আমায় একটু ভালবেসো পর্ব-১+২

0
407

#আমায়_একটু_ভালবেসো
#জান্নাতুল_ফেরদৌস_কেয়া

নিজের ভালবাসার মানুষকে বিয়ে করছে আমারি আপন ছোট বোন। তাও আবার আমার সামনে।ক ষ্টে যেন বুকটা ফে টে যাচ্ছে। তবুও হাসি মুখে মেনে নিচ্ছি সব। কী আর করব? একতরফা ভালবাসা গুলো বোধহয় এমনই হয়।
যার সাথে আমার ছোট বোনের বিয়ে হচ্ছে। সে আমাদের কলেজের প্রফেসর আদনান রহমান। যেদিন আমি আর পর্ণা কলেজে ভর্তি হই, সেদিনই প্রেমে পড়ি আদনান স্যারের। গ ম্ভী র, আর সল্পভাষী আদনান স্যারকে যখন প্রথম দেখি। সেদিনই থমকে গিয়েছিলাম। সতরো বছর বয়সে সেদিন উপলব্দি করি আমি প্রেমে পড়েছি। মা রা ত্মক ভাবে প্রেমে পড়েছি। আস্তে, আস্তে সেই প্রেম বাড়তে থাকে।একসময় তা ভালবাসাতে পরিণয় হয়। সবসময় চুপচাপ আর একা থাকার কারণে, কোন বন্ধু বান্ধব ও ছিল না আমার। তাই কখনো কারো কাছে বলতে পারতাম না, যে আমি আদনান স্যারকে ভালবাসি। পর্ণার সাথে আমার সম্পর্ক কখনোই ভাল থাকতো না ।সে আমার দু মিনিটের ছোট। আমরা জমজ হয়েছিলাম। কিন্তু পর্ণা আর আমি সম্পূর্ণ আলাদা। দুজনেই সুন্দর তবে চেহারার কোনো মিল নেই। অনেকেই বলে আমার থেকে নাকি পর্ণাকে বড় লাগে। আসলেই তাই। ভালো স্বাস্থের অধিকারী হওয়ায়, পর্ণাকে একটু বেশিই ভালো লাগতো।

,,এই অর্ণা!এখানে কি করছিস? ঐদিকে তো পর্ণাকে সাজাতে হবে নাকি।চল তাড়াতাড়ি। বরপক্ষ তাড়াহুড়ো করছে। বলছে এখনো সাজানো হয়নি কেন?
মেঝো ফুফুর ডাকে ধ্যান ভা ঙে আমার।
আড়ালে চোখের পানি গুলো মুছে ওঠে দাঁড়ালাম। মিথ্যা হাসির হেসে বললাম,
,হ্যাঁ চলো ফুপি।
,একি তোর চোখ ওমন লাল হয়ে আছে কেন?কান্না করছিলি বুঝি?কেন রে মা বল আমাকে। কী হয়েছে তোর?
আমি ভড়কে গেলাম। কোনভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,
,নাহ ফুপি তেমন কিছু না। পর্ণার জন্য মন খা রা প হচ্ছিল। তাই,,
ফুপির মন গলে গেল । জড়িয়ে ধরে বলল,
,মন খা রা প করিস না পাখি। মেয়েদের জন্মই হয় পড়ের ঘরে যাবার জন্য। এটাই জগৎের নিয়ম।আমরা তো চেয়েছিলাম আগে তোর বিয়ে দেব তারপর পর্ণার।কিন্তু মেয়েটা তো আর সেই সুযোগ দিল না। আর এদিকে তুইও লেখাপড়া করবি। যাকগে ওসব কথা বাদ দে এখন চল তাড়াতাড়ি।
এই বলে ফুপি আমার হাত ধরে নিচে নিয়ে গেল।
পর্ণার রুমে ঢুকতেই। সে আমার দিকে তাকিয়ে পৈশাচিক একটা হাসি দিল। তারপর মিছে কান্নার অভিনয় করে বলল,
,কোথায় ছিলি অর্ণা? আমি তোকে সেই কখন থেকে খুঁজছি জানিস। তোর জন্য আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি চলে গেলে তুই একা থাকবি কিভাবে?
এই বলে পর্ণা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর ফিসফিস করে বলল,
,কেমন চমক দিলাম মিস অর্ণা আহমেদ। তুই কি ভেবেছিলি। আমি তোর আর আদনানের বিয়ের জন্য বাবাকে বলছিলাম। মূর্খ মেয়ে। তুই যে আদনানকে পছন্দ করিস। তা আমি আগে থেকে জানি।আর তুই তো জানিস। তোর পছন্দের জিনিস কেড়ে নেয়া। আমার অন্যতম শখ। তাই বেহায়ার মতো বাবাকে নিজের বিয়ের কথা বলেছি।হুহ্ কেমন লাগছে এখন? বুঝবি এখন কষ্ট কাকে বলে।সবসময় ভালো রেজাল্ট করে। ভালো কাজ করে বাবা-মা ফুফু কাকাদের মধ্য মণি হয়ে থাকতি।তোর জন্য কেউ আমাকে ভালবাসতো না সবাই আমাকে গাল মন্দ করতো।সবকিছু আমি চুপচাপ স হ্য করেছি। শুধু আজকের জন্য। আজ থেকে তোর সব সুখ আমি কেড়ে নিলাম অর্ণা। আজ থেকে তুই বুঝবি ভালবাসা না পাওয়ার কষ্ট কী!
পর্ণার কথা শুনা মাত্র আমার মনে হলো আশেপাশে কোথাও হয়তো বা জ পড়েছে। অবাক চোখে তার দিকে তাকালাম। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম। একটা কথায় শুধু মাথায় ঘুরছিল।কেউ কি করে এতটা বিশ্বাস ঘা ত ক হতো পারে।
,এই মেয়েরা কি করছিস তোরা? হ্যাঁ। ঐদিকে যে তাড়া দিচ্ছে। এই অর্ণা ওকে তাড়াতাড়ি সাজিয়ে দে তো। অনেক হয়েছে দু বোনের কান্নাকাটি। এবার থাম্।
বলেই ফুপি তাড়া দিল।পর্ণা আমার হাত ধরে নিয়ে খাটে বসালো। তারপর আমার দিকে ঝুঁকে কানে,কানে বলল,
,ভালো করে সাজাবি আমাকে অর্ণা।যেন আদনান আমার থেকে চোখ ফেরাতে না পাড়ে। আর যদি খা রা প হয়। তাহলে আমি সবাইকে বলব যে,তোর আগে আমার বিয়ে হচ্ছে বলে তুই হি ং সা করছিস।
আমার যেন আজ অবাক হওয়ার পালা। নিজের আপন বোন যে এতো খা রা প হতে পারে তা জানা ছিল না।কি না করেছি ওর জন্য। এতদিন এসব গল্পে শুনে এসেছি। কিন্তু আজ স চোখে দেখলাম।

শখের বশে পার্লারের কাজ শিখেছিলাম। হাত ও বেশ ভালো ছিল।তাই পর্ণা না করেছে পার্লারের লোক আনতে।ভেবেছিলাম আমার হাতে সাজার ইচ্ছে বুঝি ওর। কিন্তু এখন বুঝলাম কেন এই আবদার।আমি মুচকি হেসে সাজানো শুরু করলাম। নিজের সর্বোচ্চ টা দিয়ে পর্ণাকে সাজিয়ে দিলাম।সত্যি আজ পর্ণাকে দারুণ লাগছে। চোখ ফেরানো যাবে না এমন সুন্দর।

বিয়ে পড়ানো শেষ। এখন বিদায় পালা। পর্ণাকে সাজিয়ে সেই যে আমি আমার রুমে এসেছি। আর বের হয়নি। চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়ছে। এ য ন্ত্র ণা স হ্য করার ক্ষ মতা আমার নেই। যাকে এতদিন ভালোবেসে এলাম। সে আজ অন্য কারো হয়ে গেছে। কই আদনান স্যার তো এমন ছিল না। আমি যখন তার চোখে চোখ রাখতাম। তার চোখ তো অন্য কথা বলতো। মেয়েদেরকে কেউ যদি ভালবাসে। তবে তারা নাকি বুঝতে পারে। তবে কী আমার বুঝার মধ্যে ভু ল হয়েছে।
,এই অর্ণা। কই তুই? দরজা খোল।পর্ণাকে ওরা গাড়িতে তুলছে। মেয়েটা দেখতে চাইছে তোকে!

#চলবে,,,

#আমায়_,একটু_ভালবেসো
#জান্নাতুল_ফেরদৌস_কেয়া

(২)

,,পর্ণার বিদায় পালা শেষ। সব আত্মীয় স্বজনের তাদের বাড়ি ফেরার জন্য পায়তারা করছে। আমি ছাঁদে ওঠে এলাম। এই জায়গাটা নিরিবিলি। মানুষজন নেই। ছাঁদের ওপাশটাই একটা দোলনা আছে। আমি গিয়ে সেখানে বসে পড়লাম। এই জায়গাটা আমার ভিষণ প্রিয়। যখনই মন খা রা প হয় তখনই চলে আসি।
আমি দোলনায় হেলান দিয়ে বসে পড়লাম। বড্ড ক্লান্ত লাগছে। চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলাম ফেলে আসা দিনগুলো।
,যেদিন প্রথম আদনান স্যারকে দেখি সেদিন ছিল বৃষ্টি। আমি আর পর্ণা কোনরকমে কলেজে পৌঁছায়।কলেজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমরা যখন কাপড় ঝারছিলাম।তখনই বৃষ্টিতে দৌড়ে আসতে দেখলাম স্যার কে।প্রথমে আমি গুরুত্ব দেয়নি।কিন্তু যখন আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালো,তখনই আমি অবাক হয়ে যায়। স্যার কাপড় থেকে পানি ঝারতে,ঝারতে হেসে বলল,
,কি অবস্থা মেয়েরা?
ব্যস এটুকু কথাতেই আমি ঘায়েল হয়ে যায়। তার হাসি,গালে পড়া টোল,শ্যামবর্ণের চেহারা।সেদিন তার করা প্রতিটা আচরণে মুগ্ধ হয় আমি।
তারপর
থেকে শুরু হয় কথা বলা দেখা হওয়া। বছর না ঘুরতেই স্যারকে রাখা হয় আমাদের প্রাইভেট টিচার হিসেবে। সেদিন যে কি খুশি হয়েছিলাম। তা ভাষায় প্রকাশ সম্ভব নয়। মনে মনে ভাবি যে এবার স্যারকে বলব। আমার মনের কথা। যেই ভাবা সেই কাজ।বসে পড়লাম চিঠি লিখতে। কিন্তু খাতার সব কাগজ শেষ হয়ে গেল কিন্তু, আমার চিঠি লেখা আর হলো না। পর্ণার সাথে আমার কখনোই ভালো সম্পর্ক ছিল নাই। তাই তাকে বলার মতো সাহস করতে পারছিলাম না। তারপর একদিন পর্ণা গেল বাবার কাছে আদনান স্যারের নামে কি যেন বলতে। আমি ভেবেছিলাম পর্ণা বোধহয় কোনোভাবে আমার মনের কথা জানতে পেরেছে। তাই বাবাকে বোঝাতে গিয়েছে। সেদিন লজ্জায় ওঠে চলে এসেছিলাম।কিন্তু পড়ে যা হলো তা মেনে নেয়ার মতো না।

এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখ লেগে গেছে বুঝতে পারিনি। যখন চোখ খুললাম চারিদিকে তখন গুটগুটে অ ন্ধ কার। শরীরে এক ফোটা শ ক্তি পাচ্ছি না। দুদিন ধরে না খাওয়ার কারণে শরীর ভিষণ দূর্ব ল। আমি আরো কিছুক্ষণ এভাবেই বসে রইলাম। হঠাৎ কারো পায়ের শব্দ পেলাম। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। অ ন্ধ কারে কিছু দেখতে পেলাম না।
,এখানে কি করছিস মা?
কন্ঠ শুনে বুঝলাম এটা ছোট বাবা।তাকে দেখে মুচকি হাসলাম । দোলনার এক কোনে সরে গিয়ে বসার জায়গা করে দিয়ে বললাম,
,তেমন কিছু না। আকাশের তারা দেখছি।
,ওহ্ ভালো!একটা কথা বলব অনি?
,হ্যাঁ বলো না।
,না মানে,,তোর কি কোনো বিষয় নিয়ে মন খা রা প? কয়দিন ধরেই দেখছি তুই কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছিস। কিছু কি হয়েছে? আমাকে বল মা। তুই তো আগে এমন ছিলি না?
আমি দীর্ঘ শ্বাস ফেললাম। জীবনটা আর আগের মতো নেই । কিন্তু এটা ওদের কে বলবো কীভাবে।আমরা যৌথ পরিবার। এখানে একজনের মন খা রা প হলে অন্য জন তা ঠিকই ধরে ফেলে। এখানে মন খা রা প করা বারণ।
আমি কিছু বলার জন্য উদ্যেৎ হবো। তার আগেই বাবার আগমন ঘটে।
,কি হচ্ছে এরেখানে? দুই কাকা-ভাতিজী মিলে কি নিয়ে গল্প করছিস তোরা?
,এইতো ভাই ও এসেছো।দেখ না অর্ণা কেমন যেন হয়ে গেছে আজকাল। মন ম রা হয়ে বসে থাকে। কারো সাথে ঠিকমত কথাও বলে না।
,তাই নাকি! আমি তো খেয়াল করিনি। আসলে তিন-চার দিন ধরে পর্ণার বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত। তাই আর নজর দিতে পারিনি। তা অর্ণা মা কি হয়েছে বলো তো?
আমি মলিন হাসলাম।
,না বাবা। তোমরা ভুল বুঝতেছো। আমি একদম ঠিক আছি।
,এই মেয়ে। একদম মি থ্যা বলবি না। সেই ছোট থেকে তোকে কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছি। আমাদের কে শেখাতে এসেছিস। যে তুই ঠিক আছিস!
,আহ্ ছোট বাবা তেমন কিছুই নয়,,
,অর্ণা। কি হয়েছে আমাদের খুলে বল। কেউ কি তোমায় কোনো কটু কথা বলেছে। তাহলে আমাদের কে বল।নয়তো বুঝবো কিভাবে?

বাবা আর ছোট বাবা হৈচৈ শুনে বাড়ির প্রায় সকলেই ছাঁদে এসে উপস্থিত হলো। সকলেই উৎসুক হয়ে চেয়ে আছে আমাদের দিকে। মা এসে বলল,
,কি হয়েছে? তোমরা এমন করছো কেন?আর অর্ণা। এতক্ষণ কই ছিলি তুই? খুঁজে,খুঁজে হয় রান হয়ে গেলাম।
,এইতো মা। ছাঁদে বসে ছিলাম।
,তা কি নিয়ে কথা বলছিলি তোরা?
,তেমন কিছু না মা।
,এই মেয়ে একদম মি থ্যা বলবি না। বড় ভাবি তুমি অর্ণাকে জিজ্ঞেস করো তো। ওর কি হয়েছে?
ব্যস এবার সবাই ওঠে পড়ে লাগলো। যে আমার কি হয়েছে তা বলার জন্য। আসলে এই বাড়ির প্রত্যেকেই আমার অতি কাছের মানুষ। এখানে ছোট বড় সবাইকে প্রাধান্ন দেয়া হই। সবার জোড়াজুড়ি তে আমি মুখ খুললাম। তবে তার নাম বললাম না। চোখ বন্ধ করে বলতে লাগলাম,,
,আসলে বাবা-মা। ছোট বাবা -ছোট মা।ফুপিরা, তোমাদের কে আমি মি থ্যা বলতে পারব না। তাই বলছি, আমি একটা ছেলেকে ভালবাসতাম। প্রচন্ড ভালবাসতাম।তোমরা আমাকে খা রা প ভেবো না। কি করে যে তার প্রেমে পড়লাম তা আমি নিজেও জানিনা। আস্তে, আস্তে সেই প্রেম বাড়তে থাকে । কিন্তু তাকে বলার মতো সাহস করতে পারিনি। যখন ঠিক করলাম তাকে আমার মনের কথা বলবো। তখনই সে হারিয়ে গেল। চিরতরে আমার জীবন থেকে চলে গেল। জানো বাবা, তাকে আমি মনে মনে কতশত চিঠি দিয়েছি। কিন্তু সে বুঝতেই পারেনি যে আমি তাকে ভালবাসি।
কথাগুলো বলতে গিয়ে আমার গলা ধরে গেল। চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগলো,,,,

#চলবে,,,,