আকাশ মোড়ানো চিরকুট পর্ব-৩২+৩৩+৩৪

0
511

আকাশ মোড়ানো চিরকুট
লেখনী – সাইমা ইসলাম প্রীতি

৩২.

ঝিম ধরা অমাবস্যার রাত! থেকে থেকে শোনা যায় নিশাচরের ডাক। দূরে কোথাও একটা বিড়াল অশীরীরীর ন্যায় কাঁদছে। জানালার মোটা রডের ফাঁকে খন্ড-বিখন্ড হওয়া আঁধারের মাঝে সমারোহর দৃষ্টি! কালো আকাশে ফালি ফালি সাদা মেঘগুলোকে আজ ছন্দহীন মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেনো বিষাদের তিক্ত ছায়া নেমে এসেছে পৃথিবী জুড়ে! দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বুঁজে থেকে মনটা হালকা করার চেষ্টা করে সমারোহ। তিন কালিমা পড়ে রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করে ধর্মীয় এবং আইনি প্রক্রিয়ায় কুহেলী এখন সমারোহর স্ত্রী। একটু আগেই শেষ হয়েছে বিয়ের কার্যক্রম। কবুল পড়ে রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করেই নিজের কক্ষে এসে দরজা আটকে বসে আছে সমারোহ। মেজাজ বিগড়ে আছে ভীষণ রকম। এক্ষুনি শিমুলপাড়া ছাড়তে ইচ্ছে হচ্ছে তার। নিজের বাবার আর খোর্শেদের কথার সম্মান রাখতে নিজের সম্মান সে নষ্ট করেছে সবার সামনে।

সকালে যে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করছিল খোর্শেদ খুলে সন্ধ্যায়। ততক্ষণে বাড়ির সকলের যাচ্ছে তাই অবস্থা। খোর্শেদ এই প্রথম লোকসম্মুখে অপমানিত হয়েছে উল্টোপাল্টা কিছু করতে পারে ভেবে উঠানে বসে মরাকান্না জুড়ে দিয়েছিলেন রমলা। শেষ পর্যন্ত যখন দরজা ভাঙার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তখন দরজা খুলে থমথমে মুখে খোর্শেদ বলেন,

‘ সমারোহ বাবা, একটু ভিতরে আসো। কথা আছে তোমার লগে। ‘

কথাটুকু বলেই খোর্শেদ ভিতরে চলে যায়। সমারোহ ঢুকলে দরজা আটকে দেয়‌। ভেতরে কি কথপোকথন হয় কিছুই বুঝতে পারে না কুহেলী, হাসনাহেনা। শুধু দেখে যখন দরজা খোলা হয় সমারোহ রক্তিম চেহারা নিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে যায়। খোর্শেদ তার পিছু পিছু বের হয়ে রজবের কানে কানে কি যেন একটা বলে। রজবের চেহারার রং পাল্টে যায় তাতে। রজব বসে যাওয়া গলায় কোনো রকম বলে,

‘ আপনের লাইগ্যা আমি জীবন দিয়া দিতে পারুম। আপনার কোন কথার অমান্য আমি কুনোদিন হইনাই। কিন্তু এইডা আমি পারমু না। ‘

খোর্শেদ কিছু একটা আন্দাজ করতে পারে। রজবের থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলে,

‘ আমিই করতেছি। ‘

তারপর বাড়ি থেকে বের হয়ে যায় খোর্শেদ। ফিরে দু ঘন্টা পরে। কুহেলীর মামা আর বয়স্ক গোছের একজন লোককে সাথে নিয়ে। তাদের বসার ঘরে বসতে বলে কুহেলীর ঘরে এসে হঠাৎ জোর গলায় বলে,

‘ কুহেলী? ‘

খোর্শেদে গলার স্বর শুনে ভড়কে গিয়ে কুহেলী বলে উঠে,

‘ কিছু বলবে আব্বা? ‘

‘ হুঁ। আমি যদি তোমার ভালো মনে কইরা বড় কোনো সিদ্ধান্ত নেই তুমি মাইনা নিবা? ‘

কুহেলী চুপসে আসে। মিনমিনে স্বরে বলে,

‘ আমার আব্বা আমার জন্য সর্বোচ্চ উত্তমটাই করবে। ‘

‘ আমি তোমাকে বিয়ে দেব। আজ! কাজি নিয়ে আসছি। তোমার মামা এবং তোমার দাদীমা এই বিষয়ে আমার সঙ্গে একমত। তুমি কি বিয়ে করতে রাজী আছো? ‘

কুহেলীর বুকটা ছ্যাৎ করে উঠে মুহূর্তেই। এমন একটা আসঙ্কা তার মনে এসেছিল তবে পাত্তা দেয়নি সে। কার সঙ্গে বিয়ে ঠিক করেছে জানে না কুহেলী। তবে সে একজনকে মন দিয়ে বসে আছে এটা অজানা নয়। তাকে ভালোবাসে কিনা জানে না তবে পৃথিবীটা শূন্য মনে হচ্ছে বিয়ের কথা শুনার পর। যার সঙ্গে জীবন বাঁধা পড়বে তাকে কি ভালোবাসতে পারবে সে নতুন করে! হিতাহিতজ্ঞান শূন্য হয়ে পড়ে কুহেলী। কি করবে এখন? আব্বার কথা ফেলা অসম্ভব। মানুষটা নিজের সব আনন্দ শখ আহ্লাদ ত্যাগ করেছে তার মেয়ে দুটির জন্য। বটবৃক্ষের ন্যায় অবিচল হয়ে পাশে থেকে প্রতিটা কঠিন মুহূর্তে। কুহেলীর উপর নিজের কোনো সিদ্ধান্ত কোনোদিন চাপিয়ে দেননি। কুহেলী মাথা নিচু করে থাকে। চোখে জল আসে। মন বলছে অন্য কিছু আর মস্তিষ্ক বলছে বাবা নামক যে লোকটার আঙ্গুল পেঁচিয়ে ধরে জীবনের সকল প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠে নতুনের স্বপ্ন দেখা, যার হাত ধরে পৃথিবী চেনা, যার বুকে মাথা রেখে অসহায় ছোটবেলায় নিরাপদে থাকা, যার মুখের বুলি দ্বারা সৃষ্টিকর্তাকে চেনা তার কথার অবাধ্য হওয়ার সাহস, ক্ষমতা কিংবা অধিকার কুহেলীর নেই। কিছুতেই নেই। কুহেলী চোখের পানি লুকিয়ে ঠোঁটে বিস্তর হাঁসি ফুটিয়ে মাথা উঁচু করে তাকায় তার আব্বার পানে। স্পষ্ট পরিষ্কার গলায় বলে,

‘ আমার আব্বার জন্য আমি দুনিয়ার সব সুখ ছেড়ে দিতে পারি। মৃত্যুকেও অনায়াসে গ্রহণ করতে পারি। হাসতে পারি, কাঁদতে পারি, সকল বিষন্নতা ঝেড়ে ফেলতে পারি, সব পারি! আর বিয়ে এক সামান্য বিষয়। তুমি যাকে পছন্দ করবে তাকে আমিও সম্মান করবো, মেনে চলবো। ‘

খোর্শেদের মন প্রসন্ন হয়। কুহেলী এমন কিছুই বলবে তিনি জানতেন। মেয়ে যে তার বড়ই বাধ্য। খোর্শেদ কুহেলীর মাথায় হাত রাখে। মেয়েকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে গভীর চুম্বন করে কপালে। কুহেলী মুচকি হাসে। খোর্শেদ বলেন,

‘ আমি আমার প্রিয় বন্ধুর ছেলে সমারোহর সাথে তোমার বিয়ে দিতে চাই। তুমি তাতে মত দিচ্ছো? ‘

কুহেলী চোখ বড়বড় করে তাকায় খোর্শেদের দিকে। সমারোহ! সমারোহর সাথে বিয়ে ঠিক করেছে মানে? সে কি বিয়েতে রাজি হয়েছে? আলোর সাথে তো সমারোহর বিয়ে হওয়ার কথা ছিল! কুহেলীর বুকটা যেন কেমন করে। ভয় হয়! কুহেলীর চেহারাখানি প্যাঁচার মতো হতে দেখে খোর্শেদের কপাল কিঞ্চিৎ কুঞ্চিত হয়‌। মেয়ের মুখের ভাষা পড়ার চেষ্টা করেন। হয়তো কিছু একটা বুঝেন। বলে উঠেন,

‘ তোমার আব্বা তোমার খারাপ চাইবে না মা। সমারোহ ভালো ছেলে। আমি চাই না কালকে তোমারে পঞ্চায়েতের বা গেরামের কেউ বাজে কিছু বলুক। তারা লোভী মানুষ। আমাদের এক আঙ্গুল ভুল দেখলে দশ আঙুল পরিমাণ সুবিধা নিতে চাইবো। ‘

কুহেলী মাথা নিচু করে থাকে। সমারোহর চেহারা মনে ভেসে উঠতেই ভয়ে জমে গিয়েছে। খোর্শেদ বলেন,

‘ তুমি একান্তে সমারোহর সাথে কথা বলবা। ‘

খোর্শেদের কথায় ঘাবড়ে গিয়ে ঝটপট কুহেলী বলে,
‘ আমি কি কথা বলবো আব্বা! তুমি যা ভালো মনে করবে তাই হবে। ‘

খোর্শেদ আর কিছু বলেন না। বের হয়ে আসেন ঘর থেকে। সমারোহ রাগে ফোঁসফাস করতে করতে আনরুবাকে কল করে। আনরুবা ফোন রিসিভ করতেই রেগে বলে উঠে,

‘ আম্মা, কি হচ্ছে এসব? তুমি বলো গ্রামবাসী যে অভিযোগ করছে সেটার সমাধান কি বিয়ে নাকি? কুহেলীকে যদি আমি এখন, এই মুহূর্তে বিয়ে করি তবে আমার মান-সম্মানের কি অবশিষ্ট থাকবে কিছু? আর কুহেলী খোর্শেদ আঙ্কেল ও ছোট হবেন সবার কাছে। সবাই এটাই মেনে নেবে আমরা অন্যায় করেছি তাই শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে বিয়ে করে ফেলেছি। এটা কোনো সমাধান হলো না আম্মা। ‘

সমারোহর কথা চুপচাপ শুনেন তিনি। পরক্ষণেই আনরুবার গম্ভীর কণ্ঠস্বর শোনা যায়,

‘ আমারে একটা সত্য কথা বলো আব্বা। তুমি কুহেলীকে পছন্দ করো? ‘

থমকে যায় সমারোহ। কথার সুর কেটে যায়। এতোক্ষণ চেঁচিয়ে উঠা মানুষটা দমিয়ে যায়। একটু থেমে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সমারোহ বলে,

‘ আম্মা এই বিষয়ের সাথে কুহেলীকে পছন্দ করার কথা কেনো আসছে? আমি তোমাকে অন্য কিছু বলছি। আমি বলছি আমার সম্মানের কথা। ‘

আনরুবা এবার কাট কাট গলায় বলেন,

‘ কিন্তু আমি এটা শুনতে চাইছি, উল্টাপাল্টা কিছু না বলে উত্তর দাও। কুহেলীকে তোমার পছন্দ না হলে দুনিয়ার কেউ তোমাকে বিয়ের জন্য জোর করতে পারবে না। এটা তোমার প্লাস পয়েন্ট। এখন বলো তোমার কুহেলীকে পছন্দ কি না! ‘

সমারোহ চুপসে থাকে। সত্যটা সে অনেক পূর্বেই রিয়েলাইজ করেছে সে। কুহেলীর মোহে জরিয়েছে, প্রেমে পড়েছে। আনরুবার কাছে সবকিছু শেয়ার করলেও কুহেলীর বিষয়টা বরাবরই চাপিয়ে এসেছে সে এর আগে। সত্যি বলতে ভয় হয়! আলো ছেড়ে যাওয়ার পর থেকে কাউকে ভালোবাসতে ভয় হয়, কাছে চাইতে এরচেয়েও বেশি ভয় হয়। সমারোহ চুপ থাকে‌। আনরুবা ফোনের অপর প্রান্ত থেকে ছেলের গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলার শব্দ শোনেন। ছেলের কষ্টগুলো বুক কাঁপিয়ে তোলে তার। নিরবতার পর্দা ভেঙে দিয়ে বলেন,

‘ আমি তোর মা। আর মা হচ্ছে পৃথিবীতে সন্তানের জন্য একমাত্র নিরাপদ স্থান যেখানে মনের সব কথা বলা যায়। তুই আমাকে তোর ভেতরকার জোরে বলে লুকিয়ে রাখা তিক্ত অনুভুতিটা না বুঝতে দিলে কি আমি বুঝবো না? তোর অব্যক্ত কথাগুলো কি আমি জানি না? তোর কষ্ট আমায় কাঁদাবে না? সন্তানের কষ্টে সবার আগে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয় তার বাবা-মায়ের। মায়ের কাছে সন্তানের সবকিছুর খবর থাকে বুঝলি! মনের খবর ও থাকে। আমি সব জানি। তাও যদি তুই বলতে না চাস আমি জোর করবো না। যা সিদ্ধান্ত নিবি ভেবে চিন্তে নিবি। ‘

কথা শেষ করে ফোন রেখে দেন আনরুবা। সমারোহ ঠাঁয় বসে থাকে। কেমন একটা চাপা কষ্ট হচ্ছে। আলোর ছেড়ে চলে যাওয়ার পরের দিনগুলোর কথা পড়ছে। আবার একটা সম্পর্কে জড়াতে যাচ্ছে সে। আবারও প্রেমে পড়েছে। পূর্বের বিশ্রী যন্ত্রণা যদি ফের ফিরে আসে? মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে পড়ে সমারোহর। সব ফাঁকা ফাঁকা লাগে। বাড়ি থাকলে হয়তো এখন আনরুবার কোলে মাথা রেখে বুকের ব্যাথা কমাতো সমারোহ। সমারোহ আবার কল করে আনরুবাকে। আনরুবা কল রিসিভ করতেই গড়গড়িয়ে বলে ফেলে,

‘ আমি হয়তো কুহেলীকে ভালোবাসি। ‘

সমারোহর সংক্ষিপ্ত স্পষ্ট উত্তর। আনরুবা খুব বেশি খুশি হন ছেলের কথা শুনে। মুচকি হেসে বলেন,

‘ আমার চোখে সেটুকু অনেক আগেই পড়েছে। তাহলে বিয়েটা করে নাও। তুমি বুদ্ধিমান ঠিকই, হয়তো বাস্তববাদী ও। কিন্তু সমাজের মানুষের পৈশাচিক রূপের সাথে পরিচিত নও খুব একটা। তাই বড়রা যা বলতে চাই করো বাবা। এতে ভালো হবে। তোমার আব্বাও তোমাকে তাই বলেছেন। ‘

সমারোহর আর কথা বলতে ইচ্ছা করে না। শুধু রেগে বলে,

‘ বিয়ে নাহয় করলাম তবে তোমাদের যুক্তির সাথে একমত হতে পারছি না। ‘

ফোন রেখে দেয় সমারোহ। রাগে ফোন আছাড় মেরে ভেঙ্গে ফেলতে নিয়েও সামলে নেয় নিজেকে। টেবিল থেকে জগ তুলে নিয়ে রূদ্ধশ্বাস সবটুকু পানি খেয়ে ফেলে। মন কেমন যেন করছে। কুহেলীকে তার অবচেতন মন চাইতো। সত্যিই খুব, খুব বেশি কাছে চাইতো। কিন্তু এভাবে নয়, এই সময়ে নয়। তপ্তশ্বাস ছেড়ে একটা সাদা সুতি পাঞ্জাবি পড়ে নেয় সমারোহ। সাথে চুড়িদার পায়জামা। রজব সমারোহর ঘরে আসে তাকে ডাকতে। তার মন খারাপ হয়তো। মাথা নিচু করে বলে,

‘ চাচায় ডাকে। বসার ঘরে আহেন জলদি। ‘

চলে যায় ছেলেটা। সমারোহ চোখ ছোট ছোট করে পরখ করে নেয় তাকে। তারপর চলে আসে বসার ঘরে। কুহেলীকে স্ত্রী মেনে তিনবার কবুল পড়া হয়। করা রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন।

চলবে.

আকাশ মোড়ানো চিরকুট
লেখনী – সাইমা ইসলাম প্রীতি

৩৩.

চুপচাপ পুকুর পাড়ে বসে আকাশের দিকে চেয়ে আছে কুহেলী। কিছুক্ষণ সময়ের ব্যবধানে সে এখন বিবাহিত। যাকে চাইতো আল্লাহ তাকেই পাইয়ে দিয়েছেন কুহেলীকে। মনে মনে শুকিয়ে আদায় করে সে। ঘুমানোর পূর্বে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়বে ভেবে নেয়। কিন্তু ঘরে যাওয়ার সাহসই তো তার হচ্ছে না। বিয়ের আগে পরে সমারোহর সামনে যায়নি। মানুষটা রেগে আছে কিনা তাও ঠিকঠাক জানা নেই। এমনকি রাতে খেয়েছি কিনা তাও ঠিক মতো জানেনা কুহেলী। কুঞ্জা একটু আগে জোর করে সাজিয়ে দিয়েছে কুহেলীকে। শরীরে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো মায়ের লাল শাড়ি আর কোমর বন্ধনি, হাত ভর্তি বেলোয়ারের চুড়ি, খোঁপায় গুঁজা তাজা বেলী ফুলের মালা আর কোমল পায়ে জায়গা করে নিয়েছে সমারোহর দেয়া রুপোর নূপুর জোড়া! অনেকটা সময় বসে থাকার পর হঠাৎই কুহেলীর চোখ যায় উত্তরের ঘরটার জানালার দিকে। সমারোহ জানালা বরাবরই বসে রয়েছে। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে তার পানে। কুহেলীর বুক কেমন ধক করে উঠে। এতোক্ষণ সে টেরই পায়নি! সমারোহর চাহনিতে বিশেষ কোনো অনুভূতি ছিল না তবে কুহেলীর অস্বস্তিবোধ হয়।
সমারোহ অনেক্ষণ থেকেই দেখছে কুহেলীকে। ঠিক যখন এখানে এসে বসেছে কুহেলী। মৃদু হাসে সে। মেয়েটাকে কি সব অবস্থাতেই ভালো লাগে? এতো প্রিয় কেনো এই মুখ? এই চেহারা খানি দেখলেই তার চোখ দুটো এমন বেহায়াপনা কেনো করে? অদূর মরুভূমির ঝড় হতে ফিরে আসা এক ছন্নছাড়া তৃষ্ণার্ত পথিক হয়ে উঠে হৃদয়টা। এই পথিকের তৃষ্ণা যে অন্য কোথাও তা কি সর্বগ্রাসী রাজকুমারী জানে? হৃদয়ের বেদনা বাড়তে বাড়তে বিশাল ক্ষতের সৃষ্টি করে একসময়। জ্বর হয় মনের। বড্ড জ্বর হয় এই কৃষ্ণলতার চোখদুটোর ছলছল দৃষ্টিতে! সে জ্বরের উত্তাপে বুক পুড়ে ছারখার! তবু মোহ মেঘ সরে না। হৃদয় আকাশে আর ফকফকে দীপ্তিময় সূর্য উঁকি দেয় না। থমকে থাকে সমারোহ, থমকে থাকে তার হৃৎস্পন্দন! মরি মরি করেও কেনো মরা হয়ে উঠে না? অবশ্য এ সর্বনাশী আঁখিযুগলের অধিকারীনি কে হৃদয় পাশে না পেলে মৃত্যু ও হয়তো বৃথা। সমারোহ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অন্যদিনের চেয়ে বেশ পরিপাটি লাগছে আজকে তার প্রণয়ীনীকে। মোমের পুতুলের মতো শরীরে লাল রং বেশ লাগে সমারোহর। চেহারায় কোনো প্রসাধনীর ছোঁয়া নেই। তাও সুন্দর! নির্মল পবিত্রতা ঘেরা! এই ভয়ংকর সৌন্দর্য মনে বেঁধে রাখা অসম্ভব! ঝলসে দেবে সব।

কুহেলী কিছুক্ষণ পর আবার আড়চোখে দেখে জানালার দিকে। সমারোহ নেই। তপ্তশ্বাস ফেলে নিজেও উঠে আসে সে।

কুঞ্জা ট্রে’তে করে খাবার নিয়ে এসেছে সমারোহর জন্য। সমারোহ কুঞ্জাকে দেখে মিষ্টি করে হেঁসে বলে,

‘ সবার খাওয়া হয়েছে? ‘

কুঞ্জা ট্রে টেবিলের ওপরে রেখে কোমরে হাত দিয়ে বলে,

‘ বারে! নতুন জামাইকে না খাইয়ে কেউ খাবে হয় নাকি? ভাইয়া আপনি ঘর থেকে বের হননি বলে আম্মা ঘরেই খাবার পাঠিয়ে দিল আপনার জন্য। খেয়ে নিন। ‘

প্রতিউত্তরে সমারোহ হাসে, উদ্বেগহীন মুগ্ধকর হাসি! কুঞ্জা বেশ ঠাট্টা করেই বলে,

‘ আমার তো আপনাকে খুউব পছন্দ হয়েছিল। ভালোই হয়েছে আপনি এবার আমার পার্মানেন্ট ভাইয়া হয়ে গেলেন। শোনেন, আমার আপাকে কিন্তু সবসময় ভালো রাখবেন। বকা দিবেন না একদম। ‘

সমারোহর বড্ড হাসি পায় কুঞ্জা ছেলেমানুষী শাসনে। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে একহাত ভাঁজ করে সামনে এনে মাথা ঝুঁকিয়ে বলে,

‘ উমমম, ছোট রাজকন্যা যখন আদেশ দিয়েছেন তখন তো আর কোনো উপায় নেই, রাখতেই হবে! ‘

কুঞ্জা হেঁসে ফেলে। সাথে সমারোহ ও হাসে। কুঞ্জার সমারোহর খুশি থাকার বৈশিষ্ট্যটা খুব বেশি ভালো লেগেছে। সে জানে বাড়ির কারো মনের অবস্থা ভালো নেই এমনকি সমারোহর ও নেই। তাও কি সুন্দর হেঁসে হেঁসে কথা বলছে তার সাথে। হয়তো তার অবুঝ আপাকেও এভাবে খুশি রাখবে সবসময়। কুঞ্জা সমারোহকে কাগজে মোড়ানো কতগুলো তেঁতুল দিয়ে বলে,

‘ আপুকে দিয়ে দিবেন হে? অনেক খুশি হয়ে যাবে। সে আবার তেঁতুল পাইলে দিন দুনিয়া ভুইলা যায়। এই একটা জিনিস যেটা নিয়ে আপার সাথে আমার ঝগড়া লাগে। রজব ভাইকে নিয়ে গিয়ে পেরে আনছি। ‘

সমারোহ ভ্রুঁ কুঁচকে মৃদু হাসে। নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে,

‘ সব কি বোনের জন্য? আমার জন্য নেই? ‘

কুঞ্জা অবাক হয়ে‌। বলে,

‘ ছেলেরা আবার তেঁতুল খায় নাকি? আপনি খান? ‘

কুঞ্জার কৌতুহল হাসায় সমারোহকে। কুহেলীর মতোই বোকা বোকা তার কথা। সমারোহ শব্দ করে হেসে উঠলে বিচলিত হয় কু্ঞ্জা। চুপসে গিয়ে বলে,

‘ ইশঃ আপনার পছন্দের জানলে তো আরো নিয়ে আসতাম। আচ্ছা কাল এনে দেব ঠিক আছে? ‘

‘ আমি টক একদমই পছন্দ করি না। ‘

‘ আমারো তাই মনে হয়েছিল। এবার কথা না বলে তাড়াতাড়ি খেতে বসে পড়ুন তো। আপার কাছে থেকে শুনে আম্মা আপনার পছন্দের খাবারগুলো সব রান্না করছে‌। ‘

সমারোহ একবার খাবারের ট্রে’র দিকে তাকিয়ে পরখ করে নেয়। মনের ভাড় যেন একটু হালকা হলো! তার সব পছন্দ কুহেলী জানে! তারপর কুঞ্জাকে নরম গলায় শুধোয়,

‘ তোমার আপার খাওয়া হয়েছে? ‘

‘ না। আপা তো খেতেই চাইছিল না। আম্মা হয়তো খাইয়ে দিবে জোর করে। আমি যাই পানি নিয়ে আসি। ‘

‘ কুহে…। ‘

কুঞ্জা ঘর থেকে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে সমারোহ পিছু ডেকে কিছু বলতে নিয়েও চুপ হয়ে যায়‌। কুঞ্জা পেছন ফিরে জিজ্ঞেস করে কিছু বলবে কিনা, সমারোহ কিছু না বলাতে চলে যায়। সমারোহর ইচ্ছা করছে এই মুহূর্তে কুহেলীর সাথে কথা বলতে। কিন্তু কুঞ্জাকে দিয়ে ডাকালে ব্যাপারটা কেমন একটা হয় ভেবে আর কিছু বলা হয় না। কুহেলী ও হয়তো বিয়েটাতে খুশি নয়। সমারোহর ভবিষ্যতের সাজানো জীবনের ছকটুকু উল্টে পাল্টে গেছে এই এক রাতে।

বাজারের টং দোকানে বসে সিগারেট টানছে রজব। সিগারেট সে খায় না খোর্শেদের ভয়ে। জানতে পারলে বেদম মার মারবে। তবে আজ খেতে ইচ্ছে করছে, তাই খাচ্ছে। মন প্রখর তিক্ত হয়ে উঠেছে। নদীর ধার ঘেঁষে দোকানটা। নদীর কুচকুচে কালো পানির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎই অনুভব করে তার পাশে কেউ বসেছে। রজব ঘাড় কাত করে তাকিয়ে চমকে উঠে। দ্রুত হাত থেকে সিগারেট ফেলে দিয়ে মিনমিনে গলায় বলে,

‘ চাচা… আপনি রাইতে বাজারে! ‘

ভয়ে বুক ধুকপুক করেছে রজবের। এই হয়তো খোর্শেদের কথা অমান্য করার জন্য কষিয়ে এক থাপ্পর লাগায় গালে। কিন্তু খোর্শেদ তেমন কিছুই করলো না। কেবল চুপচাপ বসে রইলো রজবের পাশে। রজবের মুখে সিগারেটের গন্ধ তাই ভয়ে মুখ না খুলে সেও চুপ করে রইলো। বাজারে এখন মানুষ নেই, পিনপতন নিরবতা ঘেড়া পরিবেশ। খোর্শেদ স্তব্ধা পায়ে ঠেলে দিয়ে বললো,

‘ মাঝে মধ্যে আমরা এক বিশ্রী অবস্থাতে পইড়া যাই তাই নারে রজব? কি করন দরকার আর কি না তা বুঝার আগেই সবকিছু বদলাইয়া যায়। ‘

রজব খোর্শেদের কথার অর্থ বুঝে না। খোর্শেদ ও আজ তাকে বুঝানোর চেষ্টা করে না। রজবের দিকে এক ফালি সূক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলেন,

‘ তোরে আমি বলছি না মন খারাপ হইলে নামাজ পড়বি? আল্লাহরে ডাকবি? সিগারেট খাইলে কি মনের কষ্ট কমে? ‘

‘ আমার কিছুই ভাল্লাগতাছিল না। বাইত্তে থাকতে মনে হইতাছিল কেউ গলা টিপ্পা ধইরা রাখছে। এল্লাইগ্গা… ‘

কথা শেষ হয় না রজবের। খোর্শেদ আর কিছু বলেন না। উঠে দাঁড়ান। চোয়াল শক্ত করে বলেন,

‘ তোর চিন্তায় খুঁজতে খুঁজতে এইখানে এইলাম। ভালো লাগলে বাড়ি ফিরিস। ‘

খোর্শেদ চলে গেলে টলটল করে রজবের চোখ। আকাশের দিকে তাকিয়ে শব্দ করে কেঁদে উঠে। এই সময় বৃষ্টি নামলে সুন্দর হতো। চোখের পানি মুছে দেওয়ার কাউকে পাওয়া যেতো‌।

কুহেলী ঘরে এসে দেখে সমারোহ নামাজ পড়ছে। সাদা পাঞ্জাবি আর টুপিতে দারুন লাগছে মানুষটাকে। পবিত্র-নিষ্পাপ মুখটা যেন চোখ বুঁজে গভীর ধ্যানে আছে। কুহেলী দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। দেখতে ইচ্ছা করলেও দেখে না। এখন তো আড়ষ্টতা থাকার কারণ নেই! এই মানুষটাই হবে তার সুখে, দুঃখে, অসহায় কিংবা বৃদ্ধ মুহূর্তের একমাত্র অবলম্বন। তবে তাকে দেখতে অতো লাজের কি আছে! কুহেলীর মেজাজ বিগড়ে যায়, আরেকটু নির্লজ্জ হতে পারলো না কেনো সে? কুহেলীর ভাবনার মাঝে ছেদ পড়ে সমারোহর কথায়। সমারোহ নামাজ শেষ করে উঠে পড়েছে। কুহেলীকে দেখে গম্ভীরভাবে বলে,

‘ এখানে এসে বসো। কথা আছে তোমার সাথে। ‘

কাঁপা কাঁপা পায়ে হেঁটে গিয়ে সমারোহর ঠিক সামনে বসে কুহেলী। সমারোহ কুহেলীর দিকে না তাকিয়েই বলে,

‘ তোমাকে বিয়ের জন্য জোর করা হয়নি জানি। কিন্তু আমার মতে আমাদের বিয়েটা একেবারেই সঠিক সময়ে হয়নি। কাল পুরো গ্রামবাসীর সামনে হয়তো আমাকে অপমানিত হতে হবে। সবাই ভেবে নেবে আমরা অন্যায় করেছি তাই শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে বিয়েটা পড়িয়ে দিয়েছে। ‘

কুহেলী মাথা নিচু করে থাকে সমারোহর কথায়। সমারোহ কুহেলীর দিকে এক ছটাক সূক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে পরক্ষণেই ফিরিয়ে নেয়। রাগ হচ্ছে প্রচুর। রাগ কন্ট্রোলা করতে না পেরে ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠে,

‘ এজন্যই সবসময় বাচ্চাদের মতো‌‌ জেদ ধরতে নেই। যদি জেদ চেপে বসে না থাকতে তবে তোমাকে এখনি নিয়ে আসতে হতো না আর এমন একটা পরিস্থিতির সম্মুখীন ও হতে হতো না। কাল কি হবে ভাবতেই আমার অসহ্য লাগছে। নিজের সম্মান নিয়ে এর আগে আমায় কখনো সংশয়ে পড়তে হয়নি। আজ পড়তে হলো তোমার জেদের কারণে। ‘

কুহেলী ঘাবড়ায়। সমারোহর কন্ঠে অতিরিক্ত বিরক্তি। সমারোহ কি কুহেলীর উপর বিরক্ত? প্রিয় মানুষের বিরক্তির কারণ হওয়াটা খুবই যন্ত্রণাদায়ক। হৃদয় দংশনের উৎপত্তি এখানেই। কুহেলী না চাইতেও চোখ ছাপিয়ে জল নেমে আসে। সমারোহর এহেন ব্যবহারে সে মোটেই অভ্যস্ত নয়। মানুষটা শাসন করলেও বিরক্তি নিয়ে কথা বলেনি কক্ষণো। তাহলে কি এই মুহূর্তে সে কুহেলীকে পছন্দ করেছে না! সমারোহ কিছু বুঝে ওঠার আগেই কুহেলী হঠাৎ করে উঠে দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। সমারোহ হতবিহ্বল হয়ে বসে থাকে। খারাপভাবে না বললেও বিরক্তির রেশ ছিল তার কথায় ভাবতেই খারাপ লাগে। কুহেলী তো তাকে বলেনি নিয়ে আসতে, জোর ও করেনি। সে নিজেই নিয়ে এসেছে। তাছাড়া ঘটনার শিকার তারা দুজনেই হয়েছে। তাহলে কুহেলীকে কেনো বকলো? একটু বেশিই রুড হয়ে গেল কি সে! কাঁদিয়ে দিয়েছে মেয়েটাকে। বড্ড বেশি আঘাত পেয়েছে নিশ্চয়ই?

সমারোহর নিজের প্রতি রাগ হলেও একটা বই হাতে নিয়ে পড়তে বসে পড়ে। কুহেলী আর কোথায় যাবে, ঘুরে ফিরে তো তাকে এখন এই ঘরেই আসতে হবে! সদ্য বিয়ে হলো, আজ বাসর বলে কথা! মুচকি হাসে সমারোহ। বই হাতে নিলে সময়জ্ঞান হারিয়ে ফেলে সমারোহ। ঘন্টাখানেক হয়ে গেলেও কুহেলীর দেখা মেলে না। রাত তখন এগারোটা। বাড়ির সকলেই ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছে আর একমাত্র নাক ফুলিয়ে মুখ লাল করে বসে আছে সমারোহ। গোটা শ্বশুরবাড়ির প্রতিই চটে আছে সে। আরে ভাই, মেয়ে বিয়ে দিলেই কি কাজ শেষ নাকি? জামাইয়ের কাছে পৌঁছে তো দিতে হবে! আর তার বউ ও মাশাআল্লাহ! গেছেন তো গেছেন, আর খবর নাই। এখন এতো জেদ দেখিয়ে বিয়ে করে প্রথম রাতেই যদি শ্বশুর বাড়িতে বউকে খুঁজে ধরে বেঁধে ঘরে আনতে হয় তাহলে তো মানসম্মানের কোরবানি দিতে হবে। সেই খেয়াল কি ম্যাডামের আছে নাকি! আসলে জীবনটাই প্যাঁড়াময়!

হাঁসফাঁস করে বইয়ের একটা পাতাও পড়া হলো না আর। সমারোহর বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগে কেন যেন। কুহেলী আসছেনা বলে কি? নিজের প্রতিই রাগ হয়। কুহেলী এখানে থাকবে নাকি অন্য কোথাও এটা তার ব্যাপার। এমন তো না যে রোজ একসাথে থাকতো আজ নেই! তবে মন বড়-ই অবুঝ। তাকে বুঝ দেয়ার ক্ষমতা কোনো মানুষের আছে বলে মনে হয়না, মানুষ কেবলই মনকে দমিয়ে রাখতে জানে।

দরজায় আওয়াজ হতে হুড়মুড় করে তাকায় সমারোহ। ভেবেছে হয়তো কুহেলী। কিন্তু সমারোহর সব আশা ভরসায় জল ফেলে দিয়ে বাহির থেকে কুঞ্জা চেঁচিয়ে বলে উঠলো,

‘ ভাইয়া, ভেতরে আসবো? ‘

সমারোহ তপ্তশ্বাস ফেলে ধাতস্থ হয়ে বলে, ‘ হুম, এসো। ‘

কুঞ্জা দ্রুত ভিতরে এসে বলে,

‘ আপা নাকি দাদীমার সাথে ঘুমাবে। এই ঘরে আসতে বলাতে কান্নাই করে দিসে। ‘

সমারোহ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মুখ কুঁচকে ছোট হয়ে যায়। হ্যাঁ এটাই শোনার বাকি ছিল। না চাইতেও কাট কাট গলায় বলে,

‘ সমস্যা নেই। ‘

‘ রাতে কিছু লাগলে আমাদেরকে ডাকবেন হে? অথবা আপাকে ফোন দিয়ে। ‘

‘ আচ্ছা। ‘

কুঞ্জা চলে যায়। আর বিবাহিত সন্ন্যাসী হয়ে আবার বইয়ের মাঝে ডুব দেয় সমারোহ।

চলবে.

আকাশ মোড়ানো চিরকুট
লেখনী – সাইমা ইসলাম প্রীতি

৩৪.

টুং টাং শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় সমারোহর। চোখ পিটপিট করে তাকাতেই দেখতে পায় তার সামনে একটা মেয়ে অবয়ব দাঁড়িয়ে। মেয়েটা যে কুহেলী বুঝতে দেরি হয় না তার। আর আওয়াজের উৎপত্তি কুহেলীর ধবধবে ফর্সা হাতের বেলোয়ারের চুড়ি। রাতে পড়া লাল শাড়ি এলোমেলো হয়ে জড়িয়ে আছে কুহেলীর শরীর। হাঁটু অবধি ঘন লম্বা কেশযুগল অগোছালো! ঘুমের ঘোরেই দুষ্টু হাসি হাসে সমারোহ। কুহেলী বিছানা থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আলমারির মধ্যে কি যেন একটা খুঁজছে। কুঞ্জার উপর এই মুহূর্তে তার বেজায় রাগ। কি দরকার ছিল ওকে না জানিয়ে পাকনামি করে ওর সব জামাকাপড়, জিনিসপত্র এই ঘরে রেখে যাওয়ার! কোথায় কি রেখেছে তাও জানা নেই। সকালে উঠে গোসল করে কি পড়বে সে জামা’ই খুঁজে পাচ্ছে না। সামনে পেলেই ওই শয়তান মেয়েটাকে একটা কষিয়ে থাপ্পর মারবে বলে ঠিক করে নেয় মনে মনে। খোঁজাখুঁজির ফাঁকে একবার উঁকি দিয়ে সমারোহর দিকে দেখে নেয়, লোকটার সামনে পড়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা তার নেই। সমারোহ ঘুমের ভান ধরে শুয়ে থাকে। জামা খুঁজে পেয়ে গেলে ত্রস্ত পায়ে ঘর থেকে বের হতে নিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় কুহেলী। শাড়ির আঁচলে টান পড়েছে!‌ বুকটা ছলাৎ করে উঠে। সমারোহ তো ঘুমাচ্ছে তাহলে কি শাড়ি আলমারিতে আটকে গেল? পেছন ফিরে তাকানোর সুযোগটুকু মেলে না। আরো একবার টান পড়াতে কিছু বুঝে উঠার আগেই অকস্মাৎ কয়েক কদম পেছনে চলে আসে সে। পড়ে যেতে নিলে কোমরে ধরে ঘুরিয়ে আলমারির সাথে চেপে ধরে সমারোহ। কি হলো পুরো বিষয়টা সম্পর্কে অবহিত হওয়ার আগেই সমারোহর দুই হাতের ফাঁকে বাঁধা পড়েছে কুহেলী। তার এক হাত সমারোহর বুকের ঠিক বাম পাশে।

একটু সময় নিয়ে ব্যাপারটা ঠাওর করে কুহেলী। ততক্ষণাৎ নিজের অবস্থান টের পেয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে যায় শিরদাঁড়া বেয়ে। ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়‌। দ্রুত সমারোহর বুক থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে অস্বস্তিতে ঘনঘন চোখের পলক ফেলতে থাকে। সমারোহ গাঁ ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে কুহেলীর। কুহেলী অপ্রতিভ অবস্থার সম্মুখীন হয়। দুজনের মাঝে বাতাস চলাচলের স্থানটুকু পর্যন্ত নেই। কুহেলী কিছু বলতে যেয়ে দেখে তার গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। তার শব্দভাণ্ডার শূন্য! কন্ঠ হারিয়ে ফেলেছে সে। শরীরটা যেন অসাড় হয়ে এসেছে। সমারোহ কুহেলীর আরো একটু কাছে এসে বলে,

‘ রাতে ঘরে আসোনি কেনো? ‘

কুহেলী কিছু বলতে যেয়েও পারেনা। মনে অভিমানের পসরা সাজায়। মুখখানা বাচ্চাদের মতো‌‌ অবুঝ করে রেখেছে। সমারোহ কুহেলীর শরীরের কাঁপুনিটুকু অনুভব করতে পারে। বিষয়টা বেশ মজার লাগে তার কাছে। কুহেলীর থমকে যাওয়া থেকেই তো তার সব দুষ্টুমির শুরু! সমারোহ হালকা নুইয়ে কুহেলীর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

‘ বাসর রাতে বউয়ের উষ্ণতায় মগ্ন থাকার কথা ছিল। চারিদিকে প্রেমের উম্মাদতায় ডুবে থাকার কথা ছিল। আর তুমি কিনা আমার বাসর রাতটাই লন্ডভন্ড করে দিলে? সদ্য বিবাহিত কপোত কপোতীর মাঝে প্রেমময় ফাটল ধরানোর ধান্দা? নাহ, এ ঘোর অন্যায়। এই অন্যায় মেনে নেওয়া যায় না। ‘

সমারোহর কথায় চোখ বড় বড় করে তাকায় কুহেলী। কি বলছে সমারোহ এসব? মনে মনে নাউজুবিল্লাহ পড়ে। লোকটা কি অশ্লীল! ছিঃ ছিঃ ছিঃ!

সমারোহ একটু সরে ভ্রুঁ কুঁচকে বলে,

‘ আল্লাহকে ডেকে এখন লাভ হবে না পিচ্চি। পানিশমেন্ট পেতে হবে তোমাকে। ‘

কুহেলী ভড়কে গিয়ে বলে,

‘ পানিশমেন্ট? কেনো মাফ করে দেয়া যায় না? ‘

‘ না, প্রশ্নই আসে না! কোনো মাফ নেই। ‘

কুহেলীর এবার কান্না করে দিতে ইচ্ছা করে। লোকটা একটা জঘন্য! এমনেই তাকে বারবার অস্বস্তিতে ফেলে তারপর আবার বলছে পানিশমেন্ট দিবে। কতোটা নিষ্ঠুর হতে পারে একটা মানুষ? আর কুহেলী কিনা তাকে দয়াশীল মানুষ ভেবেছিল! কুহেলী কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,

‘ কি করতে হবে আমাকে? ‘

‘ কান ধরে উঠবস করবে একশোবার। ‘

‘ কিহ! ‘

‘ কি না জ্বি। ‘

‘ আল্লাহ, আমি চিকন-চাকন একটা মানুষ। একশো বার কান ধরে উঠবস করলে আমার আর অস্তিত্ব থাকবে বলুন? মরেই তো যাব। ‘

সমারোহ ভ্রুঁ উঁচিয়ে বলে, ‘ আমি কি জানি! রাতে পালানোর সময় মনে ছিলনা? ‘

কুহেলী ঠোঁট উল্টিয়ে অসহায় চোখমুখ করে বলে,

‘ আমি পালাইনি। আপনি বকেছিলেন। ‘

‘ এটা বকা হলো? ‘ , কুহেলীর কথায় বোকা বনে যায় সমারোহ। কুহেলী মাথা নিচু করে আহ্লাদী সুরে বলে,

‘ হ্যাঁ হলো। ‘

সমারোহ মুচকি হেসে বড় সহজ গলায় বলে,

‘ হলে হবে! তাও কোনো মাফ নেই। শাস্তি তো শাস্তিই। ‘

‘ আরেকটু সহজ শাস্তি দেয়া যায়না? ‘

‘ হ্যাঁ যায়। কিন্তু সেটা তোমার জন্য সহজ হবে নাকি লজ্জাজনক হবে তা ঠিক বলতে পারছি না। ‘

দুষ্টুমি করে কুহেলীর কানের কাছে মুখ নিয়ে টেনে টেনে কথাটা বলে সমারোহ। কুহেলীর মুখের রং উড়ে যায়। একটা ঠোঁটকাটা নির্লজ্জ লোক! এই লোককে কোনো বিশ্বাস নেই। উল্টোপাল্টা কিছু করেও ফেলতে পারে। কুহেলী চোখ বুজে জোরে শ্বাস নিয়ে বলে,

‘ উফঃ! আমি কোনো শাস্তি নিতে পারবো না। আমার দাদীমার সাথে ঘুমোতে ইচ্ছে করেছে তাই ঘুমিয়েছি। ‘

‘ শুনবে না তো? ‘

‘ না। ‘

‘ সোজাসুজি বললেই পারো তোমার আরেকটু লজ্জা পেতে ইচ্ছা করছে। তাহলে দ্বিতীয় পানিশমেন্টটাই দিই? ‘

টনক নড়ে কুহেলীর। সমারোহ আরো কাছে আসতে নিলে সমারোহর বুকে দুই হাত ঠেকিয়ে হুড়মুড়িয়ে বলে উঠে,

‘ না না না। কে বলেছে করবো না। এক্ষুনি কান ধরছি। সরুন। না সরলে উঠবস করবো কি করে? ‘

সমারোহ বাঁকা হেসে দু’কদম সরে আসে। কুহেলী আলমারির কাছ থেকে সরে গিয়ে কানে হাত দিয়ে মুখ ফুলিয়ে বলে,

‘ নাহ, এখন আমার কান ধরে উঠবস করতে ইচ্ছে করছে না। ‘

‘ তাহলে আমিও ছাড়বো না। ‘

চোখ খোঁচ করে কথাটা বলেই কুহেলীকে ধরতে যাবে তার আগেই সমারোহকে ভেংচি কেটে দৌড়ে পালায় কুহেলী। সমারোহ কুহেলীর ফাজলামি দেখে হেঁসে ফেলে।

ফজর নামায পড়ে পূর্ব আকাশে একফালি আলোর ঝিলিক দিলে ঘর থেকে বের হয়েই খোর্শেদের সামনে পড়ে যায় সমারোহ। খোর্শেদ সকালের মৃদু রোদে বই হাতে বসে ছিলেন উঠানে। অসুস্থ হওয়ার পর থেকে ডাক্তারের কথা মতো রোজ সকালের নরম রোদে বসে থাকতে হয় একঘন্টা। শরীরে জন্য উপকারী। সমারোহকে দেখে প্রসন্ন হেঁসে বলেন,

‘ ঘুম ভালো হইছে বাবা? ‘

‘ জি চাচা। আপনার শরীর কেমন এখন? ‘

‘ আমার তো ভালোই তবে এইটা কেমন কথা? তুমি এখন আমার ছেলে। চাচা কইবা কেন? কুহেলী আব্বা ডাকে তুমিও তাই ডাকবা। ‘

খোর্শেদের কথায় মুচকি হাঁসি ফোঁটে সমারোহর ঠোঁটে। নিচে বিছানো পাটিতে খোর্শেদের পাশে বসে বলে,

‘ সালিশের কি হবে? কাল বিয়ে হয়েছে জানলে তো আরো পেয়ে বসবে লোকগুলো? আচ্ছা ওই জসীম নামক লোকটার সমস্যা কি কুহেলীকে নিয়ে? ‘

খোর্শেদ ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে তাকান সমারোহর দিকে। চোখ দুটো তার ঘোলাটে। অশ্রু নয়, বার্ধক্য নেমে এলে নাকি মানুষের চোখ ঘোলাটে হয়ে অসহায়ত্বের ছাপ পড়ে। খোর্শেদের ও তাই হয়েছে। শক্ত চাহনির মুখখানি আরো মায়াবী হয়েছে। খোর্শেদ বলেন,

‘ তার একটা কুলাঙ্গার বেটাছেলে আছে। মদ গাঁজা খাইয়া পইড়া থাকে দিনরাত। নাম প্রিতুস হায়দার। তার লগে কুহেলীর বিয়ে দেওনের লাইগা আমার পিছনে পইড়া ছিল। মেয়েটা যতদিন গেরামে আছিল অতিষ্ঠ কইরা ফেলাইছে। হুমকি ধামকি দিছে অনেক। তোমার লাইগা মাইয়াটা আমার এদের হাত থেইক্কা বাঁচল। ‘

খোর্শেদ একটু থামলেন। কয়েকবার জোরে জোরে শ্বাস নেন। ইদানিং বেশি কথা বলতে পারেন না। হাঁপিয়ে উঠেন। খোর্শেদ একটু জিরিয়ে নিয়ে অকস্মাৎ সমারোহর এক হাত ধরে বলেন,

‘ বাবা আমার মাইয়াটার জেদ বেশি, একটু ছেলেমানুষী ও আছে বটে। কিন্তু মনটা ভালো। শয়তানের কুনজর থেইকা বাঁচানোর জন্য অনেক ভরসা কইরা মেয়েটারে তুইলা দিছি তোমার হাতে। ওরে আমি বকছি, মারছি, শাসন করছি কিন্তু কষ্ট দেই নাই কোনোদিন। মেয়ে মানুষ! বয়স হইছে, বিয়ে দেওন ফরজ। আল্লাহর আদেশ রাখতে আমার কলিজাটারে তোমারে দিছি। ওরে কষ্ট দিও না কোনোদিন। আগলাইয়া রাইখো বাবা। ‘

খোর্শেদের কথার পরিপ্রেক্ষিতে কি বলবে খুঁজে পায়না সমারোহ। সামান্য একটু লজ্জার মাঝেই পড়তে হয়। খোর্শেদের হাতের উপর হাত রেখে ঠোঁটে প্রাণোচ্ছল হাঁসি মেখে বলে,

‘ কুহেলীকে সবসময় ভালো রাখবো কথা দিচ্ছি। আপনার চিন্তা করতে হবে না বাবা। আপনি যেমনভাবে খেয়াল, স্নেহ দিয়েছেন, খুশি রেখেছেন সেভাবে হয়তো কখনোই পারবো না তবে আমার সবটুকু দিয়ে ভালোবাসবো। ‘

সমারোহর কথায় যেন সামান্য স্বস্তি ফিরে পায় খোর্শেদ। সঠিক পাত্রের কাছেই তার মেয়ে গিয়েছে। যদিও খোর্শেদ সমারোহকে খুব একটা কাছ থেকে দেখেননি। তবে ছেলেটার চোখের অদ্ভুত নিষ্ঠা আর প্রগাঢ় ব্যক্তিত্বের ছাপ মুগ্ধ করেছে তাকে। জহির আর তার স্ত্রীর উপরও চোখ বুঁজে বিশ্বাস করা যায়। খোর্শেদ এখন নিশ্চিন্ত। এবার কুঞ্জাকে শহরের সরকারি ভার্সিটিতে ভর্তি করতে পারলে তার আর কোনো চিন্তাই থাকবে না।

খোর্শেদকে চুপ থাকতে দেখে সমারোহ আড়ষ্টতা ভেঙে বলে,

‘ আমি ভেবেছিলাম কুহেলীকে ‌বাড়ি পৌঁছে দিয়ে চিটাগাং চলে যাব। কয়েকদিন থাকতো তারপর সান্দ্র নিয়ে যেতো। আসলে সরকারি হাসপাতালে ডাক্তারদের ছুটি পাওয়া আর আকাশ থেকে চাঁদ ধরে মাটিতে এনে রাখা এক কথা। আমার আর দুদিনের ছুটি আছে। কিন্তু এমনটা হবে বুঝতে পারিনি! ‘

খোর্শেদ বুঝতে পারেন সমারোহ কি বলতে চাইছে। প্রসন্ন হেঁসে বলেন,

‘ এখন তোমার বউকে তোমার লগেই যাইতে হইবো তাই তো! ‘

সমারোহর কাচুমাচু হয়ে অস্ফুট স্বরে বলে,

‘ না আসলে আম্মা বলছিল যাতে কুহেলীকে এই অবস্থায় ফেলে না যাই‌। ‘

ঘামছে সমারোহ। এতো লজ্জা লাগছে কেনো কুহেলীকে নিয়ে কথা বলতে তার? এমনটা আগে লাগতো না। হয়তো সব শ্বশুরের সামনে তার মেয়েকে নিয়ে কথা বলতে জামাইদের লজ্জা হয়। না হওয়াটাই অস্বাভাবিক। খোর্শেদ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলেন,

‘ ঝামেলা শেষ হইলে কুহেলী তোমার লগেই যাক এইটা আমিও চাই। আল্লাহ জানে আজকে কি হইবো। ‘

সমারোহ নিশ্চুপ থাকে। খোর্শেদ একটু পর স্কুলে চলে যান। রজব রায় বাজার করতে‌। বোনের বিয়ের খুশিতে কুঞ্জা স্কুলে যায়নি। সূর্যের কিরণ আরো একটু প্রখড় হতেই পুকুরে গোসল করতে যায় দুজন। পুকুরের সবুজ পানি উষ্ণ আর শীতলের মাঝামাঝি। দুই বোন ইচ্ছামত দাপাদাপি করে পানিতে।

আনরুবাকে দু-তিনবার ফোন করতে গিয়েও মোবাইলের নেটওয়ার্ক পায়না সমারোহ। গ্রামে এই এক সমস্যা। একদম ভোরে অথবা রাত এগারোটা বারোটার পর একটু নেটওয়ার্ক ভালো পাওয়া যায়। আর অন্য সময় যাচ্ছে তা অবস্থা। বাহিরে নেটওয়ার্ক ভালো পাবে ভেবে বের হয়ে বাড়ির পেছনের দিকে গিয়ে দাঁড়ায় সমারোহ। তারপরও নেটওয়ার্ক ভালো পাওয়া যায় না। কোনো রকমে দরকারি কথা শেষ করতে হয়। ফোন রাখতেই কানে আসে খিলখিল হাঁসির শব্দ। চুপ করে দাঁড়িয়ে সমারোহ বুঝার চেষ্টা করে হাসিটা কার‌। কুহেলী আর কুঞ্জার! আওয়াজ লক্ষ্য করে পুকুর পাড়ে গিয়ে থমকে যায় সমারোহ। দুই বোনের খুনসুটিতে হেঁসে ফেলে সে নিজেও। কুহেলীকে দেখার তার শেষ হয়না তাও একপ্রকার জোর করেই চলে আসে সেখান থেকে!

কুহেলী গোসল সেরে রমলার ঘরে চলে এসেছে জামা বদলাতে। এসেই ভ্রুঁ কুঁচকে যায় মাথা গরম হয়ে যায়। সকালে সমারোহর সাথে এতো যুদ্ধ করে জামা কাপড় এনে এখানে রাখলো আর এখন জামা উধাও? জামার কি হাত পা আছে নাকি? কুহেলী ঘর থেকে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,

‘ দাদীমা, আমার জামা সরিয়েছো বিছানা থেকে? ‘

রমলা উঠানেই বসে ছিলেন। একটু আগে পালংশাক তুলে এনে রান্নার জন্য তৈরি করছেন এখন। কুহেলীর কথা শুনে চেঁচিয়ে উঠে বলেন,

‘ নাতো, দেখ ভালা কইরা যেনে রাখছোস হেনেই থাকবো। আর কই যাইবো। ‘

কুহেলী এবার বিরক্ত হয়ে ভালো করে খুঁজতে থাকে। পেছনে দরজায় মৃদু আওয়াজ হওয়ায় ভাবে হয়তো দাদীমা এসেছে। তাই ততটা পাত্তা দেয় না। বিছানা, আলনা, ছোট জামা রাখার তাঁক সব খুঁজেও জামা না পেয়ে পেছন ফিরতে ফিরতে বলে,

‘ ধুর, পাচ্ছিই তো না। আমি এখানেই…। ‘

কুহেলী কথা শেষ করার আগে ভয়ে ‘ ওমা ‘ বলে খাটের হেডবোর্ডের সাথে ধাক্কা খায়। আবার সমারোহ! সে শরীরের সাথে লেপ্টে থাকা ভেজা জামা কাপড় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এর মধ্যেই লোকটার আসতে হলো? হায় খোদা! মুখখানা প্যাঁচার মতো করে খাটের দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে থাকে কুহেলী। দরজার দিকে একবার তাকিয়ে দেখে দরজা আটকানো। সমারোহ হাসছে। সমারোহর হাঁসি দেখে যেনো তার পিত্তি জ্বলে যায়। শয়তান বেশরম লোক একটা। নারী জাতি হয়তো তার জন্য লজ্জায় নির্বাসনে চলে যাবে। আরে না না, নারী জাতি না, কুহেলী নির্বাসনে চলে যাবে। গায়ের উরনা দিয়ে শরীরটা আরো ভালো করে ঢাকার চেষ্টা করে কুহেলী‌। ঠোঁট উল্টে বলে,

‘ এই আপনি আজ সারাদিন আমার পিছু পিছু কেন ঘুরছেন হ্যাঁ? ‘

সমারোহ ভালো করে একবার পরখ করে নেয় কুহেলীকে‌। এর আগে যেদিন এভাবে দেখেছিল সেদিন নিজের দৃষ্টি সংযত করতে হয়েছিল। অথচ এখন সে মানুষটা তার। চাইলেই তাকে অপলক দেখা যায়! সমারোহ সন্দিহান কন্ঠে বলে,

‘ আমি ঘুরছি নাকি তুমি? ভোরেও তুমি এসেছিলে। আর এখনো তুমিই জামা খুঁজছিলে। আমার ঘরের আলমারিতে ছিল। তাই আমি তো কেবল সাহায্য করতে এলাম। তোমার না দরকার হলে চলে যাচ্ছি! ‘

কুহেলী বেশ বুঝতে পারে জামাটা সমারোহ সরিয়েছে ইচ্ছা করে। বাধ্য হয়ে তাই বলে,

‘ অনেক ধন্যবাদ এতো সাহায্য করার জন্য। দিন জামা। ‘

সমারোহ বিছানায় সাদা আর বেগুনী মিশেল একটা শাড়ি রেখে বলে,

‘ এখন থেকে সবসময় শাড়ি পড়বে। ‘

কুহেলী অবাক হয় সমারোহর কান্ডে। মনে মনে ভাবে হয়তো লোকটা পাগল হয়ে গেছে। এমন অদ্ভুত কাজকর্ম এর আগে কখনোই করেনি। সমারোহ শাড়ি রেখে চলে যেতে নিয়েও আবার ফিরে আসে। কুহেলী ভয়ে এবার আরো পিছিয়ে গিয়ে ছোট্ট একটা আলমারির সাথে লেগে দাঁড়ায়। সমারোহ এক হাত আলমারিতে রেখে খুব যত্ন করে কুহেলীর গলায় লেপ্টে থাকা চুল সরিয়ে দিয়ে মোহময় অনুভূতি কন্ঠে ঢেলে বলে,

‘ ভেজা শাড়িতে নারী সবচেয়ে আবেদনময়ী। এর আগের বার চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিলাম আর এবার ছেড়ে দিচ্ছি। এর পর এভাবে আমার সামনে পড়লে…। থাক আর না বলি, আই হোপ ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড। ‘

বাঁকা হেসে ঘর থেকে চলে যায় সমারোহ। কিন্তু কুহেলী তার জায়গায় জমে গিয়েছে। তাহলে সেদিন সুইমিং পুলে যে ছায়া ছিল সেটা সমারোহর ছিল! মুহূর্তেই লজ্জায় মূর্ছা যায় কুহেলী। এভাবে আর কতোবার মরবে সে!

চলবে.