আমার বোনু পর্ব-৩০ এবং শেষ পর্ব

0
532

#আমার_বোনু
#Last_Part
#Writer_NOVA

পুরনো গোডাউনে ঊষার পাঁচ ভাই, জিবরান, মাসফিকে আটকিয়ে ফেলেছে আরাভ শিকদার।সেই খুশিতে গদগদ হয়ে সামনের এক চেয়ারে বসে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছেন। হাজারো উচ্ছ্বাস তার মনে এসে টিনটিন করে বারি খাচ্ছে। পাশেই পিয়াস মনোযোগ সহকারে মোবাইলে টেম্পল রান গেমস খেলছে। ওরা সবাই গোডাউনে আসতেই চালাকি করে আরাভ শিকদারের লোকেরা ধরে ফেলেছে। সারিবদ্ধভাবে লোহার স্ট্যান্ডের সামনে দাঁড়া করিয়ে হাত বেঁধে রেখছে। প্রত্যেকের চোখে অগ্নদৃষ্টি। এই মুহুর্তে যদি এখান থেকে ছাড়া পেতো তাহলে আরাভ শিকদার আর পিয়াসকে মেরেই ফেলতো। ঈশান চেচিয়ে উঠলো,

— কাপুরুষের বাচ্চা পেছন থেকে আ্যাটাক করিস কেন? লজ্জা করে না? বেশরম, বেহায়া, নির্লজ্জ্ব। একবার শুধু ছাড়া পাই। দুজনকে মোয়া বানিয়ে ফেলবো।

পিয়াস ঈশানের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসি দিলো। সে হাসি দেখে ঈশানের পিত্তি জ্বলে উঠলো। ঝাড়া দিয়ে এগিয়ে আসতে চাইলো। মনে হচ্ছে লোহার স্ট্যান্ড ভেঙে, দড়ি ছিঁড়ে চলে আসবে। এতে পিয়াস একটু হাত উঠিয়ে ভয় পাওয়ার অভিনয় করলো। অরূপ চোখ রাঙিয়ে তাকালো। পিয়াস সেসব পাত্তা না দিয়ে ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে আরাভ শিকদারকে বললো,

— কি জানি একটা মিসিং মনে হচ্ছে শিকদার সাহেব! ওদের মধ্যে কে নেই বলুন তো?

আরাভ শিকদার সবার দিকে চোখ বুলিয়ে বললো,
— সবাই তো আছে। শুধু আমার গাধা আরান বাদে।

পিয়াস মাথা নাড়িয়ে বললো,
— উহু আরো একজন মিসিং।

মাসফি বুঝে গেলো কার কথা বলছে। জিকুকে আরাভ শিকদারের বাংলোতে পাঠিয়েছিলো। মাসফির ধারণামতে সেখানে অদিতি, ঊষাকে না পেলেও আরানকে পাবেই। অর্ণব চেচিয়ে বললো,

— আরাভ শিকদার আমরা তোর কি ক্ষতি করেছি? তুই আমাদের আটকিয়েছিস কেন?

আরাভ শিকদার মেকি হাসি দিয়ে বললো,
— না তোদের সাথে আমার কোন শত্রুতা নেই।

পিয়াস মোবাইল রেখে এক হাত উপরে তুলে বললো,
—শত্রুতা আমার সাথে বড় ভাই। আপনাদের বোনটাকে পছন্দ করে বিয়ে করতে চাইলাম। কিন্তু আপনারা করলেন কি এই জিবরানের সাথে তড়িঘড়ি করে বিয়েটা দিয়ে দিলেন৷ আমি কোন দিক দিয়ে এই জিবরানের থেকে কম বলুন তো?

ইশাত ফোঁস করে উঠে বললো,
— মনের দিক থেকে। তোর মন আসলেই ছোট। জিবরান আমাদের বোনকে আনেক ভালোবাসে। ওর গায়ে কোন আঁচড় আসতে দেয় না। কিন্তু তুই… ওয়াক থু! তোর মতো মানুষের কাছে নিজের বোনকে বিয়ে না দিয়ে আনেক ভালো করেছি।

ইশাত এক দলা থু থু সামনের দিকে ছুঁড়ে মারলো। পিয়াস চোখের ইশারা করতেই দুটো গার্ড গিয়ে ইশাতকে ইচ্ছে মতো কিল ঘুষি বসিয়ে দিলো। ঈশান পাশ থেকে সুবিধামতো একটা গার্ডের তলপেট বরাবর কষিয়ে লাথি বসিয়ে দিলো। পেট চেপে ধরে মুখ থুবড়ে পরে গেলো। আরেকজন এগিয়ে আসতেই পা দুটো উপরের দিকে উঠিয়ে মুখ বরাবর লাথি ছুঁড়ে মারলো। সেটাও দূরে ছিটকে পরলো। ঈশান মোটামুটি ভালোই ফাইটিং জানে। কিন্তু ইশাত এসবের ধারের কাছে নেই। তাই সে বর্তমানে মার খেয়ে চোখে সরিষা ফুল দেখে অজ্ঞান হয়ে গেছে। জিবরান আক্রোশ নিয়ে বললো,

— পিয়াস, ভালোই ভালোই বল ঊষা কোথায়?

পিয়াস শার্টের কলারটা ঠিক করে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললো,
— আমার কাছেই আছে। আমাদের বাসার স্টোর রুমে আটকে রেখেছি। চিন্তা করো না জিবরান। তোমার ঊষাকে আমি অনেক সুখে রাখবো। আগামীকাল সকালে আমার আর ঊষার দুবাইয়ের ফ্লাইট। এর আগে এক পলক দেখতে পাবে কিনা বলতে পারছি না।

আদিলের পেছন পকেটে থাকা মোবাইল কলে তার এজেন্সি যুক্ত আছে। তারা এসব শুনতে পেয়ে দ্রুত পিয়াসের বাসার দিকে রওনা দিলো। মাসফি বিরক্তির সহিত পিয়াসকে বলে উঠলো,

— তোর আমার সাথে কিসের দুশমনি? তোর কোন বাড়া ভাতে আমি ছাই দিয়েছি?

পিয়াস উচ্চস্বরে হাসতে হাসতে আরাভ শিকদারকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— দেখেন আপনার ভাতিজা বলে কি?

আরাভ শিকদারও হাসিতে যোগ দিলো। পিয়াস হাসি থামিয়ে বললো,
— দেখ ভাই তোর সাথে আমার কোন দুশমনি নেই। তোর চাচার সাথে তোর দুশমনি। আমার সাথে মির্জাদের। তাই দুই দলকে একসাথে তুলে এনেছি। যাতে এক পলকে কিচ্ছা খতম করতে পারি।

অরূপ হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠলো। ওর হাসি দেখে আরাভ শিকদার ও পিয়াসের কপাল কুঁচকে এলো। ছেলেটা হঠাৎ পাগল হয়ে গেলো নাকি। অরূপ হাসি থামিয়ে বললো,

— পিপীলিকার পাখা গজায় মরণের তরে৷ তোদের দুজনের সেম অবস্থা হয়েছে।

পিয়াস তার চুলগুলো পিছন দিকে ঠেলে দিয়ে বললো,
— কে মরে আর কে বাঁচে তা দেখা যাক।

আরাভ শিকদার উঠে আদিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। পৈশাচিক হাসি দিয়ে বললো,
— একটা সিক্রেট জানবে আদিল?

আদিল চোখ দুটো অগ্নিবর্ণ করে চোয়াল শক্ত করে কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করলো,
— কিসের সিক্রেট?

আরাভ শিকদার মুখটাকে ইনোসেন্ট করে বললো,
— তোমার অদিতি তখন নিউইয়র্ক যাইনি। ওর বাবা-মা কে যে আমি মেরে ফেলেছি তা জানতে পেরে গিয়েছিলো। তাই আমি ওকে আটকে রেখেছিলাম৷ আর মাসফির কাছে তোমার আর ঊষার নামে ঠান্ডা মাথায় সব দোষ চাপিয়ে দিয়েছিলাম। তাই তো মাসফি তোমাদের বোনের ক্ষতি করতে উঠেপড়ে লেগেছে।

আদিল চিৎকার করে উঠলো,
— আরাভ শিকদার! তোকে আমি কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলবো৷ তুই আমার থেকে আমার অদিতিকে কেড়ে নিয়েছিস।

মাসফিও রাগে ফাটছে। সে উচ্চস্বরে বললো,
— তোর মতো মানুষকে নিজের চাচা বলে সম্বোধন করতেও ঘৃণা হয়। টাকা-পয়সা, জায়গায়-জমির লোভে তুই আমার বাবা-মা কেও ছাড়লি না।

আরাভ শিকদার চেচিয়ে বললো,
— তোকেও ছাড়বো না।

ঈশানের হাতের দড়িতে কারো হাত পরতেই ওর ভ্রু কুঁচকে এলো। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই জিকুকে দেখলো। জিকু মুখে আঙুল দিয়ে হুশ করে চুপ থাকতে বললো। ঈশানের হাত খুলে মাসফির দিকে গেলো৷ ইশাত মারের চোটে জ্ঞান হারিয়েছে। ওর হাতের বন্ধনী খুললে ধপ করে নিচে বসে পরবে। এতে বুঝে যাবে৷ তাই ওর বন্ধন খুললো না। একে একে সবার হাতের বন্ধনী খুলে জিকু মাসফির কাছে গিয়ে নিচুস্বরে বললো,

— বস, আপনার ধারণা ঠিক। বাংলোতে গিয়ে আমি আরানকে পেয়েছি। ওকে একটা রুমে বন্দী করে রেখেছিলো।

মাসফি ফিসফিসিয়ে বললো,
— তুমি এখান থেকে সটকে পরো। তোমাকে দেখলে বুঝে ফেলতে পারে।

— ওকে বস!

অর্ণব আদিলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— এখন কি করবি আদি?

আদিল সবাইকে আদেশের সুরে বললো,
— যে যেভাবে দাঁড়িয়ে আছো সেভাবেই থাকো। ওরা যাতে বুঝতে না পারে আমাদের হাত খোলা।

আদিলের কথায় সবাই নড়াচড় না করে আগের মতো দাঁড়িয়ে রইলো। জিকু আস্তে করে সটকে পরতে নিলেই ঘটলো বিপত্তি।পেছন দিকে সারিবদ্ধ ভাবে অনেকগুলো কাচের বোতল সাজানো ছিলো।জিকুর হাতের সাথে বেজে একটা বোতল পরে ঠাস করে ভেঙে গেলো। পিয়াস দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দুই হাত বুকে গুঁজে বললো,

— আমি বলেছিলাম না শিকদার সাহেব কেউ তো একজন মিসিং। দেখলেন তো আমার ধারণাই সঠিক। এই যে আপনার ভাতিজার চামচা মিসিং ছিলো।

আরাভ শিকদার চোখ গরম করে জিকুর দিকে তাকালো। পিয়াস এগিয়ে আসলো। তার গার্ডদের বললো,

— তাকিয়ে কি দেখছিস? ধর এটাকে।

গার্ড এগিয়ে আসতে নিলে জিকু মারামারি শুরু করলো৷ সে খুব ভালো মারপিট করতে পারে। বাকি গার্ডগুলো এগিয়ে আসতে নিলে ঈশান, আদিল ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পরলো। আকস্মিক আক্রমণে পিয়াস ঘাবড়ে গেলো। চেচিয়ে বললো,

— ওহ শীট!

জিবরান এগিয়ে গিয়ে ইশাতের হাতের বাঁধন খুলে দিলো।অরূপ দৌড়ে ফাইট করতে চলে গেলো৷ অর্ণব জিবরানের দিকে এগিয়ে আসলে জিবরান বললো,

— বড় ভাই, দেখেন তো আশেপাশে পানি পাওয়া যায় কিনা।

অর্ণব এদিক সেদিক তাকিয়ে দূরের টেবিলে পানির জগ দেখতে পেলো। সেদিকে ছুটলো। তারা এখন ইশাতের জ্ঞান ফিরাতে ব্যস্ত।মাসফি দৌড়ে গিয়ে আরাভ শিকদারকে কাবু করে ফেললো। ঈশান পিয়াসকে ধরেছে। জিকু, অরূপ বাকিগুলোকে সামলাচ্ছে। টানা বিশ মিনিট সেই যুদ্ধ হলো৷ একেকজন রক্তাক্ত অবস্থায় পরে আছে। শার্ট,প্যান্ট ছিঁড়ে অবস্থা খারাপ। অরূপ পাশ থেকে একটা কাঠ উঠিয়ে পিয়াসের মাথায় বারি মেরে বললো,

— তোর সাহস হয় কি করে আমার বোনুকে কিডন্যাপ করার? এবার তার মজা বুঝবি।

পিয়াস মাথায় হাত দিয়ে ঠাস করে পরে গেলো। মাথা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। পিয়াস অজ্ঞান হয়ে গেছে। আরাভ শিকদার হাঁপাচ্ছে। তার নাক, মুখ দিয়ে রক্ত পরছে। ইশাতের জ্ঞান ফিরেছে। সে এখন অর্ণব,জিবরানের সাথে বসে বসে একশন সিন উপভোগ করছে।তখুনি আদিলের এজেন্সির লোক অদিতি এবং ঊষাকে নিয়ে ফিরে এলো। সারা গোডাউন ঘেরা দিয়ে সবাইকে আটকে ফেললো। ঊষা এগিয়ে এসে চেচিয়ে উঠলো

— ভাইয়ুরা!

বোনের কন্ঠস্বর পেয়ে সব ভাইয়ের মনে হলো জান ফিরে এসেছে৷ মারামারি থামিয়ে পাচ ভাই বোনের দিকে ছুটে এলো। বোনকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলো। অদিতি এগিয়ে এসে ভাইয়া বলে মাসফির বুকে ঝাপিয়ে পরলো। মাসফি বোনের কপালে চুমু খেয়ে বললো,

— তুই ঠিক আছিস তো অদিতি?

অদিতি মাথা ঝাকালো। আদিল একবার ছলছল চোখে অদিতির দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো। তার ভেতর ফেটে কান্না আসছে৷ ঊষা নিজেকে ভাইদের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে জিবরানের কাছে গেলো৷ সে মাথা নিচু করে বসে ছিলো। ঊষা সামনে গিয়ে জিবরানকে জড়িয়ে ধরতেই জিবরানও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সারা মুখে অজস্র চুমু খেলো। তারপর ওর কাঁধে মুখ গুঁজে চুপ করে রইলো। মিনিট খানিক পর ঊষার কাঁধে ঠান্ডা কিছুর আভাস পেতেই ঊষা বুঝলো জিবরান কাঁদছে। কান্নারত অবস্থায় বললো,

— আমার মনে হচ্ছিলো আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলছি। বারবার মন বলছিলো তুমি আমার কাছে ফিরবে না।

সবাই ঊষা আর অদিতিকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলো। এই সুযোগে আরাভ শিকদার পাশের থেকে একটা ভাঙা কাচের বোতল উঠিয়ে নিলো। মাসফিকে এক ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে অদিতির গলায় ভাঙা বোতলটা চেপে ধরে বললো,

— যে যেখানে আছো সেখানে দাড়িয়ে থাকো। এক পা নড়লে অদিতিকে লাশ বানিয়ে ফেলবো।

মুহুর্তে সবাই ভড়কে গেলো। কেউ এগিয়ে আসতে পারছে না। শুধু ঊষার চাপাস্বর শোনা গেলো।

— অদিতি আপু!

অদিতি করুণ চোখে একবার নিজের ভাইয়ের দিকে আরেকবার আদিলের দিকে তাকালো। আরাভ শিকদার খুশিতে হো হো করে হাসতে লাগলো। নিস্তব্ধতা চিড়ে তার হাসিটা ভীষণ বাজে শুনাচ্ছিলো। বেশিখন হাসতে পারলো না। একটা গুলির শব্দের সাথে সাথে হাসির শব্দ মিইয়ে গেলো। তারপর আরো একঝাঁক বুলেট এসে আরাভ শিকদারের দেহটাকে ক্ষত-বিক্ষত করে দিলো। মুখ থুবড়ে পরে গেলেন তিনি। সবাই অবাক চোখে পিছনে তাকালো।মাসফি প্রায় চিৎকার করে বলে উঠলো,

— এটা কি করলি আরান?

আরান হাতের রিভলবারটা দূরে ছুঁড়ে মেরে শান্ত গলায় বললো,
— যা দেখলে তাই করলাম।

অদিতি অবিশ্বাস্য গলায় বললো,
— তুই নিজের বাবাকে মেরে ফেললি আরান?

আরান তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
— বড্ড বেশি বেড়েছিলো উনি। তাই তার উড়া বন্ধ করে দিলাম। এমন মানুষের পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই।

সময় চোখের পলকে ছুটে চলছে। দেখতে দেখতে কেটে গেলো তিন মাস। কতকিছু বদলে গেছে। মাসফি, অদিতি সেদিনের ঘটনার পর এক সপ্তাহের মধ্যে নিউইয়র্ক চলে গেছে। আরান এখন মায়ের সাথে থাকে। নিজে একটা ছোটখাটো ব্যবসা শুরু করেছে। তার বাবার যাবতীয় সয়সম্পত্তি সে এতিমখানায় দিয়ে দিছে। মাসফির ভাগেরটা মাসফিকে বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু মাসফি তা নেয়নি। আরানকে দিয়ে গেছে। আরানের সাথে ঈশানের এখন গলায় গলায় ভাব। একজন আরেকজনকে ছাড়া চলতেই পারে না। এক দমকা হাওয়া এসে সব ঠিক করে দিয়ে গেছে। পিয়াস এখন জেলে আছে। তাকে ছাড়ানোর জন্য তার পরিবার এগিয়ে আসেনি। এতবড় অন্যায় করায় তাকে তার বাবা তাজ্য পুত্র করেছে। জীবন এগিয়ে চলছে দ্রুত।

মির্জা কুঠির…..

ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে হৈ-হুল্লোড় চলছে। পাঁচ ভাই বসে শলাপরামর্শ করছে। আজকে বাসায় ছোটখাটো একটা গেট টুগেদারের ব্যবস্থা করেছে। তারিন, রাহী, নুহাও আছে। তাদের পরিবারও এসেছে। অথৈ এর একটা ফুটফুটে মেয়ে হয়েছে। অনলের এখন সেই বোনকে নিয়ে দিন কাটে। কাউকে ধরতে দেয় না। নিজে নিতে না পারলেও ধরে বসে থাকবে। কেউ নিতে গেলে চেচিয়ে বলে,

— আমার বোনুকে কেউ ধরবে না।

জিনিয়া, অথৈ আজ হয়রান হয়ে যাবে। কিচেনে সবার জন্য কাচ্চি বিরিয়ানি বসিয়েছে। অরূপের কোলে আদিলের মেয়ে। অনল অরূপকে শুধু একটু ধরতে দেয়। কিছু সময়ের মধ্যে জিবরান ওর মাকে নিয়ে হাজির হলো। ঊষা ড্রয়িং রুমে শরবতের ট্রে নিয়ে হাজির হলো। তার শ্বাশুড়ি মাকে একটা গ্লাস এগিয়ে দিয়ে সালাম দিলো,

— আসসালামু আলাইকুম মা! কেমন আছেন?

জিবরানের মা মুখে হাসি টেনে বললো,
— ওয়া আলাইকুমুস সালাম মা। আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?

— জ্বি মা ভালো আছি।

জিবরানের সাথে ঊষার চোখাচোখি হতেই জিবরান চোখ মেরে চুমু দেখালো। ঊষা এদিক সেদিক তাকিয়ে চোখ রাঙালো। তাতে জিবরান হাত দিয়ে বুকের বা পাশ ধরে অজ্ঞান হওয়ার মতো করে সোফায় হেলে পরলো। ঊষা হাসতে হাসতে ট্রে নিয়ে চলে গেলো। মা, ভাই এসেছে দেখে চুলোয় রান্নার আচঁ কমিয়ে জিনিয়া তাদের সাথে দেখা করতে আসলো।

খাবারের টেবিলে….

সব ছেলেরা একসাথে খেতে বসেছে। মেয়েরা তদারকি করছে। নুহা, রাহী, তারিন বাইরের বাগানে ঘুরছে। রাহী এই প্রথম এই বাসায় এসেছে। তাই নুহা,তারিন ওকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে। জানালা দিয়ে ঊষা ওদের ডাকলো।

— এই তারিন, ওদের দুজনকে নিয়ে খেতে চলে আয়।

তারিন জোরে চেচিয়ে বললো,
— আসছি!

ঊষা জানালার দিক থেকে সরতেই কারো বুকের সাথে ধাক্কা খেলো। হকচকিয়ে পেছনে তাকাতেই জিবরানকে দেখতে পেলো। কপট রাগ দেখিয়ে বললো,

— এরকম হুটহাট আগমন করেন কেন? আমি কি ভয় পাই না?

জিবরান ভ্রু উঁচু করে বললো,
— আমি কি বাঘ নাকি ভাল্লুক যে আমায় ভয় পাবে।

— আরে ধূর কি যে বলেন না! সরুন তো।

জিবরান পেছন থেকে ঊষাকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে থুতনি রেখে বললো,

— আজকাল আমায় দেখলে এতো পালাই পালাই করো কেন?

ঊষার বলতে ইচ্ছে করছিলো, “আপনি বদমাশি করেন তাই।” কিন্তু কথাটা ঠোঁটের আগায় এনেও গিলে ফেললো। এখন এসব কথা বললে জিবরান দুষ্টামি শুরু করে দিবে। নিজেকে জিবরানের কাছ থেকে সরিয়ে নিতে নিতে বললো,

— ছাড়ুন আমার কাজ আছে।

জিবরান কয়েক সেকেন্ড কি জানি ভেবে বললো,
— ওয়ান কিস প্লিজ!

ঊষা চেচিয়ে বললো,
— মিস্টার জেব্রা!

— প্লিজ ঊষারাণী প্লিজ।

ঊষা মনে মনে ফন্দি আঁটলো। মুখ টিপে হেসে বললো,
— ঠিক আছে।

জিবরান ঠোঁট বাড়িয়ে এগিয়ে আসতেই ঊষা হাতের নিচ দিয়ে ছুটে পালালো। খিলখিল করে হাসতে হাসতে সামনের দিকে ছুটলো। জিবরান রাগী চোখে তাকিয়ে বললো,

— এর শোধ তোলা রইলো ঊষারাণী।

ঊষা ভেংচি কেটে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বললো,
— কচু!

ঊষা দৌড়ে ভাইদের সামনে চলে গেলো। খাওয়াদাওয়া সেরে সবাই খোশগল্পে মেতেছে। সেখানে অথৈ, তারিন, রাহীর বাবাও আছে। জিবরান, ঊষার পিছু পিছু সেখানে চলে এলো। ইশাত ঠোঁট চেপে হেসে জিবরানকে শুনিয়ে শুনিয়ে অরূপকে উদ্দেশ্য করে বললো,

— হ্যাঁ রে অরূপ, তোর কি বউয়ের পিছু ছাড়তে মন চায় না?

অরূপ কপাল কুঁচকে তাকালো। ইশাত বলে কি? ইশাত ইশারা করে জিবরানকে দেখিয়ে দিতেই সে বুঝতে পেরে ফিক করে হেসে উঠলো। সেও জোরে বললো,

— কি করবো ভাই? কপাল করে এমন একটা বউ পেয়েছি। চোখে চোখে তো রাখতেই হবে।

আদিল, ঈশান বুঝতে পেরে মুখ টিপে হাসলো। জিবরান অগ্নিচোখে একবার ইশাতের দিকে তাকালো। ইশাত সেসবকে পাত্তা দিলো না। অর্ণব সামনের সোফা দেখিয়ে দিয়ে জিবরানকে বললো,

— বসো।

আদিল বললো,
— তা জিবরান ব্যবসার কি খবর?

ঈশান এক চোখ মেরে আফসোসের সুর টেনে ছন্দ মিলানোর মতো করে বললো,
— আর ব্যবসা! মন পরে থাকে বউয়ের কাছে। কাজে কি আর মন বসে।

জিবরান ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
— ঈশান ভালো হবে না কিন্তু।

আদিল কপাল কুঁচকে বললো,
— থাক জিবরান আর কেঁদো না। এবার বউ ঘরে তোলার ব্যবস্থা করে দিবোনি।

জিবরান মুখটাকে কাঁদো কাঁদো করে বললো,
— মেজো ভাই আপনিও শুরু করলেন😵?

সবাই একসাথে হো হো করে হেসে উঠলো। তারিন, নুহা, জিনিয়া, অথৈ,রাহী এসে অপজিট সোফায় বসলো। জিনিয়া কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,

— কি হচ্ছে এখানে?

জিবরান বিচার দেওয়া ভঙ্গিতে বললো,
— তোমার ভাইয়ের মান-ইজ্জত প্লাস্টিক করা হচ্ছে।

রাহী বললো,
— মান-ইজ্জত প্লাস্টিক হয় কিভাবে?

অরূপ বললো,
— তুমি থাকো তাহলেই দেখতে পাবে।

ঈশান চোখ পিটপিট করে ঊষাকে বললো,
— কালুর মা জলদী জলদী আমাদের মামা বানিয়ে দিস তো। তোর বাচ্চাকাচ্চা কাধে নিয়ে ঘুরার ইচ্ছে হয়েছে।

ঊষা লজ্জায় দুই হাতে মুখ ঢেকে ফেললো। জিভে কামড় দিয়ে মাথা নিচু করে ফেললো। ইশাত মুখ দিয়ে চুক চুক শব্দ করে বললো,

— ইস্ কি লজ্জা, কি লজ্জা!

আদিল অথৈকে জিজ্ঞেস করলো,
— অনল কোথায়?

অথৈ বললো,
— ওর নানুর সাথে। আমাদের মেয়েও সেখানে আছে।

নুহা সবার দিকে তাকিয়ে ঊষাকে বললো,
— হ্যাঁ ঊষা আমরা আমাদের কালুকে জলদী চাই। কোন দেরী সহ্য করবো না।

অরূপ বললো,
— জরিনা এলে কি সমস্যা হবে?

জিবরান লাজুক ভঙ্গিতে চেচিয়ে বললো,
— কি শুরু করলে তোমরা?

জিনিয়া টিটকারির সুরে বললো,
— ওরে আমার ভাই লজ্জা পেয়েছে রে।

তারিন ফট করে ঊষাকে বললো,
— ঊষা তোর ওড়নাটা জিবরান ভাইয়াকে দে। বেচারা লজ্জায় লাল, নীল সিগনাল দিচ্ছে।

রাহী বললো,
— যে যা বলুক ঊষাকে কিন্তু আমার বেয়াইন বানাবো। ওর ছেলের সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দিবো।

তারিন চেচিয়ে বললো,
— এই না, আমি কবের থেকে ঠিক করে রেখেছি ঊষার ছেলেকে আমার মেয়ের জামাই বানাবো।

রিতীমত ঊষার ছেলে-মেয়ে নিয়ে ড্রয়িং রুমে যুদ্ধ বেঁধে গেলো। কে ঊষার মেয়ের সাথে ছেলে বিয়ে দিবে তা নিয়ে কথা কাটাকাটি। অর্ণব উঠে সবাইকে থামিয়ে বললো,

— এবার থামো তোমরা। আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলবো।

গুরুত্বপূর্ণ কথা শুনে সবাই নড়েচড়ে চুপটি করে বসলো। অর্ণব আদিলের দিকে তাকিয়ে বললো,
— কিরে বলবো?

আদিল মাথা নাড়িয়ে বললো,
— হুম বলো।

ইশাত জিজ্ঞেস করলো,
— কি কথা?

অর্ণব বললো,
— বলছি, আগামী মাসের ৩ তারিখে ঊষা আর জিবরানের রিসিপশনের আয়োজন করেছি।

সবাই হাতে তালি দিয়ে উঠলো। জিবরান হাত দিয়ে ঊষার দিকে ফ্লাইং কিস ছুঁড়ে দিলো। আদিল সবাইকে শান্ত করে বললো,

— সেদিন কিন্তু এক বিয়ের অনুষ্ঠান হবে না।

অরূপ ভ্রু কুঁচকে বললো,
— এক বিয়ের অনুষ্ঠান হবে না মানে?

অর্ণব মুচকি হেসে বললো,
— সেদিন চারটা বিয়ে হবে। ঊষা❤️জিবরান,
অরূপ🧡রাহী, ইশাত 💙তারিন, ঈশান 💜নুহা।

সবাই খুশিতে একে অপরকে জড়িয়ে ধরলো। ঈশান জোরে শিস বাজিয়ে উঠলো। নুহা, রাহী লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো। তারিন খুশিতে বোধহয় পাগল হয়ে গেছে। দুটো ঘূর্ণি দিয়ে চেচিয়ে বললো,

— আহা, আমার বিয়া!

ওর কথা শুনে সবাই হেসে উঠলো। পুরো ড্রয়িংরুমে উচ্চ হাসির রোল পরলো। ইশাত নিজের কপালে চাপর মেরে বসলো৷ এই পাগলীকে নিয়ে তার কি হবে কে জানে! জিবরান ঊষার দিকে তাকিয়ে প্রাপ্তির হাসি দিলো। হুট করে পাঁচ ভাই এগিয়ে এসে বোনেকে জড়িয়ে ধরলো। তাদের বোন কিছু দিন পর চলে যাবে। এটা মনে এলেই তাদের মনে হয় দূর থেকে কেউ বিষাদের সুর বাজাচ্ছে। ঊষা সশব্দে ফুপিয়ে কেদে উঠলো। কপাল করে পাঁচটা ভাই পেয়েছে। যারা “আমার বোনু” বলতেই অজ্ঞান। তার আর কিছু চাই না। এই পাচ ভাই হলেই চলবে।হাজার বছর বেঁচে থাকুক ভাই-বোনের ভালোবাসা💚।

~~~ পৃথিবীর সবচেয়ে দামী সম্পর্কের মধ্যে একটি হলো একটি ভাই-বোনের ভালোবাসা। চিরদিন অমলিন হয়ে থাকুক এই সম্পর্ক।

~~~~~~~~~~~~#সমাপ্ত~~~~~~~~~~~~

আসসালামু আলাইকুম। অবশেষে গল্পটা শেষ হলো। শেষটা কেমন হয়েছে আমি জানি না। ভালো না লাগলে আমি ক্ষমাপার্থী। এই গল্পটা আমি অনেক অনিয়মিত দিয়েছে। এর জন্য দুঃখীত। এই গল্পের সিজন টু কখনো আসবে না। তাই দয়া করে সিজন টু চাইবেন না। ওদের ছয় ভাই-বোনের এটাই শেষ গল্প। ওদের নিয়ে আর কোন গল্প লিখবো না। গল্পটা এক প্রকার তাড়াহুড়ো করে শেষ করতে হলো। আমি নিরুপায় হয়ে এমনটা করেছি। এছাড়া আর কোন উপায় পেলাম না। আগামী শনিবার আমার ২য় সেমিস্টার পরীক্ষা। এখন পড়াশোনায় মনোযোগ দিবো। তাছাড়া মনে হচ্ছে আবারো একটা দীর্ঘ বিরতি নিতে হবে। সামনের সপ্তাহে সেমিস্টার তারপরের মাসে ফাইনাল এক্সাম। তাই গল্পের জগত থেকে মাস খানিক দূরে থাকবো। সবাই ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন। আল্লাহ হাফেজ 🥰।