#আমি_সেই_চারুলতা
#Shuvra_Priya
#পর্বঃ২৭
_______________________
– নাজিমুদ্দিনের কলিজা কি করেছেন চারুলতা?
– হামিদ খেয়ে ফেলেছে।
– আপনি বারবার এই একই উত্তর দিচ্ছেন কেনো?
– কারণ আপনি বারবার একই প্রশ্ন করছেন।
– তাহলে উত্তরটা দিয়ে দিলেই পারেন। এমন উৎভট কথা বলছেন কেনো?
– উৎভট কথা নয়, সত্যিই কথাই বলছি।
– আপনার সাথে কথা বলাই বেকার। বাদ দিন এসব। আমি যা বলতে এসেছিলাম শুনুন।
– জ্বি বলুন।
– আজ পুতুলের জন্মদিন। ছোটখাটো একটা পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। আপনি সেখানে ইনভাইটেড।
– ধন্যবাদ তবে আমি এখানেই ঠিক আছি। আমার সম্পর্কে কেউ জানলে আপনাদেরই অস্বস্তিতে পড়তে হবে। অন্যের কলিজা ভক্ষণ করা নারী আমি।
– কে জানবে? আমার মা-ও তো সেসব জানেনা। বাড়িতে একজন মানুষ আছে সে যদি অনুষ্ঠানে না থাকে তবে সেটা দৃষ্টিকটু। আমি চাই আপনি অনুষ্ঠানে থাকুন। আর হ্যাঁ, আমার মা আর মেয়ের থেকে অবশ্যই দূরত্ব অবলম্বন করে।
ছোট বেলা থেকেই চারুর আত্মসম্মানবোধ প্রবল। সাজিদের এ কথায় সে অপমানিত বোধ করলেও সাজিদের অবস্থা সে বুঝতে পারছে। কোনো মানুষই নিজের প্রিয়জনের জীবনের ঝুঁকি নিতে চায়না। কিন্তু তাহলেও প্রশ্ন থেকেই যায়। সাজিদ যদি ওকে নিয়ে এতই অনিশ্চিয়তায় ভোগে তাহলে কিসের কৃতজ্ঞতা পালন করতে ও চারুকে এখানে রেখেছে? তাছাড়া সবচেয়ে বড় কথা সাজিদ ওকে সাহায্য করতে রাজি হয়েছে। সেটাই অনেক। তার কথাগুলো মেনে চলাই শ্রেয়। অন্তত কৃতজ্ঞতা বোধের একটা ব্যাপার তো আছে। চারু মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো সে যাবে।
সাজিদ নীচে চলে গেলো। নিশ্চয়ই অনেক বিজি হবে। মেয়ের জন্মদিন বলে কথা। কিছুক্ষণের মাঝেই ছাদে আসলো কাজের মেয়েটি। এই মেয়েটি-ই সবসময় চারুকে খাবার দিয়ে যায়। তার হাতে একটি প্যাকেট। সাজিদের মা পাঠিয়েছে। লাল রঙের একটি জামদানি শাড়ি। সন্ধ্যাবেলা এইটা পড়েই সে চারুকে নীচে যেতে বলেছে। শাড়ির সাথে কিছু প্রসাধনীও রয়েছে। চারু ব্যাপারটা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামালো না। কেমন যেনো নিজেকে অনুভূতি শূন্য মনে হয়। আজকাল আর কারোর জন্যই অনুভূতি আসেনা। কেনো যেনো মনে হচ্ছে শিহাবের প্রতি থাকা অনুভূতিটাও মরে গেছে। সেদিন পুতুল নামের মিষ্টি মেয়েটিও এসেছিলো। অনেকক্ষণ গল্প করলো চারুর সাথে কিন্তু এত মিষ্টি একটা মেয়ের প্রতি চারুর মায়া এলোনা। লতাকে দেখলেই মনের মাঝে প্রশান্তি আসে ঠিকই কিন্তু যতটা ভালোবাসা উচিত ভাইয়ের মেয়ে হিসেবে ততটা ভালোবাসা আসেনা। হামিদ ওর জন্য জীবন অবধি দিয়ে দিতে পারে কিন্তু আজকাল হামিদের প্রতিও আর ভালোবাসাটা কাজ করেনা। কে জানে কেনো এমন হচ্ছে। তবে কি একাকিত্ব-ই ওকে ভয়ানক ভাবে গ্রাস করে নিচ্ছে। শাওন ওকে কতটা ভালোবাসতো কিন্তু তার পরেও শাওনের ভালোবাসাটা ওকে ছুয়ে যেতে পারলো না। হঠাৎই কোনো কিছু মনে আসতেই চমকে উঠলো চারু। শিহাব বলেছিলো শাওন চল্লিশটা ঘুমের ঔষধ খেয়েছে আর নাজিমুদ্দিন বলেছিলো, তারা পরিকল্পনা করে শাওনকে পাগল বানিয়ে দিয়েছে। কথায় মিলছে না। এদের মধ্যে কে মিথ্যা বলছে? নাজিমুদ্দিনের মিথ্যা বলার সুযোগ ছিলোনা। ওই অবস্থায় কেউ মিথ্যা বলেনা। নাজিমুদ্দিন মা*রা যাওয়ার আগে বলেছিলো,
– আমি জানি আমি ম’ই’রা যামু। মর*নের আগে মানুষ মিথ্যা কথা কয় না।
নাজিমুদ্দিনের কথা যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত তবে মিথ্যা কে বললো? শিহাব! কিন্তু মিথ্যা বলে শিহাবের কি লাভ?
★
বিকেল বেলা চারু তৈরি হয়ে নিলো। লাল জামদানি শাড়ি, কানের দুল, দু’হাতে কাচের কুচি, ঠোঁটে হালকা লাল রঙা লিপষ্টিক আর বেলি ফুলের গাছ থেকে কিছু বেলি ফুল ছিড়ে নিয়ে নিজের খোলা চুলে সেগুলো ক্লিপ দিয়ে আটকে ফেললো। সাধারণ সাজেও অসাধারণ লাগছে কিন্তু এই সাজ কেমন ফিকে, বিবর্ণ মনে হচ্ছে চারুর কাছে। লাগবেই তো! যার জীবনের রঙই বিবর্ণ, দুনিয়ার কোনো রঙই তার রঙ মনে হয়না। মনে হয় যেনো সবই বিবর্ণ। এই অনূভুতিহীন চারুর তৈরি হওয়ার পেছনে কার অবদান সবচেয়ে বেশি? নাজিমুদ্দিন? নাহ! নাজিমুদ্দিন তো শুধু খেলার এক গুটি ছিলো, আসল কারণ ছিলো বস নামক ব্যক্তিটি। কিন্তু নাজিমুদ্দিন যদি চাইতো চারুর জীবনটা এভাবে ভেসে যেতো না৷ ও একটা সুন্দর জীবন পেতে পারতো। বাবা মায়ের ভালোবাসা পূর্ণ জীবন পেতে পারতো। চারু কী ভীষণ বোকা, এতদিন মনে করে এসেছে তার মা শ্যামলা তাই নাজিমুদ্দিন তাকে পছন্দ করতো না অথচ শয়’তান টা সেদিন এক নিমিষেই সকল ভ্রান্তি দূর করে দিলো।
★
চারু নীচে নেমে এলো। সজিদ যেমন ছোটখাটো পার্টির কথা বলেছিলো তেমন ছোট নয়। মোটামুটি বড় করেই মেয়ের জন্মদিন পালন করছে সে। চারু নেমে সাজিদ কিংবা নাজমা বেগম কাউকেই দেখতে পেলো না। গল্পের আসল লেখিকা শুভ্রা আহমেদ প্রিয়া। পুতুল বা সেই কাজের মেয়েটিও নেই। চারিদিকে অপরিচিত মানুষদের আনাগোনা। চারু চুপচাপ একটি কোনায় গিয়ে সোফায় বসে রইলো। এমন জন্মদিনের পার্টি সে আগে কখনোই দেখেনি। পরিবেশও তেমন বুঝতে পারছেনা তার ওপর সবাই প্রায় অপরিচিত। একজন ওয়েটারের কাছ থেকে এক গ্লাস জুস নিয়ে বসে রইলো সে৷ চোখ বারবার এদিক সেদিক পরিচিত কাউকে খুজে চলেছে। হঠাৎই একটা তিন-চার বছর বয়সী বাচ্চা একটা ছেলে চারুর দিকে এগিয়ে গেলো। বাচ্চাটার চোখেমুখে কৌতুহল। চারু বাচ্চাটাকে দেখে একটু হাসার চেষ্টা করলো। বাচ্চাদের সম্পর্কে তেমন অভিজ্ঞতা নেই ওর। পরিবারে ওই সবার ছোট। বাচ্চাটি ধীরে ধীরে চারুর পাশের সোফায় এসে বসলো।
– তোমার নাম কি বাবু?
চারু মুচকি হেসে বাচ্চাটার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো। আপাতত কথা বলার জন্য আর কিছু পাচ্ছিলো না সে। চারুকে অবাক করে দিয়ে বাচ্চাটা বলে উঠলো,
– আমাকে বাচ্চা বলবেন না আন্তি। আমি বড় হয়ে গেচি।
চারু অবাক হয়ে বাচ্চাটার কথা শুনলো। চেহারায় এবং কণ্ঠস্বরে হালকা গম্ভীরতা প্রকাশ পেয়েছে।
– আচ্ছা ঠিক আছে বলবো না। তোমার নাম কি?
– আমার নাম সাদাফ। তোমার নাম কি?
– চারুলতা। তোমার নামটা খুবই সুন্দর।
– তোমার নামটাও সুন্দর। আমাকে একটা ফুল দিবে আন্তি?
এতক্ষণে চারু বুঝতে পারলো বাচ্চাটার এখানে আসার কারণ। চারু মুচকি হেসে চুল থেকে একটা ফুল খুলতে শুরু করলো।
★
পুতুলের জন্মদিন নিয়ে অনেক বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছে সাজিদ। একমাত্র মেয়ের জন্মদিন বলে কথা৷ কোনো কম থাকা চলবেনা। সাজিদ আয়নার নিজেকে খেয়াল করলো, তার বয়স এখন ৩২। কম বয়সে বিয়ে করায় এত তাড়াতাড়ি বাচ্চার বাবা হয়ে গেছে। তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল সায়মাকে বিয়ে করা। সায়মা সম্পর্কে ছিলো সাজিদের ফুপাতো বোন। তবে সাজিদের সাথে তার পরিচয় ছিলোনা বললেই চলে। দুজন ছিলো দুই মেরুর মানুষ। বছরে দুই একবার দেখা হওয়া দুই মেরুর এই দুই মানুষকে প্রথম এক করার কথা ভাবলেন সাজিদের বাবা। কিন্তু সেটাকে সম্পূর্ণ করার আগেই তিনি ইন্তে*কাল করেন। তার অপূর্ণ ইচ্ছা পূরণ করতেই সাজিদের সাথে সায়মার বিয়ে হয়। সাজিদ অস্বীকার করতে চায়না, সায়মাও সংসারে যথেষ্ট মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। চেষ্টা করছে সাজিদও, কিন্তু তারপরেও পারেনি। দুজনের কর্মব্যস্ততা তাদের এক হতে দিতো না। তাও সম্ভবত দুজনের সংসারটা ভাঙতো না যদি না সায়মার আগের প্রেমিক থাকতো। পুতুলের জন্মের পরই সায়মা সাজিদকে ডিভোর্স দিয়ে দেয়। সাজিদও দ্বিমত করেনি। ফলাফল মিউচুয়াল ডিভোর্স। সংসয় ছিলো পুতুলকে নিয়ে। পুতুলের বয়স তখন সবেমাত্র দুই। কোর্ট পুতুলকে সায়মার সাথে থাকার নির্দেশ দিলে সায়মা জানায়, যেখানে সাজিদের সাথে তার আর কোনো সম্পর্ক নেই সেখানে সাজিদের মেয়েকে দিয়ে ও কি করবে? উপস্থিত সবাই অবাক হয়েছিলো তার কথায়। একজন মা কিভাবে এমন কথা বলতে পারে? সাজিদ নিজের কাছে এনে রাখে পুতুলকে। আর সায়মা তার সেই প্রাক্তন প্রেমিককে বিয়ে করে নেয়। সম্প্রতি, সাজিদের মা নাজমা বেগম চাইছেন সাজিদকে আবার বিয়ে করাতে কিন্তু পুতুলের কথা ভেবে সাজিদ সেটা চাইছেনা। মেয়েটা সৎ মায়ের হাতে বড় হবে কোনোভাবেই সে সেটা চায়না। তারপরও নাজমা বেগমের জোড়াজুড়িতে সাজিদ রাজি হয়েছে কিন্তু সাজিদ তার সকল সম্পদ পুতুলের নামে করে দিয়েছে। পুতুলের আঠারো বছর হওয়ার সাথে সাথে সকল সম্পদ ওর নামে হয়ে যাবে। কোনোভাবে সায়মা এই খবর পেয়ে এখন সম্পত্তির লোভে পুতুলকে নিজের কাছে নিতে চাইছে। সায়মা যে এতটা জঘ*ন্য হতে পারে তা কখনো কল্পনাও করেনি সাজিদ। তবে যাই হোক, সাজিদ আইনের লোক। আইন টপকে সায়মা কখনোই পুতুলকে নিতে পারবেনা। আর এখন তো আরো আগে না।
সাজিদ আরো একবার আয়নায় তাকালো। নাহ! খারাপ লাগছেনা দেখতে। লম্বা মুখমন্ডলে সানগ্লাস ভালো মানায় তবে এই রাতের বেলা সানগ্লাস পড়ে নিজেকে ভূত প্রমান করার কোনো ইচ্ছে হলো না সাজিদের। অতিরিক্ত ব্যস্ততায় ফর্সা মুখে ক্লান্তি ফুটে উঠলো কিন্তু তারপরও মেয়ের আনন্দের কথা ভাবতেই বুক ভরে উঠছে তার। ওর মেয়েটার মুখে যে খুব মায়া। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়েই সারাজীবন পার করে দেওয়া যায়। সাজিদ নিচে নেমে আসতেই চোখ পড়লো চারুর দিকে। মোহনীয় সাজ! আসলেই সাজলে মেয়েটাকে অসম্ভব সুন্দর লাগে। এমনি এমনি শিহাব আর শাওন চারুলতাতে আটকে যায়নি। তবে এই সৌন্দর্য যে কত বড় অভিসাপ তা আন্দাজ করতে পারছে সে। চারু মাথায় বেলি ফুল লাগিয়েছে। বেলি ফুল খুলে বাচ্চাটাকে দেওয়ার দৃশ্যে চোখ আটকে গেলো সাজিদের। চারু হাসছে! আজ অবধি চারুকে এত কোমলভাবে হাসতে দেখেনি সাজিদ। তার হাসিতে লুকিয়ে ছিলো হিং*স্রতা! কিন্তু এই কোমনীয় হাসিতে যে চারুকে এতটা মোহনীয় লাগতে পারে তা সাজিদ ভাবতেও পারেনি। সাজিদ খুব সাবধানে চোখ সরিয়ে নিলো, নাহ! এই মেয়ের দিকে তাকানো যাবেনা। তাকালেই সর্বনাশ!
কিছুক্ষণ মাঝেই পুতুলকে বের করে আনা হলো। পুতুলের পরনে একটি গোলাপি ছড়ানো গাউন। মাথায় তাজ, হাতে, গলায় বিভিন্ন গয়না। মেয়েটাকে আসলেই রাজকন্যা সিন্ডারেলার মতো লাগছে। চুলগুলো রুপানজেলের মতো সুন্দর। সাজিদই তাকে ঘর থেকে নিয়ে এসেছে। মেয়েটার চোখেমুখে খুশি উপচে পড়ছে। পুতুল চারুর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি একটা হাসি দিলো। প্রত্যুত্তরে চারুও হাসলো। মেয়েটাকে আসলেই সুন্দর লাগে। পুতুল চারুর কাছে আসতে চাইলে তাকে আটকে দিলো সাজিদ। মেয়েকে নিয়ে কোনো ঝুঁকি সে নিতে চায়না।
চারু ঘরের এক কোনায় বসে ছিলো। তার পাশে এসে বসলেন নাজমা বেগম। চারু তাকে দেখে ভদ্রতাসূচক একটু হাসলো।
– কেমন আছো মা?
– আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি কেমন আছেন?
– এইতো আছি। কয়দিন আর থাকবো বলো? ছেলে আর নাতনীটা-কে নিয়ে চিন্তা করতে করতেই অর্ধেক অসুস্থতা তৈরি হয়ে যায় আমার। আমার কথা বাদ দাও। তোমার কথা বলো। ছেলেটার জন্য তোমার সাথে ঠিকমতো পরিচিত হওয়াও গেলো না।
চারু চুপ করে রইলো। ও বুঝতে পারছেনা ওর কি বলা উচিত কিংবা সাজিদই বা ওর মা-কে কি বলেছে। চারুকে অবশ্য খুব একটা চিন্তা করতে হলোনা। নাজমা বেগম আবার নিজেই বললো,
– শাড়িটায় তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে মা। সাজিদের বাবা মারা যাওয়ার আগের দিন আমার জন্য নিয়ে এসেছিলো এই শাড়িটি। বলেছিলো তাকে যেনো পড়িয়ে দেখাই। তার মৃ*ত্যুর পর আর এই শাড়িটা পড়িনি। কে দেখবে বলো?
– উনি কিভাবে মা*রা গেলেন?
– হার্ট অ্যাটাক। হঠাৎ করেই সব হয়ে গেলো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই। শুনলাম তোমার বাবা মাও নাকি ইন্তেকাল করেছেন। তাদের খু*ন হয়েছে আর তারপর সেই দুষ্কৃতকারীরা নাকি এখন তোমাকে টার্গেট করেছে। তাই তোমাকে বাঁচানোর জন্য সাজিদের কাছে রাখতে বলা হয়েছে।
চারু কোনোমতে মাথা ঝাকালো। সাজিদের পরিকল্পনা কিছুই জানেনা চারু তাই নাজমা বেগমের হ্যাঁ তে হ্যাঁ মেলানোই শ্রেয় বলে মনে হলো।
– তোমার বাবা-মা নেই৷ ভেবেছিলাম তোমাকে সঙ্গ দেই। নিজেদের কাছে রাখি তাহলে তুমি কষ্ট ভুলে থাকবে। কিন্তু সাজিদকে দেখো, বারবার বলে দিয়েছে এইসব থানার কেইস। এইসবে যেনো না ঢুকি। তোমার ক্ষতি হতে পারে। এখন তুমি হলে আমাদের বাড়ির আমানত। তোমার ক্ষতি তো মা হতে দিতে পারিনা। গল্পের আসল লেখিকা শুভ্রা আহমেদ প্রিয়া।
চারু বুঝতে পারলো ভদ্রমহিলা খুব আন্তরিক। কেনো যেনো হঠাৎই মনোরমার কথা মনে পড়ে গেলো। মনোরমা ভীতু ছিলেন, সমাজের মানুষকে ভয় করতেন তাও ওদের দুই ভাই-বোনকে খুব ভালোবাসতেন। প্রতিটি মা-ই সন্তানকে জীবন দিয়ে ভালোবাসে। বাবারা কেনো বাসেনা? কে বলেছে বাসে না? সাজিদ তো খুবই ভালোবাসে পুতুলকে৷ সাজিদ যতটা তার মেয়েকে ভালোবাসে, নাজিমুদ্দিনের কাছে কখনো চারু এতটা ভালোবাসা পাওয়া তো দূর কল্পনাও করতে পারতো না। চাতক পাখির মতো একটু বাবার ভালোবাসা খুজে বেড়াতো।
চারুর সাথে কথা বলতে দেখে সাজিদ তড়িঘড়ি করে নাজমা বেগমকে ডেকে নিয়ে গেলো। চারু আবার একা হয়ে গেলো। কিছুক্ষণের মাঝেই কেক কা*টার পর্ব শেষ হলো। পুতুল সবাইকে কেক খাওয়ানো শেষ করে চারুর দিকে এগিয়ে এলো। মিষ্টি হেসে চারুকে কেক খায়িয়ে দিলো। পুতুলের হাত থেকে কেক নিয়ে চারুও ওকে খায়িয়ে দিলো।
– আন্টি তুমি কি পারফিউম ব্যাবহার করো? কত সুন্দর গন্ধ তোমার পারফিউমের।
– পারফিউম না মা। ছাদের উপর থাকা বেলি ফুলের গন্ধ এইটা।
– বেলি ফুল? আমাকে দেবে বেলি ফুল?
– দেবো না কেনো? এইসব ফুল তো তোমারই। তুমি তোমার পাপার সাথে গিয়ে যত ফুল খুশি নিয়ে নেবে।
– পাপা তো আমাকে নেয় না ছাদে। তুমি নেবে?
– তোমার পাপা বকবে মা। তুমি তোমার পাপার সাথে এসে যতগুলো ইচ্ছে ফুল নিও।
পুতুল কিছুটা মন খারাপ করে সেখান দেখে চলে গেলো। চারু সব বুঝেও কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না। মাথায় প্রতিক্রিয়া করার বাটন টা বোধহয় খারাপ হয়ে গেছে। সবকিছু স্বাভাবিক মনে হয়। এখন আর কান্না পায়না, হাসি আসে না, রাগ ওঠেনা, কষ্ট হয়না। কি অদ্ভুত জীবন!
চারু ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে বাগানের উদ্দেশ্য। সেখানে তেমন ভালো লাগছেনা। সকলেই অপরিচিত। বাগানের এক অংশে গিয়ে দেখলো পুতুলকে। সাথেই একটা লোক পুতুলকে চকলেটের প্রলোভন দেখাচ্ছে৷ পুতুল ঠিক বুঝে উঠতে পারছেনা ওর কি করা উচিত। চারু সেদিকে এগিয়ে গেলো। চারুকে দেখেই ভড়কে গেলো লোকটা। চারু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লোকটার দিকে তাকালো। চারুকে এভাবে তাকাতে দেখে লোকটা আবারও ঘাবড়ে গেলো। শার্টের হাতা দিয়ে ঘাম মুছে একটু হাসার চেষ্টা করলো। চারু কঠিন মুখভঙ্গি নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো পুতুলের পাশে।
– কে আপনি?
চারুর এই সামান্য প্রশ্নে চমকে উঠলো লোকটি, অথচ চারু চমকে যাওয়ার মতো কিছু বলেনি। চারুর সন্দেহ আরো গভীর হলো।
– আমি পুতুলের মামা। আমি আমার ভাগনির সাথে দেখা করতে এসেছি। আপনি কে?
– আপনি পুতুলের মামা তার কি প্রমান আছে? মা তুমি এই লোকটাকে চেনো?
পুতুল কিছুই বললো না। লোকটা একটু আত্মবিশ্বাস নিয়ে পুতুলকে কোলে তুলতে নিলেই চারু তার হাত ধরে আটকে ফেলে।
– আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছি আমি।
– আপনি কে যে আমি আপনাকে উত্তর দেবো?
– আমি কে সেটা আপনার জানার প্রয়োজন নেই তবে আপনি যে ভালো কেউ নন সেটা আমি বেশ ভালোই বুঝতে পেরেছি।
– বাজে কথা না বলে সরে যান৷ আপনার সাথে আমার কোনো শত্রুতা নেই। শুধু শুধু নিজের বিপদ টেনে আনবেন না।
লোকটার কথা শুনে উচ্চস্বরে হেসে উঠলো চারু। ভয়ংকর হাসি! চারুর হাসির শব্দে লোকটার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেলো। শুকনো একটা ঢোক গিলে গলায় জোর আনার চেষ্টা করে বললো,
– দেখুন আপনি ভালো করছেন না। পুতুল আমার ভাগ্নী। ওকে আমার কাছে আসতে দিন।
– সম্পত্তির লোভে বুঝি ভাগনীকে এতদিন পরে মনে পড়লো?
চারু আন্দাজে কথাটা বললেও লোকটার চোখেমুখে ভীতি প্রদর্শিত হলো। এমন সময়েই সাজিদকে ছুটে বাড়ির বাইরে আসতে দেখা গেলো। সম্ভবত পুতুলকে খুজতেই এসেছে। লোকটাকে দেখেই সাজিদ স্তব্ধ হয়ে গেলো কিছু মূহুর্তের জন্য। পরক্ষণেই আবার চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলো,
– এইখানে কেনো এসেছিস তুই? কি চাস আমার মেয়ের কাছে?
সাজিদের চিৎকারে ভড়কে গেলো লোকটা তবে চারু নির্ভয়ে উত্তর দিলো,
– এই লোকটিকে পুতুলকে চকলেটের প্রলোভন দেখিয়ে নিজের কাছে নিতে চাইছিলো।
আগুনে ঘি ঢালার জন্য এই কথাটুকুই যথেষ্ট ছিলো।
বিঃদ্রঃ রেসপন্স হঠাৎ উধাও হয়ে গেলো কেনো? রেসপন্স উধাও হয়ে গেলে কিন্তু গল্পও উধাও হয়ে যাবে। প্লিজ রেসপন্স করুন।
#শুভ্রা_আহমেদ_প্রিয়া (স্নেহা)
(কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ)
To Be Continued….
#আমি_সেই_চারুলতা
#Shuvra_Priya (স্নেহা)
#পর্বঃ২৮
_______________________
– রেডি হয়ে নিন চারুলতা। আপনাকে একটা জায়গায় নিয়ে যাবো।
সাজিদ ভেবেছিলো চারু জিজ্ঞেস করবে কোথায় যেতে হবে তবে সাজিদকে ভুল প্রমান করে দিয়ে চারু এ সম্পর্কে কিছুই জিজ্ঞেস করলো না। মেয়েটাকে আজও ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না সাজিদ। সে চারুলতাকে একটা বোরকা দিলো যেনো চারুকে কেউ চিনতে না পারে। চারু কিছু না বলেই সেটা নিয়ে নিলো।
– গাড়ি বের করছি আমি, আপনি তৈরি হয়ে আসুন।
চারু সাজিদের কথার কোনো প্রত্যুত্তর করলো না। চুপচাপ বোরকা পরিধান করে নীচে নেমে গেলো যেখানে সাজিদ তার জন্য অপেক্ষায় আছে। চারু নিচে নেমেই গাড়িতে গিয়ে বসে পড়লো।
– আপনার কৌতুহল হচ্ছেনা আমরা কোথায় যাচ্ছি?
– অনুভূতিরা এখন মৃ*ত। তাই এইসব ছোট খাটো বিষয়ে আর কৌতুহল জাগেনা।
– বাহ! মাত্র উনিশ বছর বয়সেই অনুভূতিহীন হয়ে গেলেন। এইটা তো অনুভূতি জন্মানোর বয়স।
– আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতো হলে সম্ভবত, এই সময়টাতে অনুভূতি জাগতো।
– পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতো বাঁচতে চান?
– আমি চাইলেও আমার জীবন আর কখনো স্বাভাবিক হয়ে যাবেনা। আমার ভয়ানক অতীত বারবার সামনে চলে আসবে। তাছাড়া বেঁচে থাকার অনুভূতিটাও এখন আর তীব্র নয়। সবকিছুই খাপছাড়া মনে হয়।
– এতটা শক্ত হবেন না চারুলতা। জীবন এখনো শেষ হয়ে যায়নি।
– খুব শীঘ্রই হবে। পাঁচটা খু*ন করে জেল পালিয়ে যদি আরো একটা খু*ন করি তাহলে তো অচিরেই আমার ফা*সি অনিবার্য।
– আপনার কথাবার্তার ধরন খুব গম্ভীর। বয়সের তুলনায় অধিক ম্যাচুরিটি আপনার মাঝে।
– বয়স দিয়ে সবসময় সবকিছু হিসেব করা যায়না মি. এস.আই।
– হুম, তার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ আপনি।
চারু কিছু না বলে রহস্যময়ী একটা হাসি দিলো। কে জানে কতটা রহস্য এই মানবীকে ঘিরে আছে। সেই রহস্যের চাদর কবে ভেদ হবে।
– আপনার কলিগরা কাল পার্টিতে এলো না?
– জেলে যেতে ইচ্ছে হয়েছে নাকি তাদের খোজ করছেন।
– আপনার জুনিয়রকে আমার বিরিয়ানি রান্না করে খাওয়ানোর ছিলো।
– আপনি হিমেলের পেছনে কেনো পড়েছেন বলুন তো? বেচারা খুবই ইনোসেন্ট।
– আজকাল সরলতার ভাত নেই। যে সয় তাকে আরো অনেক কিছু সহ্য করতে হয়। সে এখনো যোগ্য পুলিশ অফিসার হয়ে উঠতে পারেনি।
– সে যোগ্য নাকি অযোগ্য সেটা ঠিক করার যোগ্যতা এখনো আপনার হয়ে ওঠেনি চারুলতা। নিজের সীমায় থাকুন।
{গল্পের আসল লেখিকা শুভ্রা আহমেদ প্রিয়া}
– আমার সীমা আমি অনেক আগেই অতিক্রম করে ফেলেছি। এখন কারোর সাধ্য নেই আমাকে আবার সেই সীমারেখার গন্ডিতে আবদ্ধ করার।
– এতটা বেপরোয়া হবেন না চারুলতা। সামনে সারাজীবন পড়ে আছে।
– আমার জীবন তো শুধুমাত্র আর কয়েকটা দিন। তারপর আমার ফা*সি হবে আমি নিশ্চিত কিন্তু তার আগে আমি তাকে হ*ত্যা করে যেতে চাই। আরো হাজারো চারুলতার জীবন রক্ষা করতে চাই। আমার প্রতিশোধের আগুনে তাকে জ্বালাতে চাই।
সাজিদ চারুকে নিয়ে গেলো তার কলেজে। চারু কলেজ দেখেও কোনো বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখালো না। খুবই স্বাভাবিক ভাবে বললো,
– এখানে কেনো এসেছি আমরা?
– সামনেই আপনার পরীক্ষা। পড়াশোনা শুরু করে দেওয়া উচিত আপনার।
– কি হবে পড়াশোনা করে? আমি তো এমনিতেই ম*রে যাবো।
– আপনার কাছে আমি এমন উত্তর আশা করিনি চারুলতা। আপনাকে আমি খুবই প্রানবন্ত মনে করেছিলাম। আমি ভাবতাম আপনি শেখার জন্য পড়া শোনা করেন। জীবনের শেষ কয়েকটা দিন যদি শিক্ষা অর্জন করে কাটানো যায় তাহলে ক্ষতি কি?
চারু উত্তর দেয়না। নিজেকে কেমন যেনো শক্ত কোনো এক আবরনীতে ঢেকে ফেলেছে সে।
– আপনার জীবনের উদ্দেশ্য কি চারুলতা?
– আমার মৃ*ত্যুর আগে ওই পিশাচটাকে খু*ন করা।
– তেমন উদ্দেশ্য নয়। আমি বলতে চাইছি অনেকেরই তো ইচ্ছে থাকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, টিচার ইত্যাদি হওয়ার।
– আগে ইচ্ছে ছিলো ডক্টর হবো। এখন আর সে স্বপ্ন দেখি না। বাঁচবোই কয়দিন? অবশ্য স্বপ্ন দেখতে ক্ষতি কি? স্বপ্ন তো সবাই দেখে। তবে আমার চোখেই এখন আর কোনো স্বপ্ন আসেনা। স্বপ্নও আমাকে ফাকি দিয়ে আমার সাথে লুকোচুরি খেলে। ঘুমালেও স্বপ্ন আসেনা জেগে থাকলেও আসেনা।
– আপনার কথাবার্তায় আপনাকে বেশ ডিপ্রেসড মনে হয় চারুলতা।
– আমি মানুষটাই এমন হয়ে গেছি বুঝলেন! কেনো যেনো আর অনুভূতি কাজ করেনা।
– শিহাবের প্রতিও না?
– অনুভূতিরা প্রায় ঝিমিয়ে এসেছে। তবে তার প্রতি অনুভূতি না আনতে চাইলেও আমি অনুভূতি চাই। প্রতিহিং*সা ছাড়াও অন্যান্য অনুভূতি আমার প্রয়োজন। মৃ*ত্যুর আগে কিছু মানুষকে আমি ভালোবাসতে চাই। আমার ভাইকে ভালোবাসতে চাই। লতাকে ভালোবাসতে চাই। শাওন ভাইকে একটু ভালোবাসতে চাই। এই মানুষটা সারাজীবন শুধু আমাকে দিয়েই গেলো। তারও কিছু প্রাপ্য। শিহাবের প্রতি অনুভূতিহীন হতে চাই।
– হামিদকেও ভালোবাসেন না?
– খুব চেষ্টা করি৷ ভালোবাসাটা আসেনা।
– শিহাবকে ছেড়ে শাওনকে কেনো ভালোবাসতে চান? শাওন তো আর নেই। শিহাবের সাথে ভালোবাসা পরিনতি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও শাওনের সাথে তো সেই সম্ভাবনা শূন্য।
– এই জীবনে কাউকে জড়াতে চাইনা তাই শাওন ভাই-ই সর্বসেরা। সে মৃত্যুর আগেও আমার কাছে শুধু একটু ভালোবাসা চেয়েছে কিন্তু আমি এতটাই অনুভূতিহীন হয়ে গেছি যে আমি চেয়েও তাকে ভালোবাসতে পারিনি।
– তাকে ভালোবাসার ইচ্ছে ছেড়ে দিন। শিহাবকে ভালোবাসুন। আমি নাহয় আপনাকে আইনের হাতে তুলে দেবো না। সুন্দর মতো বেঁচে থাকবেন। আপনার সুখে থাকার অধিকার আছে চারুলতা।
– আমি মানুষটাই কষ্টের সাগরের মতো। আমাতে বিলিন হতে চাইলে যে সব সুখের আশা ত্যাগ করে দুঃখের সাগরে বিলিন হতে হবে।
– শিহাব তো পেয়েই আসছে এত বছর যাবত সেই কষ্ট। বিলিন হয়েছে আপনাতে।
– আমাতে বিলিন হলেই বিলিন হওয়া যায়না। কষ্টের সমুদ্রে জাহাজ ভিড়ানো এত সহজ নয়। দক্ষ নাবিক হতে হয়।
★★★
মাত্র চৌত্রিশ বছর বয়সে এত বড় একটা ব্যাবসা নিজ হাতে সামলানো ছেলেটির মতো শক্ত একজন ছেলের প্রতিরাতে বালিশ ভেজে অশ্রুজলে। প্রতিনিয়ত অপেক্ষা করে যায় তার স্বর্ণলতার জন্য। এই বুঝি একবার এলো, তাকে জড়িয়ে ধরলো। অনেক বেশি ভালোবাসা নিয়ে তার মনের সর্বস্ব দখল দিয়ে দিলো তাকে। কিন্তু এমন হয়না। স্বর্ণলতা আসেও না, তাকে ভালোও বাসেনা। চাতক পাখির মতো খুজে বেড়ায় একটু ভালোবাসা কিন্তু তার ভালোবাসার ঝুড়ি সে সম্পূর্ণই অন্য কারোর নামে করে দিয়েছে। ভালোবাসার ঝুড়ি শিহাবের নামে নেই এর চেয়েও বেশি কষ্ট হয় যখন শিহাবের মনে হয় সেই ঝুড়িটা অন্যকারোর নামে। সেই ভালোবাসার ঝুড়িটা কি একমাত্র শিহাবের হতে পারতো না? উত্তর মেলে না। নিস্তব্ধ রাত ছাপিয়ে নতুন ভোরের উদয় হয় কিন্তু শিহাবের অপেক্ষার প্রহর কাটেনা। তার জীবনে ভোর হয়না। তার স্বর্ণলতা ফিরে আসেনা। কি বিষণ্ণ লাগে সবকিছু! বাড়ির সাথে সকল সম্পর্ক অনেক আগেই শেষ করেছে কিন্তু আজও সব শেষ হয়নি। বাড়ির প্রতিটি মানুষ এখনো ভালোবেসে অপেক্ষা করে যায় তার জন্য। এতগুলো মানুষের ভালোবাসা পায়ে ঠেলা সম্ভব হয়না শিহাবের পক্ষে তাই আজ প্রায় দুই বছর পর বাড়ি ফিরে এসেছে শিহাব তবে বাড়িতে এসেই দরজায় খিল দিয়েছে। কারোর সাথেই কথা বলতে আর ভালো লাগছেনা। অনেক দিন পর শিহাব এগিয়ে গেলো সেই ড্রয়ারের সামনে। মাঝে পেরিয়ে গেছে চারটা বছর কিন্তু এই ড্রয়ারটা খোলা হয়নি। তালা খুলতে কিছুটা ঝামেলা হলো। চার বছর যাবত অকেজো হয়ে আছে এটি। তবে তালা খুলতেই বেড়িয়ে এলো চার বছর আগের কিশোরী চারুর সেই চিত্র যা নিজের হাতে অঙ্কন করেছিলো শিহাব। কচি কিশলয়ের মতো মুখখানি কি কোমল! এই ছবিটা শিহাব তখন একেছিলো যখন চারুর বয়স পনেরো। লজ্জাজনক ঘটনা তখন ঘটেছিলো যখন চারুর সামনে ধরা পড়ে গেলো। শিহাব যে কেমন অস্বস্তির মাঝে পড়েছিলো সেটা শুধু সে নিজেই জানে। খুব কষ্টে নিজেকে তখন শক্ত রেখেছিলো। যে চিত্রকর্মটি শিহাব চারুকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে সেটা দেখে অবাক নেত্রে চারু তাকিয়েছিলো শিহাবের দিকে। শিহাবের ইচ্ছে হচ্ছিলো,, কি যে ইচ্ছে হচ্ছিলো তা শিহাব নিজেও ধরতে পারেনি। কতদিন পর এই পুরোনো স্মৃতিরা আবার মাথায় এসে হানা দিলো। চারুর সাথে কাটানো এক মূহুর্তও শিহাব ভুলে যেতে পারেনা। কাঙ্ক্ষিত জিনিস পেয়ে গেলে যত না আনন্দ হয়ে, না পেলে তারচেয়েও অনেক বেশি কষ্ট হয়। পাওয়ার আনন্দ কিছুদিনের হলেও না পাওয়ার বেদনাটা সারাজীবনের। শিহাব এখনো ভেবে পায়না সে বেঁচে আছে কিভাবে! স্বর্ণলতা বিহীন শিহাবের অস্তিত্ব না থাকুক। দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজে শিহাবের ভ্রুযুগোল কুঞ্চিত হলো,
– কে?
– ভাই আমি জাবিন। বড় চাচি তোমারে নিচে যাইতে কইসে।
– আমার ক্লান্ত লাগছে। মা কে গিয়ে বল আমি এখন নিচে আসতে পারবো না।
– আসো ভাত খাইয়া যাও। খাওনের জন্য ডাকছে। তুমি না খাইলে বড় চাচিও খাইবো না।
শিহাব জানে এখন কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। জমিদার গিন্নি বড্ড জেদি।
★★★
– আপনার কাছে আমি আরো একবার কৃতজ্ঞ চারুলতা।
– কেনো?
– কাল রাতে সাইফুল এসেছিলো পুতুলকে নিতে। সায়মার ভাই ছিলো সে। আপনি সঠিক সময়ে না পৌছালে সম্ভবত আমার মেয়েটাকে আমি আর পেতাম না।
– পুতুল কি তাকে চিনতো?
– কয়েকবার ছবি দেখেছিলো তবে জ্ঞান হওয়ার পর সরাসরি দেখা হয়নি।
– তাই সম্ভবত সে কনফিউশানে ছিলো।
– চারুলতা আপনি কিছু মনে করবেন না আমি পুতুলকে আপনার সাথে মিশতে দিচ্ছিনা বলে। আসলে মেয়েটাকে আমি খুবই ভালোবাসি। কোনো ঝুকি নিতে ইচ্ছে হয়না। আপনার অতীত তো আপনি জানেনই। সত্যিই বলতে খুবই চিন্তায় থাকি আমি।
– আপনার কি মনে হয় আমি আপনার মেয়েকে খেয়ে ফেলবো?
– মনে করাটা কি খুব ভুল হবে?
– সম্ভবত না।
– তবে কালকের পর অনেকাংশেই সেই ভয় আমার কেটে গেছে। আপনিই আমার মেয়েকে বাচিঁয়েছেন। আমি আবারও কৃতজ্ঞ আপনার কাছে।
– আপনি পুতুলকে খুব ভালোবাসেন তাই না?
– হুম। প্রতিটা বাবার কাছেই তার মেয়ে রাজকন্যা। একজন বাবা সবচেয়ে বেশি তার মেয়েদের ভালোবাসেন।
– আমি কেনো বাবার ভালোবাসা পেলাম না বলতে পারেন? পেলে হয়তো আমার জীবনটা এমন হতো না। সুন্দর একটা জীবন পেতাম আমি।
– সৃষ্টিকর্তা হয়তো আপনার জন্য আরো ভালো কিছু ভেবে রেখেছেন।
– আর ভালো কিছু চাইনা আমি। আমি শুধু তাকে খু*ন করতে চাই।
{গল্পের আসল লেখিকা শুভ্রা আহমেদ প্রিয়া}
চারপাশে প্রচন্ড বাতাস। ওভারব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে আছে সাজিদ আর চারু। ইতিমধ্যেই পরিবেশ ভারি হয়ে এসেছে। পরিবেশ স্বাভাবিক করার জন্যই সাজিদ বলে উঠলো,
– দেখুন তো জায়গাটা চিনতে পারছেন কি না?
– আমি আগে কখনো এখানে আসিনি।
– গেস করার চেষ্টা করুন।
– পারছিনা।
– আচ্ছা সহজ করে দিচ্ছি। বলুন তো ব্রিজের নিচ দিয়ে কোন নদী প্রবাহিত হচ্ছে।
– নদীর নাম সম্পর্কে আমার তেমন ধারণা নেই। কবির ভাষায় তেরোশত নদীর দেশ বাংলাদেশ। তার মধ্যে হাতে গোনা বারো তেরো টা নদীর নাম আমি বলতে পারবো।
– কবির ভাষায় ১৩০০ নদীর কথা উল্লেখ হলেও বর্তমান বাংলাদেশে কিন্তু প্রায় ৯০০+ নদী আছে। যাই হোক, আপনি যেই বারো তেরো টা নদীর নাম জানেন তাদের মধ্যে একটা নদী-ই এইটা।
– আপনি কিভাবে জানলেন এই নদী আমার বারো তেরো টা নদীর নামের লিষ্টে আছে?
– জানি। আপনার পাঠ্যবই অনেকবার নদীটির নাম এসেছে।
চারু একবার ব্রিজ থেকে নিচের দিকে তাকালো। খুব বেশি উঁচু না হলেও নিচু বলা যাবেনা ব্রিজটাকে। নদীর পানি মনে হচ্ছে খুবই কালো এবং বাতাসে দুর্গন্ধ ভেসে আসছে। চারুর মুখে বাকা তীর্যক হাসি ফুটে উঠলো,
– এইটা বুড়িগঙ্গা নদী।
– ঠিক ধরেছেন। বলেছিলাম না আপনার জানা নদীর নামেই এই নদীটা আছে।
– পাঠ্যবইয়ে নামটা দেখতে দেখতে অনেকবার বুড়িগঙ্গা নদীটি দেখতে ইচ্ছে হয়েছিলো। কতবার পড়েছি এই নামটি। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা বুড়িগঙ্গার তীরে অবস্থিত। বর্তমানে, বুড়িগঙ্গা নদী দুষিত হয়ে গেছে। ইত্যাদি ইত্যাদি।
– নৌকায় উঠবেন নাকি? (সাজিদ)
– না।
– কেনো? সাতার জানেন না? মেয়েরা তো শুনেছি নৌকায় চড়ে ভাব দেখানোর জন্য পাগল থাকে।
– আমার বেড়ে ওঠা গ্রামাঞ্চলে। নদী, খাল, বিল, পুকুর এইসব হরহামেশাই দেখে এসেছি। নৌকায় চড়ায়ও কম হয়নি। সাতারও কেটেছি প্রচুর। আর বাকি রইলো ভাব, ভাব জিনিসটা কি সেটাই আজ অবধি বুঝে উঠতে পারলাম না।
– বাদ দিন। বাসায় যাওয়া যাক।
– আরেকটু থাকি?
সাজিদ উত্তর দিলো না তবে নিজেও দাঁড়িয়ে থাকলো। এইটা মৌন সম্মতির লক্ষণ। চারু মুচকি হেসে তাকিয়ে রইলো নদীর দিকে। কতদিন পর নিজের ভিতরে গভীর আবেগ অনুভূত হচ্ছে। অনুভূতিটা মন্দ না। সাজিদ অবাক হয়ে প্রথম বারের মতো লক্ষ্য করলো আবেগ, অনুভূতিহীন চারুর গভীর আবেগ। চারুর অতীতের কথা ভেবে সাজিদের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। মেয়েটা এখনো সম্পূর্ণ অনুভূতিহীন হয়ে যায়নি। একটু ভালোবাসা দিয়েই আবার তাকে প্রানবন্ত করে তোলা সম্ভব। চারুলতার সাথে যা হয়েছে তার জন্য চারুলতা দায়ী ছিলো না তবে এর শাস্তি কেনো ওকে পেতে হবে? নাহ! এইটা অন্যায় হবে মেয়েটার সাথে। তার একটু সুখে থাকার, একটু ভালো থাকার অধিকার আছে।
_______________________
To Be Continued…
®শুভ্রা আহমেদ প্রিয়া