আরশি পর্ব-২৭

0
2010

#আরশি
#Part_27
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

— আমার বাবা বলার মত কেউ নেই কেন? সবারই তো আছে আমার নেই কেন?

অহনার কথাটি শুনে বুকটা খাঁ খাঁ করে উঠলো। ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে গেল। ২ বছরের ব্যবধানে শুকিয়ে আসা ক্ষতগুলো পুনরায় তাজা হতে শুরু করে। দূর্বল হয়ে পড়ছি তা কিন্তু না। শুধু একটু বিষন্নবোধ করছি। আমি নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রই অহনার মুখপানে। অহনার চোখে মুখে আজ প্রশ্নের মেলা। থাকাটা অস্বাভাবিক কিছুও নয়। সে এখন বড় হয়েছে, তার ভাবনার পরিসর বড় হয়েছে। চারপাশের অনেক কিছুই তার অজানা। আর এই অজানাকে নিয়ে তার মনে জন্মাতে শুরু করেছে হাজারো প্রশ্নের মেলা। আর আপাতত দৃষ্টিতে এই প্রশ্নের ঝুলিও পেস করার একমাত্র মাধ্যম আমি। আমি বুঝি তার মনের মনোভাব। কিন্তু ওকেই বা আমি কিভাবে বলি? সে যে বাবার খোঁজ করতে চলেছে সে এই আড়াই বছরে একবারের জন্যও তার খোঁজ নেয় নি। জন্মের পর তাকে কোলে নিয়ে আদর করে নি, তাকে ভালোবাসে নি, তাকে কখনো আগলে রাখেনি, তার সাথে কখনো খেলেনি। তাকে কখনো একবেলা বুকে নিয়ে ঘুম পারায় নি, মিষ্টি মুখে দুই-তিনটে কথাও বলেনি। সেই বাবার কথা আমি কিভাবে বলবো অহনাকে? ও কি পারবে এই তিক্ত সত্যিটা মেনে নিতে? পারবে কি সইতে এইসব?

গলার মাঝে আমার কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে আসে। বুক চিরে বেরিয়ে আসতে চায় আর্তনাদ। না আমার জন্য নয়, অহনার জন্য। এই নিষ্পাপ ফুলটির জন্য। যার ভাগ্য কি না এমনই যে, সে জন্মের দুইদিনের মাথায় তার বাবার ছোঁয়া অনুভব করেছিল। কিন্তু এইখানে কথা হচ্ছে, আদৌ কি সেই ছোঁয়ায় বাবার ভালবাসা ছিল? আমার শত ভাবনার মাঝে অহনা আবার জিজ্ঞেস করে উঠে,

— ও আম্মি! বলো না, আমার বাবা নেই কেন? আমার বাবা কোথায়?

আমি এইবার অসহায় দৃষ্টিতে তাকাই অহনার দিকে। সবটা না হলেও এতটুকু বুঝতে পারছি অহনার মন-মস্তিষ্ক থেকে ফাহাদ নামক মানুষটার প্রতিচ্ছবি প্রায় মুছেই গিয়েছে। সকলের ভালবাসা ও আদরের স্তুপের আবরণে ফাহাদের করা ব্যবহারগুলো চাপা পড়ে গিয়েছে। তাই তো আজ ওর মনে এই প্রশ্নটা এসেছে। আমি ধরা গলায় বলি,

— সবার যে সবকিছু থাকতে নেই মামণি। অনেকসময় কিছু কিছু জিনিস না থাকাই শ্রেয়।

অহনা এইবার প্রশ্ন করে উঠে,

— এমন কেন?

আমি এইবার অসহায় কন্ঠে বলি,

— এই প্রশ্নের উত্তর যে আমার কাছেও নেই।

অহনা মুখ ছোট করে বলে,

— তাহলে কি আমার বাবা নেই?

আমি ওর প্রত্যুত্তরে কিছু বলতে চেয়েও পারলাম না। গলা যে আমার ধরে আসছে। অহনা এইবার মন খারাপ করে বলে উঠে,

— জানো আম্মি! স্কুলে যখন আমার বান্ধুবিদের বাবা নিতে আসে, ওদের আদর করে তখন আমার অনেক কষ্ট হয়। ম্যামরা যখন বাবা নিয়ে কিছু বলতে বলে আর আমি কিছুই বলতে পারি না। তখন অন্যরা আমাকে নিয়ে অনেক মজা করে। সেদিন ক্লাসে আনিকা (অহনার বান্ধবী) আমাকে জিজ্ঞেস করছিল আমার বাবা কি করে, আমি কিছুই বলতে পারি নি। এই নিয়েও তারা আমার উপর হেসেছে। আমার তখন অনেক খারাপ লেগেছে।

অহনার কথাগুলো শুনে আমার বুক ভার হয়ে আসে। চোখের কার্নিশ ঘেষে দুইফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে পড়ে। অহনা সহজে নালিশ করে না। যখন অনেক কষ্টে থাকে সে তখনই এইসব কথা গুলো প্রকাশ করে। আজও হয়তো তাই। আমি বুঝতে পারছিলাম না আমার কি করা উচিৎ। ওকে কি সব বলে দিব নাকি সব লুকিয়ে যাব। বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমি একবার অহনার দিকে তাকালাম। মলিন হয়ে আছে তার মুখখানি। মন বলছে, “ওকে কিছু না বলতে। ও কষ্ট পাবে।” অন্যদিকে আবার মস্তিষ্ক বলছে, “ওকে সব বলে দিতে৷ একটু একটু করে কষ্ট পাওয়ার চেয়ে একবারে কষ্ট পাওয়াটাই শ্রেয়। যতদিন যাবে তার প্রশ্নের থলি ভারী হবে, আর যখন সে কোন সন্তোষজনক উত্তর পাবে না তখন বেড়িয়ে পড়বে নিরুদ্দেশের পথে।”

অনেক চিন্তা-ভাবনা করে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম মস্তিষ্কের কথাটাই শুনবো আমি। এরপর যা হওয়ার হবে। অহনা যথেষ্ট বড় হয়েছে। সে মোটামুটি সবই বুঝে। এইটাও নিশ্চিত বুঝবে। আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলি,

— তোমার বাবা আছে মামণি। কিন্তু সে তোমায় ভালবাসে না। তাই তো সে তোমায় আর আমায় ছেড়ে দিয়েছে।

— মানে?

অহনার কথা শুনে আমি ওকে ভেঙ্গে বুঝানোর চেষ্টা করি। ওর আর আমার প্রতি ফাহাদের করা সকল ব্যবহার গুলো ওকে মনে করিয়ে দেই। ওর অমানুষিক রুপটা পুরোপুরি ভাবে তুলে না ধরলেও আংশিকটা তুলে ধরি। বুঝাই তাকে তার বাবা ভালো মানুষ না। খুব খারাপ একজন মানুষ। তাই সে আমাদের ছেড়ে দিয়েছে৷ সে এখন আমাদের কেউ না। তার বাবা কখনো আসবে না আর যদি আসেও সে যাতে তার সাথে না যায়। অহনা সবকিছুই মন দিয়ে শুনতে থাকে। আমি সর্বশেষে বলি,

— একটা কথা মনে রাখবে আমিই তোমার বাবা আর আমিই তোমার মা। আমার ভালবাসাই যথেষ্ট তোমার জন্য। আর আমার কাছ থেকে কখনো তুমি কোন কিছু লুকাবে না। সবকিছু শেয়ার করবে। হোক সেটা খারাপ বা ভালো। প্রমিস করো!

অহনা আমার গলা জড়িয়ে ধরে বলে,

— প্রমিস! আর আমার চাই না ওমন পঁচা বাবা। লাগবে না আমার বাবা। তুমি হলেই আমার হবে, আমার আর কাউকে চাই না।

আমি অহনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকি। মনটা আজ বড় হালকা লাগছে। মনে হচ্ছে কোন বড় এক বোঝা যেন মাথা থেকে নেমে গেল।

_______________________

— এইসব কি জুঁই? তুমি আবার কেন ক্যাশ আউট করেছ? কয়েকদিন আগে না তোমায় আমি ক্যাশ দিলাম।

জুঁই নির্ভয়ে বলে,

— দরকার ছিল তাই বের করেছি৷

— তোমার এমন কি দরকার পড়লো শুনি যে, তোমার এক লক্ষ টাকা ক্যাশ আউট করা লাগলো? কয়েকদিন আগেই না সত্তর হাজার টাকা খরচ করে আসলে? এত জলদি কিভাবে তোমার এতটাকার দরকার পরে?

— তার কৈফিয়ত আমি তোমায় দিতে বাধ্য নই।

— আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমার টাকা উড়িয়ে বলছো আমাকে তুমি কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নয়? বাহ! তুমি জানো তোমার জন্য আমার ব্যাংক ব্যালেন্স প্রায় হাফ হয়ে এসেছে। এতদিনের জমানো আমার কষ্টের টাকাগুলো তুমি চোখের পলকেই শেষ করে দিচ্ছ। আর সেই টাকা গুলো কিসের পিছনে ইনভেস্ট করছো তা জানার অধিকারও আমার নেই?

— হাসালে। কি যেন বললে কষ্টের টাকা এগুলো? লাইক সিরিয়াসলি! সবই যে তোমার অসৎ পথে কামানো টাকা তা বুঝি আমি জানি না? আমি আজ যা খরচ করছি তার দ্বিগুণ তুমি পরের দিন কামিয়ে নিতে পারবে। কোন ব্যাপারই না। তাই এত এমন ভাব করবে না যে তুমি অনেক সৎ। আর এতটাকা জমাচ্ছ কার জন্য? আমার আর ফারদিনের জন্যই তো। তো আমি টাকা গুলো খরচ করলে সমস্যা বা কোথায়?

— ইউ আর জাস্ট ইম্পসিবল।

জুঁই স্বাভাবিক কন্ঠেই বলে,

— হুম আই নো।

ফাহাদ এইবার দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। রাগ হচ্ছে তার খুব। নিত্যদিনই নতুন এক নাটক, ঝামেলা, ঝগড়া। অশান্ত হয়ে উঠেছে এখন সে এইসব থেকে। তার শান্তি দরকার। কিন্তু সেই শান্তি যেন তার কাছে মরিচীকা। একসময় যখন আরশি তার জীবনে ছিল তখন সে ভাবতো সে অশান্তিতে আছে৷ আরশিই তার জীবনের অশান্তি। অথচ অবাক করার বিষয় হচ্ছে তখনকার অনুভূতি আর এখনকার অনুভূতিগুলোর মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ। সে তখন যেটাকে অশান্তি মনে করতো সেটাই ছিল আসল শান্তি। কেন না তার তখন কোন চিন্তা ছিল না। কিছু চাওয়ার আগেই সে সব পেয়ে যেত। সকালের নাস্তা থেকে শুরু করে তার যাবতীয় সকল দরকারী জিনিস। এমনকি তার এক গ্লাস পানিও এনে খেতে হয়নি। আর এখন কিনা সেই এক গ্লাস পানিই অন্যকে এনে খাওয়াতে হচ্ছে। হাহ ভাগ্য! আরশি কখনো অতি দরকার ছাড়া তার কাছে মুখ ফুটে কিছু চায় নি। আর এইদিকে জুঁই এর তো ডিমান্ড দিন দিন বেড়েই চলেছে। সেই সাথে বেড়ে চলেছে ফারদিনের প্রতি তার অনিহা। যার ফলে ফারদিন তার মায়ের ভালোবাসা ঠিক মত উপলব্ধিই করতেই পারছে না৷ আচ্ছা এমনটা কেন হচ্ছে? এমনটা হওয়ার কথা ছিল না তাহলে কেন?

_______________________

সাপ্তাহিক ছুটির দিন আজ। সকাল হতেই ঝুম বৃষ্টি নেমেছে৷ যার রেশ এখনো পুরোপুরি ভাবে কাটে নি। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি এখনো বইছে। হিম হিম ভাব ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। তাই মামাও সুযোগের সৎ ব্যবহার করে আষাঢ় দিনের সবচেয়ে জনপ্রিয় চাহিদা আমার সামনে পেস করে দেয়। খিচুড়ি আর গরুর মাংসের ভুনা। অহনাও তাল মেলায়। দুইজনে এক প্রকার জীদ ধরেই বসে। আজ আমায় খিচুড়ি রাঁধতেই হবে, তা নাহলে তারা আজ কিছুই খাবে না। তাই আমিও আর কথা না বাড়িয়ে তাদের চাহিদা অনুযায়ী দুপুরের খাবারের প্রস্তুতি নিতে থাকি। এর মাঝে মামা ভাইয়া,ভাবীকে আসার জন্য বলে দেয় সাথেই সাদ আর শোভা আন্টিকেও আসার প্রস্তাব দিয়ে ফেলে। সকলে দাওয়াত গ্রহণও করে। তার মতে, মানুষ যত বেশি খাবারের স্বাদ ততোবেশি। সাথে একসাথে খাওয়ার আনন্দই আলাদা। আমিও আর অমত করি নি। আসুক না সবাই, আজ না হয় একসাথেই খেলাম।

দুপুর ৩ টার আগেই সকলে এসে বাসায় হাজির হয়। মূহুর্তেই কেমন হৈ-হুল্লোড় পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে যায় চারপাশে। আদ্র আর অহনা মেতে উঠে খেলায়। আর বড়রা মেতে উঠে আড্ডায়।
খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষে সকলেই ড্রয়িং রুমে ঝাঁক দিয়ে বসে। এই সেই বিষয় নিয়ে গড়ে উঠে আড্ডামহল। দেখতে দেখতে প্রায় বিকেল নেমে আসে। আকাশও ততক্ষণে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। সকলেই আছরের নামাজ পড়ে আবার ড্রয়িং এ বসে। আমি নাস্তার জন্য সকল কিছু কেটে-কুটে রেখে দেই। মাগরিবের পর ঝটপট বানিয়ে দিব বলে। আমি রান্নাঘরে সকল কাজ শেষ করে ড্রয়িং রুমে আসতেই শোভা আন্টির কথাগুলো কর্ণপাত হতেই আমি স্তব্ধ হয়ে যাই। স্থির চোখে তাকিয়ে রই সকলের দিকে।

#চলবে