#আরশি
#Part_13
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
তপ্ত দুপুরের তীক্ষ্ণ রোদ্দুরে কুঞ্জ কুঞ্জ মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে আকাশের বুকে। ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে চারদিকে। গাছে গাছে ফুটে উঠেছে হরেক রকমের মুকুল। ফল বিশিষ্ট গাছে ছড়িয়ে পড়েছে ফলের বাহার। গাছের ফাঁক-ফুঁকুর দিয়ে উঁকি মারছে এক ফালি রোদ। কয়েক’শ ভাগে ভাগ হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে ভূ-পৃষ্ঠের বুকে। ঘাসফুলের উপর রোদের টুকরো পড়তেই তারা
যেন খিলখিলিয়ে হেসে উঠছে। দূর আকাশ থেকে কোন এক পাখির কিচিরমিচির ডাক শুনা যাচ্ছে। মাঝে মধ্যে ভেসে আসছে কর্কশ কন্ঠে কাক পাখির ডাকটি। চারদিকে ভ্যাপ্সা গরমের উত্তাপ। উত্তাপ সইতে না পেরে কোন এক কুকুর রাস্তার ধারে করে উঠছে আর্তনাদ। ধীরে ধীরে পথচারীদের দেখা সাক্ষাৎ কমে আসছে। ফাঁকা হয়ে আসছে রাস্তা।
এই অসহ্য এক তপ্ত দুপুরেই ঘামযুক্ত শরীর নিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ফাহাদ। বেশ কিছুক্ষণ ধরেই দরজার তালাটা খুলার চেষ্টা করছে কিন্তু খুলতে পারছে না। যার জন্য মিনিট কয়েক এর মধ্যেই তার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। সজোরে লাথি বসিয়ে দেয় দরজায়। অতঃপর নিজেকে শান্ত করে আবার তালা খুলার জন্য প্রয়াস করতে থাকে। একসময় সে সফলও হয়ে যায়। তালা খুলে যেতেই সে গটগট করে ভিতরে ঢুকে পড়ে। ড্রয়িং রুমে এসেই আগে সে পূর্ণবেগবানে ফ্যানটি ছেড়ে দেয়। সাথে সাথে জমে থাকা ধুলোবালি গুলো উড়ে এসে বারি খায় তার মুখে। কেশে উঠে সে। পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে এগিয়ে যায় জানালার দিকে। জানালা খুলে দিয়ে চলে যায় সোফার দিকে। ধপ করে বসে পড়ে। মূহুর্তেই ইন করা শার্টটি ছেড়ে দেয় আর গলার ঠিক নিচে দুই-তিনটি বোতাম উন্মুক্ত করে দেয়। চোখ বন্ধ করে গা এলিয়ে দেয় সোফায়। বেশ কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে সে, মাথা তুলে বসে। চারদিকটা একবার সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে নেয়। সকল আসবাবপত্র ধুলোবালির স্তুপ জমে গিয়েছে। গুমোট ভাব ছড়িয়ে আছে চারদিকে। দেড়-দু মাস হবে সে এই বাসা ছেড়ে নতুন বাসায় এসেছে। এর মাঝে একবারও এইখানে আসা হয়নি। এর প্রমাণ সেই তালাটা। নাড়াচাড়া না পড়ায় সে শক্ত হয়ে গিয়েছে। অবশ্য তার আজও আশা হতো না যদি তার কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফাইল এইখানে থাকতো। সব নেওয়া হলেও সেই ফাইলগুলো আর নেওয়া হয় নি। এইখানেই রয়ে যায়। এখন সেগুলো লাগবে বলেই এইখানে আসা।
ফাহাদ দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে চলে যায় নিজের রুমের দিকে। রুমে আসতেই সে কিছুক্ষণের জন্য থম মেরে যায়। বুকের বা পাশটা লাফিয়ে উঠে। মনের মাঝে দ্বিধাবোধটা ধপ করে জেগে উঠে। কোন এক শূন্যতা ঘিরে ধরে তাকে। কিন্তু কিসের এই শূন্যতা তা তার জানা নেই। সে সতর্ক দৃষ্টিতে চারদিকটাতে চোখ বুলিয়ে নেয়। বিছানার চাদরটা কুঁচকে আছে। তার উপর রাখা কাঁথাটাও এলোমেলো অবস্থায় পড়ে আছে। বিছানার পাশে থাকা সাইড টেবিলে সেই অর্ধেক খাওয়া পানির গ্লাস এখনো বিধ্যমান। তার মধ্যে কয়েকটা পোকা মৃত অবস্থায় ভাসছে। ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখা সাজসজ্জার জিনিস গুলো এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। সবকিছুতেই ধুলোবালির স্তুপ পড়ে একাকার। মেঝেতে পড়ে আছে কিছু কাগজ আর দুই একটা মেয়েলী পোশাক। ফাহাদের আর বুঝতে দেরি নেই পোশাকটা কার। সে নাক ছিটকে বিরবির করে বলে,
— ইশশ! কি হাল রুমের। আরশি থাকলে কখনোই রুমের এই রকম বীভৎসকর অবস্থা হতো না।
কথা বলা মাত্রই সে চমকে উঠে। নিজেই নিজেকে বলে উঠে,
— হুট করে আরশির কথা কেন মনে পড়লো আমার? ওর কথা তো আমার মনে পড়ার নয়। তাহলে?
কথাটা শেষ হতেই বারান্দায় নজর যেতেই সে দেখে সেখানে থাকা সকল গাছগুলো পানির অভাবে শুকিয়ে একদন মারা গিয়েছে। তা দেখে ফাহাদ আপন মনে বলে উঠে,
— কত বার বলেছি এইসব জঙ্গলি-ফঙ্গলি বাসায় রাখতে না। তাও মেয়েটা শুনে না। অসহ্য!
নিজের বলা কথায় ফাহাদ পুনরায় চমকে উঠে। তার বুঝতে দেরি নেই তার মস্তিষ্ক আরশিকে নিয়ে খেলা করছে। আরশির প্রতি তার করা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যবহারগুলো সে পুনরাবৃত্তি করছে। তাই ফাহাদ এইসব তোয়াক্কা না করে আলমারির দিকে চলে যায়। চাবি দিয়ে আলমারি দ্বিতীয় পাল্লা খুলে সে ভিতরের ছোট ড্রয়ারটি খুলে। খুলার সাথে সাথে সে থমকে যায়। চোখগুলো আপনা-আপনি বড় হয়ে আসে। কেন না ভিতরে আরশির সব গহনা-গাটি পড়ে আছে। সাথেই কিছু ক্যাশ৷ ফাহাদ অস্ফুট কন্ঠে বলে উঠে,
— আজব মেয়ে তো! নিজের গহনা-গাটি কিছু নেই। আর না ক্যাশ নিয়েছে। আমি তো ভেবেছিলাম সব নিয়ে গিয়েছে।
কথাটা বলতেই বলতে পাশের দিকে থাকা একটা দুই ভাজের কাগজের দিকে নজর যায় তার। ফাহাদ সেটা হাতে তুলে নেয়। কাগজের ভাজ খুলতেই সে বুঝতে পারে এইটা আরশির চিঠি। চিঠি ঠিকই কিন্তু সাধারণ চিঠিপত্র এর মত দীর্ঘ না। তিন-চার লাইনে লেখা। ফাহাদ পড়তে শুরু করে,
” বিয়ের সময় বাবা এইগুলো আমাকে দেওয়ার জন্য বানায় নি। বরং তোমাদের দেওয়ার জন্য বানিয়েছিল। তাই এতে আমার অধিকার নি। যার অধিকার আছে তাকেই দিয়ে গেলাম। শুধু একটা চেইন নিয়ে গেলাম যেটা নাকি আমার মা আমার জন্য বানিয়েছিল। যেটা আমার আধিকার।”
কথাটা যেন ফাহাদের বুকে তীরের মত লাগলো। রাগে অপমানে সে ফুঁসে উঠে। প্রত্যক্ষভাবে না হলেও আরশি যে তাকে পরোক্ষভাবে অপমান করেছে তা আর তার বুঝতে দেরি নেই। ফাহাদ সেই কাগজটা দুমড়ে মুচড়ে ছুঁড়ে মারে। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে,
— সাহস তো কম না। আমাকে! ফাহাদকে সে অপমান করে। সামনে পেলে পিটিয়ে ছাল উঠিয়া ফেলতাম। অসভ্য মেয়ে একটা।
কথা বলেই সে ধুম করে ড্রয়ার লাগিয়ে দেয়। রাগে উপরে ভাজ করা কিছু কাপড় টেনে মেঝেতে ফালিয়ে দেয়। তখনই সেখান থেকে কয়েকটা ছবি টুপ করে নিচে পড়ে যায়। ফাহাদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সেইদিকে তাকাতেই দেখে ছোট অহনার কিছু ছবি। সাথেই সেখানে তার আর আরশির কিছু ছবিও রয়েছে। ফাহাদ সেইদিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। কি মনে যেন ছবিগুলো তুলে নেয়। হাতে নিয়ে দেখতে থাকে। অহনার সদ্য নিজের পায়ের দাঁড়ানো এক ছবি। মাথায় ছোট ছোট ছাটা চুল। চোখে মায়া ভরা। সে তার ইদুরের মত ছোট ছোট দাঁত বের হাসছে। যার জন্য গালের দিকে গর্ত হয়ে আছে। ফাহাদ অবাক হয়ে বলে,
— অহনার গালে টোল পড়তো? কই আমি তো কখনো দেখলাম না। স্ট্রেঞ্জ!
ফাহাদ বাকি ছবিগুলোও দেখতে থাকে। অতঃপর শেষের ছবিটাতে তার নজর আটকে যায়। তার আর আরশির ছবি। বিয়ের কয়েকমাসের ব্যবধানেই ছবিটা তুলা হয়েছিল। কতটা প্রাণবন্ত লাগছে আরশিকে। কি মিষ্টি তার হাসি। এই হাসি যেন কাব্য-উপন্যাসের লেখা সর্বনাশী হাসি। যার এক ঝলক এই যথেষ্ট কাউরো সর্বনাশ ডেকে আনার। কোমড় অব্দি চুলগুলো তার বাতাসে ছুটাছুটি করছে। হরিণীটানা চোখে কালো কাজলের ছড়াছড়ি। সাথেই তাতে লুকিয়ে আছে একরাশ চঞ্চলতা। গালে কেমন লাল আভা ছড়িয়েআছে। একবার এই মুখপানে তাকালেই চোখ ফিরানো দায়। অথচ এখন আর সেই চঞ্চলতার কিছুই নেই। নেই মুখে সেই মিষ্টি হাসি। নেতিয়ে গেছে মুখ। ভেঙ্গেছে চেহেরার গঠন। ফাহাদ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। আনমনে ভাবছে,
— আরশি কি আদৌ এত সুন্দর ছিল নাকি আজ হঠাৎ দেখছি বলে এমন লাগছে। কই আগে তো তার এই সৌন্দর্য চোখে পড়ে নি। কেন পড়ে নি?
অতঃপর ফাহাদ দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলে,
— উত্তরটা তো আমার জানাই৷ আমি তো কখনো আরশিকে ভালো মত দেখি এই নি৷ না নিয়েছি যত্ন। জীদের বসে বিয়েটা করেছিলাম ঠিকই কিন্তু মেনে নিতে পারি নি। দায়িত্ব নিয়েছিলাম ঠিকই কিন্তু বোঝা মনে করে। আদৌ কি আমি ওকে ভালবেসেছিলাম? উঁহু! বাসি নি। যেখানে আমার ওকে সহ্যই হতো না সেখানে ভালবাসা নিছক স্বপ্ন। অধিকার খাটিয়েছি ঠিকই কিন্তু তাকে অধিকার দেই নি। আরশি হয়তো কখনো বুঝেই নি যে আমি ওকে কখনো স্ত্রীর অধিকার দেইনি।
এই বলে ফাহাদ তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। অতঃপর ভাবলো,
— আচ্ছা এই কয়েক মাসে তো একটি বারের জন্যও আরশির কথা মনে পড়েনি তাহলে আজ কেন এমন হচ্ছে? শুধুমাত্র এইখানে আরশির স্মৃতি আছে বলে কি? দেয়ালে দেয়ালে আরশির আর্তনাদ লুকিয়ে আছে বলে কি? আচ্ছা আমি কি খুব বেশি অন্যায় করে ফেলেছি ওর সাথে? আচ্ছা নিজের সন্তানও তো ছিল আমার। তাকেও তো অবজ্ঞা করেছিলাম আমি। সেটাও কি তাহলে অন্যায়?
পরক্ষণেই ফাহাদ নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
— না আমি কোন অন্যায় করি নি। আরশি নিজের কর্মেরই শাস্তি পেয়েছে। আমার বউ হওয়ার শাস্তি পেয়েছে সে। আর সেই শাস্তি এর ভাগিদারই হয়েছে তার মেয়ে। হ্যাঁ ঠিক তাই। আর এইভাবেও আমি এইসব নিয়ে ভাবছিই বা কেন? যে কাজে এসেছি তা করে জাস্ট এখন বেরুতে পারলেই বাঁচি। উফফ!!
এই বলে ফাহাদ ছবিগুলো দুই খন্ড করে ছুঁড়ে মারে। অতঃপর নিজের ফাইল খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
______________________________________________
মিনিট দশেক ধরে বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছি বাসের জন্য। কিন্তু বাস আসার নাম গন্ধ নেই। আকাশের আজও মেঘ জমেছে৷ দুপুর কি বিকেলের দিকে বৃষ্টি পড়ার সম্ভাবনা বেশি। দামকা হাওয়া বইছে। আমি মনে মনে ভাবছি, এই বুঝি ফাস্ট এট অফিস লেট হয় আমার। আরও পাঁচ মিনিট অপেক্ষার পর বাস আসে। সাথে সাথে শুরু হয় মানুষের ধাক্কাধাক্কি। অনেক কষ্টে বাসে উঠি। উঠে দেখি সব সিট বুক। কোথাও কোন খালি সিট নেই। বেশিরভাগ মানুষই দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ মনে পড়ে এখন অফিস টাইম। ভীড় হওয়া স্বাভাবিক। দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে উপরের হ্যান্ডাল ধরে দাঁড়িয়ে রই। বেশ কিছুক্ষণ পর অনুভব করি…..
#চলবে
গল্পটা কেমন হচ্ছে প্লিজ জানাবেন। ভুল-ত্রুটিগুলো ধরিয়ে দিলে খুশি হবো৷