আমার একটাই যে তুই ২ পর্ব-০২

0
4136

#আমার_একটাই_যে_তুই❤️
#সিজন-২
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
০২
ইউসুফ কঁপাল কুঁচকে দু আঙ্গুলে চেঁপে ধরে বসে আছে। কঁপালের রগ দপ দপ করে ব্যথা করছে। তার চোখ নিবদ্ধ কুহুর পিঠের দিক।তার লাল টুকটুকে বউ কি সুন্দর শান্তিতে ঘুমাচ্ছে । আজ নাকি তাদের বাসর রাত!তার ছোট বউ, তার বাবুইপাখি তার কাছে, কত কাছে। তবুও তাকে ছুঁতে পারছে না, আদর করতে পারছে না, বুকে জড়িয়ে ঘুমতে পারছে না, ঠোঁটে ঠোঁট রেখে ভালবাসার পরশ দিতে পাড়ছে না, না পাড়ছে কাঁজল কালো চোখ দুটির লেপ্টে যাওয়া কাঁজল আর বিন্দু পানি টুকু মুছে দিতে। ইউসুফ ছোট শ্বাস ছাড়লো। বিড়বিড় করে আওড়ালো,,

—” আমাকে কবে বুঝবি তুই বাবুইপাখি! ”

“ঠক ঠক ঠক”

মধ্যরাতে ইউসুফের দরজায় নক হতেই বেড়িয়ে আসে সে। সামনে কাঁচুমাচু ভাবে দাঁড়িয়ে আছে কবির। তার ভয়ার্থ মুখটা দেখে ইউসুফের হাসি পেলো।বলল,,

—” কি ব্যাপার কবির বাবু?”

ইউসুফে ঠাট্টা করাতেও ভয় পেলো কবির।কবির নতজানু হয়ে বলল,,

—” স্যার সব রেডি!”

ইউসুফ তার বিখ্যাত হাসি বিস্তার করে বলল,,

—“চলো!”

কবিরও পিছন পিছন যেতে লাগলো। ভয়ে জড়সড় হয়ে আছে সে। অথচ আজ পর্যন্ত ইউসুফ হাসি মুখ ছাড়া কথা বলেনি তার সাথে। তার মতো সফল নেতাকে ময়মনসিংহের প্রতিটি মানুষ সম্মান করে। কিন্তু কবির? সে ভয় পায়। এ মানুষটিকে বাঘের মতো ভয় পায়।

ইউসুফের সামনে রক্তাক্ত অবস্থা লুটিয়ে আছে আনিস। মুখ, নাক ফেঁটে রক্ত বয়ে যাচ্ছে এখনো। ইউসুফ পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে। মুখে সেই বিখ্যাত হাসি। ইউসুফ বলল,,

—” তো আনিস সাহেব? দু নৌকায় পা দেয়ার আগে আমার মুখটি একবার-ও চোখে পড়েনি?এতেই কি খারাপ দেখতে আমি? কি কবির? বলো তো? আমার চেহারা কি মনে পড়ার মতো না?”

কবির এখন-ও নতজানু। থেকে থেকে শুকনো ঢুক গিলছে। ঠোঁট জোড়া শুকিয়ে কাঠ। ইউসুফে হাসিতে সে সহ উপস্থিত সকলেরই রক্ত হীমশীতল হয়ে যাচ্ছে। কবির জ্বিব দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে কাঁপা স্বরে বলল,,

—“হে স্যার । আপনার চেহারা কেউ কখনো ভুলতে পারবে না।”

ইউসুফ হাসলো। ঘর কঁপানো হাসি।সেই হাসির শব্দে আনিসের ভয়ে গলা শুকিয়ে আসচ্ছে। এতই মার খেয়েছে যে বেচার উঠে বসতেও অক্ষম । তবুও খুব কষ্টে হাত দুটি এক করে বলল,,

—“স্যার ভুল হয়ে গেছে ক্ষমা করে দিন!”

—” আমার ডিকশিনারিতে ক্ষমা বলতে কিছু নেই।” ভাবলেশহীন ভাবে বলল ইউসুফ।

আনিস কাঁদতে লাগলো। হাউ-মাউ করে। ব্যথাতুর শরীরটা টেনে টেনে ইউসুফে পায়ের কাছে নতজানু হয়ে বলল,,

—” প্লীজ স্যার আমায় ছেড়ে দিন। আমার ছোট ছোট বাচ্চা আছে। ওদের উপর তো দয়া করুন?”

লোকটি কাঁদছে। কিন্তু ইউসুফের বুকে এক ফুটো মায়া হলো না। সে অন্য চিন্তায় মগ্ন। আচ্ছা তার এই সুন্দর চেহারার কি আদো দাম আছে? যেখানে ময়মনসিংহের সকল মেয়েরা তাকে কাছে পেতে চায়, হোক সে এক রাতে জন্য! সেখানে তার বাবুইপাখি তাকায়-ও না একটি পলক। তাকে কি ভালবাসার যায় না?

—” স্যার প্লীজ যেতে দিন!”
অানিসের প্যাচ প্যাচ ইউসুফের ভালো লাগেনি।তার চিন্তায় ভাঙ্গন ধরেছে। সে বিরক্তি নিয়ে বলল,,

—” এর প্যাচ প্যাচ ভালো লাগচ্ছে না। কাসেম মুক্তি দিয়ে দে।”

বলেই ইউসুফ উঠে বাহিরে পা বাড়ায়। পিছন থেকে ভেসে আসে আর্তনাদ আর চিৎকার।

কারো বিকট এক চিৎকারে কুহু ধড়ফড়িয়ে উঠে। ভয়ে তার প্রাণ যায় যায়। এমন চিৎকার এ বাসায় সে আরো শুনেছে। এ বিষয়ে যখন দাদুকে বলতো তখন তিনি বলতেন,,

—” এ বাড়িতে তেনাদের বসবাস আছে। তাই রাত-বিরাতে বের হবি না ঘর থেকে!”

ছোট কুহু ভয়ে কলিজার পানি শুকিয়ে যেত। মাথা কাত করে হে বলতো। আজও তেমন চিৎকার ভেসে এলো। এ যে কোনো মানুষের চিৎকার স্পষ্ট বুঝতে পারছে সে। কোনো জ্বিন-ভুত এর ধারের কাছেও নেই। কুহু বিছানা থেকে নামে। পা টিপে টিপে দরজা খুলে। আশেপাশে ইউসুফ কেন তার ছায়া-ও নেই সে কৌতুহল নিয়ে বের হতে নিতেই কারো সাথে ধাক্কা কায়। মস্তিষ্কে তখন জানান দিচ্ছে তেনারা এলেন না তো? কিন্তু নাকের মাঝে পরিচিত এক পার্ফিউমের গন্ধ তীর তীর করে বাড়ি খাচ্ছে। ভয়ে ভয়ে চোখ তুলে তাকায় কুহু। ইউসুফকে দেখে হকচকিয়ে উঠে। ইউসুফ কঁপাল কুঁচকে কুহুকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে বলল,,

—” পালাতে চাইছিলি?”

কুহু আমতা-আমতা করে বলল,,

—” না তো! পালাবো কেন? ”

—“তাহলে?” সন্দিহান ইউসুফ।

কুহু ঝটপট বলল,,

—” বাহির থেকে কারো চিৎকারের অাওয়াজ শুনলাম!”

ইউসুফ হাসলো বলল,,

—” এর থেকে ভালো এক্সকিউজ খুঁজে পেলিনা?”

কুহু চোখ বড় বড় করে বলল,,

—” আমি মিথ্যা বলছি না।”

ইউসুফ আর কথা বাড়ালো না ঘরে এসে সটান করে বিছানা শুয়ে পড়লো। কুহু তার পিছন পিছন এলো। বলল,,

—” আমার কিছু কথা আছে!”

—” হুম।”

—” আপনি শুনচ্ছেন?”

—” হুম!”

—” আমার ডিভোর্স চাই!”

ইউসুফ এতক্ষণ চোখ বুজে ছিলো। ডিভোর্সের কথা উঠে বসে পড়লো। কুহুর দিক ভয়ানক এক দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে, চেঁচিয়ে উঠলো,,

—” এখন আর এই মুহূর্তে বিছানায় ঘুমুতে আসবি। আর একটি কথা বললে তোকে বাড়ির পিছনে সেই জঙ্গলে ফেলে আসবো।”

কুহুর মুখ কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল। টুপ করে জল টুকু নিচেও পড়ে গেল। বাড়ির পিছনে আছে গহীন জঙ্গল আর তার মাঝে আছে একটি রাজ বাড়ি।প্রায়-ই সেখান থেকে ভেসে আসে নুপুরের শব্দ। আর যাই৷ হোক সে ভুতরে বাড়ির দর্শন সে করতে চায় না। সে দাঁড়িয়ে না থেকে দ্রুতে উঠে পরে বিছানায়। তা দেখে ইউসুফ মুখ টিপে হাসে।

সকাল বেলা ইউসুফের দাদু এসে হাজির। সাথে এসেছেন তার ছোট চাচি আর তার দুই মেয়ে। ইউসুফের বাবারা দুইভাই। মহসিন আর তুহিন। মহসিন ময়মনসিংহ শহরের মেয়র। আর৷ তুহিন তাদের গ্রামের চেয়ারম্যান। বছর ছয় মাস ইউসুফের দাদু রোকেয়া বানু দুই ছেলের কাছে থাকেন। তার নাতি হুট করে বিয়ে করেছে শুনে সে নারাজ। তিনি পান মুখে পুরে বললেন,,

—” তোর পোলা কই মনিশা? না জানায় বিয়ে দিলি নবাব কি এখনো শুনে নাই আমি আইছি?”

মনিশা তার শাশুড়ীকে ভয় পান খুব৷ তিনি খ্যাক করে গলা পরিস্কার করে বলেন,,

—” শুনছে আম্মা। আসচ্ছে। বুঝেনি তো বিয়ের রাত!”

রোকেয়া বানু খেঁত করে উঠেন,,

—” নাতি না হয় ঘুমায়, নাতি বউ ও কি ঘুমায় নি? এত বেইল হইলো। ডাকো যাও। শুনো বউ মা বউ গো এতো লাই দিতে নাই। পড়ে কান্দে উইঠা নাচবো!”

মনিশা মাথা কাত করে সম্মতি দেয়। আওয়াজ তুলে কাজের মেয়ে রূপালিকে ঢেকে পাঠায় দেয় ইউসুফ কুহুকে ডাকতে।

কুহুর তখনো ঘুম ভাঙ্গেনি। ইউসুফের বুকের মাঝে বিড়াল ছানার মতো লেপ্টে আছে। কুহুর নিশ্বাসে ইউসুফের বুকের চুল গুলো উড়ছে। ইউসুফ এক হাতে কুহুকে আকড়ে ধরে তাকিয়ে আছে তার নিষ্পাপ, বাচ্চা বউটির দিকে। দাদু এসেছে, নিচে যেতে বলেছে এ নিয়ে চারবার বলে গেলো রুপালি। কিন্তু ইউসুফের উঠতে ইচ্ছে করলো না। না কুহুকে জাগাতে চাইলো। তার ঘুম পরি বাবুইপাখিটি ঘুমন্ত অবস্থায় তার বুক দখল করে আছে। ঘুম ভাঙ্গলেই আবার ছুটে পালাবে!

রুপালী আবার ডেকে গেলো। এবার কুহুরও ঘুম ভাঙ্গলো। রোকায়া বানু এসেছে শুনে তার মুখ শুকিয়ে গেছে। মহিলাটি তাকে দু চোখেও দেখতে পায় না। সে জলধি উঠে বসলো। ইউসুফ তখন জুতো পড়চ্ছে। কুহুকে দেখে হেসে বলল,,

—” ঘুড মর্নিং বাবুইপাখি! ”

কুহু মুখ বাঁকালো ইউসুফকে পাত্তা না দিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেলো।

—-” এই মাইয়ার সাথে শেষ পর্ডন্ত বিয়া দিলি মনিশা? কেন আমার চান্দের লাখান নাতির মাইয়ার অভাব পড়ছিন?”

রোকেয়া বানু তেজে ফেঁটে যাচ্ছেন।তার নাতির জন্য কত মেয়ের সন্ধান না করেছিলেন তিনি। সব রিজেক্ট করলো ইউসুফ। লাষ্ট পর্যন্ত মুদির দোকানের মেয়ে ঘরে তুললো? ভেবেই নাক ছিটকায় তিনি। কুহু সব হজম করে। চোখের কোনে জল টলমল করে। মুরব্বিদের মুখে তো কথা বলতে পারবে না সে। তখনি ইউসুফ নিচে নেমে আসে। উপর থেকে কুহুর কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে বসে থাকতে দেখে, বুঝতে দেড়ি হয়নি কটুকথা শুরু করে দিয়েছে তার দাদু। সে এগিয়ে এসে বলে,,

—” দাদু, এসেছো, নিজের মতো থাকো। অন্যকারো লাইফে বাম হাত ঢুকিও না।”

রোকেয়া বানু ইউসুফকে কিছুটা ভয়ও পান। তিনি হেসে আদুরে কন্ঠে বলে,,

—” এমন কউ কেরে আমিতো তোমার ভালার লাগি কইছি!”

ইউসুফ হেসে ফেলে। বলে,,

—” দাদু আমার ভালো আমি বুঝতে শিখেছি আজ ১২ বছর। তোমার চিন্তা না করলেও চলবে।”

দাড়ালো না আর ইউসুফ কুহুকে টেনে রুমে নিয়ে গেল। রোকেয়া বানু রেগে যান। রাগের মাঝে ঘী ঢালেন ছোট চাচি বলে,,

—” দেখলেন আম্মা? কেমন ব্যবহার? আমার ছেলে-মেয়ে এমন করলে জুঁতা খুলে মুখে মারতাম!”

রোকেয়া বানু জ্বলে উঠে। মনিশাকে বলে,,

—” তোর ছেড়াডা এখনি হাত ছাড়া হইয়া গেলোরে মনিশা!”

মহিশা নিরবে শ্বাস ত্যাগ করে ছয় মাস এই ক্যান ক্যান তার সইতেই হবে।

গুরত্বপূর্ণ এক মিটিংয়ে বসে আছে ইউসুফ। বিরোধী দলের সাথে। তখনি ফোনের মাঝে রিং বাঁজতে থাকে লাগাতার। বাসা থেকে কলটা এসেছে দেখে চিন্তার ভাজ পরে। ইউসুফ ফোন রিসিভ করে। ভেসে আসে কান্নার আওয়াজ। ইউসুফের বুক খ্যাত করে উঠে, বাবুইপাখি ঠিক আছে তো?? অপর পাশ থেকে তখন চাপা অর্তনাদ ভেসে আসে তার মার,,

—” ইউসুফ কুহু….!”

চলবে,