আড়ালে কে পর্ব-১৪+১৫

0
300

. #গল্প – #আড়ালে_কে [ পর্ব – ১৪ ]
#লেখক – #সালাহউদ্দিন_তারিক

প্রচন্ড রাগে নাজমুল সাহেব এক থা*বা দিয়ে সোহানার গলা টি*পে ধরেন। তারপর ঠেলে দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে উপরের দিকে তোলার চেষ্টা করেন। সোহানা তার ছোট্ট শরীরটা সা*পের মতো মোঁচড়াতে শুরু করে আর হাত পা ছুঁড়তে থাকে। নাজমুল সাহেব তার বাম হাত দিয়ে সোহানার হাত দু’টো ধরে ফেলে। তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে ভয়ানক গলায় বলেন, ‘ মা*গ* তোকে বলেছিলাম না! আমাকে ছেড়ে যেতে চাইলে খুন করে ফেলব তোকে’?

সোহানার আর কিছুই বলার সুযোগ হয় না, সুযোগ হয় না ছাড়া পাওয়ার। সে পাগলের মতো চেষ্টা করতে থাকে, কিন্তু নাজমুল সাহেব একটুও মায়া দেখান না। তবে প্রাণ পাখি বের হাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে সোহানার গলা ছেড়ে দেন তিনি। সাথে সাথেই নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মাটিতে পড়ে যায় সোহানা। তখন নাজমুল সাহেব উদভ্রান্তের মতো হাসতে থাকে তার মাথার পাশে দাঁড়িয়ে। সোহানা কাঁপতে কাঁপতে নাজমুল সাহেবের পা ধরে। তারপর আস্তে আস্তে সোজা হয়ে দাঁড়ায় নাজমুল সাহেবের হাতে ধরে। অতঃপর কাঁপা কাঁপা কন্ঠে কোনো রকমে বলে, ‘ ছাড়লেন কেন! একবারেই মেরে ফেলতেন আমাকে! ‘

নাজমুল সাহেব আমতা আমতা করে বলে, ‘ভালোবাসি তোমাকে তাই মারতে পারলাম না। ‘

সোহানা তার শাহাদাত আঙুলটা ঠোঁটে ছোঁয়ায়, ‘ চুপ একদম মিথ্যা কথা বলবেন না। আপনি কখনোই আমাকে ভালোবাসেননি। বরং ৩ লক্ষ টাকা সম্পূর্ণ লস হয়ে যাচ্ছে বলেই ভালোবাসার অভিনয় করছেন। আপনার মুখের ভাষাই বলে দেয় আপনি কতটা বাজে মানুষ। ‘

কথা গুলো নাজমুল সাহেবের চিন্তা শক্তিকে জাগ্রত করে। সোহানার সামনে হাত জোর করে বলে, ‘ক্ষমা করে দাও আমাকে। আর কখনো এমন হবে না। আর কখনো এমন হবে না। ‘

সোহানা ওনাকে ধাক্কা দিয়ে চলে যেতে চায়। কিন্তু নাজমুল সাহেব তার পথ আগলে দাঁড়িয়ে পড়েন। নানান ভাবে বলতে থাকেন ক্ষমা করার জন্য। সোহানা কোনো কথা না বলে শুধু সেখান থেকে চলে যেতে চায়। নাজমুল সাহেব সোহানাকে তার ভালোবাসা বুঝানোর জন্য ডান হাতে প্রচন্ড জোরে একটা ঘু*সি মারেন ব্যলকনির দরজাতে। সোহানাকে বুঝানোর চেষ্টা করেন যে, ‘এই দেখ তোমাকে যে হাত দিয়ে আঘাত করছি সে হাতে নিজেই আঘাত করছি। কিন্তু এসব আর সোহানার মন গলাতে পারে না। নাজমুল সাহেবকে ধাক্কা দিয়ে একপাশে সরিয়ে ঘরে ঢুকে সে। তারপর ঝটপট হাত মুখ ধুঁয়ে খেতে বসে পরে। নাজমুল সাহেব তখনও ব্যলকনিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চিন্তা করেন যে এখন কি হবে। এখন যদি সত্যি সত্যিই ওনাকে ছেড়ে চলে যায় সোহানা!

ব্যালকনিতে বসে এমন নানান চিন্তা করতে থাকেন তিনি। ততক্ষণে সোহানা একা একা খেয়ে শুয়ে পরে। বাধ্য হয়ে এবার নিজের খাবার নিজেরই নিয়ে খেতে হয় নাজমুল সাহেবের। উনি খাওয়া শেষ করে যতক্ষণে বিছানার যান ততক্ষণে সোহানার প্রায় চোখ লেগে আসে। কিন্তু পিঠে স্পর্শ পেয়ে এক প্রকার লাফিয়ে উঠে সে। পিছন ফিরে জিজ্ঞেস করে, ‘ কি নির্লজ্যের মতো কাজ কর্ম! কি করে আবার টাচ করেন আমাকে! ”

নাজমুল সাহেব নিজের হাত গুটিয়ে নেন। অনুনয় করে বলার চেষ্টা করেন, ‘ স্যরি সোহানা আমার ভুল হয়ে গেছে আমাকে ক্ষমা করে দাও! ”

সোহানার রাগ বেড়ে যায়, ‘ আবার কোন মুখে এসব বলেন আপনি! আমি আপনার কোনো কথা শুনতে চাইছি না।। ”

নাজমুল সাহেব নিজের কানের লতি স্পর্শ করেন। শেষ বারের মতো বলেন, ‘ এই দেখ কানে ধরেছি এবার তো ক্ষমা করবে! ‘

এসব কিছুই সোহানার রাগ কমাতে পারে না। আর কোনো কথা না বাড়িয়ে আবারও উল্টো পাশ ফিরে শুয়ে পরে সে। নাজমুল সাহেবও ব্যর্থ হয়ে শুয়ে থাকেন বিছানার অন্যূ পাশে।
.
.
সকালে নানান জিনিস পত্র নাড়াচাড়ার শব্দ পেয়ে ঘুম ভাঙে নাজমুল সাহেবের। চোখ খুলতেই দেখেন সোহানা তার বড় ব্যাগটা গুছাচ্ছে আর ঘরের নানান জিনিস পত্র নাড়াচাড়া করছে। প্রথমে ভালো মতো সব কিছু মাথায় না ঢুকলেও বুঝতে পারার সাথে সাথেই লাফিয়ে উঠেন তিনি। সোহানাকে জিজ্ঞেস করেনন, কি হয়েছে?”

সোহানা কোনো উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করে না। সে তার মতো ব্যাগ গুছানোতে ব্যস্ত থাকে। নাজমুল সাহেব তাকে নানান ভাবে বুঝানোর চেষ্টা করতে থাকে। সোহানা যেখানে যাচ্ছে, তিনিও তার পিছুপিছু সেখানেই যান। বারবার সোহানাকে বুঝানোর চেষ্টা করেন যে, ” তুমি চলে গেলে আমার কি হবে সোহানা! আমার ভুল হয়ে গেছে ক্ষমা করে দাও। ”

সোহানা সেসব কথাকে কোনো প্রকার পাত্তা না দিয়েই নিজের সব জিনিসপত্র গুছিয়ে নেয়। তারপর ফ্রেশ হয়ে সকালের খাবারের আগেই হনহন করে বাসা থেকে বেরিয়ে পরে। নাজমুল সাহেব হাজারো চেষ্টা করেও আর তাকে আটকাতে পারেন না। ব্যর্থ হয়ে ফ্লোরে বসে থাকেন তিনি, চিন্তা করতে থাকেন নিজের ভুলগুলো নিয়ে। নিজের করা জ*ন্তু সুলভ আচরণ আর মুখের জঘন্য নোংরা গা*লি গুলো বারবার ওনার কানে বাজতে থাকে। তবে বেশিক্ষণ আর এসব ভাবতে পারেন না তিনি। মোবাইল ফোনের এলার্ম ওনাকে স্মরণ করিয়ে দেয় অফিসে যাওয়ার কথা। মাথা থেকে সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে অফিসে যাওয়ার কথা ভাবতে হয় ওনাকে। ঘরে কোনো কিছু রান্না করা নেই বলে ফ্রেশ হয়ে অফিসের জন্য তৈরি হয়ে বাইরে চলে যান। ছোট একটা রেস্তোরাঁ থেকে অল্প কিছু খেয়ে একটা সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে যেতে থাকেন অফিসের উদ্দেশ্যে।

দুপুরের খাওয়ার জন্য বিরতি পেতেই সোহানার ফোনে কল দেন নাজমুল সাহেব। ওপাশ থেকে ওনার নাম্বার ব্লক করে রাখায় কল আর পৌঁছায় না। দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে সারাটা দিন অতিবাহিত করেন তিনি। রাতে বাড়ি ফেরার সময়েও বাইরে হোটেলেই খেতে হয় ওনার। সোহানাকে ছাড়া বিভীষিকাময় প্রথম দিনটি এভাবেই কেটে যায় ওনার। রাতে অনেক চেষ্টা করেন একটা উপন্যাসের বই পড়ে নিজের চিন্তাকে অন্যদিকে নিয়ে যাওয়ার। কিন্তু নিজের জীবনটাই যেখানে উপন্যাসের চাইতে নাটকীয় সেখানে উপন্যাসের পাতায় মন বসে না ওনার। সারা রাত সোহানার বিষয়ে চিন্তা করতে করতে গভীর রাতের দিকে চোখ লাগে ওনার।
.
.
অপরদিকে সোহানা একদম নিজের সব জিনিসপত্র গুছিয়ে বাড়িতে চলে যাওয়ায় বাড়ির লোকেরা তাকে নানান রকম প্রশ্ন করতে থাকে। সোহানা এসবের কোনো রকম তোয়াক্কা করে না। চুপচাপ নিজের সেই পুরোনো আলাদা ঘরের দরজাটা লাগিয়ে ভিতরে একা একা বসে থাকে। খাওয়ার সময হলে খাওয়া দাওয়া শেষ করেই আবার ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিচ্ছে সে। তার পরিবার চিন্তায় পরে যায় যে কি হয়েছে ওর। সারাদিন সোহানার কার্যকলাপ দেখে অতিষ্ঠ হয়ে যায় সোহানার মা। রাতে চিন্তা করেন নাজমুল সাহেবকে কল করবেন। পরে আবার কি যেন ভেবে কল দেওয়া থেকে বিরত থাকেন।

পরদিন সকালে আগে আগে ঘুম থেকে উঠেন নাজমুল সাহেব। বাইরের খাবার কি আর প্রতিদিন খাওয়া যায়! তাই সকাল সকাল অল্প কিছু রান্না করে নেন তিনি। তারপর খাওয়া দাওয়া শেষে আগে ভাগেই অফিসে রওনা হয়ে যান তিনি। অফিসের কাজের মাঝখানে ফোন বেজে ওঠে ওনার। সেভ করা নাম্বারটা দেখে চিনতে অসুবিধা হয় না একটুও। সোহানার মা কল দিয়েছে দেখে নিজের ডেস্ক ছেড়ে বাইরে গিয়ে রিসিভ করেন।

কল রিসিভ করে সাথে সাথেই সালাম দেন তিনি, ” আসসালামু আলাইকুম আম্মা।”

ওপাশ থেকে সোহানার মায়ের গলার আওয়াজ পাওয়া যায়, ‘ ওয়ালাইকুমুস সালাম। কি খবর, তোমাদের কি হয়েছে? ”

একদম সরাসরি প্রশ্নে একটু অপ্রস্তুত হয়ে যান নাজমুল সাহেব। কি বলা যায় ভেবে নিয়ে বলেন, ” কি হয়েছে সেসব বলতে গেলে অনেক কথাই বলা যায় আম্মা। তবে একটা কথাই বলব বিয়ে দেওয়ার আগে আপনাদের মেয়ের মতামত যাচাই করা উচিত ছিল। ”

সোহানার মা স্তব্ধ হয়ে যায় এক কথাতেই। ওনারা যেভাবে জোর করে বিয়ে দিয়েছিল তাকে সে কারণেই যে এমন হয়েছে তার আর বুঝতে অসুবিধা হয় না ওনার। তবুও আরেকটু নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করেন তিনি, ” বাবা এসব কি বলছ এতোদিন পর এসে? ”

নাজমুল সাহেব কোনো ভনিতা না করে সোজাসাপটা উত্তর দেন, ” আম্মা সব কথা তো আর আপনারা সাথে খুলে বলা যায় না। শুধু এটুকুই জেনে রাখুন যে, এখন পর্যন্ত আমাকে পছন্দ হয়নি সোহানার। সরকারি কাগজে সিগনেচার ছাড়া আর কিছুই আমাদের মাঝে নাই। আশাকরি আর বেশি কিছু বলতে হবে না।”

সোহানার মায়ের আর বুঝতে অসুবিধা হয় না যে তাদের জামাই ইঙ্গিতে কি বুঝাতে চেয়েছে। এজন্য কি বলবে তা আর মাথায় আসে না ওনার। কতক্ষণ চুপচাপ থাকেন দেখে নাজমুল সাহেবই আবার বলেন, ” আমি অফিসে আছি এখন রাখছি।”

সোহানার মায়ের আর বেশি কিছু বলার মুখ থাকে না। তাই কোনো কথা না বাড়িয়ে কল কেটে দেন তিনি। তারপর রাগে চিল্লাচিল্লি করতে করতে ছুটে যান সোহানার ঘরের দিকে, ” এতো ভালা জায়গাতে বিয়া দিছি এইটা ওনার ভাল্লাগে না! কি ভাল্লাগে তোর শুনি!”

ঘরের বাইরে থেকে জোরে জোরে চিৎকার করে এসব বলতে থাকেন সোহানার মা। কিন্তু ভিতর থেকে কোনো উত্তর না আসাতে অকথ্য নোংরা ভাষায় নানান ধরনের গা*লি দিতে থাকেন তিনি। ওনার গালা*গালি শুনে আসে পাশের লোকজনও ছুটে আসেন ঝগড়া দেখার জন্য। সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ না করেই নানান কথা বলে চিল্লাতে থাকেন সোহানার মা। এসব শুনে আশেপাশের মহিলারাও কানাঘুষা করতে শুরু করে “এতো ভালা যাগাত বিয়া দিছে আর এইডাও নাকি পছন্দ না। মনে হয় তলেতলে কোনো দিকে লাইন করে। ”

একজনের কথা শেষ না হতেই আরেকজন বলতে থাকে, ” আছেই মনে হয় নাইলে কি এমন হয়! বিয়াতে পহেলা পহেলা রাজি হয় নাই। পরে ৩ লাখ টাকা কাবিন পাইয়া বিয়া করছে। সব টাকার লাইগা করছে আর এখন আইসা পরছে। ”

মহিলা কয়েকজন একসাথে হলে দুনিয়ায় কোনো কথাই আর বাকি থাকে না। তেমনি ভাবে সোহানার ব্যাপারেও তারা দুনিয়ায় কোনো কথা বাকি রাখছে না। যার যা মাথায় আসছে সব কিছু বলে ফেলছে এক মজলিসেই। কেউ কেউ তো গোয়েন্দাদের মতো চরম গোপনীয় কথাও তুলে ধরছেন….।
.
.
নাজমুল সাহেব অফিস থেকে বাড়িতে ফিরতে ফিরতে রাত ১০ টা বেজে যায় আজকে। তার কারণ, বাইরে রাস্তায় হেঁটে হেঁটে অনেকক্ষণ সিগারেটের ধুঁয়া উড়িয়েছেন তিনি। যতক্ষণ না পেটের খিদার কথা মনে হয়েছে ঠিক ততক্ষণই পায়চারি করেছেন রাজপথে। তারপর বাড়িতে এসে সবে মাত্র ভাত রান্না শুরু করেছন। এর মধ্যেও সিগারেটের কথা মনে পড়ে ওনার। রান্নার ফাঁকেই একটা সিগারেট ধরিয়ে ব্যলকনিতে দাঁড়িয়ে ফুঁকতে থাকেন সেটা। আকাশের দিকে তাকিয়ে বারবার নানান ধরনের রিং বানানোর চেষ্টা করেন সিগারেটের ধুঁয়া থেকে। প্রায় ধ্যানে মগ্ন হয়ে সিগারেট ফুঁকছিলেন তিনি। হঠাৎই মোবাইল বেজে উঠায় ধ্যান ভাঙে ওনার। একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে এসেছে কলটি। কল রিসিভ করে লাউডস্পিকার দিয়ে “হ্যালো ” বললেন নাজমুল সাহেব।

ওপাশ থেকে নানান যন্ত্রাংশের আওয়াজের সাথে সাথে একটা গমগমে গলার শব্দ পাওয়া যায়। সে লোক কোনো প্রকার ভূমিকা ছাড়াই বলেন, ” তোর বউ এখন আমার কাছে। যদি তাকে ফেরত পেতে চাস তবে দশ লাখ টাকা ম্যানেজ কর তাড়াতাড়ি।”

নাজমুল সাহেব হো হো করে হাসেন কতক্ষণ। তারপর বলেন, “দেখ আমি গরিব মানুষ, আমার সাথে এসব মজা করিস না।”

রাগে গজগজ করে ওপাশের লোকটি। একটা জঘন্য গা*লি দিয়ে বলে, “তোর কাছে কি আমার কথা মজা মনে হয়? নে তোর বউয়ের সাথে কথা বল।”

কথাটা শেষ করতেই প্রায় পাঁচ সেকেন্ড আর কোনো কথা শুনতে পান না নাজমুল সাহেব। তার পরপরই একটা মেয়েলি কন্ঠ শুনতে পান তিনি। ওপাশ থেকে ভয়ার্ত গলায় একটা মেয়ে “হ্যালো ” বলে। তারপর আর কোনো কথা শুনতে পান না তিনি।

ফোনের ওপাশ থেকে আসা কন্ঠটা চিনতে এক মুহূর্তও দেরি হয় না ওনার। বুকে একটা গভীর চাপ অনুভব করেন তিনি। মুখ থেকে অস্ফুট শব্দে একটা শব্দই বেরিয়ে আসে, “আমার সোহানা!”

(চলবে ইন শা আল্লাহ )

. #গল্প – #আড়ালে_কে [ #পর্ব – ১৫ ]
#লেখক – #সালাহউদ্দিন_তারিক ( জুনিয়র মুগলি )

ফোনের ওপাশ থেকে আসা কন্ঠটা চিনতে এক মুহূর্তও দেরি হয় না নাজমুল সাহেবের। বুকে একটা গভীর চাপ অনুভব করেন তিনি। মুখ থেকে অস্ফুট শব্দে একটা শব্দই বেরিয়ে আসে, “আমার সোহানা!”

এসবের মানে যেন কিছুই বুঝতে পারেন না তিনি। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলেন, ‘হ্যালো কে আপনি? কে বলছেন? ”

ওপাশ থেকে পৈশাচিক হাসির শব্দ পাওয়া যায় কিছুক্ষন। তারপর বলে, ” এবার বিশ্বাস হলো তো, মিস্টার নাজমুল ইসলাম সাহেব।”

নাজমুল সাহেবও রাগে গজগজ করতে করতে বলেন, ” কে তুই? কি হচ্ছে এসব!”

‘ আমার পরিচয় জানতে চেয়ে লাভ নাই নাজমুল সাহেব। আপনি বরং টাকার ব্যবস্থা করুন। আমাকে ধরার চেষ্টা করে লাভ হবে না আর এই নাম্বারটা থেকেও কোনো তথ্য পাবেন না। এটা আজকেই ছিনতাই করা হয়েছে এবং একটু পরেই ফেলে দেওয়া হবে। ”

” তোর সমস্যা কি সেটা বল আগে।”

” আহ্ নাজমুল সাহেব, আপনি কি অশিক্ষিতদের মতো তুইতোকারি করতে শুরু করলেন। আপনার ঘরের বউ আমার হাতে, নিজের সম্মান বাঁচানোর চিন্তা করুন। তাড়াতাড়ি টাকার ব্যবস্থা করুন।”

” আমার কাছে এখন ১ লাখ টাকাও নেই, আর আপনি দশ চাইছেন। এসব বলে কোনো লাভ নেই। ”

” আচ্ছা! দেখি কি করা যায় তবে। নিন আরেকটু কথা বলে দেখুন সুন্দরী ফুলবানুর সাথে।” কথাটা বলেই মোবাইলটা সোহানার কাছে দেয় লোকটি।

সোহানা কাঁদতে কাঁদতে বলে, “হ্যালো! এসব কি হচ্ছে আমি কিছু বুঝতে পারছি না। তাড়াতাড়ি আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করুন প্লিজ।’ কথা শেষ করতেই কান্নায় ভেঙে পরে সোহানা।

নাজমুল সাহেব বলেছেন একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে বলেন ‘ এতো দেমাগ দেখিয়ে যার জন্য চলে গেলা তাকে কল দেও এবারে। আমি তো তোমার কেউ না আমি কেন এসব ঝামেলা পোহাতে যাব!”

সোহানার মুখ থেকে কোনো কথা বের হয় না। অঝোরে কাঁদতে শুরু করে সে। এই কান্না এখন আর নাজমুল সাহেবের কাছে কিছুই মনে হয় না। এই কান্না উনি বহুবার করেছেন কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।
সোহানা কোনো কথা বলছে না দেখে ওপাশের লোকটি মোবাইল ছিনিয়ে নেয়। হাসতে হাসতে বলে, “এবার আশাকরি নাজমুল সাহেবের হাতে পর্যাপ্ত টাকা থাকবে আমাকে দেওয়ার মতো!”

নাজমুল সাহেব কিছুক্ষন চিন্তা করে বলেন, ‘দেখেন আমার কাছে আসলেই টাকা নেই। আর থাকলেই বা কেন আপনাকে দিব সেটা? আর সবচেয়ে বড় কথা হলো কালকে অবদি ও আমার স্ত্রী ছিল। কিন্তু আমাদের বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। শুধু মাত্র কাগজ পত্রে সাইন করা বাকি। সুতরাং আমার সাথে কথা বলে এখন আর লাভ নেই। ”

ওপাশ থেকে কয়েকটা অকথ্য গালি ভেসে আসে। তার পরপরই কল কেটে যায়। কলটা কাটতেই নাজমুল সাহেবও তড়িঘড়ি করে কল করেন সোহাহার বাবার ফোনে। কল রিসিভ হতেই কোনো ভূমিকা ছাড়া জিজ্ঞেস করেন, ” আব্বা! সোহানা কোথায়? ”

এমন আকষ্মিক কথায় হতভম্ব হয়ে যান সোহানার বাবা। এমনিতেই তারা বিকালের পর থেকে সোহানার খোঁজ পাচ্ছেন না। এরমধ্যে যখন নাজমুল সাহেব কল করেই সাথে সাথে এই কথা বলেন তখন সম্পূর্ণ অবাক হয়ে যান সোহানার বাবা। পাল্টা জিজ্ঞেস করেন করেন, ” তুমি হঠাৎ কল দিয়েই যে সোহানার কথা বলতেছ, কি হয়েছে? ‘

” না মানে এখন আমার কাছে অপরিচিত নাম্বার থেকে একটা কল এসেছে আর কসব উল্টা পাল্টা বলতেছে। ”

” উল্টা পাল্টা বলতে! কি হয়েছে বলো।”

নাজমুল সাহেব বিরতি দিয়ে লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে ওনাকে পুরো ঘটনাটা বলেন। সোহানার বাবা ভয়ে চিৎকার করে উঠে, ” এসব কি বলছ তুমি! ”

নাজমুল সাহেব কি বলবেন বুঝে উঠতে পারেন না। কিন্তু কিছু তো বলতেই হবে! এজন্য একে একে সব খোঁজ নেন তিনি। সোহানা কখন কি জন্য ঘর বেরিয়েছিল। কার সাথে গিয়েছিল সব কিছুর খোঁজ নেব নাজমুল সাহেব। তারপর সোহানার বাবাকে স্বান্তনা দেন তিনি, ” আপনি চিন্তা করবেন না আব্বা। আর আম্মাকেও চিন্তা করতে না করেন। আমি দেখতেছি কি করা যায়। ”

সোহানার বাবা কাঁদকাঁদ গলায় বলেন “তাড়াতাড়ি দেখ বাবা, সোহানার মা শুনলে তো পুরা বাড়ি মাথায় তুলে ফেলবে ।”

” ওনাকে চিন্তা করতে না করিয়েন, আমি দেখতেছি কি করা যায়। এখন রাখছি । ”

তারপর কল কেটে তাড়াতাড়ি রান্না শেষ করে খেয়ে নেন তিনি। পরনের কাপড় পাল্টে গিয়ে বাড়ি ওয়ালার ঘরের দরজায় টোকা দেন। বাড়ি ওয়ালা দরজা খুলতেই তাকে বুঝান যে তার একটু বিশেষ দরকারে এখুনি নিজ এলাকার থানাতে যেতে হবে তাই দয়া করে যেন দরজা খুলে দেয়। রাত সাড়ে এগারোটার পরেই গেইট খোলার নিষিদ্ধজ্ঞা আছে। তাই বাড়িওয়ালাকে অনুরোধ করে মূল দরজা খোলাতে হয় নাজমুল সাহেবকে। তারপর দের ঘন্টা জার্নি শেষে থানায় গিয়ে পৌঁছাতে পারেন। মধ্য বয়সী এস আই আজিজুল ইসলাম সাবেব সে সময় ডিউটি অফিসারের দ্বায়িত্ব পালন করছিলেন। ওনার সামনে একে একে সব কিছু খুুলে বলেন নাজমুল সাহেব। একটা মিসিং ডায়েরি ও অজ্ঞাতনামা অপহরণের মামলাও করেন তিনি। পুলিশ থেকে ওনাকে সম্পূর্ণ আশ্বাস দেওয়া হয় সোহানাকে উদ্ধার করার ব্যপারে। তাৎক্ষণিক ভাবে ফোন নাম্বার ও মোবাইলের লোকেশন ট্রেক করা শুরু করে পুলিশ। আর নাজমুল সাহেবকে জানিয়ে দেওয়া হয় যে উনি এখন চাইলে বাড়িতে চলে যেতে পারেন। আগামীতে যদি কোনো নাম্বার থেকে কল করা হয় তবে যেন সাথে সাথে ওনাদের জানান এবং লম্বা সময় ধরে কথা চালিয়ে যান।

নাজমুল সাহেব ওনাদের থেকে সব কাজ বুঝে নিয়ে নিজের বাড়িতে চলে যান। এতো রাতে আর নিজের ভাড়া বাসাতে যাওয়ার কথা ভাবেন না। তারচেয়ে বরং কাছেই নিজেদের ফ্ল্যাটে যাওয়ার কথা ভাবেন। কতদিন পর বাড়িতে মা বাবার কাছে যাবেন, ছোট বোনের কাছে যাবেন। তাই কিছু কিনবেন ঠিক করলেন। কিন্তু ততক্ষণে রাত প্রায় আড়াইটা বাজে। মেইন রাস্তার আশেপাশের ১-২ টা চায়ের দোকান ব্যতীত আর কিছুই খোলা পেলেন না। শেষমেশ এক কাপ দুধ চা খেয়ে নিজের চোখের ঘুম তাড়িয়ে বাড়ির দিকে রওনা করলেন।

রাস্তায় গাড়ি নেই বললেই চলে, কিন্তু কপাল গুণে ২-১ টার দেখা পেলেন তিনি। যে গাড়িটা সবচেয়ে সেফ মনে হলো সেটাতেই উঠলেন। কিন্তু শেষে বাড়ির কাছাকাছি এসে আর সিএনজির দেখা পেলেন না। বাধ্য হয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। যদিও সবে মাত্র শীত পড়তে শুরু হয়েছে কিন্তু শেষ রাত বলে ঘন কুয়াশার সাথে পাল্লা দিয়ে শীতও বেড়েছে। তাতে কি! বাড়ি তো যেতেই হবে। এজন্য হাত বুকে চেপে কাঁপতে কাঁপতে হাঁটতে লাগলেন তিনি। প্রায় ৩০ মিনিট হাঁটা শেষে অবশেষে বাড়িতে পৌঁছাতে পারলেন। থানায় থাকতেই বাড়িতে কল করে রেখেছিলেন নাজমুল সাহেব তাই নাদিয়া সজাগ হয়ে বসেছিল ভাইয়ের জন্য। বাড়ির নিচতলার মূল গেইট খোলার জন্য অবশ্য কেয়ারটেকারকে ১০ মিনিট ধরে চিল্লাতে চিল্লাতে ডাকতে হয়েছিল ওনার।

অবশেষে কেয়ার টেকার দরজা খুলে দিলে কোনো কথা না বলেই সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে পরেন। সিঁড়িতে ভাইয়ের পায়ের শব্দ পেতেই আগে আগে এসে ফ্ল্যাটের দরজা খুলে দেয় নাদিয়া। অনেকদিন পর ছোটো বোনকে দেখেই তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে ভুলেন না নাজমুল সাহেব। তারপর ক্লান্ত গলায় বলেন, “স্যরিরে তোর জন্য কিছু আনতে পারিনি। আবার এতোক্ষণ সজাগ রেখে দিছি। ”

নাদিয়া কপাল কুঁচকে বলে, ” এতোক্ষণ ঘুমাইনি তো কি হয়েছে! কত্তদিন পর তোমাকে দেখছি সেটাই অনেক কিছু। আর তুমি শীতে যেভাবে কাঁপতেছ চা বানিয়ে দিব?”

” ধুর পাগলি মাইয়া এতো রাতে চা বানাতে হবে না। চা খেলে আর ঘুম হবে না। আব্বা আম্মা কখন ঘুমিয়েছে?”

” আম্মু তো টেনশন করতাছিল যে কি হয়েছে হঠাৎ এতো রাতে আসতাছ রাস্তায় কি না কি হয়। পরে প্রেশারের ঔষধ খাওয়ায় দিতেই ঘুমিয়ে গেছে। ”

” আচ্ছা বেশ ভালো করেছিস। যা এবার ঘুমিয়ে পর সকালে কথা বলব। ”

নাদিয়া ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালে নাজমুল সাহেব আবারও তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বিদায় জানান তাকে। বিছানায় শুয়ে কতক্ষণ চিন্তা করেন, সোহানার এই পরিনতির কথা যদি নাদিয়া জানতে পারে তবে কি হবে। আর যদি ওনার মায়ের কানে এই খবরটা যায় তবে পরিস্থিতি কতটা খারাপ হতে পারে। তবে ঘুমের চাপে বেশিক্ষণ আর চিন্তা করতে পারেন না তিনি। অনেকক্ষণ ধরে হাটার ফলে পা দু’টোও ব্যাথা করতে শুরু করে। তাই ব্যাথা আর ক্লান্তি নিয়ে ঘুমের মধ্যে তলিয়ে যান তিনি।

নয়…

সাইফা খু*নের মামলাটা বন্ধ হয় খু*নি সিয়ামের মৃত্যুর কারণে। সিয়ামের মৃ*ত্যুতে অনেকেই খুশি হলেও তার মা মোটেই খুশি হতে পারেননি। ওনার মধ্যে উল্টো রাগ ছিল সিয়ামের খু*নির উপরে। কিন্তু শুরুতেই উনি কোনো প্রকার মামলা করতে পারেননি এই জন্যেই যে সবাই জেনেছিল সিয়াম সাইফাকে খু*ন করে পালিয়ে গেছিল। কিন্তু সাইফার পোস্ট*মর্টেম রিপোর্ট সম্পূর্ণ সামনে আসার পরে দেখা যায় ইচ্ছেকৃত নয়, বরং হাতাহাতির ফলে হঠাৎই অস্বাভাবিক ভাবে পরে গিয়ে মাথার পিছনে আঘাত পায় সাইফা। সেই আঘাত থেকেই মৃত্যু হয় সাইফার।

এই রিপোর্ট পাওয়ার পর থেকেই সিয়ামের মা উঠে পরে লাগে তার খু*নিকে খুঁজে বের করতে। সাইফা খুনের মামলা যে অফিসার হ্যান্ডেল করছিল সেই এস আই আজিজ সাহেবের কাছেই আজ বিকাল বেলাতে কেস দাখিল করেন তিনি। আজিজ সাহেব প্রথমে বলার চেষ্টা করেন যে, “দেখুন ও এমন জায়গায় মারা গেছে যেখানে কোনো প্রমান ছিল না। এবং প্রমান বা সাক্ষী নেওয়ার মতোও কাউকে পাইনি আমরা। এখন আপনি কেস করতে পারবেন কিন্তু এটা আমাদের খুঁজে বের করতে এতোটাই কষ্ট হবে যে শেষ পর্যন্ত মামলাটা আমাদের হাতে থাকবে কি-না সেটাই সন্দেহ। ”

সিয়ামের মা সেসব কিছুই বুঝতে চান না। উনি সরাসরি জানিয়ে দেন, “আমার ছেলেকে খু*ন করা হয়েছে। সে যেমনই হোক না কেন, আমার তো ছেলে। আপনার ছেলে হলে আপনারও কলিজা পুড়তো। আমি আমার ছেলের খু*নিকে দেখতে চাই। আমি কেস করতে চাই, এবার আপনি কেস নিবেন না-কি আদালতে যেতে হবে আমাকে?”

আজিজ সাহেব বুঝতে পারেন এই মহিলা খুবই ডেঞ্জারাস। কেস না নিলে কি কি ঝামেলা পাকায় তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। তারচেয়ে বরং কেসটা নিয়ে রাখি যদি সমাধান করতে পারি তবে ভালো। নয়তো ফাইল ফাইলের জায়গায় পরে থাকবে।
কেস দাখিল হয়ে যায়। আজিজ সাহেবের উপরে নতুন আরেকটা কেস এসে চেপে বসে। এই কোনো সাক্ষী প্রমান ছাড়া কেস কি সমাধান করতে পারবেন তিনি….?

(চলবে ইন শা আল্লাহ )