আমায় একটু ভালবেসো পর্ব-৩+৪

0
326

#আমায়_একটু_ভালবেসো
#জান্নাতুল_ফেরদৌস_কেয়

(৩)

আমার কথা শুনে সবাই বাকরূ দ্ধ হয়ে গেল।বাবা এসে তার বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো। মায়ের চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। তার মেয়ে যে এতদিন কী ক ষ্টের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। তা হয়তো ভাবতেই পারেনি। ছোট বাবা এসে একহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো। ভাঙা,ভাঙা কন্ঠে বলল,
,তুই আগে কেন বলিসনি অনি। নিজের মধ্যে কেন এতো পাহাড় সমান ক ষ্ট পুঁষে রেখেছিস? কী ঐ ছেলের নাম? কোথায় তার বাড়ি? আমাকে বল! এখুনি তাকে এনে হাজির করব তোর সামনে। ওর সা হ স হয় কী করে। তোকে ধোঁ কা দেওয়ার। তুই শুধু নাম বল অনি।
আমি বাবার বুকের সাথেই লেপ্টে রইলাম।
স্মিত হেসে বললাম,
,তার আর প্রয়োজন নেই ছোট কাকা। সে এখন অন্য কারো। তাকে আর আমার চাই না।
আমি মুখ দিয়ে আর শব্দ করতে পারলাম না। তার আগেই জ্ঞা ন হারালাম।

আমি যখন চোখ খুললাম। তখন ভোর হবে বোধহয়। বাহিরে পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ। ডান হাতটা অবশ হয়ে আছে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম। সেখানে ক্যানলা লাগানো। উপড়ে স্যালাইনের প্যাকেট। আমি চোখ খুলেছি দেখেই ছোট মা দৌড়ে এলো।
,এই অর্ণা।তোর জ্ঞান ফিরেছে। কেমন লাগছে এখন? কোথাও কোনো কষ্ট হচ্ছে? ও বড় ভাবি। দেখুন অর্ণার জ্ঞান ফিরেছে।
মা হন্তদন্ত হয়ে রুমে ঢুকলেন। ছোট মায়ের চিৎ কারে বাবার ঘুম ভে ঙে গেল। বাবা আমার পাশেই শুয়ে ছিল। তিনি ওঠেই আমার মাথায় হাত বুলালেন।নরম সুরে বললেন,
,এখন কেমন লাগছে মা?
বাবার কন্ঠ শুনে। আমার চোখ ছলছল করে ওঠলো। আহ্ কী মধুময় ডাক।
মা বাবাকে ধমক দিয়ে বলল,
,আহ্ সরো তো। মেয়েটা সবে মাত্র জ্ঞান ফিরলো। আর তোমরা সবাই জেরা শুরু করে দিয়েছো।মেয়েটা যে দুদিন ধরে না খেয়ে আছে। সেটা মাথায় আছে। দেখি সরো তো। নে মা হা করতো!
আমি আর কথা বাড়ালাম না লক্ষি মেয়ের মতো। খাবার গুলো খেয়ে নিলাম।
খাবার শেষ করে আমাকে বিশ্রাম নিতে দিয়ে । সবাই যে যার ঘরে চলে গেল। আমি চোখ ব ন্ধ করে শুয়ে রইলাম। মনে পড়লো পর্ণার কথা। শশুর বাড়িতে গিয়ে কেমন আছে কে জানে? সুখে থাকারই কথা। নিসন্দেহে আদনান স্যার ভালো মানুষ। পর্ণাকে সুখেই রাখবে।
আমি হাসলাম। আজকাল নিজেকে পা গ ল, পা গ ল লাগে। বুকের ভেতর চিনচিন ব্যাথা হয়। বুকটা খালি,খালি মনে হয়। আগামী দিন গুলো কেমন কা ট বে কে জানে?

বেলা গড়িয়ে বিকেল হলো।আমি আর রুম থেকে বের হলাম না। মা এসে দুপুরের নিজ হাতে খাইয়ে দিয়ে গেছে। আমি শোয়া থেকে উঠে বারান্দায় এলাম। ফুরফুরে বাতাস আমার মন ছুঁয়ে গেল । পড়ন্ত বিকেলের নরম আলো আমার শরীরে এসে লাগল। মনে হলো আমি যেন দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর সুস্থ হলাম।
পাখিরা তার আপন নিড়ে ফিরে যাচ্ছে।আকাশে ধূসররাঙা মেঘেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। কি অপরূপ দৃশ্য।
হঠাৎই চোখ গেল বাগানের দিকে। আয়ান,ইশান,ইরা, মিতু,সবাই মিলে আড্ডা দিচ্ছে। ওরা আমার কাকা তো, জেঠা তো ভাই বোন। আয়ান, আর ইশান আমার সমবয়সী। আর ওরা ছোট।আমি বাগানের দিকে তাকাতেই, মিতু চেঁচিয়ে উঠলো,
,এই অর্ণা আপু নিচে এসো! গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।
,নারে শরীরটা ভালো লাগছে না। তোরা গল্প করো।
,আচ্ছা দাঁড়াও। আমরা আসছি, এই চলো সবাই।
এই বলে সবাই দৌড়ে আমার রুমের দিকে রওনা হলো।
দরজা এসো সবগুলো একসাথে ধাক্কা দিতে লাগলো। আমি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে দরজা খুলে দিলাম। ওমনি সবগুলো হুড়মুড় করে রুমে ঢুকলো। যে যার মতো বসে পড়লো।
,এই অর্ণা আপু কাল তোমার কী হয়েছে বলো তো?এত রাতে ডাক্তার এসেছিল। আর কয়দিন ধরেই দেখছি তুমি কেমন জানি হয়ে গেছ।(ইরা বলল)
,আরে! অর্ণা শাকচু ন্নি কার প্রেমে যেন হাবুডুবু খাচ্ছিল। কিন্তু সেই ব্যাটা অর্ণাকে ছেঁকা দিয়ে। অন্য কাউকে বিয়ে করে ফেলেছে। তাই আমাদের অর্ণা বেগম এই বি চ্ছে দ সইতে না পেরে ডিপ্রেশনে চলে গেছে।হা,হা,হা(আয়ান)
,আয়ান এবার কিন্তু বেশি হয়ে যাচ্ছে।
,আচ্ছা ওসব বাদ দাও। যা নিয়ে কথা হচ্ছিল। আপু তুমি কালকে কি পড়ে যাবে কিছু ভেবেছো?(মিতু)
,মানে?কালকে কোথায় যাব আমরা?
,সেকি তুমি ভুলে গেছ!আরে কাল না পর্ণা আপুর বউভাত।আমরা সবাই তো কাল সেখানেই যাব।
কথাটা শুনা মাত্র আমার মুখ কালো হয়ে গেল। আনমনে হয়ে বললাম।
,আমি যাব না রে!
,কেন?কেন যাবি না তুই (আয়ান)
,এমনি আমার ওসব ভালো লাগে না । আর তাছাড়া লোকে কি বলবে ?
,এই লোকে কি বলবে মানে কী? এখানে বলাবলির কী আছে বল তো?(ইশান)
,আমার একটা জিনিস নিয়ে খটকা লাগছে?(আয়ান)
,কী সেটা?(ইরা)
,দেখ যেদিন থেকে পর্ণার বিয়ের কথা চলছে। তারপর থেকেই অর্ণা কেমন যেন করছে। এমন তো হতে পারে পর্ণার জামাই, অর্ণার সেই পছন্দ করা ছেলে।(আয়ান)
আয়ানের কথা শুনার পর সকলেই অবাক চোখে তাকালো আমার দিকে। আমি পা থ রের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। মুখ দিয়ে কোনো আওয়া জ বের হচ্ছে না। এই তিক্ত সত্যি টা যে এভাবে সবার সামনে চলে আসবে তা ভাবতে ও পারিনি। বেশ কিছুক্ষণ নিরবতা কে টে গেল।হঠাৎ আয়ান উ চ্চ স্ব রে হেসে উঠলো।
,আরে তোরা এমন সিরিয়াস হয়ে গেলি কেন?আমি তো শুধুমাত্র ম জা করার জন্য বলেছি । অর্ণা কেন পর্ণার জামাই কে ভালবাসতে যাবে!ওদের তো নিশ্চয় আগে থেকেই রিলেশন ছিল। আমি তো শুধু ভ য় দেখানোর জন্য বলেছি।
আয়ানের কথাটা শুনে হাফ ছেড়ে বাচঁলাম। মনে মনে আল্লাহ দরবারে শুকরিয়া আদায় করলাম।আর একটু হলেই ধরা পড়ে যেতাম।
,যাই হোক, তোমাকে কিন্তু কাল যেতে হবে আপু। আমরা কিছু জানি না ব্যস্।(ইরা)
,কিন্তু,,,,
,কোনো কিন্তু নয়!আর নয়তো ভেবে নেব যে আয়ানের কথায় সত্যি।(ইশান)
,ঠিক আছে যাব!এবার হলো?

চলবে,,,৷

#আমায়_একটু_ভালবেসো
#জান্নাতুল_ফেরদৌস_কেয়া

(৪)

,,,পরদিন বউভাতে যাবার সময় হয়ে গেছে। অর্ণার কিছুই ভালো লাগছে না। ওখানে গেলেই পর্ণা আর আদনানাকে একসাথে দেখতে হবে। যেটা তার জন্য, পো ড়া ঘা য়ে নুনের ছিটা দেয়ার মতো। কিন্তু এছাড়া কোনো উপায় নেই। মিতু আর ইরা এসে দেখল, অর্ণা এখনও তৈরি হয়নি।তাই ওরা দুজন মিলে অর্ণাকে সাজিয়ে দিল। সাদা রঙের একটা চুড়িদার।আর হালকা কিছু সাঁজ। ব্যস্ এটুকুতেই অর্ণাকে দারুণ লাগছে।বাড়ির সব ছেলে-মেয়েরা সবাই এক গাড়িতে ওঠেছে।গাড়িতে উঠার সময় আয়ান চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
,বাহ্ অর্ণা! আজকে তো তোকে দারুণ লাগছে। মনে হচ্ছে আমিই তোর প্রেমে পড়ে যাচ্ছি। তা চান্স দেয়া যায় নাকি আমাকে”এক চোখ টিপে(আয়ান)
,আয়ানের বাচ্চা! দেব এক বা রি তোর মাথায়। দিনদিন লা গা ম ছাড়া হয়ে যাচ্ছিস।
,এই সবাই একটা জিনিস খেয়াল করেছিস?(ইশান)
,কি?(মিতু
,ছেকা খাওয়ার পর অর্ণা আরো সুন্দর হ’য়ে গেছে! তাই না?
সবাই হো,হো করে হেসে উঠলো। ওদের কথা শুনে অর্ণার মাথা ধরে গেল । সে উঠে গিয়ে অন্য গাড়িতে বসল। গাড়ি ছুটে গেল তার গন্তব্য স্থলে।

,,আদনানদের বাড়িতে হু লুস্থু ল কান্ড। খাবারের গন্ধে সাড়া বাড়ি ম,ম করছে। লোকজনের সমাগমে গরমের হার বেড়ে গেছে দ্বিগুণ। অর্ণা তার ছোট মার সাথেই বসে রয়েছে। স্টেজের মধ্যে পর্ণা আর আদনান বসে আছে। পর্ণার মুখে ভারী সাঁজ। পরনে গোল্ডেন কালারের লেহেঙ্গা। আদনানের সাথে কী বিষয় নিয়ে যেন হাসছে। বেশ মানিয়েছে দুজনকে। অর্ণা মুখে হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। নিয়তি বড় অদ্ভুত।
একসময় এইদিন গুলো কে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখা হয়েছিল। আজও তা স্বপ্নই রয়ে গেল।
অর্ণা ওঠে চলে গেল বাড়ির পিছন দিকটায়। বাগান হওয়ায় এদিক টা বেশ নিরিবিলি। অর্ণা আনমনে হয়ে কি যেন ভাবতে লাগল।

,এক্সকিউজ মি’
অর্ণা ঘুরে তাকালো। একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে, হাতে শরবতের গ্লাস নিয়ে। অর্ণা ঘুরতেই তার দিকে গ্লাস টা বাড়িয়ে দিল।
,জুস!আপনার জন্য। যা গরম পড়েছে খেয়ে নিন। ভালো লাগবে।
অর্ণা ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে রইল। মনে,মনে বলল,
এই উ ট কো আ পদ টা আবার কে?এখানে কি চাই?
ছেলেটা বোধ হয় লাজুক স্বভাবের। সে বারবার এদিক, সেদিক তাকাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ গ্লাস নিয়ে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পর। বেশ অনুনয় করে বলল,
,আপনি কি জুসটা খাবেন না?
লোকটা কথার ধরন দেখে অর্ণার বেশ হাসি পেল।
নিজেকে সামলে নিয়ে অর্ণা হাত বাড়িয়ে জুসটা নিল।
তা দেখে লোকটা খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,
,আমার নাম তুহিন। আমি আদনান ভাইয়ার মামাতো ভাই হই। আপনি পর্ণা ভাবির বোন। তাই না?
,হুম।
,আমি আপনাকে বিয়ের দিন দেখেছিলাম। আচ্ছা আপনি এখানে কেন?আপনার সব কাজিন রা তো ওখানে আড্ডা দিচ্ছে। আপনি একা,একা এখানে কি করছেন?
,আমার হইচই ভালো লাগে না।
,ও আচ্ছা। তাহলে চলুন পুকুর পাড়ে যায়। ঐদিক টা আরো সুন্দর।
,ধন্যবাদ। তার কোনো প্রয়োজন নেই । আমি এখানেই কমফোর্ট ফিল করছি। আর আপনি যদি চলে যান, তবে আরো ভালো লাগবে।
অর্ণার কথায় ছেলেটার মুখ থমথমে হয়ে যায়।তার জীবনে বোধহয় এমন অপমানের মুখোমুখি হয়নি।মুখের উপর কেউ যে এভাবে বলতে পারে, তা তার জানা ছিল না।সে গম্ভীর মুখে গ্লাস নিয়ে জায়গা ত্যাগ করলো।
অর্ণা বিরক্তিকর চাহুনি নিয়ে ছেলেটার যাওয়ার পানে চেয়ে রইল।
‌,কি অসহ্যকর গায়ে পড়া ছেলে রে বাবা।

শশুর বাড়ির সব নিয়মকানুন পালন করে পর্ণাকে গাড়িতে ওঠালো।পাশে বসেছে আদনান, তার বোন আঁখি, কাকাতো বোন মাইশা আদনানের কলিগ, বন্ধুবান্ধব। এরা ছেলের বাড়ি থেকে যাচ্ছে মেয়ের বাড়িতে । আয়ানরা ও আছে সেখানে। অর্ণা উঠেছে বড়দের গাড়িতে। যদিও পর্ণা বলেছিল তাদের সাথে যাবার জন্য। তবে অর্ণা রাজি হয়নি। সে জানি পর্ণা ইচ্ছে করেই এসব করছে। তাকে কষ্ট দেবার জন্য।
,কিরে অনি তুই এখানে কি করছিস? ঐ গাড়িতে যা!ঐখানে সবাই মজা করবে তোর ভালো লাগবে।
,না ছোট বাবা। আমি এই গাড়িতেই যাব! ওখানে আমার ভালো লাগে না।
,আচ্ছা ঠিক আছে। তোর যা পছন্দ।শুধু একটা কথায় বলব। মন খা রা প করে থাকিস না মা। তাহলে যে আমাদের ভালো লাগে না।
অর্ণা হাসি দিয়ে বলল,
,ঠিক আছে।
,অর্ণা মা তুই যে ছেলেটাকে পছন্দ করেছিলি, সে দেখতে কেমন ছিল রে?
অর্ণা জোরপূর্বক হেসে বলল,
,তার কথা বলতে আমার ভালো লাগে না ফুপি।আমি চাই তাকে ভুলে যেতে। আশা করি তার বিষয়ে আর কিছু জিজ্ঞেস করবে না তোমরা।
,আচ্ছা! আর কখনো বলব না। তুই ভুলে যা এসব। আগের মতো হয়ে যা।

বাড়িতে এসেই নিজের রুমে দরজা বন্ধ করে ফ্লোরে বসে পড়ল অর্ণা। অঝোরে কাঁদতে লাগলো সে।
কেন তার সাথেই এমন হলো। অর্ণা কান্না করছিল। এর মাঝেই তার ফোনে একটা মেসেজ এলো।দু’হাতে চোখটা মুছে। ওঠে গিয়ে দেখলো আয়ান একটা ভিডিও শেয়ার করেছে। অর্ণা সেটাতে ক্লিক করতেই একটা মেয়ের জীবনের গল্প লেখা। পুরোপুরি অর্ণার সাথে না মিললেও। বেশ কিছু ঘটনা সাদৃশ্য রয়েছে। এখানে লেখা ছিল, মেয়ে টা একটা ছেলের সাথে প্রেম করে। একসময় ছেলেটা মেয়েটা ধোঁকা দিয়ে চলে যায়। মেয়েটা মানসিক ভাবে ভে ঙে পড়ে। সু ই সা ই ড করার পথ বেছে নেই। কিন্তু লাস্ট মূহুর্তে সে নিজেকে শক্ত করে নেই । নিজেকে এমন ভাবে তৈরি যে শেষে মেয়েটা কে দেখে ছেলেটা আপসোস করে।
অর্ণা ভিডিও টা দেখে বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। শুরু থেকে শেষ অবধি ভাবতে থাকে। যে নিজের সাথে কি কি হয়েছে। পরে সিদ্ধান্ত নেই নিজেকে শক্ত করবে। আর এভাবে নিজেকে তিলে,তিলে কষ্ট দেবে না।

চলবে,,,,