আবার এলো যে সন্ধ্যা পর্ব-০৭

0
176

#আবার এলো যে সন্ধ্যা
পর্ব-৭

বাবাকে হঠাৎ নিজের রুমের দরজায় দেখে ঘাবড়ে গেল রিফাত। উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে দাঁড়ায়-“বাবা তুমি? কিছু দরকার ছিলো? আমাকে খবর দিলেই তো হত?”
গোলাম রসুল এগিয়ে এসে ছেলের বিছানায় বসলেন। রিফাত ল্যাপটপে বসে ভিডিও এডিটিং করছিল। সেটা বন্ধ করে দিয়ে বাবার দিকে তাকায়। গোলাম রসুল সব দেখলেন চুপ করে। রিফাতকে তাকাতে দেখে চোখের চশমা খুলে পাঞ্জাবি দিয়ে মুছে আবার চোখে
দিলেন-“কেমন ইনকাম হচ্ছে তোমার? এইসব ভিডিও বানিয়ে মাসে কত পাও?”
রিফাত বিস্ময় নিয়ে বাবাকে দেখলো। এর আগে বাবা তার ভিডিও বানানো নিয়ে কখনোই কিছু জানতে চায়নি। হঠাৎ এসব কেন জানতে চাইছে বাবা?
“বর্তমানে ভালোই পাই বাবা। তবে এমাউন্ট প্রতিমাসে একরকম থাকে না। কোন মাসে দেড়, কখনো দুই আবার কখনো এক লাখ। এরচেয়ে কমও পেয়েছি।”
“এভারেজে এক লাখের আশেপাশে তাইতো?”
রিফাত মাথা দুলায়। গোলাম রসুল হাসেন-“খারাপ না। আমিও হয়তো তোমাকে এমনই স্যালারি দিতাম। অবশ্য মালিক হিসেবে হয়তো আরও অনেক বেনিফিট পেতে। সেসব আলাদা হিসাব।”
বাবার কথায় রিফাত বোবা বনে গেলো। মানে হঠাৎ এমন আলাপের কোন মানে খুঁজে পেলো না সে। তাই চুপ করে রইলো। গোলাম রসুল হাসলেন-“তুমি ভাবছো, আমি আচমকা এমন আলাপ কেন করছি। তাই না?”
রিফাত মাথা দুলায়।
“আজ বিকেলে কি তোমার কোন জরুরি কাজ আছে?”
“না নেই।”
“তাহলে আজ আমার সাথে এক জায়গায় যাবে। কোন আপত্তি নেই তো?”
“কোথায় যাবে?”
“তোমার কি কোন পছন্দ আছে? মানে কারো সাথে কমিটমেন্টে আছো?”
রিফাত আকাশ থেকে পড়লো যেন। বাবার শরীর ঠিক আছে তো? এমন উল্টো পাল্টা প্রশ্ন কেন করছে? লজ্জাও পেল বেশ। কান দু’টো গরম হয়ে গেলো। চোখের পাতা পড়ছে ঘনঘন।
“তেমন কেউ নেই বাবা কিন্তু একথা জানতে চাইছ কেন?”
“তোমরা আধুনিক ছেলেপেলে। তোমাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোন কাজ করানো যায় না। তাই জেনে নিলাম। আমি আর তোমার মা তোমার জন্য একটা মেয়ে পছন্দ করেছি। তাকেই দেখতে যাব আজ। না না ভয় পেয় না। কোন জোরজবরদস্তি নেই। মেয়ে তোমার পছন্দ হলে তবেই বিয়ের জন্য আগাবো।”
“কিন্তু বাবা আমি এখন বিয়ের কথা ভাবছি না। এখনো অনেক কাজ করা বাকী আছে আমার।”
রিফাতের কথায় গোলাম রসুলের চেহারায় খানিকটা গম্ভীরতা নেমে এলো-“তোমার মাকে বিয়ে করেছিলাম ব্যবসা শুরুর আগে। তখন কেবল চাকরিতে ঢুকেছি। তারপর কোন সমস্যা তো হয়নি আমার। এ পর্যন্ত ভালোই এলাম। আর তুমি তো সেই তুলনায় অনেক ইনকাম করো তাহলে ভয় পাচ্ছ কেন? তাছাড়া আগেই বলেছি কোন প্রেশার নেই তোমার উপর। মেয়ে যদি পছন্দ হয় তাহলেই না হয় বিয়ে করবে। বাবার জন্য এইটুকু তো করতেই পার। নাকি পারবে না?”
এরপর আর কোন কথা চলে না। রিফাত তাই নিশ্চুপ রইলো। গোলাম রসুল উঠে দাঁড়ালেন-“তাহলে বিকেলে তৈরী থেকো। আমরা সাড়ে পাঁচটার দিকে বেরবো।”
“আচ্ছা।”
বাবা চলে যাওয়ার পরও নিজের চেয়ারে চুপচাপ বসে থাকলো রিফাত। ইচ্ছে ছিল ওর বিয়েটা ভালোবাসার বিয়ে হবে। ভার্সিটিতে উঠে একটা মেয়েকে পছন্দ হয়েছিল রিফাতের। মেয়েটারও ওকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বছর খানেকের সম্পর্কটা হুট করেই ভেঙে গেলো। মেয়েটাই পিছিয়ে গেছিল। না কোন সিনক্রিয়েট করেনি রিফাত। মেনে নিয়ে চুপচাপ সরে এসেছিল। ব্যাপারটা ভুলতে অনেকদিন লেগেছিল। তার উপর একই জায়গায় পড়ার সুবাদে মেয়েটার সাথে প্রায়ই দেখা হত। বুকের মাঝে চিনচিনে ব্যথার অনুভুতি অনেকদিন তাড়িয়ে বেড়িয়েছে তাকে। তারপরই ইউটিউবে কন্টেন্ট ক্রিয়েট করতে শুরু করলো। ভাগ্য বেশ সহায়তা করেছে ওকে। অল্পদিনে ওর কন্টেন্টগুলো বেশ জনপ্রিয়তা পেল। ধীরে ধীরে ব্যস্ততা বাড়লে মেয়েটার স্মৃতি ফিকে হতে শুরু করে। এরপর আর কারো দিকে ফিরে তাকায়নি রিফাত।

সেদিন কি হয়েছিল কে জানে। শোভা মেয়েটাকে দেখে চোখ আঁটকে গেছিল। ভীতসন্ত্রস্ত মেয়েটাকে দেখে মনের কোনে খানিকটা মায়া আর ওর অতীত শুনে কিছুটা আগ্রহ জেগেছিল। সত্যি বলতে প্রথমদিন কথা বলে ভালো লেগে গেছিল। কিন্তু তারপর কি সব ভজঘট লেগে গেল। রিফাতের মনটা খারাপ থাকে আজকাল। বারবার মনেহয় মেয়েরা তাকে পছন্দ করে না। প্রথম প্রেমিকার মত শোভাও তাকে একপ্রকার এড়িয়ে চলছে। এজন্যই মনে মনে ভীষণ অপমানিত বোধ করে রিফাত। জানতে মন চায়, কেন মেয়েরা তাকে পছন্দ করে না? কোথায় কমতি তার? দেখতে শুনতে ভালো। উচ্চতা পাঁচ ফিট পাঁচ, গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামবর্ন, চেহারা কাটিংও বেশ আকর্ষনীয়। জনপ্রিয় ইউটিউবার। টাকা পয়সার কোন সমস্যা নেই। তাহলে সমস্যাটা কোথায়?

★★★

“কি সুন্দর লাগছে তোমাকে আপু?”
ছোট বোন বিভা মুগ্ধ হয়ে বোনকে দেখলো। লাল রঙের সাধারণ একটা তাঁতের শাড়ি পরেছে শোভা আর তাতেই ওকে ভীষণ অন্যরকম লাগছে। আসলে জীবনে দ্বিতীয়বারের মতো শাড়ি পরলো সে। প্রথমবার পরেছিল স্কুলের এসএসসি শিক্ষার্থিদের বিদায় অনুষ্ঠানে। আর এই দ্বিতীয় বার। বোনের কথা শুনে শোভা আয়নায় নিজেকে দেখলো। খুব একটা পার্থক্য খুঁজে পেলো না। অবশ্য নিজেকে সুন্দর দেখার মন মানসিকতা ওর নেই। বিয়ের ব্যাপারটাই তো মন থেকে মেনে নিতে পারছে না। ভালো লাগা খারাপ লাগায় কি আসে যায়? ও চুপ করে রইলো।
“আজ তোমাকে পছন্দ না করে ফিরতে পারবে না কেউ।”
শোভাকে সাজিয়ে দিচ্ছে বিভা। ও বয়সে শোভার ছোট হলেও সাজগোজে এক্সপার্ট। চোখের কাজল টানতে টানতে কথাগুলো বলে সে। শোভা মুর্তির মতো নিশ্চুপ বসে আছে। বোনকে কথা বলতে না দেখে বিভা চুপ করে গেলো। দশমিনিট পরে শোভার গায়ে টোকা দিল-“দেখতো কেমন লাগছে?”
শোভা চোখ খুলে আয়নায় তাকায়। বড় বড় কাজল টানা আঁখি আর হালকা লালচে লিপস্টিক এ শোভা নিজেকে চিনতে পারে না। বিভ চোখ নাচায়-“কি? কেমন সাজিয়েছি?”
“ভালো।”
ঠান্ডা গলায় জবাব দিলো। বিভা ওকে জড়িয়ে ধরে-“আঙ্কেল খুব ভালো মানুষ। কয়েকবার এসেছে আমাদের বাসায়। তাছাড়া আঙ্কেলের ছেলেটা আরও ভালো মানুষ। দেখতে বেশ হ্যান্ডসাম আছে। তোমার তাকে পছন্দ হবে।”
শোভা ভ্রু কুঁচকে তাকায় বোনের দিকে। বিভা মিটিমিটি হাসছে। শোভা গম্ভীর হয়ে জানতে চাইলো-“তুই দেখেছিস?”
“হুমমম।”
“তোর পছন্দ হলে বাবাকে বলি তোর সাথে বিয়ে দিক।”
কথাটা শোনা মাত্রই বিভার মুখে আঁধার নেমে এলো-“ছিহ আপু! এভাবে বলতে পারলে? আমি তোমার ছোট বোন তাছাড়া এখনো মাইনর আপু। এসব পঁচা কথা কেন বলছো? আর এখনো এত জেদ কেন তোমার? তোমার জন্য আমরা সবাই কষ্ট করছি তবুও তোমার ভাব কমে না। আসলে তুমি একটা স্বার্থপর মানুষ।”
বিভা চলে গেল। শোভা ধপ করে বিছানায় বসলো। তার ছোট বোনও আজ কথা শুনিয়ে গেলো? এই ছিল ভাগ্যে? যার জন্মের পর সে সবচেয়ে খুশি হয়েছিল, যার খিদে লাগলে শোভা ছুটে এসে কোলে নিয়ে কান্না থামাত সেই বোনের কাছেও আজ সে খুব স্বার্থপর বনে গেল? শোভার হৃদয়ে ভাঙচুর হয়, নয়ন থেকে নোনাজল গড়িয়ে পড়ে। কেন তার ভাগ্যটা এমন হলো? কোন দোষে আর কার ভুলে?

ঘন্টা খানেক পরেই শোভার ডাক পড়লো।
“আপু চলো, তোমাকে ডাকছে।”
বিভা অন্যদিকে তাকিয়ে কথাগুলো বললো। ওর মুখটা তখনও মলিন হয়ে আছে। শোভার ইচ্ছে হলো বিভাকে সরি বলতে কিন্তু বিভার আচরণ দেখে সাহস হলো না। মাথায় ঘোমটা টেনে বেড়িয়ে এলো। মাথা নিচু করেই সবাইকে সালাম দিলো।
“ওয়ালাইকুম আসসালাম মা। কেমন আছো তুমি?”
গোলাম রসুল আন্তরিক গলায় সালামের উত্তর দিলেন।
এদিকে পাশে বসে থাকা রিফাত ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে উত্তেজনায়। নিজের নয়নদ্বয়কে এক পশলা ডলে নিলো। কুলকুল করে ঘামছে শোভাদের ছোট্ট ড্রইং রুমে এ বসে। সত্যি কি তার সামনে শোভা দাঁড়িয়ে আছে? ভুল দেখছে নাতো? চোখকে বিশ্বাস হতে চায় না বলে হাতে চিমটি কাটে। বেশ ব্যাথা পেলেও আওয়াজ করলো না।
“তোমার কি হলো রিফাত? দাঁড়িয়ে গেলে কেন?”
নামটা শোভার কানে পৌঁছামাত্রই সে ঝট করে সামনে তাকায়। সাথে সাথে তার নেত্র দ্বয় বড় বড় হয়ে গেলো।
“শোভা, বসো মা। দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না।”
গোলাম রসুল নির্দেশ দিতেই শোভা কলের পুতুলের মতো বসে পড়লো। ওর দেখাদেখি রিফাতও। রোকেয়া টুকটাক প্রশ্ন করে যাচ্ছে শোভাকে। শোভা সেসব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে ছোট ছোট শব্দে। ওর মাথায় চিন্তার ঝর। রিফাতের সাথে বিয়ের কথাবার্তা কি কেবলই কোইন্সিডেন্স? নাকি ভাগ্য ওকে নিয়ে খেলছে? রিফাতের পরিবার কি জানে ওর অতীত? নার্ভাস শোভার পা কাঁপছে। অতীত জানলে নিশ্চয় বিয়েটা হবে না? সেকেন্ডের জন্য ওর মুখে হাসি এসে মিলিয়ে গেল। বাবা টের পেলে কি হবে? ভাবনায় দাড়ি টানলো শোভা।
“তুমি কি আলাদা কথা বলবে রিফাত? ওর কাছে কিছু জানার আছে? চাইলে জিজ্ঞেস করতে পার।”
“আমার কিছু জানার নেই বাবা। তোমার সিদ্ধান্তই আমার সিদ্ধান্ত।”
রিফাতের কথায় আবারও মাথা তুলে ওকে দেখলো শোভা। রিফাত লোচনদ্বয় লুকিয়ে নিতে মাথা নিচু করে।
“তাহলে শুভ কাজে দেরি কিসের? রোকেয়া তুমি কি বলো?”
“আমারও একই কথা।”
“আলহামদুলিল্লাহ। তাহলে তাই হোক। কি বলিস আজমল?”
গোলাম রসুলের কথায় আজমল শেখের নেত্রদ্বয় খানিকটা ভিজে উঠেছে। মেয়েটাকে নিয়ে এতোদিন যে দু:শ্চিতায় ছিলেন আজ তা দূর হয়ে গেলো। যে মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে চোখে অন্ধকার দেখেছে আজ তাকে এত ভালো পাত্রের হাতে সমার্পন করতে পারছে বাবা হিসেবে এর চাইতে আনন্দের আর কিছু হয় না। আজমল শেখ উঠে এসে বন্ধুর হাত ধরলেন-“তুই আমার বুকের উপর থেকে অনেক বড় পাথর নামিয়ে দিলি বন্ধু। তোকে কি বলে যে ধন্যবাদ দেব।”
“আরে, এসব কি কথা? তুই আমার বন্ধু। আমার ছেলের জন্য তোর মেয়ের চাইতে ভালো আর কাকে পাবো। তুই বরং আমার অনেক বড় চিন্তা দূর করে দিলি।”
দুই বন্ধু কোলাকুলি করলেন।
“শোভা মা, আমাদের পাশে এসে বসো।”
রোকেয়া শোভাকে ডাকলেন।
“রিফাত, নে আংটিটা ধর। শোভার হাতে পরিয়ে দে।”
গোল্ডোর উপর লাল রঙের তিনটি পাথর জুলজুল করছে। রিফাত আংটিটা হাতে নিলো। গোলাম রসুল তাড়া দিলেন-“রিফাত, দেরি করছিস কেন? পরিয়ে দে তাড়াতাড়ি।”
সাজেদা পাশ থেকে শোভার হাত বাড়িয়ে দেয়। লম্বা সরু আঙুলগুলো ভারি মিষ্টি লাগছে দেখতে। রিফাত অনেকটা সময় তাকিয়ে রইলো। বুকটা অকারণে ঢিবঢিব করছে। তার জীবনে এইরকম কিছু ঘটবে কখনো কি ভেবেছিল? রিফাত খুব যত্ন নিয়ে আংটিটা শোভার হাতে পরিয়ে দিয়ে শোভার মুখের উপর দৃষ্টিপাত করে। ঠিক সেই সময় শোভা তাকালো তার দিকে। দু’জনই দু’জনার চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে রইলো নির্নিমেশ।

চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন