আরশি পর্ব-১০

0
2644

#আরশি
#Part_10
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

মামার বাসায় এসেছি আজ দু’দিন হতে চললো। মামা তিন রুমের একটি ফ্ল্যাট নিয়ে থাকেন। তো তারই একরুমে আমার আর অহনার জায়গা হয়। অহনা প্রথম দিকে মন খারাপ করলেও পরে ঠিক হতে যায় আর মামার সাথে ভাবও জমিয়ে নেয়। মামাও প্রায় বেশির ভাগ ওর সাথেই এখন সময় কাটায়। এইখানে আসার পর মামা আমার আর অহনার জন্য কিছু নতুন জামা কিনে নিয়ে আসে। সাথে অহনার জন্য কিছু খেলনা আর চকলেট। সেসব দেখে অহনার খুশি আর দেখে কে? অহনার মুখে তখন হাসি দেখে নিজেও প্রশান্তির নিশ্বাস নেই। মামার দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকাই। কিন্তু মামা সেইসব আমলে নেয় না।
মামার পুরো নাম মেহেদী হাসান নীরব। পেশায় একজন ব্যবসায়ী। তার নিজস্ব একটি বুটিক হাউজ আছে। সেটা মোটামুটি ভালোই চলে। যে টাকা আসে তাতে ফ্ল্যাট ও অন্যান্য ভাড়া-টাড়া দিয়ে তার বেশ চলে যায়। একা মানুষের খরচ তো আর বেশি নয়। আগে নানু তার সাথে থাকতো। নানা তার যৌবন কালেই মারা গিয়েছিল। সেই থেকে নানুই তার সঙ্গী ছিল। কয়েকবছর হলো নানু মারা গিয়েছে এরপর থেকে মামা পুরাই একা। একাকিত্ব নিয়েই কাটছে তার জীবন।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চললো। আকাশ আজ ধূসর রঙে রাঙ্গা। আবছা আবছা লাগছে সব। মৃদু মৃদু বায়ু বইছে। বায়ুর সাথে তাল মিলিয়ে স্বল্প পরিমাণে দোল খাচ্ছে গাছে কচি পাতাগুলো। জানালার কার্নিশে এসে চুপটি করে বসে আছে এক জোড়া শালিক। বেশ অদ্ভুত যেন তাদের চাহনি। আমি বেশ মনোযোগ দিয়ে তাদের দেখছি। তাদের চাহনি পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করছি। হুট করে চারদিকে আসরের আজানের ধ্বনি প্রতিফলিত হতে শুরু। আজানের ধ্বনি শুনতেই জোড়া শালিকটি উড়াল দেয়। সাথে সাথে আমি চমকে উঠি। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে ছোট ছোট চোখে তাদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রই। অতঃপর দীর্ঘ এক নিশ্বাস নিয়ে মাথায় ওড়না টেনে নেই। ঘাড় ঘুরিয়ে পিছে তাকাই। অহনা ঠোঁট উল্টিয়ে এলোমেলো হয়ে ঘুমাচ্ছে। আমি অহনার একটু সামনে গিয়ে ওকে ঠিক করে শুয়ে দেই। কপালে ছোট এক চুমু একে দিয়ে উঠে দাঁড়াই। ওযু করে এসে আসরের নামাজটা আদায় করে নেই। নামাজ পড়া শেষে হিজাবটা খুলতে যাব তখন বেল বেজে উঠে। বেল বাজার শব্দ কানে আসতেই আমি দরজার দিকে চলে যাই। দরজা খুলতেই মামার হাস্যজ্জ্বল মুখ ভেসে উঠে। মসজিদ হতে নামাজ আদায় করে আসলো সে। আমি তাকে সালাম দিয়ে দরজা থেকে সরে দাঁড়াই। মামা সালামের জবাব দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়েন। হাতে তার ঝুলন্ত ব্যাগ। আমিও দরজা দিয়ে তার পিছু নেই। মামা ডাইনিং টেবিলে ব্যাগটি রেখে নিজের মাথার টুপিটা খুলে ফেলেন। টুপিটা নিজের পকেটে ভরতে ভরতে বললেন,

— মসজিদের বাইরে ভালো মানের ফজলি আম পেলাম। তাই নিয়ে এলাম। তোর তো আবার আম অনেক প্রিয়।

— তোমার মনে আছে? সে তো অনেক আগের কথা।

— অভিভাবকরা কখনোই নিজের সন্তানের পছন্দ-অপছন্দ ভুলতে পারে না। হোক সেটা পুরোনো আর নতুন। এখন যদি তোর পছন্দ পরিবর্তন হয় সেটা অন্য বিষয়।

শেষের কথাটা অভিমানী সুরেই বললেন। আমি তার কথা শুনে মুচকি হেসে বলি,

— মানুষটি যখন সেই একই আছে তাহলে পছন্দও সেই একই থাকবে, তাই না?

মামা মুচকি হেসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নিজের রুমের দিকে চলে যান। বেশকিছুক্ষণ আমি আম কেটে প্লেটে সাজিয়ে তার রুমে এসে হাজির হই। মামা ইজি চেয়ারে বসে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর লিখা “দূরবিন” উপন্যাসটি পড়ছে। আমি মুচকি হেসে প্লেটটা বিছানায় রেখে একটা ছোট মোরা নিয়ে তার সামনে রাখি। অতঃপর প্লেটটা হাতে নিয়ে সেটাতে বসে পড়ি আর প্লেটটা কোলে নিয়ে নেই। মামা আমার উপস্থিতি বুঝতে পেরে বইটা বন্ধ করে নিজের কোলে রেখে দিলেন। চোখে থাকা কালো মোটা ফ্রেমের চশমাটা হাত দিয়ে পিছনের দিকে ঠেলে দিলেন। চেহেরায় বয়সের ছাপ পড়েছে। চাপা রঙের চামড়ায় খানিকটা কুচকে এসেছে। মামা ভাজ পড়া গালে স্মিত হাসি উপহার দিতেই আমিও মিষ্টি হেসে তার দিকে প্লেটটা উঁচু করে ধরি। মামা এক টুকরো আম নিয়ে মুখে পুরে নেন। অতঃপর বলেন,

— কি রে কিছু বলবি? দেখে তো মনে হয় কিছু বলতে চাচ্ছিস। তা বলে ফেল।

আমি মামার কথা শুনে শুকনো গলায় ঢোক গিলে জিহ্বা দিয়ে নিজের ঠোঁট ভিজিয়ে নেই। অতঃপর চঞ্চল চোখে এইদিক সেদিক তাকাই। দীর্ঘ এক নিশ্বাস নিয়ে বলি,

— আমি জব করতে চাই মামা।

আমার এই কথা শুনার পরও মামার মধ্যে আমি তেমন কোন প্রতিক্রিয়া দেখলাম না। সে আগের ন্যায় শান্ত শিষ্টই আছে। সে আরেক টুকরো আম মুখে পুরে দিতে দিতে বলেন,

— কাউরো ঘাড়ে বোঝা হতে চাস না বলে কি জব করতে চাস নাকি নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য জব করতে চাস? কোনটা?

মামার কথার ধাঁচ শুনে বুঝে যাই মামা কি বুঝাতে চাচ্ছে৷ আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলি,

— আগের ডিসিশনটা রাগ ও জীদের বসে নিয়েছিলাম। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই বলে জব খুঁজতে যাই নি। বরং বোঝা নামক শব্দটি থেকে মুক্তি পেতে জব করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই বলে জব করতে চাই। স্বাধীন হতে চাই। নিজের নাম গড়তে চাই না শুধু একটা কর্মরত জীবন পরিচালনা করতে চাই।

— তাহলে তো হলোই। আমি দেখছি ব্যাপারটা।

— আমি কিন্তু তোমার দোকানে জব চাই না। অন্য কোথাও চাই তাও নিজের যোগ্যতার উপর নির্ভর করে।

— আচ্ছা তাই হবে। তুই চিন্তা করিস না। কিন্তু তোকে কিছু কথা বলার ছিল।

— হুম বলো।

মামা এক লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে বলেন,

— তোকে কিন্তু শক্ত হতে হবে। প্রতিবাদী হতে হবে। পাল্টা উত্তর যদি তুই দিতে না পারিস তাহলে মনে রাখবি তুই এই সমাজে টিকতে পারবি না। লোকনিন্দা তোকে টিকতে দিবে না। জবাব তোকে দিতেই হবে।
একটা কথা জানিস কি? ১৯৭৪ সালে যে বাংলাদেশে দূর্দশা দেখা গিয়েছিল তা এখন পর্যন্ত স্থায়ী। পরিস্থিতির দিক দিয়ে নয় মানসিক দিক দিয়ে। ১৯৭৪ সালের দূর্দশা ছিল সকলের চোখের স্পষ্ট। কিন্তু এখনকার দূর্দশা চোখের স্পষ্ট না। অনুভবে স্পর্শনীয়।
সময়ের সাথে সাথে যেমন সভ্যতায় আধুনিকতা এসেছে ঠিক তেমনেই দূর্দশায়ও আধুনিকতা এসেছে। বলতে গেলে আপডেট হয়েছে। আগের ন্যায় এখনকার তৎকালীন সমাজে পার্থক্য শুধু এতটুকুই এসেছে যে, আগের দূর্দশাগুলো মানুষের মধ্যে হাহাকার তৈরি করতো কিন্তু এখনকার দূর্দশাগুলো মানুষের মধ্যে নিম্নতম অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারে না। বরং পরিস্থিতিটা এখন সকলের অবহেলার স্তূপের নিচে পড়ে গিয়েছে। এই যে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে পথচারী শিশু, বাসস্থান ছাড়া থাকছে মানুষ, নারী ও পুরুষেরা হচ্ছে অপমানিত-লজ্জিত, ধর্ষিত হচ্ছে নারী, পুরুষরা করছে সমাজে টিকে থাকার যুদ্ধ, শক্ত হতে গিয়ে অনুভূতিহীন হচ্ছে পুরুষ, নিম্ন কর্মরত মানুষ হচ্ছে লাঞ্চিত, আগুনে পুড়ছে ঘর-বাড়ি, না খেয়ে মরছে হাজারো মানুষ। কিন্তু কই মানুষ তো একবারের জন্যও কষ্ট অনুভব করছে না। আর না এদের নিয়ে ভাবছে, না এদের সাহায্য করতে কেউ এগিয়ে আসছে। বুঝতে পারছিস তো কেন? সকলের মন-মানসিকতা এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে যেখানে সবকিছুই স্পষ্ট হয়ে অস্পষ্ট তার কাছে। সকল মানবই এখন এই দূর্দশায় ভুগছে। প্রত্যক্ষ ভাবে না পরোক্ষভাবে।

তাই স্বার্থের জন্য হোক বাঁচার জন্য হোক আওয়াজ উঁচু তোকে করতেই হবে। উত্তর তোকে দিতেই হবে৷ তুই যত চুপ থাকবি ততো তোকে তারা ঘিরে ধরবে বুঝলি।

আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম। মামা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আরেক টুকরো আম মুখে পুরে নিলেন। আমি এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলি,

— তুমি তো বুঝদার কম নও। তাহলে নিজের ভালোটা কেন বুঝলে না? বিয়েটা কেন করলে না তুমি?

আমার কথাটা শুনার সাথে সাথে মামা চমকে উঠেন। সর্তক চোখে আমার দিকে তাকান। অতঃপর গলা ঝেড়ে ঠোঁটের কোনে হাসি ঝুলিয়ে বলে,

— কখনো নিজের স্বার্থের চেয়ে প্রতিশ্রুতি বড় হয়ে যায়। তখন চেয়েও সেটা ভাঙ্গা যায় না। পৃথিবীতে এমন কিছু প্রতিশ্রুতি আছে যা চিরতরের জন্য অমর। জীবন্ত! তুই যখনই নিজের কথা ভাবতে যাবি তখনই সেই প্রতিশ্রুতি তোর চোখে সামনে ভেসে উঠবে আর তোকে দিশেহারা করে তুলবে। তখন তুই চেয়েও তা ভঙ্গ করার দুঃসাহস দেখাতে পারবি না।

— উপন্যাস পড়ে পড়ে তোমার মধ্যেও রহস্য আর প্যাঁচ ঢুকে গিয়েছে।

— কথা ঘুরানো বেশ ভালোই শিখেছিস। তা যা রুমে যা। একটু পর মাগরিবের আজান দিবে। আর শুন! আজ আমায় আর ডাকিস না। একা থাকতে চাচ্ছি।

— সরি মামা! আমি আসলে তোমাকে…

— ধুর পাগলি। তুই যা ভাবছিস তা না। শুধু একটু একা থাকতে চাইছি আর কিছুই না। জানিস এই তো মাঝে মাঝে নিজেকেও সময় দেওয়া দরকার।

আমি আর কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে আসি। জানি কিছু বলকেও কাজ হবে না। বরং ক্ষত বাড়বে। এর চেয়ে চুপচাপ থাকাই ভালো। মামার রুম থেকে বের হয়ে আমি দরজা দিয়ে দেই। হঠাৎ চারদিকে আজানের মিষ্টি ধ্বনি এসে কানে বারি খায়।

____________________________________________

দেখতেই দেখতে প্রায় ১ সপ্তাহ কেটে গেল। দিন গুলো কিভাবে যে এত দ্রুত চলে গেল বুঝাই গেল না। সকালে আমি, অহনা ও মামা নাস্তা করছি। নাস্তা যখন প্রায় শেষের দিকে তখন মামা বলে,

— আরশি শুন!

আমি খাওয়া থেকে মনোযোগ সরিয়ে মামার দিকে কৌতূহল দৃষ্টিতে তাকালাম। মামা আমার দৃষ্টি বুঝতে পেরে বলে,

— তোর জবের ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছে।

#চলবে