আমার বোনু পর্ব-২৯

0
355

#আমার_বোনু
#Part_29
#Writer_NOVA

ঊষার নিখোঁজ হওয়ার তেরো ঘন্টা হয়ে গেছে। কিন্তু এখনো ঊষার কোন খোঁজ নেই। পাঁচ ভাই আর জিবরান পুরো ঢাকা শহর তন্নতন্ন করেও ঊষার হদিস মেলাতে পারলো না। নিজস্ব লোক, আশেপাশের সব খোঁজ করেও কাজ হলো না। বর্তমানে তারা সবাই ড্রয়িংরুমের সোফায় এলোমেলো হয়ে বসে আছে। অরূপ অর্ণবের সামনে গিয়ে বললো,

— রিসোর্টের সি সি টিভি ফুটেজ চেক করে তেমন সন্তোষজনক ফলাফল আসেনি। বোনুকে পেছনের দিকে যেতে দেখা গেছে। কিন্তু তাকে ফিরে আসতে দেখা যায়নি। সেদিকে কোন সি সি টিভি না থাকায় কিডন্যাপার তা কাজে লাগিয়েছে।

অর্ণব এক পলক অরূপের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে ফেললো। ইশাত বিষন্নতার সুরে বললো,
— এমন কোন সম্ভাব্য জায়গা নেই যা আমরা খুঁজিনি। লোকেশন ট্রেস করেও ফলাফল শূন্য। করবোটা কি আমরা?

ঈশান সামনের সোফায় লাথি মেরে চেচিয়ে উঠে বললো,
— হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে তো কাজে দিবে না। ওকে তো খুঁজতে বের হতে হবে।

নুহা কিছুটা সাহস জুগিয়ে এগিয়ে এসে বললো,
— গতকাল রাত থেকে হন্যি হয়ে আপুকে খুঁজছেন। সেই রাত থেকে কিছু খাননি। এখন একটু কিছু মুখে দেন। নয়তো আপনারা অসুস্থ হয়ে যাবেন।

ঈশান দাঁত কটমট করে নুহার দিকে তাকালো। এখন নুহা ছাড়া অন্য কেউ হলে তাকে চিবিয়ে খেতো। ওর বোন নিখোঁজ আর এখন কিনা আদিখ্যেতা মার্কা কথাবার্তা বলছে। ঈশানের চাহনীতে নুহা মুখটাকে কাচুমাচু করে ফেললো। জিবরান এতখন ধরে ফ্লোরে দুই হাতে মাথা চেপে ধরে হাঁটু ভেঙে বসে ছিলো। মাথা তুলে নুহাকে বললো,

— কেউ খাবে না নুহা। তুমি এখন এসব কথা বলো না। এমনি মাথা খারাপ। তার মধ্যে এসব কথা শুনলে কারো মেজাজ ঠিক থাকবে না।

নুহা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে মাথা নাড়লো। অথৈ ধীর পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আদিলকে জিজ্ঞেস করলো,
— কোন খোঁজ পেলে আদি? কিংবা কোন ক্লু?

আদিল নিষ্পলক দৃষ্টিতে অথৈ এর দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় উত্তর দিলো,
— না!

অথৈ এসে স্বামীর পাশ দিয়ে বসে পরলো। জিনিয়া এগিয়ে এসে জিবরানের কাঁধে হাত রেখে বললো,
— এতো ভেঙে পরছিস কেনো ভাই?সব ঠিক হয়ে যাবে, ইন শা আল্লাহ। তোর ঊষা তোর কাছে ফিরে আসবে। তোকে এভাবে আমি নিতে পারছি না। নিজেকে শক্ত কর।

জিবরান বোনকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। তার নিজের কাছে নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হচ্ছে। একপাশে তারিন গুটিসুটি মেরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তার অনেক ইচ্ছে করছে দৌড়ে গিয়ে ইশাতকে জড়িয়ে ধরে বলতে, “তুমি ভয় পেয়ো না ইশাত, তোমার বোনের কিছু হবে না। তোমরা ঠিক খুঁজে পাবে।” কিন্তু কোথায় জানি একটা জড়তা কাজ করছে। কোন অদৃশ্য শক্তি তাকে আটকে রেখেছে। সে চাইলেও এগিয়ে গিয়ে ইশাতের পাশে বসে স্বান্তনা দিতে পারছে না।

অর্ণব এবার নড়েচড়ে উঠে দাঁড়ালো। কঠিন গলায় বললো,
— অনেক হয়েছে! আর হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। পুলিশ, নিজেদের লোক, আশেপাশের সিকিউরিটি কোন কিছুতো বাকি রাখলাম না। এবার আমাদের কিছু করতে হবে।

আদিল তার ভাইয়ের কথার সাথে তাল মিলিয়ে বললো,
— হ্যাঁ আমাদেরি মিশনে নামতে হবে। আমি সিউর ক্লু আমাদের সামনেই ঘুরছে। কিন্তু আমরা ধরতে পারছিনা। অরূপ!

অরূপকে ডাকতেই অরূপ জোরে চেচিয়ে বললো,
— জ্বি মেজো ভাই।

আদিল অথৈকে ইশারা করে ভেতরে যেতে বললো। কিন্তু অথৈ বুঝালো সে এখানেই ঠিক আছে। আদিল অরূপকে বললো,

— রিসোর্টেের সিসি টিভি ফুটেজগুলো নিয়ে আসো৷ আমি চেউক করবো। আমার এজেন্সিকে বিষয়টা জানিয়ে দিয়েছি। তারা তাদের কাজ শুরু করে দিয়েছে। আমাকে আশ্বাস দিয়েছে তাদের সাধ্যমতো কাজ করবে। আর হ্যাঁ, সাথে ইশাতকে নিয়ো।

অরূপ বেরিয়ে গেলো। তখুনি অর্ণবের মোবাইলে একটা কল এলো। অচেনা নাম্বার দেখে অর্ণবের কপাল কুঁচকে এলো। কিডন্যাপার টাকা দাবী করতে কল করেনি তো? যত টাকা লাগুক সব দিবে। কিন্তু তার বোনকে অক্ষত ফেরত পেলেই চলবে।

মাসফি অর্ণবের নাম্বারে কল করে জিকুর দিকে তাকালো। অর্ণবকে কল সেই করেছে৷ অর্ণব কল ধরে বললো,

— কাকে চাই?

মাসফি ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো,
— অর্ণব মির্জা, আপনার সাথে আমার কথা আছে।

— কে বলছেন আপনি?

— আমি মাসফি শিকদার।

— অদিতির ভাই মাসফি শিকদার?

— জ্বি।

— হ্যাঁ কি বলবেন বলুন।

— এত কথা মোবাইলে বলা সম্ভব নয়। আমি সামনাসামনি দেখা করতে চাইছি। আই হোপ আমার সমস্যার সাথে আপনাদের বোন নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টা কানেক্টেড। যদি আমার সমস্যার সমাধান পেয়ে যাই তাহলে আপনারাও আপনাদের বোনকে পেয়ে যাবেন।

— আপনি ঠিক কি বলতে চাইছেন তা আমি বুঝতে পারছি না। অনুগ্রহ করে একটু খুলে বলুন।

মাসফি প্রথম থেকে সব খুলে বললো। আরাভ শিকদারের কোন বিষয় বাদ রাখলো না। এমনকি নিজের কার্যকলাপের কথাও বাদ দিলো না। অর্ণব সব শুনে বুঝতে পারলো কাজটা কার। সে রেগে বললো,

— এটা কে করেছে আমি বুঝে গেছি। ওর মৃত্যু হানা দিয়েছে। এক মিনিট এসবের সাথে আবার আপনার কোন কানেকশন নেই তো মাসফি সাহেব।

মাসফি নিজের চুল টেনে ধরে চেচিয়ে বললো,
— দেখুন গতরাতে শুধু আপনার বোন কিডন্যাপ হয়নি। আমার বোন অদিতিও কিডন্যাপ হয়েছে। আমি সিউর ওরা দুজন একসাথে আছে। নিজের বোনের এই অবস্থায় আমি কেন আপনাদের সাথে শত্রুতা করবো৷ হ্যাঁ, আমি ভুল করতে নিয়েছিলাম। যা আমার বোন ভেঙে দিয়েছে। তাই আমি সব ছেড়ে বোনকে নিয়ে নিউইয়র্ক পারি দিতে চেয়েছি।

অর্ণব অবাক গলায় বললো,
— বলেন কি? আপনার বোন অদিতিও রিসোর্ট থেকে কিডন্যাপ হয়েছে?

আদিল চমকে ভাইয়ের দিকে তাকালো। তার হৃৎপিণ্ডটা ধক করে উঠেছে। সে উঠে গিয়ে অর্ণবের পাশে দাঁড়িয়ে গেলো বাকি কথা শোনার জন্য। মাসফি চিন্তায় নিজের কপাল চেপে ধরে বললো,

— সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো আমি যেভাবে আপনাদের বোনকে কিডন্যাপ করার প্ল্যানিং করেছিলাম ঠিক সেভাবেই আপনার আর আমার বোনের কিডন্যাপিংটা হয়েছে।

— এখন ওদের কোথায় খুঁজে পেতে পারি বলুন তো? সম্ভাব্য জায়গার নাম বলুন।

মাসফি কপাল চেপে ধরে ব্রেণের ওপর জোর দিয়ে কিছু মনে করার চেষ্টা করলো। তারপর বেশ কিছু সময় পর মনে করতে সক্ষম হলো। চাঞ্চল্যের সহিত চেচিয়ে বললো,

— আরাভ শিকদারের গোডাউনে কিংবা বাংলো তে খুঁজলে আমরা পেতে পারি। দেখুন আমাদের দুজনের সমস্যা যেহেতু এক। তাই আমি চাইছি আমরা এক হয়ে কাজ করি। তাতে আমাদের জোর বাড়বে।

— আচ্ছা ঠিক আছে। আপনি বের হোন। আমরা হাইওয়ে তে একসাথে মিলছি।

— জ্বি নিশ্চয়ই। তবে জলদী করবেন। আমাদের হাতে সময় কম।

কল কেটে মাসফি চেয়ারে ধপ করে বসে পরলো। এর জন্য বলে অন্যের জন্য কুয়া খুদতে নেই। নয়তো সেই কুয়ায় নিজেকে পরতে হয়। যেই প্ল্যানিং ঊষাকে কিডন্যাপ করতে সে করেছিলো তা কোনভাবে জেনে ওর বোনের ওপর কাজে লাগিয়েছে। অদিতির জন্য ভীষণ ভয় করছে তার। আপন বলতে তো এই একটা বোন আর আরানই আছে। এই আরানের খোঁজ নেই দেড় দিন ধরে। ওকে কোথায় হাওয়া করলো আরাভ শিকদার। চোখ, মুখ মুছে মাসফি জিকুকে আদেশ করলো,

— গাড়ি বের করো জিকু। আমরা এখুনি বের হবো।

— জ্বি বস।

অন্যদিকে এই খবর শুনে ঊষার পাঁচ ভাই ও জিবরান এক সেকেন্ডও দেরী করেনি। দ্রুত বের হয়ে গেছে। লক্ষ্য তাদের একটাই, বোনকে ফিরিয়ে আনতে হবে।

ছোট্ট ভেন্টিলেটর দিয়ে তীব্র রোদের আলোর ছিটেফোঁটা আসতেই ঊষা নড়েচড়ে উঠলো। কিছু সময় চোখ বন্ধ করে এপাশ ওপাশ মাথা নাড়ালো।মাথাটা কেমন ভার হয়ে আছে। পিটপিট করে চোখ খুলতেই আবছা আলোতে নিজেকে আবিষ্কার করলো। কেমন নোংরা পরিবেশ। ধুলো-বালিতে পুরো রুম মাখামাখি। দেখে বোঝাই যাচ্ছে বহুদিন ধরে এই রুমের কোন যত্ন নেওয়া হয়না। একপাশে কতগুলো মোটা বস্তা ফেলে রাখা। সেগুলোর ভেতর কি আছে তা ঊষা আন্দাজ করতে পারলো না। পুরো রুমে গুমোট পরিবেশ। ভাঙা চেয়ার, বেঞ্চে পরিপূর্ণ। কোণার দিকে পুরনো একটা বুকশেলফ। ঊষার ধারণামতে এটা একটা স্টোর রুম।

ঊষা কষ্টেসৃষ্টে উঠতে নিলেই টের পেলো তার হাত বাঁধা। বিস্মিত চোখে লাফ দিয়ে উঠতে চাইলেও সে ব্যর্থ। মাথাটা ঘূর্ণি দিয়ে উঠলো। কোথায় আছে সে তা মনে করতে চাইলো। মিনিট খানিক চেষ্টা করতেই সে সক্ষম হলো। গতকাল সে পেছন দিকে যেতেই কেউ তার মুখে ক্লোরোফোম স্প্রে করেছিলো। তারপর তার কিছু মনে নেই। ধুলো-ময়লায় তার শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। দক্ষিণ আর পূর্ব দিকের ভেন্টিলেটর দিয়ে যতটুকু অক্সিজেন আসছে তাতে ঊষার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। গলা ফাটিয়ে সে একটা চিৎকার দিয়ে বললো,

— কেউ আছেন? এনিওয়ান হেয়ার!

তখুনি ঊষার দৃষ্টি গেলো পাশের দিকে। সেখানে আরেকটা মেয়ে বস্তার মধ্যে মাথা হেলিয়ে রেখেছে। মেয়েটাকে চিনতে তার কয়েক সেকেন্ড লাগলো। চেচিয়ে বললো,

— অদিতি আপু!

কিন্তু অদিতির হুশ নেই। অদিতি আগে প্রায় সময় আদিলের সাথে ওদের বাসায় আসতো।সেই সুবাদে চেনা। অদিতিকে তার ভীষণ পছন্দ ছিলো। তারপর হঠাৎ করে অদিতির গায়েব হওয়া শুনে ঊষার ভীষণ ভয় হয়েছিলো। কিন্তু যখন জানলো অদিতি না জানিয়ে নিউইয়র্ক চলে গেছে তখন বেশ রাগ হয়েছিলো তার। অদিতির বিরহে আদিলের অবস্থা সে মেনে নিতে পারছিলো না। তাই অদিতির প্রতি চাপা ক্ষোভ থেকেই আদিলকে ফোর্স করে অথৈকে বিয়ে করার জন্য। কিন্তু আসল গল্প কিন্তু ছিলো ভিন্ন। অদিতিকে আটকে রেখে আরাভ শিকদার এই বানোয়াট গল্প সাজিয়েছিলো।

ঊষা বহু কষ্টে উঠে গিয়ে অদিতিকে মাথা দিয়ে ঠেলতে লাগলো। কিন্তু অদিতির রেসপন্স নেই। হঠাৎ দরজা খুলে গেলো। সাথে সাথে বাইরে থেকে এক ঝাটকা আলো এসে ঊষার চোখে বারি খেলো। ঊষা চোখ বন্ধ করে ফেললো। হুট করে এতো আলো তার চোখ নিতে পারছে না। সেই আলোতে একটা অবয়ব ধীরে ধীরে ঊষার পায়ের কাছে এসে বসলো। মুখে পৈশাচিক হাসি রেখে ইনোসেন্ট ফেস করার ভান করে বললো,

— কেমন আছো ঊষারাণী?

ঊষা রেগে চেচিয়ে উঠলো,
— একদম ঊষারাণী বলবেন না। এই নামে ডাকার অধিকার শুধুমাত্র আমার জিবরানের।

অবয়বটা উচ্চস্বরে হো হো করে হেসে উঠলো। সেই হাসির শব্দে ঊষার কানে তালা লাগার জোগাড়। সে পেছন দিক দিয়ে অদিতিকে ঠেলতে লাগলো। কিন্তু অদিতির জ্ঞান ফিরেনি। অবয়বটা হুট করে হাসি থামিয়ে মুখটাকে কঠিন করে বললো,

— তোমার জামাইটা এমন কেন? ওরে কতগুলো ছবি পাঠালাম, একটা বাল্ঙ্ক ম্যাসেজ পাঠালাম তবুও বিশ্বাস করলো না। এমন ছেলে আজকালকার দিনে হয়? বউয়ের পরপুরুষের সাথে এত ঘনিষ্ঠ ছবি দেখেও বউকে সন্দেহ করে না। স্ট্রেঞ্জ!

ঊষা ছবির বিষয় কিছুই জানে না। তার ভাইরা কিংবা জিবরান এই ব্যাপারে কিছু বলেনি। সে মুখে বিস্মিত ভাব রেখে জিজ্ঞেস করলো,

— কিসের ছবি?

— ওহ তোমার ভাই,স্বামী এসব বিষয় কিছু বলেনি। আচ্ছা, ছাড়ো এসব। দেখো তো আমাকে চিনো নাকি।

ঊষা চোখ তুলে তাকালো। তাকিয়ে আৎকে উঠলো। এই তো সেই রেইনকোট পরিহিত ব্যক্তিটা। একি রুমাল বাঁধা মুখে, চোখে একি সানগ্লাস। ঊষা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,

— কে আপনি?

সে আবারো হো হো করে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে এক টানে মুখের রুমাল আর চোখের সানগ্লাস খুলে ফেললো। বাঁকা হাসি দিয়ে বললো,

— এবার চিনতে পেরেছো?

ঊষা বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে প্রায় চিৎকার করে বলে উঠলো,

— পিয়াস!

~~~ যে আপনার নীরবতার ভাষা বুঝে না, তাকে রচনা লিখে দিলেও আপনাকে বুঝবে না🍁।

#চলবে