আমি মায়াবতী পর্ব-০২

0
327

#আমি_মায়াবতী
#পর্ব_২
#লেখনীতে_তাহমিনা_মিনা

একটা বিকট শব্দ করে বাস টা ব্রেক কষলে আমি বাসের সামনের দিকে ঝুঁকে পড়তে গিয়েও থেমে গেলাম। দেখলাম একটা শক্ত হাত আমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে। মানুষটা আমার বাবা। কয়েক মুহুর্ত লাগলো আমার আমি কোথায় আছি সেটা বুঝতে। দ্রুতই মস্তিষ্ক সচল হলো। মনে পড়লো আমি কোথায়। হ্যাঁ, আমি বাবার সাথে। বাবার সাথে আমার নতুন পরিবারে যাচ্ছি। তারমানে মা আমার কাছে নেই। মা আর বেঁচে নেই। মায়ের মৃত্যুটা আমি এখন ও মেনে নিতে পারিনি। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মনে হয় মা আমার কাছেই আছে৷ ডাকলেই চলে আসবে। কিন্তু আসেনি। এই কয়েকদিন ঘুম ভাঙলে হয়তো খালামনি না হয় নানী এসেছে। কিন্তু এখন কে আসবে? বাবা আসবে? নাকি অন্য কেউ? নাকি আসলেই কেউ আসবে?নাকি কেউ আসবেই না?

“ব্যথা পেয়েছো মা? কোথাও লাগেনি তো? ভয় পেয়েছো?” বাবার প্রশ্নে বাস্তবে ফিরে এলাম আমি।
মা? বাবা আমাকে এইভাবে মা বলে ডাকবে আমার কল্পনার অতীত ছিল বিষয়টা। ভিতর থেকে যেন কেউ কান্নার একটা কল খুলে দিল। এতটুকু আদরেই আমার ভীষণ কান্না পেতে থাকলো। আমি বুঝতে পারলাম না আমি কষ্টে কান্না করছি নাকি সুখে। আমি মাথা নাড়িয়ে না বললাম।
বাবাসহ আরও কয়েকজন মানুষ ড্রাইভারের সাথে কথা বললো। বাবা ফিরে এসে আমাকে বললো, ” আমাদের নামতে হবে মা। বাস একটু খারাপ হয়েছে। সামনেই গ্যারেজ আছে। কিছুক্ষন পরেই কিছু লোক আসবে। ওরা ঘন্টাখানেকের মাঝে ঠিক করে দিবে। বাসের ভিতরে বসে থাকতে আমার ভালো লাগে না। দম বন্ধ লাগে। চলো বাইরে যাই। ৫ মিনিট হাঁটলেই একটা ধাবার মতো কিছু একটা পাবো। বের হও মা।”
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো করে বাবার পিছনে গেলাম। বাসের লাইটের মৃদু আলোয় হাতঘড়িতে দেখলাম রাত ৪ টার কাছাকাছি। তার মানে ভোর হতে খুব দেরি নেই। আমাদের সাথে আরও কিছু মানুষ যাচ্ছিল। বাবা সবার সাথেই কথা বলতে বলতে হাটছিল। একজন লোক আমার দিকে তাকিয়ে বাবাকে প্রশ্ন করে,” ভাই, ও কি আপনার মেয়ে?”
বাবাও হেসে জবাব দেয়,” হ্যাঁ, ও আমার মেয়ে।”
” আমি দেখেই বুঝেছিলাম। বাবা মেয়ের চেহারা তো একেবারে একই রকম। একেবারে কার্বন কপি একজন আরেকজনের। যে কেউ দেখেই বলে দিবে যে ও আপনারই মেয়ে।”
আমি একটু মুচকি হাসলাম। আসলেই বাবা আর আমার চেহারায় অনেক মিল। মা বলতো আমার হাসিটাও নাকি বাবার মতো। এমনকি নাকটাও৷ মা মাঝে মাঝে অভিমান করে বলতো,” তোকে পেটে ধরেছি আমি। পুরো প্রেগ্ন্যান্সির সময় আমি তোর আর আমার খেয়াল রেখেছি। আর তুই হইছিস তোর বাপের মতো। এইটা কি ঠিক কাজ করেছিস তুই মা? বলতো আমাকে। ”
মায়ের কথাগুলো শুনে আমি খিলখিল করে হাসতাম। আমার সময় কাটতোই মায়ের সাথে। তাই মায়ের সাথেই বন্ধুত্ব ছিল। কিন্তু এখন? সবই স্মৃতি। শত খুঁজলেও মাকে আর ফিরে পাবো না৷ পাবো শুধু স্মৃতিগুলোকে। কিন্তু স্মৃতিগুলোতে যে দগদগে ঘা। আর বাবার প্রতি তীব্র ঘৃণা কিংবা অভিমান। মাঝেমাঝে মনে হয় বাবার প্রতি অনুভুতিটি ঘৃণা। আবার মায়ের কথাগুলো মনে পড়লে মনে হয় অভিমান।

কিছুক্ষণ পরই আমরা রেস্টুরেন্টে বসে খাওয়া শুরু করলাম। কোনোদিন ভাবিনি বাবার সাথে এইভাবে বাইরে এসে খেতে পারবো। স্কুলে বান্ধবীদের দেখতাম ওদের বাবারা এসে ওদের নিয়ে যেত। ছুটির দিনে বাবার সাথে ঘুরতে যেত। বছরের শেষে বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে যেত। আমাকে এসে ছবি দেখাতো৷ কত কি করেছে সেইসবের গল্প বলতো। একবার এক বান্ধবী সিলেট থেকে ফিরে এসে বলেছিল ও নাকি পাহাড় দেখেছে। আমারও ভীষণ ইচ্ছে হলো পাহাড় দেখার। মনে মনে ভাবলো, এইবার বাসায় বাবা আসলে বাবাকে বলে কোনোভাবে সিলেট যাবেই যাবেই। কিন্তু মেয়েটি যখন বললো, ও পাহাড়ে উঠতে ভয় পাচ্ছিল, তখন ওর বাবা ওকে পিঠে নিয়ে পাহাড়ে উঠেছিল। মুহুর্তেই আমার মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। বাবার পিঠে কেউ উঠে নাকি? বাবা ব্যথা পায় না? মেয়েটি তখন একা একাই বলছিল,” জানিস, আমার বাবা আমাকে কত ভালোবাসে? আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন বাবা অফিস থেকে ফিরে আমার সাথে ঘোড়া ঘোড়া খেলতো।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম,” ঘোড়া ঘোড়া কি খেলা?”
বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে মেয়েটি আমাকে উত্তর দিয়েছিল, ” তুই তাও জানিস না? বাবা হামাগুড়ি দিত। আর আমি বাবার পিঠে উঠে বলতাম ঘোড়া এইদিকে যাও। ঐদিকে যাও৷ তুই ক্লাস ফোর এ পড়িস, তাও ঘোড়া ঘোড়া খেলা জানিস না? ” বলেই খিলখিল করে হেসে উঠেছিল মেয়েটি।

” বাবা, আমাকে আইসক্রিম কিনে দাও না। ও বাবা, আইসক্রিম কিনে দাও।” একটা বাচ্চার চিৎকারে বাস্তবে ফিরে আসি আমি। বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, আমি কখনো আবদার করার সুযোগও পাইনি বাবার কাছে। আবার তো ঘোড়া ঘোড়া খেলা। সবাই কি আর আমার বান্ধবীর মতো ভাগ্যবতী হয়?

একটা কাপল কে দেখলাম। ছোট্ট একটা বাচ্চা মেয়েও আছে তাদের সাথে। বাচ্চাটাকে মা মুখে তুলে খাবার খাওয়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে। বাবাটা কিছুক্ষণ পরে নিজের মুখটাকে জোকার এর মতো করছে। তাতে বাচ্চাটা খিলখিল করে হাসছে। আর সেই সুযোগে মা বাচ্চাকে খাওয়াচ্ছে। আমার অস্থির লাগতে শুরু করলো। আমি যেন অন্য এক জগতে এসে পড়েছি। এইখানে সবকিছু আমার জগতের বিপরীত৷ আমার নিঃশ্বাস নিতেও যেন কষ্ট হচ্ছিল। একটা বাচ্চা মেয়েকে মা মুখে তুলে খাবার খাইয়ে দিচ্ছে। আমার হঠাৎ করেই মায়ের কথা মনে পড়ে গেল। আমার মাও আমাকে এইভাবে খাইয়ে দিত। আমায় ভালোবাসার জন্য কেউ ছিল না বলেই হয়তো মা আমাকে এতো ভালোবাসতো। আমাকে কোনো কাজই করতে দিত না। আমার সবকিছু মুখের সামনে এনে রাখতো। রান্না করা ভাত আর গ্লাস ভর্তি পানি সবসময় পেয়েছি আমি। এতোটাই আদুরে ছিলাম আমি। কিন্তু যখন মা অসুস্থ হয়ে পড়লো, আমাকে মা নিজেই হাতে ধরে সব কাজ শিখিয়েছে। এখন সবই পারি আমি। হয়তো মা জানতো, এইরকম দিন আসবে কোনোদিন। তাই হয়তো তার আগাম প্রস্তুতি নিয়েছিল। কিন্তু আজকের এই খাবার টা আমার নিজের হাতে খেতে ইচ্ছে করছে না। একবার ইচ্ছে হলো বাবাকে বলি,” বাবা, আমাকে একটু খাবার খাইয়ে দিবে? ”
কিন্তু বলতে পারলাম না। জড়তা কিংবা ভয়। দুটোর একটা কিংবা দুটোই হয়তো কাজ করছিল মনের মধ্যে। আর তাছাড়া ১৬ বছরের মেয়েকে কেউ কেন খাইয়ে দিবে? যেখানে আমি সামনের বছরই এসএসসি দিব। এখন কি আমার আবদার করা মানায়? যেখানে আবার আমার মা এই দুনিয়াতে নেই।

আমার হঠাৎ কি হলো জানি না। আমি কোনো কিছু না ভেবেই দৃঢ় গলায় বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম,” বাবা, আমাদের সাথে তুমি থাকতে না কেন? অন্য ১০ টা পরিবারের মতো আমরা কেন একসাথে থাকতাম না? আমাদের কি এমন দোষ ছিল যে তুমি আলাদা থাকতে? আমার আর আমার মায়ের সাথে কেন এমন অবিচার করেছো?”
আমার করা এহেন প্রশ্নে বাবা হঠাৎ থতমত খেয়ে গেল। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,” অবিচার? অবিচার করেছি তোমাদের সাথে? কিভাবে অবিচার করলাম? বলো আমাকে।”
বাবার এইরকম জবাবে আমি থতমত খেয়ে গেলাম। আমতাআমতা করে বললাম,” তাহলে তুমি শুধু কেন তোমার আরেকটা পরিবার নিয়ে ছিলে? কেন আমার মাকে সময় দাওনি?”
” পরিবার? তোমার মা আমার পরিবার ছিল? তোমার মা কি তোমাকে এই ১৬ বছরে তোমাকে কিছুই বলেনি?”
আমি কিছু না বলে মাথা নিচু করে রইলাম। বাবা আবার বলতে শুরু করলো,” আগুন চিনো মায়া? আগুন? যা সবকিছুকে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। তোমার মা আমাকে সেই আগুনে ঠেলে ফেলে দিয়েছে। ১৭ বছর ধরে আমি সেই আগুনে জ্বলছি। তোমার মায়ের করা একটা ভুল আমাকে সারাজীবন জ্বালাচ্ছে। প্রতি মুহুর্তে আমার মনে হয় আমার জীবনটা এই বুঝি শেষ হয়ে গেল। ১৭ বছর ধরে আমি জ্বলছি। আর এখন আমার পরিবার জ্বলবে। আমার পরিবার টা ধ্বংস হয়ে যাবে হয়তো। বুঝলে তুমি?”
আমি মুহুর্তেই মিইয়ে গেলাম। কি এমন করেছিল আমার মা, যার দাম তাকে সারাজীবন ধরে দিতে হলো। নিজেকে বুঝালাম, আমাকে জানতে হবে সবকিছু। আমাকে টিকে থাকতে হবে। সামনে যাই হোক না কেন, আমাকে সক্ষম থাকতে হবে৷ বাবার দিকে তাকিয়ে বললাম,” আমার মা মারা গেছে ৭ দিন আগে৷ প্লিজ একজন মৃত মানুষকে নিয়ে খারাপ কথা বলো না। ” বলেই মাথা নিচু করে রাখলাম।
বাবাও আর কিছু না বলে চুপচাপ খেতে লাগলো।
বাসে উঠে আবারও চুপচাপ বসে রইলাম। জানিনা কি হবে সামনে। জোরে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে সকালের বাতাস টা উপভোগ করলাম। আর ভাবলাম, ইশশ! মা যদি এখন আমাদের সাথে থাকতো? মানুষ কল্পনাতেই সুখি। আমিও না হয় হলাম। মায়ের গায়ের ওম টা যদি এখন পেতাম। আমার মনে হলো মা আমাদের সাথেই আছে। আমরা ৩ জন। হ্যাঁ, আমাদের পরিবার। বাবা পরম যত্নে মায়ের খোলা চুলগুলো কপাল থেকে সরিয়ে দিচ্ছে। আমি তাদের ভালোবাসার এই মুহুর্ত টা ক্যামেরা বন্দী করছি। ইশশ! খুব বেশি কি ক্ষতি হতো, যদি এমনটা হতো? সৃষ্টিকর্তা কি এমন টা করতে পারতেন না? একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে মায়ার বুক চিরে।

চলবে….