আরশি পর্ব-১৮

0
2132

#আরশি
#Part_18
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

— তোমার আপত্তি না থাকলে আমি তোমায় ড্রপ করে দেই?

সাদ এর কথা শুনে আমি ভরকে যাই। পরক্ষণে নিজেকে সামলে চঞ্চল দৃষ্টিতে এইদিক সেদিক তাকাই। উশখুশ করতে থাকি। মনের মাঝে এসে ভীড় জমায় হাজারো প্রশ্ন। বুঝে উঠতে পারি না আমার কি করা উচিৎ। ওর থেকে লিফট নিবো নাকি না। এতদিনে যতটুকু বুঝেছি ছেলেটা খারাপ না। চরিত্রে কোন দোষ। ভরসা করার মত পাত্র সে। কিন্তু তাও কার মনে কি আছে তা তো বলা যায় না। ধীরে ধীরে মনের মধ্যে সংকোচের দানা বুনতে শুরু করে। আমি যখন এই আকাশ-কুসুম ভাবনায় বিভোর তখন সাদ আবার বলে উঠে,

— এই মি দর্পণ! কোথায় হারালে? বৃষ্টি নামবে তো।

সাদের কথা কর্ণপাত হতেই আমি বিচক্ষণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাই। সাদ আমার দৃষ্টির মনোভাব ধরতে পেরে আনমনে কিছু একটা ভাবে। হঠাৎ কিঞ্চিৎ ভূবণ ভুলানো হাসি হাসে সে। সাথে সাথে গালের ভাঁজে ফুটে উঠে এক গভীর গর্ত। সাদ ঠোঁটের কোনে হাসি ঝুলিয়ে রেখে স্বাভাবিক কন্ঠেই বলে,

— ভয় করছে বুঝি? তা ভয়ে হওয়া স্বাভাবিক। আমি আবার মানুষ সুবিধার না।

বলে নিজের এক হাত তার ঘন কালো চুলের মাঝে নিয়ে নেড়ে ঠিক করে নেয়। কথাটা শুনে সাথে খানিকটা অবাকও হলাম যে সে নিজেকে আমার সামনে ভালো বলে দাবী করছে না। যেখানে সকলে নিজের গুনগান গেয়ে নিজেকে সর্বস্তরের প্রাণী প্রমাণ করতে ব্যস্ত সেখানে এই ছেলে নাকি নিজেকে নিচুই দেখাচ্ছে। আদৌ কি তা সম্ভব? আমি আরেকবার সাদের মুখ পানে চাই। দেখি তার ঠোঁটের কোনে দুষ্টু মাখা হাসি। তা দেখে আমি বুঝে যাই সাদ আবার ফাজলামো করছে। কথাটা বুঝার সাথে সাথে আমি ফুঁসে উঠে বলি,

— ফাজলামো হচ্ছে?

সাদ আমার দিকে তাকিয়ে হাসি মুখেই বলে,

— কি যে বলো না। তোমার ফাজলামো করার মত দুঃসাহস কি আমার আছে? এমন দুঃসাহস দেখালে বুঝি তোমার অগ্নিগিরির ন্যায় নয়ন জোড়া আমায় ভস্ম করে দিবে না?

কথাটা কর্ণপাত হতেই আমি রাগা বদলে নিভে গেলাম। ছোট ছোট চোখ তার দিকে চেয়ে থাকলাম। জড়ো হাওয়া বইতে শুরু করলো। ধুলোবালি মিশে একাকার। তা দেখে সাদ কিছুটা একটা ভাবলো। অতঃপর আমার মুখ পানে তাকিয়ে বলে,

— আবহাওয়া খারাপ করছে। হয়তো ঝড় নামবে। তুমি কি যাবে নাকি থাকবে? এখন ট্রাস্ট করবে কি না সেটা তোমার ব্যাপার। বাট আমার তাড়া আছে।

কথাটা শুনে আমি চারদিকে তাকালাম। জায়গায়টা ধীরে ধীরে মানব শূন্য হয়ে আসছে। হয়তো ইতি মধ্যে তারাও খবর পেয়ে গিয়েছে আজ বাস আসবে না। তাই হয়তো যে যার মত পথ দেখছে। আমি সাদের দিকে তাকালাম। ১ মাসে যতটা চিনেছি ছেলেটা মোটেও খারাপ না। পরিষ্কার মনের মানুষ। কত সময় কাজের বাহানায় একা পেয়েছে তাও কোন অসভ্য আচরণ করে নি। ফাজলামো করে ঠিকই কিন্তু তাও বাজে মিন করে না। আকাশ-কুসুম ভেবে আমি ছোট এক নিঃশ্বাস নিয়ে বলি,

— চলেন।

_______________________

রাত হয়েছে বেশ। বৃষ্টি এখন আর নেই। কালো মেঘেরা আকাশের বুকে বেশিক্ষণ সুবিধা না করতে পেরে হাল ছেড়ে হাওয়ায় মিইয়ে গিয়েছে। পরিষ্কার হয়ে উঠেছে আকাশ। ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। বাতাসের সাথে উড়ে উড়ে আসছে ভেজা মাটির গন্ধ। আমি জানালার ধার ঘেষে সেই ঘ্রাণ উপভোগ করছি।এই বৃষ্টি ভেজা মাটির গন্ধ আমার বেশ লাগে। পাশেই কিছু ফাইল রাখা। যা বাতাসের শক্তি গায়ে মাখিয়ে মৃদু মৃদু উড়ছে। মনের মাঝে উঁকি দিচ্ছে সন্ধ্যার ঘটনাটা। সাদের সাথে আমি যেতে রাজী হতেই সে আর এক মূহুর্ত দেরি না করে বাইকে গিয়ে বসে আর স্টার্ট দেয়। আমিও ওর পিছু পিছু যাই আর ওর পিছে গিয়ে বসি। শক্ত করে বাইকটা ধরে রাখি। বাইকে বসতেই মন কেমন আনচান করে উঠে। উশখুশ করে উঠে। হয়তো এই প্রথম পর পুরুষের বাইকে উঠছি বলে। আগে ভাইয়ার বাইকে অনেক বারই উঠা হয়েছে তাই বাইকে উঠার অভিজ্ঞতাটা আমার আছে। বাইক চলতে শুরু করে। বাইকের স্পীড কমই ছিল। সে না জোড়ে চালিয়েছে আর না হার্ড ব্রেক কসেছে। বিষয়টা তখন ভালো লেগেছিল। সাদ আমার ঠিকানা জানতে চাইলে বলি, “মোহাম্মদপুর বি ব্লক।” তখন সে চমকিত হয়ে জানায় সেও নাকি মোহাম্মদপুরই থাকে। ও এ ব্লকে থাকে। কথা শুনে আমিও চমকাল। কিন্তু মুখে কিছু বললাম না। সাদ আপন মনে বাইক চালাতে চালাতে বলে,

— ভার্সিটির লাইফে তুমি আমার সাথে অমনটা না করলেও পারতে।

সাথে সাথে আমি চমকে তাকাই। মনে পড়ে যায় সেই ১০ বছর আগের কথা। আমি তখন সবে মাত্র ডিইউতে ফিন্যান্স বিভাগে ভর্তি হয়েছি। সকল ফরমালিটি শেষে ক্লাস মনিটার হিসাবে আমাকে সিলেক্ট করা হয়। আমিও সে দায়িত্ব ভালো ভাবেই পূরণ করতে থাকি। ক্লাসের মনিটার হওয়া সুবাদে সকলেই চিনে গিয়েছিল আমায়। সাদও আমার সেকশনেই ছিল। কিন্তু কখনো আমাদের মাঝে কথা হয়নি। তো একবার কিছু এসাইনমেন্ট জমা নেওয়ার সময় আমার ওড়না পিছের বেঞ্চে লেগে যায়। আর সেটাতেই সেদিন সাদ বসেছিল। আমি ভুলবসত মনে করি যে সাদই আমার ওড়না ধরে টেনে ধরেছে। ভীতু প্রকৃতির ছিলাম তো আমি পিছে না ঘুরেই চিৎকার দিয়ে বসি। সেই চিৎকারে ক্লাসের স্টুডেন্টরা জোড়ো হয়। ঘটনা বুঝে সাদকে উল্টাপাল্টা বলতে শুরু করে। সাদ বেকুব বোনে রয়ে যায়। বুঝে উঠতে পারে না আসলে ঘটনা কি। এইদিকে আমি ওড়নাটা ছুটাতে যেয়ে বুঝতে পারি সাদ আমার ওড়না টেনে ধরে নি বরং বেঞ্চের সাথে বেজেছে। লজ্জায় কুঁকড়ে যাই। কোন মতে সবাইকে থামিয়ে সাদকে সরি বলে ওড়না ছুটিয়ে চলে আসি। ব্যাস! এরপর থেকেই সাদ আমার পিছে পড়ে যায়। যতদিন ডিইউতে ছিলাম ও সবসময় আমাকে আমার নাম ও সেই ঘটনা নিয়ে পিঞ্চ কর‍তো। এই নিয়ে আমার আর ওর মধ্যে লেগে যেত। কিন্তু কখনো ওর মধ্যে প্রতিশোধের ভাবনা নিয়ে আমার বিপক্ষে কাজ করতে দেখিনি। এরপর তো আমি সেখান থেকে চলেই আসি। পারি জমাই খুলনাতে। সাথে সব স্মৃতি বন্দী পড়ে যায় মনের কোঠায়। সেইসব ভেবেই দীর্ঘ নিঃশ্বাস নেই। নিচু গলায় বলি,

— সেই বিষয় নিয়ে দুঃখিত।

সাদ হেসে বলে,

— তা অবশ্য তোমার হওয়াই উচিৎ। আমার মত ইনোসেন্ট একটা ছেলেকে ফাঁসিয়েছিলে তুমি। হুহ!

আমি প্রত্যুত্তরে কিছু বললাম না। চুপ করে রইলাম। তা দেখে সাদ আর কিছু বললো না। নীরবে কেটে যায় সময়। সাদ আমায় বাসায় নামিয়ে চলে যায়। আমি বাসার ভিতর ঢুকতেই শুরু হয় ঝুম বৃষ্টি।

হঠাৎ কানে ধুপধাপ পায়ের আওয়াজ কানে এসে বারি খেতেই আমি ভাবনার জগৎ থেকে বেড়িয়ে আসি। ঘাড় ঘুরিয়ে পিছে তাকাই। অহনা গাল ফুলিয়ে ধুপধাপ করে এগিয়ে আসছে। অহনা আমার সামনে এসে দুই হাত কোমড়ে রেখে ছোট ছোট ভ্রুকুটি কুঞ্চিত করে ঠোঁট উল্টিয়ে দাঁড়ায়। অহনার এমন মনোভাব দেখে আমিও ভ্রুকুটি কুঞ্চিত করে তাকাই। আদর মাখা কন্ঠে বলি,

— কি হয়েছে আমার মামনীটার? এইভাবে মুখ ফুলিয়ে আছে কেন?

অহনা আদো আদো গলায় বলে উঠে,

— তুমি কেন আমাকে আগের মত ভালোবাসো না? তুমিও কি পঁচা হয়ে গিয়েছ?

#চলবে