আমার সংসার পর্ব-০২

0
206

#আমার_সংসার
পর্বঃ ২
কলমেঃ আয়েশা সিদ্দিকা (লাকী)

দরজার ওপারে এক পা রাখতেই মরিয়ম বেগম বলে উঠলো,

— কাহিনি জুড়ে দিয়ে এখন দুই বউ মিলে নাটক দেখতে এসেছো?

— মা, আপনি আমাদের ভুল বুঝছেন। আমি বা মেজো আপা কেওই কোনো কথা উনাকে বলিনি।

— আমার চুল বয়সে পেকেছে হাওয়ায় পাকেনি, বড়ো বউ! যেভাবে আমাকে বুঝাবে আর আমি সেভাবেই বুঝে যাবো! যদি সেটা ভেবে থাকো তাহলে ভুল ভাবছো।

— মা আপনি না বুঝলে আমার ক্ষমতা নেই আপনাকে বোঝানোর। আর আপনাকে বোঝাতে যাওয়ার দুঃসাহস আমি কখনোই দেখাবো না।

অথৈ মরিয়ম বেগমকে কথা গুলো বলতে বলতে তরকারির বাটির দিকে হাত বাড়ালো। সুমন অথৈকে থামিয়ে দিয়ে বললো,

— অথৈ! ওগুলো ওখানে রাখো। তুমি আর লতা দুজনেই রান্নারুমে যাও আমি আসছি।

— তোমার কাছে অনুরোধ করছি, তুমি এই বিষয়টা নিয়ে আর বাড়াবাড়ি করোনা। আর রাতে মানুষ কতটুকুই বা খায়! যা আছে তাতে আমাদের দুজনের হয়ে যাবে।

— তোমাকে আমি এখান থেকে যেতে বলেছি।

রহমান সাহেব বললেন,

— বড়ো বউমা তুমি যাও, আমি দেখছি।

অথৈ আর কোনো কথা না বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। লতা অথৈকে নিয়ে রান্না রুমের দিকে চলে গেলো।

মরিয়মের দিকে তাকিয়ে রহমান সাহেব বললেন,

— মরিয়ম তুমি কাজটা একদম ঠিক করোনি। তোমার বুঝা উচিৎ ছিলো যে তারা এ বাড়ির বউ।

— তুমিও কি এখন আমাকে এটা বোঝাতে আসবে নাকি যে, আমি বাড়ির বউদের দেখতে পারিনা, খেতে দেইনা এগুলো বলতে চাইছো নাকি?

— আমি তোমাকে কিছুই বলতে চাইনি। আর তুমি কি করেছো না করেছো সেটা তুমি তোমার বিবেক দিয়ে বিবেচনা করে দেখো তাহলেই বুঝতে পারবে।

রহমান সাহেব সুমনের দিকে তাকিয়ে বললো,

— সুমন, বাবা এটা নিয়ে আর বাড়াবাড়ি করিসনা। যা শুয়ে পড়।

— বাড়াবাড়ি না আব্বা, আমি কোনোকালেই অন্যায় সহ্য করতে পারিনা। আমার মনে হয়েছিলো এটা আপনাকে জানানো দরকার তাই জানালাম।

মরিয়ম ফোসফাস করতে করতে বললো,

— আমার কাছে যেটা ভালো মনে হয়েছে আমি সেটাই করেছি। আর তারা বিয়ে করে আসার সময় বাবার বাড়ি থেকে এমন কোনো অঢাল সম্পত্তি নিয়ে আসেনি যে, এতো বাচবিচার করে তাদের সাথে চলতে হবে।

— মা তুমি এ আবার কেমন কথা বললে?

— ভুল কিছু বলেছি কি? আর মেজো বউ তো এইবাড়িতে নয় বছর হলো এসেছে। কই সুজন তো কোনোদিন এসব বিষয় নিয়ে মাথা ঘামায়নি কোনোদিন। আর তুই বিয়ে করেছিস মাসও গড়াইনি তাতে এতো বিচার সালিশ!

— সুজন কি করলো না করলো সেটা তো আমার বিষয় না। আমি দেশে ছিলামনা তাই আমি জানিওনা যে এই সংসারে কি হয়েছে। আর শুধু আমার বউ এখানে যদি লতা একা থাকতো তাও আমি এটাই করতাম। আর তুমি কি বললে!ওরা বিয়ে হয়ে আসার সময় অঢাল সম্পত্তি আনেনি দেখে ঠিক মতো খাবারটাও পাবেনা তাই তো?

সুমন তার মাকে কথা গুলো বলে রহমান সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললো,

— আব্বা, মা এ বাড়িতে বিয়ে হয়ে আসার সময় কত বিঘা সম্পত্তি এনেছিলো?

— সেটা তোর মাকেই জিজ্ঞেস কর।

সুমন মায়ের দিকে তাকাতেই মরিয়ম মাথা নিচু করে ফেললো। সুমন মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

— মা, তুমি যেভাবে এই বাড়িতে এসেছো ওরা দুজনও এইবাড়িতে ঠিক সেই ভাবেই এসেছে। তুমি যেমন মা বাবা আত্মীয় স্বজন সবাইকে ছেড়ে আব্বার হাত ধরে এইবাড়িতে এসেছো, ওরাও ঠিক তেমন ওদের কাছের মানুষগুলোকে ছেড়ে এইবাড়িতে এসেছে। বানের পানিতে ভেসে আসা কোনো খড়কুটো না ওরা। তাদের আমরা দু ভাই বিয়ে করে সসম্মানে এই বাড়িতে এনেছিলাম তাই তারা এসেছে। তাই তোমার কাছে আমার অনুরধ করবো, অসম্মান করে মনে কষ্ট দিওনা ওদের। তুমি তোমার শাশুড়ীর কাছ থেকে সম্মান ভালোবাসা অধিকার কোনোটাই পাওনি আমি দেখেছি। তাই বলে সেই প্রতিশোধ তুমি তোমার ছেলের বউদের উপর নিতে পারোনা! বরং এটা ভাবো যে, যে সম্মান ভালোবাসা তুমি তোমার শাশুড়ীর কাছ থেকে না পেয়ে কষ্ট পেয়েছো সেই কষ্ট তুমি তোমার ছেলের বউদের পেতে দিবেনা। তাহলে দেখবে সম্পর্কগুলো কতো সুন্দর হয়ে উঠেছে। সংসার তোমার একার না মা। এই সংসার যেমন তোমার, লতার তেমন অথৈ এরও।

কথাগুলো বলে সুমন তরকারির বাটি দুটো হাতে করে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। মরিয়ম বেগম সুমনের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রাগে ফোসফাস করতে লাগলো।

সুমন রান্নাঘরে এসে অথৈকে ডেকে ওর হাতে বাটি দুটো এগিয়ে দিয়ে বললো,

— বাড়িতে ডিম আছে?

— হ্যাঁ আছে।

— দুটো ডিম নিয়ে আসো।

— ডিম দিয়ে কি করবে?

— দরকার আছে নিয়ে আসো।

লতা দুটো ডিম এনে সুমনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,

— এইযে ভাইয়া ডিম।

লতার হাত থেকে ডিম দুটো নিয়ে অথৈ এর হাতে দিয়ে বললো,

— অথৈ, ডিম দুটো ভাজি করোতো।

— ডিম কেনো ভাজি করবো?

— আমি বলেছি তাই ভাজবে, কথা বাড়িওনা।

অথৈ ডিম দুটো নিয়ে ভাজতে শুরু করলো। যতক্ষণ ডিম ভাজা না হলো ততক্ষণ সুমন রান্নাঘরের দরজায় ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। ডিম ভাজা শেষ হলে সুমন লতাকে ডেকে বললো,

— লতা!

— জ্বী ভাইয়া?

— ডিম ভাজি দিয়ে দুজন ভাত খেয়ে যে যার মতো সব গুছিয়ে শুয়ে পড়ো।

লতা আর অথৈ অবাক হয়ে একে অপরের দিকে তাকালো। সুমন তার রুমে চলে গেলো। এরপর লতা আর অথৈ দুজনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে খেতে শুরু করলো। খেতে খেতে লতা বললো,

— বড় আপা, আপনি কপাল করে ভাইয়ার মতো একটা স্বামী পেয়েছেন। আমি খেয়ে থাকলাম কি না খেয়ে থাকলাম তা কোনোদিন আপনার দেবরের চোখে পড়েনি। কোনোদিন জিজ্ঞেসও করেনি যে আমি খেয়েছি কিনা। এমন কতো দিন রাত গেছে যে আধপেটা খেয়ে থেকেছি। কেও কখনো জানতেও চাইনি আমি খেয়েছি কিনা। ভাতে আমার পেট ভরেছে কিনা। কিন্তু কোনো জিনিসের কোনো অভাবনেই। অভাব শুধু মানসিকতার।

অথৈ তাকিয়ে দেখলো লতার প্লেটের উপর চোখের পানি টপটপ করে পড়ছে। লতাকে কি বলে সান্ত্বনা দেবে তা অথৈ এর জানা নাই তবুও অথৈ বললো,

— এগুলো ভেবে কষ্ট পাইয়েননা আপা। দিন সবসময় একরকম থাকেনা। এমন একদিন আসবে দেখবেন সেদিন আর আপনার কোনো কষ্ট থাকবেনা।

— সান্তনা দিচ্ছো আপা!

— সান্তনা হবে কেনো! তুমি দেখো নিও।

— জানিনা কপালে কি আছে।

— কাল সকালে কি রান্না হবে আপা।

— কি আর! প্রতিদিনের মতো রুটি আর তরকারি।

— কি তরকারি রান্না করতে হবে জানা থাকলে সকালে আগে আগে উঠে কেটে রাখতাম।

— কি তরকারি রান্না হবে সেটাতো মা উঠে ঠিক করবে।

— ও আচ্ছা

দুজনের খাওয়া দাওয়া শেষ করে প্লেট বাসন মেজে পরিষ্কার করে রেখে শুতে চলে গেলো দুজনেই।

রুমে এসে অথৈ দেখলো সুমন ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই কোনো সাড়াশব্দ না করে চুপচাপ একপাশে শুয়ে পড়লো। হঠাৎ সুমন বলে উঠলো,

— কাজ শেষ হলো?

— তুমি ঘুমাওনি?

— না।

— হ্যাঁ কাজ শেষ হলো, আমিতো ভেবেছিলাম তুমি ঘুমিয়ে গেছো।

— না ঘুমাইনি, চেষ্টা করছি অনেকক্ষণ ধরে কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছেনা।

— শরীর খারাপ লাগছে?

— না, মনটা খারাপ লাগছে। নিজেকে অনেক বড়ো অপরাধী মনে হচ্ছে।

— আমার জানা মতে তো তুমি কোনো অপরাধ করোনি, তাহলে হঠাৎ অপরাধী মনে হচ্ছে কেনো?

— এই যে প্রতিদিন তোমাদের সাথে এমন অন্যায় কাজ হয় যা আমি কখনও বুঝতেই পারিনি। আবার কখনও সেইভাবে খোঁজও নেইনি। কি খাচ্ছো না খাচ্ছো কখনও খেয়াল করিনি। কিন্তু আমার মা কখনো এমন কাজ করতে পারে তা আমি কখনও কল্পনাও করতে পারিনি।

— তুমি যা ভাবছো তেমন কিছুই হয়নি। আর তুমি মায়ের সাথে একটু বেশি বেশি করে ফেলেছো। এমনটা না করলেও পারতে। মায়ের মনে শুধু কষ্ট দিলে।

— আমি মাকে কষ্ট দিয়ে কিছুই বলিনি যেটা সত্যি আমি সেটাই বলেছি। মা ভুল করলে সেই ভুলটা ধরিয়ে দেওয়াও আমার কর্তব্য কারন আমি মায়ের বড় ছেলে। আমি জেনে বুঝে মাকে অন্যায় কাজ করতে দিতে পারিনা।

— সে ঠিক আছে কিন্তু মা তো কষ্ট পেয়েছে।

— মা যদি নিজের ভুলগুলো ধরতে পারে তাহলে কষ্ট পাবেনা। আর যদি মনে করে তিনি হেরে গেছেন তাহলে এর জন্য মা ভবিষ্যতে আরও বেশি কষ্ট পাবে।

— আচ্ছা যা হবার হয়ে গেছে অনেক রাত হলো ঘুমাও।

অথৈ পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছে। এদিকে লতা ঘরে ঢুকতেই সুজন জিজ্ঞেস করলো,

— কি হয়েছে বাড়িতে?

— কই কি হয়েছে! কিছু হয়নিতো।

— আমি সবটাই শুনেছি, আমার কাছে লুকিয়ে লাভ নাই।

— সবটা যখন শুনেছো তাহলে জিজ্ঞেস করছো কেনো?

— ভাইয়া একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করে ফেলছে। মাত্র বিয়ে করেছে কয়দিন হলো আর এখনই বউ এর হয়ে উকালতি শুরু করে দিয়েছে মায়ের সাথে।

— ভাইয়া শুধু একা আপার জন্য লড়াই করেনি সেখানে আমিও ছিলাম। যা তুমি কোনোদিন পারোনি আজ ভাইয়া তা পেরেছে তার জন্য তোমার লজ্জা হওয়া উচিৎ।

— আমি মানুষের মতো এতো ন্যাকামি করার মধ্যে নাই। আর এই মেয়ে মানুষের খাওয়া দাওয়া এসব নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যাথাও নেই।

— মাথা থাকলে ঠিকই ব্যাথা থাকতো, যার মাথা নেই তার আবার ব্যাথা কিসের!

সুজনকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত পায়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো লতা। ঘুম আসুক বা না আসুক অভিনয় করতে তো আর দোষ নেই!

চলবে……