আঙুলে আঙুল পর্ব-১১+১২

0
177

#আঙুলে_আঙুল
পর্ব (১১)

অরুণিমা দরজা খুলে দেখল, একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় লাল ক্যাপ, মুখে লাল মাস্ক। হাতে বেশ বড়সড় একটি প্যাকেট। ডেলিভারি বয়’এর বেশভূষার আড়ালে থাকা মানুষটিকে এক পলকেই চিনে ফেলল। পেছনে দেখে নিয়ে ফিসফিস স্বরে বলল,
” আপনি! ”

মাইমূনের চোখজোড়ায় আশ্চর্য দ্যুতি ছড়াচ্ছিল। এবার সেটি আনন্দের সাথে লুটোপুটি খেল। টান টান করে থাকা সিনাটা একটু নয়নীয় হলো। মাথাটা সামান্য ঝুকে বলল,
” কিছু সেকেন্ড পূর্বেও আমি আফসোস করছিলাম এটা ভেবে যে, তুমি আমার দিকে ভালো করে তাকাওনি। অথচ মাত্রই আমার আফসোস দূর করে প্রমাণ করলে, শুধু ভালো করে না খুব ভালো করে তাকিয়েছ। নাহলে চোখ দেখে এত দ্রুত চিনে ফেল? অরুণিমা, আমার ভালোবাসা নামক চুম্বকে আটকে পড়েছ! ”

অরুণিমা এই আবেগঘন কথাবার্তাকে পাত্তা দিতে পারল না। তার হৃদয়ে হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে। বুক জুড়ে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে। বার বার পেছনে তাকিয়ে দেখছে, মা আসছে নাকি। অন্যরা ঘুমিয়ে পড়লেও নাজিয়া বেগম এখনও সজাগ। আরও একবার পেছনে দৃষ্টি ঘুরিয়ে এনে বলল,
” এখানে কী করছেন? ”

মাইমূনকে উত্তর দেওয়ার সুযোগ দিল না। ফিসফিস কণ্ঠস্বরে একটু বিরক্ত ও রাগ মাখিয়ে বলল,
” দুপুরে কী যেন বলেছিলেন? আমার আগে-পিছে ঘুরেন না। আমি বললেই আসেন, না হলে আসেন না। সেই কথার কী হলো? আমি কি আপনাকে ডেকেছি? ”

অরুণিমার অপ্রসন্ন মুখটায় চেয়ে থেকে প্রত্যুত্তরে মাইমূন বলল,
” যে কারণে ডেকেছিলে, সেটা তো সম্পন্ন হয়নি। ”
” তাই বলে আমার বাড়িতে চলে আসবেন? এত রাতে? ”

মাইমূন একটু অন্যরকম স্বরে বলল,
” কী করব! অর্ধেক আলাপটা মাছের কাঁটার মতো মনে ও মাথায় গেঁথে আছে। কিছুতেই সরাতে পারছি না, শান্তি হারিয়ে ফেলেছি। ”

অরুণিমার অস্থির দৃষ্টি স্থির হলো মাইমূনের চোখজোড়ায়। একটু আগের সেই দ্যুতিটা নেই। রয়েছে তীব্র ব্যাকুলতা! চঞ্চলতা। তার তাড়িয়ে দেওয়ার ইচ্ছে হলেও প্রকাশ করতে পারল না। জিজ্ঞেস করল,
” কী করলে শান্তি ফিরে পাবেন। ”

মাইমূন এক মুহূর্তও দেরি করল না। সঙ্গে সঙ্গে উপায়টা বলল,
” প্রতিশ্রুতির পত্র পেলে। ”

অরুণিমা শুরুতে বুঝতে পারল না। প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে চাইতেই মনে পড়ে গেল, মাইমূন তার কাছে ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি চেয়েছিল, বিয়েরও। বিনিময়েই তার চাওয়াটাও পূরণ হবে। সে ভাবনায় পড়ে গেল, মুক্তি চাইতে গিয়ে কি আজীবনের জন্য বন্দি হয়ে যাবে? কথা দিলে কি ভেঙে ফেলা সহজ হবে? কিন্তু অন্য কোনো উপায়ও নেই। আবার এই চিন্তাও আসল, সে কবে বিয়ে করবে তার ঠিক-ঠিকানা নেই। ততদিন এখানে থাকবে নাকি তার নিশ্চয়তাও নেই। মাইমূন এই এলাকার মিয়াভাই। অন্য এলাকার জন্য না। অন্য কোথাও চলে গেলে, খুঁজে পাবে না। পেলেও ক্ষমতা থাকবে না, দাপট থাকবে না। সাধারণ মানুষের বিপরীতে দাঁড়াতে তার খুব একটা কষ্ট হবে না। এই অছিলায় মানুষটার থেকে দূরে থাকতে পারবে। কথা-বার্তা, দেখা-সাক্ষাৎ ছাড়া কি ভালোবাসা বেঁচে থাকে? ছেলে মানুষ! মন বদলে যেতে পারে যেকোনো সময়।

” অরুণিমা? কে এসেছে? কার সাথে কথা বলছিস? ”

মায়ের গলা পেয়ে অরুণিমার চিন্তাভাবনার মালা ছিঁড়ে গেল। ভয় ও আতঙ্ক স্বরে দ্রুত জবাব দিল,
” ডেলিভারি বয়, মা। তোমাকে আসতে হবে না। ”

বলতে বলতে মাইমূনের হাত থেকে প্যাকেটটা ছিনিয়ে নিল। মাইমূন এই সুযোগে জিজ্ঞেস করল,
” কথা দিচ্ছ তো? ”

নাজিয়া বেগম মেয়ের কথা শুনে দাঁড়িয়ে পড়েননি। দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। অরুণিমা পদধ্বনি টের পেয়ে দ্রুত বলল,
” হ্যাঁ। দিচ্ছি। এবার যান, এখান থেকে। মা আপনাকে চেনে। ”

মাইমূন অবাক হয়ে সুধাল,
” তাই নাকি? কীভাবে? ”

অরুণিমা উত্তর না দিয়ে দরজা আটকে দিল। পেছনে ফিরতে দেখল, মা একদম তার মুখোমুখি। সে ঘাবড়ে গেল। হাতের প্যাকেটটা দেখিয়ে বলল,
” এটা দেওয়ার জন্য এসেছিল। ”

নাজিয়া বেগম প্যাকেটটা হাতে নিলেন। নেড়েচেড়ে বললেন,
” কী এটা? কে পাঠিয়েছে? ”
” কেউ না। আমি অনলাইনে অর্ডার করেছিলাম, মা। ”
” ওহ, কিন্তু ভেতরে কী আছে? বুঝতে পারছি না। ”

অরুণিমা প্যাকেটটা নিজের কাছে নিয়ে নিল। রুমের দিকে অগ্রসর হতে হতে বলল,
” তোমার বুঝতে হবে না। এগুলো আমার দরকারি জিনিস। ”

ঘন ঘন পা ফেলে ভেতরে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিল। প্যাকেটটা খোলার পূর্বে তাকাল বড় খাটটায়, শূভ্রা ঘুমে অচেতন। অন্য পাশের ছোট খাটটায় নিয়াজও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সে খুব সাবধানে প্যাকেটটি খুলল। উপুত করে ঢালতে একগাদা মেক-আপ সেট বেরিয়ে এলো তুষারপাতের মতো। সে আশ্চর্য না হয়ে পারল না! এতগুলো! প্রতিদিন সাজলেও বছর দুয়েক পেরিয়ে যাবে অনায়াসে। তার বিস্মিত চোখজোড়া একটি কাগজও আবিষ্কার করল। হাতে তুলে নিয়ে দেখল তাতে লেখা,
‘ প্রথম বারের মতো তোমার সাথে দেখা করতে যাচ্ছি, উপহার না নিলে হয়? কিন্তু কী নেব চিন্তায় পড়তে মনে পড়ল, কয়েকদিন ধরে তুমি সাজগোজ করছ না। তাই এগুলো উপহার হিসেবে সঙ্গে নিয়েছিলাম। তুমি এত তাড়াহুড়ায় বেরিয়ে গেলে যে, দিতেই পারিনি। ‘
অরুণিমা পড়া বাদ দিয়ে মনে মনে বলল, ‘ এত ব্যস্ততার মাঝেও নজর সরেনি এক মুহূর্তের জন্য! এই মিয়া ভাইয়ের চোখ কি আমাদের মতো দুটো নাকি আরও বেশি? ‘ কাগজটির নিচে আরও লিখেছে,
‘ আমার খুব ইচ্ছে ছিল, এই ভারী সাজের প্রলেপের নিচের সৌন্দর্য টা দেখার, যা সৃষ্টিকর্তা সযত্নে সুনিপুণভাবে সাজিয়েছে। সেই ইচ্ছে আজ পূরণ করে দিলে। বিশ্বাস করিয়ে দিলে, সৃষ্টিকর্তার দেওয়া সৌন্দর্যের সাথে অন্য কিছুর তুলনা হয় না। অরুণিমা, এরপর যখন আমার সামনে আসবে, তখন এমন সাধারণ, অগোছালভাবেই আসবে। সাজসজ্জাহীন তোমার পবিত্র, বরপ্রাপ্ত স্বর্গীয় সৌন্দর্যটুকু আমি চোখ দ্বারা পান করতে চাই। ‘

অরুণিমা একটানে কাগজটা দুই টুকরো করে ফেলল। জানালার একটা পাল্লা মেলে বাইরে ফেলে বিছানায় শুয়ে পড়ল। চোখ বন্ধ করতে মোবাইলে একটি বার্তা ঢুকল। তাতে লেখা, ‘ ভালোবাসা, আমরা একে-অপরের প্রতিশ্রুতি জীবন দিয়ে হলেও রক্ষা করব। ‘

_________
‘ ছায়ানীড় ‘ এ তখন গভীর রাত। নীরব, নিস্তব্ধ। আলো নিভে গেছে অনেক্ষণ। স্বর্ণলতা তাহাজ্জুদ শেষ করে জগ হাতে রুম থেকে বেরুলেন। রান্নাঘরে ঢোকার সময় অভ্যাসমতো ছেলের রুমের দিকে তাকালেন। মুহূর্তে থমকে গেলেন। বন্ধ দরজার ফাঁকফোকর দিয়ে আলো বেরিয়ে আসছে। মুখের মধ্যে চিন্তার আগমন ঘটল। সঞ্জয়ান সময়কে মূল্য দেয় খুব। বাঁধা নিয়মে চলতে পছন্দ করে। সেই হিসেবে তার অর্ধেক ঘুম সমাপ্ত হওয়ার কথা। কিন্তু আলো দেখে মনে হচ্ছে না, ঘুমাচ্ছে। স্বর্ণলতা ছেলের ঘরের দিকে এগুলেন। দরজায় টোকা দিতে সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেল। জিজ্ঞেস করল,
” মা, ঘুমাওনি? ”

স্বর্ণলতা উত্তরে বললেন,
” আমারও একই প্রশ্ন। ঘুমাসনি এখনও? ”

সঞ্জয়ান মৃদু হাসল। মাকে ভেতরে আমন্ত্রণ জানিয়ে বলল,
” ঘুম আসছে না। ”
” কেন? শরীর খারাপ? ”

মায়ের উদ্বিগ্নতা উড়িয়ে দিতে বলল,
” না। আমি একদম সুস্থ। কিছু হয়নি। ”
” তাহলে? কোনো ব্যাপারে চিন্তিত? ”

সঞ্জয়ান এক মুহূর্ত মায়ের মুখটায় চেয়ে থাকল। তারপরে অন্যমনস্ক হলো। উদাস গলায় বলল,
” মা, তোমার মনে আছে? ছোটবেলায় এক বাচ্চাকে আদর করার জন্য খুব জেদ করেছিলাম? ”

স্বর্ণলতার মাথায় খুব একটা চাপ দিতে হলো না। এই ঘটনা ভোলার মতো না। আয়নার মতো ঝকঝকে। তখন সঞ্জয়ানের বয়স মাত্র চার বছর। অন্যসব বাচ্চাদের মতো না। কথা-বার্তা, চাল-চলনে খুব চালু। সমবয়সীদের সাথে খেলা-ধুলা পছন্দ না। তার চেয়ে ছোট বাচ্চাদের দেখতে পারে না একদমই। তবুও মায়ের সাথে ‘ শিশুর যত্ন ‘ নামের সংস্থায় যাওয়া চাই। মা যখন সদ্য জন্ম নেওয়া কোনো বাচ্চাকে কোলে নিত তখন মুখ গোমড়া করে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকত। খুব হিংসুটে ছিল যে! তেমনি একদিন কী হলো কে জানে! মাত্রই জন্ম নেওয়া এক বাচ্চাকে নাড়ি কেটে আতুরনিবাস থেকে যখন বেরুলেন তখনই সে বলে ওঠল, ‘ প্রথমে আমি কোলে নিব। ‘ স্বর্ণলতা অবাক হলেন। ভয়ও পেলেন। কারণ, বাচ্চাটি তখনও কান্না করেনি। শারীরিকভাবেও দুর্বল। বাবার সাথে দেখা করিয়ে হাসপাতালে নিযে যাওয়ার পরামর্শ দিবে। এর মধ্যে সঞ্জয়ানের কোলে দেওয়া ঠিক হবে না৷ তাই মানা করে দিল। কিন্তু সে মানল না। মায়ের কথা বুঝল না। বাচ্চাটিকে কোলে নেওয়ার জন্য কান্নাকাটি শুরু করল। মাটিতে গড়াগড়ি খেতে খেতে বলছিল, ‘ আমি প্রথমে আদর করব। ভালোবাসব। ‘ এরমধ্যে বাচ্চার বাবা চলে আসে। এমন কাণ্ড চক্ষুদর্শন করে অনুমতি দিল, বাচ্চাটিকে প্রথমে তার কোলে দিতে। অনুমতি পেয়ে স্বর্ণলতা বাচ্চাটিকে ছেলের কোলে দিয়েছিল। সেই প্রথম সঞ্জয়ান কোনো বাচ্চাকে কোলে নেয়, চুমুতে ভরিয়ে দেয় চোখ-মুখ। স্বর্ণলতা ঝকঝকে স্মৃতির আয়না থেকে মুখ সরিয়ে নিয়ে বললেন,
” হঠাৎ ঐ বাচ্চার কথা মনে হলো কেন? ”
” সেই বাচ্চাটির মতো আরেকজনকে দেখলাম। চেহারায় একই রকম মায়া! ভারি নিষ্পাপ। খুব আদুরে। চোখ ফেরানো যায় না। ফেরালেই বুকের ভেতর কিছু একটা হয়। আমারও হয়েছে। খুব যন্ত্রণাদায়ক কিছু। কিন্তু ব্যথা হয় না। আনন্দ হয়। আর শূণ্য শূণ্য লাগে। ”

ছেলের কথাগুলোকে খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলেও ভালো করে বুঝতে পারলেন না। কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে গেছে! কিসের সাথে কী মেলাচ্ছে সেটাই স্পষ্ট নয়। জিজ্ঞেস করলেন,
” কোথায় দেখলি? কোলে নিয়েছিলি? ”

সঞ্জয়ানের হুঁশ এলো। জিভ কামড়ে বলল,
” না। কোলে নেওয়ার মতো না। ”
” কেন? বড় বাচ্চা? ছেলে নাকি মেয়ে? ”
” মেয়ে। ”
” আলহামদুলিল্লাহ! কার বাচ্চা রে? আমি চিনি? ”

সঞ্জয়ান অন্য দিকে ফিরে গেল। কী উত্তর করবে বুঝতে পারছে না। নিজের বোকামির জন্য মনে মনে ধমকাচ্ছে। স্বর্ণলতা তার সামনে গিয়ে পুনরায় সুধালেন,
” কার মেয়ে? খুব রক্ষণশীল পরিবার নাকি? সেজন্যই হয়তো বাচ্চাকে কোলে দেয়নি। ”

সঞ্জয়ান চোখ বন্ধ করে রুদ্ধশ্বাসে বলল,
” অসীউল্লাহর মেয়ে। ”

চলবে

#আঙুলে_আঙুল
#পর্ব (১২)

সঞ্জয়ানের হুঁশ এলো। জিভ কামড়ে বলল,
” না। কোলে নেওয়ার মতো না। ”
” কেন? বড় বাচ্চা? ছেলে নাকি মেয়ে? ”
” মেয়ে। ”
” আলহামদুলিল্লাহ! কার বাচ্চা রে? আমি চিনি? ”

সঞ্জয়ান অন্য দিকে ফিরে গেল। কী উত্তর করবে বুঝতে পারছে না। নিজের বোকামির জন্য মনে মনে ধমকাচ্ছে। স্বর্ণলতা তার সামনে গিয়ে পুনরায় সুধালেন,
” কার মেয়ে? খুব রক্ষণশীল পরিবার নাকি? সেজন্যই হয়তো বাচ্চাকে কোলে দেয়নি। ”

সঞ্জয়ান চোখ বন্ধ করে রুদ্ধশ্বাসে বলল,
” অসীউল্লাহর মেয়ে। ”

স্বর্ণলতা ভাবুক স্বরে বললেন,
” অসীউল্লাহ! নামটা চেনা লাগছে। তোর কোনো বন্ধু নাকি? ”

সঞ্জয়ান কিঞ্চিৎ ঘাবড়ে গেল। তার মা বছরে দুই বার রুহানিয়া কলেজে যান। সকলের সাথে দেখা করেন, কথা বলেন, ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনাও করেন। সেই সূত্রে অসীউল্লাহর সাথেও দেখা হয়েছে কয়েক বার। আলাদা করে কথা বলেনি বলেই হয়তো চট করে ধরতে পারেননি। নাহলে ঠিক চিনে ফেলতেন! তার স্মরণ শক্তি চমৎকার, প্রশংসনীয়। স্বর্ণলতাকে ভাবার সময় দিয়ে বিপদে পড়তে চাইল না। দ্রুত বলল,
” না। পরিচিত। মনটা খুব ভালো। ”

কৌশলে উত্তরটা প্রদান করে বলল,
” পানি নিতে এসেছিলে, মা ? নিয়ে যাও। ”

স্বর্ণলতার ভাবনার পথ বন্ধ হয়ে গেল। হাতের খালি জগটায় চেয়ে বলল,
” হ্যাঁ, ঘুমিয়ে পড়। আর রাত জাগিস না, বাবা। ”

সঞ্জয়ান মৃদু হেসে বলল,
” তুমিও ঘুমিয়ে পড়ো। ”

মাকে একটু এগিয়ে দিয়ে দরজা আটকে দিল ভেতর থেকে। আলো নিভিয়ে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিয়ে আনমনা হলো। ঠোঁটের কোণে হাসি জমল। বন্ধ চোখের পাতায় ভেসে উঠা মুখটা হৃদয়ে আনন্দের ঢেউ তুলতে আপনমনে উচ্চারিত হলো, ‘ অরুণিমা! ‘

___________
সকালে দাঁত ব্রাশ করা নিয়ে এক প্রস্থ ঝগড়া হয়েছে শূভ্রা ও নিয়াজের মধ্যে। ভাইয়ের গায়ের জোরের সাথে না পেরে রাগে-ক্ষোভে পেস্ট সমেত ব্রাশটা জানালা দিয়ে ঢিল মেরে ফেলে দিয়ে বলল,
” এই বাড়ির দুটো ছেলে-মেয়ে। অরুণিমা ও নিয়াজ। আমি অন্য বাড়ির মেয়ে। ভুল করে এসেছি, তাই সব ক্ষেত্রে দ্বিতীয়। ”

নিয়াজ গোসলখানার ভেতর থেকে মুখ ধুতে ধুতে উত্তর করল,
” উহু, ফেইল। তুই আবার দ্বিতীয় হলি কোন জন্মে? বাবা হাতে-পায়ে ধরল বলেই তো কলেজে সিট পেলি। ”

শূভ্রা দৌড়ে এসে বন্ধ দরজায় লাথি মারল। চিৎকার করে বলল,
” চুপ, বান্দর। মুখে মুখে কথা বলিস! বেরিয়ে আয় শুধু, নাক সই করে ঘুষিটা যদি…”

হুমকিটা সম্পন্ন হলো না। তার পূর্বে অরুণিমার আগমন ঘটল। বোনের উদ্দেশ্যে বলল,
” যে ব্যবহারটা তুই সহ্য করতে পারিস না, সেই ব্যবহারটা অন্যের সাথে কিভাবে করিস? ”

শূভ্রা রাগ মুখে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাল। জিজ্ঞেস করল,
” আমি আবার কী করলাম? ”
” মুখে মুখে তর্ক করেছিস। কত বার নিষেধ করেছি, বাবা-মায়ের সাথে এভাবে কথা বলবি না? ”

অরুণিমার কণ্ঠস্বরে একই সাথে রাগ ও হতাশা। শূভ্রার মনে পড়ল, ঘুম থেকে ডাকতে এসে মা রান্না-বান্না নিয়ে কথা শোনাচ্ছিল। বড় মেয়ে পড়া, চাকরি সামলেও মায়ের সাথে রান্নার কাজ করে। আর ছোট মেয়ে শুধু ঘুম, টইটই করা। বড় বোনের প্রশংসার সাথে নিজের নিন্দাটুকু সহ্য করতে পারছিন না। বিরক্ত ঝাড়তে গিয়ে কয়েকটা কথা বলে ফেলেছে। শূভ্রা অনুতপ্ত হওয়ার পরিবর্তে পরিহাস করল,
” এরমধ্যে বিচারকের কাছে নালিশও করা হয়ে গেছে? এত অধৈর্য্য তোমরা? দাঁতটা পরিষ্কার করার সময়ও দিলে না? গন্ধ মুখে শাস্তি নিতে হবে এখন? ”
” শূভ্রা! ঠিক করে কথা বল। ”

অরুণিমা চাপা স্বরে ধমকে ওঠল। শূভ্রা বিন্দু পরিমানও ভয় পেল না। সামনে অগ্রসর হয়ে বলল,
” বলব না। কী করবে? মারবে? মার। আমার জন্য এটাই তোলা থাকে সবসময়। ”

অরুণিমার ইচ্ছে হলো সত্যি সত্যি চড় মেরে বসতে। মেয়েটা দিন দিন বখে যাচ্ছে। সামলানো যাচ্ছে না কিছুতেই। এতদিন তার সাথে বাজে ব্যবহার করেছে, এখন তো বাবা-মায়ের সাথেও করছে! অরুণিমা ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রাখল। ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে বলল,
” ব্রাশ করিসনি কেন? কয়টা বাজে দেখেছিস? তোর কলেজে দেরি হয়ে যাবে না? ”

বলতে বলতে শূভ্রার ব্রাশটায় খুঁজছিল। না পেয়ে সুধাল,
” তোর ব্রাশ কোথায়? দেখতে পাচ্ছি না যে? ”

শূভ্রা দূর থেকে জানালার দিকে তাকাল, যেটা দিয়ে ব্রাশটা ফেলে দিছে। আপুর প্রশ্নটার উত্তর করবে কি-না ভাবতেই নজর পড়ল কাছের টেবিলটায়। বেশ বড় একটি ব্যাগ। কৌতূহল বশত ব্যাগটার দিকে এগিয়ে এলো। মুখটা খুলে ভেতরে তাকাতে তার সব রাগ জলে পরিণত হলো। সবিস্ময়ে উচ্চারণ করল,
” মেকাপ সেট! ”

তারপরে হাত ঢুকিয়ে দিল ভেতরে। এক এক করে সব বের করছে আর আনন্দ ঝলমল করছে মুখটায়। অরুণিমার এদিকে যখন নজর পড়ল তখনই শুনতে পেল,
” এগুলো আমার জন্য এনেছ, আপু? কী সুন্দর! খুব দামী, তাই না? ”

অরুণিমার একবার মনে হলো, দৌড়ে সব কেড়ে নিয়ে বলে, এগুলো শূভ্রার না। সে আনেনি। কিন্তু বোনের আনন্দিত মুখটায় চেয়ে কিছুই বলতে পারল না। চুপচাপ তাকিয়ে থাকল শুধু।

_________

” আপু, খালি হাতে এলে যে? ”

অরুণিমা কাজ থেকে ফিরেছে মাত্র। হিজাবটা খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করল,
” কিছু আনার কথা ছিল? ”

শূভ্রা ভীষণ উৎসাহে বলল,
” অবশ্যই। তোমার বন্ধু নির্বাচনে পাশ করে গেল, তার তুমি কিছু আনবে না? অন্তত এক প্যাকেট মিষ্টি আনতে পারতে। ”

অরুণিমা বোনের দিকে মনোযোগী হলো। পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
” আমার বন্ধু নির্বাচনে পাশ করেছে? কোন বন্ধু? ”
” মাইমূন ভাই। ”

নামটা তীরের ফলার মতো গিয়ে বিঁধল অরুণিমার হৃদয়ে। আচমকা আঘাতটা সামলাতে পারল না বুঝি! ছিটকে ওঠল। কেঁপে ওঠল সর্বাঙ্গ। কয়েক মূহুর্তের জন্য পাথরের রূপ নিল। অত:পর বিচলিত স্বরে সুধাল,
” তোকে কে বলল, উনি আমার বন্ধু? ”

শূভ্রা নি:সংকোচে প্রত্যুত্তর করল,
” বলতে হবে কেন? আমি দেখেছি। রেষ্টুরেন্টে বসে আড্ডা দিচ্ছিলে। ”

অরুণিমার বুকের ভেতরটায় ঝড় সৃষ্টি হলো। তাকে আর মাইমূনকে একত্রে দেখে ফেলেছে কেউ। বাবার কানে কথাটা গেলে কী হবে? এই চিন্তায় তার গলা শুকিয়ে এলো। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল চোখ-মুখে। শূভ্রা এতকিছু খেয়াল করল না। নিজের মতো বলে চলল,
” সেদিন ভালো করে দেখতে পারিনি। আজ দেখে এসেছি। ”

অরুণিমা বিপন্ন স্বরে সুধাল,
” কোথায়? ”
” পোস্টারে। তুমি দেখনি নাকি? রাস্তার পাশের গাছে, দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার সাঁটানো হয়েছে। আমাদের বাসার গেইটের দুইপাশেও তো দুটো লাগিয়েছ। আমি দাঁড়িয়ে থেকে দেখলাম। কী ভালো দেখতে! একদম রাজাদের মতো। তোমার এই বন্ধুটিকে বাসায় দাওয়াত দাও একদিন। সামনাসামনি দেখি। ”
” সামনাসামনি দেখে তুই কী করবি? ”

অরুণিমা ধমকে উঠে দরজার দিকে এগুল। বের হতে হতে আবার বলল,
” উনি আমার বন্ধু নয়। ”

শূভ্রা পিছু নিতে নিতে প্রশ্ন করল,
” তাহলে? ”
” তাহলে কী? ”
” বন্ধু নাহলে কী হয় তোমার? ”
” কিছু না। ”

অরুণিমা গেইটের কাছে এসে পোস্টার দুটো টেনে তুলে ফেলল।

___________

অরুণিমা আজ দুপুরে বাসায় যায়নি। বাবার কল পেয়ে রুহানিয়া কলেজে এসেছে। সে ভেবেছিল, বাবা আবারও অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এসে দেখে, তেমন কিছু নয়। তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ। অরুণিমাকে কাছে ডেকে নিয়ে বললেন,
” আজ আমরা একসাথে দুপুরের খাবার খাব। ”
” এজন্যে ডেকে এনেছ, বাবা? ”

অসীউল্লাহ দুজনের খাবার সাজাতে সাজাতে বললেন,
” না। আরও একটি কারণ আছে। ”
” কী কারণ, বাবা? ”

অরুণিমা জিজ্ঞাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে তিনি মৃদু হাসলেন। মেয়ের ভাগের খাবারটা এগিয়ে দিয়ে বললেন,
” খাওয়া শুরু কর, বলছি। ”

সে দেখল, একজনের খাবার দুজনের জন্য ভাগ করা হয়েছে। তাই বলল,
” এইটুকুতে কারও পেট ভরবে না, বাবা। তুমি খাও। আমি বাসায় গিয়ে খেয়ে নিব। ”

অসীউল্লাহ নিজের ভাগের ভাতটা মাখলেন। এক লোকমা মেয়ের মুখের সামনে ধরে বললেন,
” খুশিমনে খেলে, এক মুঠো ভাতেও পেট ভরে যায়। ”

অরুণিমা বিস্ময়াশ্চর্য হলো। বাবাকে এমন গলায় কথা বলতে শোনেনি অনেক দিন। জিজ্ঞেস করল,
” তোমাকে অনেক খুশি লাগছে, বাবা। কারণটা কি খাওয়ার পরই বলবে? ”
” এখনও বলা যায়। ”

অরুণিমা বাবাকে অপেক্ষায় রাখল না। ভাতের দলা মুখে নিয়ে চিবুতে শুরু করল। অসীউল্লাহ একটুক্ষণ নীরব থেকে বললেন,
” তোকে সঞ্জয়ান স্যার ডেকে পাঠিয়েছেন। ”

অরুণিমা ভাত চাবানো বন্ধ করে বাবার দিকে চেয়ে থাকলে তিনি বললেন,
” সঞ্জয়ান স্যারকে ভুলে গেলি নাকি? ঐ যে আমাকে হাসপাতালে ভর্তি…”
” মনে আছে, বাবা। তিনি হঠাৎ আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন কেন? ”

অসীউল্লাহ সামান্য হাসলেন। নিজের মুখে ভাত নিয়ে বললেন,
” এই কারণটা আমি জানি, কিন্তু বলব না। ”
” কেন? ”
” আমি চাই, কারণটা উনি-ই তোকে বলুক। ”

মেয়েকে নিয়ে খাওয়ার পর্ব শেষ করে অসীউল্লাহ অফিস রুমের দিকে হাঁটা ধরলেন। কিছু দূর এগুতে এক লোকের সাথে দেখা। তিনি এক ছাত্রকে খুঁজছেন। অসীউল্লাহ নাম-পরিচয় জেনে নিয়ে মেয়ের উদ্দেশ্যে বললেন,
” তুই এখানে দাঁড়া। আমি এখনই আসছি। ”

অরুণিমাকে দাঁড় করিয়ে লোকটিকে নিয়ে তিনি মাঠে নামলেন। বিরতি সময় চলছে বিধায় পুরো মাঠেই কলেজ পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। তার হঠাৎই স্মরণ হলো, শূভ্রাও এখানে পড়ে। তাকে চমকে দিলে দারুন হবে। সেই বাসনায় পুরো মাঠে চোখ বুলাতে লাগল। শূভ্রা নজরে এলে ভূতের মতো সামনে গিয়ে দাঁড়াবে। এই খোঁজাখুঁজির মধ্যে আমচকা একটি কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,
” আপনি সবসময় এমন সাধারণভাবেই চলাফেরা করেন? ”

অরুণিমা চমকে ঘাড় বাঁকিশে পাশে তাকায়। মুহূর্তেই অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। সঞ্জয়ানের মুখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয় চট করে। মাঠের দিকে চেয়ে মৃদু স্বরে বলল,
” জি। ”

উত্তরটা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাইমূনের মুখটা অন্তরে প্রজ্জ্বলিত হলো। এই মানুষটার সামনে অসুন্দর হওয়ার জন্য ভারী সাজের প্রলেপটা মুখে ল্যাপ্টানো বন্ধ করলেও আর শুরু করা হয়নি। অবাক করার বিষয়, তার মালিকও কিছু বলে না। অথচ শুরুতে তার ঝাড়ি খেতে খেতেই এই প্রলেপ ল্যাপ্টানো শেখা হয়েছিল। এই সময় এটাও মনে করিয়ে দিল, মাইমূন তার কথা রেখেছে। তার সাথে শেষ দেখা হয়েছিল, দুই মাস আগে। এর মধ্যে দেখা তো দূর, অন্য কোনোভাবেও যোগাযোগ হয়নি।

” আপনার নামটা খুব সুন্দর। অর্থ জানেন? ”
” ভোরের আলো। ”

সঞ্জয়ান মনে মনে বলল, ‘ উহু, মনের আলো। ‘ সামনাসামনি বলল,
” চাচা বলেছিলেন, আপনি খুব মেধাবী, বুদ্ধিমতী। মনে হচ্ছে, সত্যিই বলেছিলেন। ”
” কীভাবে বুঝলেন? বাবা, সিভিও দিয়েছে নাকি? ”

সঞ্জয়ান স্মিত হাসল। বলল,
” না, তবে দিলে উপকার হতো। আপনার সঙ্গে আছে? ”

অরুণিমার দৃষ্টি ফিরে এলো সঞ্জয়ানের দিকে। সম্পূর্ণ শরীরটা ঘুরিয়ে এনে সুধাল,
” এজন্য ডেকেছেন? ”

সঞ্জয়ানের চোখ শুরুতেই তার মুখের মধ্যে নিবদ্ধ ছিল। এবার আরও গভীর করে বলল,
” হ্যাঁ, অন্যায় করে ফেললাম নাকি? চাচা, আপনার সম্পর্কে অনেক কিছুই বলেছে, কিন্তু এটা বলেনি, আপনি অল্পতেই রেগে যান। ”
” আমি রাগ করিনি। ”
” আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। প্রথম দিনের গলার সাথে আজকেরটা মিলছে না। একটু রুক্ষ! ”
” সম্বোধন বদলে গেছে যে তাই। ”
” বুঝিনি। ”
” তুমি থেকে আপনি হয়ে গেছি তো, তাই বিনয়ীর ভাবও বদলে গেছে। সম্বোধন আচরণে প্রভাব ফেলে। ”

পুরো ব্যাপারটা বুঝতে সঞ্জয়ান একটু সময় নিল। তারপর বলল,
” আপনি আসলেই বুদ্ধিমতি। ”

অরুণিমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই পুনরায় বলল,
” ‘ তুমি ‘ করে বলার অনুমতি দিচ্ছেন তাহলে? ”
” অনুমতি ছাড়াই তো আমি ‘ তুমি ‘ ছিলাম। ”

চলবে