আবার এলো যে সন্ধ্যা পর্ব-০৮

0
163

#আবার এলো যে সন্ধ্যা
পর্ব-৮

পরের দিনই শোভা জোর করে হলে ফিরে এসেছে। মায়ের হাজারো জোরাজোরিতে কাজ হয়নি। আজমল শেখ স্ত্রীকে থামালেন-“যেতে দাও ওকে।”
শোভা থমকে গেল বাবার কথা শুনে। আজমল শেখ ডাকলেন মেয়েকে-“শোন শোভা, আমি জানি বিয়েতে তোমার মত নেই। তবে জেনে রেখ বাবা হিসেবে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি। একসময় হয়তো বুঝবে তুমি। তোমার কাছে অনুরোধ রইলো, আগামী তিনমাস অন্তত চলাফেরায় সংযত হয়ে থাকবে। তুমি এখন অন্য বাড়ির আমানত। দুই বাড়ির মানসন্মান জড়িয়ে আছে তোমার সাথে। কাজে ভুলেও এমন কিছু করবে না যাতে আমাদের মাথা নত হয়। বন্ধু অনেক ভরসা করে তোমাকে তার পুত্র বঁধু করেছে। তুমি আমার বন্ধুর কাছে আমার মান রাখবে এটাই এখন তোমার কাছে আমার একমাত্র চাওয়া। ধরে নাও, সন্তান হিসেবে বাবার স্নেহ মমতার ঋণ শোধ করছো।”
শোভা দাঁতে ঠোঁট চেপে প্রানপণে কান্না নিবারনের চেষ্টা করছে। কতদিন পরে বাবা তার সাথে এতগুলো কথা বললো। এই বিয়ে করে যদি বাবার মাফ পাওয়া যায় তাহলে হাসিমুখে এই বিয়ে করতে প্রস্তুত সে। বাবার জন্য হাসিমুখে বিষ পান করতে রাজি সে। আর এতো সামান্য বিয়ে করা। শোভা জবাব দিতে পারে না। মাথা দুলিয়ে ব্যাগ হাতে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে। আপাতত গন্তব্য ইউনিভার্সিটি। মাথাটা ফাঁকা হয়ে আছে একদম। রিফাত তার অতীত জানে তবুও কেন বিয়েতে রাজি হলো? সে কি দয়া করছে তাকে? সবচেয়ে বড় প্রশ্ন রিফাতের পরিবার কি জানে তার অতীত? বাবা কি বলেছে তার বন্ধুকে?

পাত্রী হিসেবে শোভা অসাধারণ। দেখতে শুনতে মোটামোটি ভালো, ভালো ছাত্রী, নম্রভদ্র, পারিবারিক স্ট্যাটাস ভালো ছিল। শুধু অতীতের ঘটনা না থাকলে হয়তো এতোদিনে পাত্রের লাইন লেগে যেত। কিন্তু এই এক জায়গায় হেরে গেছে শোভা। একটা কারণে তার বাকীসব গুন উহ্য হয়ে গেছে। একটা ভুলে ভরা অতীত তার গোটা জীবন এলোমেলো করে দিয়েছে। এখন প্রতি পদে পদে হোঁচট খাওয়া। কিন্তু তবুও নিজেকে সেই সব মানুষের কাতারে দেখতে চায় না যাদের মানুষ বাটপার বলে। সে চায়না কোন মিথ্যে দিয়ে তার জীবন শুরু হোক যা পরবর্তীতে জীবনে ঝড় তুলবে। ওর ঘটনা বাবা যদি তার বন্ধুকে না জানিয়ে থাকে তাহলে ওর দায়িত্ব জানিয়ে দেওয়া। শোভা মনে মনে ঠিক করলো, তার ঘটনা যেভাবেই হোক রিফাতের বাবা মায়ের কানে তুলবে। ভাবনাটা ওকে বেশ সস্তি দিলো। সিদ্ধান্ত নিতে পেরে মন হালকা লাগছে তার।

★★★

“ভাইয়া, এটা কি হলো? পরীক্ষার পর বাড়িতে গেলাম আর তুমি বিয়ে করে নিলে? দিস ইস নট ফেয়ার। আমাদের কি তোমার বউ দেখার হক নেই?”
আদৃতা বাড়িতে গেছিল পরীক্ষার পর। আজই ঢাকায় ফিরেছে। আর ফিরেই রিফাতের এনগেজমেন্ট এর খবর পেলো। তাতেই হইচই লাগিয়ে দিয়েছে। রিফাত হাত উঁচিয়ে সারেন্ডার করলো-“আমি কিছু জানি না। বাবা যা বলেছে সেটাই করেছি। আমি নিজেও কি জানতাম নাকি?”
“বাব্বাহ, তুমি কবে থেকে চাচ্চুর ইনসট্রাকশন শুনছো বলো তো? কাহিনি কি?”
“কোন কাহিনি নেই ডিয়ার সিসি। বাকী তোমার চাচ্চুকে জিজ্ঞেস করো কি কাহিনি। তাছাড়া, কেবল আংটি বদল হয়েছে। বিয়ের দেরি আছে এখনো। এতো উতলা হোস না। তুই বিয়ে খেতে পারবি।”
আদৃতার তবুও মন খারাপ হয়ে গেলো। একটা অনুষ্ঠান মিস করে ফেললো সে।
“আচ্ছা বেশ, অনুষ্ঠানে না হয় থাকতে পারলাম না। বউয়ের ছবি তো দেখাও।”
রিফাতের তখন মনে পড়লো ওর মোবাইলে ওদের কোন ছবি তোলা হয়নি। শোভাকে দেখতে কি সুন্দর লাগছিল অথচ ওর ছবি নেই তার কাছে। তাছাড়া বাবা ছবি তোলায় অনিহা দেখালেন। বললেন ছবি তোলার দরকার নেই। এখন কাউকে বলারও দরকার নেই। বিয়ের ডেট কাছিয়ে আসুক তারপর কার্ড ছাপিয়ে ঘটা করে দাওয়াত দেবেন সবাইকে। এমনকি রিফাতকে মানা করেছে এঙগেজমেন্টের ব্যাপারে ওর বন্ধুদেরও বলতে মানা করেছে। সত্যি বলতে বাবার কথা শুনে রিফাত বেশ অবাক হয়েছিল। এ আবার কেমন কথা। তার বিয়ে হবে মানুষ জানবে না? ওর মাথাতেই ঢুকলো না বাবা কেন গোপনীয়তা দেখাচ্ছে। ও মাথা চুলকে আদৃতাকে দেখলো-“সরি রে আমার কাছে কোন ছবি নেই। ছবি তোলা হয়নি খুব একটা। তোড়ার কাছে দেখ আছে কিনা।”
আদৃতা আকাশ থেকে পড়লো যেন-“কি বলছো ভাইয়া। ছবি কেন তোলনি?”
“বাবার নিষেধ অমান্য করি কি করে?”
“আচ্ছা তাহলে দেখা করিয়ে দাও একদিন।”
“আচ্ছা। কিছুদিন যাক তারপর। আমি নিজেই তো তাকে দেখিনি ঠিকঠাক। নিজে আগে দেখি, পরিচিত হই তারপর তোদের সাথে আলাপ করিয়ে দেব।”
“তুমি দেখছি নানী দাদীর আমলের বিয়ে করতে যাচ্ছ। হিহিহি।”
আদৃতার হাসি দেখে রিফাতও হেসে দিলো-“কথা খুব একটা ভুল বলিসনি।”
চোখের সামনে শোভার কঠিন মুখশ্রী ভেসে উঠলো। শোভার কথা ভেবেই রিফাতের ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসির আভা। মেয়েটাকে একটা সারপ্রাইজ দেওয়া দরকার। এখন নিশ্চয়ই দূর দূর করে তাড়িয়ে দেবে না। আজই যাবে নাকি ওর বাসায়? নাহ, বাসায় যাওয়া যাবে না। ওর বাবা মা আবার কি ভাববে। বেহায়া ভাবে যদি? ওকে ফোন করে অন্য কোথাও আসতে বললে কেমন হবে? কিন্তু ফোন করবে কিভাবে? ওর নাম্বারই তো নেই কাছে। ভাবনার মাঝে ডুবে থেকে মনে পড়লো ভাবি বউয়ের নাম্বার না থাকলেও শালীর নাম্বার আছে। তাকে একটা ফোন দেবে কি? নাহ থাক। তাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে। পরক্ষণেই ভাবলো, হাসলে হাসুক তার কি? সে তার বউয়ের সাথেই তো কথা বলতে চেয়েছে। এতে তো দোষের কিছু নেই। রিফাত আনমনা হয়ে উঠে যায়। আদৃতা বারকয়েক ডাকলো ওকে কিন্তু শোভার ধ্যানে থাকায় কিছু শুনতে পেলো না।

★★★

আননোন নাম্বার থেকে ফোন আসছে বারবার। মন দিয়ে পড়ছিল, বারবার ফোনে পড়ায় ব্যাঘাত ঘটছে। পড়ার মাঝে ফোন এলে শোভা রিসিভ করে না। পরে সময় বুঝে কল ব্যাক করে। এখনও তাই করছিলো ফোন কেটে দিচ্ছিলো। কিন্তু তারপর ওপাশের জন ভীষণ অস্থির হয়ে ফোন দিয়েই যাচ্ছে। বিরক্ত শোভা রেগেমেগে অস্থির হয়ে ফোন ধরলো-“কে? কাকে চাই? এতবার ফোন দেওয়ার মানে কি? কেটে দিচ্ছি মানে বুঝতে হবে ব্যস্ত আছি এই সাধারণ কমনসেন্স নাই?”
ওপাশের জন একদম নীরব। পিনপতন নীরবতা যেটাকে বলে। এরকম ধমক সে আশা করেনি হয়তো। শব্দ না পেয়ে শোভার মেজাজ আরও বিগড়ে গেলো-“কি এখন কথা নেই কেন? মুখে তালা লাগিয়েছেন তো ফোন কেন করেছেন?”
“এভাবে ধমক দিলে কি কারো সাহস হবে কথা বলার?”
রিফাতের শান্ত কন্ঠস্বর শুনে চমকে উঠলো শোভা-“কে? কে বলছেন?”
“চিনতে পারছো না সত্যি?”
“নাহ। পরিচয় দিন প্লিজ না হলে ফোন কেটে দেব।”
“দাও কেটে দাও। যে মেয়ে তার হবু বরের ভয়েজ চেনে না তার সাথে কথা নেই কোন।”
শোভা ফট করে ফোন কেটে দিলো। তার বুক ধুকপুক করছে। এই ছেলে আচ্ছা বেহায়া তো? এনগেজমেন্ট হতে না হতেই ফোন দেওয়া শুরু করেছে? কি ভেবেছে কি? এখন বিয়ে ঠিক হয়েছে বলে শোভা কথা বলবে? প্রেম প্রেম ভাব দেখাবে? কখনোই না। শোভা ফোন সাইলেন্ট করে রাখে। তাতেও নিস্তার নেই। ফোনটা অনবরত ভাইব্রেশন দিচ্ছে। বিরক্ত শোভা কল রিসিভ করে।
“আমি বললাম তাই কল কেটে দিলে? অভিমানও বোঝ না মেয়ে। এতো নিষ্ঠুর কেন তুমি?”
উফফ ন্যাকামো দেখ ছেলের। রাগে শোভার পিত্তি জ্বলে গেলো। নাকের পাটা ফুলে ফুলে উঠছে। সে ঠান্ডা গলায় জানতে চাইলো-“কি চাই সেটা বলুন। কেন ফোন দিয়েছেন?”
“প্রেম করতে। এখন তো লিগ্যাল অনুমতি আছে। আর কোন ছুতো দিতে পারবে না তুমি।” রিফাতের কন্ঠে কৌতুকের রেশ। না চাইতে শোভার গাল দু’টো লাল হলো। কেমন নির্লজ্জ মানুষ। রিং পড়িয়ে যেন মাথা কিনে নিয়েছে।
“ওসব পঁচা কাজ আমি করি না।”
শোভা কোনরকমে গলা বাঁচিয়ে উত্তর দিলো। রিফাত এবার গম্ভীর স্বরে হুকুম জারি করলো-“এতো কথা শুনতে চাই না। আমি তোমার হলের সামনের রাস্তায় গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। তাড়াতাড়ি চলে এসো। দশ মিনিট সময়। না হলে কিন্তু…”
ইসস ঢং কতো! তুমি তুমি করা হচ্ছে আবার হুকুম জারি করছে যেন আমি তার দাসী। শোভা মনে মনে কয়েকটা গালি দিলো রিফাতকে। মুখে বললো-“না হলে কি করবেন শুনি?”
“শোন মেয়ে আমাকে গালি দেওয়া বন্ধ করে তাড়াতাড়ি নিচে নামো। নয়তো এখনই তোমার বাবার কাছে ফোন যাবে বলে দিলাম। তোমার দশ মিনিট এখন শুরু হচ্ছে। টিক টিক এক টিক টিক দুই…”
শোভার বুকের মধ্যে ধরাস ধরাস শব্দ যেন এখনই কলিজা বেড়িয়ে আসবে। আশ্চর্য! এমন হচ্ছে কেন ওর সাথে? এই ছেলেকে কেন এতো ভয় পাচ্ছে?

চলবে—
©Farhana_Yesmin