আকাশ মোড়ানো চিরকুট পর্ব-৩৮+৩৯

0
497

আকাশ মোড়ানো চিরকুট
লেখনী – সাইমা ইসলাম প্রীতি

৩৮.

পূর্বাকাশে সূর্যের মৃদু আভা ফুটেছে কেবল। শুভ্র ধোঁয়াশার ন্যায় কুয়াশার মখমলে চাদরে আবৃত তখনো প্রকৃতি। বিভাবসুর আলোক খেলা তখন মোলায়েম! দিনের সবচেয়ে স্নিগ্ধতা মাখা প্রহর। পাতলা চাদর গাঁয়ে দিয়ে খোলা আকাশের নিচে বিমর্ষ চেহারায় দাঁড়িয়ে আছে কুহেলী। কুঞ্জার কবরের উপর শিউলির গাছটা বেশি বড় হয়নি। অসময়ে ফুলও ফুটেছে গাছে। গুনে গুনে সতেরটা ফুল, বাতাসে দুলছে। কুঞ্জার হাসিও শিউলি ফুলের মতো ছিল। কুঞ্জার মৃত্যুর পর মাস তিনেক কেটে গিয়েছে চোখের পলকেই। কুহেলীর মাঝে প্রবল আঁচড় কেটে গেছে কুঞ্জার মৃত্যু। বোন হারা সে নিজেকে ভাবতেই পারে না এখনো। কুঞ্জার পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট আসার পরপরই গ্রেফতার করা হয়েছিল জসীম আর পলাশ হায়দারকে। সোলায়মান এখনো পলাতক। জসীম প্রভাবশালী মানুষ! তাকে ধরাটা এতোটা সহজ হতো না যদিনা কুঞ্জার পেট থেকে পলাশের লকেট পাওয়া যেতো। পুলিশের ধারনা কুঞ্জা ইচ্ছে করে পলাশের লকেট গিলে নিয়েছিল যাতে তারা কোনো ক্লু পায়। গতকাল কুঞ্জার মামলার রায় দিয়েছে। সোলায়মান নামক জল্লাদ লোকটার মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে, যদিও তাকে আর খুঁজে পাওয়াই যায়নি। জসীম আর পলাশের যাবৎ জীবন কারাদণ্ড আর অবৈধ কাজে জড়িত থাকার জন্য প্রিতুসের চার বছরের জেল হয়েছে‌। কুহেলী খুশি, সে মৃত্যুদণ্ড চায়নি। ওই জানোয়ার লোকগুলোর অন্ধকারে কুৎসিত-কিটের সঙ্গে পরে ধীরে ধীরে মরা উচিত এদের। কুহেলী এই চার মাসে রোজ ভোরে কুঞ্জার কবরের কাছে এসে রক্তজবার মালা রেখে গেছে। জবা ছিল কুঞ্জার খুব প্রিয়। রোজকার দিনের সকল কথা এসে বলতো কবরের পাশে বসে। যেন কুঞ্জার সাথেই গল্প করছে‌। আজ বোনের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কুহেলী বলে,

‘ তোকে কষ্ট দেয়া লোকগুলোর শাস্তি হয়েছে বোন। তুই হয়তো একটু হলেও খুশি হবি। তোকে অনেক কষ্ট পেতে হয়েছিল নারে বোন! আমি অনেক খুশি ওই লোকগুলোর যন্ত্রণা দেখে। কিন্তু জানিস বোন, আজ আমার মনটা বড্ড খারাপ। তোকে একা রেখেই আমাকে অনেক দূরে চলে যেতে হবে। যেদিন প্রথম বাড়ি ছেড়ে গিয়েছিলাম, তুই উঠানে হাত-পা ছড়িয়ে বসে কেঁদেছিলি। আমার বুক ফেটে যাচ্ছিল তোকে আম্মাকে চেড়ে যেতে। এবার আমায় আটকাবি না? বোন, বোনরে আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে! তোকে ছাড়া প্রতিটা দিন ফ্যাকাসে লাগে আমার। আব্বা একদম চুপ হয়ে গেছে জানিস! কথা বলে না, আম্মার সুন্দর চোখ দুটাতে বয়সের ছাপ পড়ে গেছে। এই তিন মাসে তিন বছরের বয়স বেড়েছে আম্মার। তোরে ছাড়া ভালো নাই আমরা। ‘

কুহেলী চিৎকার করে কাঁদে। বড় রাস্তার পাশে কবরস্থানে কুঞ্জার কবর। রাস্তা দিয়ে দুএকজন মানুষ যাওয়ার সময় কুহেলীকে দেখে আফসোস করে। অবলীলায় বলে চলে, মেয়েটার কষ্টতে খারাপ লাগে‌। খোর্শেদের মেয়েটার সাথে এতো খারাপ হলো কেন? কেউ কেউ আবার কুঞ্জিকেই দোষী মনে করে। বাড়ন্তি মেয়ে, টইটই করে গেরামে ঘুরবো কেন? বেটাগো নজর তো তাইলে পরবোই। গ্রামের কারোরই এখন ততো মাথাব্যথা নেই। খোর্শেদ বাড়ি গেলে কেবল সবার দরদ উঠলে উঠে।

সান্দ্রর সঙ্গে সেঁজুতি এসেছে কুহেলীকে নিয়ে যেতে। কুহেলীর আরো কিছুদিন থাকার কথা ছিল গ্রামে। কিন্তু ওদিকে সমারোহ বাড়ি ফিরে গিয়েই অস্থির হয়ে গিয়েছে কুহেলীকে নিয়ে আসার জন্য। বিদেশে যাওয়ার জন্য পড়াশোনা, পরীক্ষা, কাগজপত্র গোছগাছ সবমিলিয়ে মহা ব্যস্ত সে। অবশেষে অনেক পরিশ্রমের পর আমেরিকার স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি অফ মেডিসিন, মেডিসিনে পিএইচডি এবং মাস্টার্স করার সুযোগ পেয়েছে সমারোহ। দুমাসের মধ্যে সকল ডকুমেন্টস জমা দিয়ে ভর্তির জন্য চলে যেতে হবে। কুহেলীকে না দেখে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব না। তার অস্থিরতা দেখে আনরুবা সান্দ্রকে বলে কুহেলীকে বাড়ি নিয়ে যেতে। রজব শহরের স্টেশন থেকে এগিয়ে নিয়ে এসেছে তাদের। অনেক বড় জার্নি করে ক্লান্ত দুজনা। বাড়ির সকলের সঙ্গে কুশল বিনিময় করে ঘরে গিয়ে রেস্ট নিচ্ছিল সেঁজুতি। কুহেলী তার ঘরের সামনে গিয়ে বিনয়ের সুরে বলে ,

‘ আপু আসবো? ‘

‘ আরে আসো আসো কুহেলী‌। কতোদিন দেখিনি তোমাকে। কেমন আছো বোন? ‘

‘ আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি আপু? ‘

‘ আল্লাহর রহমতে অনেক ভালো। ‘

সেঁজুতি আলতো করে জড়িয়ে ধরে কুহেলীকে। কুহেলীর চেহারার কালসিটে হয়ে গিয়েছে। চোখের নিচে গাড় কালি। দুর্বলতা ছেড়ে ধরেছে শরীর জুড়ে। এই কুহেলীই কি সেদিন তাদের বাড়িতে গিয়েছিল একঝলক হাসি নিয়ে? এই চোখজোড়াই কি তার ভাইয়ের হৃদয় নাড়া দিয়েছিল? বিশ্বাস হয় না সেঁজুতির। খারাপ লাগাটা ঢোক দিয়ে গিলে নিয়ে মুখে বিস্তর হাঁসি ফুটিয়ে সেঁজুতি বলে,

‘ বয়সে ছোট হলে কি, তুমি তো এখন আমার বড় ভাইয়ের বউ, সম্পর্কে বড় বলে কথা। ভাবী বলে ডাকতে হবে। ‘

‘ আপু কি সব যে বলো! তুমি কুহেলী বলেই ডাকবে। ‘

কুহেলী লজ্জা পায় সেঁজুতির কথায়। সেঁজুতি ফোড়ন কেটে বলে,

‘ আচ্ছা ভাবী আমার ভাইটাকে কোনো জাদুটোনা করোনি তো! বাড়ি যেয়ে তো কুহেলী কুহেলী করে পাগল হয়ে গিয়েছে একদম। কেমন দেখলে আমাদের ঠেলে পাঠালো তোমাকে নিয়ে যেতে! ‘

কুহেলীর লজ্জা আরো বেড়ে যায়। পরক্ষনেই আবার খারাপ লাগে। এতোই ব্যস্ত সে যে এই তিন মাসে একটা ফোনকলও করলে পারেনি! তার আম্মা আব্বার সঙ্গে তো ঠিকই কথা বলেছে। কুহেলীকে নিয়ে যাওয়ার সময়টুকুও হয়নি তার? কুহেলী মিনমিনে গলায় বলে,

‘ উনি কি খুব বেশি ব্যস্ত আপু? ‘

সেঁজুতি টিপে টিপে হাসে।বলে, ‘ স্ট্যানফোর্ড এর মতো ইউনিভার্সিটিতে চান্স পাওয়া কতোটা টাফ তো জানোই। ভাইয়া আসলেই ব্যস্ত ছিল। এতো দিন পহতে পড়তে জান ছিল না আর এখন সব সার্টিফিকেট, মার্কশিট, ভিসা এসব নিয়ে দৌড়াদৌড়ি। দুমিনিট বসে জিড়াবার জোঁ নেই। বাড়ি গেলেই দেখতে পাবে সব। ‘

‘ কবে যাব আমরা? ‘

‘ ভাইয়া বললো কালই যেন রওনা দেই। আমার শরীরের এতো জোর নেই বাবা। পরশু যাব। ‘

‘ কয়েকদিন থাকলে হতো না? মানে এসেই চলে যাবা! ‘

সেঁজুতি কিছু বলার আগেই তার মোবাইলে সমারোহর কল আসে। মিনিট খানেক কথা বলে সেঁজুতি। কুহেলী ভেবেছে হয়তো তাকেও চাইবে, একটু কথা বলবে। মানুষটার কন্ঠ একটুখানি শোনার জন্য কুহেলীর ভেতরে কি তোলপাড় বয়ে চলে সেটা কি সত্যিই সে বুঝে না?
কিন্তু না, কুহেলীকে ভুল প্রমাণ করে সমারোহ কল কেটে দিয়েছে। সেঁজুতি কথা বলবে কিনা জিজ্ঞেস করার পরও সে কথা বলেনি। কুহেলীর তোর বেদম কান্না পায়।

ফোন রেখেই সেঁজুতি কেমন গাল টিপে হেসে তাকায় কুহেলীর দিকে। সেঁজুতির চাহনি মোটেই ভালো ঠেকায় না কুহেলীর কাছে। কুহেলীর কাছে গিয়ে ফিসফিসে সে বলে উঠে,

‘ যাওয়ার কথা আমাকে না বলে তোমার জামাইকে বুঝাও গিয়ে। সে তো মনে হয় বউ দিওয়ানা হয়ে গেছে। ‘

কুহেলী বুক ভরা অভিমান চেপে গিয়ে ভাঙ্গা গলায় বলে, ‘ যাওয়ার পর একটা কল করে খবর নেয়নি তিনি নাকি আবার আমাকে দেখতে চাইবে! হাস্যকর লাগলো। কয়দিন পর চলে যাবে তো, সেখানে বউ না থাকলে কেমন দেখায় তাই ফর্মালিটি দেখাচ্ছে আরকি। ‘

কথাটা বলেই দ্রুত সেখান থেকে চলে যায় কুহেলী‌। সেঁজুতির পেট ফেটে হাসি আসে। তার ভাইকে যে এই মেয়ে ঠিক কতোটা পাগল বানিয়েছে এটা শুধু সে আর মা জানে। এই কয়েকটা দিন একটু পর পর তাকে আর মাকে দিয়ে ফোন জোরজুলুম করে কুহেলীর খবর নেওয়েছে সমারোহ। রাতের পর রাত নির্ঘুম কাটানো, নাওয়া খাওয়া ভুলে বইয়ে মুখ গুঁজে পরে থাকা, এতো প্রতিক্ষা আর কঠোর সাধনার করে লক্ষ্যে পৌঁছানোর পর আমেরিকা চলে যেতে হবে শুনেই মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল তার। এতোটা আনন্দের মাঝেও মায়ের কোলে মাথা রেখে অঝোরে কেঁদেছে তার ভাই। কারনটা, কুহেলীকে ছাড়া এতো দূরে কি করে যাবে সে! ভালোবাসা ছেড়ে যাওয়া যে কৃষ্ণ আকাশের ধূসর মেঘে তারার সৌন্দর্য ডেকে দেয়ার মতো বিষাদের। সেঁজুতিও তো একসময় সেই বিষাক্ত অনুভূতির ছোবলে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল। হাফ ছাড়ে সেঁজুতি। এই সময়টা সুন্দর। প্রেমে সিক্ত সে। হিরণের কোমল প্রেমে।

রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে উঠানে বসে টুকটাক গল্প করছিল সবাই। সান্দ্রর রসিকতায় খোর্শেদ বাড়ির মানুষগুলো অনেকদিন বাদে প্রাণ খুলে হেসেছে। হিরণের ফোনের জ্বালায় এক মুহুর্ত শান্তিতে বসে গল্প করতে পারেনি সেঁজুতি। এখানে আসছে পর থেকে একটু পর পর কল করেই যাচ্ছে। কুহেলীর কাছে ব্যাপারটা দারুন লাগে। ছোট ছোট কেয়ারিং গুলো আসলেই সুন্দর। এতো কলে বিরক্ত হয়ে অবশেষে সবার মাঝখান থেকেই ঘরে চলে আসে সেঁজুতি। মোবাইল কানে তুলেই কপট রাগ দেখিয়ে বলে,

‘ এই কি শুরু করলাটা কি হে? তোমাকে মেসেজে বললাম না সবার সামনে আছি? কি একটা অবস্থার মধ্যে পড়তে হলো সবার সামনে! ‘

‘ তুমি জানো না তোমাকে ছাড়া আমি ঘুমাতে পারি না? ‘

হিরণের এক কথায় সেঁজুতির সব রাগ উবে যায়। তারপরও কন্ঠে তেজ মিশিয়ে বলে,

‘ একদম না হে। একদম ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করবা না বলে দিলাম। খারাপ লোক একটা। ‘

‘ ওকে। এমনে বললা তো! আর ফোন দিব না যাও। ‘ হিরণের কথায় অভিমান উপছে পড়ছে। তবে এই মুহূর্তে তাকে একদমই পাত্তা দেয়া যাবে না। তাহলে দেখা যাবে আরো পাগলামি শুরু করেছে। সেঁজুতি অবলিলায় বলে,

‘ হ্যা দিও না। আমি বলছি দেও? ‘

‘ সত্যিই দিব না কিন্তু। ‘

‘ সাহসও করবেনা সেটার। ‘

‘ ভয় পেলাম ম্যাডাম। ‘

সেঁজুতি হেঁসে ফেলে। হিরণও হাসে। হঠাৎই ফোনের দুই প্রান্তের মানুষের মাঝে নিরবতা কাজ করে। হিরণ কিছুই বলছে না। সেঁজুতির ও কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না। হিরণের নিঃশ্বাসটুকুও শুনতে পাচ্ছে সে। বেশ কিছু সময় এভাবেই চুপচাপ কেটে গেলে সেঁজুতি আমতা আমতা করে বলে,

‘ শুনুন! ‘

‘ হুঁ ‘

‘ খেয়েছেন ঠিক মতো? খাবার গরম করে নিয়েছিলেন খাওয়ার আগে? ‘

‘ ঠান্ডাই খেয়ে ফেলেছি। ‘

‘ এমা কেনো? আপনি না ভাত ঠান্ডা হয়ে গেলে খেতে পারেন না। গরম করতে না পারলে মাকে বলতেন করে দিতো। ‘

‘ উঁহু, যেটা এখন তুমি করো সেটা তুমিই করবে। তুমি না থাকলে সে কাজ আর কাউকে করতে দিবনা। ‘

‘ হ্যা বুঝেছি‌। আমাকে নিজের কাছে আটকে রাখার ধান্দা। ‘

সশব্দে হেঁসে উঠে হিরণ। শীতল কন্ঠে বলে, ‘ কেনো? চাওনা নাকি! ‘

‘ খুব করে চাই। ‘

‘ মিস করছি। ‘

‘ আমিও। ‘

‘ তাহলে গেলে কোনো? ‘

‘ আপনি আসতে দিলেন কেনো? ‘

‘ ভালোবাসি বলে কি তোমার স্বাধীনতা আটকে রাখবো নাকি। ‘

‘ হয়েছে হয়েছে এখন এতো ঢং করতে হবে না। আমাকে ছাড়া থাকতে পারেন না আবার নিজেই ঠেলে পাঠালেন। ‘

‘ চলে আসবো কাল? ‘

‘ একদম না। পরশুই তো আসছি। ‘

‘ আরো দুটা দিন‌। আমি পারবোনা। প্লিজ, কাল সকালে বাসে উঠলে সময় লাগবে না বেশি। ‘

‘ পাগলামি নাকি! এমন উদ্ভট কাজ মোটেই করবেন না। ফোন রেখে ঘুমান এখন কাল অফিস আছে। সকালে তুলে দিব? ‘

‘ নাহ। উঠবো না সকালে। ‘

‘ অফিস ছুটি? ‘

‘ না। ‘

‘ তাহলে? ‘

‘ তুমিহীনা সকাল ফ্যাকাশে লাগে গো প্রাণহরিণী। কেনো যে কিছুই বুঝো না! ‘

‘ ধ্যাত! আপনার মতো পাগল লোকের সঙ্গে কথা বলাই ভুল। সকালে তুলে দিব আমি। রাখলাম। ঘুম পেয়েছে আমার। ‘

‘ ভালোবাসি। ‘

‘ হিহিহি। আমিও ভালোবাসি। রাখলাম। ‘

ফোন রেখে লজ্জায় লাল হয়ে যায় সেঁজুতি। শেষে কেমন পাগল লোকের পাল্লায় পড়লো সে!

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে লম্বা নিঃশ্বাস নেয় নয়না। অন্যান্য দিনের চেয়ে আজকে তাকে আরো বেশি আত্মবিশ্বাসী লাগছে। সাদামাটা সেলোয়ার কামিজ আর মাথায় জড়ানো জর্জেটের হিজাব। হাতে কালো ফিতার ঘড়ি। আজ তাকে বিসিএস ভাইভা বোর্ডে ডেকেছে। নিজেকে একদম পারফেক্ট আর পরিপাটি ভাবে প্রেজেন্ট করতে হবে সবার সামনে। তার সর্বোচ্চটা দেয়ার জন্য সে প্রস্তুত। গত কয়েকমাসে অনেক অনেক পরীক্ষা সে দিয়েছে। একটাতে টিকেছে কেবল। তবে মন মতো হয়নি চাকরিটা। ছোটখাটো কিছু করার ইচ্ছা নয়নার নেই, অনেক বড় হতে হবে তাকে। তার সন্তানের জন্য, সমাজের আর বাকি আট-দশটা মেয়ের ভরসা, শক্তি হওয়ার জন্য। এই সমাজে মেয়েরা প্রতিষ্ঠিত না হতে পারলে খুব অসহায়। সে অসহায় হবে না! নয়না আয়নার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বিড়বিড় করে বলে,

‘ নয়না অনেক বড় হবে। সকল মানুষের অহংকার ঝুঁকে পড়বে নয়নার যোগ্যতার সামনে। ‘

চলবে.

আকাশ মোড়ানো চিরকুট
লেখনী – সাইমা ইসলাম প্রীতি

৩৯.

রৌদ্র উজ্জ্বল সকালে চিটাগাং শহরে পা রাখে কুহেলী। এতো দিন গ্রামে থাকার পর হাসনাহেনা কিছুতেই ছাড়তে পারছিল না কুহেলীকে। তবে মানুষ জাতির নিয়ম যে বড়ই অদ্ভুত! প্রিয় মানুষগুলোকে ভালো রাখতে, ভালোবাসতে তাদের থেকেই দূরে সরে যায় বারংবার। বাড়ি আসার পর কুহেলীকে দেখে খুশিতে আত্মহারা হয়ে গিয়েছেন আনরুবা। কুহেলীও দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে তাকে‌। ফিসফিসিয়ে বললে,

‘ আমি তোমাকে খুব মিস করেছি আন্টি। রোজ তোমার কথা মনে পড়তো আমার। ‘

‘ আহারে আমার মা রে! আমি কি তোকে কম মিস করছি? যা এখন ঘরে গিয়ে গোসল করে নিচে আয় ঝটপট। সারাটা দিন জার্নি কইরা চেহারার কি অবস্থা তাকানো যায় না। নিজের হাতে খাওয়া দিব তোরে আজকে। ‘

কুহেলী হালকা হেসে সম্মতি জানায়। পুরো ঘরটা একবার চোখ বুলিয়ে নেয়। সমারোহ নেই। সে এসেছে জেনেও এখানে থাকা কি তার উচিত ছিল না! নয়নাও কুহেলীকে দেখে এগিয়ে এসে হালকা হাতে জড়িয়ে ধরে। কুহেলী বলে উঠে,

‘ কেমন আছো আপু? ওফ! কবে আসবে বাবুটা, আমি এক্সাইটেড। ‘

কুহেলী প্রফুল্ল হয়ে বলে কথাটা। কিন্তু পাঁচ ছয় মাস আগের কুহেলী আর এই কুহেলীর মাঝে চরম ব্যবধান খুঁজে পায় নয়না। এই কুহেলীর হাসি ঘন কালো মেঘে ছেয়ে যাওয়া আকাশের ন্যায়। আগের মতো উজ্জ্বল কিরণ নেই তার চোখে। উচ্ছ্বাস নেই ঠোঁটের কোণে। নয়নার বড্ড মায়া হয়। কুহেলীর কাছে গিয়ে বলে,

‘ দ্রুতই আসবে। নিজেকে জোর করে সবার সামনে হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করো না, সত্যিকারের আনন্দ হারিয়ে ফেলবে তাহলে। যা আমাদের ভাগ্যে আছে তা হবেই। সময়ের সঙ্গে বয়ে যেতে দাও নিজেকে। জীবনের নেগেটিভ সাইড ভুলে গিয়ে পজেটিভটা দেখো আর আল্লাহর উপর আস্থা রাখো। যা হবে সব ভালো হবে। ‘

কুহেলী আর কিছু বলার সুযোগ পায় না। সেঁজুতি তাকে নিয়ে উপরের ঘরে চলে যায়। নিজের ঘরে গিয়ে লম্বা শাওয়ার নিয়ে বের হতেই দেখে সমারোহ ও তার ঘর থেকে বের হয়েছে মাত্র। সমারোহ মুচকি হাসে কুহেলীকে দেখে। মৃদু পদক্ষেপে তার দিকেই এগিয়ে আসে। সমারোহকে দেখে কুহেলীর ভেতর কেঁপে উঠে। কতোগুলো দিন পার হয়ে গেছে মাঝে। সমারোহ ঠিক আগের মতোই আছে। হাসিটাও ঠিক আগেরই মতো ভয়ংকর মায়াবী। পরিবর্তন কেবল চোখে পাতলা চকচকে সোনালী ফ্রেমের চশমাটা। আচ্ছা উনি এখন রোজ চশমা পড়েন? কুহেলী চোখ সরিয়ে নেয় সমারোহর কাছ থেকে। তারপর দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে। এই মুহূর্তে লোকটার সাথে কথা বলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছাও তার নেই। যে মানুষ তাকে ভুলে এতো দিন কাটাতে পারে তার সাথে আবার কিসের কথা! কুহেলী নিজেকেই মনে মনে বকতে শুরু করে। সমারোহ তাকে বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছিল, তাহলে এতো অধিকারবোধ আসছে কেনো তার সমারোহর প্রতি? স্বামী-স্ত্রী হলেও তো তাদের মাঝে প্রেমের সম্পর্ক নেই তবে কেনইবা সমারোহ তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতো! তবুও মনকে বুঝ দিতে পারে না কুহেলী। হৃৎপিণ্ডের ভেতরটা যেন আগ্নেয়গিরির জলন্ত লার্ভার ন্যায় পুড়ে। গলা বেয়ে একটা চিনচিনে ব্যাথা নেমে গিয়ে গ্রাস করে তাকে। এই যন্ত্রণা বড়ই বেহায়া।

আনরুবা নিজ হাতে খাইয়ে দেন কুহেলীকে। জমিয়ে রাখা কথার ঝুড়ি খুলে বসে ভুলেই যান এতবড় জার্নি করে কুহেলীর এখন রেস্ট দরকার। জড়তা আর লজ্জার কারণে গ্রাম থেকে ফিরে কুহেলীর সাথে কথাই বলেনি সমারোহ। অবশ্য ব্যস্ততাও ছিল আকাশ ছোঁয়া। তবে ম্যাডাম যে বেজায় রেগে আছেন তার হদিস অলরেডি সে পেয়ে গিয়েছে। ঘরে অস্থির হয়ে বসে থাকে সমারোহ কখন কুহেলী উপরে আসবে! উঠে দ্রুত পদক্ষেপে পাইচারি করে কতক্ষন। মনের ভেতর তার উথালপাথাল চলে। আচ্ছা, কুহেলী কি এখন থেকে তার ঘরেই থাকবে, তার সাথে? নাকি আগের ঘরে! নাহ আগের ঘরে কেনো থাকতে যাবে, তার সঙ্গেই থাকবে। আচ্ছা এই ঘরটা তার পছন্দ হবেতো! অনেককিছু চেঞ্জ করতে হবে ঘরের। কতশত চিন্তায় সমারোহর অস্থিরতা ক্রমাগত বাড়তেই থাকে। নাহ, এভাবে আর হবে না। এতো অপেক্ষা নেয়া যায় না। টেবিলে থাকা জগের সবটুকু পানি ফেলে দিয়ে পানি আনার বাহানা করে আসে নিচে। আনরুবা তখনও কুহেলীর সাথে গল্পে মগ্ন। সমারোহ জগে পানি নিতে নিতে ভ্রুঁ সঙ্কুচিত করে বলে,

‘ আম্মু কুহেলীর এখন একটু বিশ্রাম দরকার না? তুমি এখনই শুরু করে দিলা! ‘

সমারোহর কথা শুনে আনরুবা হেলেদুলে বসে। অস্ফুটস্বরে বলে উঠেন, ‘ তাইতো! ভুইলাই গেছিলাম। এতো দিন পর দেখছি তো মা’টারে। যাও মা ঘরে যাও। একটু ঘুমাইয়া নিও পারলে। ‘

কুহেলী মাথা নেড়ে উঠে যেতেই আনরুবার চোখ পরে সমারোহর উপর। টমেটোর মতো মুখ ফুলিয়ে গোলগাল চোখে চেয়ে আছে আনরুবার দিকে। আনরুবা ছেলের মনের ভাব বুঝতে পেরে হেসে ফেলেন। সমারোহকে চোখে কিছু ইশারা করতেই সমারোহ হনহনিয়ে কুহেলীর পাশ কাটিয়ে চলে যায়। আনরুবা কুহেলীকে পেছন থেকে ডেকে বলেন,

‘ দেখো মা, আমার বড় ছেলে সমারোহ। অনেক ইচ্ছা ছিল বড়সড় করে বিয়ে হবে তার। কিন্তু ছেলের বিয়েতে থাকার সৌভাগ্যই আমার হলো না। তবে বিয়ে যখন হয়েছে এখন থেকে তুমি সমারোহর ঘরেই থাকবা। তোমার ঘর থেকে জিনিসপত্র পরে গোছগাছ করে নিও। এখন সমারোহর ঘরে গিয়েই রেস্ট নাও‌। ‘

কুহেলী হিতাহিতজ্ঞান শূন্য হয়ে পরে আনরুবার কথা শুনে। লজ্জায় গাল দুটোতে লাল আভা স্পষ্টতর হয়। কি বলবে বুঝে না পেয়ে আমতা আমতা করে বলে,

‘ আন্টি আমি…। ‘

কুহেলীর কথা শেষ হওয়ার আগেই আনরুবা কপট রাগ দেখিয়ে বলেন,

‘ কিসব আন্টিফান্টি করতেছো হে? মা বলবা মা। তুমি জানো মায়েরা ছেলের বউয়ের মুখ থেকে মা ডাক শুনলে কতো খুশি হয়! এখনকার আধুনিক যুগের পোলাপাইন গুলাতো মা বলতেই চায় না। আমাদের সময় তো আমরা শ্বশুরিরেই নিজের মায়ের মতো দেখতাম। ‘

‘ আচ্ছা আচ্ছা আমি মামনি বলেই ডাকবো। তোমাকে আমি অনেক আগে থেকেই মায়ের চোখে দেখি মামনি। ‘

আহ্লাদী সুরে বলে কুহেলী। আনরুবা হেসে কুহেলীর চিবুক ছুঁয়ে চুমু খেয়ে বলে, ‘ সোনা মেয়ে আমার। এখন থেকে এটাই কিন্তু তোমার বাড়ি। এখানের সব মানুষগুলোই তোমার আপন। যাও এখন ঘরে যাও মা। ‘

কুহেলী কিছু একটা ভেবে রসিয়ে কসিয়ে বলে,
‘ যাচ্ছি মামনি। কিন্তু নয়না আপুর ঘরে। আপু বলেছিল আপুর সাথে যেন থাকি। আপু অনেক মিস করছিল না এতো দিন আমাকে তাই‌। আমি আপুর ঘরে গেলাম হে! ‘

কথা শেষ করেই দৌড়ে পালায় কুহেলী। আনরুবাকে কিছু বলার সুযোগই দেয় না। আনরুবা ফিক করে হেসে বলে, ‘ হায়রে মেয়ে! সবার খবর আছে। শুধু আমার ছেলে যে কতো পাগল হয়ে আছে এই খবরই নাই। আল্লাহ আমার ছেলেমেয়েদের সুখে রাইখো সম্মানে রাইখো। দেখি রান্নাঘরে আবার কি কাজ পইরা আছে, কাজের আর শেষ নাই। ‘

ঘন্টাখানেক পার হয়ছ যাওয়ার পরও যখন কুহেলী ঘরে আসে না সমারোহ বিরক্ত হয়েই কুহেলীর ঘরের দিকে যায়‌। যেয়ে দেখে কুহেলী সেখানেও নেই। কি খারাপ মেয়েরে বাবা সেই কখন বলেছিল ঘরে যেতে কিন্তু কথা শুনলো না। দোতলায় দাঁড়িয়ে নিচে উঁকি দিয়ে দেখে সেখানেও নেই। মন খারাপ করে ঘরের দিকে যাওয়ার সময় কুহেলীর হাঁসির কন্ঠ শুনে থমকে দাঁড়ায় সমারোহ। নয়নার ঘর থেকে আসছে শব্দটা। সমারোহ বিড়বিড় করে বলে,

‘ বাহ, আমাকে অপেক্ষার প্রহর গুনিয়ে ম্যাডাম বড়ই আনন্দে নয়নার সাথে গল্প করছেন। দাঁড়ান আজকে আপনার একদিন তো আমার দশদিন। ‘

সমারোহ নয়নার দরজায় হালকা নক করে বলে, ‘ নয়না, আসবো? ‘

‘ হ্যাঁ ভাইয়া আয়। ‘

পরিবেশ মুহূর্তেই স্তব্ধা মেরে যায়। সমারোহ ভেতরে ঢুকে দেখে কুহেলী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সঙ্গে সঙ্গে রাগ মাথায় চড়ে বসে তার। তার ঘরে যাবেনা বলে ঘুমের ভান ধরে পরে আছে। কি জঘন্য দুষ্টু মেয়ে! নয়না সমারোহকে দেখে সন্দিহান গলায় বলে,

‘ কিছু বলবি ভাইয়া? ‘

‘ কুহেলী কি ঘুমিয়েছে? ‘

‘ হ্যাঁ, সেই কখন! ‘

ভ্রুঁ কুঁচকে দাঁতে দাঁত চেপে সমারোহ বলে, ‘ এইমাত্র ওর হাসির শব্দ আসছিল। ‘

‘ তুমি বোধহয় ভুল শুনেছো ভাইয়া। ইদানীং পড়তে পড়তে তোমার কানের পর্দা ছিড়ে গেছে মনে হয়। ‘

‘ বেশি পড়লে কানের পর্দা ছিড়ে? ‘

‘ না কিন্তু তুমি তো জোরে শব্দ করে পড়ো। ‘

সমারোহ চোখ গরম করে তাকাতেই নয়না চুপসে যায়। সমারোহ রাগে গিজগিজ করতে করতে বের হয়ে যায় ঘর থেকে। বলে যায় কুহেলী উঠলেই যেন তার ঘরে পাঠায়। সমারোহ যেতেই কুহেলী ফট করে উঠে বসে নয়নাকে জড়িয়ে ধরে বলে,

‘ উফ এই যাত্রায় বাঁচিয়ে দিলে আপু। থ্যাংক ইউ। ‘

নয়না নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে,
‘ এবার নাহয় বেঁচে গেলে। যাকে বিয়ে করেছো তার হাত থেকে বাঁচবে কীভাবে হে? নাকি লজ্জায় কাছেই যেতে পারছো না। আমার ভাইটা যতই স্ট্রিক্ট হোক না কেনো রোমান্টিক আছে কিন্তু! ‘

হো হো করে হাসতে থাকে নয়না। কুহেলীর লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছা করে। নয়না তার বড় হয়েও এভাবে লজ্জা দিচ্ছে। কুহেলী লাজুকলতার মতো নুইয়ে পড়ে বলে, ‘ কি যে বলো না আপু! ‘

‘ কি বলি হে! হা হা। আচ্ছা কুহেলী? ‘, নয়না এবার সিরিয়াস হয়ে বলে।

‘ হ্যা আপু। ‘

‘ তুমি আমার বোনের মতো, সেঁজুতি যেমন তুমিও তেমন। তাই তোমাকে কথাগুলো বলি হে? কিছু মনে করো না। ‘

‘ আমি আবার কি মনে করবো। তুমি বলো না আপু যা বলতে চাও। ‘

‘ কুহেলী আমার ভাই দেখে বলছি না। সমারোহ সত্যিই একজন সৎ এবং কেয়ারিং মানুষ। ভাইয়া উপরে উপরেই যত কঠিন, ভেতরটা একদম কোমল। ভাইয়ার মন একদম সেনসেটিভ। ভাইয়া কিন্তু আগে এতো কঠিন ও ছিল না জানো! আলোর সাথে ভাইয়ার প্রেম হওয়ার আগে ভাইয়া সবসময় হৈ হৈ করে দিন কাটাতো। পড়ালেখা,খেলাধুলা সবকিছু নিয়ে সময় কাটতো তার। বাড়ির সবার সাথে সারাদিন বকবক করতেই থাকতো। মাঝে মাঝে তো আমরাই বিরক্ত হয়ে যেতাম। ভাইয়া যখন ঢাকা মেডিকেলে চান্স পাওয়ার পর ঢাকা চলে গেলো, আমার মনে আছে একবছর যাবৎ আমরা মানতেই পারিনি যে ভাইয়া চলে গিয়েছে। বাড়ি ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। একটু পরপর কাঁদাতাম। বাবা আম্মু সবাই কেঁদেছে খুব। আমাদের সবটা জুড়ে ছিল ভাইয়া। সান্দ্র ভাইয়ার চেয়েও চরম দুষ্টু ছিল সে। কিন্তু আলোর যেদিন বিয়ে হয়ে গেল…। ‘

একটু জিরোয় নয়না চোখ মুছে আবার বলতে শুরু করে,
‘ ভাইয়ার, ভাইয়ার সবকিছু কেমন যেন উলোটপালোট হয়ে গেল। আমার ভাইটা বদলে গেলো। ভাইয়া খুব ভালোবাসতো আলোকে। তার প্রতি ভাইয়া খুব লয়াল ছিল। কিন্তু আলো কখনোই ছিল না। সে ভাইয়ার থেকে ভালো পজিশনে থাকা ছেলে পাওয়াতে বিয়েতে মত দিয়ে দেয়। তার ফ্যামিলি তাকে মোটেই জোর করেনি। কুহেলী জানো আলোর বিয়ের দিন ভাইয়া পুরো পাগল হয়ে গিয়েছিল। আলোর বিয়েতে চলে যেতো বিয়ে ভাঙতে। বাবা জোর করে ভাইয়াকে ঘরে বন্দি করে রেখেছিল দুইদিন। সারিকা আপুর ও দোষ ছিল না, তার দেবরের সাথে নয়নার বিয়ে পাকাপোক্ত হওয়ার পর সে জেনেছে আলো ভাইয়ার প্রেমিকা ছিল। তখন আপু কিছু বললে তার সংসার ভাঙ্গার মতো অবস্থা। আপু বাধ্য হয়ে একবছরের উপর আমাদের সঙে কোনো যোগাযোগ রাখেনি। ভাইয়া একদম খাওয়া দাওয়া ভুলে গিয়েছিল। আলোর বিয়ের তৃতীয় দিন হসপিটালাইজ করতে হয়েছিল ভাইয়াকে। কি ভয়াবহ ছিল সে দিনগুলো। ভাইয়ার অবস্থা দেখে আমরা খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভাইয়া একমাস হসপিটালে পাগলের মতোই ছিল। এর থেকে সুস্থ হয়ে ডাক্তারি পড়বে সে আশা ছেড়ে দিলাম সবাই। ভাইয়া সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেই তখন আমরা খুশি। একমাস পর যখন ভাইয়াকে বাড়ি আনি ভাইয়া নিজেকে একঘরে করে ফেলে। ঘর থেকে বের হতো না কেউ ঘরে গেলেও কথা বলতো না। মেডিক্যালে ক্লাস বন্ধ করেছে পাঁচ ছয় মাস কেটে যায়। ইয়ার লস হয়। একদিন কি হলো হঠাৎ করে ভোর পাঁচটায় নিজের ঘর থেকে ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে এসে বলে ঢাকা যাবে, ক্লাস করবে। আম্মু শুনেই কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। ভাইয়া তখনো মেন্টালি ডিস্টার্বড। কোনো কাজই করতে পারতো না ঠিক করে। এই কটাদিন আম্মু না খাইয়ে দিলে নিজের হাতে খেতেও পারতো না। হাই পাওয়ারের ডিপ্রেশনের মেডিসিন চলছে। এর মাঝে ঢাকা গিয়ে থাকবে কি করে! আব্বু আম্মু আমরা সবাই অনেক বুঝাই। কারো কথা না শুনে সেই সকালেই রওনা দেয় ভাইয়া। সান্দ্র ভাইয়া ছিল ঢাকা তাই একটা ভরসা। নিজেকে হঠাৎ করেই সবার থেকে গুটিয়ে নিয়ে একাকি গুছিয়ে নেয় ভাইয়া। আগের চঞ্চল, প্রফুল্ল সমারোহ বদলে গিয়ে হয়ে গেল নিশ্চুপ, যার ভেতরটা পুরোটাই তীব্র যন্ত্রণায় ভরপুর। ‘

নয়না থামে। সমারোহর কষ্ট যেন কুহেলীর ভেতর জ্বলে পুড়ে ছারখার করে। চোখের কার্নিশ বেয়ে কখন উপছে পড়ে অশ্রুকণা ঠাওর করতে পারে না। শুধু বোঝে কষ্ট হচ্ছে, খুব কষ্ট হচ্ছে। মাথা নিচু করে বসে থাকে কুহেলী। নয়না কুহেলীর মাথায় হাত রেখে বলে,

‘ ভাইয়া সেদিন নিজেকে সামলে নিয়েছে নিজেই। যন্ত্রণাগুলো বুকের মাঝে চেপে রেখে এর ভাড় বহন করে গেছে চুপচাপ। সময় কেমন পাল্টে দিয়েছিল আমার ভাইকে। তবে জানো কুহেলী, তুমি এই বাড়িতে আসার পর ভাইয়া অনেকটা চেঞ্জ হয়ে গেল কিভাবে যেন। হুট করেই। আমাদের সবার অগোচরে। মায়ে চোখে সবার আগে পড়েছিল সেটা। আমি জানিনা ভাইয়া তোমাকে ভালোবাসে কিনা তবে তার চোখে তোমার জন্য আলাদা কিছু দেখি আমি। কুহেলী, আমার ভাইয়া নরমাল হতে শুরু করেছে। হয়তো নতুন করে ভালোবাসতে শুরু করেছে। তুমি আমাকে কথা দাও আমার ভাইয়াকে কষ্ট দেবে না কখনো। কথা দাও তোমার ভালোবাসা দিয়ে ওর অতীতের সব ভুলিয়ে দেবে। বল কুহেলী পারবে না তুমি? ‘

অপ্রস্তুত হয়ে পরে কুহেলী। এই মুহূর্তে তার কি বলা উচিত সে জানে না‌। নয়না অন্যায় কিছু চায়নি। কি করবে এখন সে! কুহেলী এদিক ওদিক তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলে,

‘ আপু আমি! আমি… মানে… । ‘

‘ হ্যা তুমি কুহেলী। পারবে না বলো? আমি কি তোমাকে খুব জোর করছি? আমার ভাইকে কি ভালোবাসা যায় না কুহেলী? ‘

‘ আমি চেষ্টা করবো আপু। আর আমার দিক থেকে উনি কোনো কষ্ট কখনো পাবেনা আপু কথা দিচ্ছি। ‘

নয়না খুশি হয়ে কুহেলীর কপালে চুমু খায়। তারপর বলে, ‘ ঘুমাও এবার নাহলে তোর জামাই এসে আবার আমাকে ধোলাই দিবে। ‘

কুহেলী কিছু না বলে অন্যদিকে মুখ করে শুয়ে পরে। একটু আগেই ক্লান্ত লাগছিল তবে এখন লাগছে না। কষ্ট হচ্ছে। হিংসে হচ্ছে কেনো যেন। একটা অন্যরকম অনুভূতিতে সিক্ত সে। আচ্ছা সমারোহ যেভাবে আলোকে ভালোবাসতো সেভাবে কি তাকে বাসবে? না তার তো আরও বেশি চাই সবটা। আলোকে সমারোহ মনের কোণে জায়গা দিয়েছিল, আর সে সবটা জুড়ে বিরাজ করতে চায়। সে চায় সমারোহ কেবল কুহেলীতে উম্মাদের ন্যায় মত্ত থাকবে। সত্যিই তার জন্যও এতোটা উতলা হবে কোনোদিন সমারোহর ভেতরখানি? তাকে নিজের সর্বস্ব ভুলে গিয়ে কাছে চাইবে? কুহেলী পাবে সমারোহর বুকের উষ্ণ পরশ!

চলবে.