মায়া হয় সমারোহর জন্য। লোকটা খাটতে খাটতে পাগল হয়ে যাচ্ছে। ফুল পৌঁছে দিয়ে কুহেলীকে নিয়ে আবার ছুটে মিষ্টি কিনতে। বিয়ের জন্য যা মিষ্টি কিনা হয়েছে তা কম পড়ে গেছে। পঞ্চাশ প্যাকেট মিষ্টি কিনে মিষ্টি সহই যায় হসপিটালে। ছুটি নিয়েছিল দুদিনের জন্য। কিন্তু কি একটা ঝামেলায় আবার যেতে হয়েছে। কুহেলীকে গাড়িতে বসিয়ে হসপিটালের ভিতর যে যায়, ফিরে দেড় ঘণ্টা পর! এসেই ব্যস্ত হয়ে গাড়িতে বসে স্টার্ট দিতে দিতে বলে,
‘ সবগুলো অকর্মা বুঝলে! সরি, অনেকক্ষণ ওয়েট করালাম। ‘
‘ ব্যাপার না। এখানে আসলেন কেনো? ‘
‘ যার সাথে ডিউটি এক্সচেঞ্জ করেছিলাম সে ভুলে গেছে। ফোনও বন্ধ করে রেখেছে। আমাকে ডাকলো আবার। ঝামেলা হয়েছে অনেক। ‘
‘ ওহ! ‘
কমিউনিটি সেন্টারে মিষ্টি পৌঁছে দিতে দিতে তখন সাড়ে পাঁচটা বেজে গিয়েছে। সেখানে আরো কতোক্ষণ দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। সাতটায় বর পক্ষ চলে আসে। সমারোহ তখনো দৌড়াদৌড়িতে ব্যস্ত। কুহেলী চরম অবাক। বাড়ি না যাওয়ার কথা ছিল তাদের! বাড়ির সবাই সেজেগুজে চলে এসেছে এখানে। আর একমাত্র ফকিন্নি সেজে বসে আছে সে! সমারোহ কুহেলীকে সেখানে রেখেই গিয়ে সেঁজুতিকে পৌঁছে দেয় সেন্টারে। তারপর কুহেলীকে নিয়ে বাড়ি যায়। বিশাল বড় রমরমা বাড়িটা এখন ফাঁকা পড়ে আছে। বাইরের মরিচ বাতি ভেতরের অন্ধকার ঘরগুলোও আলোকিত করে রেখেছে। রহস্যময় সুন্দর এই আলো!
সমারোহ এসেই দ্রুত কুহেলীকে তৈরি হতে বলে নিজের ঘরে চলে যায়। কুহেলী নিজের রুমে এসে তাড়াহুড়ো করে কোনো রকম গোসল শেষ করে। এমন স্তব্ধা মারা পরিবেশে ভয় লাগে তার। কি সাজবে না সাজবে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। চুল থেকে টুপটাপ পানি ঝরে পেছনের জামাও ভিজে যাচ্ছে। যাচ্ছেতা একটা অবস্থা। সমারোহ বোধহয় এতক্ষণে তৈরিও হয়ে নিয়েছে। যা ঝটপট কাজ করে মানুষটা! সেঁজুতি বলেছিল বিয়েতে যেন তার সাথেই থাকে। আনরুবা, নয়না বারকয়েক ফোন ও করে ফেলেছে তাদের খোঁজে। কুহেলীর মাথা জ্যাম হয়ে যায়। তাড়াহুড়ো করে ঘর থেকে বের হতে নিলেই দরজার বাহিরে সমারোহর বুকে ঠাস করে বারি খায় কুহেলী। মাথায় হাত দিয়ে ঘষতে ঘষতে চমকে তাকালে সমারোহও অবাক চোখে তাকায়। কুহেলী দ্রুত সরে আসে। ইতস্ততবোধ করে কিছুটা। সমারোহ কুহেলীর দিকে একটা ব্যাগ এগিয়ে দিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলে,
‘ এই ড্রেসটা পড়ে বিয়েতে যাবে। পড়ে নাও। আর, চুল খোলা রাখবে না হিজাব পড়ে নিবা। ‘
চলে যেতে নিয়ে ফিরে দাঁড়িয়ে কথাটুকু বলে সমারোহ। কুহেলী চমকে তাকায় সমারোহর দিকে। সমারোহর চোখজোড়া শীতল। আর কিছু না বলে চুপচাপ সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যায় সমারোহ। কুহেলী অবাক হয়ে সমারোহর নেমে যাওয়া দেখতে দেখতে ঘরের ভেতর ঢুকে যায়। ব্যাগে একটা কালো লেহেঙ্গা। উপরের অংশ পুরোটা স্টোনের কাজ করা আর নিচের স্কার্টটা পুরো নেটের। সমারোহর পছন্দ সত্যিই খুব সুন্দর। কিন্তু সমারোহ তার জন্য এটা কেনো কিনলো? আর কখনই বা আনলো! কুহেলী মুচকি হাসে। দ্রুত লেহেঙ্গা পড়ে নিয়ে ভিজা চুল বেঁধেই হিজাব পড়ে নেয়। তাড়াহুড়ো করে নিচে নেমে এসে দেখে সমারোহ সোফার উপর চোখ বুজে শরীর লম্বা করে শুয়ে আছে। একহাত কপালের উপর তোলা। মানুষটার উপর যত খাটুনি গেছে তাতে ক্লান্ত হওয়ারই কথা। কুহেলীর সমারোহকে ডাকতে ইচ্ছা করে না তাও মৃদু স্বরে বলে,
‘ আমি তৈরি। ‘
হন্তদন্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায় সমারোহ। ‘চল’ বলেই মাপা মাপা পায়ে হেঁটে বাহিরে চলে যায়। কুহেলীর এবার মেজাজ বেশ খানিক গরম হয়। লেহেঙ্গাটা পড়ে তাকে কেমন লাগছে বললো না এমনিই ফিরেও তাকালো না একবার। অদ্ভুত! বিয়ে বাড়িতে যাওয়ার পর তো সমারোহ পুরোই লাপাত্তা। সান্দ্র ভাইয়াকে তাও মাঝে মধ্যে দেখা যায় মাইশার সাথে আর সমারোহ তো বাতাসের বেগে উড়ে উড়ে কাজ করছে। ফ্যামিলি ফোটো তোলার সময়ও তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। মেহমান আপ্যায়নে ব্যস্ত সে।
অবশেষে বিয়ে সম্পন্ন হলো সেঁজুতি আর হিরণের। বউ নিয়ে যাওয়ার সময় কমিউনিটি সেন্টারের পরিবেশ থমথমে হয়ে যায়। সেঁজুতি আনরুবাকে জরিয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। আনরুবা মেয়েকে ঝাপটে ধরেন নিজের বুকের সাথে। সেঁজুতির জন্মের পর থেকে আজ পর্যন্ত কখনোই সেঁজুতিকে একা ছাড়েননি তিনি। এক রাতের জন্যও না। সেঁজুতি মা ছাড়া থাকতে পারে না। আনরুবা সেঁজুতির চোখের জল মুছে দিয়ে বলেন,
‘ মনে রেখো, এক মাকে ছেড়ে আরেক মা’য়ের কাছে যাচ্ছো। তার মনে যেন তোমার দ্বারা কখনো আঘাত না লাগে। তুমি আমাদের ঠিক যেমন ভালোবাসতে খেয়াল রাখতে তেমনটাই হবে তাদের প্রতিও। সম্মান করবে সবসময়, তাদের কথার অবাধ্য হবে না। আর সবাই যেমনই হোক নিজের জায়গা থেকে সৎ, সাহসী থাকবে। ‘
সেঁজুতিও মাথা ঝুঁকিয়ে সায় দেয়। আনরুবা মেয়ের কপালে চুমু খান। জহির কিছু বলতে পারেন না সেঁজুতিকে। কেবলই বুকের সাথে ল্যাপ্টে জরিয়ে ধরে থাকেন। তার চোখে টলটল করা পানি আটকাতেন ব্যস্ত তিনি। জহির হিরণের বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
‘ বেয়াই, আমি আমার বুকের পাঁচ রত্ন থেকে একটা খুলে আপনাকে দিলাম। এইগুলো সাধারণ রত্ন নয়! আমার প্রাণ ভোমরা। এবার তাকে রক্ষা করার দায়িত্ব আপনাদের। ‘
হিরণের বাবা সেঁজুতির মাথায় হাত রাখেন। মুখে তার মাখনের মতো মোলায়েম হাসি। তিনি তার জোরালো সুরেলা কন্ঠে বলেন,
‘ আপনার রত্ন এবার আমার মেয়ে হলো। আমার মেয়ে নাই ভাই। আজকে মেয়ে পাওয়ার ইচ্ছা পূরণ হলো। হিরণ, হাসিন যেমন সেঁজুতিও তেমন আমার কাছে। আর আপনার মেয়ে তো আপনার আছেই। যখন খুশি দেখতে চলে আসবেন। আমরা দুই বেয়াইতে মিলে আড্ডা দেব। ‘
হো হো করে হেঁসে উঠেন তিনি , সঙ্গ দেন জহির। সেঁজুতি নয়নার কাছে গিয়ে দেখে নয়না মুখ লুকিয়ে কাঁদছে। সেঁজুতি জরিয়ে ধরতে চাইলে সে কিছুটা দূরে সরে যায়। ছোট থেকে নয়নাই একমাত্র খেলার সাথী ছিল সেঁজুতির। হাঁসি কান্না সবটা শেয়ার করার নিরাপদ জায়গা। সেঁজুতি চলে গেলে নয়না একা হয়ে পড়বে। সেঁজুতি হঠাৎই ঝাঁপিয়ে পড়ে নয়নার উপর। হাউ মাউ করে কাঁদে দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে। সেঁজুতি নয়নার বুক থেকে মাথা তুলে বলে,
‘ পুচকুটার কিছু হলে তোর খবর আছে বলে দিলাম। এভাবে নিজেকে কষ্ট দিবি না আপু। আমিও কষ্ট পাই। ঠিক মতো খেয়াল রাখবি নিজের আর আমার সোনামনিটার। ‘
নয়না কাঁদতে কাঁদতে মুচকি হাসে। সেঁজুতির কানের কাছে গিয়ে বলে,
‘ তাড়াতাড়ি বাচ্চা ফুটাবি। আমার ছেলের সাথে তোর মেয়ের বিয়ে দেব। ‘
সেঁজুতির চোখ বড় বড় হয়ে যায়। দূরে গিয়ে সেঁজুতির হাতে চিমটি দিয়ে বলে,
‘ তুই শয়তান-ই থাকলি সারা জীবন। ‘
নয়না হেসে কুটি কুটি হয়ে আবার বলে,
‘ ওই তুই আর আমি না প্ল্যান করছিলাম ছোট বেলা, একজনের ফুলশয্যায় আরেকজন থাকবো। অচেনা একটা ছেলের সাথে এমন হুট করেই থাকতে ভয় পাবি। আমারে নিয়ে চল। ‘
বলেই চোখ টিপে নয়না। সেঁজুতি রাগে ফেটে পড়ে ফোঁসতে ফোঁসতে বলে,
‘ অসভ্য মেয়ে মানুষ! ‘
নয়নার হাসির মাঝেই আবার কান্না চলে আসে। সেঁজুতি কুহেলীকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে। সবার কান্না দেখে কুহেলীও কেঁদে ফেলেছে। সেঁজুতি কুহেলীর চোখের জল মুছে দিয়ে বলে,
‘ তোমার মিষ্টি পাগলামি গুলোকে মিস করবো খুব। ‘
কুহেলী হেসে বলে, ‘ আমারও তোমার কথা মনে পড়বে অনেক।’
সেঁজুতি কুহেলীর গালে হাত ছুঁইয়ে চুমু খেয়ে বলে, ‘ আমি তোমার কথা মনে রাখবো। হিরণকে নতুন করে ভালোবাসবো। তবে, তুমিও ভাইয়াকে দ্রুত পটিয়ে ফেলো বুঝলা! ‘
শেষের কথাটুকু ফিসফিসিয়ে বলে সেঁজুতি। কুহেলী লজ্জায় নুইয়ে পড়ে। আড়চোখে একবার তাকায় সমারোহর দিকে। সমারোহ দূরে দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। সেঁজুতি ধীর পায়ে হেঁটে গিয়ে দাঁড়ায় সমারোহর কাছে। সমারোহ অপল চেয়ে থাকে সেঁজুতির দিকে। তারপর কিছু বলতে নিয়ে ঠোঁট চেপে উপরের দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখ উপচে জল পড়তে চাইছে। কিন্তু তাকে তো শক্ত থাকতে হবে। ছেলে মানুষের চোখে জল বেমানান। সেঁজুতি চুপচাপ দাঁড়িয়ে কাঁদতে থাকে। সান্দ্র এসে জড়িয়ে ধরে সেঁজুতিকে। সেঁজুতি এবার কাঁপতে থাকে। বলে,
‘ ভাইয়া আমি মেতে চাই না। ‘
সান্দ্র কাঁদতে কাঁদতেই বলে, ‘ আর আমরা তোকে রাখতে চাই না। ‘
সেঁজুতি সান্দ্রকে ছেড়ে তেড়ে তাকায়। দুচারটে কিল ঘুষি মেরে দিলে সান্দ্র আবার জড়িয়ে ধরে তাকে। তারপর সমারোহকে জড়িয়ে ধরে বলে,
‘ ভাইয়া তোমাকে খুব মিস করবো। ‘
সমারোহর বুকটা শূন্যতায় খাঁ খাঁ করে। তার আদরের বোনটা সত্যিই চলে যাচ্ছে। তাদের বাড়িটা ফাঁকা হয়ে যাবে। হারিয়ে যাবে খুনসুটি গুলো। যদিও এটা বিচ্ছেদ নয়, নতুন সম্পর্কের সূচনার ত্যাগ তবুও তা তিক্ত। বেদনাদায়ক! সমারোহ সেঁজুতিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। কাঁদতে কাঁদতে সেঁজুতি একটু শান্ত হলে সমারোহ তার কপালে চুমু খেয়ে বলে,
‘ আমার পেত্নির মতো বোন। ‘
সেঁজুতি রাগতে গিয়ে হেসে ফেলে। বলে,
‘ তোমরা সবাই মিলে আজকেও আমাকে চেতাচ্ছো! আমি বউভাতের পর আবার যাব না বাসায়! দেইখ্যো খবর আছে তোমাদের। ‘
হিরণ ততক্ষণে সান্দ্রর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সান্দ্র হিরণের পেটে আলতো করে ঘুষি মেরে বলে,
‘ আমার বোনের সবকথা শুনবা বুঝলা! নাহলে সেতি রেগে গেলে কিন্তু বিষক্রিয়া খাওয়াইয়া দিবে। ‘
হিরণ হো হো করে হেঁসে উঠে। সান্দ্রর কানের কাছে বলে, ‘ তোমার বোনের , উপস সরি বউয়ের বিষক্রিয়া খাওয়ার জন্য এতো বছর না খেয়ে পেট ক্লিয়ার রাখছি। ‘
সান্দ্র হেসে উঠে। সেঁজুতি গাড়িতে উঠতে নিয়েও দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে আনরুবাকে। আনরুবাও বুকের শীতল আবেশে আবদ্ধ করেন মেয়েকে। তার বুকের মাঝে এখন ঘূর্ণিঝড় বয়ে যাচ্ছে। এই ঝড়ে লন্ডভন্ড করে দিচ্ছে তার সকল অনুভূতি। সেঁজুতি এমনভাবে জড়িয়ে ধরে আছে যেন তার শেষ অবলম্বনটুকু আঁকড়ে আছে। মেয়েটা বারবার বলছে সে যেতে চায় না। আনরুবা চোখ মুখ বুঁজে একটু শক্ত হওয়ার চেষ্টা করেন। মেয়ের নিজের থেকে ছাড়িয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলেন,
‘ সেঁজুতি উনারা অপেক্ষা করছেন সবাই তোমার জন্য। যাও গাড়িতে ওঠো। ‘
অনেক বিষন্নতার মুখড় পরিবেশে বিদায় হয় সেঁজুতির। সবার বুকে শূন্যতা ছুঁড়ে দিয়ে এক সমুদ্র স্বপ্ন নিয়ে শ্বশুরবাড়ি পাড়ি জমায় সেঁজুতি।
চলবে.
(রিচেক করতে পারিনি। ভুল ক্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)
আকাশ মোড়ানো চিরকুট
লেখনী – সাইমা ইসলাম প্রীতি
২৯.
স্কুলে একা যেতে ভয় লাগে কুঞ্জার! রোজ ভোরে তার যাওয়ার রাস্তায় বিশ্রী মনমানসিকতা সম্পন্ন কিছু লোক দাঁড়িয়ে থাকে। উদ্ভট সব কথাবর্তা বলে। মাঝে-মাঝে আবার ভয়ও দেখায়। প্রিতুসের বন্ধু এরা। প্রায়ই কুহেলীর কথা জিজ্ঞেস করে। আগে কোন রকম পাশ কাটিয়ে চলে আসলেও ইদানিং কুঞ্জার পথ আটকে মজা নেয়। কুঞ্জার সদ্য বেড়ে ওঠা কিশোরী মনকে খুব আঘাত করে বিষয়টা। হাসনাহেনাকে বলতে খুব ভয় করে। সেদিন পলাশকে মারার পর থেকে মায়ের সাথে কথা বলতেই ভয় করে। দাদিমাকে একবার বলেছিল ইনিয়ে বিনিয়ে। খুব একটা গুরুত্ব দেননি রমলা। শুধু বলেছেন ‘ওইসব পোলাগো রে এড়াইয়া যাবি। যা বলুক কথা কবি না’। কুঞ্জাও তাই করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু গত দিনের বিষয়টা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেনা কুঞ্জা।
বিকেলবেলা পাশের গ্রামের মামার বাড়ি গিয়েছিল সে। হাসনাহেনা পিঠা বানিয়ে পাঠিয়েছেন। অন্যান্য সময় রজবই দিয়ে আসে তবে তখন রজব খোর্শেদের সাথে বাজারে ছিল। তাই কুঞ্জাই যেতে রাজি হয়ে যায়। মামির বড় আদরের সে। এই সুযোগে একটু ঘুরে আসতে পারবে। মামির বাড়ি যায় বেলা থাকতেই কিন্তু মামির জোরাজুরিতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। নদী পাড় হয়ে আসার পরের জায়গাটা সবসময় নিরিবিলিই থাকে, তখনো ছিল। সেই সুযোগটাই নিয়েছে প্রিতুসের খারাপ বন্ধুগুলো। তিনজন ছিল তারা। কুঞ্জাকে ঘিরে কয়েকটা কালো নিজেদের বিশ্রি কুৎসিত তৃপ্তি মিটিয়ে নিল। তাদের পাষান হৃদয় কুঞ্জার কোমল চোখগুলো দেখেনি। ভাবতেই ডুকরে কেঁদে ওঠে কুঞ্জা। সেদিন সেই পথ ধরে আরো কয়েকজন মানুষ যাচ্ছিল। তাদের ভয়ে ওই কুৎসিত মানুষগুলো কুঞ্জাকে ছেড়ে পালিয়েছিল। নয়তো এখন হয়তো কুঞ্জার আত্নহত্যা করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকতো না!
–
দোতলা থেকে জীতুকে দেখে হতবাক হয়ে যায় সেঁজুতি। জীতুর হাতে অনেকগুলো মিষ্টির প্যাকেট। মানুষটা আবার কেনো এসছে! এখন কি চাই তার? সেঁজুতিকে কনগ্রেস করতে এসেছে নাকি নিজের বিয়ের দাওয়াত দিতে? নিচে নেমে যাওয়ার সাহস হয় না সেঁজুতির। মানুষটার জন্য তার মাঝে এক সাগর অভিমান অথবা ঘৃণা জমে আছে। এই অভিমানের শেষ নেই। এটা নিয়ে ভাবতেও নেই। সেঁজুতি সন্তর্পণে চোখের জল লুকিয়ে রাখে। জীতুকে দেখে আনরুবা বসতে বলেন। টুকটাক কথা হচ্ছে তাদের মাঝে, উপরে দাঁড়িয়ে ঠিক স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছেনা সেঁজুতি। আনরুবার সাথে কথা বলার সময় জীতু হাসছে, খুব প্রফুল্ল দেখাচ্ছে তাকে। আনরুবা তার মা বাবার কথা, পড়াশোনার খবর নেন। জীতু খুব প্রফুল্ল হয়ে বলে,
‘ বাবা মায়ের শরীর কিছুদিন আগে খারাপ ছিল অনেক। এখন অনেক ভালো আছেন। আপনারা সবাই ভালো আছেন তো? ‘
‘ হ্যা এই আছি আরকি। তো এতো মিষ্টি কিসের? ‘
জীতু লাজুক হাসে। বলে,
‘ আপনাদের দোয়ায় বি.সি.এস. পুলিশ ক্যাডারে টিকেছি আমি। ‘
‘ মাশা’আল্লাহ মাশাআল্লাহ, এতো কষ্ট করে পড়ালেখা তাহলে এবার ফল পাইলা। ভালো খবর শুনাইলা। তোমার বাবা মাকে আমার সালাম দিও। সমারোহ ও টিকছে। ‘
জীতু হেসে বলে, ‘ ভাইয়া আছেন বাসায়? ‘
‘ ওর আবার বাসায় থাকা! আমরা বাসার মানুষই তার দেখা পাইনা ঠিক মতো। একটু আগে ফোন দিয়ে জানাইলো। ‘
‘ আচ্ছা! ‘
জীতু অস্থির হয়ে এদিক ওদিক দেখে। কুহেলী ফলমূল মিষ্টি এনে দেয় তাকে। জীতুর চাকরির কথা শুনে খুশি হলেও মনটা খারাপ হয়ে গেছে তার। সেঁজুতি আপু একটু বেশিই তাড়াহুড়ো করে ফেলেছে। কুহেলীকে দেখে জীতু মুচকি হেসে বলে,
‘ ভালো আছো? ‘
‘ জি ভাইয়া, কংগ্রাচুলেশন। ‘
‘ থ্যাঙ্কস। ‘
আনরুবা হেসে কুহেলীর হাত ধরে তার পাশে বসিয়ে দিয়ে জীতুকে নরম কন্ঠস্বরে বলেন,
‘ তা বাবা বিয়েতে আসোনি কেন? দেখলাম না তোমাকে। ‘
জীতু খানিক অবাক হয়। বিয়ে! কার বিয়ে? হঠাৎ সেদিনের সেঁজুতির রাগ মিশ্রিত ভেজা চোখগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে জীতুর। বুকটাতে কেমন অস্বস্তি দেখা দেয়। জীতু জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বলে,
‘ বিয়ে মানে! ‘
আনরুবা অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যান। বিয়ের দাওয়াত সমারোহ নিজে গিয়ে দিয়েছে সবাইকে, নয়নাকেও বারবার বলা হয়েছে জীতুকে ফোন দেয়া হয়েছে কিনা । জীতু তাদের বাড়ি এসে পড়িয়ে গিয়েছে এতো দিন। সম্পর্ক গভীর। জীতুকে দাওয়াত দেয়া হয়নি? লজ্জায় পরে যাবেন তাহলে আনরুবা। আনরুবা কিছু বলার আগেই জীতু আবার বলে,
‘ আন্টি, সেঁজুতিকে একটু ডেকে দেওয়া যাবে? ওর সাথে কিছু কথা ছিল। ‘
কুহেলী একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে জীতুর দিকে। মানুষটার সব প্রফুল্লতা এক নিমিষেই প্রগাঢ় বিষাদে পরিনত হয়ে যাবে হয়তো এখন। মায়া হয় কুহেলীর। কেমন ভালোবাসা এটা! জীতু যদি আগেই সেঁজুতির অনুভূতিকে সম্মান দিত তাহলে কতোটা সুন্দর হতো। আনরুবা কুহেলীকে বলে সেঁজুতিকে ডাকতে। তারপর আনরুবা উঠে যান। কুহেলী কিছু একটা ভেবে জীতুকে বলে,
‘ ভাইয়া এখানে আন্টি, আপুরা আছেন আপনি বাগানে চলে যান আমি সেখানে পাঠিয়ে দিচ্ছি আপুকে। ‘
জীতু খুব খুশি হয় কথাটা শুনে। সঙ্গে সঙ্গে একপ্রকার দৌড়েই চলে যায় বাগানে। কুহেলী সেঁজুতিকে নিচে জীতুর সাথে কথা বলতে বলে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায়। সেঁজুতি বাগানে আসতেই থাকে দেখে যেন এক বড়সড় ধাক্কা খায় জীতু। সেঁজুতির গাঁয়ে জড়ানো রঙিন কাতান শাড়ি, হাত ভর্তি স্বর্ণের চুড়ি , গলা কান ও ফাঁকা নেই। একদম নতুন বউয়ের মতো লাগছে মেয়েটাকে। এভাবে সেজেছে কেন সেঁজুতি! জীতুর বুকটা হালকা মোচড় দিয়ে উঠে। কাঁপা কাঁপা পায়ে হেঁটে গিয়ে সেঁজুতির সামনে দাঁড়িয়ে অনিশ্চিত হাসি হাসে। চোখে মুখে তার আতঙ্ক। সেঁজুতি জীতুর চোখে তাকাতে পারে না। কষ্ট হয় তার। কপট রাগ নিয়ে বলে,
‘ বিয়ের দাওয়াত দিতে এলেন নাকি? ‘
জীতু হু হা করে হেসে ফেলে সেঁজুতির কথায়। সেঁজুতি ভ্রুঁ উঁচিয়ে তাকায় তার দিকে। জীতু একটু জিরিয়ে নিয়ে বড় একটা শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করে বলে,
‘ তোমাকে বিয়ের দাওয়াত দেয়ার মতো সাহস আমার নেই। আমি তো এলাম বিয়ে করবো বলে। এভাবে সেজেছো কেনো তুমি? জানতে নাকি আসবো? ‘
শেষের কথাগুলো বেশ ঠাট্টা করেই বলে জীতু। সেঁজুতির রাগ হয়। কটমটে চোখে তাকায় জীতুর দিকে। জীতু হেসে বলে উঠে,
‘ ওকে, ওকে সরি ম্যাম। ভুল হয়েছে। রাগ করবেন না। সবকিছু থেকে ব্লক কেনো করেছো আমাকে? ‘
‘ যাতে যোগাযোগ করতে না ইচ্ছে করে। আপনি এসেছেন কেনো সেটা বলুন। ‘
‘ চাকরি হয়ে গেছে আমার। ‘
জীতুর মুখ জুড়ে বিজয়ের হাসি। সেঁজুতি জীতুর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারে না। বুক ফেটে যায় তার। এতো কষ্ট , এতো কষ্ট ওই হাসিতে! কেনো? সেঁজুতি জীতুর থেকে চোখ সরিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে চোখের জল আটকায়। অনুভূতিহীন গলায় বলে,
‘ তো ভালো, এবার বিয়েও হবে। ‘
‘ হুম। একটা কথা বলবো? ‘
আবেগের ঝুড়ি মেলে বসেছে যেন আজ জীতু তার মাঝে। এর আগেও প্রায় সময় এমন ভাবে কথা বলতো সে সেঁজুতির সাথে। সে সবের আবেগ গাঁয়ে মাখিয়েই সেঁজুতি তার মোহে ডুবেছিল। তবু এখন বিরক্ত লাগছে। সব বিরক্ত লাগছে। জীতুকে অসহ্য লাগছে। সেঁজুতি আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারে না চেঁচিয়ে উঠে,
‘ সমস্যা কি আপনার? আমার আপনার এতো টালবাহানা দেখার সময় নেই। যা বলার সোজাসুজি বলে ফেলুন। ‘
‘ ভালোবাসি। ‘
জীতুর কথায় চমকে তাকায় সেঁজুতি। জীতু হাসছে। তার চোখে বিন্দু বিন্দু অশ্রু কণারা এসে জমা হয়েছে। সেঁজুতি জীতুর চোখের দিকে তাকিয়েই কেঁদে ওঠে। জীতু মুচকি হেসে সেঁজুতির দিকে এগোতে নিলেই দু পা পিছিয়ে যায় সে। মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে তার। যে মানুষটার অবহেলায় জীবনের সবচেয়ে কঠিনতম সিদ্ধান্ত সে নিয়েছে সে মানুষটা আজ তার দুয়ারে দাঁড়িয়ে বলছে ভালোবাসে! ভালোবাসা কি এতো সস্তা যে এই আছে এই নেই! সেঁজুতি কান্নায় ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে,
‘ আগে কেনো বলেননি আমায়? ‘
‘ আমার পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো নয় সেটা তুমি জানো যুঁথি। আমার কোনো চাকরিও ছিল না তখন ,না ছিল তোমার বাবার সামনে দাঁড়ানোর যোগ্যতা। সেদিন বি.সি.এস. পিলির রেজাল্ট পেয়ে তোমায় ফোন দিয়ে দেখি ব্লক দিয়েছো। সব জায়গায় ট্রাই করে দেখি তুমি পুরো সোশ্যাল মিডায়া থেকে নিজেকে আলাদা করে নিয়েছো। ভাবলাম রেগে আছো। তোমার বাড়ি চিনা ছিল না। তাই আরো একটু অপেক্ষা করলাম একেবারে চাকরিটা হোক তারপর নাহয় বলবো ভালোবাসি। চাকরিটা হতেই পাগলের মতো ছুটে এসেছি যুঁথি। ‘
–
মেডিক্যালে আজ শেষ ক্লাস ছিল পরীক্ষার আগে। ইয়ার প্রুফ এক্সাম আর ঠিক নয় দিন পর। লাইব্রেরীতে বসে চন্দ্রিমার সাথে পড়া গুছিয়ে নিচ্ছিল কুহেলী। হঠাৎ সমারোহ এসে তাড়া দিয়ে বললো তার সাথে বাড়ি যেতে হবে এক্ষুনি। না চাইতেও বাধ্য হয়ে উঠতে হয় কুহেলীকে। কলেজ থেকে বের হয়েই রিকশায় উঠে বসে দুজন। কিন্তু কুহেলীকে চমকে দিয়ে সমারোহ রিকশা বাড়ির দিকে না নিয়ে তার উল্টো পথে নিয়ে যেতে বলে। কুহেলী সচকিত হলেও সমারোহ কে প্রশ্ন করেনা। চুপচাপ বসে থাকে। রিকশা চলে আপন গতিতে। রিকশার ঘন ঝাঁকুনিতে বেশ কয়েকবার তারা ধাক্কা খায় একে অপরের সাথে। কুহেলী লজ্জায় মুড়িয়ে থাকে তবে বেশ ভালোই লাগে সময়টুকু। সমারোহ আজ কফি কলারের শার্ট পড়েছে, সাথে কালো প্যান্ট। হাতে ব্ল্যাক ওয়াচ। হাতা গুটিয়ে রেখেছে কনুইয়ের একটু নিচ পর্যন্ত। সাদা এপ্রোনের নিচে শার্টটার উপরের দুইটা বোতাম খোলা। কুহেলী আজ মুগ্ধ সমারোহকে দেখে। আড়চোখে কয়েকবার সমারোহকে দেখতে গিয়ে একবার চোখাচোখি হয়ে যায়। কুহেলী চোখ সরিয়ে নিলেও সমারোহ মৃদু হাসে। প্রায় দেড়ঘন্টা রিকশায় বসে থাকার পর অবশেষে রিকশা থামে। কুহেলী সামনে তাকিয়ে দেখে অদূরে সমুদ্র সৈকত। খানিক অবাক হয়ে হেঁসে ফেলে সে। সমারোহর দিকে তাকাতেই বলে,
‘ নামো। ‘
কুহেলী নেমে সামনের দিকে হেঁটে যায়। সমারোহ রিকশার ভাড়া মিটিয়ে কুহেলীর পাশাপাশি এসে হাঁটতে থাকে। কুহেলী মৃদু হেসে সন্দিহান কন্ঠে বলে,
‘ হঠাৎ সি বিচে? ‘
‘ ওয়েদারটা দেখেছো কি সুন্দর! ‘
কুহেলী আকাশের দিকে তাকায়। বিষন্ন আকাশে মেঘকন্নাদের দাপট চলছে এখন। বাতাস খানিকটা উত্তাল। সমুদ্র সৈকত থেকে মানুষ ফিরে যাচ্ছে যার তার গন্তব্যে। সমারোহ একপলক মুগ্ধ হয়ে কুহেলীকে দেখে কন্ঠে শতসহস্র মোহ ঢেলে বলে,
‘ পড়তে পড়তে তো হাঁপিয়ে উঠেছেন ম্যাডাম। পড়ার পাশাপাশি একটু রিল্যাক্স তো দরকার।’
কুহেলী চমকায়। মানুষটা তার অগোচরে এতো কিছু কিভাবে বুঝে নেয়!
সাগর উত্তাল হয়ে উঠেছে। অবাধ্য স্রোত একেরপর এক বিশাল গর্জন করে আছড়ে পড়ছে পাড়ে এসে। স্রোতের ছন্দময় শব্দে মুহূর্তগুলো মোহময় করে তুলছে। সমারোহর পাশে বসে থাকা সময়টাকে চিরকালের জন্য স্থির করে রাখা গেলে তাই করতো কুহেলী। এই অজানা অনুভূতিগুলোর সংঘর্ষ আর মেনে নেয়া যাচ্ছে না। ভেতরটা ধুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। এলোমেলো হয়ে আসছে ভাবনা। মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে বিকালের উজ্জ্বল লাল দিপ্তীময় সূর্যের মৃদু আভা দেখা যায় আকাশের পশ্চিম কোণে। আকাশে ঝোড়ো হওয়া কালো মেঘগুলো সুন্দর। মেঘের গাঁ গলে অতি কষ্টে এক মুঠো কমলা রঙের আলোয় মাখামাখি হয়েছে একটুকরো আকাশ। সমুদ্রের পানি ফুলে ফেঁপে উঠেছে। তীরের দোকানগুলোর কাছ অবধি চলে এসেছে পানি। সমারোহ হঠাৎই কুহেলীর হাত ধরে দাঁড়িয়ে বলে,
‘ চলো এবার উঠা যাক। এর বেশি এখানে বসা নিরাপদ হবে না। ‘
কুহেলী চুপচাপ উঠে দাঁড়ায়। সমারোহ কুহেলীর হাত ধরেই হাঁটা শুরু করে। এমনভাবে হাতটা ধরে রেখেছে যেন কুহেলী বাচ্চা, হাত ছাড়লেই এদিকসেদিক দৌড় দিতে পারে। নিরিবিলি রাস্তা ধরে অনেকটা পথ হেঁটে আসে দুজন। একটু আগের জনাকীর্ণ পিচ ঢালা সরু রাস্তাটা ফাঁকা পরে আছে। দু-তিনটা ডাব ভর্তি ভ্যান নীল পলিথিন দিয়ে মুড়াতে ব্যস্ত মানুষ। অনেকটা দূরে একটা ফুচকার ভ্যান দেখা যায়। সমারোহ মৃদু হেসে কাট কাট গলায় বলে,
‘ ফুচকা খাবে? ‘
‘ হুঁম। ‘
হাঁটতে হাঁটতে ফুচকার কাছে এসে দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ায় দুজন। সমারোহ ততক্ষণে কুহেলীর হাত ছেড়ে দিয়েছে। ফুচকা ওয়ালা মামাকে হাসি মুখে বলে,
‘ প্ল্যাট কতো মামা? ‘
‘পঞ্চাশ টিঁয়া। অনে ইগ্গান টাইমে আছলেন অ্যাঁই গাড়ি অফ করতে গইজ্জি। ‘ ( পঞ্চাশ টাকা। এমন সময় আসছেন গাড়ি বন্ধ করতে নিচ্ছিলাম। )
সমারোহ হালকা হাসে। বলে,
‘ আরে মামা, বৃষ্টি কি নামছে নাকি এখনো? দাও দুই প্লেট দাও। ‘
‘ এব্বারে ঝাল দিয়ুম না ইগ্গিনি গরি? ‘( ঝাল দিয়া নাকি ঝাল ছাড়া? )
সমারোহ কুহেলীর দিকে একপলক তাকিয়ে বলে, ‘ ঝাল দিবে? ‘
‘ অনেক। ‘
সমারোহ সন্দিহান চোখে তাকিয়ে থাকে কুহেলীর দিকে। কুহেলীর সমারোহর মনের কথা পড়তে কষ্ট হয় না। এই মুহূর্তে সে ভাবছে এতো ঝাল খাওয়ার মানে কি! সমারোহ ফুচকা ওয়ালা মামাকে বলে,
‘ একটাতে একদম ঝাল দিবানা আরেকটাতে বেশি দিবা। আবার খুব বেশি দিও না। ‘
লোকটা মৃদু হেসে তাদের দুজনের দিকে একবার তাকায়। তারপর উচ্চস্বরে বলে,
‘ আইচ্ছা। ‘
সমারোহর মোবাইলে কল আসাতে সে একটু দূরে গিয়ে কল এটেন্ড করে। সমারোহর পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে কুহেলী। লোকটা যে একদমই ঝাল খেতে পারে না তা বুঝে গিয়েছে। সমারোহর সাথে যতটা সময় থাকে একটা দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে থাকে কুহেলী। লোকটার একেক সময়ের আচরণ একেক রকম। কুহেলী সেদিন চন্দ্রিমাকে বাড়ি যাওয়ার কথা বলার পর থেকে সমারোহ কি তাকে চোখে চোখে বেশি রাখছে? কি জানি, কুহেলীর কেন যেন এমনটাই মনে হচ্ছে। আচ্ছা, সেঁজুতির বিয়ে তো হয়ে গেল এবার কি সমারোহ আলোকে বিয়ে করে নেবে? সারিকা আপু তো এমনটাই বলেছিলেন সেদিন। হয়তো হবে। তাতে কুহেলীর কি! সমারোহর বিয়ে হোক বা না হোক , গরু ছাগল তাকে খুশি বিয়ে করুক তাতে কুহেলীর কি! নিজেকে উল্টাপাল্টা বুঝ দিয়ে শান্ত করতে চায় কুহেলী। তবে মন কি অবুঝ নাকি যে তাকে ছাইপাশ বুঝ দিয়ে দেয়া যাবে।
‘ ম্যাডাম! কোন চিন্তায় মগ্ন হয়ে আছেন আপনি? ফুচকা কি খাবেন না? ‘
সমারোহর কথায় ধ্যান ফিরে কুহেলীর। সমারোহ দুই হাতে ফুচকার প্লেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কুহেলী একদমই খেয়াল করেনি। খেয়াল করার পর সামান্য লজ্জা পেয়ে ‘ সরি ‘ বলে সমারোহর হাত থেকে একটা প্লেট নিয়ে নেয়। নিয়ে ফুচকাতে আনমনে কাপ থেকে চামচ দিয়ে টক ঢালতে থাকে।
‘ কুহেলী, ঠিক আছো তুমি? শরীর ঠিক আছে? ‘
সমারোহর এমন প্রশ্নে কপাল কুঁচকে অবাক হয়ে তাকায় কুহেলী। সমারোহর ঠোঁটের কোণে হালকা মোহনীয় হাঁসি ঝুলছে। কুহেলীর দিকে ঝুঁকে তার চোখে গভীর আবেগ নিয়ে তাকিয়ে সে বলে,
‘ আপনি আমার প্লেট নিয়ে নিয়েছেন। ‘
কুহেলী দ্রুত তার হাতের দিকে তাকিয়ে চোখ খিঁচে বন্ধ করে বিড়বিড়িয়ে বলে, ‘ শিট!’
এমন উল্টাপাল্টা উদ্ভট কাজ সে কেন করে বুঝে পায় না। করলেও বারবার এই লোকটার সামনেই করে বসে আর লোকটা তার পুরো ফায়দা নেয়।কুহেলী চোখ বুঁজেই সমারোহর হাত থেকে প্লেটটা নিয়ে তার হাতের টা সেখানে রেখে দেয়। তারপর দ্রুত অন্য দিকে ফিরে যায়। লজ্জায় তার নাক কাটা যাচ্ছে। সমারোহ ঝুঁকেই থাকে। হেসে ঠোঁট ভিজিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে আবার কুহেলীর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। কুহেলী ততক্ষণে খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। একেকটা ফুচকা খাচ্ছে আর চোখ দিয়ে টুপটপ করে পানি পড়ছে। ঝালে চারটা ফুচকা খাওয়ার পরই চেহারা অসম্ভব রকম লাল হয়ে গিয়েছে কুহেলীর। সমারোহ নিজের খাওয়া ফালিয়ে সেদিকেই চেপে আছে। ঝালে কাঁদছে অথচ একের পর এক খেয়েই চলেছে। কুহেলীর কান্ডে চোখ ছোট ছোট হয়ে আসে সমারোহর। কপট রাগ দেখিয়ে কুহেলীর হাত থেকে ফুচকার প্লেট নিয়ে গিয়ে বলে,
‘ কাঁদছে আবার খাচ্ছে। এতো ঝাল কেন খেতে হবে? আর মামা আপনাকে না বললাম খুব বেশি ঝাল না দিতে। ‘
সমারোহর কথা শুনে লোকটা দাঁত কেলিয়ে হাসলো। কুহেলী চোখমুখ কুঁচকে নাক টানতে টানতে বলে,
‘ না মামা, ঝাল একদম ঠিক আছে। আপনি নিলেন কেনো? দিন আমার প্লেট দিন! খুব মজা হয়েছে ফুচকা। আপনিও জালটা খেয়ে দেখুন একবার। ‘
সমারোহ চোখ বড় বড় করে বলে, ‘ আর ইউ মেড? চেহারার অবস্থা কি হয়েছে তোমার তারপরও খেতে চাচ্ছো! তোমাকে ফুচকা খাওয়ানোই ভুল হয়েছে আমার। ‘
কুহেলী মুখ টমেটোর মতো ফুলিয়ে তাকায় সমারোহর দিকে। যদি ঝালে বেশিক্ষণ থাকতে পারে না, হুঁ হা শুরু করে দেয়। সমারোহর খুব জোর হাসি পায় কুহেলীর অবস্থা দেখে। কুহেলী বেশ কয়েকবার চিল্লাপাল্লা করেও বাটিটা ছিনিয়ে নিতে পারে না সমারোহর থেকে। অবশেষে কোনো উপায়ান্তর না দেখে মাথা নুইয়ে গোটা গোটা চোখে বাচ্চাদের মতো দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,
‘ আচ্ছা আপনি জাস্ট একটা ঝাল ফুচকা খেয়ে দেখুন। ভালো না লাগলে আমি আর খাব না আর যদি ঝাল হওয়ার পরও ভালো লাগে তো আপনি আমাকে আরেক প্লেট ফুচকা খাওয়াবেন। ডান? ‘
‘ নেভার! কোনো প্রশ্নই আসে না। আমি এতো ঝাল খাব কি মরতে? ‘
‘ আমি কি মরে গেছি মি. ডক্টর? ‘
কুহেলীর প্রতিউত্তরে সমারোহ কাট কাট গলায় বলে,
‘ বাচ্চামো করো না তো! এই ফুচকা আর খাওয়া যাবে না। ‘
কুহেলী মুখ ভেংচে দাঁড়িয়ে থাকে। লোকটা একটা অস্তো জল্লাদ। মেয়েদের হাত থেকে যে ব্যক্তি ফুচকার প্লেট কেড়ে নিয়ে নিতে পারে তার হৃদয় যে কতো পাষাণ এর সাক্ষ্য কুহেলী নিজে। এই মুহূর্তে সমারোহকে সে মনে মনে যমের বাড়ি পাঠাচ্ছে। সমারোহ কুহেলীর চুপসে যাওয়া মুখ দেখে আমতা আমতা করে বলে,
‘ আচ্ছা, জাস্ট একবার! ‘
সমারোহর কথা শুনেই সব কষ্ট ফানুসের মতো উড়ে যায় কুহেলীর। খুশিতে গদগদ হয়ে বলে,
‘ আচ্ছা আচ্ছা! খান? ‘
‘ বাট তুমি পাচ্ছো না কিন্তু আর। চলবে? ‘
‘ দৌড়াবে। খেয়ে দেখুন। ফুচকা আবার ঝাল ছাড়া মজা আছে নাকি? আপনি যে ফুচকাটা নিলেন দেখতে তো মনে হচ্ছে নিরামিষ। ‘
ভ্রুঁ উঁচিয়ে তাকায় সমারোহ। কুহেলী জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে। ফুচকার দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলে একবার। মনে হচ্ছে দুনিয়ার সব কাঁচা মরিচ আর শুকনো মরিচ ঢেলে দিয়েছে এখানে। ঘুগনি থেকে মরিচের পরিমাণ বেশি। ধুর বাবা, কুহেলীর মন রাখতে গিয়ে বলে বিপদেই পড়ে গিয়েছে। এটা খেলে বেঁচে থাকবে তো সে! এদিকে কুহেলী তাড়া দিয়ে যাচ্ছে বারবার। সমারোহ মনে মনে আয়াতুল কুরসি, কালিমা সব পড়ে চোখ বুজে এক পিস ফুচকা মুখে তোলে নেয়।
কুহেলীর এবার বিশ্ব জয় করার মতো শান্তি হচ্ছে মনে। মনে মনে বলে ‘বুঝবেন এবার কুহেলী কাহারে বলে। আমার হাত থেকে ফুচকা ছিনিয়ে নেয়া! ‘
অর্ধেক ফুচকা খেতে না খেতেই মুখ লাল হয়ে এলো সমারোহর। চোখ দুটো টকটকে লাল হয়ে গেছে। নাক দিয়ে পানি ঝড়ছে। কুহেলীর আনন্দটা মুহূর্তেই উবে গেছে। সমারোহ দ্রুত প্লেট দুটো পাশের চেয়ারে রেখে দুই হাতে কান চেপে ধরলো। কুহেলী সামান্য ভয় পেয়েই সমারোহর কাছে গিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বলে,
‘ ভাইয়া! ঠিক আছেন আপনি? ঝাল কি খুব বেশি লেগেছে ? ‘
সমারোহ কুহেলীর কথার কোন উত্তর না দিয়েই হাঁটু মুড়ে বসে রইলো কতক্ষণ। কুহেলী এদিক ওদিক খুঁজে একটা দোকান থেকে পানি এনে দিতে নিমিষেই পুরো পানিটা সাবার করে দিলো। কুহেলীর নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে এখান, কেনো সে জোর করতে গেল! সমারোহ কয়েকবার জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করতে চায়। কিন্তু ঝাল কমে না। কান মাথা গরম হয়ে গিয়েছে। ছোট থেকেই ঝাল খাওয়ার অভ্যাস একদম নেই তার। কাঁচা মরিচ দুই চোখের বিষ যেন! তাও কুহেলীর কথায় কিভাবে খেয়ে নিল কে জানে! ফুচকা ওয়ালা ততক্ষণে গাড়ি বন্ধ করে দিয়ে তাদের কান্ড দেখে হেসে কুটিকুটি। প্রায় বিশ ত্রিশ মিনিট পর ধীরে ধীরে ঠিক হয় সমারোহ। কুহেলীকে দেখে মুচকি হেসে উঠে দাঁড়িয়ে গলা ছেড়ে বলে,
‘ মেয়ে মানুষ মানেই হচ্ছে উল্টাপাল্টা কাজকর্ম। একটু হলেই তো জান নিয়ে নিচ্ছিলা আমার। মাথা এখনো ভোঁ ভোঁ করছে। ‘
কুহেলী মাথা নুইয়ে আর্তস্বরে বলে,
‘ আই এপোলজাইস। ‘
সমারোহ হেসে ফেলে কুহেলীর কন্ঠ শুনে। কুহেলী একবার সমারোহর দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়। সমারোহ হাঁটতে হাঁটতে বলে,
‘ সুন্দরী মেয়েদের উপর বেশিক্ষণ রাগ করে থাকাটা একদমই ঠিক নয়। তাই তোমায় ক্ষমা করলাম যাও। ‘
নিঃশব্দে পাশাপাশি হেঁটে চলে দুজনা। কারোর মুখে রা নেই। বৃষ্টি হওয়ার পূর্বমুহূর্তে প্রকৃতি উত্তাল হয়ে উঠা শুরু করেছে। সমুদ্র সৈকত থেকে হেঁটে অনেকটা সামনে আসার পরও রিকশার দেখা মিলে না। দু একটা সিএনজি পাওয়া যায়। এদিকে বৃষ্টিকন্যারা নামতে শুরু করেছে অল্প পরিসরে। সমারোহ সিএনজি ডাকতে নিলে কুহেলী মিনমিনে স্বরে বলে,
‘ বৃষ্টিতে ভিজবো আমি। সিএনজিতে উঠবো না। ‘
সমারোহ ভ্রুঁ উঁচিয়ে তাকায় কুহেলীর দিকে। তারপর কঠিন গলায় বলে,
‘ মোটেই না। এখন বৃষ্টি ভিজে জ্বর বাঁধাবে তারপর পরীক্ষাটা খারাপ হবে। ‘
কুহেলী মাথা নিচু করে চুপসে যাওয়া মুখে বলে,
‘ একটু ভিজবো। অল্প একটু ভিজলে কিচ্ছু হবে না। ভিজি? ‘
‘ না। ‘
কুহেলী এতো মায়াবী চেহারা বানিয়ে বলল তাতেও কোন বিশেষ লাভ হলো না। সমারোহ তার কথায় অনড়। সমারোহর গম্ভীর মুখখানি দেখে রাগ হয় কুহেলীর। এখন বৃষ্টি নামার-ই বা কি দরকার ছিল! পাশাপাশি আরো কিছুটা সময় থাকা যেত। সমারোহ কিছু সময় অপেক্ষা করে একটা সিএনজি ঠিক করে নিলে উঠে বসে দুজন।
–
শাওয়ার ছেড়ে তার নিচে একটানা একঘন্টা যাবৎ দাঁড়িয়ে আছে সেঁজুতি। এই পানির যদি মনের ব্যাথাগুলো ধুয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা থাকতো! সেঁজুতি সবটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। সব অসহ্য লাগছে,সব। জীতুকে খুন করে ফেলতে ইচ্ছা করছে এই মুহূর্তে। মানুষটার অবহেলার জন্য আজ সে তার ভালোবাসা হারিয়ে ফেললো। কি দরকার ছিল অমন করার? সেঁজুতি বেকার জীতুকেই তো ভালোবেসেছিল। তবে সময় নিত! জীতুর ওভাবে আঘাত পেয়ে ফিরে যাওয়াটা মেনে নিতে পারছে না সেঁজুতি। ঠিক যতটা আনন্দ নিয়ে এসেছিল তার চেয়েও বেশি আঘাত পেয়ে ফিরে গেছে। কাঁদছিল জীতু। সেঁজুতির কেন যেন শান্তি হচ্ছিল তখন জীতুকে কাঁদতে দেখে। শুধু একা সে কষ্ট পাবে না! এখন থেকে জীতুও জ্বলে পুড়ে মরবে ঠিক তার মতো।
মন একটু শান্ত হলে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখে হিরণ বিছানায় বসে তার জন্য অপেক্ষা করছে। সেঁজুতিকে বের হতে দেখেই রেগে কটকটে স্বরে বলে ওঠে,
‘ এই মেয়ে, তুমি কি একটুও খেয়াল রাখতে পারো না নিজের? এতোক্ষণ ধরে পানিতে শরীর ভিজিয়ে রেখেছো ঠান্ডা লাগবে না? আর যাতে এসব উল্টাপাল্টা কথা না দেখি। ‘
সেঁজুতি নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে। হিরণ উঠে এসে সেঁজুতিকে খাটে বসিয়ে দিয়ে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছে দেয়। তারপর সেঁজুতির দুই গালে হাত দিয়ে চেপে ধরে বলে,
‘ কাঁদছিলে? আমার কোনো আচরণে কষ্ট লেগেছে মনে? ‘
সেঁজুতি কোনো উত্তর করে না। হিরণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। কিছু একটা ভেবে বলে,
‘ উমমম, তাহলে কাল বাড়ির সবাইকে ছেড়ে চলে যাবে বলে মনে খারাপ? ‘
সেঁজুতি হিরণের চোখে চোখ রেখে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর কি যেন বুঝে চোখ নামিয়ে নিয়ে ভেজা কন্ঠে বলে,
‘ জীতু এসেছিল। আমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। ‘
চুপসে যায় হিরণ। কথা খুঁজে পায়না। সেঁজুতির হাঁসি পায়। অনুনয় করে বলে,
‘ মাথা ধরেছে।একটু ঘুমাই? ‘
‘ তুমি ঘুমালে আমার কাছে পারমিশন নিতে হবে নাকি? ‘
‘ উহু, আপনার পায়ে মাথা রেখে ঘুমাবো। ‘
হিরণ বড় বড় চোখ করে তাকায় সেঁজুতির দিকে। চুপসে আসা মুখটা মুহূর্তেই জ্বলজ্বল করে উঠে। খুশি যেন ঠিকরে পড়ছে। সেঁজুতি তা পাত্তা না দিয়ে হিরণের হাত টেনে বসিয়ে দিয়ে তার পায়ে মাথা রাখে। হিরণ খুব যত্নে সেঁজুতির চুলে বিলি কেটে দেয়। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে হঠাৎই দুই হাতে হিরণকে ঝাপটে ধরে পেটে মাথা লুকিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে সেঁজুতি। হিরণ শক্ত করে চেপে ধরে তাকে। এই মেয়েটার কান্নায় এতো মায়া! হিরণ মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে সেঁজুতির চোখে তার কখনো জল ঝরতে দিবে না সে। কক্ষনো না। সেঁজুতি হিরণকে জড়িয়ে ধরেই ঘুমিয়ে পরে। হিরণ খুব সাবধানে মাথায় অসংখ্যবার চুমু খায় সেঁজুতির।
–
‘ কালো দাগ পড়ছে কেনো চোখের নিচে? ‘
‘ স্বাভাবিক না? ‘
‘ খাওয়া দাওয়া করছো ঠিক মতো? ‘
‘ জ্বি। ‘
‘ কষ্ট দিয়ে ফেলেছি না খুব! ‘
নয়নার মুখে তাচ্ছিল্য হাসি ফুটে উঠে। মনটা বিষিয়ে গিয়েছে তার সবকিছুর প্রতিই। নয়না কে নিশ্চুপ বসে থাকতে দেখে সৌরভ হতাশ হয়। তপ্তশ্বাস ফেলে বলে,
‘ তোমার আরো মোটা হওয়ার দরকার ছিল। এই সময় শরীরের প্রতি অবহেলা তোমার বাচ্ছার জন্য ক্ষতিকর তো। ‘
‘ একদম! তবে কি জানেন আমার সন্তান যেহেতু তার ভালোটা আমিই বেশি ভালো বুঝবো। ‘
‘ হুঁ, তবে তুমি জানো তোমার নিজের দেহের প্রতি অবহেলা একদম সহ্য হয়না আমার নয়না! ‘
রাগ দেখিয়ে বললো সৌরভ। নয়না অদূরের পুকুরে সাঁতার কাটা হাঁসের ঝাঁকের দিকে তাকিয়ে রইল নির্বিকার ভঙ্গিতে। এতো সব নেকামো যত্ন তার মোটেই পছন্দ হচ্ছে না। হিজাব পড়ে আছে নয়না। কপাল নাক ঘামে চুপসে আছে। সৌরভ কিছু না বলে চুপচাপ উঠে গিয়ে এক বোতল ঠান্ডা পানি এনে এগিয়ে দেয় নয়নার দিকে। নয়না খেয়াল করেও অন্যদিকে চেয়ে থাকে। সৌরভ নয়নার আরো একটু গাঁ ঘেঁষে বসে বলে,
‘ কষ্ট হচ্ছে তোমার। হিজাবটা হালকা করো। ‘
‘ অভ্যাস হয়ে গেছে আমার। আমাকে হঠাৎ ডাকার কারণটা বলো। ‘
কাট কাট গলা নয়নার। সৌরভের কলিজা ফেটে যায়। হঠাৎই কাঠের বেঞ্চি থেকে উঠে নয়নার হাত দুটো ধরে তার সামনে মাটিতে বসে পরে বলে,
‘ নয়না আমি প্রথমে মেনে নিতে পারিনি তবে আমাকে তো একটু সময় দিতে পারতে! আমি ভালোবাসি তোমায়। তখন, ‘
সৌরভ একটু থামে। চোখ বুঁজে তপ্তশ্বাস ফেলে আবার বলতে শুরু করে,
‘ তখন হুট করেই সবটা শুনে আমি নিজেকে সামলে নিতে পারিনি। আমি মানছি আমি ভুল করেছি। কি করতাম বলো, আমার অনেক স্বপ্ন ছিল তোমায় আমায় ঘিরে। এক মুহুর্তের জন্য মনের হয়েছিল সব থমকে গেছে। আমার ভুলের জন্য আমি দুই পরিবারের মান সম্মান নষ্ট করে ফেলেছি। ডেড আমার মুখ হয়তো আর কখনো দেখবে না। ভার্সিটিতে আমার ইমেজ! সব মিলিয়ে পাগল হয়ে উঠেছিলাম। আমি সবটা বুঝার আগেই সমারোহ ভাইয়া…।
আমি ভুল করেছি নয়না। তবে আমি আমার ভুল শুধরে নিতে চাই। ‘
সৌরভের চোখ ছাপিয়ে অশ্রুধারা নেমে আসে। নয়না খোচ চোখে সৌরভকে দেখে গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
‘ কিভাবে? এভশন করে? এখন এভশন করলে আমিও মারা যেতে পারি জানো! ‘
সৌরভ দ্রুত নয়নার মুখ চেপে ধরে নিজের হাতে। দ্রুত নয়নার মাথা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে বলে,
‘ আমার নয়না, তুমি যেমন আমি তোমাকে তেমন ভাবেই কাছে টেনে নেব। আর এই সন্তান তোমার নয়। আমাদের। ‘
‘ হুঁ। ‘
‘ আমি তোমাকে খুব শিগগিরই বিয়ে করে নেব। ‘
‘ আমি বিয়ে করবো না। ‘
চলবে.