আজকে শহর তোমার আমার পর্ব-১৯

0
735

#গল্পঃআজকে_শহর_তোমার_আমার
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_১৯

আলিফ অফিসে যাওয়ার আগে রুপ্সিতাকে রিতার শশুর বাড়িতে পৌঁছে দিতে এসেছে।দরজার কলিংবেলে চাপ দিতেই রিতা এসে দরজা খুলে দিলো।রুপ্সিতার সাথে আলিফকে দেখে প্রথমে ভড়কে গেলো রিতা।কারণ শোভন রুপ্সিতাকে নিয়ে যে সিনক্রিয়েট করেছে সেসবের কিছুই আলিফ জানেনা।রিতা তবুও মুখে জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে আলিফকে ভেতরে আসতে বলল।
আলিফ মাথা নাড়িয়ে হাসিমুখে বলল,না আপু এখন ভেতরে যাবোনা রুপ্সিকে পৌঁছে দিতেই এসেছিলাম।আমার অফিসে যেতে হবে।রিতাও আর জোর করেনি।আলিফ এখানে থাকলে কাহিনী আরো বহুদূর গড়াবে।

আলিফ পেছন ঘুরে চলে যেতেই রুপ্সিতা সেদিকে একবার তাকিয়ে বাসার ভেতরে প্রবেশ করে।বসার ঘরে ওর বাবা মাকে বসে থাকতে দেখে মাথা নিচু করে নেয়।রুপ্সিতার বাবা-মা রুপ্সিতার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন।কতদিন পর ছোট মেয়ের মুখ দেখলো।রিতা রুপ্সিতাকে বসতে বললে রুপ্সিতা প্রশ্ন করে ওঠে আমাকে এখানে কেন ডেকেছিস সেটা বল।আমাকে আবার বাসায় ফিরতে হবে।
রিতা লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে বলল,তুই আগে বস আমি বলছি।আমি এখন যেই কথাগুলো বলবো সেগুলো শুধু তুই না এখানে বসে থাকা প্রত্যেকটা মানুষের শোনা জরুরী।
সবাই মনযোগ দিয়ে রিতার কথাগুলো শোনার চেষ্টায় আছে।কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে রিতা বলা শুরু করলো।

রুপার বিয়ের আগেরদিন আমাদের বাসায় যে সিনক্রিয়েটটা হয়েছিলো সেটার জন্য সম্পূর্ণ দোষী শোভন।সেদিনের ঘটনাটা ছিলো সম্পূর্ণ মিথ্যে।তাতে রুপার বিন্দুমাত্র দোষ ছিলোনা।রুপ্সিতার বাবা মায়ের রিতার কথায় পিলে চমকে উঠে।
রিতা কাল রাতেই তার শশুর শাশুড়ীকে শোভনের করা কুকর্মের কথা বলে দেওয়ায় সবকিছু বুঝতে তাদের এখন কষ্ট হচ্ছেনা।রুপ্সিতা কোনো প্রতি উত্তর করেনি।ওর চোখমুখ বেশ শক্ত হয়ে উঠেছে।এতক্ষণ বোধগম্য না হলেও এখন যখন বুঝতে পেরেছে ও শোভনের বাড়িতে অবস্থান করছে ঘৃণায় এই জায়গা থেকে একছুটে পালাতে ইচ্ছে করতেছে।রুপ্সিতা চোয়াল শক্ত রেখেই ভাবছে এখন এই কথাগুলো কেন উঠছে আর শোভনই বা কোথায়?

রিতা তার বাবা মায়ের চেহারার দিকে তাকিয়ে নড়েচড়ে বসে বলল,আমি এখন যা বলছি এগুলোই সত্যি।শোভন একটা মেয়েবাজ।ঘরে আমাকে রেখে বাইরে অন্য মেয়েদের নিয়ে ফূর্তি করে বেড়ায়।চেয়েছিলো রুপাকেও নিজের নোংরা ফাঁদে ফেলবে।রুপাকে একরাত কাটানোর প্রস্তাব দিয়েছে।সেদিন রাতে আমি যখন শোভনকে পাশে না পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়েছিলাম তখন দেখি শোভন রুপার ঘর থেকে বের হচ্ছে।অজানা আতঙ্ক আমাকে গ্রাস করে ফেলেছে।নানান ভাবনা চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো।আমি শোভনকে এতরাতে রুপার ঘরে যাওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করতেই ও আমাকে মিথ্যে বলে কয়েকটা কথা বলেছিলো।যাতে আমি সারারাত এসব নিয়ে ভেবে ওর কথাটাই বিশ্বাস করি।আর হলোও তাই আমি রুপাকে বিশ্বাস না করে মায়ের কাছে গেলাম।মা বাবা ও তখন যাচাই-বাছাই না করে রুপার কথা না শুনে ওর গায়ে হাত তোলে।
এরপর রিতা এতদিনের সব ঘটনা সবাইকে খুলে বলে।কালকে কি হয়েছিলো সেগুলোও বলে।

সব শুনে রুপ্সিতার বাবা মা স্থির হয়ে গেলেন।জল ভর্তি চোখে রুপ্সিতার দিকে তাকাতেই রুপ্সিতা অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নেয়।শোভনের বাবা মা নিরবে চোখের জল ফেলছেন ছেলের কুকর্মের কথা শুনে।এছাড়া তাদের আর কিইবা করার আছে?
রুপ্সিতার বাবা চোখের পানি ছেড়ে হুহু করে কেঁদে উঠলেন।নিজের মেয়েকে বিশ্বাস না করে তার সাথে কতবড় অন্যায় করে ফেলেছেন।রুপ্সিতার বাবা মা দুজনেই এগিয়ে এসে রুপ্সিতার সামনে দাঁড়ালেন।রিতা সহ রুপ্সিতার বাবা মা রুপ্সিতার কাছে ক্ষমা চাইতে লাগলো।
রুপ্সিতার মা কেঁদে দিয়ে দুই হাত জোর করে বললেন,তুই আমাদেরকে ক্ষমা করে দে মা।আমরা তখন ঠিক ভুল বিচার না করেই তোর প্রতি অন্যায় করে ফেলেছি।
রুপ্সিতার বাবা বললেন,আমরা জানি আমরা ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য না।তারপরও তোর কাছে আমরা ক্ষমা চাইছি।আমাদেরকে তুই ক্ষমা করে দিস।

রিতা ও কাঁদতে কাঁদতে ক্ষমা চাইছে রুপ্সিতার কাছে কিন্তু রুপ্সিতা চুপ করে আছে।সেদিন রুপ্সিতা কেঁদে কেঁদে বলেছিলো আমি নির্দোষ সবাই চুপ ছিলো।কেউ ওর কথা শুনতে চায়নি আর আজ সবাই কেঁদে কেঁদে ক্ষমা চাইছে কিন্তু রুপ্সিতা চুপ করে আছে।
রুপ্সিতার বাবা কাতর কন্ঠে বললেন,কি হলো আমাদের ক্ষমা করবিনা?আমরা যে তোর সাথে বড় অন্যায় করে ফেলেছি আমাদেরকে তুই ক্ষমা কর মা।

শোভনের বাবা মা বলে উঠলো,আমাদের চরিত্রহীন ছেলের জন্য তোমাকে কত কি সহ্য করতে হয়েছে।আমরা খুবই লজ্জিত আমাদেরকেও ক্ষমা করে দিও মা।
রুপ্সিতা বলল,আপনারা কেন ক্ষমা চাইছেন?আপনাদেরতো কোনো দোষ নেই।আপনারা কিছুই জানতেন না।তাই আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে আমাকে লজ্জা দিবেন না প্লিজ।আপনাদের বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই।
রিতা ভাঙা ভাঙা কন্ঠে বলল,আর আমাদের ক্ষমা করা যায় না তাইনা?

রুপ্সিতা তাচ্ছিল্য হেসে বলল,সেদিন চিৎকার করে কেঁদে কেঁদে বলেছিলাম আমি কিছু করিনি আমার কোনো দোষ নেই।কিন্তু আমার সেদিনের কান্না, আর্তনাদ তোমাদের হৃদয় কাঁপাতে পারেনি।একটা বাইরের ছেলের কথা বিশ্বাস করলে অথচ যাকে সেই ছোট থেকে বড় করেছো তাকে বিশ্বাস করতে পারলেনা।বাবা মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,যাকে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছো।নিজেদের আদর্শে গড়ে তুলেছো সেই আদর্শের কথা কিভাবে ভুলে গেলে?কিভাবে ভাবতে পারলে আমি এরকম একটা জঘন্য,নোংরা কাজ করতে পারি?
আজ কথাগুলো বলতে রুপ্সিতার একটুও গলা কাঁপছেনা চোখে পানি আসাতো দূর।অথচ এতদিন বাবা মায়ের কথা ভাবলেই সেদিনের মারের কথা মনে পড়ে যেতো।চোখে অশ্রুর ঢল নেমে আসতো।কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বললো,

একটা সম্পর্কের মূল খুঁটি হলো বিশ্বাস।সম্পর্ক গড়ার জন্য বিশ্বাস অতিব জরুরি।কিন্তু আফসোস সম্পর্কের খুঁটি হিসেবে বিশ্বাসটাই তোমাদের মাঝে নেই।ক্ষমা করার কথা বলছো?তাহলে শুনে রাখো আমি তোমাদেরকে ক্ষমা করতে পারিনি।ভবিষ্যতে পারবো কিনা সেটা ও জানিনা।
রুপ্সিতার বাবা ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়লেন।রুপ্সিতার মা উনাকে ধরে পাশেই বসে রইলেন।রিতা এগিয়ে এসে বলল,প্লিজ একটা সুযোগ দে আমাদেরকে।এবারের মতো ক্ষমা করে দে।ক্ষমা করা মহৎগুন।

রুপ্সিতা ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বলল,
এখন আমি মহান হওয়ার জন্য তোমাদেরকে বলবো আমি তোমাদের ক্ষমা করে দিয়েছি।কিন্তু আদেও আমি মন থেকে তোমাদেরকে ক্ষমা করতে পারবো তো?তাহলে মুখে ক্ষমা করেছি বলে মহান সাজার কি দরকার?হঠাৎ করে তোমাদের করা অন্যায়ের কথা মনে পড়লে তোমাদের প্রতি একধরনের ক্ষোভ জন্ম নেবে আমার মনে।তাহলে আমি কিভাবে বলবো যে আমি তোমাদের ক্ষমা করেছি?
তবে যখন দেখবো তোমাদের করা অন্যায়ের কথা আমার মনে পড়ছেনা,যদি কখনো তোমাদের কাছে ফিরে আসি তাহলে ধরে নেবে আমি তোমাদের ক্ষমা করতে পেরেছি।

এখন আমাকে যেতে হবে বলেই সোফা থেকে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে রুপ্সিতা দরজার দিকে পা বাড়ায়।সবাই জলভরা চোখে তাকিয়ে আছে।পেছন ফিরেই রুপ্সিতার পা দুটো থেমে যায়।
আলিফ দাঁড়িয়ে আছে।কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছে?এখানে যেহেতু দাঁড়িয়ে ছিলো তারমানে সবকিছুই শুনেছে।রুপ্সিতা চোখমুখ শক্ত করে আলিফকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যায়।
সবাই আলিফকে দেখে থমকে যায়।আলিফ সবার দিকে এক নজর তাকিয়ে রুপ্সিতার পিছু পিছু বেরিয়ে আসে।
রিতা আনমনে বলে ওঠে আমার বোনের সংসারটা টিকবে তো?

রাগে আলিফের মাথা ফেটে যাচ্ছে।এরা এতটা জঘন্য যে কিনা নিজের মেয়েকে বিশ্বাস না করে গায়ে হাত তুলেছে।তারমানে রুপ্সির গায়ে বিয়ের প্রথমে যে দাগ গুলো ছিলো সেগুলো ওর পরিবারের দেওয়া?এদের সাথে কথা বলতেও আলিফের রুচিতে বাঁধছে তাইতো ওখানে আর এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে বেরিয়ে এসেছে।আলিফ এসেছিলো রুপ্সিতার ফোন দিয়ে যেতে।আসার সময় সিএনজিতে ফেলে এসেছিলো।কিন্তু এখানে এসে সবার কথা শুনেই বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে।

রুপ্সিতা একটা সিএনজি ডেকে উঠে পড়তেই আলিফ হুড়মুড়িয়ে এসে রুপ্সিতার পাশে এসে বসে।রুপ্সিতার চোখে পানি চিকচিক করছে।আলিফ কি ওকে ভুল বুঝে দূরে সরিয়ে দেবে?আলিফ সন্তর্পণে রুপ্সিতার দিকে ওর ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বলল,তোমার ফোন সিএনজিতে ফেলে গিয়েছিলে।একেবারে স্বাভাবিক ব্যবহার করছে রুপ্সিতার সাথে।রুপ্সিতা চোখের পলক ঝাপটাতেই টুপ করে দুফোঁটা জল কপল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো।থুতনি বেয়ে জলগুলো নিচে গড়িয়ে পড়ার আগেই আলিফ সযত্নে সেগুলো মুছে দিয়ে বলে,কাঁদছো কেন?ওয়েট তোমার চোখে কি কিছু পড়েছে?
আলিফ এমন ব্যবহার করছে যেন একটু আগের কথাগুলো কিছুই শুনেনি।

রুপ্সিতা আলিফের কথাকে উপেক্ষা করে বলল,সবার মতো আপনি ও কি আমাকে দূরে সরিয়ে দিবেন?
আলিফ রুপ্সিতার মাথা বুকের সাথে চেপে ধরে বলল,ভালোবাসি আমি তোমায় আর সেটা সারাজীবনের জন্য।তোমার অতীত আমাদের বর্তমান জীবনে কোনো প্রভাব ফেলবেনা।এখানে তোমার কোনো দোষই নেই তাহলে তুমি শুধু শুধু কেন কেঁদে কেটে নিজের চোখের পানি ঝরাচ্ছো?মনে রেখো তোমার এই চোখের পানি কোনো একজনের কাছে অমূল্য রত্ন।তাই এই রত্নকে না ঝরিয়ে যত্ন করে রাখো।রুপ্সিতা নিজের দুহাত দিয়ে আলিফের পিঠ আঁকড়ে ধরে প্রশান্তির হাসি দিলো।ও ভুল মানুষকে ভালোবাসেনি।

সিএনজির ড্রাইভার সামনে থেকে বলছে ভাই পার্কে গিয়ে প্রেম করেন এটা প্রেম করার জায়গা না।
আলিফ ড্রাইভারকে বলল,সামনে তাকিয়ে গাড়ি চালান নয়তো এক্সিডেন্ট হবে।আর আমরা প্রেমিক-প্রেমিকা না স্বামী-স্ত্রী।ড্রাইভার আর কিছু না বলে গাড়ি চালাতে থাকে।রুপ্সিতা সরে আসতে নিলেই আলিফ আটকে দেয়।

সিএনজি পাঁচ মিনিটের পথ অতিক্রম না করতেই একটা ছেলে সিএনজি থামিয়ে দিয়ে পেছনে উঠতে নিলেই আলিফের চোখে চোখ পড়ে।ছেলেটা আর কিছু না ভেবেই ভোঁ দৌড় দেয় উল্টো দিকে।
এটা সেই ছেলেটা যাকে কিছুদিন আগে রাতে রুপ্সিতার দিকে তাকানোর কারণে আলিফ ঘুষি মেরেছিলো।রুপ্সিতা ভ্যবলার মতো তাকিয়ে থেকে বলল,ছেলেটা এভাবে দৌড় দিলো কেন?
আলিফ শার্টের কলার ঠিক করতে গিয়ে বলল,এরা ছোটখাটো বখাটে পোলাপান।হালকা একটু গুন্ডামী করতে পারলে নিজেকে অনেক বড় কিছু মনে করে।মনে হয় সেদিনের ঘুষিটা এখনো ভুলতে পারেনি তাই দৌড়ে পালিয়েছে।

ছেলেটা কিছুদূর গিয়ে হাটুতে হাত রেখে হাঁপাচ্ছে।নাকে হাত দিয়ে বলে,সেদিন আমার নাক ফাটিয়েছে নাজানি আজ কি ফাটিয়ে দিতো?আর জীবনে গুন্ডামী করতে যাবোনা।
#চলবে……….।

(ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।হ্যাপি রিডিং।)