#আরশি
#Part_26
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
দেখতেই দেখতে কেটে গেল দু’টি বছর। সময়ের এই আবর্তনে এসেছে বিরাট পরিবর্তন। পরিবর্তন এসেছে আশেপাশের মানুষের মধ্যে। পরিবর্তন এসেছে জীবনের ধারায়। সেই ছোট অহনা এখন আর ছোট নেই৷ সে এখন স্কুলে যায়। ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল সে। আগের চেয়ে হয়েছে বেশ চঞ্চল আর বুঝদার। মায়ের কষ্ট সে বুঝে৷ আমি আমার জব কান্টিনিউ করে গিয়েছি। সারাদিন অফিসে সময় দিলেও রাতের সময়টা একান্ত অহনানে দেওয়ার চেষ্টা করি। রাতের সেই সময়টুকু আমাকে পাশে পেলেই অহনা তার কথার ঝুলি নিয়ে বসে। ছোট থেকে ছোটও সে আমার সাথে শেয়ার করে। আমি সর্বদা চেষ্টা করি ওর সাথে ফ্রি হওয়ার। পড়ার জন্য একটু শাসন করলেও বাকি সবকিছুতেই আমি একে ছাড় দেই। সে যা করতে চায় তা করতে দেই আর বিভিন্ন এক্টিভিটিসের প্রতি উৎসাহিত করি। মামা সুস্থ হয়ে উঠায় অহনাকে স্কুল নিয়ে যাওয়ার আসার দায়িত্ব আপাতত সেই পালন করছে। পাশাপাশি তার ব্যবসাও সামলে নিচ্ছে। আর সাদ তো যেন আমাদের পরিবারের অংশই হয়ে উঠেছে। সে সবসময় একজন শুভকাঙ্ক্ষিকের মত আমাদের পাশে থেকেছে। অহনা তো সাদ বলতে পাগল। অহনা যেমন আমার ভক্ত ঠিক তেমনই সাদেরও বেশ ভক্ত। অহনার প্রতি সাদের গভীর ভালবাসার ফল এই ভক্তিটি। সাদ আর অহনাকে প্রথমবারের মত একসাথে দেখলে যে কেউ বলবে বাবা আর মেয়ে। এর মূখ্য কারণ তাদের হাসি অবিকল একে অপরের সাথে মিলে। যখন দুইজন একসাথে হাসে আর দুইজনের গালের মাঝেই সেই গভীর গর্তটা ফুটে তখন এক মিনিটের জন্য আমারই মনে হয় অহনা সাদেরই মেয়ে। এছাড়া তাদের আচরণেও বেশ মিল রয়েছে৷ দুইজন যখন একত্রিত হয় তখন পুরো ঘর মাথায় তুলে নেয়। হৈ-চৈ তে উঠে চারদিকের পরিবেশ। যেমনটা এখন হচ্ছে। সন্ধ্যার পর পর সাদ এসে হাজির হয়। আর শুরু হয়ে যায় দুইজনের হৈ-হুল্লোড়। আমি হালকা-পাতলা কিন্তু স্নেকস তৈরি করে নিয়ে যাই ওদের জন্য। রুমে গিয়ে দেখি সাদ অহনাকে কোলে বসিয়ে মোবাইলে গেম খেলছে। আমি স্নেকস এর ট্রে-টা পাশে রেখে দুইজনের উদ্দেশ্যে বলি,
— অনেক হয়েছে এইবার নাস্তা খেয়ে নাও দুইজনে৷
দুইজনে একসাথে আমার দিকে তাকিয়ে বলে,
— ডিস্টার্ব করো না তো৷ পরে খাব!
দুইজনের একই উক্তি শুনে আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি দুইজনের দিকে। আর দুইজনে একটা ভাব নিয়ে আবার গেল খেলায় মনোযোগ দেয়। আমি কিছু না বলে ছোঁ মেরে সাদের হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে নেই। তারপর কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলি,
— অনেক হয়েছে আর না। আগে নাস্তা খাও তারপর যা করার করো। দুইজন একসাথে হলে দিন দুনিয়া ভুলে যায়।
আমার কথা শুনে দুইজনেই মুখ ফুলিয়ে উঠে। একটু পর সাদ বলে,
— পুরো দুনিয়া ভুলিই, আর পুরো সৌরজগত ভুলি তাতে তোমার কি ভাই? তোমাকে ভুলে যাচ্ছি নাকি যে এমন অগ্নিমূর্তি হতে হবে?
অহনাও তাল মিলিয়ে বলে,
— হ্যাঁ! হ্যাঁ! উত্তর দাও।
আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলি,
— আমি ভুলে যাই তোমাদের দুইজনকে? বেশ ভালো হবে না?
আমার কথা শুনে অহনা একবার আমার দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার সাদের দিকে তাকাচ্ছে। কোন দিক নির্দেশনা না পেয়ে সে চুপ মেরে বসে থাকে। সাদ হাত উঁচিয়ে ট্রে থেকে দুইটা নুডলসেট বাটি হাতে নিয়ে, একটা অহনার দিকে এগিয়ে দিয়ে চাপা কন্ঠে বলে,
— চুপচাপ খেয়ে নাও। আবহাওয়া ভালো না।
অহনা ভালো বাচ্চার মত সাদের কথা মেনে নেয়। অতঃপর খাওয়া শুরু করে। সাদ এক চামচ খেয়ে বলে,
— আহা কি স্বাদ! এমন নুডলস মনে হয় না আমি কখনো কোথাও খেয়েছি। কি মিশিয়েছ নুডলসে? এত স্বাদ কেন?
অহনাও তাল মিলিয়ে বলে,
— হ্যাঁ! হ্যাঁ! অনেক মজা হয়েছে আম্মি। কি মিশিয়েছ নুডলসে বলো না?
সাদ আর অহনার কথা শুনে আমি সরু দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাই। এই ছেলে যে হুদাই পাম দিচ্ছে তা বুঝতে আমার দেরি নেই। আমি হালকা হেসে বলি,
— এক গ্লাস ফিনাইল মিলিয়েছি৷ সাথে ২ চামচ হারপিক।
আমার কথা শুনে সাদ বিষম খেয়ে উঠে। অহনা তা দেখে দ্রুত সাদের কোল থেকে নেমে পড়ে। বিছানার উপর বাটিটা রেখে ট্রে থেকে পানির গ্লাস এনে সাদের দিকে এগিয়ে দেয়৷ সাদ দ্রুত পানিটা খেয়ে নিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস নেয়। অতঃপর আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলে,
— লেডি হিটলার!
কথাটা আমি শুনেও না শুনার ভাণ করলাম। দুইজনকে নাস্তা শেষ করার কড়া নির্দেশ দিয়ে সাদের মোবাইলটা ফিরিয়ে দিলাম আর বেড়িয়ে আসলাম রুম থেকে। রুম থেকে বেড়িয়ে এসে ফিক করে হেসে দিলাম।
_____________________
— আজও ফারদিনকে রেখে একা বেড়িয়ে গিয়েছিলে তুমি?
জুঁই নির্ভয়ে বলে উঠে,
— হ্যাঁ গিয়েছিলাম তো?
ফাহাদ রুদ্ধ কন্ঠে বলে,
— কেমন মা তুমি? ছেলের প্রতি আদৌ কোন চিন্তা আছে তোমার? আজকে হাটতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিল সে৷ বা পা পুরো ছিলে গিয়েছে।
— বাচ্চা মানুষরা খেলার সময় একটু আধটু ব্যথা পায় এই। এতে এত হাইপার হওয়ার কি আছে?
ফাহাদ বিষ্ময়কর কন্ঠে বলে,
— লাইক সিরিয়াসলি! আমি হাইপার হচ্ছি? তুমি একজন আয়ার কাছে নিজের সন্তানকে রেখে গিয়ে এত নিশ্চিন্তে কিভাবে থাকছো? নিজের সন্তান ব্যথা পেয়েছে তা জানার পরও তোমার কষ্ট হচ্ছে না? কেমন মা তুমি?
জুঁই চেঁচিয়ে বলে,
— আমাকে বলার আগে নিজেকে জিজ্ঞেস করো, তুমি কেমন বাবা ছিলে? অহনা না তোমার সন্তান ছিল? তাহলে তুমি কিভাবে পেরেছিলে ওকে অবহেলা করতে? ওকে মারতে, বকতে? রাফ বিহ্যাভ করতে? বলো?
জুঁইয়ের কথা শুনে ফাহাদ স্তম্ভিত হয়ে যায়। নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়৷ চোখের সামনে ভেসে উঠে ছোট অহনার সেই ভিতু মুখখানি। তার করা ব্যবহার গুলো অহনার প্রতি। আরশির প্রতি। অনুতাপের আগুন জ্বলে উঠে বুকের মাঝে। নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আসে। তা দেখে জুঁই বলে,
— কি মনে পড়েছে কিছু? অমানুষের মত করা আচরণ গুলো কি আছে মনে?
ফাহাদ এইবার একটু চেঁচিয়ে বলে,
— জুঁই!!!
— চেঁচাবে না। সত্যি বলছি বলে গায়ে লাগছে তাই না? নিজের বেলায় ষোলো আনা আর আমার বেলায় চার আনাও না? আমাকে ভুলেও আরশি ভেব না যে, আমি তোমার সকল অত্যাচার মুখ বুঝে সহ্য করে নিব।
— ইউ নো হোয়াট? আরশি আর তোমার মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। তুমি চাইলেও আরশি হতে পারবে না। এমনকি তুমি আরশির পায়ের নখের যোগ্যও না।
জুঁই তেড়ে এসে বলে,
— কি বললে তুমি? তোমার সাহস কিভাবে হয় এইসব বলার? ওই মেয়ের সাথে আমার তুলনা?
জুঁই এর এমন চেঁচানিতে ফারদিন উঠে যায়। আর কান্না শুরু করে দেয়। ফাহাদ ফারদিনের দিকে একবার তাকিয়ে আবার জুঁইয়ের দিকে তাকায়। তারপর ফারদিনকে কোলে নিয়ে জুঁইয়ের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে,
— আসলে কি জানো? আমার লাইফের সবচেয়ে বড় ভুল সিদ্ধান্ত হচ্ছ তুমি। সাথেই আমার জীবনের অভিশাপও। এতদিন না বুঝতে পারলেও এখন বুঝতে পারছি আমি আসলে কি হারিয়েছি৷ তোমার নেশায় অন্ধ ছিলাম বিধায় বুঝতে পারি নি কে রত্ন আর কে কয়লা। এখন বুঝতে পেরে বড্ড আফসোস হচ্ছে৷ বড্ড!
এই বলে ফাহাদ ফারদিনকে কোলে নিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়৷ সে আপাতত থাকতে চায় না জুঁই নামক মানবীর সংস্পর্শেও। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার৷ অসহ্য লাগছে সব কিছু। মনটাও হয়ে উঠেছে অশান্ত৷ তার এখন শান্তি দরকার। কিন্তু এই শান্তি আদৌ তার দেখা দিবে কি না তা তার জানা নেই।
_________________________
রাত প্রায় নয়টা ছুঁই ছুঁই। অহনা নিজের হোমওয়ার্ক করছে। আমি আমার হাতের কাজ সেরে ওর পাশে বসি। আলতো হাতে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেই। অহনা আমার দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসে। অতঃপর কি যেন বলার জন্য ইতস্তত করতে থাকে৷ আমি ওর ইতস্তত ভাবটা বুঝতে পেরে বলি,
— কিছু কি বলবে?
অহনা মাথা নাড়ায়। আমি শান্ত কন্ঠেই জিজ্ঞেস করি,
— কি বলবে বলো?
অহনা নিচু গলায় বলে,
— আমার বাবা বলার মত কেউ নেই কেন? সবারই তো আছে আমার নেই কেন?
#চলবে