আঙুলে আঙুল পর্ব-০৫

0
184

#আঙুলে_আঙুল
#পর্ব (৫)

অরুণিমা খেয়াল করল, মাইমূনের ক্লাবটি এমন স্থানে অবস্থিত যে, সে মলে যাওয়া-আসার সময় চোখে পড়ে। মাইমূন কি তাকে এখান থেকেই নজরে রেখেছে? হতে পারে। এর আগে এই ছেলেটিকে কোথাও দেখেনি। এই ক্লাবটার দিকেও ভালো করে তাকায়নি কখনও।

অরুণিমা ধীর কদমে ক্লাবের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। শাটার তোলা, কাচের দরজাটি বন্ধ। আশপাশে কেউ নেই। সে একবার ডানে ও বামে তাকাল সতর্ক দৃষ্টিতে। তারপরে দরজা সংলগ্ন হাতলটি ধরতে চাইল। প্রয়োজন পড়ল না। তার পূর্বেই ভেতর থেকে একটি ছেলেকে এগিয়ে আসতে দেখল। দরজাটা ভেতরে টেনে নিয়ে উঁকি দিল। অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বলল,
” আসসালামু আলাইকুম, ভাবি। ভালো আছেন? ”

অরুণিমা সালামের উত্তর নিল মনে মনে। মাথা নেড়ে ভালো আছে বুঝাল। ছেলেটি পুনরায় মৃদু স্বরে সুধাল,
” মিয়া ভাইকে খুঁজছেন? ”

অরুণিমার সম্পূর্ণ মনোযোগ ক্লাবের ভেতরে। সন্ধিৎসু দৃষ্টি জোড়া মাইমূনকেই খুঁজছে। ধরা পড়ে যাওয়ায় লজ্জা পেল। দৃষ্টি ফিরিয়ে আনল দ্রুত। অন্যদিকে চেয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,
” হ্যাঁ, দেখতে পাচ্ছি না যে। কোথায় তিনি? ”
” ভার্সিটিতে। ”
” পড়াশোনাও করে নাকি? ”

অরুণিমার কণ্ঠস্বরে একই সাথে বিস্ময় ও বিদ্রুপ। ছেলেটি গায়ে মাখল না। আগের মতোই উত্তর করল,
” আগে করত। এখন শেষ হয়ে গেছে। ”
” তাহলে ভার্সিটিতে গেছে কেন? ”
” অন্য দরকারে। ”

অরুণিমার ইচ্ছে হলো দরকারটা জানতে। কিন্তু জিজ্ঞেস করল না। অপছন্দ জিনিসের প্রতি আগ্রহ, কৌতূহল থাকতে নেই। তাহলে চোখের পলকে তা পছন্দের জিনিস হয়ে যায়। সে চায় না, মাইমূন তার পছন্দের হোক। তাই ইচ্ছেটাকে অগ্রাহ্য করে বলল,
” তিনি এলে আমার কথা বলবেন। ”

ছেলেটি প্রশ্ন করল,
” আপনার কথা কী বলব? ”

তার সহজ গলার সরল প্রশ্নটা অরুণিমাকে ভাবনায় ফেলে দিল। কী বলবে! বিরাট ও ভারী প্রশ্ন বোধ হলো। মাইমূনকে নিয়ে তার কাছে কোনো কথা-ই নেই। যা আছে, তা কাঁটা। যেটা দেওয়ার জন্য আগ বাড়িয়ে আসা। অথচ মানুষটিই নেই! অরুণিমা খানিকক্ষণ ভেবে বলল,
” বলবে, কোথাও না যেতে। তার সাথে আমার জরুরি কথা আছে। ”

ছেলেটি মাথা নেড়ে বুঝাল, সে এ কথাটি বলবে।

____________
অরুণিমা মলে খদ্দেরদের নানান রকম সাজের প্রসাধনি দেখানোর ফাঁকে ফাঁকে ভাবছে, মাইমূনকে কী রকম কাঁটা দান করা উচিত। এমন কাঁটা দিতে হবে, যা শুধু তার শরীর না মনেও গিয়ে বিঁধে। ব্যথা ও যন্ত্রণায় যেন সারাক্ষণই ভোগে। কত বড় সাহস, তার অনুরোধের এক ফোঁটাও দাম দিল না! না বলে ফুল পাঠাচ্ছে, আবার ছেলেগুলো এখনও সমানে ভাবি বলে ডাকছে!

দুপুরে খাওয়ার জন্য বেরুনোর পূর্বে অরুণিমা জুয়েলারি দোকানে গেল। মায়ের বিয়ের আংটিটা উজ্জ্বলতা হারিয়ে গেছে। ক্ষয়ে গিয়ে সামান্য বাঁকাও হয়েছে। সেটি ঠিক করার জন্য কাল এই দোকানে দিয়েছিল। আজ নিয়ে যাবে, তাই আসা। আংটিটা ব্যাগে ভরতে গিয়ে মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চাপল। আংটিটা বাম হাতের অনামিকা আঙুলে পরে ফেলল দ্রুত। প্রফুল্লচিত্তে বেরিয়ে এলো রাস্তায়। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি। চোখের তারায় আনন্দের ঝলকানি।

মাইমূনের ক্লাবের সামনে এসে গলার ভেতরটা পরিষ্কার করে নিল। মনে মনে কিছু কথা গুছিয়ে নিয়ে দরজায় হাত দিল। এবার অন্যের খুলে দেওয়ার অপেক্ষা করল না। ভেতরে উঁকি মেরে বলল,
” মিয়া ভাই, আছেন? ”

ভেতর থেকে উত্তর এলো,
” নেই। ”

অরুণিমা ভালো করে সবগুলো মুখ দেখল। তিনটে ছেলে। একই বয়সের হবে। মোবাইলের উপর হুমড়ি খেয়ে ছিল। তাকে দেখে সকলে আলাদা হয়ে দাঁড়াল। কাপড় টানল, চুল ঠিক করল। হাসি মুখ বানাল। এরমধ্যে কে তার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে বুঝা মুশকিল। একেক সময় একেক জনের সাথে কথা হচ্ছে, মুখটা চেনা হলেও কণ্ঠটা মনে রাখতে পারছে না। তাও ভালো, একজনের নাম জানা হয়েছিল!

তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে লম্বা ছেলেটা এক কদম এগিয়ে এসে বলল,
” ভাবি, ভেতরে আসবেন? ”

তারপরে আরেক জন চেয়ার ঠিক করে দিয়ে বলল,
” ভাবি, চা খাবেন নাকি কোক? ”

শেষজন বলল,
” ভাবি, মিয়া ভাইকে ডেকে আনব? ”

অরুণিমা সকলের প্রশ্নকেই অবজ্ঞা করে বলল,
” মোবাইলটা কার? ”

শেষেরজন বলল,
” আমার। ”
” আমার হাতের একটা ছবি তুলো তো। ”

ছেলেটি বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাল না। ভাবির আদেশ পালন করল। ছবি তোলা শেষে অরুণিমা বলল,
” মিয়া ভাইকে এই ছবিটা দেখিয়ে বলবে, এক সুদর্শন পুলিশের সাথে আমার আংটি বদল হয়েছে। খুব শীঘ্রই আমার বিয়ে। সে যেন, আমাকে ভুলে যায়। ”

তিনজনে একে-অপরের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করল। অতঃপর সমস্বরে জিজ্ঞেস করল,
” সত্যি, ভাবি? ”

অরুণিমার হাসি পেল। মনে হচ্ছে, ঠিকমতো জব্দ করতে পেরেছে। তার অনুরোধ উপেক্ষার ফল এমনই হওয়া উচিত। সামনাসামনি বলল,
” খাঁটি সত্যি। ”

বেরিয়ে যেতে যেতে সাবধান বাণী ছুঁড়ে গেল,
” আমাকে আর কখনও ভাবি ডাকবে না। শুনেছি, আমার হবু পুলিশ বর খুব রাগী। সে নিশ্চয় চাইবে না, তার বউকে অন্যের কথায় কেউ ভাবি ডাকুক? ”

অরুণিমা দুপুরে খাওয়া শেষ করে মলে যাওয়ার সময় আড় চোখে ক্লাবের দিকে তাকায়। শাটার নামানো, ক্লাব বন্ধ। আশপাশে মাইমূন নেই, তার সাঙ্গপাঙ্গও না। সে খুব খুশি হলো। চিন্তার অবসান ঘটেছে। বিপদ নেই আর। উপহারের বিপরীতে উপহারটা যুতসই হয়েছে একদম।

___________
মনের খুশি অরুণিমার কথা ও ব্যবহারেও প্রকাশ পাচ্ছে। কাস্টমারদের ডেকে এনে একের পর এক সাজসামগ্রী বিক্রি করে চলেছে। দোকানের মালিকও সন্তুষ্ট। একবার তো বলেই ফেললেন, এ রকম বিক্রি চালাতে পারলে অরুণিমার বেতন বাড়িয়ে দিবেন। সে দ্বিগুণ উৎসাহে কাস্টমারদের ডাকতে লাগল। পণ্য দেখাল, গুণ শোনাল, পরিশেষে প্যাকেটে ভরে দামটাও আদায় করছিল সমান তালে। সহসাই বজ্রপাতের মতো মাইমূনের আগমন ঘটল। কোনো কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই হুংকার ছাড়ল,
” শাটার নামা। ”

অরুণিমা ভূত দেখার মতো চমকে ওঠল। ক্ষণকাল স্তম্ভিত থেকে মৃদু স্বরে উচ্চারণ করল,
” মিয়া ভাই! ”

মাইমূন তৎক্ষনাৎ কঠিন গলায় শুধরে দিল,
” মাইমূন। শুধু মাইমূন। ”

অরুণিমার ভয়ে হাত-পা কাঁপছে। মাইমূন একা আসেনি। দশ-বারোজন ছেলেও আছে সঙ্গে। শাটার নামিয়ে দোকান বন্ধ ঘোষণা করেছে। মাইমূন পেছনে ঘাড় বাঁকিয়ে বলল,
” কাজী কোথায়? ”

ছেলেগুলোর পেছন থেকে এক লোক সামনে এগিয়ে এলো। মাঝবয়সী। ফর্সা মুখে চার আঙুল সমান দাড়ি। পরনে সাদা পাঞ্জাবি।

দোকানের মালিক ভয়ে এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিল চুপচাপ। এবার মুখ খুলল,
” মিয়া ভাই? কোনো সমস্যা? ”

মাইমূন তার দিকে না তাকিয়ে প্রত্যুত্তর করল,
” বিরাট সমস্যা। ভবিষ্যৎ ধ্বংসের পথে! ”
” তার কারণ কি আমি? ”

এই পর্যায়ে মাইমূন চোখ ঘুরিয়ে তাকাল। তিনি ভয়ে চোখ নামিয়ে নিলেন। আমতা আমতা করে বললেন,
” আমার দোকানে..”

তাকে কথা শেষ করতে দিল না। মাইমূন কাজীর উদ্দেশ্যে বলল,
” কাজী দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বিয়ে পরান। ”

কাজীর চোখ-মুখও ভয়ার্ত। ভীতস্বরে জিজ্ঞেস করল,
” সাক্ষী কোথায়? ”

মাইমূন ছেলেদের দিকে তাকালে কাজী মনে করিয়ে দিল,
” ওরা প্রাপ্তবয়স্ক নয়। বিয়ে বৈধ হতে হলে কমপক্ষে দুজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ অথবা একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ও দুজন মহিলা লাগবে। ”

মাইমূন দোকানদারের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
” সাক্ষী হবেন না? ”

সে কাঁপা স্বরে বলল,
” হব। ”

উত্তর পেয়ে পেছনে তাকিয়ে আদেশ করল,
” আরেকজন সাক্ষী নিয়ে আয়। ”

শাটার তুলে দুজন ছেলে বেরিয়ে গেল। অরুণিমার চোখ-মুখ আতঙ্কে ঠাসা। এই মিয়া ভাইকে তার মালিক চেনে, ভয়ও পায়। সে আশ্চর্য না হয়ে পারছে না। মাইমূন এবার সম্পূর্ণ মনোযোগ আনল অরুণিমার দিকে। বাম হাতের আঙুলে আংটিটা জ্বলজ্বল করছে। সেদিকে চেয়ে বলল,
” আমার জন্য আরেকটু অপেক্ষা করতে পারলে না! এত তাড়া ছিল তোমার? ”

অরুণিমা কী উত্তর দিবে বুঝে উঠতে পারছে না। কিসের প্রতি তাড়া? অপেক্ষা আসছে কেন এখানে? মাইমূন নিজ থেকে আবার বলল,
” কাল রাতের পার্টিতে মদপানের আয়োজনও ছিল। তুমি আমাকে খুঁজে বের করেছ, এই খুশিতে একটু বেশি খেয়ে ফেলেছিলাম। সারাদিন ঘুমিয়ে নেশা কাটিয়ে ক্লাবে এসে শুনি, তুমি আমার খোঁজ করছ। তখনই বুঝেছি, কোনো ঝামেলা আছে। ঝামেলা উদ্ঘাটন করার সুযোগও পেলাম না, বিয়ের সংবাদ পাঠালে! ”

অরুণিমা চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করল,
” আপনি মদও খান? ”
” খাই তো। সেজন্যই তো বিপদটা আটকাতে পারলাম না। অবশ্য অর্ধেকটা আটকে দিয়েছি। আংটি বদল হয়েছে, বিয়ে না। সেটা তো আমি করব। ”

অরুণিমার কানে শেষ কথাগুলো পৌঁছাল না। সে রাগ চোখে তাকিয়ে আছে পেছনের দলের একজনের উপর। এই ছেলেটি তাকে মিথ্যা বলেছে। মাইমূন ভার্সিটিতে যায়নি। মাতাল হয়ে পড়েছিল কোথাও। ছেলেটি উত্তপ্ত দৃষ্টিতে গলে গেল যেন! মাথা ঝুকিয়ে ফেলল। তার এই অমনোযোগের সুযোগে মাইমূন হাত টেনে নিল নিজের দিকে। পরে থাকা আংটিটা খুলে ছুঁড়ে মারল এক কোণে। তারপর নিজের আনা আংটিটা পরিয়ে বলল,
” আমি আংটি পরিয়েছি। আমিই বিয়ে করব। ”

আংটি পরার তীক্ষ্ণ শব্দে হুঁশ ফেরে অরুণিমার। আঁতকে উঠে বলল,
” ওটা আমার মায়ের আংটি ছিল। কোথায় ফেলেছেন? ”

সে উত্তরের অপেক্ষা করল না। পাগলের মতো খুঁজতে শুরু করল। মাইমূন কিছুক্ষণ নীরব থেকে সুধাল,
” তোমার মায়ের আংটি দিয়ে এনগেজমেন্ট হয়েছে? ওটা সুদর্শন পুলিশ নাকি ফকির পুলিশ? ”

চলবে