আড়ালে কে পর্ব-১২+১৩

0
113

. #গল্প – #আড়ালে_কে . [ #পর্ব – ১২ ]
#লেখক — #সালাহউদ্দিন_তারিক [ জুনিয়র মুগলি ]

নাজমুল সাহেব সামনে কি করে বসে তার কোনো ঠিক নেই। একদিকে এমনিতেই সোহানার ভয় বাড়ে আস্তে আস্তে, অন্যদিকে মাস শেষ হয়ে আসছে। সামনের মাসেই নতুন বাড়িতে একা থাকতে হবে তাকে। কি হয় না হয়, তার কোনো ঠিক নেই। তাই দুপুরের দিকে প্রেমিককে কল দিয়ে বলে, ‘তুমি যা করার তাড়াতাড়ি করে ফেল নয়তো সামনে অনেক ঝামেলা হতে পারে।’

ওপাশ থেকে এক যুবকের কন্ঠ শোনা যায়, ‘কি জন্য সমস্যা হবে?’

– ‘ কি জন্য হবে মানে! সামনের মাস থেকে আমাদের আলাদা ফ্ল্যাটে থাকতে হবে সেখানে কি হয় না হয় কোনো ঠিক আছ?’

– ‘ এতো চিন্তা করো না বোকা মেয়ে। কিচ্ছু হবে না তোমার। আমি খুব তাড়াতাড়িই ব্যবস্থা করব। ‘

– ‘ হুহ তাড়াতাড়ি যে কবে আসবে তা আমার মাথায় ঢুকে না। কালকেও আমার গলা টি*পে ধরেছিল আরেকটু হলে ম*রেই যেতাম।’

– ‘ কি বলো! আবার এমন দুঃসাহস করেছে? ‘

– ‘ হুম, সামনে আরো কি কি করে তার ঠিক নাই। আর তুমি বল খালি অপেক্ষা করতে।’

– ‘ বললাম তো বাড়িতে একটু ঝামেলা চলছে শেষ হোক পরেই সব হবে। আর শোনো, আবার যদি তোমার সাথে এমন কিছু করে তবে সোজা মামলা করে দিবে।’

– ‘ আমিও সেটাই ভেবে রাখছি। এই বারের মতো কিছু করিনি, কিন্তু আবার করলে পুরো মামলা করে ফেলব।”

– ‘ সেটাই কর। আর একটা কথা, ডিভোর্সের সাথে সাথেই তো আমরা বিয়ে করতে পারব না। ৪ মাস ওয়েট করতে হবে তোমাকে। তো এখনই ডিভোর্স নিয়ে ফেল এর মধ্যে তো আমি একটা ব্যবস্থা করবই।”

– ‘ আমি এমন কিছুই করি নাই যে ৪ মাস অপেক্ষা করে প্রেগন্যান্সি চেক করতে হবে। ডিভোর্স দিয়ে সোজা তোমার কাছে চলে যাব। বাড়িতেই যাব না, গেলে ঝামেলা হবে আবারও।’

– ‘ আচ্ছা তুমি যা ভালো বুঝ সেটাই করো। এখন রাখছি কাজ করতে হবে। ‘

– ‘ আচ্ছা জান, লাভ ইউ। ‘

– ‘ লাভ ইউ টু ‘

প্রেমিকের সাথে কথা বলা শেষে মোবাইল ফোন রেখে চিন্তা করতে থাকে সোহানা। কি কি হতে পারে ভবিষ্যতে! যদি নাজমুল সাহেব সেচ্ছায় ডিভোর্স দিতে না চান তখন কি হবে? আর নতুন বাসায় একা একা থাকে অবস্থায় যদি আবারও আক্রান্ত হয় সে!
পরক্ষনেই চিন্তা করে এবার কিছু করলে তো সোজা মামলাই করে দিব, তখন বুঝবে কত ধানে কত চাল। কিন্তু সব শেষে যখন কাল রাতের কথা মনে পড়ে, মনে পড়ে নাজমুল সাহেবের কান্না জড়ানো চেহারাটা, তখন মন খারাপ হয়ে যায়। ইচ্ছে করে ওনাকে নিয়ে ভাবতে, কত মায়াবী দৃষ্টিতেই না তাকাচ্ছিলেন তিনি। কত সুন্দর করেই না জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকে। ওনার স্পর্শে সব সময়ই ভালোবাসা খুঁজে পায় সে, এক মুহূর্তের জন্যও কখনো সে*ক্সুয়াল ভাবে স্পর্শ করেনি তাকে। ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্যে কাছে টানেনি তাকে।

তার মাঝে মধ্যেই মনে চায় নাজমুল সাহেবের ভালোবাসায় নিজেকে বিলিয়ে দিতে। কিন্তু পরক্ষনেই মনে হয় ৩ বছরের সম্পর্কের কথা। বাবা মার চাপে পরে বিয়ে টা সে এজন্যই করেছিল যে তার প্রেমিকের তখন বিয়ে করার বা তাকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সামর্থ ছিল না। এক প্রকার বাধ্য হয়েই সে বিয়ে করে, এবং অপেক্ষা করতে থাকে উপযুক্ত সময়ের…।

বিয়ের সময় তার ইচ্ছেতেই ৩ লক্ষ টাকা কাবিন নির্ধারণ করা হয়। সে ভেবেছিল বরপক্ষ এতো টাকা দিতে রাজিও হবে না আর বিয়েও হবে না। কিন্তু নাজমুল সাহেবেরও তখন সামর্থ ছিল এই টাকা দেওয়ার মতো। এজন্য নগদ সব টাকা দিয়েই বিয়ে করে আনে সোহানাকে। কিন্তু বিয়ের দিন রাতেই সোহানা সরাসরি বলে দেয় যে তার অসম্মতিতে হয়েছে এই বিয়ে। সে ওনাকে মেনে নিতে পারছে না। কলেজ জীবনের সেই পুরোনো ধাক্কাটা আবারও এসে লাগে নাজমুল সাহেবের বুকে। সেবার না হয় পছন্দের মানুষ ছিল কেবল।
কিন্তু এবার তো নিজের বিয়ে করা বউ একদম। বিয়ে করা বউ ও এবার তাকে অপছন্দ করছে!
ভাবতেই অজানা এক কষ্ট অনুভব করেন তিনি। কিন্তু অন্যসব পুরুষের মতো খারাপ আচরণ করেননি তিনি। স্বাভাবিক ভাবেই বলেছিলেন “তোমার যদি আমার সাথে এই মুহুর্তে মানিয়ে নিতে সমস্যা হয় তবে কোনো আক্ষেপ নেই আমার। আমি তোমাকে পর্যাপ্ত সময় দিব খাপ খাইয়ে নেওয়ার নেওয়ার জন্য।”

নাজমুল সাহেব তখন ধারণা করেছিল যে ওনার বয়স যেহেতু সোহানার চেয়ে প্রায় ৮ বছর বেশি তাই হয়তো-বা এমন কথা বলছে সে। এজন্যই উনি তাকে কোনো প্রকার চাপ না দিয়ে সুযোগ দেন স্বাভাবিক ভাবে মানিয়ে নেওয়ার জন্য। কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝতে শিখেন যে, সোহানার আসলে এমন কোনো সমস্যা নেই। বরং অন্য কারো সাথে নিয়মিত সম্পর্ক রাখছে সে। সে সব সময় লুকিয়ে লুকিয়ে মোবাইল টিপে। ওনার সামনে খুব কম ব্যবহার করে। তাই নিজের ঘরের ডোর লকের একটা নকল চাবি বানান তিনি। আর সেই নকল চাবি দিয়ে ঘরে ঢুকে চুপিচুপি মোবাইল চেক করার সিদ্ধান্ত নেন। সত্যি সত্যিই একদিন সেই সুযোগ পেয়ে যান। সেদিন অফিস থেকে এক ঘন্টা আগেই বের হতে পারেন তিনি। আর আগে আগে ঘরে ঢুকেন লুকিয়ে। তখন ঘুমন্ত অবস্থায় বিছানায় শুয়ে ছিল সোহানা। এই সুযোগে তার ফেস লক ব্যবহার হোয়াটসঅ্যাপের সব মেসেজ চেক করেন তিনি। আর রাগ পুষতে থাকেন নিজের মধ্যে। কিন্তু সোহানার দিকে তাকালে হুট করেই যেন ওনার সব রাগ চলে যায়। মনে মনে ভাবেন এতো সুন্দর চেহারার মেয়েটিকে কি করে আঘাত করব আমি!!!
.

.
আজ রাতে অফিস শেষ করেই একটা বাসা দেখে আসেন তিনি। মাত্র দুই রুমের একটা বাসা, রান্না ঘর আর গোসলখানা রুমের সাথেই লাগোয়া। বাসাটা ওনার অসম্ভব পছন্দ হওয়ায় বাড়ির মালিককে ১ মাসের অগ্রীম ভাড়া দিয়ে নিশ্চিত করে আসেন যে উনি এখানেই উঠবেন। সেখানে কথা বলতে বলতেই একটু দেরি হয়ে যায় ওনার। বাড়িতে ফিরতে ফিরতে ১০ টা বেজে যায় একদম। বাড়িতে ঢুকেই সবার আগে নাদিয়ার রুমে গিয়ে পড়াশোনার খোঁজ খবর নেন। তারপর বাবা মার রুমে গিয়ে ওনাদের শরীর স্বাস্থ্যের খবর নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকেন। সোহানা আগেই শব্দ পেয়ে গিয়েছিল ওনার আসার। তাই দরজায় টোকা পরার আগেই খুলে দিয়ে বসে থাকে সে। নাজমুল সাহেব ঘরে ঢুকতেই সে উঠে দাঁড়ায় বাধ্য ছাত্রের মতো। যেন স্যার ক্লাসে ঢুকেছে, দাঁড়ানো একটা কর্তব্য।

নাজমুল সাহেবের চেহারার দিকে তাকানোরও সাহস হয় না তার। বুকের ভিতরে ধুকধুক করতে থাকে তার, কখন না জানি কি বলে ফেলেন নাজমুল সাহেব। কিন্তু ওনাকে একদম স্বাভাবিক দেখে হাসি মুখে জিজ্ঞেস করে , “এখনই খাবেন? না আরেকটুু পরে।’

নাজমুল সাহেবের সোজা উত্তর, ‘ খিদা লেগে গেছে রেডি কর সব। আব্বু আম্মুকেও ডাক দাও।’

” আচ্ছা ঠিক আছে। ”

অল্প কথা শেষ করেই খাবার টেবিলে সব গোছাতে ব্যস্ত হয়ে যায় সোহানা। কাজ করে আর মনে মনে চিন্তা করে, “যাক ওনার মন দেখা যায় ফ্রেশ আছে।”

সবাই এক সাথে খেয়ে যার যার ঘরে চলে যায়। নাজমুল সাহেব এনায়েতুল্লাহ আল তমাস স্যারের একটা উপন্যাসের বই নিয়ে বসে। ঐতিহাসিক উর্দূ উপন্যাস “ফেরদৌসে ইবলিশ।” বইটির বাংলা অনুবাদ অবশ্য ভিন্ন নামে প্রকাশিত হয়। বাংলা অনুবাদের নাম হচ্ছে “শয়তানের বেহেশত”। সেলজুক সম্রাজ্যের সময়ে উঠে আসা এক ভয়ংকর যাদুকর ও ইসলামের অপব্যাখ্যাকারী ” হাসান ইবনে সাব্বাহ্” এর জীবনের নানান কাহিনী নিয়ে লেখা হয়েছে এই বইটি। বইটি পরলে জানা যায় কিভাবে এই হাসান ইবনে সাব্বাহ তার তৈরি করা বিশেষ মাদক “হাসিস” দ্বারা প্রভাবিত করত তার শিষ্যদের। আর শিষ্যরা তখন পাগলের মতো অনুসরণ করত তাকে।

নাজমুল সাহেব এসব পড়েন আর বিছানায় শুয়ে থাকা সোহানার দিকে তাকান। মনে মনে চিন্তা করেন, ‘আহ্ আমিও যদি সেই হাসিস পেতাম! প্রিয়তমা তোকে সারা জীবনের জন্য আপন করে নিতে পারতাম। না-কি ঐ হাসিস দেওয়ার পরেও কি তুই অন্য কারো কথা ভাবতিস? ”

নিজের অজান্তেই ওনার চোখ ভিজে যায়, মনটা খারাপ হয়ে যায়। বইটা আর পড়তে ইচ্ছে করে না। ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পরেন তিনিও। শীত শুরু হয়ে যাচ্ছে প্রায়। ঘুমের মধ্যে সোহানা কেমন জড়সড় হয়ে আছে। একবার চিন্তা করেন ওকে নিয়ে আর কিছুই ভাববেন না। কিন্তু না ভেবেও থাকতে পারেন না। ভারী একটা কাঁথা দিয়ে ওর শরীরটা ঢেকে দেন। অতঃপর বিছানার একদম অপরপাশে উল্টোদিক ফিরে শুয়ে পরেন। মাঝে মধ্যে অনুভব করেন পিছন দিক থেকে ওনাকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করছে কিছু একটা। বারবার বলছে সোহানার মায়াবী মুখটার দিকে তাকাতে। আর উনি নিজের বিবেককে বুঝ দিতে থাকেন, ‘যে তোকে ভালোবাসে না তার প্রতি মায়া কাটাতে শিখে নে।’
বিভীষিকাময় অনুভূতি নিয়েই কখন ওনার চোখ লেগে আসে নিজেও বুঝতে পারেন না। ঘুমের অতলে হারিয়ে যান নিমিষেই।
.
.
পরদিন সকালে খাওয়া দাওয়া শেষে অফিসের জন্য তৈরি তৈরি হন আগে আগেই। সোহানা একটু দুরেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। একদম ঘর থেকে বের হওয়ার আগ মুহূর্তে ডাক দেন সোহানাকে। কোনো রূপ সূচনা ছাড়াই বলেন, ‘ বাসা ঠিক করে ফেলেছি। কালকেই চলে যাব সেখানে। কি কি নেওয়া লাগবে ঠিকঠাক করতে থাকো।”

মুহুর্তেই সোহানার মুখটা শুঁকিয়ে আসে। মাথা নিচে করে নিচুস্বরে বলে, ‘আচ্ছা’।

নাজমুল সাহেব আর কিছু না বলে হনহন করে চলে যান সিঁড়ি বেয়ে। সোহানা একদম ধপাস করে বসে পরে বিছানায়। এক ঝাঁক চিন্তা চেপে ধরে তাকে। কতটা খারাপ হতে পারে আগামীর দিনগুলো! সেই ভাবনাতেই কাটতে থাকে তার এক একটি সময়…।

( চলবে…)

. #গল্প — #আড়ালে_কে [ #পর্ব – ১৩ ]
#লেখক – #সালাহউদ্দিন_তারিক ( জুনিয়র মুগলি )

নতুন বাসাতে উঠেছে সোহানা আর নাজমুল সাহেব। দুজনেই একসাথে গুছিয়েছে পুরো ঘর। নাজমুল সাহেব অফিস থেকে ছুটি নিয়েছিলেন আজকের জন্য। সকাল বেলাতে একটা মিনি পিকআপ ভ্যানে করে একটা খাট, ফ্রিজ আর দুটা টেবিল সহ প্রয়োজনীয় সব নিয়ে এসেছেন। সারা দিন ঘর গুছানোর কাজ করে দু’জনেই ক্লান্ত। সোহানা সাধারণত চা খায় না, কিন্তু নাজমুুল সাহেবের ক্লান্তি দূর করার সাথী হচ্ছে চা। উনি যেহেতু সোহানার থেকে একটু দূরে দূরে থাকছেন তাই চা বানানোর কথা বলতে পারলেন না। মাগরিবের পরে চা নিজেকেই বানাতে হলো। দুই কাপ চা বানিয়ে নিজ হাতেই সোহানাকে এক কাপ অফার করেন। সোহানা বিনাবাক্য ব্যয়ে ওনার হাত থেকে নেন কাপটা।

নাজমুল সাহেব গরম কাপে কয়েকটা ফুঁ দিয়েই ছোট্ট ছোট্ট চুমুকে শেষ করে ফেলেন পুরো কাপ। আর সোহানা তখনও বাচ্চা মেয়ের মতো চা ঠান্ডা করায় ব্যস্ত। এ দেখে তাকে টিটকারি করতে মনে চায় নাজমুল সাহেবের। কিন্তু যেহেতু নিরব মন মালিন্য চলছে সে জন্য আর কিছু বলেন না। সোহানাও এক হাতে কাপ নিয়ে চা ঠান্ডা করে, আর অন্য হাতে মোবাইল ফোন নিয়ে ফেসবুক স্ক্রলিং করে। নাজমুল সাহেবের মনে চায় ফোনটা আছাড় মে*রে ভে*ঙে ফেলতে, কিন্তু যেখানে বনিবনা-ই নাই সেখানে এমন কিছু করা সাজে না। সামনে থেকে সোহানাকে মোবাইল টিপতে দেখা সহ্য হতে চায় না নাজমুল সাহেবের। এজন্য নিজেও একটা গল্পের বই নিয়ে ব্যালকনিতে চলে যায়। রোমান্টিক উপন্যাসে মাথা ডুবিয়ে নিজের রাগটা একটু কমাতে চান তিনি। কিন্তু এতে রাগ তো কমেই না উল্টো বেড়ে যায়। অন্যের প্রেমের গল্প পড়েন আর নিজের জীবনের প্রেম নিয়ে ভাবেন। কি অদ্ভুদ প্রেম ই না আসছে ওনার কপালে…. ।

সারাদিন কাজ করে যেহেতু দু’জনেই খুব ক্লান্ত তাই রাতের খাবার বাইরে থেকে নিয়ে আসেন নাজমুল সাহেব। যত যাই হোক, একটু ইনসাফ তো আছে ওনার মাঝে। এতো কাজের পর সোহানাকে দিয়ে আর রান্নার ঝামেলা করালেন না উনি। খাওয়া দাওয়া করে খুব তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পরলেন দু’জনেই। যথারীতি বিছানার দুপাশে দু’জন দু’দিকে ফিরে রইল।

পরদিন সকালে সোহানা একটু আগে আগেই উঠল। নাজমুল সাহেবের ঘুম ভাঙার আগে আগেই রান্না গুছিয়ে ফেলল সে। রান্নার প্রায় শেষের দিকে ঘুম থেকে উঠেন নাজমুল সাহেব। ওনার অফিসে আজ থেকে তাড়াতাড়ি যাওয়ার কথা। কিন্তু এখন যেহেতু অফিসের কাছেই বাসা সেজন্য আর তাড়াতাড়ি বের হতে হলো না। রান্না শেষ হতেই, নাস্তা শেষ করে বের হয়ে পরলেন তিনি। সারা রাস্তাতে শুধু একটা জিনিসই চিন্তা করলেন, যে এখন তো আর নাদিয়া নেই নজর রাখার মতো। বাবা – মা ও নেই। খালি ফ্ল্যাটে কত কি করবে সে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। ভাবতেই কেমন যেন কষ্ট লাগে ওনার কাছে। বুকটা ফেটে যেতে চায়। একটা সময় ভাবনা ছিল যে একা বাসায় ভালো করে শায়েস্তা করতে পারবে তাকে। কিন্তু এখন আর সেসব ভাবতেই পারেন না তিনি। সোহানার উপরে হাত তোলার কথাই ভাবতে পারেন না। কেমন যেন বুকে আঘাত করে ওনার। সোহানার মায়াবী মুখের দিকে তাকাতেই সব রাগ চলে যায়।

নানান রকম চিন্তা মাথায় নিয়ে সারাদিন অফিসের কাজ শেষে বাসায় ফিরেন তিনি। দরজায় টোকা দিতেও কেমন যেন লাগে ওনার। ভাবতে থাকেন, কেমন দেখবেন সোহানাকে! সে কি একাকী সময়টাতে ওনার কথা মনে রেখে নিজেকে সংযত রেখেছিল! না-কি সুযোগে অসৎ ব্যবহার করে পর পুরুষের কাছে উৎসর্গ করেছিল নিজেকে! পরপর তিনবার টোকা দিতেই এসে দরজা খুলে দেয় সোহানা। দরজা খুলে আর অপেক্ষা না করে সোজা আবার ভিতরের ঘরের দিকে হাঁটা দেয় সে। নাজমুল সাহেব দরজা লাগিয়ে তার পিছন পিছন ভেতরের ঘরে যায়। এক দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকেন সোহানার দিকে। সোহানার কাছে কেমন যেন লাগে ওনার চাহনি। ধারণা করে নাজমুল সাহেব গোয়েন্দা দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন তার দিকে। হয়তো-বা কিছু একটা বুঝার চেষ্টা করছেন। তার কাছে বিরক্ত লাগে এই অবিরাম দৃষ্টি। মুখের উপরে বলেই ফেলে, ‘কি হয়েছে! এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?’

সোহানার কথায় যেন হুঁশ ফিরে নাজমুল সাহেবের। আমতা আমতা করে বলে, ‘ না কিছু না। সারাদিন একদম একা একা ছিলে তুমি ভয় লাগেনি তো?’

সোহানা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে, ‘আমি তো কচি বাচ্চা নই যে এই ফ্ল্যাট বাসাতেও ভয় পাব। তাছাড়া পাশের ঘরের ভাবী এসেছিল গল্প করে গেছে অনেকক্ষন।’

নাজমুল সাহেবের মুখে মুচকি হাসি ফুটে উঠে। ঘাড় বাঁকা করে কথার সমাপ্তি ঘটিয়ে নিজের কাপড়চোপড় পাল্টে ফ্রেশ হয়ে নেন। দু’জনেই একসাথে রাতের খাবার খেতে বসেন টেবিলে। দু’জনে সামনা সামনি বসে খায়। অথচ কেউ কারো সাথে কথা বলে না। সোহানা প্লেটের পাশেই মোবাইল ফোনটা রেখে সেটার দিকে তাকিয়ে থাকে আর একটু পরপর লোকমা মুখে দেয়। রাগে নাজমুল সাহেবের পিত্তি জ্বলে। বেশিক্ষণ আর চুপ থাকতে পারেন না তিনি। গমগমে গলায় বলেন, খাবার সামনে নিয়ে মোবাইল টিপছ কেন বাচ্চাদের মতো। আরেকবার দেখলে এক আছাড়ে গুঁড়া করে ফেলব এটা। ”
হঠাৎ এমন কথায় সোহানাও ভয় পেয়ে যায়। মোবাইল দূরে রেখে চুপচাপ খাওয়ায় মনোযোগী হয় সেও।
.
.
প্রতি রাতের মতো আজকেও একই ভাবে দু’জন দু’দিকে ফিরে শোয়। নাজমুল সাহেব তাকে বেশি ঘাটাঘাটি করছে না দেখে অনেকটা স্বস্তিতে থাকে সোহানা। মনে মনে চিন্তা করে এভাবেই শুধু আর কয়টা দিন গেলেই হয়। তারপরই ফ্রুত করে একদিন চলে যাবে তার প্রিয় মানুষটির কাছে। এভাবেই একের পর এক করতে করতে দশ দিন চলে যায়। নাজমুল সাহেব সোহানার সাথে বিশেষ কোনো কথাই বলেন না। একসাথে এক ঘরে থাকতে হলে যে টুকটাক কথা হয় সেটটুকুই শুধু। তার বাইরে আর কোনো কথা হয় না তাদের। একদিন রাতে অফিস থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে ব্যলকনিতে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকেন নাজমুল সাহেব। সোহানা আগেই খেয়াল করে যে ওনার চেহারা কেমন যেন মনে হচ্ছে। সোহানার একটু ভয় ভয় লাগতে শুরু করে।
আধাঘন্টা হয়ে যায় নাজমুল সাহেব ব্যালকনিতে বসে আছেন। সোহানা ঘরে বসেই সিগারেটের বিরক্তিকর ঘ্রাণ পায়। সিগারেটের ধুঁয়া তার কাছে একটুও ভালো লাগে না। তাই টিকতে না পেরে ব্যলকনির সাথে থাকা জানালাটা বন্ধ করে দেয় সে।

রাত প্রায় ১১ টা বেজে যায়….

খিদায় সোহানার পেট চো-চো করে উঠে। কিন্তু নাজমুল সাহেবকে রেখে একা একা খেয়ে নেওয়ার সাহস হয় না ওর। আবার গিয়ে ওনাকে ডেকেও আনতে ভয় হয়। এমন দ্বিধা দ্বন্দ্বের মাঝেই নাজমুল সাহেবের ডাক শুনতে পায় সে, ‘ সোহানা একটু এদিকে আসবে?”

সোহানা কোনো কথা না বলে ব্যলকনিতে গিয়ে দাঁড়ায় ওনার পাশে। সে অনেকটা কাছেই ছিল নাজমুল সাহেবের। তাই পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই সোহানার হাত দু’টো আলতো করে ধরেন তিনি। সোহানা একবার ছাড়ানোর চেষ্টা করলে আরো শক্ত করে ধরেন। সোহানা বুঝে যায় যে ছাড়ানোর চেষ্টা করে লাভ নেই। তাই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে।

সোহানা নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা থামাতেই ওর হাতটা নিজের তালুতে নিয়ে আঙুল গুলো নিয়ে খেলতে থাকেন নাজমুল সাহেব। সোহানা রাগে দাঁত কিরকির করতে থাকে। বেশিক্ষণ এটা সহ্য করতে না পেরে বলে, “কি জন্য ডাকছেন সেটা বলেন, নয়তো আমি যাচ্ছি। ‘ কথা শেষ করেই নিজের হাত ছাড়িয়ে নিতে চায় সে। নাজমুল সাহেবও ছেড়ে দেয় তাকে। ভাঙা ভাঙা গলায় বলে, ‘অন্তত পাঁচটা মিনিট তোমার হাতটা ধরার অধিকার টুকুও কি নেই আমার?’

সোহানা কোনো উত্তর দিতে পারে না। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে সেখানেই। নাজমুল সাহেব আবারও নিস্তব্ধতা ভাঙে, ‘জানি না তুমি কেন রাজি হয়েছিলে এই বিয়েতে। কিন্তু আমি নিজের সবটুকু ইচ্ছেতে রাজি হয়েছিলাম। তোমাকে আমার কতটা ভালো লেগেছিল তা বলে বুঝাতে পারব না। এজন্য তুমি যখন বলছিলে দেনমোহর হিসেবে পুরো তিন লাখ টাকা লাগবে তখনও বহু কষ্ট করে সেটা মেনেজ করতে হয়েছিল।’

সোহানা কথার মাঝ খানে বলে উঠে, ‘এসব কথা এখন শোনাচ্ছেন কেন আমাকে, বিয়ে করার আগে জিজ্ঞেস করলেন আমাকে।’

‘ পারিবারিক ভাবে বিয়ে হয়েছে আমাদের। কথা হয়েছে তোমার পরিবারের সাথে। তুুমি রাজি না থাকলে কি আর সবাই রাজি হয়েছে? ‘

‘ আমাকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। ‘

‘ কিসের জোর! কোথায় জোর! কেউ কি তোমার মুখ থেকে টে*নে হিঁ*চড়ে কবুল শব্দটা বের করেছে?’

‘ আমি বাধ্য ছিলাম তাই বলেছি। ‘

‘ হা হা, বাধ্য ছিলে! তা তুমি রাজি না জোর করে বিয়ে দিচ্ছে। তো আবার নিজের ইচ্ছেতে তিন লাখ টাকা দাবি করলে কেন কাবিনের জন্য? ‘

‘ বেশি টাকা চাইলে ভাবছিলাম বিয়ে ভেঙে দিবেন। এজন্য চাইছি।’

আবারও হাসেন নাজমুল সাহেব, ‘ হো হো, মোটেই না। তোমার বরং চিন্তা ছিল যে, ৩ লাখ টাকা কাবিনের নামে নিয়ে নেই। পরে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে তো এই বড় অংকের টাকাটা আমার লাভের খাতায় থাকবেই। সেটা দিয়ে প্রেমিকের সাথে সুখের সংসার করা যাবে’

ছিহ্ ছিহ্ করে সোহানা। রাগে গজগজ করতে করতে বলে, ‘ জীবনেও না। এমন ইচ্ছে ছিল না আমার। ”

‘ আচ্ছা ভালো কথা। কি করেছ ঐ টাকা দিয়ে?’

‘ কিছুই করিনি বাবার ব্যাংক একাউন্টে পরে আছে সেটা।”

নাজমুল সাহেব একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আবারও সোহানার হাতটা ধরে। সোহানা ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই আরো জোরে ধরে নিজের কাছে টেনে নেয় তাকে। তারপর বলে, ‘একটু স্থির হয়ে দাঁড়াও কিছু কথা বলব। যে কথাগুলো বলার জন্য ডেকেছি তোমাকে”।

সোহানা অনিচ্ছা স্বত্বেও চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। বিরক্তির রেখা ফুটে উঠে তার কপালে।
নাজমুল সাহেব একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করে, ‘ দেখো সোহানা, জীবনের অর্ধেকটা সময় চলে গেছে পরিবারের দ্বায়িত্ব কাঁধে নিতে নিতে। সংসার চালিয়ে খুব আহামরি টাকা আর আমার হাতে থাকত না। বাবা মায়ের ঔষধের পিছনেও একটা বিশাল এমাউন্ট খরচ করতে হয় নিয়মিত। এর মাঝে অনেক কষ্ট করে কিছু টাকা জমিয়েছিলাম। মা এতোদিনে তাগাদা দিল বিয়ে করার জন্য। জীবনের সবটুকু সঞ্চয় দিয়ে বউ করে আনি তোমাকে। ভেবেছিলাম জীবনের অর্ধেক তো চলে গেছে টাকা আর সংসারের পিছনে দৌড়েই। এবার একজন এসেছে যে কিনা আমাকে সময় দিবে। নিজের প্রশান্তি পাওয়ার মতো একটা জায়গা হয়েছে। কিন্তু সে ভাবনা আর সত্যি হলো না। মনে মনে যাকে আমি নিজের চাইতেও বেশি ভালোবাসব ঠিক করে রেখেছিললাম সে আমাকে এক ফোঁটাও ভালোবাসে না।’ এক নিঃশ্বাসে সবটুকু কথা শেষ করে থামেন নাজমুল সাহেব।

সোহানা চুপ করে সব শুনছিল। একবার তার খারাপ লাগে নিজের উপরে আবার পরক্ষনেই এসব বিরক্তিকর লাগে। সোহানা কিছু বলছে না দেখে নাজমুল সাহেবই আবার বলতে শুরু করে, ‘ তোমার জন্মদিনের দিন আমি হয়তো অনেক খারাপ কিছু করেছিলাম। তার জন্য কিন্তু ক্ষমা চেয়েছিলাম। আমি সারা রাত অপেক্ষা করেছিলাম, ভেবেছিলাম যে তুমি হয়তোবা আমার কাছে আসবে। কিন্তু এলে না। সকালে আমার এতো খারাপ লাগছিল, মনে চাইছিল সব কিছু ভেঙে ফেলি। ইচ্ছে করছিল কসম ফেলি জীবনেও আর তোমাকে স্পর্শ করব না, একবারও না। আমি জানতাম যে আমি তোমাকে স্পর্শ না করে থাকতে পারব না। তোমার হাত না ধরে থাকতে পারব না। এজন্য কসম করার সাহস হয়নি। তবে আজকেও একটা বিশেষ কারণে আমার খুব খারাপ লাগছে। যেটা তোমাকে বলতে চাইছি না আমি। তোমাকে কয়টা কয়টা প্রশ্ন করার জন্য ডেকেছি এখানে। তুমি কি সেগুলার উত্তর দিবে?’

নাজমুল সাহেবের হাজারটা কথার বিনিময়ে সোহানা কেবল ছোট্ট করে বলে, “হুম বলুন।’

ভেবে চিন্তে উত্তর দিবে, ‘বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত এমন কি একবারও হয়েছে যে তোমার ঐ সময়টাতে আমাকে ভালো লাগছে?’

সোহানার সোজাসাপটা উত্তর, ‘ মনে হয় না। ‘

নাজমুল সাহেব আবারও প্রশ্ন করেন, ‘আমি যে কয়বার তোমার হাত ধরেছি বা জড়িয়ে ধরেছি একবারও কি তোমার কাছে ভালো লাগছে? না শুধুই বিরক্ত লাগছে। ‘

সোহানা রেগেমেগে উত্তর দেয়, ‘কত বার বলব যে আমার এসব ভালো লাগে না। তারপরও কেন করেন এমন? এখন আবার জিজ্ঞেস করছেন।’

কথাগুলো নাজমুল সাহেবের বুকে হাতুড়ির মতো আ*ঘাত করে। সাথে সাথে সোহানার হাতটা ছেঁড়ে দেন তিনি।
ভাঙা ভাঙা গলায় বলেন, ‘ শেষ একটা কথা জিজ্ঞেস করছি, অতীতের সব কিছু ক্ষমা করে দিয়ে যদি তোমাকে আমার কাছে রাখতে চাই তুমি কি আমার পাশে থাকবে?’

সোহানার সোজাসাপটা উত্তর, ‘ আপনাকে আমার মোটেও পছন্দ নয়। বাধ্য হয়ে এক ছাঁদের নিচে আছি কেবল। সারা জীবন থাকা সম্ভব নয়।’

নাজমুল সাহেব চেয়ার ছেঁড়ে উঠে দাঁড়ান। ওনার চোখ পানিতে জ্বল জ্বল করতে থাকে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে ওনার। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন, ‘ জীবনের সবটুকু আয় খরচ করেছিলাম তোকে বিয়ে করে আনার জন্য শুধু। এখন আমার আয়ের খাতাও শূন্য, আর তুই ও আমাকে শূন্য করে দিয়ে চলে যেতে চাইছিস তাই না? ‘

সোহানা চুপ করে থাকে, কোনো কথা বের হয় না তার মুখ দিয়ে। এবার রাগ উঠে যায় ওনার, রাগে মাথায় রক্ত উঠে যায়। এক থা*বা দিয়ে সোহানার গলা টি*পে ধরেন তিনি। তারপর ঠেলে দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে উপরের দিকে তোলার চেষ্টা করেন। সোহানা তার ছোট্ট শরীরটা সা*পের মতো মোঁচড়াতে শুরু করে আর হাত পা ছুঁড়তে থাকে। নাজমুল সাহেব তার বাম হাত দিয়ে সোহানার হাত দু’টো ধরে ফেলে। তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে ভয়ানক গলায় বলেন, ‘ মা*গ* তোকে বলেছিলাম না! আমাকে ছেড়ে যেতে চাইলে খুন করে ফেলব তোকে’?

সোহানার চোখ দু’টো বড় বড় হয়ে যায়। জিহ্বা বেরিয়ে আসে অক্সিজেন শূন্যতায়। মস্তিষ্কে একটা চিন্তাই ঘুরতে থাকে তার, ‘আজকেই কি আমার জীবনের শেষ দিন……’

( চলবে ইন শা আল্লাহ )