আমার ভুল পর্ব-০৮

0
260

#আমার_ভুল
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ৮

আমার স্বভাব চরিত্র বিশ্লেষণ করলে কেউ কোনদিন বলতে পারবে না আমি আবেগের বশবর্তী হয়ে কোন ভুল করেছি। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন সবাই আমাকে ‘ম্যাচিউর’ প্রকৃতির বলেই জানে।

কিন্তু সত্যিটা হলো আমি ভুল করেছি। আবেগের বশবর্তী হয়েই ভুল করেছি। অবিশ্বাস্য হলেও কথাটা সত্যি, সচরাচর ভুল না করা মানুষগুলো হঠাৎ এমন এক ভুল করে ফেলে যা তাঁরা নিজেরাই কখনো কল্পনা করতে পারে না।

সাধারণ মানুষ ভুল করে আবার সামলে নেয়। কিন্তু আমি ভুল করে সামলাতে পারি নি। আমি একবার ভুলে করে, বারবার ভুল করেছি।
কেন করেছি সেসব এখন থাক। আগে আমার কর্মজীবন সম্পর্কে একটু আলোচনা করি।

ভালো ছাত্রী হওয়ার সুবাদে ডিপার্টমেন্টের সব স্যার ম্যামেদের কাছে আমি বেশ পরিচিত মুখ। চেয়ারম্যান স্যার আমাকে বিশেষ স্নেহ করেন। তারওপর প্রিন্স এখানকার শিক্ষক ছিলেন। উনার দিক থেকেও পরিচিতিটা বেশ ভালো।

ডিপার্টমেন্টের স্যার ম্যামদের সহযোগিতা, নিজের মেধা আর পরিশ্রমের কারণে শিক্ষকতার চাকরিটা আমি মোটামুটি সহজভাবে পেয়ে যাই। যদিও এর জন্য আমাকে প্রায় বছর খানেকের মত অপেক্ষা করতে হয়েছিলো। তবুও অন্যদের তুলনায় সেটা অনেক কম। কেউ বছরের পর বছর অপেক্ষা করেও চাকরি পায় না।

প্রিন্স ভীষণ খুশি হলেন। আমার জয়েনিং এর খুশিতে সবাইকে রেস্টুরেন্টে নিয়ে ট্রিট দিলেন। তিনদিনের ট্রিপে আমরা কক্সবাজার গেলাম। সেখান থেকে ফিরে বেশ হাসিখুশি একটা মুড নিয়ে আমি ইউনিভার্সিটিতে জয়েন করি।

কিন্তু জয়েন করার পর বুঝতে পারলাম শিক্ষকতা পেশাটায় আসলে নতুনত্ব বলে কিছু নেই। রোজ একই কাজ করতে হয়। একই বাঁধাধরা নিয়ম। ছাত্রছাত্রীদের ক্লাস করিয়ে বাসায় ফেরা, বাসায় ফিরে আবার ওদের জন্য নতুন ক্লাস লেকচার তৈরী করা। ক্লাসে যাওয়ার আগে নিজে একটু প্রিপারেশন নিয়ে যাওয়া। এসবই! ঘুরেফিরে এসবই করতে হয়।

মাঝেমধ্যে ছাত্রছাত্রীদের সাথে মজা করার সুযোগ থাকলেও আমি করি না। কারণ কম বয়সী ম্যাডাম দেখলে ছাত্ররা মাথায় উঠে বসে। তাই যথাসম্ভব ওদের সামনে কঠোর ভাব বজায় রাখার চেষ্টা করি।

সকালে উনি কলেজে যাওয়ার সময় আমাকে ইউনিভার্সিটিতে নামিয়ে দিয়ে যান। আবার ফেরার সময় রিক্সা নিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করেন। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে ঐসময়টুকুতে আমার অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করে। রিক্সায় পাশাপাশি বসে হাওয়া খেতে খেতে বাড়ি ফিরি দুজনে। মাঝেমধ্যে সংসার জীবন নিয়ে টুকটাক আলাপ আলোচনাও করি।


আমার ডিপার্টমেন্টে অধিকাংশ শিক্ষক শিক্ষিকারাই পিএইচডিধারী। দুচার জন যারা বিদেশে আছেন তারাও পিএইচডি করার জন্যই বিদেশে গেছেন।
আমি পিএইচডি করার বিষয়ে এখনো কিছু ভেবে দেখে নি। সেই সময়ও হয়ে উঠে নি। স্টুডেন্টদের ক্লাস নেওয়া আর সংসার জীবন সামলাতে সামলাতেই আমার দিন কেটে যায়।
কিন্তু চেয়ারম্যান স্যার বিষয়টা নিয়ে বেশ জোর দিলেন। পিএইচডি করতে না পারলে সহজে প্রমোশন মিলবে না। সারাজীবন লেকচারার হয়েই কাটিয়ে দিতে হবে। তাই আমাকে যত দ্রুত সম্ভব পিএইচডির জন্য এপ্লাই করার পরামর্শ দিলেন। উনার পছন্দমত কয়েকটা ইউনিভার্সিটির নামও বললেন। সবশেষে এই বিষয়ে প্রিন্স এর সাথে আলাপ করার পরামর্শ দিলেন।

রাতে প্রিন্সের সাথে বিষয়টা আলাপ করলাম। উনি প্রথমে না করে দিলেন। একা একা আমাকে কিছুতেই দেশের বাইরে যেতে দেবেন না। তিন চারবছরের ব্যাপার!

আমি উনাকে রাজি করানোর জন্য উঠেপড়ে লেগে গেলাম। রোজ রাতে উনার গলা জড়িয়ে ধরে একই আবদার করি। অনুনয় বিনয় করি। কিন্তু উনি আমার চাইতেও এক ডিগ্রী উপরে। উল্টো ভুলিয়ে ভালিয়ে আমাকে বুঝ দিয়ে দেন। এভাবে বেশ কিছুদিন কেটে গেলো। আমি না পারি কিছু বলতে না পারি কিছু করতে। উনি যে আমাকে ছাড়া থাকতে পারেন না সে আমি বুঝি।

তবুও আমি আকুতি মিনতি জারি রাখলাম। শেষে একপ্রকার বাধ্য হয়েই উনি রাজি হলেন। কিন্তু শর্ত দিয়ে দিলেন। বাসায় রাজি না হলে আমি মন খারাপ করতে পারবো না। চুপচাপ উনার কথা মেনে নিতে হবে।

আমি সম্মতি জানিয়ে দিলাম। কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমার টেনশন হচ্ছিলো। কারণ বাড়ির বউ একা একা পিএইচডি করার জন্য দেশের বাইরে যাবে এটা স্বামী মেনে নিলেও শ্বশুরবাড়ির লোকজন মানতে রাজি হবে না। সমাজ, পরিবেশ, পরিস্থিতি এই সবকিছু উনাদের কাছে মুখ্য হয়ে দাঁড়াবে।

প্রিন্স আমার শ্বশুর মহাশয়ের সঙ্গে বিষয়টা আলাপ করলেন। আমার শ্বশুর নির্ঝঞ্ঝাট প্রকৃতির মানুষ। উনি এই বিষয়টা নিজের ছেলের ওপরেই ছেড়ে দিলেন।

কিন্তু আমার শাশুড়ি মাকে মানালো গেলো না। উনার ঘোরতর আপত্তি। বিয়ে হয়েছে তিন বছরের বেশি। এখনো আমাদের কোনো বাচ্চাকাচ্চা হয় নি। এই অবস্থায় তিন চারবছরের জন্য স্বামী ছাড়া উনি কিছুতেই আমাকে একা থাকতে দেবেন না। রাগ করে আমাদের সঙ্গে কথাবার্তা বন্ধ করে দিলেন। উনার এক কথা। যেতে হলে স্বামী স্ত্রী দুজন মিলে যাবে। কিন্তু একা বাড়ির বউকে উনি কিছুতেই বিদেশে যেতে দেবেন না।

আব্বার সাথেও যোগাযোগ করলেন প্রিন্স। আব্বাও রাজি হলেন না। মোট কথা আমাকে দেশের বাইরে একা একা ছাড়তে কারোরই সম্মতি নেই।

পরিস্থিতি বুঝতে পারলেও আমি প্রথমে কিছুটা মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিলাম। কিন্তু পরে আস্তে আস্তে সামলে নিই।
আমার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রিন্স চেষ্টার কোন কসুর বাকি রাখেন নি। নানারকম কথাবার্তা বলে আমার শ্বাশুড়ি মাকে বোঝানোর চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। কিন্তু শাশুড়ি মা নিজের সিদ্ধান্তে অটল।

শেষে আমি নিজেই প্রিন্সকে ডেকে নিষেধ করে দিলাম। শ্বাশুড়ি মা রাগ করে বললেও কথাগুলো একেবারে ভুল কিছু বলেন নি। যেতে হলে দুজনের একসঙ্গেই যাওয়া উচিৎ। নইলে উনাকে ছাড়া একা একা এতদূর গিয়ে আমি নিজেও শান্তিতে থাকতে পারবো না।

কিন্তু এরজন্য প্রিন্স এর ইউনিভার্সিটিতে চাকরী হওয়াটা ভীষণ জরুরী। উনার চাকরী হলেই আমরা একসাথে পিএইচডির জন্য প্রিপারেশন নিতে পারবো। উনিও আমার কথায় সম্মতি জানালেন। উনার চাকরী না হওয়া পর্যন্ত পর্যন্ত ধৈর্য ধরার সিদ্ধান্ত নিয়ে সেখানেই আলোচনার সমাপ্তি ঘটালাম।

এই মাঝে আমি কনসিভ করলাম। সারাবাড়ি জুড়ে আনন্দের রোল পড়ে গেলো। বংশের প্রথম প্রদীপ! সবাই ভীষণ খুশি। সবচেয়ে বেশি খুশি হলেন আমার প্রিয় মানুষটা! খুশি যেন উনার চোখেমুখে ধরে না। হৈচৈ করে সারাবাড়ি একাই মাথায় তুলে রাখেন। কি আহ্লাদ আমাকে নিয়ে! আমার শ্বশুর শাশুড়িও ভীষণ খুশি। বাড়ির পরিবেশ একেবারে অন্যরকম হয়ে গেলো।

কিন্তু এই খুশি বেশিদিন রইলো না। তিনমাসের মাথায় আমার মিসক্যারেজ হয়ে গেলো। হতাশায়, যন্ত্রণায় আমি একেবারে মুষড়ে পড়লাম। প্রথম সন্তান! অনেক আশাভরসা ছিলো! একনিমিষেই সব শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু প্রিন্স ধৈর্য হারালেন না। উনি বারবার করে আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে ধৈর্য ধরার পরামর্শ দিচ্ছিলেন। কিন্তু আমি পারি না। যতবারই ধৈর্য ধরে নিজেকে বোঝাতে চাই ততবারই কান্নায় বুক ভেঙ্গে আসে। শরীর উইক থাকার কারণে খুব তাড়াতাড়ি আবার বেবিও নিতে পারবো না। ডাক্তার নিষেধ করেছেন।

চলবে।