আঠারো বছর বয়স পর্ব-০২

0
4220

#আঠারো_বছর_বয়স
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-২

বিভোর কীভাবে রুহির মনের কথা টের পেলো? আশ্চর্য! লোকটা কী মনের কথা শুনতে পায় নাকি! রুহি যে প্রেমে পড়ার কথা ভাবছে এটাও কী জেনে গিয়েছে! ছিঃ, কি লজ্জ্বা। প্রথম দেখায় এভাবে কেউ প্রেমে পড়ে নাকি। বিভোর ছেলেটা না আবার ওকে নির্লজ্জ ভাবে। কিন্তু বিভোর! এটা আবার কেমন নাম? ছেলেটা কী কোনো হিরো? হিরোদেরই এরকম নাম মানায়। অবশ্য ছেলেটা দেখতে হিরোর চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।

‘ বিভোর নামের অর্থ কী?’

‘ জানিনা।’

‘ কেন?’

‘ জানার ইচ্ছে কখনো হয়নি। আর জেনেই বা কী হবে!’

‘ আপনার নামটা সুন্দর।’

‘ আপনার নাম কী?’

রুহি ভাবলো নিজের নাম বলাটা কতোটা যুক্তিযুক্ত। তার ভাই যদি কোনোভাবে ওর খোঁজ করে তাহলে খুব সহজেই পেয়ে যাবে। তবে কোন নামটা বলবে? বাবা-মা যে নামে ওকে ডাকতো সেই নাম? হুম, ওটাই ভালো। চট করে কেউ ওকে চিনতে পারবেনা।

‘ আমার নাম রুহানি!’

বিভোর নিচের ঠোঁটে চিমটি কেটে আনমনে বলল,

‘ রুহানি, বাহ! ইন্টারেস্টিং নেইম।’

তারপর আরকিছুই কথা হলোনা দুজনের মধ্যে। রুহি প্রাণপণে ওর নামটা ভুলতে চাইছে। ভাবছে ও শুধু রুহানি। হ্যাঁ, রুহানি! বাবা-মায়ের আদরের মেয়ে রুহানি।

বিভোরের দেওয়া তুলোতে রুহির ঠোঁট আর কপালের রক্ত আর গড়াচ্ছে না। মলিন মুখটাতে চিন্তার ছাপ। ট্রেন কোথায় যাচ্ছে জানেনা রুহি। কামরাটাতেও মানুষ নেই বলতে গেলে। পুরোটাই খালি। বিভোর আর রুহি ছাড়াও চার, পাঁচজন যাত্রী পেছনের দিকে আছেন। ওকে আনমনা হয়ে থাকতে দেখে বিভোর হালকা কেশে জিজ্ঞেস করলো,

‘ আপনি কী কোনোকিছু নিয়ে চিন্তিত মিস রক্তজবা?’

রুহি ঘাড় ঘুরিয়ে বিভোরের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ রক্তজবা মানে? আমি কী জবাফুল?’

‘ হুম। আপনাকে দেখে আমার রক্তজবার কথাই মনে হচ্ছে।’

‘ কেন? এমনটা কেন হচ্ছে?’

‘ কারণ আপনি দেখতে খুবই অন্যরকম।’

‘ যেমন?’

‘ একটু অদ্ভুত, বিস্ময়কর।’

রুহি চোখগুলো বন্ধ করে রাগ নিয়ন্ত্রণ করলো। ওকে কেউ অদ্ভুত বলুক তা ও চায় না। বিভোরকে ঠাস করে থাপ্পড় দিতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু অতোসুন্দর গালে চড়-থাপ্পড় মানাবেনা। রাজপুত্রদের মার খেতে নেই, দিতেও নেই। এটা ঘোরতর অন্যায়। সুদর্শন যুবকরা হাজারো দোষ করার পরেও এই একটা কারণেই মাঝেমধ্যে বেঁচে যায়!

‘ আচ্ছা, আপনি যাচ্ছেন কোথায়?’

‘ আমি?’

‘ তো এখানে আর কেউ আছে নাকি?’

রুহি ঢোক গিললো। বলবেটা কী এখন? কিছুক্ষণ গাইগুই করে বলল,

‘ ট্রেনটা যাচ্ছে কোথায়?’

বিভোর অবাক হয়ে বলল,

‘ মানে আপনি জানেন না আপনি কোথায় যাবেন? আশ্চর্য! আপনি সেন্স অব হিউমার কী ডিজেবল হয়ে গিয়েছে নাকি?’

‘ আসলে..!’

বিভোর রেগে বলল,

‘ আপনি বোধহয় বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছেন। সেজন্যই এতোক্ষণ পরখ করে দেখছিলাম। কেমন চোর চোর ভাব টের পাওয়া যাচ্ছিলো।’

রুহি মাথা নিচু করে রইলো। বিভোরকে এভাবে রাগতে দেখে মনে মনে প্রমাদ গুনলো। বিভোর চেঁচিয়ে বলল,

‘ আমার কথাই ঠিক! এভাবে মাথাটাথা ফাটিয়ে কোথা থেকে এসেছেন আপনি?’

রুহি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। নোনাজলে ওর গাল ভেসে গেলো।

‘ আমাকে ওরা খুব মেরেছে। আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি।’

বিভোর রুহির কথা শুনে খুব অবাক হলো। বোতলের ক্যাপ খুলে ওর হাতে দিয়ে বলল,

‘ পানিটুকু খেয়ে নিন।’

রুহি পুরোটা ঢকঢক করে খেলো। বিভোর বলল,

‘ কারণটা জানতে পারি? অবশ্য আপনার অসুবিধে হলে না বলাই ভালো।’

‘ আমাকে জোর করে একটা মাতাল ছেলের সাথে বিয়ে দিতে চাচ্ছিলো ওরা।’

‘ বয়স কতো আপনার?’

‘ আজ আঠারো হলো।’

বিভোর বিস্ময় নিয়ে বলল,

‘ আজ তোমার জন্মদিন! তুমি তো খুবই ছোট, আমি কেন আপনি আপনি করছি। শিট ম্যান! কিন্তু তোমার কথাবার্তায় ম্যাচিউরিটি এসে গিয়েছে। আমিতো ভেবেছি বড়ই হবে।’

রুহি মনে মনে বলল,

‘ কচু এসেছে। সুযোগ পেলে তোর জীবন ত্যানাত্যানা বানিয়ে দিবো!’

কিন্তু ফোঁপাতে ফোপাঁতেই মুখফুটে বলল,

‘ আচ্ছা, ওয়াশরুম কোনদিকে? আমাকে একটু দেখিয়ে দিন।’

বিভোর উঠলো না। আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো। রুহি সেদিকে গেলো। ওয়াশরুমে গিয়ে চোখেমুখে পানির ছিঁটা দিলো। আয়নায় দেখলো মুখটা ভীষণ অন্যরকম দেখাচ্ছে। চুলগুলোতে আঙুল চালিয়ে খোঁপা বেঁধে নিলো৷ জামাকাপড় ঠিকঠাক করে বেরিয়ে এলো। ওয়াশরুম থেকে বেরুতেই দেখলো দরজার কাছে কয়েকটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। রুহিকে দেখে হাসাহাসি শুরু করলো৷ বিশ্রি ইশারা করছে। ও যখন ওদেরকে পাশ কাটিয়ে আসতে যাবে তখনোই কালো মতোন একটা ছেলে ওর হাত টেনে ধরে বলল,

‘ কই যাও মামুনি?’

রুহি ভয় পেয়ে গেলো। বলল,

‘ আমার হাত ছাড়ুন।’

‘ ছাড়ার জন্য তো ধরিনাই সুন্দরী।’

‘ মানে?’

‘ আসো, আমাগো লগে মজা করো।’

‘ দরকার নেই।’

‘ তা কইলে তো হইবো না সুন্দরী ললনা!’

রুহির গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে৷ এ কোন বিপদে পড়লো ও? গ্রামে সজীবও মাঝেমধ্যে এভাবেই ওকে উত্ত্যক্ত করতো।

‘ আমি কিন্তু চিৎকার করবো।’

ছেলেগুলো দাঁত কেলিয়ে হেসে বললো,

‘ তোমার মিষ্টি চিৎকার কেউ শুনবেনা মামুনি। দেখ, কামরায় কেউ নাই। যাবা কই! হা হা!’

রুহি ভালো করে খেয়াল করে দেখলো আসলেই কামরায় কেউ নেই। ভেবেছিলো কামরায় বুঝি ও আর বিভোর ছাড়াও পেছনের দিকে মানুষ আছে। কিন্তু কেউ নেই, পুরোটা খালি। আসলে এই ছেলেরাই পেছনের দিকে বসে ছিলো। বিভোর সামনে, ওর ডাক শুনতে পাচ্ছেনা। কিন্তু এখন ও কী করবে? উপায় না পেয়ে হাত-পা ছুঁড়াছুঁড়ি করতে লাগলো। একটা ছেলে ওর মুখ চেপে ধরলো। একজন বললো,

‘ এই ভিডিও কর মাম্মা!’

কালো ছেলেটা যখন ওর ওড়নায় হাত দিতে যাবে তখনই পেছন থেকে ভেসে এলো বিভোরের কন্ঠ!

‘ এক্সকিউজ মি! এখানে কী হচ্ছে?’

রুহি ছেলেটার হাতে কামড় দিয়ে বলল,

‘ আমাকে বাঁচান প্লিজ!’

বিভোর দেখলো ছেলেগুলো রুহির সাথে অসভ্যতামি করছে। ও রেগে বলল,

‘ ওকে ছাড়ুন বলছি, ছেড়ে দিন।’

‘ কেন ছাড়মু? তুই ভাগ।’

‘ আপনারা এমন কেন করছেন?’

‘ এরে আমাগো পছন্দ হইছে৷ আজ রাইতটা এরে চাই আমরা।’

‘ আমি কিন্তু কর্তৃপক্ষকে জানাতে বাধ্য হবো।’

‘ এই তোর কী লাগে এই মাইয়া? তোর কিছু লাগে?’

বিভোর হঠাৎই খামখেয়ালি হয়ে বলে উঠলো,

‘ সে আমার হবু স্ত্রী!’

ছেলেগুলো ব্যক্কল বনে গেলো। একজন বলল,

‘ মিছা কথা।’

বিভোর বলল,

‘ এটাই সত্যি। আর আপনারা আমার স্ত্রীর সাথে এরকম কর‍তে পারেন না।’

‘ তোর কথা আমরা বিশ্বাস করিনা।’

‘ সেটা আপনাদের সমস্যা।’

‘ তুই বেশি ঝামেলা করতাছিস। ভালোয় ভালোয় যা এখান থেইকা।’

বিভোর মাথা ঠান্ডা রেখে বলল,

‘ দেখুন, আমি একজন ডক্টর। আপনারা যদি আমার বা আমার হবু স্ত্রীর সাথে খারাপ কিছু করার চেষ্টা করেন তাহলে এর ফল খুবই ভয়ানক হবে।’

এতকিছু বলার পরেও লোকগুলো ওর কথা বিশ্বাস কর‍তে রাজি হলোনা। রুহি উপায় না পেয়ে মৃদু গলায় বলল,

‘ ওনি সত্যিই বলছেন! আমাকে ছেড়ে দিন।’

রুহির কথা শুনে ছেলেগুলো নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করতে লাগলো। কিন্তু ওরা বিশ্বাস করতে পারছেনা রুহির কথা। তাই অনেকক্ষণ পরে কালো লোকটা বলল,

‘ তোদের কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে আমাগো কথা মানতে হবে।’

‘ কী কথা?’

‘ সেইডা সময় হলে বলমু। কিন্তু আমাদের কথা যদি না মানতে পারিস তাহলে বুঝমু এই মাইয়া তোর কিছু লাগেনা। আর তখন আমরা যা চাইবো তাই হইবো।’

বিভোর হাত দুটো পকেটে ঢুকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘ কী চান আপনারা?’

‘ আমাদের কথা না মানলে এই মাইয়ারে আমাদের কাছে ছাইড়া দিতে হইবো। তুই কোনো প্যাঁচাল পারতে পারবিনা।’

বিভোর রেগে বলল,

‘ আপনাদের কথা আমি শুনবোই কেন?’

ছেলেগুলো দাঁত কেলিয়ে হাসলো। চিকন একটা ছেলে বলল,

‘ আমরা যদি এখন বলি ট্রেন এইহানে থামাতে হইবে, তাইলে ট্রেইন এইহানেই থামব। আমাদের এতোই ক্ষমতা আছে।’

‘ তাই নাকি?’

‘ হাহ!’

বিভোর চিন্তায় পড়ে গেলো। একজন সচেতন নাগরিক এবং বিবেকবান ছেলে হয়ে কিছুতেই ওই রক্তজবার ন্যায় মেয়েটাকে ওদের মতো পশুর হাতে তুলে দিতে পারবেনা। আর ও একা এতগুলো ছেলের সঙ্গে পারবেনা, কারণ ওরা নয়জনের দল। আর মেয়েটাকে দেখে মনে হচ্ছে খুব ভয় পাচ্ছে, এ অবস্থায় ওকে ছেড়ে ঝামেলাহীনভাবে বিভোর বসে থাকতে পারবেনা। তাছাড়া মেয়েটা ওর সাহায্য চেয়েছে, একটা অদ্ভুত অধিকারবোধ কাজ করছে মেয়েটার প্রতি। তাই শেষমেশ ছেলেগুলোর কথায় রাজি হতেই হলো।

পরের স্টেশনে ট্রেন থামতেই ছেলেগুলো বিভোর আর রুহিকে নামতে বললো। ও অবাক হয়ে বলল,

‘ এখানে নামবো মানে? এমন তো কোনো কথা ছিলোনা!’

‘ নামতে কইছি, নাম।’

রুহি কালো লোকটির ধমক শুনে ভয় পেয়ে বিভোরের হাত আঁকড়ে ধরলো। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলো বিভোর। হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে রুহির নখ ওর মাংসের ভেতর ঢুকে গিয়েছে। রক্ত বেরিয়ে গিয়েছে। রাগী চোখে রুহির দিকে তাকালো ও। কিন্তু মেয়েটির অসহায় মুখখানা দেখে বেশিক্ষণ রাগ ধরে রাখতে পারলোনা। ওর হাত ধরে নেমে এলো প্ল্যাটফর্মে।

রুহির কাঁধে ওর ছোট্ট স্কুলের ব্যাগ আর বিভোরের কাঁধে ব্যাকপ্যাক। ছেলেগুলো চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে ওদের। এভাবেই হাঁটতে লাগলো ওদের নিয়ে। কালো ছেলেটির নাম আবির। সে-ই বোধহয় এই গ্যাংয়ের লিডার। বয়স ত্রিশের কাছাকাছি হবে। সে কিছুসময় পরপর দলের ছেলেগুলোকে ধমকাচ্ছে। একজনকে বললো,

‘ ওই সালেক, দেখ তো ওই কুঁজো বুড়া হুজুর মসজিদে আছেনি?’

সালেক নামের ছেলেটা বলল,

‘ এতো রাইতে মসজিদে থাকেনা হুজুর।’

‘ বুইড়ারে কই পামু এখন?’

চিকন ছেলেটার নাম আপন। সে বেশ উৎসাহ নিয়ে বলল,

‘ ওনার বাড়িত পাইবা ভাই।’

আবির ছেলেটা বলল,

‘ তাইলে বুইড়ারে ফোন দিয়া কইয়া দে, আমরা দুইডা পোলা-মাইয়া নিয়া আইতাছি। সবকিছু যেন রেডি রাহে।’

সালেক বলল,

‘ এতো রাইতে কেমনে কী?’

‘ যেমনে পেটে খাওন দে, ওমনেই করব। তুই চুপ কর!’

আপন ফোন লাগালো হুজুরকে। একটু দূরে গিয়ে কঘা বলায় কী বলছে কিছুই বুঝতে পারছেনা বিভোর। তবে ওদেরকে নিয়ে কথা হচ্ছে বেশ বুঝতে পারছে। কী মতলব আটছে ওরা কে জানে। হুট করে বউ না বলে বোন বললেই পারতো। তাহলে কোনো ভয় ছিলোনা। কিন্তু কেন যেন বউ কথাটাই মনে আসলো প্রথমে। মেয়েটার দিকে তাকালো বিভোর। মুখচোখ রক্তশূণ্য, খোলা বাতাসে চুল উড়ছে। গালগুলো টমেটোর মতো লাল, ঠোঁটদুটো কাঁপছে। বিভোরের হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। বেশ ভয় পেয়ে আছে বোঝাই যাচ্ছে। মৃদু হাসলেও একটা চিন্তার রেখা বিভোরের মস্তিষ্কে জেঁকে বসলো।

এই গল্পের নামটা মূলত #আঠারো_বছর_বয়স কবিতা থেকে নেওয়া। গল্পটা আপনাদের কেমন লাগছে জানাবেন দয়া করে। ভুল-ভ্রান্তি ক্ষমা করবেন। রি-চেইক হয়নি।

চলবে…ইনশাআল্লাহ!