আঙুলে আঙুল পর্ব-০৬

0
186

আঙুলে আঙুল

পর্ব (৬)

” তোমার মায়ের আংটি দিয়ে এনগেজমেন্ট হয়েছে? ওটা সুদর্শন পুলিশ নাকি ফকির পুলিশ? ”

মাইমূনের শ্লেষাত্মক প্রশ্নটির উত্তর এলো না। অরুণিমা পুরো দমে আংটি খোঁজায় ব্যস্ত। দোকানের মালিক, কাজী ও অন্যরা অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে দেখছে, এই প্রমত্ত নারীটিকে। সে কোণায় কোণায় হাতড়াচ্ছে। এটা-সেটা উল্টাচ্ছে। উবু হয়ে খুঁজতে খুঁজতে শুয়ে পড়েছে প্রায়। মাইমূনের চোখে এত কিছু পড়ল না। ঠিকমতো খেয়ালও করছে না। তার ধ্যান-জ্ঞানে শুধু বিয়ের ব্যাপারটিই ঘুরপাক খাচ্ছে। টেবিলের মতো লম্বা বস্তুটি পেরিয়ে অরুণিমার কাছে গিয়ে বসল। বলল,
” আমার মতো রাজপুত্র থাকতে ফকিরকে বিয়ে করবে? অসম্ভব! এই মাইমূন কখনও মেনে নিবে না। ”

এসময় আরেকজন সাক্ষী এসে পৌঁছাল। মাইমূন কাজীর উদ্দেশ্যে বলল,
” কাজী সাহেব, বিয়ে পড়াচ্ছেন না কেন? মাইকিংয়ের অপেক্ষায় আছেন? জলদি শুরু করেন। ”

ধমক খেয়ে কাজী বিয়ের কার্য শুরু করল। পাত্র-পাত্রীর তথ্যাদি আগে থেকেই লিপিবদ্ধ ছিল। সেগুলো সুন্দর করে সকলকে পড়ে শুনিয়ে বলল,
” বলো মা, কবুল। ”

অরুণিমার ধ্যানমগ্ন ঐ আংটি খোঁজাতেই আছে। কাজীর কথাটি কানে একটুও ঢুকল না। মাইমূন আগ্রহ নিয়ে অরুণিমার মুখের দিকে চেয়ে আছে। কয়েক সেকেন্ড কেটে যাওয়ার পরও যখন কবুল বলল না। তখন তার আগ্রহ ও ধৈর্যের বিনাশ ঘটল। চড়া গলায় আদেশের সুরে বলল,
” কবুল বলো। ”

অরুণিমা চমকে কেঁপে ওঠল। মাথাটা বাড়ি খেল দেয়াল সংলগ্ন তাকের সাথে। ব্যথায় ‘ আহ! ‘ শব্দটা উচ্চারণ করেও নিজেকে সামলে নিল। সকলের দিকে চেয়ে পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করছে তখনই মাইমূন আবার বলল,
” কী হলো? কবুল বলো। ”

অরুণিমার কপালে ভাঁজ পড়ল। চোখের ভেতরটা লাল হলো। নাক ফুলিয়ে রাগ নিয়ে বলল,
” বলব না। ”
” কেন বলবে না? ”
” আপনাকে বিয়ে করব না তাই। আমার পাশ থেকে সরুন বলছি। ”

মাইমূন সরল না। জিজ্ঞেস করল,
” কেন করবে না? আমি দেখতে সুদর্শন না? তোমার ফকির পুলিশের চেয়ে অনেক বেশি সুদর্শন। চেয়ে দেখ। ”

অরুণিমা উঠে দাঁড়াল। বিরক্তে তার মাথার ভেতরটা ঝিম ধরে আছে। কী চেয়েছিল, কী পাচ্ছে! ঝামেলা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য যে মিথ্যাটা বলেছিল, সেটা অন্য ভাবে সত্য হয়ে যাচ্ছে। উফ! এখন এই বিপদ থেকে মুক্তি পাবে কী করে? অরুণিমা স্বীকার করতে বাধ্য হলো, উপহারটা একদমই যুতসই হয়নি। আরও ভালো কিছু পরিকল্পনা করা উচিত ছিল।

মাইমূনও উঠে দাঁড়াল। অরুণিমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,
” অন্যদিকে তাকিয়ে থাকলে আমার সৌন্দর্য দেখবে কীভাবে? পরে তো অলস শিক্ষকদের মতো, খাতা না দেখেই ফলাফল দিয়ে দিবে। এ কিন্তু ভারি অন্যায়, অরুণিমা। ”

অরুণিমা বিরক্তের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে। অযথায় জেদ দেখিয়ে বলল,
” আমি পুলিশকেই বিয়ে করব। ফকির হলে সমস্যা নেই, কুৎসিত হলেও সমস্যা নেই। ”

মাইমূন আশাহত হলো। এই মেয়েকে সৌন্দর্য দিয়ে বশ করা যাচ্ছে না, অর্থবিত্ত দিয়েও না। অন্য কোনো উপায় ভাবতে হবে। কিন্তু কী উপায়? সে খানিক ভাবনায় জড়িয়ে পড়ল। ভাবনার মধ্যে বিয়ের কথাটা মনে পড়ে গেল। মনে মনে ঠিক করল, আগে বিয়েটা হোক, তারপরে ভেবে একটা উপায় বের করা যাবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজীর দিকে চেয়ে বলল,
” কবুল বাদ, সাইনের ব্যবস্থা করেন। রেজিস্ট্রি পেপার এনেছেন? ”

কাজী মাথা নেড়ে জানাল এনেছে। তারপরেই তাড়াহুড়ো করে কাগজ ও কলম এগিয়ে দিল। মাইমূন এক নিশ্বাসে নিজের নামটা লেখা শেষ করল। অরুণিমার দিকে কলমটা বাড়িয়ে ধরতে সে অগ্নিশর্মার ন্যায় তাকাল। মাইমূনের ইচ্ছে হলো, পাত্রীর জায়গায় নিজেই সাইন করে দিতে। অরুণিমা নামটা এত সুন্দর করে লিখবে যে, নাম দেখেই পাত্রী বুঝে ফেলবে মাইমূন তাকে কত ভালোবাসে। সেটা সম্ভব হচ্ছে না তাই জিজ্ঞেস করল,
” কাজী, নাম লেখা কি বাধ্যতামূলক? টিপসই দিলে হবে না? ”

অরুণিমার বুক কেঁপে ওঠল। রাগ উবে গিয়ে ভয় এসে জড়ো হলো মুখমন্ডলে। হাত দুটো মুঠো করে পেছনে লুকিয়ে ফেলল চট করে। জোর করে নাম লেখাতে না পারলেও টিপসই ঠিকই নিতে পারবে। এতগুলো পুরুষের সাথে গায়ের জোরে কি পেরে উঠতে পারবে? তার শ্বাসরুদ্ধ হয়ে এলো। বাবার কথা মনে পড়ল, মায়ের কথা মনে পড়ল, ছোট ভাই-বোন দুটোর কথাও। সকলে যখন শুনবে সে একা একা বিয়ে করে ফেলেছে তখন নিশ্চয় খুব কষ্ট পাবে? তার মুখও দেখতে চাইবে না। সোজা বাড়ি থেকে বের করে দিবে। তাদের ছাড়া অরুণিমা কি বাঁচতে পারবে? পারবে না। এক মিনিটও বাঁচতে পারবে না। অরুণিমা আচমকা সত্য স্বীকার করল,
” আমার কোনো বিয়ে-টিয়ে হবে না। আংটি বদলও হয়নি। আপনাকে কষ্ট দিতে মিথ্যা বলেছিলাম। ”

মাইমূনের মুখের ভাব বদলাল না। অরুণিমা বুঝে গেল, তার কথা বিশ্বাস করছে না। তাই পুনরায় বলল,
” আমি সত্যি বলছি। বিশ্বাস করুন। ওটা আমার মায়ের বিয়ের আংটি। ঠিক করার জন্য এনেছিলাম। ”

ধীরে ধীরে পুরো ঘটনাই খুলে বলল। মাইমূন বিশ্বাস করতে শুরু করলে অরুণিমা জানাল, সে এখনই বিয়ে করতে চায় না। একা একা তো একদমই না। কথা শোনার ফাঁকে মাইমূন নিজের দলবলের দিকে চোখের ইশারা করেছিল। ইশারা পেয়ে সকলে আংটি খোঁজায় লেগে পড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যে পেয়েও যায়। মাইমূন সেটি নিজের হাতের মুঠোয় চেপে ধরে বলল,
” তোমার আংটি বদল হয়েছে। সেটা আমার সাথে, কিছুক্ষণ আগে। বিয়েটা আপাতত স্থগিত থাকল। তুমি যেদিন চাইবে, সেদিন ই হবে। তোমার পরিবারের মত নিয়ে, খুব বড় আয়োজন করে হবে। ”

সে যেমন আচমকা হাজির হয়েছিল, তেমন আচমকাই চলে গেল। অরুণিমা দোকানের জিনিসপত্র গোছানোতে মনোযোগ দিলে দোকানদার জিজ্ঞেস করলেন,
” তুমি মিয়া ভাইয়ের নজরে পড়লে কীভাবে? ”

অরুণিমা যতটুকু জানে, ততটুকু গুছিয়ে বলল। দোকানদার সব শুনে মাথা নেড়ে চিন্তিত স্বরে বললেন,
” খুব ভালেভাবেই ফেঁসে গেছ। মুক্ত হওয়ার কোনো পথ দেখছি না। থানা-পুলিশ করেও লাভ নেই, বিপদ বাড়বে আরও। ”

অরুণিমার চিত্ত অস্থির হয়ে পড়ল। অসহায় স্বরে সুধাল,
” কোনো পথই কি নেই, চাচা? ”

চাচা কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললেন,
” ভালো করে বুঝিয়ে অনুরোধ করে দেখতে পার। মিয়া ভাইয়ের চলাফেরা খারাপ হলেও মনটা ভালো। দয়া-মায়া আছে এখনও। ”

অরুণিমা বিপরীতে কিছু বলল না। মনে পড়ল, আগেও একবার অনুরোধ করেছিল, রাখেনি। আবার চেষ্টা করে লাভ হবে কি?

____________
শূভ্রা কলেজে ঢুকে প্রথমে অফিস রুমে দেখা করেছিল। আইডি কার্ড চাইলে জানতে পারে, তাদের কাছে কোনো কার্ড জমা পড়েনি। সে ভীষণ অবাক হয়, রাগও ওঠে। বাবা তাকে মিথ্যা বলেছে! এই অবস্থায় ক্লাস শেষ করে। ছুটির পর বাড়িতে না গিয়ে, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয় কলেজের মাঠে। আড্ডার ফাঁকে চোখ পড়ে দূরে দুটো মানুষের উপর। ভালো করে তাকাতে চিনতে পারে, একজন তাদের আইসিটি শিক্ষক, অন্যজন সেই মানুষটা। হলে ছবি দেখতে গিয়ে যার কাছে ধরা পড়েছিল। মুহূর্তেই তার ভাবনা বদলে গেল। মনে হলো, বাবা নয় এই লোকটা মিথ্যা বলেছে। শূভ্রা তার সাথের বন্ধু তপুকে জিজ্ঞেস করল,
” স্যারের সাথে ঐ লোকটাকে চিনিস? ”

তপু চোখ সরু সরু করে তাকাল দূরের মানুষ দুটোর দিকে। তারপর বলল,
” চিনি তো। ”
” কে? কলেজের কিছু হয়? ”
” এতকিছু তো জানি না। কিন্তু শুনেছি, এই কলেজ যিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তার ছেলে হয়। আমাদের নবীন বরণের সময় বিশেষ অতিথি হয়ে এসেছিল। দেখিসনি? বিশাল বক্তৃতাও তো দিয়েছিল। ”

শূভ্রা নবীন বরণের সময় ছিল না। সেই সময় সে গ্রামে ছিল। ভর্তির কাজ পুরোটাই বাবা করেছে। পরবর্তীতে এখানে নতুন বাসা নিয়ে উঠতে উঠতে অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছিল। অনেকগুলো ক্লাসও করতে পারেনি।

” নামটা যেন কী? ”

তপু উত্তর দিল,
” সঞ্জয়ান সাখাওয়াত। ”

শূভ্রা ভেঙিয়ে বলল,
” নামটা সুন্দর না, মানুষটাও না। ”

সে আড্ডায় মনোযোগ দিতে চাইল, পারল না। সঞ্জয়ান স্যারের সাথে কথা শেষ করে কলেজ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। শূভ্রার কী মনে হলো কে জানে! সেও আড্ডা ছেড়ে উঠে পড়ল। দৌড়ে সঞ্জয়ানের পিছু নিল। কলেজের গেইট ও আঙিনা পার হওয়ার পরই উঁচু স্বরে ডাকল,
” সাজনা শাক। এই সাজনা শাক। দাঁড়ান বলছি। ”

সঞ্জয়ান দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য হলো। পেছন ফিরে শূভ্রাকে এক নজর দেখে চিনে ফেললেও আশপাশটা তাকাল। বুঝার চেষ্টা করছে এমন করে কাকে ডাকছে। ততক্ষণে শূভ্রা দৌড়ে কাছে পৌঁছে গেল। জোরে জোরে নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
” আপনাকেই ডাকছি। ”
” আমাকে ডাকছিলে? কেন? ”

শূভ্রা উত্তর দেওয়ার সময় পেল না। তার আগেই সঞ্জয়ানের মনে পড়ল, মেয়েটা তাকে অদ্ভুত কোনে শব্দে সম্বোধন করেছে। তাই পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
” কী বলে ডাকছিলে? ”

শূভ্রা নির্ভয়ে বলল,
” সাজনা শাক। ”

চলবে