আঙুলে আঙুল পর্ব-৯+১০

0
173

আঙুলে আঙুল

পর্ব (৯)

বাসায় ফিরে অরুণিমা গোসল করে। আজ করল না। জামাটাও বদলাল না। ঠিক করল, ঘামে ভেজা ক্লান্ত ও অগোছাল অবস্থায় মাইমূনের সামনে হাজির হবে। কাঁধের ব্যাগটা বিছানায় ফেলল। মাথায় প্যাঁচিয়ে রাখা কালো হিজাবটাও খুলল চটপটে। সাধারণভাবে ওড়না মাথায় তুলে দিয়ে বের হওয়ার উদযোগ করছে। তখনই নিয়াজ ডেকে ওঠল,
” আপু, ও আপু। ”

অরুণিমা ব্যস্ত স্বরে উত্তর নিল,
” বল। ”
” এই অংকটা বুঝতে পারছি না। ”

অরুণিমা দরজার দিকে হাঁটা ধরেছে। পিছু না ফিরে বলল,
” কেন? স্যার বুঝিয়ে দেয়নি? ”
” দিয়েছিল। তাও বুঝতে পারছি না। তুমি একটু বুঝিয়ে দাও না। ”
” শূভ্রাকে বল। ”

শূভ্রা নিজের টেবিলে বই-খাতা নিয়ে বসে আছে। পড়ার চেয়েও মনোযোগটা আইডি কার্ডে বেশি। আজ সকালে বাবা ক্লাসে গিয়ে দিয়ে এসেছিল। তার বার বার মনে হচ্ছে, এটা আগের কার্ড নয়। নতুন করে বানানো। যদি সত্যি নতুন কার্ড হয় তাহলে পুরোনো কার্ডটা কোথায়? সাজনা শাক ওটা দিয়ে কী করেছে? প্রশ্নটা মনে উদয় হতে আপুর কণ্ঠে নিজের নাম শুনতে পেল। মুহূর্তে মনোযোগে বিঘ্ন ঘটল। তিরিক্ষি মেজাজে বলল,
” পারব না। তোমার ভাইকে তুমি-ই বুঝাও। ”

অরুণিমা পিছু ফিরতে বাধ্য হলো। আশ্চর্যান্বিত হয়ে সুধাল,
” আমার ভাই? ”
” হ্যাঁ, তোমার ভাই। সেজন্য শুধু তোমার কথা শুনে। ”
” তোর কথা শুনে না? ”

শূভ্রা প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না। মুখ বাঁকিয়ে পড়ায় মনোযোগী হলো। অরুণিমা ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
” তুই অন্য পড়া শেষ কর। আমি একটু পর অংকটা বুঝিয়ে দিচ্ছি। ”

নিয়াজ দ্রুত বলল,
” অন্য পড়া কেন পড়ব? কাল তো আমার অংক পরীক্ষা। ”

অরুণিমা জুতা পরে ফেলেছে। এবার ছাদের দিকে ছুটা বাকি।

” তাহলে অন্য অংকগুলো কর। এটা পরে করিস। ”

নিয়াজ মেনে নিল না। অসহায়ের মতো বলল,
” এটার চিন্তায় অন্য অংকও হচ্ছে না। সন্ধ্যা থেকে চেষ্টা করছি তো। ”

অরুণিমা কী বলবে খুঁজে পাচ্ছে না। এদিকে সময়ও অনেক পেরিয়ে গেছে। মাইমূন হয়তো ছাদে অপেক্ষা করছে। এরমধ্যে বাবার গলা পেল,
” একটাই অংক তো, মা। বুঝিয়ে দে না। এত কথা বাড়াচ্ছিস কেন? ”

বাবার কথা অমান্য করার সাধ্যি নেই। নিতান্ত বাধ্য হয়েই জুতা খুলে ঘরের ভেতর ঢুকতে হলো। ভাইয়ের পাশে বসে বলল,
” কোনটা? তাড়াতাড়ি দেখা। ”

নিয়াজ দেখানো মাত্র অরুণিমা বুঝানো শুরু করে দিল। বেশ কয়েক বার বুঝানোর পরও নিয়াজ বুঝছে না। এক পর্যায়ে অরুণিমা বিরক্ত হয়ে কলম দিয়ে বাড়ি মারল হাতে। ধমকাতেও শুরু করল। নিয়াজ কান্নাপ্রায় গলায় বলল,
” আমার কী দোষ! তুমি এত কঠিন করে বুঝাচ্ছ কেন? অন্য দিনের মতো সহজ করে বুঝাও না, আপু। ”

অরুণিমা একটু নিভল। রাগটাকে সংবরণ করল। চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ নিশ্বাস টেনে নিতে নিতে বুঝল, তার মন অন্য দিকে পড়ে আছে। সেজন্য ঠিকমতো বুঝাতে পারছে না। নাহলে নিয়াজ বুঝবে না কেন? তিন ভাই-বোনের মধ্যে নিয়াজ অধিক মেধাবী। অরুণিমা অবাক হলো। মাইমূন তার মনোযোগ কেড়ে নিচ্ছে। যেটাকে সে প্রশ্রয় দিতে চাইল না। তাই এই অংকটা বুঝিয়ে দেওয়ার পরও আরও অনেকগুলো অংক করাল। সিলেবাস মোটামুটি শেষের দিকে আসলে ভাইয়ের পাশ থেকে ওঠল। রুম থেকে বেরুতে আবার বাঁধা পেল। মা বলল,
” রান্না হয়ে গেছে। সবাইকে নিয়ে খেতে আয়। ”

অরুণিমা বলতে চাইল, একটু পর খাবে। বলতে পারল না। নজর গিয়ে পড়ল বাবার ওপর। তিনি খেতে বসে গেছেন। এখন বাইরে যেতে চাইলে প্রশ্নের মুখোমুখি হবে। বাবার সাথে মিথ্যা বলার অভ্যাস নেই তার। সত্য বলতেও চায় না। উপায়ন্তর না পেয়ে ভাই-বোনকে নিয়ে খেতে বসল। খাওয়া শেষে মায়ের সাথে রান্নাঘরে টুকটাক কাজ শেষ করে বলল,
” আমি একটু ছাদে যাই, মা? ”
” কেন? এত রাতে ছাদে কী কাজ? ”

অরুণিমা কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। আমতা আমতা শুরু করল। সহসা বলল,
” আমার একটা জামা খুঁজে পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে, ছাদে রয়ে গেছে। ”

নাজিয়া বেগম মেয়ের দিকে ঘুরলেন। বিশ্বাসের সাথে বললেন,
” না, ছাদে নেই। রুমেই আছে, খুঁজে দেখ। আমি গুণে গুণে কাপড় নিয়ে আসি। ”

অরুণিমা আর কিছু বলতে পারল না। মনখারাপ করে রুমের দিকে অগ্রসর হতে হতে শুনল,
” খুঁজে না পেলে আমাকে ডাক দিস। ”

রুমে এসে কাপড় খোঁজার প্রয়োজন পড়ল না তার। বিছানায় শুয়ে বোনের উদ্দেশ্যে বলল,
” তোর পড়া শেষ হলে আলোটা নিভিয়ে দিস। ”

শূভ্রা চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল তৎক্ষনাৎ। আলোটা নিভিয়ে আপুর পাশে শুয়ে জিজ্ঞেস করল,
” কিছু হয়েছে? ”

অরুণিমা অন্যমনস্ক হয়ে উত্তর করল,
” না। ”
” তাহলে মনখারাপ কেন? ”

সে সতর্ক হলো। অন্য পাশে ফিরে বলল,
” কিসের মনখারাপ? চুপচাপ ঘুমা। ”

কথাটা বলে অরুণিমা আবারও অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। মাইমূনকে আসতে বলে, সে নিজেই যেতে পারল না। ভারি অপরাধ বোধ হচ্ছে। মানুষটা না জানি কতক্ষণ অপেক্ষা করে আছে! কাজটা একদমই ভালো হয়নি। রেগে না গেলেই হয়। অরুণিমার ভেতরে বিষয়টা এমনভাবে গেঁথে গেল যে, অশান্তি শুরু হলো হৃদয়ে। ছটফট করছে খুব। কিছুতে ঘুম আসছে না। একবার ভাবল, কল করে সরি বলে দেয়। পর মুহূর্তে নিজেকে সংযত করল। এত ভালোমানুষি দেখিয়ে কী লাভ? সে তো এই মানুষটার সামনে নিজেকে ভালোভাবে উপস্থাপন করতে চায় না। সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাতিল করতে করতে প্রায় মাঝরাত হয়ে গেল। তখনও চোখে ঘুম না আসায় বুঝতে পারল, সরি না বললে রাতটা নির্ঘুমেই কাটবে। তাই চট করে মোবাইলটা হাতে নিয়ে লিখে পাঠাল, ‘ সরি, হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে যাওয়ায় বাসা থেকে বেরুতে পারিনি।’

_________
সকালে ঘুম ভাঙার পরে অরুণিমা প্রথমে মোবাইল হাতে নিল। মাইমূন ফিরতি বার্তা পাঠায়নি। কলও করেনি। তার মনটা ভার হলো। ভয়ও পেল। ভাবল, নিশ্চয় খুব রেগে গেছে। রাস্তায় পথ আটকে দাঁড়াবে না তো? আবারও দোকানে গিয়ে ঝামেলা করবে না তো! এরূপ শঙ্কা নিয়ে সে স্নাগারে ঢুকল। ভেজা কাপড় মেলে দেওয়ার জন্য বাসা থেকে বেরুতে চাইলে, মা আটকালেন। বিরক্তের মুখ করে বললেন,
” তোর যেতে হবে না। রেখে দে, আমি সময় করে ছাদে নেড়ে আসব। ”
” তুমি আবার কষ্ট করে ছাদে ওঠবে? আমিই দিয়ে আসি। ”
” বলেছি না যেতে হবে না? চুপচাপ রুমে যা। ”

মায়ের ধমক খেয়ে অরুণিমা ছিটকে ওঠে। অবাকও হয়। এসময় অসীউল্লাহ তৈরি হয়ে রুম থেকে বের হয়েছিলেন। স্ত্রীর চড়া গলা পেয়ে বললেন,
” কী হলো? সকাল সকাল মেয়েকে ধমকাচ্ছ কেন? ”
” ধমকানোর কাজ করছে বলেই ধমকাচ্ছি। ”

স্বামীর সাথে কথা-বার্তা চালানোর মধ্যে মেয়ের হাত থেকে কাপড় ছিনিয়ে নিলেন। অরুণিমা চুপ থেকে দুজনের কথোপকথন শুনছে। সেখান থেকে জানতে পারল, ছাদ ভর্তি সিগারেটের টুকরো, ছাই, গন্ধ। তার মধ্যে একটি অচেনা ছেলে শুয়ে আছে। জামা-কাপড় ঠিক নেই। এমন অবস্থায় মেয়েকে ছাদে পাঠায় কী করে? অরুণিমার বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠল। সে নিশ্চিত এই অচেনা ছেলেটা মাইমূন। সারারাত ছাদে ছিল! তার জন্য অপেক্ষা করতে করতে ছাদেই ঘুমিয়ে পড়েছে। ভাবনাটা মনে আসতে তার যেমন খারাপ লাগল, মায়া হলো। তেমন রাগও হলো, বিরক্তও হলো এই ভেবে, ধানের মতো সিগারেট বুনেছে। এত ধুমপান করে কেউ? অজান্তেই অরুণিমা নাক কুঁচকে উচ্চারণ করল,
” ছি! ”

___________

মাইমূনকে মাথা থেকে সরিয়ে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়তে অরুণিমার ফোনে একটি বার্তা ঢুকল। সঙ্গে সঙ্গে দেখেনি। একটু অবসর পেয়ে তারপরে দেখল। যা সন্দেহ করেছিল তাই। বার্তাটি মাইমূনই পাঠিয়েছে। লিখেছে, ‘ আমি বুঝতে পারছি, সরি বলতে হবে না। ‘

অরুণিমার মনের ভারটা পুরোপুরি গায়েব হয়ে গেল। ঠোঁট ছড়িয়ে একটু হাসলও। মানুষটা এত সহজে মেনে নিবে ভাবতে পারেনি। মিনিট কয়েক পরে আবারও বার্তা পাঠাল, ‘ আজ দেখা করি? ছাদে না অন্য কেথাও। সন্ধ্যার পরে দেখা করতে চেয়েছ দেখেই ঝামেলা হলো। দিনে পারবে না? তোমার মালিককে বলে ছুটি পায়িয়ে দেব। ‘

অরুণিমার দেখা করা জরুরি। তাই এড়িয়ে যেতে পারল না। লিখল, ‘ আজ না। কাল। ছুটি পায়িয়ে দেওয়ার দরকার নেই। দুপুরে বাড়িতে যাওয়ার সময় দেখা করব। ‘ সঙ্গে সঙ্গে ফিরতি বার্তা এলো, ‘ ঠিক আছে। আমি মলের সামনে অপেক্ষা করব। ‘

________
” আপনি যে এত সিগারেট খান, বাসায় জানে? ”

পরের দিন দুপুরে মাইমূন মলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেও বসতে হয়েছে ‘ কুটুমবাড়ি ‘ রেষ্টুরেন্টটায়। অরুণিমা প্রথম কথাতে এই প্রশ্নটা করল। মাইমূন সহজভাবে উত্তর করল,
” জানে। ”
” কিছু বলে না? ”
” বলে, আমি শুনি না। ”
” কেন? ”
” ছোটবেলা থেকে অভ্যস্ত। ছাড়তে পারি না। ”

অরুণিমা বলতে চাইল, ‘ যদি আমি ছাড়তে বলি? ‘ বলতে পারল না। মন থেকে বাঁধা পেল। মনে করিয়ে দিল, সে এই লোকটার নজর থেকে মুক্তি চাচ্ছে। অযথা এসব বলে কী লাভ? সে ধুমপান করলে তার কোনো যাবে-আসবে না। তাই যে কারণে এসেছে সে কথাটাই তুলল,
” আমি জানি, আপনি আমার ব্যাপারে সব জানেন। তবুও আরও একবার বলছি, আমরা গ্রাম থেকে এখানে এসেছি, বাবার জন্য। তিনি চাননি, আমার জোরাজুরিতে রাজি হয়েছেন। আমি তার পাশে থাকতে চাই। সাহায্য করতে চাই। শূভ্রা ও নিয়াজের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে দিতে চাই। এই মুহূর্তে প্রেম, বিয়ে এসব নিয়ে ভাবতে চাই না। ভাবা উচিতও না। ”

মাইমূনের মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা দিল না। নিরুদ্বেগে বলল,
” জানি। সেজন্য তোমার বাড়িতে এখনও বিয়ের প্রস্তাব পাঠাইনি। ”
” প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছেন। আগে-পিছে ঘুরছেন। বাবা জানলে, খুব রাগ করবেন। ”
” এটাও জানি। জানি বলেই কখনও তোমার সামনে আসিনি। বিরক্ত করিনি। তুমি নিজে আমার সামনে চলে আসায়, মনের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারিনি। অনুভূতির কথা জানিয়ে দিয়েছি মাত্র। আগে-পিছে ঘুরিনি। ”

এটুকু বলে মাইমূন থামল। অরুণিমার দিকে গাঢ় দৃষ্টি রেখে শান্ত স্বরে বলল,
” আমি কিন্তু এখনও তোমার সামনে নিজে থেকে আসিনি। তুমি চেয়েছ, তাই এসেছি। অরুণিমা, তুমি শুধু কথা দেও, যখন ভালোবাসতে ইচ্ছে হবে তখন আমাকেই ভালোবাসবে। বিয়ে করার সময় হলে আমাকেই করবে। তাহলে আমিও কথা দিব, তুমি না ডাকলে কখনও তোমার সামনে আসব না। ”

অরুণিমা বিস্মিত না হয়ে পারল না। এমন পাগল মানুষও হয়? সে নিরুত্তর থাকতে থাকতে ফোনটা বেজে ওঠল। ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে দেখল, অচেনা নাম্বার। ধরতে অপরিচিত পুরুষ গলা পেল,
” অরুণিমা বলছ? ”
” জি, আপনি? ”
” আমি সঞ্জয়ান। তুমি চিনবে না। তোমার বাবার ফোন থেকে নাম্বার নিয়েছি। চাচার শরীর ভালো নেই। মাথা ঘুরে পড়ে গেছে। আমরা হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছি। তুমি কি একবার আসতে পারবে? ”

চলবে

#আঙুলে_আঙুল
পর্ব (১০)

বাবার সংবাদ পেয়ে অরুণিমা ভয় পেল। মুখটা ফ্যাকাসে হলো। ভেতর-বাহিরে ক্রমাগত কম্পন তৈরি হতে অসহায় দৃষ্টিতে চাইল মাইমূনের দিকে। সে বুঝে গেল খারাপ কিছু শুনেছে। তাই জিজ্ঞেস করল,
” কী হয়েছে? ”

অরুণিমা মোবাইলটা ব্যাগে ভরতে ভরতে উঠে দাঁড়াল। দুর্বল স্বরে উত্তর করল,
” হাসপাতালে যেতে হবে। ”

মাইমূনও উঠে দাঁড়াল। পরবর্তী প্রশ্নটা করার সুযোগ পেল না। অরুণিমা ব্যাগ থেকে কিছু টাকা বের করে রাখল টেবিলে। বলল,
” বিলটা দিয়ে দিয়েন। আসি। ”

মাইমূন টাকা ফিরিয়ে দিতে চাইলে অরুণিমা শান্ত স্বরে বলল,
” আপনাকে আমি ডেকে এনেছি। তাহলে খরচটা তো আমার পক্ষ থেকেই হওয়া উচিত। ”
” তুমি তো কিছু খাওনি। ”
” তাই বলে কি, বিল মাফ পেয়ে যাব? ”

মাইমূন খাবারগুলোতে আরেকবার তাকাল। অরুণিমা দুপুরে দেখা করে বাড়ি যাওয়ার সময় পাবে না। খাওয়াটাও হবে না। তাই মেন্যুকার্ডের ভারী খাবারের দিকে চোখ বুলিয়েছিল। সেখান থেকেই চিকেন ফ্রাইড রাইস, মিক্স ভেজিটেবলস, প্রন ও চিলি চিকেন অর্ডার করেছিল। আলাপের ফাঁকে মেয়েটার পেটটাও ভরে যাবে এই ভাবনায়। মাঝখানে কল চলে আসায় আলাপ ও খাওয়া কোনোটাই সম্পূর্ণ হলো না। বিল নিয়ে এমন যুক্তি দেখাবে বুঝতে পারলে, এসব খাবার অর্ডারও দিত না। মাইমূনের যেমন রাগ হলো তেমন অনুতাপও। দুটোর মধ্য থেকে জিজ্ঞেস করল,
” তোমার সঙ্গে আসব ? ”

অরুণিমা ব্যাগের চেইন লাগানো শেষ করেছে। চেয়ার সরিয়ে বের হতে হতে বলল,
” না। আপনার ভাগের খাবারটা শেষ করুন। ”

মাইমূনও চেয়ার সরিয়ে বেরিয়ে এলো। সামান্য কঠিন হয়ে বলল,
” আমি খেতে আসিনি। ”

অরুণিমা এক ঝলক তাকাল। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে দ্রুত বলল,
” আসি। ”

_________

অরুণিমাকে হাসপাতালে এসে খোঁজাখুঁজি করতে হলো না। সঞ্জয়ান সুন্দর করে ফ্লোর ও রুম নাম্বার বলে দিয়েছিল। কাঙ্ক্ষিত রুমটার সামনে পৌঁছাতে শুনতে পেল,
” তুমি অরুণিমা? ”

অরুণিমা চমকাল, অপ্রস্তুত হলো। ভীত ও শঙ্কিত দৃষ্টি নিয়ে সুধাল,
” বাবা কেমন আছে? ”

প্রশ্নকর্তা সামান্য হাসলেন। আশ্বস্ত চাহনি মেলে বললেন,
” ভালো। জ্ঞান ফিরেছে। কথাও বলছেন। চিন্তার কিছু নেই। ”

অরুণিমা আটকে রাখা নিশ্বাসটা ছাড়ল। মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” আপনি সঞ্জয়ান স্যার? ”

সঞ্জয়ান আগের মতো হাসল। বিনয়ীভাবে বলল,
” আমি সঞ্জয়ান সাখাওয়াত। স্যার নই। ”

ফোনে নাম শুনে অরুণিমা চিনতে না পারলেও এবার চিনেছে। বাবার মুখে এই নামটা একাধিক বার শুনেছে। শুনতে শুনতে মনের মধ্যে শ্রদ্ধা ও সম্মান জমা হয়ে গিয়েছিল। সেটাই বুঝি ব্যবহারে প্রকাশ পাচ্ছে। সহজভাবে কথা বলতে পারছে না। ভীষণ লজ্জা ও অস্বস্তি হচ্ছে। তাই বলল,
” বাবার সাথে দেখা করা যাবে? ”
” অবশ্যই। হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়ায় আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তাই একদম ভর্তি করে ফেলেছি। ডাক্তার পরীক্ষা করে জানিয়েছেন, এখানে থাকার প্রয়োজন নেই। বিকেলের মধ্যে ছেড়ে দিবেন। ”

সঞ্জয়ানের দেখানো পথে অরুণিমা হেঁটে বাবার সামনে উপস্থিত হলো। তিনি বসে আছেন। চোখ-মুখে ক্লান্ত, চিন্তার ছাপ। অরুণিমা পাশে গিয়ে বসতে তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
” কত টাকা বিল হয়েছে রে? আমার পকেট তো একদম ফাঁকা। তোর কাছে আছে কিছু? ”

বাবার প্রশ্নে অরুণিমার দরদপূর্ণ মুখটা বিষণ্ণ হলো। তার ব্যাগে পঞ্চাশ টাকার দুটো নোট আছে মাত্র। বাকি টাকা রেষ্টুরেন্টের বিলে চলে গেছে। তার এত খারাপ লাগল! মনে হলো, রাতের চেয়েও দুপুরে দেখা করাটাই বেশি ঝামেলা হয়েছে। এখন হাসপাতালের বিলটা কীভাবে দিবে? ”

মেয়ের নিশ্চুপতায় অসীউল্লাহর চিন্তা বেড়ে গেল। অসহায় স্বরে বললেন,
” কেন যে অজ্ঞান হলাম! সঞ্জয়ান সাহেবের সামনেই হলাম! তার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে চোখে পানি ছিটিয়েই সুস্থ করে দিত। এসব বড়লোকই চিকিৎসা কি আমাদের জন্য? ”

অরুণিমা এক মুহূর্তের জন্য টাকার চিন্তাটাকে এড়িয়ে গেল। জিজ্ঞেস করল,
” কী হয়েছিল তোমার? ডাক্তার বলেছে কিছু? ”

অসীউল্লাহ প্রশ্নটাকে তেমন গুরুত্ব দিলেন না। হালকা স্বরে বললেন,
” তেমন কিছুই না। প্রেশারটা বেড়ে গেছিল। ”
” কেন? ওষুধ কাজ করছে না? ”

অসীউল্লাহ উত্তর দিতে চাচ্ছিলেন না। দোষটা ওষুধের না, তার। চার দিন হলো ওষুধ শেষ। কিনতে চেয়েও কিনেননি। ভেবেছিলেন, বেতনটা পেয়ে একেবারে কিনবেন। মাসের শেষ কটা দিন, কাঁচাবাজারটাও মনমতো করতে পারেন না।

” তুমি আসো। আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলে আসি। ”

অসীউল্লাহ হাত বাড়িয়ে মেয়েকে আটকাতে চাইলেন, পারলেন না। অরুণিমা ব্যস্তপায়ে নাগালের বাইরে চলে গেছে। মুখের নিষেধটাকে পাত্তায়-ই দেয়নি।

বাইরে বেরিয়ে সঞ্জয়ানকে পেল না। হয়তো চলে গেছেন। ব্যস্ত মানুষ, রোগীকে যে হাসপাতালে এনেছেন এটাই অনেক। অরুণিমার মনের ভেতরটা শ্রদ্ধায় পরিপূর্ণ হয়ে গেল। ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করার চেয়েও হাসপাতালের বিলের টাকা যোগাড় করা বেশি জরুরি। তাই বাসার দিকে ছুটল। মায়ের কাছে জমানো কিছু থাকতে পারে।

________
অরুণিমা বাসায় পৌঁছে বাবার সম্পর্কে মাকে কিছু বলল না। অন্য কারণ শুনিয়ে টাকার কথা তুলল। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বলে দিলেন তার কাছে কিছু নেই। দুশো টাকার মতো ছিল, পরশু বাবা চেয়ে নিয়েছেন। অরুণিমা আশাহত হলো। চিন্তা দুশ্চিন্তায় রূপ নিল। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ রুমে বসে থাকার পর যখন বাইরে বেরুল তখনই মল থেকে কল এলো। অরুণিমা ভাবছিল, কাজে ফিরে যায়নি তাই কল দিয়েছে। কিন্তু দোকানদার চাচা সেই প্রসঙ্গ না টেনে বললেন,
” শুনলাম, তোমার বাবা অসুস্থ? আমাকে বলোনি কেন? ওষুধপত্র কিনেছ? ”
” না। ”
” কত টাকা লাগবে? দোকানে এসে নিয়ে যেও। থাক আসতে হবে না। আমি আসছি তোমার কাছে। এই সুযোগে তোমার বাবাকেও দেখে নিব। ”

অরুণিমা বাঁধা দিতে চাইল, তিনি শুনলেন না। হাসাপাতালের সামনে দাঁড়াতে বলে কল কেটে দিলেন।

_______
দোকানদার চাচার অপেক্ষা করতে করতে অরুণিমার মনে সন্দেহ তৈরি হলো। কতগুলো প্রশ্নও জমা হলো। সে তো বাবার অসুস্থের কথা বলেনি, হাসপাতালের ঠিকানাও দেয়নি। তাহলে খোঁজ-খবর পেলেন কোথায়? এই সন্দেহ গ্রস্ত অবস্থায় দোকানদারের সাথে সাক্ষাত হলো। রিকশায় এসেছেন। হাসপাতালের মূল ফটকে পৌঁছাতে বেলা শেষ হয়। মাগরিবের আযানের ধ্বনি শোনা যায় আশপাশের মসজিদ থেকে।

” চলো, তোমার বাবার সাথে আগে দেখা করি। ”

অরুণিমা তাকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটা শুরু করতে মিয়াভাইয়ের মুখটা ভেসে উঠে মানসপটে। পা দুটোকে একটুখানির জন্য থাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” চাচা, আপনার সাথে মিয়াভাইয়ের যোগাযোগ হয়েছে? ”

চাচা আকস্মিক থেমে গেলেন। থতমত খেয়ে বললেন,
” না তো। ”

অরুণিমা বিশ্বাস করল না। বলল,
” টাকা কি উনি দিচ্ছেন? আমি এ টাকা নিতে পারব না। আপনি যেহেতু এসেই পড়েছেন, বাবার সাথে দেখা করে চলে যান। ”

চাচা দ্রুত বললেন,
” না, না। মিয়া ভাই টাকা দিবে কেন? তুমি কি উনার দোকানে কাজ করো নাকি আমার? আমি দিচ্ছি। তোমার যদি বিশ্বাস না হয় ধার মনে করে বেতন থেকে কেটে নিও। ”

অরুণিমার ধার নিতে হলো না। হাসপাতালে বাবা নেই। রিসিপশনে খোঁজ নিয়ে শুনল, তাকে বিকেলে ছুটি দেওয়া হয়েছে। সকল বিলও পরিশোধ হয়ে গেছে। অরুণিমার বুঝতে বাকি রইল না এই কাজটি কার। সঞ্জয়ান চলে যায়নি, বিল পরিশোধ করতে গিয়েছিল। সেজন্যই তার সাথে দেখা হয়নি।

বাসায় পৌঁছে দেখল, বাবার বিছানায় ওষুধের সাথে একগাদা ফলমূল। শূভ্রা ও নিয়াজ ইতিমধ্যে একটা করে আপেল ও বাটি ভর্তি আঙুর নিয়ে খাওয়া শুরু করেছে। অরুণিমা সেখান থেকে বেরিয়ে এলো মুখ ভার করে। যে সাহায্যটা মিয়া ভাইয়ের কাছ থেকে নিতে চায়নি, সেটা কি সঞ্জয়ানের কাছ থেকে নেওয়া উচিত? অরুণিমা দ্বিধায় পড়ল। রাতের খাবারটা ঠিকমতো খেতে পারল না। ঘুমাতে যাওয়ার সময় সঞ্জয়ানকে কল না করে পারল না। ভীরুমনে খুব মনোযোগের সাথে রিং শুনতে শুনতে আচমকা পুরুষ কণ্ঠটা পেল। সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” চাচার শরীর এখন কেমন? ”
” ভালো। ”
” গলা এমন শোনাচ্ছে কেন? চিন্তা দূর হয়নি এখনও? ”

অরুণিমা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করতে করতে বলল,
” আমার গলা এমনই। একটা প্রশ্ন ছিল। ”
” জি, বলুন। ”

অরুণিমার সঞ্চয় করা সাহসটা হারিয়ে গেল। অপরিচিত অবস্থায় মানুষটি তাকে ‘ তুমি ‘ সম্বোধন করেছিল। পরিচিত হওয়ার পর ‘ আপনি ‘ হয়ে গেল কেন? অরুণিমার মনে হলো, এত রাতে কল দেওয়ায় সঞ্জয়ান রাগ করেছে। বিরক্ত হয়েছে। সেজন্যই সম্বোধন বদলে গেছে। তাই প্রশ্নটা করবে কী করবে না বুঝতে পারছে না। একবার মনে হলো, কলটা কেটে দিলেই বেশি ভালো হবে। পরক্ষণে ভাবনা পাল্টাল। বার বার কল দিয়ে বিরক্ত করার চেয়ে একবার কল দিয়েই কাজটা সম্পন্ন করাই ঠিক হবে। সে একটা নিঃশ্বাস টেনে জিজ্ঞেস করল,
” হাসপাতালের বিল কি আপনি পরিশোধ করেছেন? ”
” হ্যাঁ, এটা তো উনার হক। ”
” কীভাবে? ”

সঞ্জয়ান বুঝাল, অসীউল্লাহ রুহানিয়াতে কর্মরত আছেন। সেই হিসেবে তার চিকিৎসার কিছু খরচের দায়ভার কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করতেই পারে। অরুণিমা বুঝতে পেরে চুপ হয়ে গেলে সঞ্জয়ান জিজ্ঞেস করল,
” আর কোনো প্রশ্ন? ”
” না। ”
” তাহলে রাখব? ”

অরুণিমা এই প্রশ্নের উত্তর করল না। চট করে কলটা কেটে দিল। ঠিক সেই সময় কলিংবেল বেজে ওঠল।

চলবে