আবার এলো যে সন্ধ্যা পর্ব-০২

0
255

#আবার এলো যে সন্ধ্যা
পর্ব-২

“বাবা, পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি। দোয়া করো।”
আজমল শেখের পায়ে হাত দিতেই তিনি ঝট করে পা সরিয়ে নিলেন। স্বামীর এহেন কর্মে অদূরে দাঁড়ানো সাজেদা বেশ মর্মাহত হলেন। মেয়ের দিকে স্নেহের দৃষ্টি মেলে দিলেন-“শোভা, মন খারাপ করিস না মা। ইনশাআল্লাহ তুই সফল হবি। মা অনেক দোয়া করে তোর জন্য।”
শোভার চোখ ততক্ষণে জলে টইটম্বুর। নিজেকে সংবরণ করার বহু চেষ্টা করেও পারলোনা। ঝরঝর করে কেঁদে দিলো। সাজেদা দৌড়ে এসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে স্বামীর দিকে তাকালেন-“আর কতদিন মেয়েটার সাথে এমন ব্যবহার করবে? বাবা হয়ে সন্তানের সাথে এমন করতে পার কি করে? হৃদয় কাঁপে না তোমার? ছোট মানুষ না হয় ভুল করে ফেলেছে তাই বলে এমন করবে?”
আজমল শেখ যেন দৃষ্টি দিয়ে ঝলসে দেবেন স্ত্রীকে। তপ্ত নয়ন নিয়ে মেয়েকে দেখলেন এক নজর তারপর স্ত্রীর দিকে ফিরে চাইলেন-“যে সন্তানের জন্য নিজের পূর্বপূরুষের ভিটে মাটি ত্যাগ করতে হয়। খোলা হাওয়ায় শ্বাস নেওয়া মানুষটার খাঁচার মতো ফ্লাটে শ্বাস নিতে হয়, অপরিচিত এই শহরে লুকিয়ে চুরিয়ে বাঁচতে হয় সেই সন্তানকে অন্তত আমি মাফ করতে পারবো না। আমি যে এখনো ওকে সন্তান বলে স্বীকার করছি এটাই অনেক। এর বেশি আশা না তুমি করবে না তোমার মেয়ে।”
শোভা হাউমাউ করে কাঁদলো-“ভুল করেছিলাম বাবা। সেই ভুলের আড়াই বছর পার হয়েছে। এবার তো মাফ করে দাও। আর কত শাস্তি দেবে? তুমি তো আমার বাবা, আমার জন্মদাতা। ছোট থেকে তোমার কোলে হেসেখেলে বড় হয়েছি। তোমার আদরের সন্তান হিসেবে মাফ পাওয়ার অধিকার কি আমার নেই?”
আজমল শেখের চোখ মুখ জুড়ে বিরক্তি। মুখের উপর হাত ঝাড়েন-“পুরনো কাসুন্দি ঝেড় নাতো। যা করতে যাচ্ছ তাই করো। তোমার জন্য কম হ্যাপা তো পোহাচ্ছি না। এবার ভালো কোথাও চান্স পেয়ে আমাকে উদ্ধার কর। আশাকরি আমায় আর তোমার পড়ার খরচ টানতে হবে না।
তোমার আরও দু’টি ভাই বোন আছে। তাদের ভাবনাও ভাবার সুযোগ দাও আমাকে।”
অনেক কষ্টে নিজের কান্না থামিয়ে শোভা নাক টানে-“তাহলে এই দোয়াই করো বাবা। আমি যেন নিজের পায়ে দাঁড়াই। তোমার টাকা যেন আর না নষ্ট করি।”
আজমল শেখের আর ধৈর্য্য হলো না। স্ত্রী আর মেয়েকে ঘরে রেখে বেড়িয়ে এলেন। সাজেদা মেয়ের মাথায় হাত রাখে-“বাবার উপর অভিমান করিস না শোভা। সব ঠিক হয়ে যাবে দেখিস। তুই কেবল ভালো কোথাও চান্স পেয়ে দেখা।”
শোভা মাথা দুলালো-“কিছুই ঠিক হবে না মা। বাবা কখনো আর আগের মতো আমাকে ভালোবাসবে না। বাবার ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যতা হারিয়েছি আমি।”
হতাশ হয়ে মাথা নাড়ে শোভা-“আমি যাই মা। দেরি হয়ে যাবে।”
“হ্যা যা।”
তবুও বেরুতে বেরুতে শোভা পিছু ফিরে তাকায়। ভাবে, যদি ভুল করেও তার বাবা দরজায় দাঁড়ায়। সেই ছোট বেলায় যেমন দাঁড়াত। পরীক্ষার দিনগুলোতে বাবা নিজে ওকে স্কুলে নিয়ে যেত। শোভার পচ্ছন্দের জিনিসগুলো এনে ঘর ভরিয়ে দিত বাবা। আড়ত থেকে ফিরে এসে প্রথমেই শোভার খোঁজ করতো। কোথায় হারিয়ে গেলো সেসব দিন? তার প্রতি বাবার ভালোবাসা? একটা মাত্র ভুল কি এভাবে সব শেষ করে দেবে? অশ্রুশিক্ত নয়নে শোভা পথ চলতে গিয়ে হোঁচট খায়। কেঁটে যাওয়া পা থেকে গলগল করে রক্ত বেরোয়। তবুও বিন্দু মাত্র ব্যাথা টের পায় না শোভা। যার হৃদয় জুড়ে ক্ষত তার জন্য এ ব্যাথা কিছুই না। ব্যাথা উপেক্ষা করে শোভা এগিয়ে যায়।

বাবার অভিমান, মায়ের কষ্ট, ভাই বোনদের অবহেলা কেন যেন আর সহ্য হচ্ছে না শোভার। নিজের জীবন নিজে নেওয়ার মতো গর্হিত পাপ করতেও মন সায় দেয় না। কিন্তু এই জীবনের একটা সমাপ্তি টানার সময় হয়ে গেছে। নিজেকে নিয়ে নতুন করে ভাবাবার সময় হয়েছে। ভেজা নয়নের বারিধারা হাত দিয়ে মুছে নিলো। শোভা দৃঢ় সংকল্প করে, সব কিছু আবার আগের মতো করে ফেলবে সে। আবার বাবার মন জয় করবে। পরিবারে আগের মতো আনন্দঘন পরিবেশ ফিরিয়ে আনবে। আর এজন্য যা করা দরকার করবে। নিজেকে জীবনের এমন একটা পর্যায়ে নিয়ে যাবে যাতে সে তার বাবার পুরনো গৌরব ফিরিয়ে দিতে পারে। বাবার নিচু হওয়া মাথা পুনরায় উঁচু করে দেবে সে।

★★★

রিফাত, মিনহাজ, ফুয়াদ, নিয়াজ আর হাফিজ। সদ্য ইউনিভার্সিটি শেষ করা পাঁচ বন্ধু যার যার কর্ম ক্ষেত্রে ব্যস্ত থাকে। ওদের মধ্যে রিফাত আর মিনহাজ ইউটিউবের পরিচিত মুখ। রিফাত বিভিন্ন সামাজিক, বৈশ্বিক ইস্যুতে কথা বলে আর মিনহাজ ফুড ব্লগিং করে। ফুয়াদ আর হাফিজ একটা সফটওয়্যার ফার্মের সাথে জড়িত আছে। নিয়াজ ওর বাবার অফিসে বসছে। সপ্তাহের একটা দিন ওরা পাঁচ বন্ধু ব্যস্ততাকে পাশ কাটিয়ে একসাথে হয়ে আড্ডা দেয় সারাদিন। স্হানটা একেকদিন একেক জায়গায় নিজেদের সুবিধা মতো কোন প্লেস। আজকে যেমন বসেছে সাত মসজিদ রোডের ফোর সিজন এ। এটা নিয়াজের অফিসের কাছাকাছি।
“এই রিফাত, তোর নেক্সট প্রজেক্ট কি বলতো? কোন বিষয় নিয়ে ভিডিও দিবি?”
হাফিজের প্রশ্ন আসতেই মিনহাজ হাত তুললো-“মেয়েদের নিয়ে কিছু হবে হয়তো।”
“তুই কিভাবে বলছিস? রিফু কি তোকে কিছু বলেছে?”
ফুয়াদ প্রশ্ন করলো। মিনহাজ হাসলো-“আমাকে তোরা আড়ালে মিডিয়া মিনহাজ ডাকিস না? তাহলে তোদের এই ডাক বৃথা যেতে দেই কি করে?”
বন্ধুরা হাসলো সবাই। নিয়াজ আরেক টেবিলে বসে ল্যাপটপে অফিসের জরুরি মেইল চেক করছিল। মিনহাজের কথা শুনে উঠে এসে গম্ভীর গলায় জানতে চাইলো-“সত্যি নাকি রে রিফু?”
রিফাত অসন্তোষ প্রকাশ করলো-“ধ্যাত, মিনহাজের কথা তোরা সিরিয়াসলি নিচ্ছিস কেন? জানিস না মিডিয়ার সব কথা বিশ্বাস করতে নেই? যা নিউজ হয় তার বেশিরভাগই ভুয়া নিউজ।”
হো হো হাসির আওয়াজে ছাঁদে টিকে থাকাই দায় হলো। মিনহাজের মেজাজ খারাপ হলো। সে একে একে সব বন্ধুদের দিকে চোখ বুলিয়ে আনলো। তারপর রিফাতের দিকে তাকিয়ে বললো-“কিন্তু এ কথাও সত্য যা রটে তার কিছুটা বটে। তুই বল, সেদিন ওই মেয়েটার সাথে তুই কথা বলিসনি? ওকে তো গাড়িতে লিফট পর্যন্ত দিলি দেখলাম। রাতও কাটিয়েছিস কিনা কে জানে।”
রিফাতের মধ্যে কোন হেলদোল নেই। বরং ফুয়াদ উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়ায়-“কি বলছিস দোস্ত? বিশ্বাস হচ্ছে না। রিফুর আর যাইহোক মেয়ে মানুষের দোষ নেই।”
“আরে বাবা, আমি সত্যি বলছি না মিথ্যা সেটা ওকেই জিজ্ঞেস কর না? আমি নিজেও কি কম অবাক হয়েছি? বল রিফু, আমি কি মিথ্যে বলছি?”
রিফাত সিগারেট ধরালো। পর পর কয়েকটা লম্বা টান দিতেই হাফিজ ওর হাত থেকে সিগারেট টেনে নিলো-“উহু, ভালো লক্ষন না এটা। কথা এড়ানোর জন্য সিগারেট জ্বালানো পুরনো টেকনিক। বল দেখি মিনহাজ যা বলছে সত্যি কিনা?”
রিফাত পুনরায় সিগারেট কেড়ে নেয়-“আংশিক সত্যি। ওর স্বভাব বাড়িয়ে বলা। মেয়েটার প্রতি কিউরিয়সিটি হয়েছিল এটা সত্যি। তোরা তো জানিস, কোন ব্যাপারে কিউরিওসিটি হলে সেটা নিয়ে ঘাটাঘাটি করা আমার স্বভাব। এখানেও সেম ব্যাপার। আর গাড়িতে লিফট দেওয়ার ব্যাপারটা একদম আনইউজুয়াল। মেয়েটা সিক ফিল করছিলো তাই লিফট দিয়েছি। নাথিং এলস মামু।”
“ওহহহ, তাই বল। আমিও তো সেটাই বলি, রিফুর মেয়েলী দোষ নেই। এবার প্রমান পেলি?” বলতে বলতে ফুয়াদ কোক ঢেলে গলা ভিজালো। মিনহাল জুলজুলে দৃষ্টি নিয়ে রিফাতকে দেখছে। চোখাচোখি হতেই রিফাত ইশারা দিলো আর কিছু না বলতে। মিনহাজ মাথা নেড়ে ঠোঁট টিপে হাসলো। তার অনুমান তাহলে সত্যি। রিফাতের ঘটনা অনেকদূর এগিয়েছে। কিন্তু ওই মেয়েটার মধ্যে কি এমন দেখলো রিফাত? একেতো ভিডিও ভাইরাল হয়েছে তার উপর তেমন সুন্দর বা স্মার্টও নয়। ওর চাইতে ঢের ভালো মেয়ে রিফাতের পিছনে ঘোরে। মিনহাজ ঠিক বুঝলো না রিফাত কেন কিছু বলতে নিষেধ করলো ওকে। মুখে বলছে তেমন কিছু না। কিছুই যদি না হয় তাহলে এতো লুকোছাপার কি আছে?

আড্ডা ভাঙলো রাত এগারোটা নাগাদ। মোহাম্মদপুর ক্রশ করতে যেয়ে মনে হলো মেঘা নামের মেয়েটার সাথে দেখা করলে কেমন হয়? আজই তো কোথায় যেন ভর্তি পরীক্ষা ছিলো। পরীক্ষা কেমন হলো এটা জানার উসিলায় গেলে নিশ্চয়ই খারাপ দেখাবে না? ভাবনা মাথায় আসতেই গাড়ি ঘুড়িয়ে নিলো রিফাত। সোজা সুকন্যা গার্লস হোস্টেল এর সামনে গাড়ি থামায়। ঘড়ি দেখলো রাত এগারোটা। দ্বিধা নিয়ে গাড়িতে বসে থাকে রিফাত। এতো রাতে এভাবে চলে আসা কি ঠিক হয়েছে? আর স্বল্প পরিচিত একজনের কাছে এভাবে আসাটা কি সমুচিত কাজ? রিফাত বেশ লজ্জিত হলো নিজের কাজে। কিন্তু কেন যেন মেয়েটার সাথে আলাপ করার লোভ সংবরণ করতে পারছে না। কিছু একটা ব্যাপার আছে মেয়েটার মধ্যে। ওর পুরো ঘটনা না জেনে শান্তি পাবে না আপাতত এইটুকু বুঝতে পারছে।

রিফাত গাড়ি থেকে নেমে হোস্টেলের দিকে তাকালো। দশ তলা বিল্ডিং এর পুরোটাই প্রায় আলোকিত। ঢাকা শহরে এতো তাড়াতাড়ি কেউ ঘুমায় না। তবে হোস্টেলের কিছু নিয়ম আছে। এতেরাতে নিশ্চয়ই কোন মেয়ের বাইরে বের হওয়া এলাউ না? আর এলাউ হলেও এইসময় কি মেঘা নামবে নিচে? রিফাত মোবাইল বের করে টের পেলো কি বেকুবের মতো কাজ করেছে সে। মেঘাকে ডাকবে কি করে? রিফাতের মনে হলো মেঘার ফোন নাম্বার বা হোস্টেলের রুম নাম্বার কোন কিছুই জানা নেই তার। গতদিন কোন তথ্য দেয়নি মেয়েটা। আর ও বোকার মতো কিছু জানতে চায়নি। তাহলে উপায়?

একবার ভাবলো ফিরে যায়। পরক্ষণেই মনে হচ্ছে এত কষ্ট করে এসে ফিরে যাবে? একবার চেষ্টা করতে ক্ষতি কি? রিফাত হোস্টেল গেটে দারোয়ানকে ডাকে। মেঘা নামের এডমিশন ক্যান্ডিডেটকে ডেকে দিতে বললে দারোয়ান আকাশ থেকে পড়ে। জানায় এই নামে এখানে কোন ছাত্রী থাকে না।
“আরে মামা, থাকে একজন। এই সেদিন আমি তাকে এই গেটে নামায় দিছি। তাকে ভিতরে ঢুকতে দেখছি। আপনি একটু ভালো মতো খোঁজ করেন।”
“তাহলে আপনে নাম ভুল কইছেন মামা। কারণ আমি এই নামে কাউকে চিনি না। আর ভর্তি পরীক্ষা তো মেলা জন দিতেছে আমি কারে খোঁজ করমু?”
“মেয়েটার মাথায় লম্বা চুল আছে। একটু শ্যামলা মতন, গোলগাল মুখে বড় বড় চোখ, পাতলা ঠোঁট। মনে করে দেখেন মামা।”
দারোয়ান হেসে দিলো-“এমন কেউ এইখানে থাকেনা মামা। বিশ্বাস না হইলে আপনে এন্ট্রি বই দেখেন। কে আসে কে যায় সব নাম লেখা থাকে।”
রিফাত পুরো এন্ট্রি বই দেখে মেঘা নামে কাউকে খুঁজে পেলো না। মন যতটা খারাপ হলো তার চাইতে বেশি অবাক হলো। মেয়েটা ওকে মিথ্যে বলেছে? কিন্তু কেন?

চলবে—
©Farhana_Yesmin