আরশি পর্ব-০৯

0
2640

#আরশি
#Part_09
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

— তোর কি আরশি আর অহনাকে নিজের কাছে রাখতে কোন সমস্যা হচ্ছে? বোঝা মনে হচ্ছে তাদের?

কথাটা শুনার সাথে সাথে ভাইয়া থমথম খেয়ে যান। বিষ্ময়ে চোখ দুটো গোলগাল হয়ে আসে। ভাবী চোরা চোখে একবার আমার দিকে তাকাচ্ছে তো আরেকবার মামার দিকে। এইদিকে মামার কথাটা শুনে আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ়। ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রই মামার দিকে। মামা এইসব কিছু তোয়াক্কা না করে দ্বিতীয় বারের মত ভাইয়ার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে মারলো,

— কি হলো বল? থম মেরে বসে আছিস কেন?

কথাটা শুনে ভাইয়া একটু নড়েচড়ে বসে। অতঃপর শান্ত গলায় বলেন,

— মোটেও না। তারা আমার জন্য বোঝা নয়। ওরা কেন বোঝা হতে যাবে?

— যদি তাই হয় তাহলে তুই থাকতে আরশি কেন আজ ইন্টারভিউ দিতে গেল? তা তুই কিভাবে ওকে যেতি দিলি? নিশ্চয়ই ও না জানিয়ে যাই নি। তাই না জানার কথাই উঠে না। তাহলে?

— জব করার সিদ্ধান্ত তো আর খারাপ নয়। ও যখন নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাচ্ছে তখন সেখানে বাঁধা সাজা তো আর আমায় সাজে না।

— পুরো কারণ কি শুধু এইটাই?

— নাইলে আরকি?

— তোর যে চলতে সমস্যা হচ্ছে এইটা কি তোর বাঁধা না দেওয়ার অন্যতম কারণ নয়? আরশি যদি জব করে তাহলে হয়তো তোর টানাপোড়েনের কিছুটা ব্যপ্তি ঘটবে এইটাও কি কারণ নয়?

ভাইয়া এইবার বিষ্ময়কর দৃষ্টিতে মামার দিকে তাকিয়ে থাকে। দুই ঠোঁটের মাঝে বেশ দূরত্ব বিদ্যমান। গোলগাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন মামার দিকে। ভাইয়া কিছু বলতে যাবে তার আগেই মামা বলে উঠেন,

— দেখ আমি তোকে ভুল বুঝছি না। তাই হাইপার হোস না। সাংসারিক জীবনে খরচ তুলনামূলক একটু বেশিই হয় তা কম-বেশি সকলের জানা। খরচের শেষ নেই। আর যদি সংসারে বাচ্চা থাকে তাহলে সেই খরচই হয় দ্বিগুণ। তোর যা বেতন তাতে তোদের ছোট সংসার খুব ভালো ভাবেই চলে যায় তা জানি। এখন আরশি আর অহনা আসায়য় একটু তো হিমসিম খেতে হবে এইটা স্বাভাবিক। হয়তো চলতে কষ্টও হবে। কিন্তু তাই বলে এইটা তুই প্রকাশ করতে পারবি না। না ভাব-ভাবে আর না আকার-ইঙ্গিতে। যদি কোনভাবে তারা কথাটি বুঝতে পেরে তাহলে অবশ্যই সে নিজেকে তোদের ঘারে বোঝা মনে করবে। ভুল বুঝবে আর দূরে সরে যেতে চাইবে। আর সেটা তোরাও বুঝতে পারবি না। তোরা মনে করবি বিষয়টা অন্য। এইসময় যদি তাদের ভালোর জন্য ভেবেই কিছু বলিস তখন তা তাদের নিকট বিষের মত পরিনত হবে। ধীরে ধীরে সেই সম্পর্কে ফাটল ধরবে আর অবিশ্বাস জন্ম নিবে।
যেমনটা হচ্ছে এখন। আরশি নিজেকে তোদের ঘাড়ে বোঝা মনে করছে। তাই তো জব খুঁজছে যাতে দূরে সরে যেতে পারে। হয়তো তোর কাছে ও বোঝা নয় কিন্তু তোর কথার ধরণ হয়তো কিছুটা অরকম মনে হয়েছে ওর।

কথাটা শুনে আমি মাথা নিচু করে ফেলি আর ভাইয়া আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়৷ তার হয়তো কথাটা বিশ্বাস করতে চাইছে না। ভাইয়া অস্ফুট স্বরে বলে উঠেন,

— আরশি মামা যা বলছে তা কি সত্যি?

আমি তখনও মাথা নিচু করে বসে রই। মামা তা দেখে বলে,

— দেখ এইখানে ওর দোষ নেই৷ আর না আছে তোদের৷ সবাই আমরা পরিস্থিতির স্বীকার। একবার ওর জায়গায় থেকে চিন্তা করে দেখ। কিসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে ও। বাহির দিয়ে ও নিজেকে যতই শক্ত দেখাক না কেন, ভিতর দিয়ে যে ও একদম ভেঙ্গে পড়েছে। ও এখন খুব সেন্সিটিভ। তার উপর গুরুজন বলে কেউও নেই যে ওকে সামলাবে। এখন ও যা বুঝবে তাই ওর জন্য সত্য। চরম সত্য! আর ওর এই সত্যকে মিথ্যায় পরিনত করারও কেউ নেই। তোদের সামন্য কোন ব্যবহার যে ওর মনে গাঢ় দাগ বসিয়ে দিয়ে যেতে পারে তা হয়তো তোরাও বুঝতেও পারবি না।
তোকে সেই প্রশ্ন করার উদ্দেশ্য ছিল উভয়কে নিজের দিক বুঝানো। হিংসা ও ঈর্ষা যেমন এক সম্পর্ককে ভস্ম করে দিতে পারে, ঠিক তেমনই সামান্য ভুল-বুঝাবুঝি সারাজীবনের জন্য মনের মাঝে দাগ কেটে যেতে পারে। তখন কেউ চাইলেও সেটা আর মন থেকে মুছতে পারে না।

সব শুনে আমার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি ঝড়তে থাকে। সত্যি তো ভাইয়াকে ভুল বুঝেছিলাম। সাথে ভাবীকেও। এখন নিজের কাছেই নিজেকে ছোট মনে হচ্ছে। ভাইয়া কিছু না বলে আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। আলতো হাতে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। আমি কিছু না বলে ভাইয়ার কোমর জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেই। ভাইয়া আমার মাথায় জড়িয়ে ধরে আলতো কন্ঠে বলে,

— এই পেত্নী কানছিস কেন? আমি কি কিছু বলেছি তোকে? কান্না থামা নাইলে ঠাডিয়ে দিব এক।

— সরি ভাইয়া!

— তাহলে আমিও সরি। তোর দিকে বেশি নজর না দেওয়ার জন্য। নজর দিলে হয়তো ঘটনাটা এই পর্যায়ে আসতো না।

আমি কিছু না বলে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকি। একসময় কান্না থেমে আসে৷ আমি ভাইয়ার কাছ থেকে সরে আসি। মাথা তুলে ভাবীর দিকে তাকাই। তার মুখ ছোট হয়ে আছে। কেমন উষ্কখুষ্ক তার চাহনি। হঠাৎ মনে হলো, “আমি কি তাহলে ভাবীর বেলায় ঠিক ছিলাম? তার কথার ভাজে লুকিয়ে থাকা ইঙ্গিতগুলো কি আমি ঠিকই ধরেছিলাম? ” ভাবীর সাথে আমার চোখাচোখি হতেই সে স্মিত হাসি দিয়ে সকলের উদ্দেশ্যে বলেন,

— চা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। আমি আবার গরম করে নিয়ে আসছি।

এই বলে তিনি কেটে পড়লেন। আর আমার মনের মধ্যে থাকা প্রশ্নগুলোর উত্তর একেক করে বেরিয়ে আসলো। কিন্তু সেগুলো আর প্রকাশ করলাম না৷ শুধু একবার ভাইয়ার দিকে তাকালাম। অতঃপর মনকে এই বলে সান্ত্বনা দিলাম যে, ” আপন মানুষ তো আপনই আছে। তাহলে বাহিরের মানুষ নিয়ে এত ভাবনা কিসের?” কিন্তু তাও মনের মধ্যে একটা দ্বিধা রয়েই যায়।

____________________________________________

আজ সাপ্তাহিক ছুটির দিন। তাই সকালে একই সাথে বসে সকলে নাস্তা করছি। আমি অহনাকে খায়িয়ে দিচ্ছি আর ভাবী আদ্রকে। ভাইয়া আর মামা যে যার মত খাচ্ছে। এরই মধ্যে মামা বলে উঠেন,

— আরশি শুন! বিকেল হওয়ার আগেই নিজের ব্যাগ প্যাক করে রাখিস তো।

কথাটি কান পর্যন্ত পৌঁছাতে আমার ভ্রু কুটি কুঞ্চিত হয়ে আসে। আমি কিছু বলতে যাব তার আগেই ভাইয়া বলে উঠেন,

— কেন মামা? ও কি কোথাও যাচ্ছে?

মামা সোজাসাপটা ভাবে উত্তর দেন,

— হ্যাঁ যাচ্ছে। ও আমার সাথে আমার বাসায় যাচ্ছে।

ভাইয়া বিস্ময়কর কন্ঠে বলে উঠেন,

— কিন্তু কেন? আমরা কি ওর ঠিক মত খেয়াল রাখছি না?

মামা ধমকের সুরে বলে উঠেন,

— তুই কথায় কথায় হাইপার হোস কেন বুঝি না। হয়েছিস একদম বাপের মত। পুরো কথা না শুনে আগেই ফুঁসফাঁস। পুরো কথা তো আগে শুন বেডা।

মামার ঝাড়ি খেয়ে ভাইয়া একটু সোজা হয়ে বসে। চারপাশে একটু চোখ বুলিয়ে দেখে অহনা আর আদ্র মিটিমিটি করে হাসছে। তা দেখে ভাইয়া একটু লজ্জাবোধই করলেন। এই বয়সে ঝাড়ি খাওয়াটা নিতান্তই লজ্জাজনক ব্যাপার তার কাছে। সাবলীল ভাষায় প্রেস্টিজে লাগে। অতঃপর মামা গলা ঝেড়ে বলেন,

— আমি আরশিকে নিজের কাছে রাখতে চাইছি। দেখছিসই তো দিন দিন বুড়ো হয়ে যাচ্ছি। দেখা শোনার মত কেউ নেই। তার উপর কাউরো সাথে যে কথা বলে সময় কাটাবো তেমন কেউ নেই। একাকিত্বে দিন কেটে যায়। তা আরশি যেহেতু এখন অবসর আছে সেহেতু ওকে নিয়ে যাই। ও আমার দেখা শোনাও করলো আর একটু আমায় সময়ও দিল।সাথে অহনা তো আছেই আমার সাথে সারাদিন গল্প করার জন্য। আমি আমার জন্য ওদের নিতে চাইছিলাম। আর তুই কি না কি ভাবকছিস। বেয়াদব একটা! এখন বল তোর কোন সমস্যা আছে নাকি?

— যদি এই কারণই হয়ে থাকে তাহলে আমার আর কিসের সমস্যা? নিয়ে যাও।

মামা একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে রসিকতার সুরে বলেন,

— অবশ্য ওকে নেওয়ার আরেকটা কারণও আছে। ঘরের রান্না খাওয়া হয় না সেই কবে থেকে। হোটেলে খেতে খেতে মুখের স্বাদই চলে গিয়েছে। তা আমাদের আরশি তো আবার সেরা রাঁধুনি। প্রতিদিন এর হাতের রান্না খাওয়ার লোভেই ওকে নিয়ে যাচ্ছি। কি রে আরশি প্রতিদিন মজার মজার খাবার রেঁধে আমায় খাওয়াবি না?

আমি স্মিত হেসে বলি,

— না খায়িয়ে উপায় আছে?

কথাটা শুনে ভাইয়া আর মামা বিনা শব্দে হেসে উঠে৷ আমি ভাবীর দিকে তাকাতেই দেখি তার চেহেরায় খুশির আভা ঝিলিক করছে। তা দেখে নিজেকে বুঝালাম, “নিজের সংসার সকলেই নিজের মত করে চায়। একান্তভাবে চায়। এইখানে অন্যকাউকে সর্বদা বোঝাই লাগে। এখম পরিস্থিতি পক্ষে হোক আর বিপক্ষে হোক। এইটা অতি স্বাভাবিক বিষয়। এই নিয়ে এত ঘাটাঘাটির করার কোন প্রয়োজন নেই।”

_________________________

সিএনজি চলছে আপন গতিতে। দমকা হাওয়া এসে বারি খাচ্ছে মুখে চোখে। অহনা আমার কোলে চুপটি করে শুয়ে আছে৷ বাতাসে তার চুলগুলো বার বার এলোমেলো হয়ে আসছে। আমি আলতো হাতে সেইগুলো সরিয়ে দিচ্ছি। আমি ওর মুখ পানে তাকিয়ে দেখি চোখের কোনে তার পানি চিকচিক করছে। আসার সময় আদ্র এর জন্য বেশ কেঁদেছে ও। আদ্রকে ছেড়ে নাকি সে যাবে না। এতদিনে বেশ ভাব জমে গিয়েছিল ওর সাথে তাই হয়তো এমন টান সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল। কত বুঝিয়ে যে এনেছি ওকে। অতঃপর সিএনজিতে বসার কয়েক মিনিট পড়েই সে আমার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে। আমার পাশেই মামা বসে আছে। অতি নীরব তার আকার-ভঙ্গি। দেখে মনে হচ্ছে তার মধ্যে যেন কোন ভাবান্তর নেই। আমি এইবার গলা ঝেড়ে জিজ্ঞেস করি,

— হুট করে নিয়ে এলে যে?

মামা আমার প্রশ্ন শুনে একবার আমার দিকে তাকায়। অতঃপর মুচকি হেসে বলে,

— “সম্পর্কে কখনো ‘অনিহা’ শব্দটা আসতে নেই। যখনই সম্পর্কে ‘অনিহা’ শব্দ এসে পড়ে তখনই সম্পর্কে জন্ম নেয় বিরক্ত শব্দটি। সেখান থেকে বিষয়টা গড়িয়ে চলে যায় দায়ভারে। আর তখন সেই সম্পর্কটা বোঝা ব্যতীত কিছুই মনে হয় না।”
তুই যদি সেখানে আর কিছু দিন থাকতি তাহলে কথাটা সত্য হতে বেশি প্রহর গুনতে হতো না তোকে।

সব শুনে আমি শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে মামার দিকে তাকিয়ে থাকি। নিজের অজান্তেই বেড়িয়ে আসে বুক ভরা দীর্ঘ নিশ্বাস।

#চলবে