আমার সংসার পর্ব-৮+৯

0
499

#আমার_সংসার
লেখক:হৃদয় আহমেদ
পর্ব ৮

‘ তোর চোখে পানি কেন সিয়া? কাঁদছিস কেন তুই? ‘

বলতে বলতে আমার পাশে বসে চোখ থেকে পানি মুছাতে লাগলেন সিয়াম ভাইয়া। ঘৃনায় শরীর রি রি করে উঠলো। কিন্তু প্রকাশ করলাম না। দ্রুত চোখের পানি মুছে সরে গেলাম ওখান থেকে। সবটা না জেনে দোষারপ করবো না আমি। বেলকনিতে গিয়ে দাড়ালাম। হালকা বাতাসে চুলগুলো অবাধ্য হয়ে উড়ছে। আমার এমন কান্ডে উনি কি আমার দিকেই তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে আছেন? অনবরত শুকনো ডোগ গিলে দাড়িয়ে রইলাম। কনকনে শিত! শরীরে লোম খাড়া করে তুলছে। ডান হাত কাঁপছে ঠান্ডায়। উনি পিছনে এসে দাড়ালেন আমার। পদধ্বনি কর্নকুহরে হানা দিলো।

‘ সিয়া কি হয়েছে? এভাবে কাঁদছিলিস কেন তুই? আমায় বল! ‘

অস্ফুটস্বরে বললাম,’ কিছু হয়নি। ‘

‘ তাহলে কাঁদছিলি কেন? ‘

‘ এমনি। ‘

‘ আব্বু কি বললো? ‘

‘ কিছু না। বিয়ের কাহিনিটুকু শুধু। ‘

‘ তোর চোখ আজ অন্যকিছু বলছিলো সিয়া। কি লুকাচ্ছিস তুই? ‘

চমকে তাকালাম ভাইয়ার দিকে। তিক্ন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে উনি। গলা শুকিয়ে আসছে। চোখ দেখে মানুষ বোঝার ক্ষমতা উনার আছে তা অজানা ছিলো না আমার! তাহলে কেন ওভাবে তাকালাম আমি? এটা কি ভুল ছিলো আমার? যদি চিঠিতে সত্যিই খারাপ কিছু লেখা থাকে, তাহলেও কি আমি পিছিয়ে যাবো? ভয় পাবো?

হঠাৎ আমার দিকে এগোতে লাগলেন সিয়াম ভাইয়া। শুকনো গলায় ডোগ গিললাম। বেলকনির রেলিং খিঁচে নিলাম আমি। আমাদের দুরুত্ব হয়েক হাত। তবুও ভয়ে কলিজা শুকিয়ে আসছে। আরও এগিয়ে এলো সিয়াম ভাইয়া। এখন ব্যাবধান কয়েক ইঞ্চির। নিশ্বাস আটকে এলো। দম ফুরিয়ে আসছে। আমাদের মাধ্যবর্তী ফাক এক আঙ্গুল হবে। তার উষ্ণ,গরম শ্বাস মুখশ্রীতে আছড়ে পড়তে লাগলো। গুটিশুটি মেরে রেলিং এর ধারে দাড়িয়ে রইলাম। হঠাৎ কোমর জড়িয়ে নিলেন উনি। বিস্ফোরিত চোখে তাকালাম ওনার দিকে। তার সূক্ষ দৃষ্টিজোড়া আমার চোখে কিছু খুজছে। হাতড়ে বেড়াচ্ছে আমার অস্বাভাবিক আচরণের কারন । হয়তো পায়নি! কোমরের হাতটি হেঁচকা টান দিতেই তার বুকে বাড়ি খেলাম। থমকে তাকালাম। একফোঁটা পানি লাগবে। গলা শুকিয়ে কাঠ! তার স্পর্শে শরীর রি রি করে উঠছে। অস্বস্তি হচ্ছে! চোখে ঘৃনা ঝড়ছে! উনি ঘোর লাগা কন্ঠে বলে উঠলেন,

‘ কিছুই লুকাচ্ছিস না? ‘

আমতাআমতা করে বলে উঠলাম,’ না, লুকাচ্ছি না! ‘

‘ আজ প্রথম তোর চোখদুটি খেয়াল করলাম সিয়া। বড্ড গভীর, নেশাভরা। ‘

তার কন্ঠ অচেনা লাগছে। এদিকে দমও শেষ! প্রানভরে শ্বাস প্রয়োজন আমার। আবারো আচমকা আমায় ছেড়ে দিলেন উনি। একটু দূরে দাড়িয়ে কিছু বিরবির করতে লাগলেন। এরপর বিছানায় দুরুম করে বসে পড়লেন। ঠোঁট ভিজিয়ে নিলাম। শ্বাস নিলাম কয়েকবার। এরপর সোজা বেলকনি থেকে দরজার সামনে এসে দাড়ালাম। পিছু ফিরে বললাম,

‘ খেতে আসুন। রাত বাড়ছে। ‘

বলেই চলে এলাম নিচে। বড়মা অনেক রান্না করেছে। কোন পদ বাদ দেয়নি। আব্বু টিভি দেখছে। বড়মাকে সাহায্য করার জন্য চলে এলাম রান্নাঘরে। যদিও জানি সব রান্না শেষ। তবুও বললাম,

‘ কোন সাহায্য লাগবে বড়মা? ‘

‘ উহুক। ‘

বলেই প্লেটগুলো হাতে তুলে টেবিলে চলে গেলো বড়মা। আমিও চলে এলাম। সার্ভ করতে চাইতেই ঝাড়লো আমায়। টেনেটুনে এনে বসালো টেবিলে। আব্বু আর সিয়াম ভাইয়াও চলে এলো। সকলে বসলাম টেবিলে। বড়মা প্লেটে প্লেটে ভাত দিচ্ছে। কোথথেকে তুষার ভাইও চলে এলো। এসেই বলে উঠলো,

‘ হ্যালো এভরিওয়ান। আর দুলাভাই, কখন এলে? ‘

উনি হাসলেন। বললেন,

‘ দুপুরে এসেছি৷ এসেছি থেকে তো তোমার টিকিটাও দেখতে পেলাম না। ‘

‘ ওহ্হো, একটু ব্যাস্ত ছিলাম। ‘

মামী তিক্ত চাউনি নিয়ে তাকালো তুষার ভাইয়ের দিকে। আক্ষেপ স্বরে বললো, ‘ তা তো দিনেদুপুরে সবসময় থাকে। ‘ বলেই হনহন করে চলে গেলো রান্নাঘরে। এখন নিশ্চিত বড়মা কাঁদবে। তার বুকের জ্বালা যে কতটুকু আমি জানি। মায়ের একটু কথা শুনলে কি হয় ভাইয়ের? আগে তো ভালোই ছিলো তুষার ভাই!

একটু পর মাছের বাটি হাতে এলো বড়মা। চোখ দেখলে যে কেউ বলে দিবে বড়মা কেঁদেছে। আমি প্লেটের দিকে চোখ রাখলাম।

‘ তা তুই কেমন আছিস বললি না সিয়া? ‘

মাথা তুলে চাইলাম। পরিক্ষিত চোখে আমার দিকে সিয়াম ভাইয়াও তাকিয়ে। আমি হাসি মুখে মাথা নাড়িয়ে বোঝালাম ভালো আছি।

এরপর সবকিছু ঠিক, শান্ত হলেও সিয়াম ভাইয়ার চোখ ঠিক, শান্ত হলো না। খাওয়ার মাঝে উনি বারবার আমায় অস্বস্তিতে ফেলেছেন। বারবার আমার দিকে তাকিয়েছেন সন্দিহান চোখে। তখনের কান্নার রেশ রয়ে গেছে তার মাঝে। পুরোটা সময় ওভাবেই চললো। খাওয়া শেষে এক মুহুর্ত না দাড়িয়ে ছুটে চলে আসলাম রুমে। পরিকল্পনা করলাম, রাতে পুরো চিঠিটা পড়বো।

রাত দশটা! শুয়ে পড়েছি আমি। প্রতিদিন যেটা হয়, আজ সেটা হলো না। ভাইয়া সারে নয়টায় ঘুমিয়ে পড়লেও আজ ঘুমালো না। লাইট অফ করা, কিন্তু ল্যাপটপে ডুবে আছেন উনি। আজ এখনো ঘুমাচ্ছে না কেন উনি? ইচ্ছে করে? আমি এপাশ ওপাশ করতে লাগলাম। আমারো ঘুম আসছে না। কই এতো দেড়ি তো উনি কখনোই করেনা! আমার উশখুশ বুঝে বলে উঠলো সিয়াম ভাইয়া,

‘ আজও কি ঘুমাবি না পণ করেছিস? ‘

পাশ ফিরে তাকালাম ওনার দিকে। বললাম,

‘ আজও মানে? ‘

‘ কতদিন ধরে রাত জাগিস আমি জানি না মনে করেছিস? ‘

অবাক হলাম, কিন্তু প্রকাশ করলাম না। বললাম,’ আপনি তো এরও আগে শুয়ে পড়েন,তাহলে আজ কেন ঘুমাচ্ছেন না? ‘

‘ খটকা লাগছে! ‘

তড়িৎ গতিতে উঠে দাড়ালাম। হাসফাস করতে করতে বললাম, ‘ কেন? ‘

‘ এইযে তুই এমন করছিস! তার কারনেই। বাই দা ওয়ে, তুই ঘুমা। আমি নাটক দেখবো এখন। ‘

ভ্রুযুগল কুঁচকে বললাম, ‘ কানের কাছে বসে এখন নাটক দেখবেন? হবে না! ‘

‘ ইয়ারফোন আছে। ইডিয়ট! ‘

ফুঁসতে ফুঁসতে শুয়ে পড়লাম। উনি সত্যিই নাটক দেখতে লাগলেন। এভাবে অনেকক্ষণ চোখ বন্ধ রাখার পর কখন আমি ঘুমিয়ে পড়লাম, জানা নেই!

শিতের সকালে সূর্যের স্নিগ্ধ আলো মুখে পড়তেই চোখমেলে তাকালাম। হাই তুলে উঠতে গিয়েই বুঝলাম কারো বুকে আমি। কেউ জড়িয়ে শুয়ে আছে। ঘুমো ঘুমো চোখ মেলে তাকাতেই দেখলাম উনি জড়িয়ে রেখেছেন আমায়! সারা শরীরে শিহরণ বয়ে গেলো। হাত পা অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপতে লাগলো। হৃদপিণ্ড লাফাচ্ছে দ্রুত গতিতে। দম আটকে এলো আমার। উনি কেন জড়িয়ে রেখেছে আমায়? সারা শরীর পাথরের মতো নিথর হয়ে রইলো। কখন ঘুম ভাঙবে ওনার? আর কতক্ষন? হঠাৎ চোখ মেলে তাকালেন উনি। সারা মুখে রোদ পড়ে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে ওনার মুখশ্রী। লজ্জায় মুখ নামিয়ে নিলাম।

‘ ওয়াও! বেশ লজ্জাতো তোর মুখে? ‘

শিতল চোখে তাকালাম তার দিকে। উনি আমায় ছেড়ে উঠে গেলেন বিছানা থেকে। লজ্জায় জুবুথুবু হয়ে বসে রইলাম আমি!
___

বালিশের নিচ থেকে দ্রুত চিঠিটা বের করে ব্যাগে পুরে নিলাম। এরপর বেড়িয়ে গেলাম বাড়ি থেকে। যে করেই হোক রিকশায় বসে চিঠিটা পড়তেই হবে। রাস্তায় অপেক্ষা করতে লাগলাম রিকশার। একটু বাদে পেয়েও গেলাম। রিকশায় উঠতেই কলেজের নাম বলে দিলাম। এরপর নতুন ভাবে ভাজ খুললাম চিঠির। প্রথম কয়েক লাইনে বিভৎস খুনের বর্ননা! বমি গলায় এসে আটকালো আমার।

#চলবে…..

#আমার_সংসার
লেখক: হৃদয় আহমেদ
পর্ব ৯

শরীর কাঁপছে! রাগে থরথর করে কাঁপছে। আধঘন্টা হলো ফোন করেছি এখনো উনি আসেনি। কেন? বিছানার চাদর খিচে নিলাম। চিঠিটা পড়ার পর রিকশা থেকে নেমে পরি আমি। ট্যাক্সি করে চলে এসেছি মামীদের বাসায়। নিচে সবাইকে উপেক্ষা করে ছুটে আমাদের রুমে চলে এসেছি। হিতাহিত জ্ঞান শূন্য লাগছে। কাল আব্বু কত শক্ত কন্ঠে বলেছিলো,’ পৃথিবী উল্টে গেলেও যেন তাকে ভুল না বুঝি! ‘ কথাগুলো বারবার প্রতিধ্বন্নি হয়ে কানে বাজছে। আর সেখানে লোকটা নিজেই একটা শিশুর খুনি? কেন উনি খুন করেছেন একটা শিশুর? কতটুকু ছিলো বাচ্চাটি? ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে আসছে! অথচ মুখে কাঠিন্যে ভাব! কতটা কষ্টকর! তবুও রেখেছি। আজ আমার সকল প্রশ্নের উত্তর ওনাকে দিতে হবে! জানতেই হবে সবটা আমায়।

‘ এভাবে এখানে আসার মানে কি সিয়া? কিসব অভদ্রতা বলবি আমায়? ‘

সিয়াম ভাইয়ার স্বর পেতেই কড়া চোখে তাকালাম আমি। উনি হাঁপাচ্ছেন। হয়তো ছুটে এসেছেন সিঁড়ি দিয়ে। আমি চুপ করে তাকিয়ে রইলাম এই লোকটার দিকে। উনি আবারো বলতে আরম্ভ করলেন,

‘ নিচে কাউকে কিছু না বলে চলে এসেছিস কেন তুই? মা চিন্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছে। ‘

……

‘ ওয়াট রং উইথ ইউ? চুপ করে আছিস কেন তুই? ‘

……

‘ এবার কিন্তু ধৈর্যের বাঁধ ভাঙছে। ওদিকে তোর আব্বুও চিন্তিত! ‘

উনি রাগে গজগজ করতে করতে ছুটে এলেন আমার সামনে। বাহু ঝাঁকিয়ে কর্কশ গলায় বললেন,

‘ তুই কিন্তু লিমিট ক্রস করছিস! ‘

শান্ত দৃষ্টিতে তাকালাম ওনার হাতের দিকে। আমার অদ্ভুত চাউনিতে উনি ভ্রু কোঁচকালেন। শান্ত গলাতেই বলে উঠলাম,

‘ কে সেই ছেলেটি সিয়াম ভাইয়া? কার খুনী আপনি? ‘

বিমুঢ় দৃষ্টিতে তাকালো সিয়াম ভাই। তার মুখ মুহুর্তে পাল্টে যায়। চোখ শিতল হয়। মুখশ্রীতে রাগ নেই। চাউনি অবাক! কেবল পাথর মুর্তির মতো একচোখে আমার দিকেই তাকিয়ে রইলেন উনি।

‘ বলবেন না? কেন খুন করেছেন? ‘

‘ কিভাবে জানলি তুই? ‘ কন্ঠ কেমন শোনালো। ঘার থেকে হাত সরিয়ে বিছানা থেকে উঠে দাড়ালাম আমি। বুক হাপড়ের মতো ওঠানামা করছে। উনি ধপ করে বসে পরলেন বিছানায়।বললাম,

‘ অজানা কেউ আপনার মুখোশ খুলে দিয়েছে আমার সামনে। ‘

উনি আমার পিছনে এসে দাড়ালেন। তার মুখেচোখে ভয়! সব হারাবার ভয় পুলকিত হতে লাগলো। উনি স্তব্ধ কন্ঠে বলে ওঠেন,

‘ কে বলেছে তোকে? ‘ কন্ঠ কত করুন, আক্ষেপে জর্জরিত শোনালো। আমার নিজেরই বিশ্বাস হতে কষ্ট হচ্ছে আমি যাতে মুগ্ধ সে খুনী! কোন বাচ্চাকে নরপশুদের মতো খুন করেছে। বুকের জ্বালা বেড়ে দ্বীগুন হলো। আমার ওষ্ঠাদ্বয় তিরতির করে কাঁপছে! বুকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, ঝলসে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। আমি নিজেকে আটকাতে পারলাম না, ঘুরে গিয়ে তার কলার চেপে চেঁচিয়ে উঠলাম,

‘ কোন মায়ের বুক খালি করেছেন আপনি? কাকে মেরেছেন উত্তর দিন! ‘

আমার প্রশ্নে তার চিবুক কেঁপে ওঠে। দৃষ্টি এলোমেলো, কনকনে শিতে তার কপালে গুচ্ছ গুচ্ছ ঘামের কনা। আমার বুক বিরতিহীনভাবে ওঠানামা করছে। উনি চুপ! চুপ থাকারই তো কথা। খুন করে অন্তত কেউ বরগলায় কিছু বলতে পারে না। কিন্তু ওনার চুপ থাকা যে আমার রাগ কয়েকশোগুন বাড়িয়ে তুলছে। কপালের রগ দপদপ করছে আমার।

‘ এভাবে চুপ থেকে প্রমান করবেন না আপনি দোষী! বলুন। সবটা বলুন। ‘

উনি চুপ। একচোখে তাকিয়েই আমার দিকে। ফের বললাম,

‘ কি হলো বলুন! কে সেই ছেলেটি সিয়াম ভাইয়া? ‘

আমার প্রশ্নকে অগ্রাহ্য করে কলার থেকে হাত নামিয়ে দুহাত শক্ত করে ধরে নিলেন উনি। উত্তজিত গলায় বললেন,

‘ তুই? সিয়া তুই বিশ্বাস করিস আমি খুন করতে পারি? আমি…এই আমি কাউকে খুন করেছি তোর বিশ্বাস হয় সিয়া? ‘

গাল বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়লো। তার চোখ ভর্তি আকুতি! আমার উত্তরের অপেক্ষা সে চোখে। শুকনো ডোগ গিলে কড়া গলায় বললাম আমি,

‘ করি! বিশ্বাস করি আমি। ‘

হাত ছেড়ে দূরে গিয়ে দাড়ালেন উনি। চোখ ছলছল করছে ভাইয়ার। কি করবেন কি না করবেন ভেবে পাচ্ছে না। বিছানার পাশে রাখা টেবিলটা থেকে উনি কাঁচের একটি টপ তুলে নিলেন। অজানা ভয়ে আৎকে উঠলাম আমি। একমুহূর্ত না দাড়িয়ে ছুটে গিয়ে হাত আটকে নিলাম ওনার।

‘ কি করছেন আপনি? ‘

আমার প্রশ্নকে অগ্রাহ্য করে জড়িয়ে নিলেন আমায় উনি। একটু ভয় পেয়ে গেলাম। তার হৃদপিণ্ড দ্রুততম বেগে লাফাচ্ছে। হয়তো তুফান বইছে। এত শিতেও তার শরীরে একটি শার্ট ছাড়া কিছু নেই। আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে রইলেন উনি। শরীর ঘেমে একাকার ভাইয়ার। একটু পর অস্ফুটস্বরে বললেন,

‘ তুই পারিস না আমায় ভুল বুঝতে। পারিস না। ‘

থেমে হেলাম। ছোটবার তেজটা কমে এলো। সান্ত গলায় বললাম,

‘ কেন পারি না? অবশ্যই পারি! ‘

‘ না…না….কিছুতেই না। ‘

‘ আমায় বলুন সবটা। ‘

দূরে ছিটকে ফেলে দিলেন উনি। টাল সামলাতে না পেরে মেঝেতে বসে পরলাম। কিংকর্তব্যবিমুঢ় চাউনিতে তাকালাম ওনার দিকে। শুকনো ঠোঁটে কিছু বিরবির করছেন উনি। আবারো আমার পাশে মেঝেতে বসে পরলেন। উন্মাদ, পাগল লাগছে। দু হাত আমার মুখে রেখে বললেন,

‘ কিভাবে জেনেছিস তুই? সিয়া বল! কে বলেছে তোকে? ‘

আলতো করে চিঠিটা হাতে দিলাম ওনার। উনি ভ্রু কুঁচকে হাত থেকে নিয়ে নিলেন। এরপর পড়তে লাগলেন। ফুপিয়ে উঠলাম। গাল ভিজে গেলো নোনাজলের স্রোতে!

খুনী সিয়াম?,
হাতচেঁড়া মৃতের মতো সে দৃশ্য কত ভয়ঙ্কর, নিকৃষ্ট ছিলো,মনে আছে তো তোমার? ওর মাথায় গুলি করা হয়েছিলো। জানো সিয়া? তোমার সাথে যার বিয়ে হলো সে একজন খুনী। আমি জানি না কে হও তুমি ওর। কিন্তু এটুকু বুঝেছি তুমি একটু স্পেশাল ওর কাছে! সিয়ামের মুখে তোমার নাম শুনেছি বহুবার। কিন্তু একটা মেয়ে হিসেবে তো আমারই উচিত তোমায় বাঁচানো তাইনা? তাই বলছি! আমি চেয়েও পারিনি বিয়ের আগে চিঠিটা পৌছাতে। লিখছি খুব তারাতাড়ি। কি লিখছি জানা নেই। তাও তুমি আসরে বসার পর লিখছি। যাইহোক, একটা আশা রাখবো তোমার কাছে, তুমি শুধু জানতে চাইবে কেন খুন করেছিলো ও। ব্যাস এতটুকুই! আমি মনে করি ওকে ছেড়ে দেয়া উচিত তোমার। আমায় খোজার চেষ্টা করোনা। এ চিঠিটা যেন কারো হাতে না পড়ে। আমায় খোজার বৃথা চেষ্টা করে নিজের সময় নষ্ট করোনা। মনে করতে পারো তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী আমি।

চিঠিটা পড়তেই পানিভরা দৃষ্টিতে তাকালেন উনি। তুফান বয়ে যায় বুকে তার তাকানোর ভঙ্গিতে। তার চাউনি দেখলে বুক ফেটে আসে। দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে বলতে ইচ্ছে হয় ,’ সবটা বলো! সবটা। ‘ কেন এমন হচ্ছে। আমিকি তাকে ভালোবেসে ফেলেছি? তাহলে তো এগুলো নাটক ছিলো! এতকিছু আনা,নাটক ছিলো সবটা! তবুও কেন এখনো মায়া হচ্ছে আমার? কেন ওনার চোখের পানি নরম করছে আমায়?

_____

আজ নিয়ে কেটে গেছে দুদীন। ভাইয়া দুদীন কোথায়, কেমন আছে জানা নেই। ফোন দিলে রিসিভ করেন না উনি। মামা-মামী চিন্তা পাগল হয়ে যাচ্ছেন। ড্রইংরুমের সোফায় চিন্তিত হয়ে বসে আছি আমি। উনি উধাও হয়ে কেন গেলেন? আমিতো বলিনি সবাইকে সব বলবো! তাহলে? গুম হয়ে এটা বোঝাচ্ছে যে উনি নির্দোষ? নাকি এটা বোঝাচ্ছে আসলেই সব দোষ ওনার। আর কে সেই চিঠি প্রেরক? ত্রিধাপুর কথা মাথায় এসেছিলো, কিন্তু ত্রিধা হয়ে থাকলে কি আবার কোন ইঙ্গিত দিতো না? সব গুলিয়ে আসছে! এ কোন বেরাজালে আবদ্ধ হলাম আমি? দুদীন ধরে তার দেখা নেই! চিন্তাও যে কম হচ্ছে তা নয়!

‘ মা, ভাবি কই তোমরা? ভাইয়া ফোন রিডিভ করেছে। ‘

কথাটা কর্নকুহরে পৌছাতেই পিছু ফিরে তাকালাম আমি। সায়েম একপ্রকার হন্তদন্ত হয়ে নিচে নামছে। সোফা ছেড়ে উঠে আমি এগোতেই মামী ছো মেরে ফোনটা হাতে নিলো। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললো,

‘ সিয়াম…বাবা কই তুই? ফোন কেন রিসিভ করছিলি না? ফিরে আয়। ‘

ওপাড় থেকে কিছু বলতেই মামী আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘ কেউ ভালো নেই। তুই জলদি ফিরে আয় বাবা। ‘

আবারো ওপাড় থেকে কিছু বললেন ভাইয়া। মামী হু হু করে কেঁদে উঠলো। হয়তো আসবে না বলছে! সঙ্গে সঙ্গে মেজাজ বিগড়ে গেলো আমার। মামীর কাছে গিয়ে বললাম, ‘ ফোনটা দাও! ‘ ফোন দিয়ে অঝোরে কাঁদতে লাগলো মামী। শক্ত গলায় বললাম,

‘ শুনতে পাচ্ছেন মায়ের কান্না? কেমন ছেলে আপনি? এখানে সকলে কত চিন্তায় রয়েছে জানেন আপনি? আজকের ভিতরে আপনাকে বাড়িতে দেখতে চাই আমি। কোন এক্সকিউজ শুনতে চাইছি না। আপনার এতটুকু মনুষ্যত্ববোধ থাকলে আজই চলে আসেন। ‘

একটানে কথাগুলো বলে দম ফেললাম। উনি খানিকটা সময় চুপ থেকে বললেন,

‘ এতটা ঘৃনা তোর আমার প্রতি? ‘

‘ ঘৃনা, অবিশ্বাস কিছুই নেই! মামীর কান্না আমার সহ্য হচ্ছে না। আপনি চলে আসুন। ‘

‘ তোর কান্না দেখে বাঁচতে বলছিস? ‘

চোখ ছলছল করে উঠলো৷ এতক্ষণ শক্ত হয়ে কথা বললেও গলা ভেঙে আসছে আমার। উনি আবারো বললেন,

‘ আসছি, আজ সব বলবো তোকে। ‘

ফোন কেটে দিলেন উনি। ফোনটা সায়েমের হাতে দিয়ে ‘ উনি আসছেন। ‘ বলে চলে গেলাম উপরে। বিকেলে বিদ্ধস্ত অবস্থায় বাড়ি ফিরলো সিয়াম ভাইয়া।

#চলবে…