আবর্তন পর্ব-০৭

0
1604

গল্পঃ #আবর্তন (৭ম পর্ব)
লেখায়ঃ #তাজরীন_খন্দকার

এখন মনে হচ্ছে তার জায়গাটা অরুণের কাছে
আরও গভীরে পৌঁছে গেলো নাতো?
অরুণ পোশাক না বদলেই রুমের এদিক ওদিক পায়চারি করছে। কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগছে।
সে খেয়াল করলো, তার রুমটা এতো গুছানো আর পরিপাটি যে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে। কোথাও বিন্দুমাত্র ময়লার আভাস নেই। অথচ বিয়ের আগে প্রতিদিন রুমে প্রবেশ করেই তার নাকে একটা বিশ্রী গন্ধ লাগতো, যেটা তার অপরিষ্কার জমানো কাপড়গুলো থেকে আসতো। তাও নিয়ম করে সেসব পরিষ্কার না করে এমন বাজে পরিবেশেই শুয়ে বসে কাটিয়ে দিতো। তারপর একেক জিনিস একেকদিকে ছড়াছড়ি হয়ে পড়ে থাকতো। আর এই চারদিনে তার সবকিছু বদলে গেছে, জায়গামতো একেক জিনিস গুছিয়ে রাখা। কাপড়গুলো কি ঝকঝকে!

অরুণের খুব ক্লান্তি লাগছে। একটু পানি খাওয়া দরকার, সে মুখ ফসকে চন্দ্রা বলে ডাক দিতে গিয়েও আঁটকে গেলো। সে যে এখনি শুনে এসেছে চন্দ্রা আজ চলে গেছে। আর এতক্ষণও এটাই ভাবছিল অথচ কেন জানি মনে হচ্ছে চন্দ্রা আশেপাশেই আছে, এ কাজ ও কাজ করতেছে। আসলে কয়েকদিন খুব বাজেভাবেই চন্দ্রার উপর নির্ভর হয়ে গেছে যে, সব কাজেই শুধু চন্দ্রা চন্দ্রা । এমনকি বিছানা থেকে টেবিলে রাখা কোনো জিনিসের জন্যও চন্দ্রাকে ডেকে সেটা আনতে বলতো। আর চন্দ্রা হাসিমুখে সব আদেশ পালন করতো৷ অথচ অরুণ তার সাথে সবসময় ধমক ছাড়া কথা-ই বলতো না।

অরুণ পোশাক বদলাতে গিয়েও কি ভেবে যেন আর বদলালোনা। ওয়াশরুমে গিয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে তড়িঘড়ি করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।



অন্যদিকে চন্দ্রা নিজের অতি পরিচিত নিজের সেই নীড়ে ফিরেও কোনো স্বস্তি বোধ করছেনা। কেমন যে অনূভব করছে সেটা নিজেই আঁচ করতে পারছেনা।
নিজের ভাবীর উপর তার অনেকটা রাগ জমে আছে,তাই আসার পরে ভালো করে কথা বলেনি।
এখন মনে হচ্ছে কথা বলাটা খুব জরুরী। তাই চুপচাপ তার ভাবীর রুমে গিয়ে, বিছানার উপর বসলো। এদিকে তাকে এভাবে আসতে দেখে ভাবী মুচকি মুচকি হাসতেছে কিন্তু কিছু বলছেনা।
চন্দ্রা মিনমিন করে বললো,
___ ভাবী আমার মোবাইলটা দিবা প্লিজ।

তার ভাবী বুঝতে পেরেছিল চন্দ্রা এই জন্যই এখানে এসেছে। উনি ড্রয়ারের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে চন্দ্রার দিকে তাকিয়ে বললো,
___ রনিকে ফোন দেওয়ার জন্য মোবাইল চাচ্ছো?

চন্দ্রা মুখটা মলিন করে বললো,
___ না আমি রনিকে ফোন দিবোনা। প্লিজ ফোনটা দাও না?

চন্দ্রার ভাবী তার দিকে তাকিয়ে আর মানা করতে পারলোনা। তিনি ড্রয়ার থেকে ফোন বের করে চন্দ্রার হাতে দিলো আর বললো,
___ তোমার ফোনে এই চারদিনে একবারও রনির ফোন আসেনি। ফোনটা খোলা-ই ছিল। আমার মনে হয়েছিল হয়তো সে ফোন দিবে। অথচ একটা এসএমএসও দিলোমা। তুমি কেমন আছো কোথায় আছো সেটা জানার ইচ্ছে যার হয়নি সেখানে বুঝা যায় সম্পর্কটা একপাক্ষিক ছিলো। তুমিই তার জন্য একা পাগলামি করতে, তাকে ভালোবাসতে এবং তাকে তোমার করে পাওয়ার জন্য অসম্ভবের দুনিয়ায় ঘুরতে। আর এমনকি তার জন্য একটা ভালো ছেলের সম্মান নিয়েও খেলা করেছিলে। আমার মনে হয় কি জানো? তুমি রনির জন্য যতটা সিরিয়াস ছিলে, সে সেটাকে ততটাই খামখেয়ালে উড়িয়ে দিতো। গিয়ে দেখো এমনও হতে পারে তোমার মতো কতো চন্দ্রা তার জীবনে আছে!

চন্দ্রা কোনো কথা না বলে ফোন হাত বাড়িয়ে নিয়ে বললো,

___ তোমাদের জামাইয়ের নাম্বারটা দাও, আমার কাছে নেই আসলে ।

চন্দ্রার কথা শুনে তার ভাবী একটা হাসি দিলো। আর নিজের ফোন থেকে অরুণের নাম্বারটা দিলো।
চন্দ্রা নাম্বার নিয়ে চলে যাবে, এরপর কি ভেবে সে পেছনে তাকিয়ে বললো,
___তুমি উনার নাম্বার কোথায় পেয়েছো? আমার জানামতে আমার শশুড় শাশুড়ীর সাথে আমার আম্মু আব্বুর কথা হয় এবং ফোন নাম্বার আছে। কিন্তু অরুণ তো, না মানে উনার সাথে তোমার হয়?

চন্দ্রার ভাবী জোরে জোরে হেসে উঠলো। চন্দ্রা এই হাসির আগাগোড়া কিছু বুঝলোনা। তখন ভাবী বললো,
___ আরে আমি নই তোমার জামাই-ই আমার নাম্বার জোগাড় করেছে। মাঝ রাতে ফোন দিয়ে দিয়ে বলে ভাবী আপনার হাসিটা আমার কি যে ভালো লাগে!

চন্দ্রা মুখ বাঁকিয়ে মাথা নাড়াতে নাড়াতে চলে গেলো। সিরিয়াস সময়েও তার ভাবী রসিকতা করতে ছাড়েনা। হুহহ পারেও উনি!

চন্দ্রা রুমে গিয়ে ফোন দিবে কি দিবেনা ভেবে আতংকে পড়ে গেলো। কারণ সে জানে ফোন দিলে নির্ঘাত ধমকি শুনতে হবে। তারপর উল্টা পাল্টা কি জানি বলে বসে।
তাও কেন জানি নিজেকে মানাতে পারছেনা, তার মনে হচ্ছে অরুণ অফিস থেকে এসে তাকে দেখতে না পেয়ে মনে হয় খুশিই হয়েছে। কিন্তু অরুণ আসার পরে নিজের পোশাকগুলো এদিক ওদিক ছুড়ে ফেলে দেয়নি তো? তাহলে তো রুমটা আবার আগের মতো করে ফেলবে। চন্দ্রা ভাবছে অরুণ তো এই কয়দিন যা প্রয়োজন সব তাকে করতে বলতো। এখন সে কি তাকে খুঁজবে? আবার অলসতায় নিজের যত্ন নিতে ভুলে যাবেনা তো!

ওহহো ভাবনায় আর পেরে উঠছেনা চন্দ্রা। সাহস করে ফোন দিয়েই দিলো। কিন্তু রিসিভ হচ্ছেনা।
তিনবারের মাথায় ফোন রিসিভ করলো, চন্দ্রা সালাম দিলো আর তারপর চন্দ্রা যা ভেবেছিল ঠিক তাই হলো,
ওপাশ থেকে জোরে জোরে ধমকিয়ে অরুণ বললো,
___ আজব এতোবার ফোন দেওয়ার মানে কি? রিসিভ করছিনা বুঝে নেওয়া উচিত আমি ব্যস্ত। তা না করে দিতেই আছে দিতেই আছে। কি? কি? কি বলবা তুমি? ইম্পরট্যান্ট কোনো কথা বলার আছে?

অরুণের ধমকিতে চন্দ্রার গলা শুকিয়ে গেছে, কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
___ আমি দুঃখিত! আসলে তেমন কিছু বলার নেই। আপনি এসে কিছু খেয়েছিলেন কিনা জানার জন্য ফোন দিয়েছিলাম।

অরুণ আবার রাগী গলায় বললো,
___ তো তোমার কি মনে হয় আমি না খেয়ে থাকবো?
মানে কি? এইটা জিজ্ঞাসার জন্য তুমি আমাকে বিরক্ত করলে। ধ্যাত!

বলেই অরুণ ফোন কেটে দিলো।
আর চন্দ্রা কান থেকে ফোনটা চোখের সামনে আনলো, তার চোখের জলগুলো বেয়ে বেয়ে ফোনের স্ক্রিনে পড়ছে। সে খুব করে চাইছে কান্না আঁটকাতে কিন্তু পারছেনা।
চন্দ্রা নিজের সামনে দেখতে পাচ্ছে শুধু গাঢ় অন্ধকার, যে অন্ধকার সাঁতরে সে একূল ওকূল কোনো কূলেই রাস্তা খুঁজে পাচ্ছেনা।

রাতের খাবারের জন্য চন্দ্রাকে অনেক্ষণ যাবৎ ডাকতেছে কিন্তু তার খেতে ইচ্ছে করছে না। অঝোরে কাঁদছে আর বারবার ফোনের দিকে তাকাচ্ছে, কেন জানি মনে হচ্ছে অরুণ তাকে ফোন দিবে।
এদিকে চন্দ্রার ভাবী ভাবছে চন্দ্রা অরুণের সাথে কথা বলছে, তাই উনিও আসছেনা।

চন্দ্রা আবার ফোন হাতে নিলো। অনলাইনে গিয়ে দেখলো রনি এক্টিভে। সে কিছু না ভেবে নিজের সব একাউন্ট থেকেই রনিকে ব্লক করে দিলো।
তারপর ফোনটা বিছানার উপর রেখে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। হ্যাঁ এতোদিন পাগলের মতো ভালোবেসে আসা মানুষটার সাথেও আর কখনো কথা হবেনা, সেটারও আর সুযোগ নেই।
সব স্বপ্নের বিসর্জন দিয়ে চন্দার নিজের অনিশ্চিত সংসারের জন্যই আজ ভীষণ মন খারাপ।

তার ভাবী ঠিক বলেছিল, তার ভালোবাসা একপাক্ষিক। রনির জন্য সে যতটা পাগলামো করতো তার সামান্যও রনি তার জন্য করতোনা। সে কথা বলতে চাইলেই রনি কথা বলতো, চন্দ্রা নিজে থেকেই তার সাথে দেখা করতে চাইতো। কতোবার তার ফ্রেন্ডরা রনির সম্পর্কে বাজে কথা বলেছে কিন্তু তারপরও কেন জানি রনিকে ভুল বুঝতে পারেনি। কারণ রনিকে সে অন্ধের মতো বিশ্বাস করতো।
মাঝে মাঝে তার মনে অনেক প্রশ্ন জাগলেও নিজেকে বুঝাতো রনি হয়তো নিরুপায়। কিন্তু এখন তার মনে হয় রনি আসলে কখনো তাকে মন থেকে চায় নি।

এদিকে রনিকে পাওয়ার জন্য যাকে এতো অসম্মান করলো সেই অরুণের জন্যই তার এখন শত চিন্তা হাজার ভাবনা। কিন্তু এটাও যে একপাক্ষিক। সে কি সবসময় আর সব ক্ষেত্রেই এভাবেই এক তরফা ভালোবাসবে আর কাউকে এতোটা গুরুত্ব দিবে?তাকে বুঝার মতো, এবং অনূভব করার মতো কেউ থাকবেনা?

ভাবতেই ভাবতেই অজান্তে চলে আসা চোখের পানি মুছতে লাগলো। হঠাৎই নিচে গেইটের সামনে একটা বাইকের আলো জ্বলে উঠলো। চন্দ্রা নিচে তাকিয়ে একদম চমকে উঠলো, সে কান্নার মধ্যে দাঁত বের করে হেসে উঠলো আর এক দৌঁড়ে নিচে চলে গেলো।
পেছন থেকে তার মা আর ভাবী জিজ্ঞাসা করতেছে কি হয়েছে, চন্দ্রা তাদের কথার জবাব না দিয়ে আগে গিয়ে দরজা খুললো। খোলেই দেখলো অরুণ বেল দেওয়ার জন্য সুইচের উপর মাত্র হাত রেখেছে। বেল দেওয়ার আগেই দরজা খোলে যাওয়াতে সেও আচমকা একটু অবাক হয়ে কি বলবে খুঁজে পাচ্ছেনা। চন্দ্রা চোখেমুখে আনন্দের তীব্রতা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। অরুণ এগিয়ে বললো,
___ সরোনা একটু, ভেতরে আসতে দিবা তো নাকি?

চন্দ্রা একটু সরে গিয়ে বললো,
___ নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই, আসেন ভেতরে আসেন। কাজের মেয়ের বাড়িতে সাহেবের আগমন এটা তো ভাবনার বাইরে।

অরুণ চেহেরা ভাঁজ করে ভেতরে পা রাখতেই চন্দ্রার পেছন থেকে তার ভাবী বলে উঠলো,
___ ওমা ওমা নতুন জামাই দাওয়াত ছাড়া চলে আসে?

অরুণ পা পেছনে নিয়ে বললো,
___ আচ্ছা এখন দাওয়াত দেন, আর আমি ভেতরে আসি।

তার ভাবী কিছু বলতে যাবে তখনি চন্দ্রার মা পেছন থেকে এসে বললো,
___ অরুণ তুমি এসেছো? রাতের বেলা এতো দূরের পথ একা এসেছো আমার তো ভীষণ ভয় হচ্ছিল।

চন্দ্রা তার মায়ের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বললো,
___ আম্মু তুমি আগে থেকে জানতে?

চন্দ্রার মা অরুণকে ভেতরে আসতে বললো।
অরুণ ভেতরে আসলো আর চন্দ্রার বাবাকে সালাম দিয়ে উনার পাশে বসলো। চন্দ্রা তার মাকে আবার জিজ্ঞাসা করলো,
___ মা উনি আসবে তুমি কি করে জানতে?

চন্দ্রার মা রান্নাঘরের দিকে এগুতে এগুতে বললো,
___ অরুণের মা আমাকে ফোন দিয়েছিল, অফিস থেকে এসে পোশাক না বদলেই নাকি অরুণ তড়িঘড়ি করে বাসা থেকে বের হয়ে গেছে। আর বের হওয়ার সময় তার মাকে বলে আসছে বউ নিয়েই বাসায় ফিরবে।

চন্দ্রা তার মায়ের কথা শুনে নিজের মুখ দুহাতে চেপে ধরলো। কারণ সে বিশ্বাস করতে পারছিলোনা কিছু। একটু আগেই ফোনের মধ্যে কি বাজেভাবে ধমকালো, অথচ সে তাকে বাসায় না পেয়ে সোজা এখানে চলে আসছে। এই অরুণ তো তার চেয়েও বড় নাটকবাজ!

চলবে…..