আকাশ মোড়ানো চিরকুট
লেখনী – সাইমা ইসলাম প্রীতি
৪৮.
পরীক্ষা শেষ। ক্লান্ত দুপুর যেন শেষই হতে চাইছে না। সঙ্গে তাল মিলিয়েছে কুহেলীর বিষন্নতা। হৃদয়ের বারান্দায় ভোরের রক্তাক্ত সূর্যটাও আজ ঢাকা পড়েছে কুয়াশার মেঘে। তার পৃথিবীতে আজ সূর্যগ্রহন চলছে। সমারোহকে না বলতে পারা কথাগুলো আজ একলা এসে ঝড়ো হয়েছে সব। তারা যেন গভীর বিক্ষোভ জানাচ্ছে কুহেলীর প্রতি। পোড়াচ্ছে তাকে। দমকা বাতাসের আঘাতে এলোমেলো হয়ে উঠেছে কুহেলী। উত্তেজিত হৃদপিন্ডটা ছন্দবিহীন কাঁপছে। আজ যে সমারোহ সত্যিই তাকে ছেড়ে বহুদূরে চলে গিয়েছে। সমারোহকে ছাড়া পুরো পৃথিবীটাই ফাঁকা মনে হচ্ছে কুহেলীর। চারদিকে যেন শূণ্যতার উত্তাপে তৃষ্ণার্থ আবহাওয়া। এই ভয়টাই সে পেয়েছিল এতোদিন। তাই দূরে সরেছিল সমারোহর কাছ থেকে যাতে কষ্টটা একটু হলেও কম হয়। কিন্তু তা আর হচ্ছে কই! বিচ্ছেদের তীব্র যন্ত্রণা আর কতোবার সহ্য করতে হবে? কুহেলীর সারাদেহ এই এক বোঝা বইতে বইতে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত। আর কিচ্ছু ভালোলাগছে না। চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে তার। সবকিছুর বিনিময়ে কুহেলী সমারোহকে চায়। এতোদিনের ভালোবাসাটা যেন আজ ধপ করে বেড়ে গেছে শতগুণ। কিভাবে দিন কাটবে এখন তার একলা? কাল রাতেও যে মানুষটাকে জরিয়ে ধরে কেঁদেছে অথচ অল্পকিছু সময়ের ব্যবধানে এখন সে বহুদূর। ভাবতেই দম বন্ধ হয়ে আসছে কুহেলীর। পুরো বাড়ি জুড়ে নিজের স্মৃতি মেখে রেখে মানুষটা সবার আড়ালে চলে গেলো। আচ্ছা তারা তো সবাই একজন থেকে দূরে আছে আর সমারোহ! উনি যে নিজের পুরো পরিবার ছেড়ে যাচ্ছেন! উনার তাহলে কতোটা কষ্ট হচ্ছে। কুহেলীর এবার আরো কান্না পায়। সমারোহ এতো কষ্ট সহ্য করবেন কিভাবে? কুহেলীর খুব করে জানতে ইচ্ছে করে সমারোহ কুহেলীকে ঠিক কতটা মিস করবে?
সমারোহর বালিশ জরিয়ে ধরে কেঁদেকেটে কখন ঘুমিয়ে গেছে কুহেলী নিজেও বলতে পারবে না। ঘুম ভাঙ্গে আনরুবার ডাকে। কুহেলী ঘুম থেকে টিপটিপ করে চোখ মেলেই দেখে আনরুবা ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে রয়েছে। তার চোখে মুখে অস্থিরতা। কুহেলী হুমড়ি খেয়ে উঠে বসে বলে,
‘ মামনি কি হয়েছে? তুমি কাঁদছো কেনো? ‘
‘ কুহেলী তাড়াতাড়ি চল নায়নার ব্লিডিং হচ্ছে অনেক। বাথরুমে স্লিপ কেটে পরে গেছে নয়না। কেমন জানি চোখ মুখ উল্টে আসতেছে ওর। ‘
কুহেলীর যেন দিন-দুনিয়া অন্ধকার মনে হয়। সমারোহ বাড়ি থেকে যেতে না যেতেই আবার কি বিপদ বাধলো। কুহেলী দ্রুত নয়নার কাছে ছুটে আসে। আনরুবা আর কুহেলী ছাড়া বাড়িতে কেউ নেই। আনরুবা কোনোরকমে নয়নাকে ধরে বিছানায় এনে বসিয়ে ছিলেন। কুহেলী যেয়ে দেখে পুরো বিছানার চাদর রক্তে মেখে গিয়েছে। নয়না এর মাঝে কাতরাচ্ছে। কুহেলীকে দেখে কাঁদতে কাঁদতে মিনতি করে নয়না বলতে লাগলো,
‘ কুহেলী, আমার বাচ্চা! আমার বাচ্চা কুহেলী। আমার বাচ্চা বাঁচবে তো? আমার সন্তানের অনেক কষ্ট হচ্ছে। আমি মরে গেলেও আমার বাচ্চাকে বাঁচাও আল্লাহ। আমার সন্তান! ‘
কুহেলী দ্রুত নয়নাকে কিছু ট্রিটমেন্ট দিয়ে হসপিটালের দিকে রওনা হয়। সেঁজুতিকেও বলে দ্রুত হাসপাতালে আসতে। রাস্তায় যাওয়ার পথেই জ্ঞান হারায় নয়না। শরীর নীল হয়ে ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তার। আনরুবা মেয়ের হাত ধরে চিৎকার করে আল্লাহর নাম জপছেন। যা কিছু হয়ে যাক আল্লাহ যেন তার মেয়েকে সুস্থ রাখেন। কুহেলী বারংবার পানির ঝাপটা দিয়ে, নয়নার সঙ্গে কথা বলে কোনো রকমে তাকে জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করছে।
সান্দ্র হসপিটালে ডিউটিরত অবস্থায় ছিল বলে আগে থেকেই সকল ব্যবস্থা করে রাখতে পেরেছে। নয়নাকে হসপিটালে নেওয়া মাত্র ওটিতে নেওয়া হয়। ঘন্টাখানেক পর সান্দ্র অন্য একজন ডাক্তারের সঙ্গে ওটি থেকে বের হয়ে এসে জানায় নয়না সেফ আছে। রক্ত দেয়া হচ্ছে তাকে। স্লিপ কেটে পরে যাওয়াতে বাচ্চার উপর চাপ পরে মাথা উল্টো দিকে হয়ে গিয়েছে , নড়াচড়া করা বন্ধ করে দিয়েছে। সম্ভবত তাকে তার বাঁচানো যাবে না। বাচ্চা ইমিডিয়েটলি বের করা না হলে নয়নার লাইফ রিস্ক হয়ে যাবে। আনরুবা, জহির ভেঙে পরেছেন একদম। নয়নার তখনো জ্ঞান ফিরেনি। মেয়ে জাগলে কি বলে সান্ত্বনা দিবে তাকে? যে সন্তান পৃথিবীর আলোই এখনো দেখলো না সে এখনই চির বিদায় নিয়েছে? আনরুবার নয়নার জেগে উঠার পরের পরিস্থিতির কথা ভাবতেই কলিজা আৎকে উঠে। তার মেয়ে এই ধাক্কা সামলাতে পারবে? নয়নার চেহারা দেখে বুক ফেটে কান্না পায় কুহেলীর। মৃত মানুষের মতো ফ্যাকাসে হয়ে গেছে নয়নার উজ্জ্বল মুখশ্রী। কুহেলী মাঝেমাঝে ভাবে মানুষের সময়টা এতো ক্রিটিকাল হয়ে যায় কেনো? হঠাৎ করেই সাজানো গোছানো সবটা তছনছ হয়ে যায় আবার মুহূর্তেই সব ঠিক হয়ে যায়।
রাত তিনটার কাটা পেরিয়েছে। সৌরভ নয়নার কেবিনের সামনে চুপচাপ বসে রয়েছে। আজ নয়নার এই অবস্থার জন্য তার কেবলই নিজেকে দায়ী মনে হচ্ছে। সে যদি এই সময়টায় নয়নার প্রোপার কেয়ার নিতো তাহলে কি হতো এমনটা? সেই তো এই বাচ্চা চায়নি। এজন্যই কি আল্লাহ তার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছেন? নয়নার ফ্যামিলির সবাই ডিসিশন নিয়ে নিয়েছে নয়নার জ্ঞান ফিরে একটু স্টেবল হওয়ার পরপরই নয়নার অপারেশন করা হবে। সবাই নয়নাকে সুস্থভাবে তাদের সামনে দেখতে চায়। সৌরভের ও শুধু নয়না সুস্থ থাকলেই আর কিচ্ছু লাগবে না। কিন্তু তার বুক ফেটে যাচ্ছে। অপারেশন করে মৃত বাচ্চা বের করে ফেলা হবে শুনেই সৌরভের মনে হচ্ছে বুক চিড়ে তার হৃৎপিণ্ডটা বের করে নিয়ে আসার কথা বলছে। এটাই কি তবে বাবা হওয়ার অনুভূতি? সে কিভাবে মানবে তার সন্তান মৃত? তার যে দুনিয়া অন্ধকার লাগছে। বারবার সৌরভ আল্লাহর দরবারে হাত পেতে ভিক্ষা চাইছে তার জীবন দিয়ে হলেও যেন তার সন্তান বেঁচে থাকে।
চার ঘন্টা পর চোখ খুলে নয়না। বাচ্চার ব্যাপারে তাকে কিছু জানানো হয়নি। সৌরভ খুব খেয়াল রাখছে তার। যদিও সৌরভের চেহারা দেখে নয়না বুঝে গিয়েছে কিছু একটা হয়েছে। বাড়ির সকলেও অতিরিক্ত বেশি যত্ন নিচ্ছে নয়নার। কিন্তু পেটে বাচ্চার নড়াচড়া উপলব্ধি করতে না পেরে অস্থির হয়ে উঠেছে সে। অতিরিক্ত হাইপার হয়ে পরার কারণে আবার ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়া হয় নয়নাকে। কিন্তু কয়েকঘন্টা পরেই নয়নার ঘুম ভেঙে যায় প্রচন্ড পেইনে। লেবার পেইন উঠেছে। বাচ্চার নড়াচড়া টের পায় নয়না। শত কষ্টেও তার ঠোঁটে ফুটে উঠে বিজয়ের হাসি। নয়না একটি ফুটফুটে মেয়ে সন্তানের জন্ম দেয়। বাচ্চা দুর্বল হওয়ায় তাকে শিশু ওয়ার্ডে রাখা হয়েছে আর নয়নাকে কেবিনে। সৌরভ বাবুর ছবি তুলে নিয়ে আসে নয়নাকে দেখাতে। নয়না এই প্রথম মেয়ের ছবি দেখে কেঁদে ফেলে। সৌরভও কাঁদে। আল্লাহ তার দোয়া কবুল করেছেন। তার নয়না আর মেয়ে সুস্থ আছে। এখন আর কিছুই দরকার নেই তার।
নয়না মুগ্ধ নয়নে চেয়ে দেখে, সৌরভকে এতোটা খুশি সে কখনো দেখেনি। নয়নার সব রাগ যেন জলে ধুয়েমুছে যায়। মুচকি হেসে সে সৌরভের চুলে আলতো করে হাত বুলিয়ে দেয়। সৌরভ খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নয়নাকে। মিনমিনে কন্ঠে বলে,
‘ আমাকে এবার ক্ষমা করে দাও নয়না, মেয়ের জন্য হলেও। ওর আমাদের দুজনকেই দরকার। ‘
‘ শুধু মেয়েরই দরকার তোমাকে? ‘
সৌরভ ছলছল চোখে তাকায় নয়নার দিকে। নয়নার হাত জোর করে বলে,
‘ নয়না, আমি আর পারছি না নয়না। প্লিজ শেষবারের মতো ক্ষমা করো আমায়। আমি কথা দিচ্ছি আমার নিঃশ্বাস যতদিন চলবে আমি তোমায় আর আমাদের মেয়েকে আগলে রাখবো কথা দিলাম। ‘
নয়না প্রচ্ছন্ন হেসে সৌরভের কপালে চুমু খেয়ে লাজুক কন্ঠে বলে, ‘ তবে আমায় বিয়ে করছেন কবে? ‘
সৌরভ যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়ে গেছে। খুশির দমকে নয়নার নাকে মুখে অসংখ্যবার চুমু খায়। নয়না হেসে বলে, ‘ আস্তে আস্তে। ‘
সৌরভ সরে এসে বলে, ‘ ওহ সরি। আমি অনেক বেশি এক্সাইটেড হয়ে গেছিলাম। ‘
–
কুহেলীর বাবুর পাশে বসে এক নজরে দেখে যাচ্ছে ওকে। কত্তো ছোট ছোট হাত পা, কি মিষ্টি মুখটা। সারাক্ষণই ঘুমাচ্ছে। সময়ে অনেক আগে হয়ে যাওয়ায় পুরোপুরি সুস্থ নয় বাবু। তারপরও আল্লাহর কাছে অনেক শুকরিয়া। কুহেলীর মন এখন আগের থেকে কিছুটা ভালো। মানুষের জীবন বৈচিত্রময়। এখানে সুখ কিংবা দুঃখ কারো জন্য থেমে থাকে না। একজন মানুষ চলে গেলে তার শূন্যস্থানে শিউলি ফুলের সুবাস নিয়ে অন্যকেউ আসবে। সে দূরে গেলে অন্য একজন, তার পর আরো কেউ। কুহেলীর আফসোস হয়, সমারোহ আর একটা দিন থেকে গেলেই ভাগিনীর মুখ দেখে যেতে পারতেন। আচ্ছা উনি ঠিক মতো পৌঁছে গেছেন তো! এতোক্ষণে তো পৌঁছে যাওয়ার কথা।
–
সমারোহ স্ট্যানফোর্ডে যাওয়ার পর কেটে গেছে আরো একটি বিভীষিকাময় বসন্ত। বসন্তে যেন এখন আর রং নেই। শিউলী ফুলে ইদানীং ঘ্রাণের সমারোহ পায়না কুহেলী। আকাশে গুচ্ছ মেঘেরা ডানা মেলে উড়ে চলে না, গভীর রাতের তারার মেলায় উজ্জ্বল আলো ছুটে চলে না। প্রথম প্রথম একদম সমারোহর ঘরে থাকতে পারতো না কুহেলী। সব সাজানো গোছানো আছে শুধু সাজিয়ে রাখা মানুষটা নেই। এখানে সমারোহ নামটা সবসময় পাগলের মতো তাড়া করে বেড়ায় কুহেলীকে। রাতে চোখ বুঁজলে সমারোহর কোমল বুকের একবিন্দু উষ্ণতার জন্য ভিজে উঠে কুহেলীর চোখ। অযাচিতভাবে একেক পর এক অশ্রু বিসর্জন দিয়ে যায় কুহেলী। একটা সময় পাড় হওয়ার পর কুহেলী বুঝতে পারে এবাড়িতে থাকলে সে পাগল হয়ে যাবে নয়তো সমারোহর বিরহে মারাই পড়বে। তাই সমারোহ যাওয়ার পাঁচ মাসের মাথা বাসা ছেড়ে হলে উঠে কুহেলী। প্রথমে আনরুবা একদম নারাজ ছিলেন। সান্দ্র রেগুলার মেডিক্যালে যাচ্ছে তাহলে বাড়ির বউ হয়ে সুযোগ থাকতে অত কষ্ট কেনো করবে কুহেলী! কিন্তু কুহেলীর জেদের কাছে হার মানতেই হলো তাকে। তবে পুরো সপ্তাহ পার হলে বৃহস্পতিবার ক্লাস শেষে বাড়িতে আসা আর শনিবার গিয়ে ক্লাস করা হয়।
হলে গিয়েও যখন সমারোহকে ভুলতে পারে না অবশেষে এই অপ্রতিভ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে দিনরাত বইয়ে মুখ গুঁজে থাকতে শুরু করে কুহেলী। যে কুহেলীর এক কার্ড থেকে অন্য কার্ডে পড়া শেষ করতে হিমশিম খেতে হতো সে কুহেলীর এখন পরীক্ষার তিন-চার মাস আগেই পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়া হয়ে যায়। রেজাল্ট ও বেশ ভালো হচ্ছে পূর্বের থেকে। চন্দ্রিমা কুহেলীর রুমমেট বর্তমানে। কুহেলীর পড়া দেখে মাঝেমধ্যেই ছোটখাটো হার্ট অ্যাটাক হয়। তবে ইদানীং কুহেলীর পাগলামি এতো বেড়েছে যে চন্দ্রিমার রীতিমতো বকতে হয় তাকে কম পড়ার জন্য। পড়তে পড়তে হাড় মাংস সব এক করে ফেলেছ মেয়েটা।
–
বর্ষার এক দুপুরে আকাশ আধার হয়ে ক্ষনে ক্ষনে চমকাচ্ছে বিদ্যুৎ। সঙ্গে মুশলধারে বৃষ্টি। মাঝে মধ্যে দু’একবার বাজ ও পড়ছে। শরীর মোটা চাদরে মুড়িয়ে বেলকনিতে এসে দাঁড়িয়েছে চন্দ্রিমা। মুগ্ধ নয়নে আকাশ দেখতে দেখতে হঠাৎ ঘরে কারো উপস্থিতি অনুভব করে সে। কুহেলীকে দেখে চমকে উঠে চন্দ্রিমা। সঙ্গে সঙ্গে হুড়হুড়িয়ে রাগ বেড়ে যায় তার। বৃষ্টিতে কাক ভেজা হয়ে ঘরে ফিরেই চন্দ্রির কপালে হাত রেখে জ্বরের তীব্রতা দেখে নেয় কুহেলী। তারপর কাধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে রেখে গোসল করার জন্য কাপড় বের করতে থাকে। চন্দ্রিমা কুহেলীর পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে কপট রাগ দেখিয়ে বলে,
‘ কলেজের সামনে হল। ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে আসতে হয়না। একটু দাঁড়ালেই বৃষ্টি ভিজতে হতো না অতোটুকু ধৈর্য্যও তোর নাই? ‘
‘ আলিফ ভাইয়া চিঠি দিয়েছেন। আমি আর অপেক্ষা করতে পারছিলাম না। তাই…। ‘
চন্দ্রিমার রাগ ফুস করে উড়ে যায় কুহেলীর কথা শুনে। আমতা-আমতা করে বলে, ‘ এই মেয়ে এই একটু তাড়াতাড়ি আসতে পারলি না? যা দৌড়ে গোসল সেরে আয়। ওহ আই কান্ট স্টপ মাইসেল্ফ। ‘
উত্তেজনায় লাফালাফি করার মতো অবস্থা চন্দ্রিমার। কুহেলী ওকে দেখে চোখ খোঁচ করে ফেলে। সন্দিহান কন্ঠে বলে,
‘ প্রেমপত্র আমার এসছে না তোর? চিংড়ি মাছের মতো লাফাস কেন? ‘
‘ আহা, তোর প্রেমপত্র দেখলে এতো খুশি লাগে যে আমার মনে হয় যেন আমিই পেয়েছি চিঠিটা। কি সুন্দর করে অনুভূতিতে মাখো মাখো করে ভাইয়া লিখেন একেকটা চিঠি! সমারোহ ভাইয়া যে এতোটা রোমান্টিক তাকে দেখে বুঝা যায় না। তোর কি ভাগ্য রে কুহি! ‘
কুহেলী মুচকি হাসে। গত তিন মাস আগে আর আজ আলিফ ভাইয়ার কাছ থেকে বেনামি চিঠি পেয়েছে কুহেলী। সেদিনের চিঠিটা ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত। কুহেলী একবার মনে মনে আওরায় সে প্রিয় বাক্যগুলো,
‘ আজ কোনো সম্বোধন করবো না তোমায়। চোখ বুঁজে কেবল বলবো প্রচন্ড রকম মিস করছি তোমায়। তোমার চোখের নিচের তিলটা দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে আমার মন। যদি পারতাম তবে সবসময় তোমায় জীবন্ত পুতুল বানিয়ে আমার বুকপকেটে রেখে দিতাম। ভাগ্যিস সে ক্ষমতা আমার নেই! বেঁচে গেলে তুমি আর…। আর বমার জন্য পড়ে রইলো এক সহস্র অপেক্ষা। ‘
কতোবার যে এই চিঠিটা সে পড়েছে তার হিসাব নেই। বেনামি চিঠির মানুষটাকে এখন সে চেনে। তার সমারোহ। অবশ্য সমারোহ এখনো প্রকাশ করেননি চিঠিগুলো তার দেয়া। আলিফ ভাইয়ার কাছে শত জিজ্ঞেস করার পরও তিনিও স্বীকার করেননি। তাতে কি হয়েছে! কুহেলী একাই একশো। সমারোহ যাওয়ার পর থেকে তার সকল কিছুই তো কুহেলীর অধিনে। কুহেলী সমারোহর পুরো ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজে সমারোহর স্টুডেন্ট অবস্থার সব নোটস বের করে ফেলেছে। চিঠির আর নোটসের হ্যান্ড রাইটিং সম্পূর্ণ এক। যে মুহূর্তে বিষয়টা শিওর হয়েছে কুহেলী, তার তখন পাগলের মতোন নাচতে ইচ্ছা করছিলো। আর এখন তো সমারোহ বহুদূরে থেকেও তার খুব কাছে। সমারোহর একেকটা চিঠির জন্য চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করে কুহেলী।
গোসল সেরে এসে চিঠিটা হাতে নিয়ে বসলো কুহেলী। চন্দ্রিমা তার সামনের বেডে বসে আছে। প্রতিবারই কুহেলীর চিঠি চুরি করে পড়ে ফেলে মেয়েটা। কুহেলী কড়া চোখে চন্দ্রিমার দিকে তাকাতেই চন্দ্রিমা হুড়োহুড়ি করে উঠে বললো,
‘ তুই পড় হ্যা, আমি বরং কবিতার সঙ্গে দেখা করে পড়ালেখার খবর নিয়ে আসি। ‘
চন্দ্রিমা চলে গেলো। কুহেলীর চোখমুখ জুড়ে প্রচন্ড ভালোলাগা খেলে গেলো। ইশঃ! কত্তো অপেক্ষা করার পর আজ তার খুশি হওয়ার দিন এসেছে। কুহেলীর তো চিঠিটা খুলে পড়বে তাতে লজ্জা লাগছে। দুই হাতে নিজের মুখ ঢেকে হালকা হাসে সে। তারপর দ্রুত অতি কাঙ্ক্ষিত ‘আকাশ মোড়ানো চিরকুট’ খুলে পড়তে শুরু করে।
‘ ময়ূরী,
একবার প্রেমে পড়বে আমার? কেনো জানিনা আজ হঠাৎ করেই তোমার ভেতরের সবটুকু প্রেম শুষে নেয়ার ইচ্ছা জেগেছে আমার। প্রেমে মগ্ন তুমি যখন আমায় কাছে পাওয়ার তীব্র ব্যাকুলতায় কাঁদবে! তোমার ফোলা চোখের ল্যাপ্টে যাওয়া কাজলে আমি খুঁজে পাবো আমার পুরো পৃথিবী। বিধস্ত তোমাতে ভালোবাসার ফুল ছড়িয়ে দিতে আমার ভেতরে তখন শুরু হবে এক বিশাল ঝড়। ধীরে ধীরে এই ঝড় আমার সবটুকু প্রাণ আত্মসাৎ করে কালবৈশাখীর ন্যায় হবে। রূক্ষ, পরিশ্রান্ত আমি যখন একদম শেষ হয়ে যাচ্ছি, তোমার পরশে নতুন করে আবিষ্কার করবে আমায়। তারপর আবার তোমায় পাওয়ার মারাত্মক নেশায় আহত হবো আমি। আবার নিঃশেষ হবো। যতদিন আমার শিরা উপশিরায় রক্ত বইবে ততদিন তুমি নামক কৃষ্ণচূড়ায় প্রজাপতি হয়ে উড়ে বেড়াবো আমি। তবে বিচ্ছেদ শেষে তুমি কেবলই আমার হবে।
ইতি,
একান্তই তোমার কেউ। ‘
রূদ্ধশ্বাসে চিঠিটা ছয়-সাতবার পড়ে ক্ষান্ত হলো কুহেলী। এই কয়েক শব্দের একটা চিঠি কুহেলীর বেঁচে থাকার টনিক।
চলবে.
আকাশ মোড়ানো চিরকুট
লেখনী – সাইমা ইসলাম প্রীতি
৪৯.
বর্ষা শেষে শরৎ পাড় হয়ে হেমন্তের গান গাইছে প্রকৃতি। গন্ধরাজের সৌরভে মুখরিত বাতাস। প্রত্যেক দিনের ব্যস্ততার মাঝেও কুহেলী যখন অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে ক্লান্ত তখন এলো সমারোহর পরবর্তী চিঠি। কুহেলী পাগল প্রায় হয়ে পড়লো চিঠিটা।
‘ কৃষ্ণলতা,
তোমার জন্য আমার বুকে এমন ব্যাথা হয় কেনো গো সুভাষীনী? কোনো এক বকুলের সৌরভে আমার জীবনে এসে কৃষ্ণচূড়া হয়ে ফুটলে। আস্তে আস্তে এই কৃষ্ণচূড়া বৃক্ষ শাখা-প্রশাখা ছেড়ে আমার হৃৎপিণ্ড ভেদ করে চলে গেলো। যতদিন কাটলো আমিও কৃষ্ণচূড়ার অংশ হয়ে উঠলাম। বছরের প্রত্যেকটা দিন তোমার ছোঁয়ার অভাবে আমি মৃতপ্রায় হয়ে রই। শীতের শিশিরে ভিজে যখন তোমার সুপ্ত কলির চিরমুক্তি ঘটে, পূর্ণতা পায় একেকটা ফুল। সেদিন আমার খুশি হওয়ার দিন। এখন এই কৃষ্ণচূড়ার কোমল স্পর্শ ছাড়া যে আমার প্রতিটা রাত বিভৎস ভয়ংকর। কুহেলী! আমার হরিণী! প্রথমে তুমি ছিলে আমার চোখের ধোঁকা, তারপর নেশা হয়ে বর্তমানে আমার খুনি! আচ্ছা, তোমার চোখ দিয়ে আমায় একেবারে ভষ্ম করে দিলেই তো পারো! এভাবে একটু একটু করে কেনো মারছো বলতে পারো? ‘
চিঠিটা পড়ে চরম পর্যায়ের বিস্মিত হলো কুহেলী। সে খুনি! সে কষ্ট দিচ্ছে! আর সমারোহ? উনি নিজেই যে কুহেলীর অভিমান না ভাঙ্গিয়ে চলে গেছেন এতো দূর। কুহেলীকে নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে চেয়েও মনের কথাটুকু বলতে পারেননি। এতে দোষী হলো কুহেলী!
চিঠিটা পাওয়ার পর অনেকটা সময় কেটে গেলেও আলিফ ভাইয়ার কাছ থেকে আর চিঠি পাচ্ছিলো না কুহেলী। পুরনো চিঠিগুলো পড়ে আর পড়ালেখার মাঝে এক জঘন্য ব্যস্ত সময় কাটতে লাগলো তার। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উঠতে যেয়ে যখনি হাঁপিয়ে উঠতো, সমারোহর শার্টে মুখ গুঁজে শক্তি খুঁজে নিতো। সমারোহর চিঠিগুলো এতোবার পড়া হয়েছে যে প্রতিটা অক্ষর তার হৃদয়ের গভীরে গেঁথে গেছে।
–
১৯৯৯ সালের কুয়াশা ভেজা এক সন্ধ্যা! আকাশ বাতাস সিক্ত হয়ে আছে পৌষের ঘাসে বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়া শিশিরের ভেজা গন্ধে। মাঝেমধ্যে হঠাৎ করেই অতিরিক্ত প্রাপ্তি হিসেবে যোগ দিচ্ছে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি। জানালা খুলে হাত বাড়ালেই ধরা যাচ্ছে একমুঠো প্রশান্তি। তবে কুহেলীর তো সেসব খেয়াল নেই! সে ব্যস্ত আছে তার ফোর্থ ইয়ারের নতুন বইগুলো ঘেঁটেঘুটে দেখতে। চন্দ্রিমা মেরুন রঙের একটা সেলোয়ার-কামিজ পড়ে এসে কুহেলীকে দেখে অবাক হয়ে বলে,
‘ কিরে কুহু? তুই রেডি হসনি কেন? যাবি না? ‘
কুহেলী বইয়ের পাতা উল্টে পাল্টে দেখতে দেখতে বলে, ‘ আসছি। ‘
কথাটা বলেই বই বন্ধ করে লং-স্কার্ট আর ফতুয়ার উপর হিজাব পেছিয়ে নিয়ে দ্রুত চলে আসে চন্দ্রিমার সাথে। মেডিক্যালের সামনের হানিফ মামার চায়ের দোকানে তাদের গ্রুপের সব ফ্রেন্ডসরা এসে ঝড়ো হয়েছে। কুহেলীরা যাওয়ার পরে চা বিস্কিটের সঙ্গে আড্ডার গতি বেড়ে যায় হুড়হুড়িয়ে। আজকের আড্ডার মূল আকর্ষণ হলো আশিক স্যার আর সাবরিনা ম্যামের লাভস্টরি। কিভাবে সবার চোখের আড়ালে প্রেম চালিয়ে যাচ্ছেন দুজন তাই নিয়ে সব শিক্ষার্থীদের মাঝে কৌতূহলের শেষ নেই!
কুহেলী বিরক্ত লাগে এসব। অল্পকিছু সময় কথা বলার পর কুহেলী মাথা ধরার বাহানা দিয়ে উঠে আসে সেখান থেকে। কোনো কিছুতেই যেন এখন আর তার আগ্রহ নেই। মন নিস্তব্ধ, হৃদয় শূন্য আর সময় অতিরিক্ত ধীর। জীবনে সবসময় বাবার মুখে সে শুনেছে, সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে হবে। এক মুহূর্ত থেমে থাকা মানে প্রকৃতির বহমানতার কাছে হার মেনে যাওয়া। কিন্তু আজ সেসকল শিক্ষার প্রতি কুহেলীর সন্দেহ জাগছে। মনে হচ্ছে সময়ে থেকে এজটু নয়, অনেকখানি দ্রুত চলছে। সময় তাট সঙ্গে খাপে খাপ মিলিয়ে চলতে পারছে না। অপেক্ষা যে কতটা তিক্ত তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে কুহেলী।
হঠাৎ কুহেলীর চোখের কার্ণিশে বিন্দু বিন্দু অশ্রুরা এসে টলমলিয়ে উঠে। ঝাপসা হয়ে আসে সামনের পথটুকু, মানুষজন। চেনা একটা গন্ধ নাকে এসে সজোরে ধাক্কা দেয়। চোখবুঁজে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কুহেলী। অশ্রুকণারা এবার গড়িয়ে পড়ে। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে সামনে আগাতেই চোখ পড়ে কালো রঙের পাঞ্জাবি পড়া একজনের উপর। হলের সামনে দাঁড়িয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে একবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার মোবাইলের দিকে। কুহেলী লোকটার দিকে ছোট্ট ছোট্ট পা ফেলে এগিয়ে গিয়ে থমকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো। সমারোহ! কুহেলীকে দেখেই বিস্তর প্রাণবন্ত হাসি ফুটিয়ে তুললেন তিনি। কুহেলীর দিকে এগিয়ে এসে কুহেলীর গালে এক হাত ছুঁইয়ে কপালে চুমু দিতেই কুহেলী তাচ্ছিল্য একটা হাসি দিয়ে দৌড়ে হলের ভেতর ঢুকে পড়লো। সোজা নিজের রুমে গিয়ে বিছানায় বসে কয়েকবার জোরে জোরে শ্বাস নিলো।
সমারোহ যাওয়ার পর থেকেই ব্যাপক বাজে এক অভ্যাস হয়েছে তার। যেখানে সেখানে যখন-তখন কল্পনা করে সমারোহকে। কল্পনা এতোটাই বাস্তব হয় যে কুহেলীর প্রতিবারই মনে হয় সে সত্যিই বুঝি সমারোহকে দেখছে। কিন্তু ছুঁতে গেলেই মিলিয়ে যায়। কুহেলী চায় না নিজেকে রোজ এই মরিচিকার মধ্যে ফেলে কষ্ট দিতে। কিন্তু আজকের সমারোহকে কল্পনা করাটা যেন একদম অন্যরকম ছিল। আজ প্রথমবার কুহেলীর ভাবনার সমারোহর স্পর্শ পেয়েছে সে। সমারোহ গায়ে মাখামাখি হয়ে থাকা সেই পাগল করে তোলা ঘ্রাণ পেয়েছে। কেনো হচ্ছে এসব? কুহেলীকে কি মানুষটা সুখে থাকতে দিবে না? এমন জানতে তো কখনো ভালোই বাসতো না কুহেলী।
কুহেলী সামনে থাকা জগের পানি ঢকঢক করে পুরোটা খেয়ে ফেলে। তারপর ঘন্টা খানেক সময় লাগিয়ে গোসল করে। এখন যেন একটু হালকা লাগছে নিজেকে। মাগরিবের নামাজ পড়ে নিয়ে দুর্বল শরীরে বিছানায় নিজেকে এলিয়ে দেয়। একটু ঘুম দরকার। চন্দ্রিমা এখনো ফিরেনি। আগামীকালের আইটেম হবে না জানিয়ে মেডিকেল কর্তৃপক্ষ। লাস্ট কোনো আপডেট আছে কিনা একবার চেক করে নিতে হবে। কবিতা নামের ক্লাসমেটকে কল করার জন্য মোবাইল হাতে নিতেই ছোটখাটো একটা হার্ট অ্যাটাক করে কুহেলী। সমারোহর নম্বর থেকে কল এসেছে! তাও একটা-দুটা না, পুরো তেইশটা মিসড কল! মোবাইল সাইলেন্ট করে রাখার দরুন তা টেরই পায়নি সে। কুহেলী ভেতরটা যেন সমারোহর কন্ঠে একটা শব্দ শোনার লোভে হাহাকার করে উঠে। সমারোহ যাওয়ার পর তো এই নম্বরটা বন্ধ ছিল। তবে কি তিনি সত্যিই ফিরে এসেছেন? কুহেলীর মাথার মধ্যে হাজারো কথা জট পেকে যায়। কুহেলী যখন হিসাব-নিকাস করতে ব্যস্ত তখনই আবারো ফোন আসে সমারোহর। কুহেলী হন্তদন্ত হয়ে কল রিসিভ করতেই অপর পার্শ্ব থেকে ভেসে আসে সমারোহর কন্ঠ,
‘ কুহেলী! কি হয়েছে তোমার বলতো? সেই কখন থেকে কল করে যাচ্ছি রিসিভ করছো না। একটু আগে নিচে আমার কাছে আসলে, আমাকে দেখেও চলে গেলে! মহারাণী আর কতোক্ষণ অপেক্ষা করাবেন আমাকে যদি একটু বলে দিতেন! ‘
কুহেলী থমকে যায়। এর অর্থ একটু আগে সে সমারোহকে কল্পনায় নয়, সত্যিই দেখেছে? কুহেলীর হাত কাঁপতে থাকে খুশিতে। কল কেটে দিয়ে বিছানার উপর উঠেই খুশিতে উড়াধুরা কতক্ষণ নাচে। এদিকে সমারোহ যেন পুরাই বোকা বনে গেছে। গত দুই ঘন্টা ধরে অপেক্ষা করানোর পর তাকে দেখেও পাত্তা না দিয়ে চলে গেলো, এখন কল রিসিভ করেও হুট করে কেটে দিলো। বউ তার পাগল হয়ে গেছে। সে কি বুঝে না সমারোহ দেশের মাটিতে পা রাখার পরই ছুটে এসেছে তার কাছে তাকে একটু মন ভরে দেখবে বলে! এতো বোকা কেনো মেয়েটা?
কুহেলী দ্রুত গায়ে উরনা জরিয়েই ছুটে আসে নিচে। সমারোহকে দূর থেকে দেখে এক হাতে মুখ চেপে ধরে কেঁদে ফেলে কুহেলী। তারপর দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার উপর। কুহেলীর দৌড়ে আসার কারণে কয়েক পা পিছিয়ে যায় সমারোহ। একটুর জন্য পড়ে যায়নি। আজ অনেক দিন পর আত্মা তার শান্ত হলো। কুহেলীকে খুব শক্ত করে নিজের সঙ্গে জরিয়ে ধরে সমারোহ। কুহেলী কাঁদছে, নিরবে ভিজিয়ে দিচ্ছে সমারোহর বুক। এই প্রথম কুহেলীকে কাঁদতে দেখে খুব আনন্দ হচ্ছে সমারোহর। এই কান্না যে তার জন্য। অনেকটা সময় কেটে গেলে কুহেলী যখন একটু ধাতস্থ হয়, সমারোহ কুহেলীর মাথা দুই হাতে ধরে উঁচু করে কপালে গভীর চুমু খেয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
‘ ম্যাম, আমি তো আপনাকে বাড়ি নিয়ে যেতে এলাম। দ্রুত যেয়ে তৈরি হয়ে আসবেন। একদম সময় নিবেন না কিন্তু। ‘
কথাটা বলেই কুহেলীর কানে আলতো করে চুমু খায় সমারোহ। কুহেলী লজ্জায় দৌড়ে ভেতরে চলে যায়। খুশিতে টইটম্বুর হয়ে আছে সে। ড্রেস চেঞ্জ করে চন্দ্রিমার জন্য একটা নোট ছেড়ে রওনা হয় বাসার উদ্দেশ্য। যতটা উৎসাহিত হয় কুহেলী বাড়িতে আসার জন্য তার চেয়েও বেশি মন খারাপ হয়ে যখন চৌকাঠ মাড়িয়ে ভেতরে ঢুকে। আলো ড্রয়িংরুমের কোণে বসে হেসে হেসে কথা বলছে আনরুবার সঙ্গে। কুহেলী সচকিত হয় এটা ভেবে যে আলোও এসেছে সমারোহর সাথে। কুহেলী সন্তপর্ণে নিজের খারাপ লাগাটুকু গিলে নিয়ে ভেজা কম্পিত গলায় সমারোহকে জিজ্ঞেস করে,
‘ সারিকা আপু এসছেন? ‘
‘ না। ‘
‘ ওহ। ‘
কুহেলী এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে সিড়ি বেয়ে উপরে চলে যায়। ভেতরটা তিক্ত হয়ে গেছে।
চলবে.
আকাশ মোড়ানো চিরকুট
লেখনী – সাইমা ইসলাম প্রীতি
৫০.
আধঘন্টা ধরে আয়নার সামনে বসে চুল আঁচড়ে যাচ্ছে কুহেলী। আর বিছানায় আধ শোয়া হয়ে কুহেলী কান্ডকারখানা দেখে চলেছে সমারোহ। অবশেষে ধৈর্য্যের শেষ সীমানা অতিক্রম করে সে বলে উঠে,
‘ ম্যাডাম, আর কতো সময় লাগলে আপনার? যদি বলেন তো আমি চুল আঁচড়ে দিতে সাহায্য করতে পারি। ‘
‘ তার দরকার হবেনা। ‘
কাটকাট উত্তর দিয়ে কুহেলী চলে যায় ওয়াশরুমের দিকে। সমারোহ স্তম্ভিত! কুহেলী যে তার প্রতি বেজায় রেগে আছে সেটা সে কুহেলী হেলদোল দেখেই আন্দাজ করতে পেরেছে। তবে রেগে থাকার কারণটা কি আলো? সমারোহ নিজের ভাবনা পরিবর্তন করে নেয়। আলো কেনো হতে যাবে! আলো এখন কেবলই সমারোহর বন্ধু সেটা কুহেলীও জানে। সমারোহ মানুষের অসহায়ত্বের সুযোগ না নিয়ে তার পাশে দাঁড়াতে জানে। আর কুহেলীর মাঝে বাচ্চামো থাকলেও ও এতোটা ইমমেচিওর না যে সমারোহকে সন্দেহ করবে। তবে? সমারোহ ভাবনা চিন্তা ছেদ করে যখন কুহেলী গোসল সেরে ওয়াশরুম থেকে বের হয়। আরো একবার ধাক্কা খায় সমারোহ। কুহেলীর কপালে, গলায় লেপ্টে আছে জলে সিক্ত কেশযুগল। পিঠ পুরো ভিজে গেলে চুলের পানিতে। শরীর হালকা বাকিয়ে চোখ বুঁজে তোয়ালে দিয়ে চুল মুছছে কুহেলী। সমারোহ পলকহীনভাবে চেয়ে রয় তার প্রেয়সীর দিকে। আর মনে মনে আওড়ায়, মেয়েটা এতো স্নিগ্ধ মায়াবী কেন! সমারোহর এই মুহূর্তে মনে হচ্ছপ স্বর্গ থেকে স্বয়ং কোনো এক পরী নেমে এসেছে তার ঘরে।
সমারোহকে এভাবে চেয়ে থাকতে দেখে কুহেলী কপাল কুঁচকে বেলকনিতে এসে দাঁড়ায়। আজ আকাশে চাঁদ নেই। নেই কোনো তারার চিহ্ন! কেবল শুধু কালো মেঘের ঘনঘটা। বিকেলে আকাশের সঙ্গে আড়ি করে মেঘেরদল বৃষ্টি হয়ে ঝড়েছিল। সে কি এক কান্না মেঘের! তবুও মান-অভিমানের হিসাব মেলেনি হয়তো। কুহেলী আকাশ দেখে চুপটি করে। সমারোহকে ছাড়া এই দীর্ঘ সময়টাতে যখনই ওর মন খারাপ হতো আকাশের দিকে চেয়েই শান্ত করতো নিজেকে। আজও তাই করার চেষ্টা করছে।
কুহেলীর চোখের কার্ণিশে বিন্দু বিন্দু জল এসে ভীড় করে কিন্তু টপকে পড়ার আগেই কুহেলী আবদ্ধ হয় করো শক্ত বাহুডোরে। সমারোহ শক্ত করে জরিয়ে ধরেছে কুহেলীকে। কুহেলী এক মুহুর্তের জন্য গলে যেতে চাইলেও চোখমুখ কঠিন করে নেয় আবার। মানুষটাকে মাফ করা চলবেই না। সে কুহেলী খারাপ লাগাটা কেন বুঝবে না? কুহেলী জোর করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইলে সমারোহ আরো শক্ত করে নিজের সঙ্গে চেপে ধরে তাকে। কুহেলীর মাথা এসে ঠেকেছে সমারোহর বুকের ঠিক মাঝখানে। সমারোহ হঠাৎই কুহেলীর গলায় মুখ গুঁজে দিয়ে নাক ঘষতে ঘষতে নেশা মিশ্রিত কন্ঠে বলে,
‘ এতো রাগ! এতো অভিমান আমার প্রতি যে, আমার একটু কাছেও আসা যায় না! ‘
‘ আমি কেন রাগ কাতে যাবো? ‘
কুহেলীর বাচ্চাদের মতো অভিমানী কথায় হাসি পায় সমারোহর। মেয়েটা বড়ই আহ্লাদী। সমারোহ কুহেলীকে নিজের দিকে ফিরেয়ে কপালের চুলগুলো সরিয়ে দিতে চাইলে কুহেলী ছিটকে দূরে সরে গিয়ে বলে,
‘ ধরবেন না আমাকে। ‘
‘ আচ্ছা। ‘
‘ কিহ? কি বললেন আপনি? ‘
‘ তুমিই তো না করলে। ‘
কুহেলীর রাগ এবার মাত্রা ছাড়ায়। ইচ্ছে করে সমারোহকে তুলে দুটো আছাড় মেড়ে দাঁতগুলো সব ভেঙে ফোকলা করে দিতে কিংবা নর্দমা ড্রেনের এক কোনে ছুড়ে ফেলে দিতে। অথবা অনেক জোরে সমারোহর হাতে একটা কামোড় বসাতে পারলেও হয়তো রাগ একটু কমে যেতো। তা তো আর সম্ভব না তাই রেগে গজগজ করতে করতে কুহেলী বলে,
‘ হ্যা, সেটাই তো। আমি না করেছি তাহলে কেনো ধরবেন। দরকার নেই তো। এই, আপনি আমাকে বিয়ে করেছিলেন কেনো হে? আমার ইচ্ছা করছে আপনাকে গলা টিপে মে…। ‘
কুহেলী আর কিছু বলার আগেই সমারোহ অকস্মাৎ কুহেলীর ঠোঁট জোড়া দখল করে নেয়। কুহেলী যেন তাৎক্ষণিক ঘটনাটা বুঝে উঠতেই পারেনি কি হলো। যখন বুঝতে পারে দ্রুত সরে আসতে চাইলে সমারোহ একহাতে কুহেলীর কোমর ধরে আরো কাছে টেনে নেয়। অপর হাতে কুহেলীর চুলের মুঠি শক্ত করে ধরে। কুহেলী হাত-পা ছোড়াছুড়ি করে ছুটার চেষ্টা করেও যখন ব্যার্থ হয় তখন একপর্যায়ে শান্ত হয়ে যায়। সমারোহ এবার আরও শক্ত করে নেয় বন্ধন। কিছুক্ষন পর কুহেলীকে ছেড়ে কুহেলীর কপালের সঙ্গে কপাল ঠেকিয়ে দাঁড়ায়। ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে দুজনেই। আরেকটু হলেই দম বন্ধ হয়ে আসছিল। কুহেলী কাঁপছে, চোখ খিঁচে বন্ধ করে রেখেছে। সমারোহ কুহেলীর ঠোঁটে আলতো করে আরো একবার চুমু খেয়ে বলে,
‘ এখন না কুহেলী! অনেক দূর থেকে এসছি। আমি ক্লান্ত। ‘
কুহেলী হঠাৎ চমকে তাকায় সমারোহর দিকে। সত্যিই তো! সে যাচ্ছে তা একটা মেয়ে। সমারোহর প্রতি অভিমানে সে ভুলেই গেছে মানুষটার এখন রেস্ট দরকার। সে কিনা এখনই ঝগড়া শুরু করে দিচ্ছিল। আর সমারোহ তাকে থামাতে…। ছিঃ ছিঃ, কুহেলী লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে এখন। কুহেলীকে চুপসে যেতে দেখে সমারোহ দুষ্টু হেসে কুহেলী গলায় মুখ ডুবিয়ে দেয়। নাক ঘষতে ঘষতে আলতো করে চুমু দিতে থাকে সমারোহ। কুহেলী নিজেকে গুটিয়ে নেয় লজ্জায়। কাঁপা গলায় বলে,
‘ আ’আপনি খেয়েছেন কিছু? ছাড়ুন আমি খাবার নিয়ে আসি খেয়ে ঘুমাবেন একটু। ‘
সমারোহ যেন কানেই নেয়না কুহেলীর কথা। কুহেলী এবার ছটফট করতে থাকে সমারোহর কাছ থেকে ছুটার জন্য। সমারোহর রাগ উঠে যায় মুহূর্তেই। রেগে কুহেলীকে কিছু বলতে যাবে তার আগে কুহেলী হঠাৎ কামোড় বসিয়ে দেয় সমারোহর হাতে। সমারোহ ভ্রুঁ কুঁচকে দ্রুত ছেড়ে দেয় কুহেলীকে। আর কুহেলী সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে পালায় ঘর থেকে। সমারোহ কেবল হতভম্ব হয়ে যায় কুহেলীর এহেন কান্ডে। কি ছিল এটা! সমারোহর মেজাজ প্রচন্ড গরম হয়ে যায় এবার। সবসময় এই মেয়ে তার রোমান্টিক মুডের বারোটা বাজিয়ে দেয়। কিচ্ছু বোঝেনা একদম। সমারোহ দাঁতে দাঁত কিড়মিড় করে বিড়বিড় করে বলে,
‘ পালিয়ে আর যাবা কই, তোমাকে আমি দেখে নেবো ম্যাডাম। ‘
সমারোহ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানায় বসে নিজের হাতের দিকে চেয়ে দেখে লাল হয়ে গেছে জায়গাটা। আরেকটু হলেই হয়তো কেটে যেতো। ফিক করে হেসে এবার সে। কি পাগল একটা মেয়ে! সমারোহকে দেখেই কেনো যেন খালি পালাই পালাই করে। নাহ আর না, এবার এই উড়নচণ্ডীকে একদম নিজের সঙ্গে বেধে ফেলবে সমারোহ। অনেক ছাড় দিয়েছে সে। আর না। এবার এতো এতো ভালোবাসবে যে কুহেলী সমারোহ ছাড়া আর কিছু বুঝবেই না।
কুহেলী ঘর থেকে দৌড়ে রান্নাঘরে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। সে ভাবতেই পারেনি সমারোহ এমন একটা কাজ করে বসবে। একটু আগের কথা ভাবতেই কুহেলীর হাত আপনা-আপনি ঠোঁটে চলে যায়। লজ্জায় নিজের মুখ ঢেকে ফেলে দু’হাতে। রান্নাঘরে যে এই সময় কেউ থাকতে পারে বেমালুম ভুলে গিয়েছে সে। সবার খাওয়া-দাওয়া শেষে সবকিছু গুছিয়ে রাখছিল মাইশা। কুহেলী এহেন কান্ডে আওয়াজ করে হেসে ফেলে সে। কুহেলী চমকে উঠে মাইশাকে দেখে। মুহুর্তে নিজেকে স্বাভাবিক জরে ফেলে। মাইশা কুহেলীর কাছে এসে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে,
‘ ভাইয়া কি করলো যে কুহুপাখি লজ্জায় মরে যাচ্ছে? আমাকে কি বলা যাবে? ‘
কুহেলীর লজ্জা যেন দ্বিগুণ বেড়ে যায়। ঢোক গিলে কোনোরকমে বলে, ‘ না তুমি যেমন ভাবছো তেমনটা একদম না আপু? ‘
‘ তাহলে কেমন শুনি? ‘
‘ আসলে… ‘
‘ এর থেকেও বেশি কিছু করলো বুঝি? ‘
‘ ওফ, আপু তুমিও না! ‘
মাইশা স্বশব্দে হেসে উঠে। কুহেলীর হাত ধরে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে,
‘ সবে তো শুরু। ভাইয়া কিন্তু খুব রোমান্টিক। সামলাতে পারবা তো? ‘
‘ আপু! ‘
চোখ বড়সড় করে তাকায় কুহেলী মাইশার দিকে। মাইশা মৃদু হেসে বলে, ‘ আচ্ছা আচ্ছা আর বলছি না কিছু। ওইদিকে খাবার রাখা আছে। বেড়ে নিও একটু হে! আমি যাই সান্দ্র ডাকছিলো। ‘
মাইশা চলে গেলে কুহেলী প্লেটে খাবার নিতে থাকে সমারোহর জন্য। আলো তখন রান্নাঘরে আসে জগে পানি নেয়ার জন্য। কুহেলীজে দেখেই মুচকি হেসে বলে,
‘ কেমন আছো কুহেলী? এখন এভাবে দৌড়ে চলে গেলে ভালো-মন্দ খবরই নেয়া হলো না। ‘
‘ ভালো। আপনি? ‘
‘ খুব ভালো। পড়ালেখা কেমন চলছে? ‘
‘ আলহামদুলিল্লাহ। ‘
‘ কার জন্য খাবার নিচ্ছো? সমারোহ? ‘
‘ হুম। ‘
‘ কিন্তু সমারোহ তো শুঁটকি মাছ খায় না, তুমি নিচ্ছো যে? ‘
‘ কি বলছেন আপু? আমি উনাকে খেতে দেখেছি শুটকি মাছের ভর্তা। ‘
‘ ভুল দেখেছো। সমারোহ শুটকি একদম খেতে পারে না। গরুর মাংসের তো ওর এলার্জি আছে। তুমি জানো না হয়তো। সমারোহর জন্য আন্টি আলাদা করে মুরগী রান্না করেছে ওটা নাও। আর সমারোহর পছন্দের রুই মাছের কালিয়া আছে, ওটা নাও। ‘
কুহেলীর মেজাজ তুঙ্গে উঠে যায় এবার আলোর কথা শুনে। কুহেলীর জামাই সে যা ইচ্ছা তা খাওয়াবে, এই মেয়ের অত মাথাব্যথা কেন? রাগে যেন পুরো শরীর জ্বলে যাচ্ছে কুহেলীর। চোখ বন্ধ করে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে কুহেলী নিজেকে। সে তর্কে যেতে চায় না, কথাও বাড়াতে চায় না। অন্যভাবে সে শিক্ষা দেবে আলোকে। কুহেলী বাকি তরকারিগুলো প্লেটে তুলে নিয়ে আলোর দিকে চেয়ে বিস্তর এক হাসি দিয়ে বলে,
‘ আপু মাংস আর শুটকি আমার জন্য। সমারোহর জন্য বাকিগুলো। আসলে সমারোহ বলেছেন এখন থেকে আমাকে উনার সঙ্গে এক প্লেটেই খেতে হবে। তাই আরকি! ‘
আলোর পাশ কাটিয়ে চলে যায় কুহেলী। কুহেলীর কথা শুনে আলোর চেহারা জুড়ে অন্ধকার নেমে আসে আলোর। বিরক্তি যেন শিরায় শিরায় ছড়িয়ে পড়ে তার।
চলবে