আমার সংসার পর্ব-১০

0
461

#আমার_সংসার
লেখক: হৃদয় আহমেদ
পর্ব ১০

দুপুরের মিষ্টি রোদ আর নেই। সূর্য হেলে পড়তেই গা হিম করা ঠান্ডা পড়তে আরম্ভ করেছে। বাতাসের তিব্রতা বেড়ছে। সাঁ সাঁ শব্দ তুলে ছুটছে ওরা। মন, শরীর কাঁপিয়ে তুলছে। দরজায় ঠকঠক আওয়াজে শিরদাঁড়া বেয়ে শিতল স্রোত বয়ে গেলো। বড়মা, মামী এমনকি আব্বুও চলে এসেছেন। বেশ কয়েকবার রক্তচক্ষু দেখিয়েছে আব্বু। আমি জানিনা কেন, কিন্তু তবুও ভয়ে জড়সড় হয়ে মামীর পাশে দাড়িয়ে ছিলাম। কোথথেকে জুঁই ছুটে এসে দরজা খুলে দিলো। বাইরের দমকা হওয়া ঘরে প্রবেশ করে। একটু কেঁপে উঠি আমি। এরপর দরজার দিকে তাকাতেই চোখ কপালে উঠলো আমার। শুধু পাতলা একটি টি শার্ট আর কালো একটি প্যান্ট ওনার শরীরে। ফ্যাকাশে মুখে তাকিয়ে সিয়াম ভাইয়া। মামী ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। ছুটে গিয়ে জড়িয়ে নিলো সিয়াম ভাইয়াকে। কিন্তু ওনার দৃষ্টি আমাতে স্হির। অস্বস্তি হয় তার তাকানোয়, কিন্তু তবুও উনি তাকান। আমি নিজেই চোখ নামিয়ে নিলাম। মামী টেনে ভিতরে ডোকালেন ওনাকে। শাসিয়ে বললেন,

‘ এমন বিদ্ধস্ত অবস্থায় তুই বাইরে ছিলি? কেন তুই এভাবে হ্যারাস করাস সিয়াম? দেখ, সবাই কতটা চিন্তিত তোকে নিয়ে। আর তুই এই ঠান্ডায় একটা শার্ট পড়ে ঘুরছিলিস? ‘

উনি কিছুই বললেন না। মামী আবারো বললো,

‘ এক্ষুনি রুমে গিয়ে সোয়েটার পরবি। যা রুমে যা। ‘

রুমে যেতে বলছে মানে? কেউ কিছুই বললো না? কেন? কোথায় ছিলো, কেন ছিলো কেউ কিছু জানতে চাইলো না কেন? সিয়াম ভাইয়া সোজা উপরে চলে গেলেন। আমি মামীর সামনে দাড়িয়ে বলে উঠলাম,

‘ তুমি জানতে চাইলে না উনি কোথায় ছিলো? ‘

‘ না! কেন বলতো? ‘ কন্ঠ স্বাভাবিক মামীর। কিছুই বুঝছি না আমি। কিছুক্ষণ আগেই মানুষটাকে সচক্ষে কাঁদতে দেখেছি। আর এখন এতটা স্বাভাবিক? এমনকি জানতেও চাইবে না উনি কেন এবং কোথায় ছিলো? আমি শুকনো ঠোগ গিলে কৌতুহল চাপা দিয়ে বললাম,

‘ কিন্তু মামী…’

‘ ও এমনি! তুই নতুন এ বাড়িতে। সবটা জানবি। তবে দুদীন কখনো ও বাড়ির বাইরে থাকেনি, কম হলে একদিন! এর বেশি নয়। তাই চিন্তা হচ্ছিলো। ‘

এরপর আমার দু হাত মামী মুঠো করে নিলো। আস্বস্ত কন্ঠে বললো, ‘ তুই নিশ্চিন্ত থাকতে পারিস, আমার সিয়াম কখনোই কোন ভুল করতে পারে না। ‘

বলেই জুঁইকে তাড়া দিয়ে চলে গেলো মামী রান্নাঘরে। একগাদা প্রশ্ন জাঁকিয়ে দিয়ে গেলো মনে। হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে রইলাম আমি। আমার কাছে সবটা অগোছালো লাগছে। সবটা!

‘ সিয়া! ‘

আব্বুর গলা পেতেই ফিরলাম তার দিকে। উনি আমার সামনে এসে সন্দিহান হয়ে বললেন,

‘ সিয়াম প্রমিজ করেছিলো, ও বিয়ের পর কখনো না বলে বাইরে রাত কাটাবে না। তাহলে দুদীন ও বাইরে কাটিয়ে এলো? তোদের মধ্যে কিছু হয়েছে সিয়া? ‘

অবাক দৃষ্টিতে তাকালাম আব্বুর দিকে। কই সেই রাতে তো আব্বু এতোকিছু বলেনি আমায়? আমি পাল্টা প্রশ্ন ছুড়লাম,

‘ আব্বু সত্যি করে বলোতো, এ বিয়ের আর কত কাহিনি বাকি? ‘

‘ সবটাই জানাতাম, সিয়াম মানা করেছে! ‘

মাথায় বাজ পড়লো আমার। সূক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে রইলাম আব্বুর দিকে। কি এমন কাহিনি এ বিয়ের যে ভাইয়া বলতে মানা করেছে? আর কত গভীরে গেলে উত্তর পাবো? আব্বুকে চেপে ধরলে কোন উত্তর পাবো না জানি আমি। সিয়াম ভাইয়া মানা করে থাকলে একটা শব্দও বের করবে না আব্বু! মাথা ঘুরছে আমার। আব্বু আবারো অস্ফুটস্বরে বললেন, ‘ সিয়া? ‘

তাকালাম ওনার দিকে। একটু কাঠিন্যে গলায় বললেন উনি,

‘ আমার প্রশ্নের উত্তর কিন্তু এখনো পাইনি আমি। ‘

‘ কোন প্রশ্ন? ‘

‘ কি হয়েছে তোদের মধ্যে? ‘

পানিশূন্য গলায় কেশে উঠলাম। আমতাআমতা করে বললাম, ‘ কি…আবার হবে? ক্ কিছুই না। ‘

‘ কিছু না হলেই ভালো। আশা রাখবো তুই আমার কথার অমান্য করবি না! কি বলেছিলাম মনে আছে? পৃথিবী উল্টে গেলেও সিয়ামকে এতটুকু ভুল বুঝবি না তুই! ‘

আবারো একই কথা বললো আব্বু। একটু আগে মামীও বলেছে! কিন্তু কেন? তারা যখন জানবে একটা ছোট্ট শিশুর খুনি উনি, তখনো কি আমায় তাকে বিশ্বাস করতে বলবে? নাকি নিজেরা করবে? কিছু না বলে ছাদে চলে গেলাম। রুমে গিয়ে ওনার সামনে দাঁড়ানোর শক্তি নেই আমার!

____

দেখতে দেখতে বিকেল গড়িয়েছে। লাল আভায় অসম্ভব সুন্দর চারপাশ। কিন্তু নিজেকে বুঝতে, আব্বু, মামী সবাইকে বুঝতে ব্যার্থ আমি। মামী কতটা উঁচু গলায় বললো যে উনি কোন অন্যায় করতে পারেন না। আব্বুও ঠিক এটাই বললো! কিন্তু ওনার নামে খুনীর অপবাদ! আবার এই অজানা শুভাকাঙ্ক্ষীটাই বা কে? চিঠিতে লিখেছিলো, আমি মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের সর্বনাশ হতে দিতে পারবো না। তাহলে কি ভাইয়া আরও কোন রিলেশনে ছিলেন? কথাগুলো ভাবলেই মাথা ঘুরে ঘুরে উঠছে। অদ্ভুত খারাপ লাগা কাজ করছে।

হঠাৎ ফোনের শব্দে টনক নড়লো আমার। পাশ থেকে ফোন হাতে নিয়ে দেখলাম ‘সামি’ ফোন করেছে। আমি রিসিভ করতেই সামি বলে উঠলো,

‘ আজ কলেজে আসলি না কেন? ‘

‘ খারাপ লাগছিলো। ‘

‘ কালই ভর্তির ডেট পড়েছে। আসবি তো? ‘

‘ হুম যাবো। ‘

কিছুক্ষণ পিনপতন নীরবতা! এরপর সামি আড়ষ্ট গলায় বললো,

‘ তুই ভালো আছিস সুন্দরী? ‘

স্মিত হেঁসে বললাম, ‘ হুম ভালো আছি। ‘

‘ ভালো থাকলেই ভালো। ‘

ফোন কাটতেই বুক হাহাকার করে উঠলো সামির। তার কেন বারবার মনে হচ্ছে তার সুন্দরী ভালো নেই? ভালো থাকলে এমন শোনায় না তার সুন্দরীর রিনরিনে কন্ঠ! সামির মনে প্রশ্ন উঁকি দেয়, ‘ সত্যিই কি ভালো আছো সুন্দরী? ‘ হাতের ফোন বুকে জড়িয়ে রাখে সযত্নে। এই ফোন থেকেই তার সুন্দরীর গলা শুনেছে। কতদিন দেখা হয়না তার বড়বড় পাপড়িওয়ালা দুটি চোখ। একপাক্ষিক ভালোবাসা এতটা কষ্টের কেন হয়? সামির সব সপ্ন চুরমার হয়ে গেছে। নাকের ডগায় পানি পৌছাতেই ছামি মুছে নিলো। ডাটা অন করেই সিয়ার প্রফাইলে উঁকি মারতে গেলো সামি। সিয়া চায়নি বলেই সে কখনো একটা ছবি তোলেনি ওর। শুধু প্রোফাইলেই তার একটা ছবি। এটা দেখে জিবন পার করা সম্ভব হবে তো?

____

ছাদে আরও কারো অস্তিত্ব টের পেতেই ঘার ঘুড়িয়ে তাকালাম আমি৷ দূরে দাড়িয়ে আছেন সিয়াম ভাইয়া। আমি তাকিয়ে দেখে আমার পাশে এসে বসলেন উনি। কিছুক্ষন পিনপতন নীরবাতা। দুটি নীরব মানুষের মধ্যিখান দিয়ে বাতাস নিজ বেগে ছুটছে অজানা গন্তব্যে। নীরবতা কাটিয়ে আমিই বললাম,

‘ খেয়েছেন? ‘

‘ না। ‘ গলা শান্ত শোনায়।

‘ কেন খাননি? ‘

‘ তুমি খেয়েছো? ‘ আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো। লাল রঙা আকাশের দিকে তাকিয়ে তপ্তশ্বাস ছেড়ে বললাম,

‘ খাইনি। ‘

কথাটা শুনেই উনিও তাকালেন সূদুর আকাশে। একঝাক পাখি উড়ে যায়। হঠাৎ বললেন,

‘ আমার আর ত্রিধার অনেক আগেই ব্রেকআপ হয়ে গিয়েছিলো। ‘

চকিত নজরে তাকালাম ওনার দিকে। উনি আকাশ দেখছেন। কন্ঠ খাদে নামিয়ে বললাম,

‘ অনেক আগে মানে? ‘

‘ বিয়ে ঠিক হওয়ার পরপর’ই। ‘

‘ কিন্তু কেন? ‘

‘ ত্রিধা কখনোই আমায় ভালোবাসে নি। টাকার লোভ, নয়তো মোহ ছিলো ওর। যা দুদীন ছিলো, এখন আর নেই। ‘

প্রতিটা বাক্য অবাক করে তুলছে আমায়। শ্বাসরুদ্ধ কন্ঠে বললাম,

‘ আপনি জেনেও রিসোর্ট বুক করেছিলেন? আর এত আত্মীয়-স্বজনকে এলাও করেছেন? ‘

‘ হুম করেছি। ‘

একদম স্বাভাবিক কন্ঠ! যেন সবটা পরিকল্পিত হয়েছে। কোন খুঁত নেই! নিখুঁত কাজ।

‘ যদি আমার আর আপনার বিয়ে না হতো? ‘

‘ হতো! হতেই হতো! ‘

হতো,হতেই হতো, কথাটা কানে বাজলো কয়েকবার। এটাও পরিকল্পনা করা ছিলো? নিচু গলায় বললাম,

‘ কেন? কেন হতেই হতো? ‘

উনি চুপ করে তাকিয়ে রইলেন আকাশে। সূর্য পুরোটা ডুবে গেছে। মৃদু অন্ধকার নেমে এসেছে ধরনীতে। আমি ফের বললাম, ‘ কি হলো বলুন? ‘

‘ কেন? জানতে চাস? কারন তোর আব্বু আমার পাশে ছিলো। ‘

বুক ধুক করে উঠলো। এতে আব্বুও সামিল? এরমানে আগে থেকেই প্লান করা সবটা।

‘ কিন্তু আপনাকে দেখলেই যে আমার জড়তা, ভয় কাজ করতো এ তো নিশ্চই অজানা ছিলো না আপনার। আর আপনিও তো আমায় তেমন পছন্দ করতেন না। ‘

‘ করতাম। এই ভয়, আমায় দেখলে পালানো, সামনে না আসা, আর কি বললি? জড়তা? এগুলোই ভালো লাগতো আমার। ‘

#চলবে….