আমার একলা আকাশ পর্ব-১১+১২

0
275

#আমার একলা আকাশ
#পর্ব_১১+১২
মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_________________
আদনানের ব্যক্ত করা প্রতিটি শব্দ, বাক্য একটা ঘোরের মাঝে প্রাপ্তিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। হাজারও না বলা কথাগুলো কণ্ঠনালিতে এসে আটকে গেছে। অপ্রত্যাশিত জিনিস পেলে আনন্দে মানুষ কী করবে, না করবে যেমন ভেবে পায় না; প্রাপ্তিরও হয়েছে এখন সেই দশা। মনে মনে ভয় পাচ্ছে আবার আদনানের সামনে সে কেঁদে না ফেলে।

প্রাপ্তি নিরব ভূমিকা পালন করাতে আদনানের বুকের ভেতর দাহ শুরু হয়। সে ভয় পেতে শুরু করে। প্রাপ্তি কি তাকে ঘৃণা করে? সে ভীতকণ্ঠে জানতে চাইল,

‘তুই কি আমায় ভালোবাসিস না হূরপরী?’

প্রাপ্তি নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে। কোনোমতেই এখন কান্না করা চলবে না। সে আদনানের গভীর আবেগময় দৃষ্টিতে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না। তার মাথা নুইয়ে ফেলা, তিরতির করে কাঁপান্বিত ঠোঁট এবং অশ্রুসজল নেত্রদ্বয়-ই স্পষ্ট প্রকাশ করে দিচ্ছিল, আজও প্রাপ্তি আদনানকে ঠিক কতটা ভালোবাসে। এই নিরব সম্মতিটুকুই আদনানকে আনন্দিত করে তোলে। সে প্রাপ্তির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

‘পাগলী!’
__________
রাত ১টা ১০ মিনিট

গভীর রাত না হলেও রাত্রির সময়টা নেহাৎ-ই কম নয়। নেত্রপল্লবদ্বয় আজ কিছুতেই একত্রিত হচ্ছে না। এমন নয় যে, আজই এমন হচ্ছে। এর পূর্বেও প্রাপ্তি রাত জেগেছে। অসংখ্য রাত্রি তার নির্ঘুম কেটেছে। ফ্যামিলি ক্রাইসিসের পর আদনানের চাইতেও বেশি রাত জাগার কারণ ছিল তার বাবা-মা। বাবার শুকনো মুখটা চোখের সামনে দৃশ্যমান হতেই তার ঘুম ভেঙে যেত। তবে আজ রাত জাগার অন্যতম এবং শুধুমাত্র কারণ হচ্ছে আদনান। তার বিশ্বাসই হচ্ছে না আদনানও তাকে ভালোবাসে। কেমন যেন ঘোর ঘোর লাগে। স্বপ্নও বোধ হয় এতটা সুন্দর হতে পারে না। প্রাপ্তি আদনানকে কোনো উত্তর দেয়নি। তখন একটা কথাও সে বলতে পারেনি। আদনানও কোনো রকম জোর করেনি। এমনকি সে তার প্রশ্নের উত্তরও চায়নি। শুধু জিজ্ঞেস করেছিল,

‘বাড়ি যাবি এখন?’

প্রত্যুত্তরে প্রাপ্তি শুধু উপর-নিচ মাথা ঝাঁকিয়েছিল। এরপর বিনা বাক্যব্যয়ে একটা রিকশা ঠিক করে দুজনে বাড়িতে ফিরেছে। প্রাপ্তিকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে তৎক্ষণাৎ-ই আবার চলে গেছে আদনান। এদিকে বাড়িতে ফেরার পথ থেকে জাগতিক কোনো কিছুই প্রাপ্তিকে স্পর্শ করতে পারছিল না। সে আদনানের ভাবনায় বিবশ হয়ে ছিল। রাতে খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকিয়ে যখন ঘুমানোর জন্য বিছানায় এসেছে তখন আনন্দের পাল্লা উড়ে গিয়ে সেখানে স্থান করে নিয়েছে ভয়াবহ ভীতি। প্রাপ্তিদের অবস্থা এখন আর আগের মতো নেই। আদনানের বাবা কি দুজনের বিয়েটা কখনো মেনে নেবে? এই ভীতিটাই তার পুরো আনন্দকে মাটি করে ফেলেছে। অস্থিরতায় না ঘুম আসছিল আর না একটু স্থির হয়ে বসে থাকতে পারছিল। রাত এগারোটা নাগাদ আদনান পাঁচ বার কল করেছিল। প্রাপ্তি কী বলবে অথবা কী কথা বলা উচিত এসব ভেবে না পেয়েই ফোন আর রিসিভ করেনি। তবে এখন মনে হচ্ছে কথা বলাটা ভীষণ জরুরী। সে বালিশের কাছ থেকে ফোন নিয়ে আদনানকে টেক্সট করল,

‘ঘুমিয়ে পড়েছ?’

প্রায় এক মিনিট পর আদনানের রিপ্লাই আসে,’এখনো না। তুই ঘুমাসনি কেন?’

‘ঘুম আসছে না। ফ্রি আছো?’

‘আছি। কথা বলবি?’

‘হুম।’

‘দশ মিনিট সময় দে।’

‘ঠিক আছে।’

প্রাপ্তি ফোন হাতে নিয়ে বসে রইল। আর একটু পরপরই ফোনে সময় দেখতে লাগল। দশ মিনিটের আগেই আদনান ফোন করে। প্রাপ্তি কল রিসিভ করে বলল,

‘হ্যালো?’

ওপাশ থেকে আদনান বলল,’আমি তোর বাড়ির সামনে।’

প্রাপ্তি আঁৎকে উঠে বলে,’কী! কেন? বাসায় কেন এসেছ?’

‘তুই-ই না বললি কথা বলবি?’

‘কথা বলব বলেছি। কিন্তু দেখা করব তো বলিনি।’

‘মুখ না দেখে কথা বলতে আমার ভালো লাগে না।’

প্রাপ্তি কিয়ৎক্ষণ নিরব থাকে। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলে,’ঠিক আছে। সোজা ছাদে যাও। আমি আসছি।’

আদনান কল কেটে ছাদে চলে যায়। প্রাপ্তি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলগুলো একটু পরিপাটি করে। তার এখন আত্মা কাঁপছে। সামনা-সামনি আদৌ এসব কথা বলতে পারবে কিনা কে জানে!

ত্রস্ত পায়ে সে ছাদের দিকে এগোতে থাকে। ছাদের মাঝ বরাবর স্থানে আদনান আকাশের দিকে মুখ করে তাকিয়ে আছে। চারদিকে পিনপতন নিরবতা থাকায় সহজেই প্রাপ্তির উপস্থিতি টের পায় আদনান। পিছু ফিরে প্রাপ্তির দিকে তাকিয়ে প্রথমেই বলে,

‘আজ আকাশে চাঁদ নেই।’

এ কথার কী উত্তর দেওয়া যায় প্রাপ্তি ভেবে পেল না। তাই চুপ করে থাকাকেই শ্রেয় মনে করল। আদনান এবার গুটি গুটি পায়ে ছাদের রেলিঙের কাছে গিয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। প্রাপ্তিও তাকে অনুকরণ করে।

‘বলতে পারবি আকাশে আজ চাঁদ নেই কেন?’ জানতে চাইল আদনান।

প্রাপ্তি একবার আকাশের দিকে তাকাল। চাঁদ নেই তবে তারা আছে। তারার উজ্জ্বলতা আজ অনেক কম। কেমন যেন টিমটিম করে জ্বলছে বলে মনে হচ্ছিল। সে গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

‘না।’

আদনান হেসে বলে,’আমিও জানি না।’

আবারও নিরবতা। নখ দিয়ে নখ খোঁচাচ্ছিল প্রাপ্তি। আদনান শান্তকণ্ঠে বলল,’সমস্যা নেই। আকাশের চাঁদ না থাকলে নেই। জমিনের চাঁদ তো আছে।’

প্রাপ্তি বুঝতে না পেরে অন্ধকারের মাঝেই আদনানের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয়েছে। মৃদু হাসে আদনান। অন্ধকারে চোখ সয়ে গেছে এখন। প্রাপ্তির মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,

‘বুঝিসনি?’

দু’দিকে মাথা নাড়ায় প্রাপ্তি। স্মিত হেসে আদনান বলে,’জমিনের চাঁদ তুই। আমার ব্যক্তিগত চাঁদ।’

‘আমার কোনো আলো নেই।’

‘চাঁদেরও নিজস্ব কোনো আলো নেই জানিস না?’

প্রাপ্তি চুপ করে থাকে। আবারও কিছুক্ষণ নিরবতা। মনে মনে গুছিয়ে রাখা কথাগুলো বলার জন্য প্রস্তুত হয় প্রাপ্তি। গলা পরিষ্কার করে থমথমে কণ্ঠস্বরে বলে,

‘তুমি আমায় সত্যিই ভালোবাসো?’

‘মিথ্যে ভালোবাসার কারণ কী হতে পারে?’

‘করুণা, দয়া।’

‘করুণা করে কিংবা দয়া দেখিয়ে বড়ো জোর কিছুদিন ভালোবাসার অভিনয় করা যায়। কিন্তু ভালোবাসা যায় না।’

এবার সে একটুখানি থেমে কেমন আবেগমাখা স্বরে প্রাপ্তিকে বলে,’আমার ভালোবাসা নিয়ে তুই সন্দিহান প্রাপ্তি? যাচাই করতে চাস?’

‘এমন কিছু নয়।’

‘তাহলে কি তুই আমায় ভালোবাসিস না?’

সকল সংকোচের ইতি ঘটে আদনানের এই প্রশ্নে। প্রাপ্তির গলা ধরে আসে। হুটহাট এভাবে কান্না কেন পায় কে জানে! সে দু’পা এগিয়ে যায় আদনানের কাছে। মাঝখানের দূরত্বটুকু দূর করে দেয়। তার পেলব উষ্ণ দু’খানা হাত আদনানের গালে রাখে। বড্ড দুঃসাহসিক কাজ ছিল এটা প্রাপ্তির মতো মেয়ের কাছে। তবে এই মুহূর্তে ভীতি, জড়তা, সংকোচ কোনো কিছুরই বালাই নেই প্রাপ্তির। সে যে আদনানকে কতটা ভালোবাসে এটাই আদনানকে উপলব্ধি করানোর জন্য তার মাঝে ব্যাকুলতার সঞ্চার বৃদ্ধি পেতে থাকে। সে বিমর্ষ হয়ে বলে,

‘আমি তোমায় কতটা ভালোবাসি আর কী করে বোঝাব? আমার চোখের ভাষা কি তুমি বোঝো না? আমার হৃদয়ের ব্যাকুলতা কি তুমি শোনো না? কী পরিমাণ নিখাদ ভালোবাসা শুধুমাত্র তোমার জন্যই আমার মনের মাঝে রয়েছে সেটা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। আমিও তোমাকে ভালোবাসি আদনান।’

প্রাপ্তির চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে। অশ্রু চিকচিক করছে আদনানের চোখের কোণে। সে প্রাপ্তির এক হাতে ধরে আলতো করে চুমু খায়। প্রাপ্তি ঠোঁট উলটিয়ে কেঁদে বলে,

‘একবার জড়িয়ে ধরব তোমায়?’

আদনান হেসে দু’হাত প্রসারিত করে। প্রাপ্তিও স্মিত হাসে। আদনানের বুকে মাথা রেখে বলে,

‘কিছু কথা বলার আছে তোমায়। যেগুলো তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলা সম্ভব নয়। তাই তোমার বুকটাই আমার জন্য এখন নিরাপদ স্থান।’

আদনান বুঝতে পারছে না প্রাপ্তি এমন কী কথা বলতে চায়। সে মৃদুস্বরে বলল,’নির্দ্বিধায় বল।’

‘দেখো আমাদের পরিবারের বর্তমান অবস্থা তো তুমি ভালো করেই জানো। আমরা এখন নিঃস্ব। কিছুই নেই আমাদের। আবার আমার বিয়ে ভেঙে যাওয়ায় এমনিতেও আমার খুঁতের শেষ নেই এখন। এতকিছু মেনে নিয়েও কিন্তু আমাদের এক হওয়াটা সহজ নয়। তোমার বাবা কি মানবে আমাদের সম্পর্ক? তুমি তোমার বাবাকে কতটা সম্মান ও শ্রদ্ধা করো তা আমি জানি। ছোটো।থেকেই তো দেখে আসছি। আমি তোমার ক’দিনের ভালোবাসা মাত্র। এই ভালোবাসার জন্য সারাজীবনের শ্রদ্ধাটুকু কখনো নষ্ট কোরো না। আমি জানি, তুমি বাবা-মায়ের আদর্শ সন্তান। আমার এসব বলার কোনো প্রয়োজনই ছিল না। শুধু বলছি এ কারণেই যে, কোনো ভুল সিদ্ধান্তের চিন্তা-ভাবনা যেন তোমার মাথায় উদয় না হয়। আর তুমি এটাও জেনে রাখো, এমন পরিস্থিতিতে তোমার ওপর আমার কোনো ক্ষোভ জন্মাবে না। অন্যতম একটা সত্য কথা হলো, তোমার পরিবার যদি আমায় না মানে তাহলে আমার পরিবারও কখনো আমায় তোমার হাতে তুলে দেবে না। কোনো পরিবার কি দেয় বলো? আমিও চাই না আমার বাবা-মায়ের দিকে কেউ আর কখনো আঙুল তুলুক।’

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলেই থামল প্রাপ্তি। আদনান কিচ্ছু বলতে পারল না। কিচ্ছু না! শুধু এতক্ষণ যেমন আলগা করে প্রাপ্তিকে জড়িয়ে রেখেছিল; এবার বাঁধন শক্ত করেছে।

সে প্রাপ্তির মাথায় হাত বু্লিয়ে বলল,’আমি আজ বাবা-মাকে বলব সব।’
.
.
সকাল আটটার দিকে ঘুম ভাঙে আদনানের। ভোর প্রায় চারটা অব্দি প্রাপ্তির সাথে গল্প করে বাড়িতে ফিরেছে। ঘুমিয়েছে দেরি করে তাই ঘুম ভেঙেছেও দেরি করে। সে দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নাস্তা খেতে বসে। রুমানা বেগম ছেলের প্লেটে খাবার তুলে দিয়ে বলেন,

‘চোখ লাল হয়ে আছে কেন? ঘুম হয়নি?’

আদনান মৃদু হেসে বলে,’নাহ্!’

‘তো এত রাত জাগার কারণ কী?’ জিজ্ঞেস করলেন আসাদ রহমান।

আদনান ইতস্তত করে বলল,’এমনি আব্বু।’

‘এটা ঠিক নয়। প্রোপার ঘুম না হলে সারাদিন ঠিকঠাক কাজ করতে পারবে না। তাই টাইম টু টাইম খাওয়াটা যেন ইম্পোর্ট্যান্ট; তেমনই প্রোপার ঘুমও ইম্পোর্ট্যান্ট। এখন থেকে তাড়াতাড়ি ঘুমানোর চেষ্টা করবে।’

‘জি আব্বু।’

‘কাজ কেমন চলছে? অফিসের সব ঠিকঠাক।’

আদনান মাথা নাড়িয়ে বলল,’হ্যাঁ।’

তবে যেটা বলার জন্য এত উশখুশ করছিল সে কথাটাই সে বলতে পারছিল না। কী করে যে নিজের বিয়ের কথা নিজেই বলবে বুঝতে পারছে না। আসাদ রহমানের খাওয়া শেষ। তাই তিনি হাত ধুয়ে রুমে চলে যান। একটু রেস্ট নিয়ে রেডি হয়ে তারপর অফিসে যাবেন। মাকে একলা পেয়ে হাত চেপে ধরে আদনান।

রুমানা বেগম ভ্রুঁ কু্চকে বলেন,’কী হয়েছে?’

‘বসো এখানে। কথা আছে।’

রুমা বেগম পাশের চেয়ারটিতে বসলেন।

‘এবার বল কী বলবি?’

মায়ের সাথে সে ভীষণ ফ্রি হওয়া সত্ত্বেও খুব সহজেই কথাটি বলতে পারল না। একটুখানি সময় নিয়ে বলল,’মা, আমি প্রাপ্তিকে ভালোবাসি।’

রুমানা বেগমের বিস্ময়ের শেষ নেই। তিনি বিস্মায়ভূত হয়ে ছেলের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকি আছেন। আদনান ফের বলল,’আমি ও-কে বিয়ে করতে চাই। তুমি প্লিজ বাবাকে একটু বলো।’

তিনি অবিশ্বাস্যকণ্ঠে জানতে চাইলেন,’তুই সত্যিই প্রাপ্তিকে ভালোবাসিস?’

‘হ্যাঁ।’

‘কবে থেকে হলো এসব?’

‘কী হবে? আমাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু আমরা দুজন দুজনকে ভালোবাসি। আর তাই আমি চাই, প্রাপ্তিকে বিয়ে করতে।’

রুমানা বেগম থম মেরে বসে রইলেন। মায়ের এমন মুখাবয়ব দেখে আদনান একটু চিন্তিতস্বরে বলল,

‘কী হয়েছে মা? প্রাপ্তিকে কি তোমার পছন্দ নয়?’

‘কীসব বলছিস! প্রাপ্তিকে কেন আমার পছন্দ হবে না? আমি ও-কে কতটা ভালোবাসি তা কি তোর অজানা। ও যদি তোর বউ হয় তাহলে আমার চেয়ে খুশি কেউ হবে না। কিন্তু সমস্যা তো তোর বাবাকে নিয়ে।’

‘তুমি আব্বুকে বুঝিয়ে বলতে পারবে না?’

‘আমার বলতে তো আপত্তি নেই। কিন্তু তিনি আমার কথা শুনলেই হয়।’

‘তুমি এখনই আব্বুকে গিয়ে বলো।’

‘এখনই?’

‘হ্যাঁ, এখনই। এই সময়েই তার মেজাজটা ঠাণ্ডা থাকে। আমি এখানে অপেক্ষা করছি। তুমি গিয়ে বলো।’

ভয়ে ভয়ে রুমানা বেগম নিজেদের রুমে প্রবেশ করেন। কিছুক্ষণ পায়চারি করে, কিছুক্ষণ উঠে, বসে। পানি পান করে। স্বামীর সাথে কথা বলে একটু সহজ হওয়ার চেষ্টা করে এবং সুন্দর করে প্রাপ্তির সাথে আদনানের বিয়ের প্রসঙ্গও তোলেন। এই প্রসঙ্গ ওঠা মাত্রা বক্রদৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে তাকান আসাদ রহমান। রাগে গজগজ করে বলেন,

‘শেষমেশ বান্ধবীর মেয়েকে বাড়ির বউ করে আনার ফন্দি করছ?’

রুমানা বেগম ভয়ে ভয়ে বলেন,’আসলে আদনান প্রাপ্তিকে ভালোবাসে।’

‘এ কথা আদনান তোমাকে বলেছে?’

‘হ্যাঁ।’

‘ডাকো ও-কে।’

আদনানকে ডাকতে হয়নি। বাহির থেকে তার কথাবার্তা অল্পবিস্তর শোনা যাচ্ছিল। তার ডাকতে বলার কথাটির জোর এত বেশি ছিল, যা আদনান স্পষ্ট শুনতে পেয়েছে। ছেলেকে দেখে তার রাগ যেন তরতর করে বাড়তে থাকে। তিনি রাগান্বিত কণ্ঠে বলেন,

‘তুমি নাকি প্রাপ্তিকে বিয়ে করতে চাও?’

মাথা নাড়ায় আদনান। তিনি আগের চেয়েও বেশি রাগ দেখিয়ে বললেন

‘তোমার রুচি দেখে আমি অবাক হচ্ছি। দিনদিন এত অধঃপতন? ঐ মেয়ের চরিত্র কেমন জানো না তুমি?’

‘আব্বু তুমি ওর ব্যাপারে সম্পূর্ণ না জেনেই এসব বোলো না প্লিজ!’

‘আচ্ছা যাও আমি আর কিছুই বলব না। শুধু এইটুকুই বলি, আমি ও-কে তোমার বউ করে আনব না। ওদের স্ট্যাটাসের সাথে আমাদের যায় না। তোমার যদি আমার অবাধ্য হয়ে ও-কে বিয়ে করতে হয় তাহলে করো। এখন তোমার যদি মনে হয় বাবাকে দরকার নেই; ওই মেয়েকেই তোমার দরকার তাহলে আমার বিরুদ্ধে যেতে পারো। আমি বেঁচে থাকতে এই সম্পর্ক মানব না।’

চলবে

#আমার_একলা_আকাশ
#পর্ব_১২
মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
__________________
প্রাপ্তি টিউশনি করাতে যাওয়ার পর মামি বাড়িতে এসেছেন। সুমনা বেগম ভাইয়ের বউকে পেয়ে একটু খুশিই হলেন। এমনিতে তো সারাদিন তার একা একাই কাটে।

চা নিয়ে দুজনে একসাথে গল্প করতে বসেছে। মামি চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন,’প্রাপ্তি বাড়িতে নেই না?’

সুমনা বেগম দীর্ঘশ্বাস গোপন করলেন না। বিমর্ষ হয়ে বললেন,’না গো! প্রাইভেট পড়াতে গেছে। আসতে আসতে সেই সন্ধ্যা।’

‘মেয়েটার তো এভাবে অনেক কষ্ট হয়ে যায় আপা।’

‘জানি! কত করে বারণ করি, দরকার নেই তোর প্রাইভেট পড়ানোর। কিন্তু মেয়েটা আমার কথাই শোনে না। বড্ড জেদি হয়ে গেছে!’

‘ওর-ই বা কী দোষ বলো? ও যে তোমাদের কষ্টও সহ্য করতে পারে না।’

‘আল্লাহ্ যে আর কত পরীক্ষা নেবেন আমাদের জানিনা আমি!’

‘এত হতাশ হইও না। আল্লাহর ওপর ভরসা রাখো। আমি এসেছিলাম একটা কথা বলতে। কীভাবে নেবে বুঝতে পারছি না।’

‘আমার কাছে এত ইতস্ততা কীসের তোমার? বলে ফেলো কী বলবে।’

‘অন্য সময় হলে এমন ইতস্তত করতাম না। কিন্তু এখন যে পরিস্থিতিটাই অন্য রকম। তবে আমার মনে হয়েছে, কথাটা ভেবে দেখলে তোমাদেরও পছন্দ হবে। প্রাপ্তির জন্য বেশ ভালো হবে বলা যায়।’

‘কী ব্যাপার বলো তো?’

‘আমাদের বাড়িওয়ালার ছেলে শিশিরকে দেখেছ না?’

‘হ্যাঁ। একবার না দু’বার যেন দেখেছিলাম। কেন কী হয়েছে?’

‘শিশির প্রাপ্তিকে দেখে পছন্দ করেছে। ওর মা-বাবা’ও ছেলের বিয়ের জন্য মেয়ে খুঁজছিল। তখন শিশির ওর মায়ের কাছে প্রাপ্তির কথা বলেছে।’

‘আমাদের পারিবারিক অবস্থা, প্রাপ্তির বিয়ে ভেঙে যাওয়া এসব কী জানে ওরা?’

‘সব জানে। শিশির নাকি ওর কোন বন্ধুর থেকে শুনেছে। ও বাকিদের মতো না। এখানে যে প্রাপ্তির কোনো দোষ নেই সেটা ও বুঝেছে। ওর বাবা-মা’ও রাজি। আমাকে বলল আগে তোমাদের জানাতে।’

সুমনা বেগম চিন্তিত হয়ে বসে রইলেন। মামি তার হাত ধরে বললেন,’ভেবে দেখো, আমার কাছে কিন্তু প্রস্তাব মন্দ লাগেনি। ছেলেটার গায়ের রঙ একটু কালো। কিন্তু এসবে কী আসে যায়? ছেলেদের গায়ের রঙ তো কোনো ফ্যাক্ট না।’

‘এসব নিয়ে আমি ভাবছি না। প্রাপ্তি রাজি হবে কিনা এখানেই ভয়।’

‘তুমি আছো কী করতে? ভাইজান আর তুমি বুঝিয়ে বলবে। রাজি করাবে। সব ছেলে তো আর এক রকম নয়। আগেরটার সাথে বিয়ে না হয়ে ভালোই হয়েছে। কেমন ছেলে ভাবো একবার! তোমাদের বাড়ি যখন ছিল তখন তো ভালোবাসা একদম উতলে পড়ত। আর যখনই দেখল বিপদ, তখন কিনা লেজ গুটিয়ে পালাল! অ’মানুষ একটা!’

সুমনা বেগম চুপ করে রইলেন। মামি নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,’তোমরা ঠাণ্ডা মাথায় ভাবো সব। শিশির ভালো একটা চাকরীও করে। মাসে পঁচিশ কি ত্রিশ হাজারের মতো বেতন পায়। সংসার দিব্যি চলে যাবে। দু-মুঠো ডাল-ভাত খেয়ে হলেও তো আমাদের প্রাপ্তি ভালো থাকবে। বড়োলোকরা কেমন স্বভাবের হয় তা তো দেখেছই। শিশিরের বাবা-মায়ের কোনো দাবি-দাওয়া নেই। তারা শুধু মেয়ে নিতে চায়। যদি রাজি হও তাহলে ওদেরকে আমি আসতে বলব।’

‘আগেই এত তাড়াহুড়ার দরকার নেই বুঝেছ। তোমার ভাই আসুক। আগে তাকে বলে দেখি, সে কী বলে। এরপর না হয় প্রাপ্তির সঙ্গে কথা বলে জানাব।’

‘ঠিক আছে। তবে বেশি সময় নিও না। তাদেরকেও তো জানাতে হবে।’
.
.
টিউশনিতে যাওয়ার পথে আদনানকে বেশ কয়েকবার কল করেছে প্রাপ্তি। কিন্তু নাম্বার বন্ধ। প্রাইভেট পড়াতে বসেও কল দিয়ে নাম্বার বন্ধ পেলো। হঠাৎ করে নাম্বার বন্ধ কেন ভেবে পাচ্ছে না সে। চার্জ নেই নাকি? সে ফেসবুকে গিয়ে আইডি ভিজিট করে দেখল ১৫ ঘণ্টা আগে একটিভ দেখাচ্ছে। সে একটু চিন্তিত হতে লাগল। এই প্রাইভেট শেষ করে অন্য প্রাইভেট পড়াতে যাওয়ার সময় আকাশের রঙ বদলাতে শুরু করে। কড়া রোদ উবে গিয়ে শান্ত, মলিন হয়ে যায়। কালো মেঘে ছেঁয়ে যায় সম্পূর্ণ আকাশ। চটজলদি যেতে না পারলে পথেই বৃষ্টিতে পেয়ে যাবে তাকে। শেষে আবার যদি জ্বর আসে তাহলে ফের উটকো ঝামেলা পোহাতে হবে। সে দ্রুত পায়ে এগোতে লাগল। আপন মনে চারদিকে চোখ বুলিয়ে রিকশাও খুঁজছিল সে। কেননা ইতিমধ্যেই গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়া আরম্ভ করেছে। একটা রিকশা পেলে ভীষণ উপকার হতো বলা চলে। রিকশা না পেয়ে সে হাঁটার গতি আরেকটু বাড়িয়ে দিলো। আশেপাশে লোকজন না থাকলে সত্যি সত্যি এবার সে দৌঁড়াতেই শুরু করে দিত।

হঠাৎ করে তার সাথে পা মিলিয়ে একটা ছেলে পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করে। এখন আর বৃষ্টির ফোঁটাও প্রাপ্তির গায়ে পড়ছে না। সে লক্ষ্য করে দেখল তার মাথার ওপর মেরুন রঙের একটি ছাতা আর পাশে হাঁটতে থাকা ছেলেটি রায়হান। তৎক্ষণাৎ ছাতার ভেতর থেকে প্রাপ্তি ছিটকে দূরে সরে যায়। রায়হান হাল ছাড়ে না। সে আবারও ছাতা নিয়ে এগিয়ে যায়। প্রাপ্তি চিৎকার করে বলে,

‘সমস্যা কী? আমাকে বিরক্ত কেন করছ?’

রায়হান সতর্ক দৃষ্টিতে একবার আশেপাশে তাকাল। এরপর শান্তকণ্ঠে বলল,’অযথা চেঁচিও না প্লিজ!’

‘তুমি এক্ষুণী এখান থেকে চলে যাও। আমার পিছু নিয়েছ কেন?’

‘তুমি ভিজে যাচ্ছ প্রাপ্তি। ছাতার নিচে আসো।’

‘তুমি যাবে নাকি আমি এবার সত্যি সত্যিই চিৎকার করে লোক জড়ো করব?’

‘তুমি অযথাই সিনক্রিয়েট করছ এখন। আমি কি তোমাকে খারাপ কিছু বলেছি? দোকান থেকে দেখলাম তুমি বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে যাচ্ছ। তাই ছাতা নিয়ে এগিয়ে এসেছি। আমার অন্য কোনো মতলব নেই।’

‘তাহলে তো খুবই ভালো। এবার এখান থেকে গিয়ে আমায় উদ্ধার করো।’

‘আচ্ছা তুমি ঠাণ্ডা হও। আমি যাব না তোমার পিছু পিছু। তুমি ছাতা নিয়ে একাই যাও।’

‘লাগবে না তোমার ছাতা।’ বলেই হনহন করে হাঁটা শুরু করে প্রাপ্তি। গুড়িগুড়ি বৃষ্টিতেও প্রাপ্তি অনেকখানি ভিজে গেছে। রায়হান আবারও পিছু পিছু যেতে লাগল। এবার বৃষ্টিও জোরে পড়া শুরু করে। তবে রায়হান এবার প্রাপ্তির মাথার ওপর ছাতা ধরলেও নিজে ছাতার বাইরে রয়েছে।

প্রাপ্তি বিরক্তস্বরে বলে,’কী সমস্যা? কী চাইছ তুমি?’

‘কী চাইব?’

‘সেটা তো তুমি আমায় বলবে। হঠাৎ করে এমন ভালো মানুষীর কারণ কী? তুমি তো মতলব ছাড়া কিছু করো না কখনো।’

‘কোনো মতলব নেই। এমনিই তোমায় দেখে কথা বলতে ইচ্ছে হলো।’

প্রাপ্তি চুপচাপ হাঁটছে। রায়হান বলল,’শুনলাম তোমার বিয়ে ভেঙে গেছে।’

প্রাপ্তি দাঁতে দাঁত চেপে বলল,’ঠিকই শুনেছ। খুশি হয়েছ তো?’

‘এভাবে কেন বলছ প্রাপ্তি? আই লাভ ইউ!’

প্রাপ্তি থমকে দাঁড়ায়। ঝলসানো দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,’নতুন করে আবার নাটক করতে আসছ?’

‘এভাবে বোলো না প্লিজ!’

‘এই যাও তো তুমি এখান থেকে। তোমাকে একদম সহ্য হচ্ছে না আমার।’

‘ঠিক আছে।’ বলে ছাতাটা প্রাপ্তির হাতে দিয়ে এমনভাবে প্রাপ্তির হাত স্পর্শ করল যেই স্পর্শটা কোনো মেয়েরই ভালো লাগবে না। স্পর্শ করার মাঝেও পার্থক্য রয়েছে। গুড টাচ এবং ব্যাড টাচ এর মধ্যে পার্থক্য সবচেয়ে বেশি বোঝে শিশু এবং মেয়েরা। এই মুহূর্তে রায়হানের উপস্থিতি এবং হাত ধরার স্পর্শে গা গুলিয়ে উঠল প্রাপ্তির। তবে রায়হানকে সে কিছু বলার পূর্বেই রায়হান বৃষ্টির মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে উলটো পথে চলে গেছে। রাগে, জিদ্দে ছাতাটি রাস্তায় ফেলে ইচ্ছেমতো লাত্থি দিতে লাগল প্রাপ্তি। রায়হানের ওপর থাকা ক্ষোভ ছাতার ওপর মিটিয়ে সেও বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে প্রাইভেট পড়াতে চলে যায়। এমনিতেই সকাল থেকে আদনানের ফোন বন্ধ, তার মধ্যে আবার রায়হানের সাথে সাক্ষাৎ; সবকিছু মিলিয়ে প্রাপ্তির মেজাজ এখন সপ্তকাশে। সে কোনো ভাবেই নিজের রাগকে দমিয়ে রাখতে পারছিল না।
_____________
অফিসের চেয়ারে বসে উদাসীনভাবে চেয়ার নাড়াচ্ছে আদনান। বারবার ডেস্কের ওপর থেকে ফোন নিয়ে ফোন অন করতে গিয়েও আবার পূণরায় যথাস্থানে রেখে দিচ্ছে। সে জানে প্রাপ্তি তাকে ইতিমধ্যে অনেকবার কল করেছে। ফোন বন্ধ পেয়ে দুশ্চিন্তাও করছে। কিন্তু সে-ই বা কী করবে? কী করে সে প্রাপ্তিকে বলবে তার বাবার বলা কথাগুলো? তার কী করা উচিত এবং কী-ই বা করবে এসব কোনো কিছুই সে ভেবে পাচ্ছিল না। এতটা অসহায়বোধ তার নিজের জন্য পূর্বে কখনো লাগেনি। এরকম দোটানায় একজন মানুষের কী করা উচিত? একদিকে পরিবার তো অন্যদিকে ভালোবাসার মানুষ।

সে যে প্রাপ্তিকে কতটা ভালোবাসে সেটা সে এবং তার অন্তর্যামীর চেয়ে ভালো কেউ জানে না। অন্যদিকে সে তার বাবাকে ছোটো থেকেই সম্মান করে। কখনোই সে বাবা-মায়ের মুখে মুখে তর্ক করেনি। এমনকি বাবার সামনে কখনো সে ফোনে কোনো মেয়ে ফ্রেন্ডের সঙ্গেও কথা বলেনি; এতটাই সম্মান সে তার বাবাকে করে। তাহলে আজ সেই সম্মান হুট করে সে কীভাবে ভঙ্গ করবে? এসব ভেবে ভেবে তার মাথা ব্যথা শুরু হয়ে গেছে। নিজেকে বড্ড ব্যর্থ মানুষ মনে হচ্ছে তার। এখন সে ব্যর্থ প্রেমিক হবে নাকি ব্যর্থ সন্তান এই প্রশ্নটাই তাকে ভোগাচ্ছে। প্রাপ্তির সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক ছিল না, এখনো নেই। শুধু দুজন দুজনকে ভালোবাসে; এ কথাটি দুজনেই জানে। কিন্তু এরপরও যদি সে প্রাপ্তিকে নিজের করে না পায় তাহলে এই দুঃখ সে কখনো মেনে নিতে পারবে না। প্রাপ্তিকে না পাওয়ার যন্ত্রণায় হয়তো সে একটু একটু করে বিলীন হয়ে নিঃশেষ হয়ে যাবে। তার খুব জানতে ইচ্ছে হয়, আল্লাহ্ আ’ত্ম’হ’ত্যা’কে কেন মহাপাপ বলেছেন! পথহারা ব্যক্তির ঐ একটাই পথ ছিল, সেটাও মহাপাপ বলে বন্ধ। সিদ্ধান্তহীনতায় আদনান ভেতর থেকে একটু একটু করে ভেঙে যাচ্ছে। সে বাড়িতে ফিরল বেশ রাত করেই। সারাদিন, সারা রাতেও সে ফোন অন করেনি আর।

এদিকে প্রাপ্তির দুশ্চিন্তা বাড়ছে বৈ কমছে না। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সকাল হলেই কাল আদনানদের বাসায় যাবে। রাতে সুমনা বেগম প্রাপ্তির বিয়ের বিষয়ে স্বামীকে কথাটি বললেন। ক্লান্তি দু’চোখে ঘুম ভর করায় ফিরোজ ইসলাম বললেন,

‘কাল এই বিষয়ে কথা বলব। আজ ক্লান্ত লাগছে ভীষণ।’
.
সকালে বাড়িতে গিয়ে রুমানা বেগম ছাড়া আর কাউকে পেলো না প্রাপ্তি। দরজা খুলে প্রাপ্তিকে দেখেই বুক থেকে ভারী নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে তার। তিনি প্রাপ্তিকে ভেতরে বসতে দিয়ে নাস্তা আনতে গেলেন। প্রাপ্তি উঁকিঝুঁকি দিয়ে এদিক-সেদিক তাকাচ্ছিল।

রুমানা বেগম এর মাঝেই নাস্তা এনে পাশে বসলেন। প্রাপ্তির দিকে এক পলক তাকিয়ে বললেন,

‘এত শুকিয়ে গেছিস কেন?’

প্রাপ্তি এ প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে অন্যভাবে বলল,’আঙ্কেল নেই বাড়িতে? বাড়ি কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে!’

রুমানা বেগমের চোখ ছলছল করছে। দু’চোখ অশ্রুতে টইটুম্বুর। অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে প্রাপ্তি। সে এগিয়ে গিয়ে তার পাশে বসে। হাত ধরে উৎকণ্ঠিত হয়ে জানতে চায়,

‘কী হয়েছে আন্টি? কাঁদছ কেন তুমি?’

তিনি কাঁদতে কাঁদতেই বললেন,’মা হয়েও ছেলেকে তার সুখ নিয়ে দিতে পারলাম না রে প্রাপ্তি!’

প্রাপ্তি কিছুই বুঝতে পারছে না। তবে ধীরে ধীরে তার ভেতরে অস্থিরতা বেড়েই চলেছে। সে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলল,

‘এভাবে কেন বলছ? কী হয়েছে?’

রুমানা বেগম নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে বললেন,’আদনান আর তুই দুজন দুজনকে ভালোবাসিস শুনে ভীষণ খুশি হয়েছি আমি। কিন্তু আমার ছেলেটাও যে ভীষণ অভাগা রে প্রাপ্তি। তোর ভালোবাসা পাওয়ার ভাগ্যটা ওর হলো না। তোদের বিয়ে তোর আঙ্কেল কিছুতেই মেনে নেবে না। আর আমার ছেলেটা কীরকম বাবার বাধ্য ছেলে তুই জানিস না? ও নিজের সাথে অনেক যুদ্ধ করেছে প্রাপ্তি। কিন্তু শেষমেশ ওর বাবার কাছেই ও’কে হারতে হয়েছে। ভালোবাসাকে ত্যাগ করতে হয়েছে।’

প্রাপ্তি জানত আসাদ রহমান ওদের সম্পর্কটা মানবে না। তবুও এ কথাটি যখন সত্য প্রমাণিত হলো তখন যেন তার ভেতরটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছিল। সে বাকি কথা শোনার জন্য চুপ করে রইল। রুমানা বেগম শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে ফের বলা শুরু করলেন,

‘কাল অনেক রাত করে অফিস থেকে বাসায় ফিরেছে। কেমন উশকো-খুশকো চুল! চোখ দুটো ফুলে আছে। বুঝতে আর বাকি রইল না, আমার হাসি-খুশি ছেলেটাও লুকিয়ে কেঁদেছে। নিজেকে আর আটকে রাখতে পারেনি। আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না করেছে। মা হয়ে ছেলের এই কষ্ট সহ্য করা যে কতটা দুর্দমনীয় প্রাপ্তি! আমি তোকে বলে বোঝাতে পারব না।’ এতটুকু বলেই শব্দ করে কান্না শুরু করেন তিনি।

প্রাপ্তি এবার আর নিজেকে আটকে রাখতে পারল না। তার দু’চোখ বেয়েও পানি পড়ছে। তিনি কাঁদতে কাঁদতেই বলছেন,

‘ও তোকে ছাড়তে না পারার যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল। আমি সহ্য করতে পারিনি। ওর বাবার কাছে গিয়ে পা ধরে বললাম, যেন সব মেনে নেয়। নি’ষ্ঠু’র, নির্দয় মানুষটার মন গলেনি। সে তার সিদ্ধান্তে একদম অনড় ছিল। আদনান তখন রুমে এসে কাঠ কাঠ গলায় বলল, ও তার বাবার বিরুদ্ধে যাবে না। কিন্তু চাকরীটা ছেড়ে দিয়েছে। আবারও চট্টগ্রাম ফিরে যাবে। তোর আঙ্কেল মেনে নিয়েছে এটা। আমি কত করে আদনানকে বোঝালাম না যাওয়ার জন্য! ছেলে শোনেনি আমার কথা। ওর এক কথা, ও তোর চোখে কাপুরুষ, ব্যর্থ মানুষ। এভাবে ও কখনোই তোর সামনে দাঁড়াতে পারবে না। তোর সামনা-সামনি হওয়ার সাহস নাকি ওর নেই। যাওয়ার আগে তোর জন্য একটা চিঠি রেখে গেছে। তোকে দিয়ে আসতে বলেছিল।’

প্রাপ্তি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল,’ও কখন গেছে?’

‘সকালেই। দশটায় বাস।’

প্রাপ্তি ফোনে সময় দেখে নিলো। নয়টা পঁয়ত্রিশ বাজে। রুমানা বেগম প্রাপ্তির হাত ধরে বললেন,

‘আমার ছেলেটাকে ভুল বুঝিস না মা। ওর যে আর কোনো উপায় নেই! ক্ষমা করে দিস।’

প্রাপ্তি তার কথার কোনো জবাব না দিয়ে,’আসছি আমি।’ বলে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। হন্তদন্ত হয়ে রিকশায় উঠে বাস স্ট্যান্ডে যাওয়ার জন্য রওনা হয়। প্রাপ্তির ভয় হতে লাগল, আদনান আবার অন্য কোনো রাস্তা দিয়ে যাবে না তো? ভয়ে ঘামতে লাগল। চোখের পানিও কোনো বাঁধা মানছে না। সে বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছাল ৯:৫৫ মিনিটে। সে ঘুরে ঘুরে আদনানকে খুঁজতে লাগল। বাসের কাছে যখন পৌঁছাল তখন দেখতে পেলো আদনান জানালার সাথে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে।

প্রাপ্তি ফুঁপিয়ে বলে উঠল,’আদনান!’

আদনান চমকে তাকাল প্রাপ্তির দিকে। প্রাপ্তিকে দেখে তার চমকের মাত্রা আরও বেশি বেড়ে যায়। সে সকল কিছু ভুলে নেমে আসে বাস থেকে। প্রাপ্তি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে বলে,

‘কেন চলে যাচ্ছ এভাবে?’

আদনানের চোখেও অশ্রু চলে আসে। সে প্রাপ্তির দু’গালে হাত রেখে চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,’তুই কাঁদিস না রক্তজবা! তোর চোখে পানি দেখতে আমার একদম ভালো লাগে না।’

বাস ছেড়ে দেওয়ার সময় হয়েছে। কন্টাক্টর সবাইকে তাড়াতাড়ি বাসে ওঠার জন্য তাড়া দিতে লাগল। আদনান ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই প্রাপ্তির কান্না বাড়ে। সে আদনানের হাত ধরে বলে,’প্লিজ!’

আদনান অসহায়কণ্ঠে বলে,’বাবার বিরুদ্ধে যেতে পারলাম না রে। আমায় মাফ করে দিস। এত কষ্ট করে আমায় বড়ো করেছে তার বিরুদ্ধে যাই কী করে বল? তুই চিন্তা করিস না। আমি অন্য কাউকে বিয়ে করব না। তবে তুই চাইলে বিয়ে করে নিতে পারিস। আমার কোনো সমস্যা নেই।’

আদনান এতটুকু কথা বলতেই কন্টাক্টর চেঁচাতে লাগল।

‘ভালো থাকিস।’ বলে আদনান হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বাসে উঠে যায়। ক্রন্দনরত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে প্রাপ্তি। বাস যখন ছেড়ে দেয় তখন বাসের সাথে সাথে প্রাপ্তিও দৌঁড়াতে শুরু করে। আদনান আর তাকিয়ে থাকতে পারল না। ছেলে মানুষের সবার সামনে কাঁদতে নেই। তবুও সে নিজেকে আর আটকে রাখতে পারেনি। নিজের জায়গায় বসে দু’হাতে মুখ ঢেকে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে।

বাস প্রাপ্তিকে রেখে অনেকদূর চলে গেছে। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে প্রাপ্তি রাস্তায় বসে পড়ে। চারপাশের মানুষজন তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে কৌতুহলী দৃষ্টিতে। এসব ভাবনা তার মাথায় মোটেও আসছে না। সে দিশেহারা হয়ে পাগলের মতো করে কাঁদছে শুধু।

চলবে…