আর একটিবার পর্ব-১৬+১৭

0
212

#আর_একটিবার
#শোভা_আক্তার(লাভলী)
#পর্ব_১৬

রাতেরবেলা…….
মাহা পড়ার টেবিলে বসে পড়ছে। আগামীকাল ভার্সিটি যাবে ভেবেছে। সে সপ্তাহে ১ দিন বা ২ দিন ভার্সিটি যায়। গিয়ে পুরো সময় আলিয়া ও বিথির সাথেই থাকে। হঠাৎ দরজা ঠকঠক করার শব্দ আসলো। মাহা পারমিশন দিলো ভেতরে আসার। দরজা খুলে মাহার দাদা উঁকি দিলো।
“আসবো দাদুন?”
মাহা দাদাকে দেখে মুচকি হেসে বলল,
“পারমিশন নেয়ার কি আছে? আসো।”
দাদা ভেতরে প্রবেশ করে মাহার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“চাচী পছন্দ হয়েছে তোমার?”
“ভীষণ, উনি খুব ভালো। খুব মিষ্টি করে কথা বলে।”
“মাশা আল্লাহ মাশা আল্লাহ, তুমি না ঘুমিয়ে পড়ছো যে?”
“অনেক পড়া এখনো কমপ্লিট হয়নি তাই পড়ছিলাম। তুমি বলো কোনো কাজ আছে?”
দাদা কিছুটা অপ্রস্তুত হলো। মাহা বিষয়টা বুঝতে পেরে হেসে উঠে দাঁড়াল। আলমারির সামনে গিয়ে ড্রয়ার খুলে চেকবই বের করলো। পড়ার টেবিলে ফিরে এসে বলল,
“কত লাগবে?”
“ভাবছি তোর চাচুর এনগেজমেন্ট করে ফেলি। বিয়ে নাহয় মেয়ের অনার্স শেষ বর্ষের পরীক্ষার পর হবে।”
“হ্যাঁ আইডিয়া ভালো। কত লাগবে বলো আমি পড়ছি।”
“৫ বা ৬ লক্ষ দিলেই হবে।”
মাহা মুখে হাসি ফুটিয়ে রেখে ৬ লক্ষ লিখে চেক সাইন করে দিয়ে দিলো। দাদা খুশিতে আত্মহারা হয়ে মাহাকে মন ভরে দোয়া করে চলে গেলেন। মাহার মাথায় তার মায়ের কথা ঘুরছে। সে সব জানে। কিন্তু মুখ বন্ধ করে সহ্য করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তার বাবার মৃত্যুর সময় মাহা ৪ বছরের ছিল। বাবার ক্যান্সার ছিল। তাই উনি সব সম্পত্তি মাহার নামে করে দেয়। সম্পত্তি যেহেতু মাহার এটার উপর কারো অধিকার নেই। দাদা, চাচু আর ফুপু মিলে মাহার মাকে দ্বিতীয় বিয়ে দেন। উনি রাজি ছিলেন না। কিন্তু হঠাৎ করেই রাজি হয়ে যায়। মাহার মনে ফুপু অনেক ঘৃণা ভরে দেয় তার মায়ের প্রতি। তাই মাহা মাকে দেখলে রেগে যায়। কিন্তু হাজার হলেও উনি তার মা হয়। তারও মায়ের ভালোবাসা পেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সে সৎ বাবার বাসায় যেতে চায় না। তার একটা সৎ ভাইও আছে। খুব মিষ্টি দেখতে তার ভাই। মাঝে মধ্যে মায়ের সাথে আসে। কিন্তু মাহা কথা বলে না। যতদিন বেঁচে আছে এইভাবেই তার জীবন কাটাতে হবে।

পরেরদিন……..
ইর্তেজা দ্রুত গতিতে ভার্সিটি পৌঁছালো। ক্লাসে গিয়ে পুরো ক্লাসে চোখ বুলালো। মাহা কোথাও নেই। আলিয়া ও বিথিকেও দেখা যাচ্ছে না। আফজাল আর রাফসান জানালার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। ইর্তেজা বেঞ্চের উপর ব্যাগ রেখে তাদের দিকে এগিয়ে গেল। রাফসানের বাম কানের পাশে হালকা নীলচে দাগ দেখা যাচ্ছে। ইর্তেজা জিজ্ঞেস করলো,
“তোর কানে কি হয়েছে?”
রাফসান মুখ লটকালো। আফজাল ফিক করে হেসে বলল,
“গতকাল মাহার হাতে মার খেয়ে এমন হয়েছে।”
ইর্তেজাও হেসে উঠলো আফজালের কথা শুনে। রাফসান ভেংচি কাটলো। তখনই স্যার আসলেন ক্লাসে। যে যে যার বেঞ্চে গিয়ে বসে পরলো। প্রায় ১০ মিনিট পর মাহা, আলিয়া ও বিথি আসলো। স্যার তাদের তিনজনকে দেখে ভ্রু কুঁচকে বলল,
“আমি কি জানতে পারি ক্লাসের সময় আপনারা কোথায় ছিলেন?”
মাহা বলল,
“স্যার, ন্যান্সিকে দেখতে গিয়েছিলাম। মাশা আল্লাহ তার চারটে ফুটফুটে বাবু হয়েছে।”
স্যার ভীতু গলায় বললেন,
“ন্যান্সি? কোন ন্যান্সি?”
“ডোন্ট ওয়ারি স্যার আপনার গার্লফ্রেন্ড ন্যান্সি না। আমি তো আমাদের ভার্সিটিতে থাকা বিড়ালটার কথা বললাম। আমি তার নাম ন্যান্সি রেখেছি।”
পুরো ক্লাসে হাসির শব্দ ছড়িয়ে পরলো। স্যার চোখের চশমা ঠিক করে বলল,
“ননসেন্স কোথাকার। যাও বেঞ্চে গিয়ে বসো।”
“থ্যাঙ্ক ইউ স্যার”
তারা গিয়ে নিজেদের সিটে বসলো। ইর্তেজা মাহার দিকে এক নজর দেখে হাসলো। মেয়েটা সত্যি অদ্ভুত। ক্লাস চলাকালীন ইর্তেজা বার বার মাহাকে দেখছিল। মাহা খেয়াল করেছে। কিন্তু তার কাছে বিষয়টা খারাপ লাগছে না।

ভার্সিটির শেষে সবাই এক এক করে ক্লাস থেকে বের হলো। ইর্তেজা দাঁড়িয়ে ব্যাগ গুছাচ্ছিল তখনই মাহা আসলো। ইর্তেজা চোখ তুলে মাহাকে দেখে মুচকি হাসলো। মাহা হাসিমুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মাঝেসাঝে এখানে সেখানে দেখছে। ইর্তেজা ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে বলল,
“কিছু বলবে?”
“হুম, সরি বলতে চাই তোমাকে?”
“কেন?”
“প্রথম দেখা থেকেই রুড ব্যবহার করেছি তোমার সাথে। শুধু তাই না তোমাকে মৃত্যুর রাস্তায় পর্যন্ত ঠেলে দিয়েছিলাম। সবকিছুর জন্যই আই এম সরি।”
ইর্তেজা হেসে বলল,
“এতে সরি বলার কি আছে? আমি এসবে মাইন্ড করি না। যেহেতু গতকালের ঘটনার কথা। আমি জানি তুমি আমাকে মরতে দিতে না। ঠিক সময়ে বলতে ইর্তেজা তোকে মাফ করে দিয়েছি আমি। তুইও মনে রাখবি মাহা কত বড়ো মনের মানুষ।”
মাহা মুখে হাত রেখে শব্দ করে হেসে উঠল। ইর্তেজার ঠোঁটে মুচকি হাসি। মাহা হাসতে হাসতে বলল,
“খুব ভালো মতো চিনেছো আমায় দেখছি।”
“ইর্তেজা প্রথম দেখাতেই বুঝে ফেলতে পারে মানুষটা কেমন। কিন্তু তোমাকে পুরোপুরি চিনতে পারি নি।”
মাহা হাসি থামিয়ে বলল,
“মানে?”
“মানে, গতকাল তুমি তোমার ফুপির সামনে এত শান্ত ছিলে। আমি তো ভেবেছিলাম তুমি তোমার পরিবারের সামনেও তুফান। না-কি পরিবারের সামনে ভদ্র হওয়ার নাটক করো?”
বলেই ইর্তেজা হাসলো। মাহার চেহারায় হঠাৎ বেদনার ছাপ দেখা গেল। ইর্তেজা হাসি থামিয়ে ভাবলো সে ভুল কিছু বলে ফেলল না তো? মাহা এক নজর ঘড়ি দেখে বলল,
“আমার দেরি হচ্ছে আমি আসি।”
বলেই মাহা দ্রুত হেটে ক্লাস থেকে বের হলো।ইর্তেজা অবাক না হয়ে পারলো না। সেও মাহার পেছনে দৌড়ে গেল। মাহা হনহন করে এগিয়ে যাচ্ছে। ইর্তেজা দৌড়ে গিয়ে তার সামনে দাঁড়াল। মাহা থেমে গেল ইর্তেজাকে দেখে।
“আমার কোনো কথায় মন খারাপ হলে সরি। প্লিজ রাগ করো না।”
ইর্তেজার কথা শুনে মাহা মাথা নিচু করে ফেলল।লম্বা নিশ্বাস ফেলে আবার মাথা তুলে বলল,
“আমি ভার্সিটিতে আসি কম। কারণ সবসময় শক্ত থাকতে পারি না। হঠাৎ করে এমন কিছু মনে এসে পড়ে, নিজেকে তখন স্বাভাবিক রাখতে কষ্ট হয়।”
ইর্তেজা এক কদম এগিয়ে মাহার বরাবর দাঁড়াল। ইর্তেজার চোখের দিকে তাকাতেই মাহা নিশ্চুপ হয়ে গেল। এমন নিষ্পাপ ও মুগ্ধকর চাহনি সে আজ পর্যন্ত দেখেনি। ইর্তেজা মাহার চেহারায় চোখ বুলিয়ে বলল,
“তোমাকে সবসময় হাসিখুশি দেখতে ভালো লাগে। এভাবে মন খারাপ করে রাখলে আমার ভালো লাগবে না। তোমার ব্যক্তিগত জীবনের সম্পর্কে জানতে চাই না আমি। আচ্ছা এখন এসব ছাড়ো, ফ্রেন্ডস?”
ইর্তেজা হাত বাড়িয়ে দিলো মাহার দিকে। মাহা এক নজর ইর্তেজার হাতের দিকে তাকিয়ে আবার ইর্তেজার দিকে তাকাল। মুচকি হেসে হাত এগিয়ে দিলো।

———-

সময় নিজের গতিতে গড়িয়ে যাচ্ছে। ইর্তেজা, মাহা, আলিয়া, রাফসান, বিথি ও আফজালের মাঝে বেশ সুন্দর বন্ধুত্ব সৃষ্টি হয়েছে। তারা এখন একে অপরের জানপ্রাণ। ইর্তেজার জন্য মাহা ও তার সম্পর্ক বন্ধুত্ব থেকেও বেশি এটা সে কিছুতেই বলতে পারছে না। মেয়েটার প্রতি ইর্তেজা খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে। মাহার একটুখানি কষ্ট সে সহ্য করতে পারে না। কিছুদিন আগের ঘটনা। একটা ছেলে মাহার জামা নিয়ে বাজে মন্তব্য করেছে ইর্তেজা তাকে মেরে হসপিটাল পাঠিয়ে দিয়েছে। মাহা ইর্তেজার এমন রূপ আগে কখনো দেখেনি। সেদিন থেকে মাহার মনে ভয় সৃষ্টি হয়েছে। ইর্তেজার ভাবসাব তার মোটেও সুবিধার মনে হচ্ছে না।

মাহা গাছের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মাথায় আজ এমন কিছু ঘুরছে যার দ্বারা ইর্তেজার মনের কথা সে জানতে পারবে। কিছুক্ষণ পর রাফসান ও ইর্তেজা আসলো। রাফসান এদিক সেদিক চোখ বুলিয়ে বলল,
“মাহা, বাকিরা কোথায়?”
মাহা মাথা নিচু রেখেই বলল, “জানিনা আমি”
“বলিস কি? আচ্ছা আমি খুঁজে নিয়ে আসি।”
রাফসান চলে গেল। ইর্তেজা মুচকি হেসে মাহার পাশাপাশি দাঁড়িয়ে গাছের সাথে হেলান দিলো। বেশ কিছুক্ষণ সময় কেটে গেল। মাহা এখনো চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ইর্তেজা বিরক্ত হয়ে বলল,
“কি হয়েছে তোর? বলেছি না এভাবে মুখ গোমরা করে রাখবি না? আমার তোকে এভাবে দেখতে মোটেও ভালো লাগে না।”
মাহা তবুও চুপ রইলো। ইর্তেজা হেলান ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“কি হয়েছে মাহা বল আমায়। কেও কিছু বলেছে? নাম বল একবার। তাকে তো আমি….”
“আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে ইর্তেজা।”
ইর্তেজা চমকে উঠল। অবাক দৃষ্টিতে তাকাল মাহার দিকে। রাফসান ও বাকিরাও আসছিল। মাহার কথা শুনে তারাও থমকে গেল। বিথি ও আলিয়া দ্রুত এসে মাহার পাশে দাঁড়াল। বিথি রাগী কন্ঠে বলল,
“কি? তুই আমাদের আগে বলিস নি কেন?”
মাহা মাথা তুলে ইর্তেজার দিকে তাকাল। ইর্তেজার অবাক হওয়ার অংশবিশেষ এখনো শেষ হয়নি। মাহা বিথির দিকে তাকিয়ে বলল,
“হঠাৎ হয়েছে সব।”
“তুই রাজি?”
মাহা ইর্তেজার দিকে তাকিয়ে হুম বলল। চারপাশে নিরবতায় ঢেকে গেল। কারো মুখ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না। ইর্তেজা মাহার বরাবর এসে দাঁড়াল। মাহা অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। ইর্তেজা মাহার গালে হাত রেখে নিজের দিকে চেহারা ঘুরালো। ইর্তেজার চোখের দিকে তাকাতেই মাহা চমকে উঠল। ইর্তেজার চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। ইর্তেজা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“তুই সত্যি রাজি?”
“হুম”
“মন থেকে বলছিস? কেও জোর করেনি তো তোকে?”
মাহা ইর্তেজাকে হালকা করে ধাক্কা দিয়ে বলল,
“এত প্রশ্ন করার কি আছে? বলেছি না আমি রাজি?”
ইর্তেজা রাগে গর্জে উঠল,
“কেন রাজি তুই? বল আমায় কেন রাজি তুই?”
সবাই ভয় পেয়ে গেল ইর্তেজার চিৎকার দেখে। আশে পাশের সবাই হা হয়ে গিয়েছে। মাহা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ইর্তেজার দিকে। ইর্তেজা হনহন করে মাহার দিকে হেটে এসে চোখে চোখ রেখে বলল,
“তুই আজই তোর পরিবারকে বলবি তুই এই বিয়েতে রাজি না।”
ভয়ে মাহার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। তবুও কোনোমতে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে ভ্রু কুঁচকে বলল,
“যেহেতু আমি রাজি তো না বলবো কেন?”
“কারণ আমি বলেছি।”
“আমি তোর কথা কেন শুনবো? কে তুই? শুধুমাত্র বন্ধু তাই না?”
“দেখ মাহা, আমি তর্ক করতে চাই না। তুই না বলবি দিবি নাহলে ভালো হবে না বলে দিচ্ছি।”
সবাই থতমত খেয়ে তাদের তর্কবিতর্ক দেখছে। মাহা ইর্তেজার কলার চেপে ধরে বলল,
“কেন ভালো হবে না শুনি? আমার উপর এত অধিকার ফলাচ্ছিস কেন তুই?”
ইর্তেজা মাহার হাত ঝাড়ি মেরে ছাড়িয়ে চিৎকার করে বলল,
“কারণ আমি ভালোবাসি তোকে।”
সবার মুখ নিমিষেই হা হয়ে গেল। ইর্তেজা আবার বলল,
“তুই অন্য কারোর হলে আমি কি করে বসবো নিজেও জানি না।”
মাহা হঠাৎ ঠাশ করে ইর্তেজার গালে চড় মেরে দিলো। যদিও আস্তে মেরেছে কিন্তু শব্দ বেশ জোরে এসেছে। ইর্তেজা মাহার দিকে তাকাল। মাহার রাগী কন্ঠে বলল,
“তুই পুরুষ না? আগে বলা যেত না এই কথা? তোর এই এক বাক্য শোনার জন্য আমার এত নাটক করতে হলো।”
“নাটক?”
“তো আর কি? তোর কি মনে হয় মাহা এতোই বাধ্য মেয়ে যে পরিবারের কথায় ঢ্যাং ঢ্যাং করে যেয়ে বিয়ে করে ফেলবে?”
কথাটা বলতে সময় লেগেছে কিন্তু মাহার গালে চড় পরতে সময় লাগে নি। মাহা গালে হাত দিয়ে হা হয়ে ইর্তেজার দিকে তাকিয়ে রইল। ইর্তেজা রাগে গজগজ করতে করতে বলল,
“তোর জান টেনে ছিঁড়ে ফেলবো ফা*জিল মেয়ে কোথাকার।”
মাহা মুখ বানিয়ে বলল,
“তুই আমাকে মারলি?”
ইর্তেজা মাহার চোখে চোখ রেখে বলল,
“এখন তো চড় মারলাম। আজকের পর থেকে এমন মজা আবার করলে তোর সাথে কি করবো নিজেও জানি না।”
মাহা গালে হাত রেখেই কেঁদে উঠল। থাপ্পড়টা ভালো মতোই লেগেছে। ইর্তেজার রাগ নিমিষেই শেষ হয়ে গেল। দ্রুত মাহাকে বুকের মাঝে ভরে নিলো। মাহা ইর্তেজার বুকে ইচ্ছে মতো মেরে বলল,
“দূর হয়ে যা আমার সামনের থেকে। লাগবে না তোর ভালোবাসা আমার।”
“চুপ থাক নাহলে আবার আর এক গালে চড় মেরে বসবো।”
মাহা চুপসে গেল। ইর্তেজার বুকে মুখ ডুবিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে। আফজাল আর রাফসান সিটি বাজিয়ে উঠল। বিথি দ্রুত মোবাইল বের করে তাদের ভিডিও করছে। আলিয়া হাসছে তাদের কান্ড দেখে। মাহা একবার মুখ তুলে সবার দিকে তাকাল। জীবনে প্রথম তার লজ্জা লাগছে তার বন্ধুদের সামনে। ইর্তেজাকে ছেড়ে দূরে সরে দাঁড়াল। ইর্তেজা পকেট থেকে রুমাল বের করে মাহার হাত ধরে নিজের কাছে নিয়ে আসলো। পরম যত্নে মাহার চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বলল,
“ভালোবাসার শুরু হলো দুজন দুজনকে চড় মেরে। জানি না ভবিষ্যতে আছে কত মা*রপি*ট করতে হবে তোর কারণে?”
“মা*রপি*ট? হা হা হা নিজেকে দেখেছিস আয়নায়?”
“আর লাগবে না দেখা। যার জন্য জন্মেছি এখন তার হয়েই থাকতে চাই।”
“তুই শিওর তুই আমার জন্য জন্মেছিস?”
“হুম, ইর্তেজা মাহার না তো কারো না।”
“যদি এমন হয়। তাহলো মাহা-ও ইর্তেজার না তো কারো না।”
ইর্তেজা মুচকি হাসলো মাহার কথা শুনে।

———–

বর্তমানে……
মোবাইল টন বাজার শব্দ শুনে ইর্তেজার ধ্যান ভাঙলো। পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখে শ্রাবণ। কিন্তু রিসিভ করার আগেই কেটে গেল। বাদশাহ বলল,
“ভাই এরপর কি হলো? আপনারা আলাদা হলেন কিভাবে?”
“সেটা আর একদিন জানাবো।”
“আমার তো এখনই জানতে ইচ্ছে করছে।”
ইর্তেজা বাদশাহ’র কাঁধে হাত রেখে মুচকি হেসে বলল,
“সব বলবো, আমাদের ভালোবাসা অসম্পূর্ণ কেন রয়েছে আমি জানি না। নিয়তি কেন মাহাকে আবার আমার জীবনে নিয়ে আসলো আমি সেটাও জানি না।”
ইর্তেজা মাহার দিকে তাকিয়ে আবার বলল,
“যদি #আর_একটিবার সুযোগ পাই। ওকে আর নিজের থেকে দূর করবো না।”
ইর্তেজার মোবাইল আবার বেজে উঠল। শ্রাবণ আবার কল করছে। রিসিভ করে কানে ধরতেই শ্রাবণের ধমকের স্বর ভেসে আসলো।
“ইর্তেজা তোমরা কাকে তুলেছো? আয়মান খলিলের স্ত্রী তো এখন তাদের বাসায়।”
তার মানে মাহা আয়মান খলিলের স্ত্রী না। ইর্তেজার মন যেন ঠান্ডা হয়ে গেল। স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
“বস, ভুল অন্য কাওকে তুলে নিয়ে এসেছি আমরা। কিন্তু ইনি আয়মান খলিলের কি হয় আমরা জানি না।”
“ইর্তেজা তোমার উপর আমার বিশ্বাস করা ভুল হয়েছে। ছোট্ট একটা কাজ করতে বলেছিলাম সেটাও পারলে না?”
“সরি বস”
“রাখো তোমার সরি। আমি খোঁজ করি তুমি কাকে তুলেছো। তার আগে মানুষটার খেয়াল রাখো তোমরা।”
“চিন্তা করবেন না বস। নিজের জানপ্রাণ দিয়ে তার রক্ষা করবো।”
শ্রাবণ ভ্রু কুঁচকে মোবাইলের দিকে তাকাল। সে মাঝেমধ্যে ইর্তেজাকে একদমই বুঝতে পারে না। ইর্তেজা মোবাইল পকেটে রেখে মাহার দিকে এগিয়ে গেল। চেহারা থেকে এখনো মায়া ভাব যায়নি। কিন্তু অনেক শুকিয়ে গিয়েছে মাহা। ইর্তেজা মাহার দিকে হাঁটু গেড়ে বসলো। তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে তার মাহার দিকে। ইর্তেজা মাহার ডান হাত ধরলো। কিছু বলার আগেই তার দৃষ্টি মাহার হাতের মেহেদীর দিকে গেল। ডান হাতের তালুতে ইংরেজি বড়ো অক্ষরে লিখা “SHAYAN”। ইর্তেজার চোখে অশ্রু জমে গেল। মাহার হাত আস্তে করে ছেড়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। মাহা তাহলে অন্য কারোর আমানত। ইর্তেজার দম বন্ধ হয়ে আসছে। মাথা ভার হয়ে আসছে তার। রাগ হচ্ছে অনেক রাগ। ইর্তেজা কাঁধে স্পর্শ অনুভব করলো। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে বাদশাহ। বাদশাহ বলল,
“ভালোবাসা পাখির মতো হয়। তাই ভালোবাসাকে খাঁচায় বন্দী করে না রেখে খোলা আকাশে উড়িয়ে দিতে হয়। পাখি যেমন উড়ে নিজের ঠিকানা নিজে খুঁজে নিতে পারে। ঠিক তেমনই, ভালোবাসাও নিজের ঠিকানা নিজে খুঁজে নিতে জানে।”
ইর্তেজা মাহার দিকে তাকাল। চোখের কোণায় জমা অশ্রু গড়িয়ে পড়তেই বলল,
“এর মানে আমার ভালোবাসাও নিজের ঠিকানা খুঁজে পেয়ে গিয়েছে।”
.
.
সন্ধ্যার সময়…..
সাগরিকা খাটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। রাগ, অভিমানে কলিজা ছিঁড়ে কান্না আসছে তার। যতবার বিশ্বাস করে শ্রাবণের উপর। শ্রাবণ ততবার তার বিশ্বাস ভাঙ্গে। হঠাৎ কলিংবেলের শব্দ আসলো। সূর্য বাহিরে গিয়েছিলো। হয়তো সে-ই ফিরে এসেছে। সাগরিকা গিয়ে কে এসেছে জিজ্ঞেস না করেই দরজা খুলল। দরজা খুলতেই তার রাগের পাল্লা আরো ভারি হয়ে গেল। শ্রাবণ দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে। সাগরিকা দরজা বন্ধ করতে নিলেই শ্রাবণ দরজা ধরে থামিয়ে দিলো। সাগরিকা দরজা খুলে রাগী কন্ঠে বলল,
“কি হয়েছে? কি সমস্যা তোমার?”
“বাসায় একা ভালো লাগছে না আমার।”
“তুমি আবার ড্রিংকস করেছো। ওয়াদা করেছিলে ছেড়ে দেবে। যাকগে, আমি আর কোনো কিছুর আশা করবো না তোমার থেকে।”
শ্রাবণ সিগারেট মাটিতে ফেলে নিভিয়ে হেলেদুলে এগিয়ে গেল। সাগরিকা রাগে ফুসছে। হাত আড়াআড়ি ভাবে ভাজ করে দাঁড়িয়ে রইল সে।
“মাফ করে দাও। আর ফিরে চলো প্লিজ।”
“না ফিরলে কি করবে শুনি।”
“এভাবে বলো না। আমার অনেক খালি খালি লাগছিল বাসায়।”
“হ্যাঁ, এই দুঃখে ম*দ খেয়েছো। একটুর মধ্যে দেবদাস হতে ইচ্ছে করে তাই তো?”
শ্রাবণ হেসে মাথা হ্যাঁ সূচক নাড়াল। তখনই সূর্য ফিরে আসলো। শ্রাবণ দেখে বিরক্ত হয়ে বলল,
“ইনি এসেও পরেছে? আমাকে বলল তোমার রাগ কম হলে আসলে। ভুল হয়েছে আমার তাকে কল দেয়া।”
“ভুল তোর না। ও ভালো মতোই জানে তুই ছাড়া আমার কেও নেই। তাই এই বাসা ছাড়া আর কোথাও যাব না আমি।”
“এত বিশ্রী গন্ধ কোথা থেকে আসছে?”
শ্রাবণ নিজের কলার ধরে বলল,
“একটুখানি ম*দ পড়েছিল এখানে।”
“আস্তাগফিরুল্লাহ আপু, আমি ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি। ঘর বাড়ি সবসময় পবিত্র রাখি। আর এই ব্যক্তি… আপু প্লিজ বের করো ওকে।”
“ও কখনো একা ফিরে যাবে না। আমারও যেতে হবে ওর সাথে।”
“কিন্তু আপু…”
“‌সূর্য আমি আবার আসবো। তুই নিজের খেয়াল রাখিস।”
সূর্য আর কিছু বলল না। সাগরিকা শ্রাবণকে ধরে বাসা থেকে বের হলো। বাহিরে গিয়ে সাগরিকা আশে পাশে চোখ বুলিয়ে বলল,
“গাড়ি আনো নি?”
“উঁহু, হেটে হেটে এসেছি।”
“যাক ভালো হয়েছে। এই অবস্থায় ড্রাইভ করে আসলে অঘটন নিশ্চিত ঘটতো।”
সাগরিকা রিকশা ডেকে নিলো। শ্রাবণকে ধরে রিকশায় বসিয়ে নিজেও বসলো। শ্রাবণ একা একা বকবক করেই যাচ্ছে। শতবার সরি বলছে তাকে। পুরো রাস্তা সাগরিকা চুপ ছিল। বাসায় পোঁছে শ্রাবণকে নিয়ে ঘরে গেল সাগরিকা। ঘরে যেতেই তার চোখ কপালে উঠে গেল। আলমারির সব জামা বের হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। খাটও উলটপালট হয়ে আছে। সাগরিকা শ্রাবণকে ধাক্কা দিয়ে খাটে বসিয়ে বলল,
“এসব কি? আমি ঘরবাড়ি যত পরিষ্কার রাখার চেষ্টা করি তুমি তত নোংরা করো।”
“ভু..ভুল হয়েছে, সরি।”
সাগরিকা লম্বা নিশ্বাস ফেলে চুল হাত খোঁপা করতে করতে এগিয়ে গেল। আলমারির সব জামা গুছিয়ে ঠিক মতো রেখে ঘুরে দাঁড়াল। শ্রাবণ উপুর হয়ে শুয়ে একটা বালিশ বুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। সাগরিকা ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল। শ্রাবণের এই ঘুমন্ত চেহারা দেখে মনে হচ্ছে না মানুষটা শত শত পাপ করেছে। সাগরিকা বসলো শ্রাবণের পাশে। আলতো করে শ্রাবণের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। শ্রাবণ এখনো নিষ্পাপ বাচ্চাদের মতো ঘুমিয়ে আছে। সাগরিকার মন গলানোর জন্য এই চেহারাই যথেষ্ট। মুচকি হাসলো সাগরিকা।

চলবে……

#আর_একটিবার
#শোভা_আক্তার(লাভলী)
#পর্ব_১৭

রাত গভীর ইর্তেজা এখনো বাসায় ফিরেনি। ইরিনা আজ ঝর্ণাকে বাসায় যেতে দেয় নি ভয়ে। সে একা কখনো থাকতে পারবে না। ঝর্ণা তার বাসায় কল দিয়ে বলে দিয়েছে আজ আসবে না। ইরিনা হেলান দিয়ে বসে আছে। তার পাশে ঝর্ণা বসে ইরিনার মোবাইল দিয়ে ইউটিউব দেখছে। ইরিনা ঘড়ির দিকে তাকাল। রাত দেড়টা। লম্বা নিশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করলো। সে ১২ টার মধ্যে ঘুমিয়ে যায়। কিন্তু আজ ইর্তেজার চিন্তায় ঘুম আসছে না তার। ঝর্ণার কন্ঠ শুনে ইরিনা চোখ খুলল,
“আপা ফোন আইসে।”
ইরিনা চোখ খুলে ঝর্ণার দিকে তাকাল। দ্রুত তার হাত থেকে মোবাইল নিয়ে দেখে ইর্তেজার কল। রিসিভ করে কানে ধরেই ঝাড়ি মেরে বলল,
“কোথায় তুই? এত টেনশন কেন দিস আমায় বল তো।”
“তুমি ঘুমাও নি এখনো?”
“তুই বাসায় নেই। একটা বার কল দিয়ে বলিসও নি যে আজ আসবি না।”
“চিন্তা করো না। আমি সকালেই এসে পরবো।”
“কোথায় তুই ইর্তেজা? তুই ঠিক আছিস তো?
“আলহামদুলিল্লাহ, তুমি কি একা বাসায়?”
“না ঝর্ণা আছে আমার সাথে।”
“ঠিক আছে তুমি নিজের খেয়াল রেখো। আর ঝর্ণাকে বলো দরজা ভালো মতো বন্ধ করে আসতে।”
“প্লিজ তারাতাড়ি ফিরে আসিস।”
“হুম”
ইর্তেজা কল কেটে দিলো। ইরিনার গলা ধরে আসছে কান্নায়। ঝর্ণার দিকে মোবাইল এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আমি ঘুমিয়ে পরি। তুমি ঘুমানোর আগে দরজা জানালা ভালো মতো দেখে ঘুমিও। ভুল করে খোলা রেখে দিও না।”
ঝর্ণা মাথা নাড়িয়ে মোবাইল নিলো। ইরিনাকে ধরে বিছানায় ভালো মতো শুইয়ে দিয়ে সেও শুয়ে পরলো। ইরিনার চোখে ঘুম নেই। তবুও জোড় করে চোখ বন্ধ করে রাখলো।
.
.
ভার্সিটি যাওয়া হচ্ছে না। পরীক্ষা সামনে। আর সাগরিকা এখনো সব পড়া কমপ্লিট করেনি। খাটের সাথে হেলান দিয়ে বইয়ে চোখ বুলাচ্ছে সে। পাশেই শ্রাবণ ঘুম। বাসায় আসার পর ঘুমিয়েছে আর উঠেনি। কিছুক্ষণ পর শ্রাবণ ধীরে ধীরে চোখ খুলল। সাগরিকার দিকে তাকিয়ে দেখে সে বইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। ম*দের নেশা এখনো কিছুটা আছে শ্রাবণের মাঝে। ধীরে ধীরে উঠে বসলো সে। সাগরিকা শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে বই বন্ধ করে সোজা হয়ে বসলো। শ্রাবণ নেশাগ্রস্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সাগরিকা শ্রাবণের চোখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বলল,
“ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসো।”
শ্রাবণ হাসলো। সাগরিকার হাত নিজের দু’হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
“তুমি কখন এলে? আমি জানতাম আমাকে ছাড়া তুমি থাকতেই পারবে না।”
সাগরিকা প্রথম অবাক হলেও পরে হেসে দিলো। শ্রাবণ তাহলে সব ভুলে গিয়েছে। সাগরিকার হাসি দেখে শ্রাবণ তার কিছুটা কাছে গেল। সাগরিকা তা দেখে হাসি থামিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কি হয়েছে? শুয়ে পরো চুপচাপ।”
শ্রাবণ না সূচক মাথা নাড়াল। সাগরিকার নিজের হাত ছাড়িয়ে বই নিয়ে দ্রুত খাট থেকে নামতে নিলো। কিন্তু শ্রাবণ তার হাত ধরে ফেলল। সাগরিকা চোখ ছোটো ছোটো করে তাকাল শ্রাবণের দিকে। শ্রাবণ ঠোঁট বাচ্চাদের মতো বাঁকিয়ে বলল,
“আবার চলে যাচ্ছো?”
“ইশশ শ্রাবণ, তোমার মতো দামড়া পুরুষের কাছ থেকে আমি এমন ন্যাকামো আশা করি নি।”
শ্রাবণ হেসে উঠল। সাগরিকা বিরক্ত হয়ে বলল,
“যেতে দাও। পালিয়ে যাচ্ছি না বই রাখতে যাচ্ছি।”
শ্রাবণ তবুও ছাড়লো না সাগরিকাকে। সাগরিকা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল,
“ফিরে তোমার কাছেই আসবো।”
শ্রাবণ মুচকি হেসে সাগরিকার হাত ছেড়ে দিলো। সাগরিকা গিয়ে বই রেখে রান্নাঘরে গেল। একগ্লাস চিনি ছাড়া লেবুর শরবত নিয়ে আসলো। শ্রাবণ হেলান দিয়ে শুয়ে আছে। গ্লাস টেবিলের উপর রেখে সাগরিকা শ্রাবণের কাছে আসলো। সাগরিকার উপস্থির টের পেয়ে শ্রাবণ চোখ খুলল। সাগরিকা শ্রাবণের দিকে হাত এগিয়ে দিয়ে ইশারায় বলল খাট থেকে নামতে। শ্রাবণ সাথে সাথে সাগরিকার হাতে হাত রেখে খাট থেকে নামলো। সাগরিকা তাকে বাথরুম নিয়ে গিয়ে শাওয়ারের নিজে দাঁড় করালো। শ্রাবণ হারিয়ে আছে ভালোবাসার জগতে। সে শুধু সাগরিকাকে দেখছে। আশে পাশে কি হচ্ছে সেটার খেয়াল নেই। সাগরিকা শাওয়ার ছেড়ে দিলো। হঠাৎ মাথায় পানি পরায় শ্রাবণ চমকে উঠল। সাগরিকা তাকে ধরে রাগী কন্ঠে বলল,
“চুপচাপ দাঁড়াও। পুরো গা থেকে বাজে গন্ধ আসছে আমি সহ্য করতে পারছি না।”
শ্রাবণ চুপসে গেল। সাগরিকা তাকে গোসল করতে বলে বাথরুম থেকে বের হলো। সেও কিছুটা ভিজেছে। আলমারি থেকে শ্রাবণের জামা বের করে আবার বাথরুমে গেল। শ্রাবণ এখনো শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। সাগরিকা তাকে দাঁড়াতে বলেছিল বলে সে সত্যিই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সাগরিকা নিঃশব্দে হাসলো। মাঝেমধ্যে এমন এমন কাজ করে শ্রাবণ সে না হেসে পারে না।

শ্রাবণ খাটের উপর বসে আছে আর সাগরিকা তার মাথা তোয়ালে দিয়ে মুছে দিচ্ছে। শ্রাবণ বার বার পড়ে যেতে নেয় সাগরিকা ধরে ফেলে। এক সময় ধমক দিয়ে বলল,
“তুমি সোজা হয়ে বসতে পারো না? মাথা ভিজে আছে দেখেছো?”
“আমার অনেক ঘুম আসছে।”
সাগরিকা লম্বা নিশ্বাস ফেলে তোয়ালে বিছানার উপর রেখে দ্রুত গিয়ে শরবতের গ্লাস নিলো। ফিরে আসতে আসতে শ্রাবণ নেতিয়ে পড়েছে। সাগরিকা তার হাত ধরে টেনে তুলে বসালো।
“শ্রাবণ এটা খেয়ে নাও।”
শ্রাবণ সাগরিকার হাতে গ্লাস দেখে নাক মুখ কুঁচকে বলল,
“ইয়াক একদম না।”
“কি বললে?”
সাগরিকা অগ্নি দৃষ্টিতে তাকাল শ্রাবণের দিকে। শ্রাবণ মন খারাপ করে বলল,
“তুমি শুধু অত্যাচার করো আমার উপর।”
“আর নিজে যখন আমার উপর অত্যাচার করো সেটা কি?”
“হয়েছে তো আর কত লজ্জা দিবে?”
“আর দিবো না। এখন লক্ষী বাচ্চাদের মতো হা করো। এটা পুরোটা পান করতে হবে বুঝলে?”
শ্রাবণ নাক মুখ কুঁচকে রেখে কোনোমতে শরবত পান করে নিলো। সাগরিকা মুচকি হেসে শ্রাবণের মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই ওড়নায় টান অনুভব করলো। ঘুরে দেখে শ্রাবণ তার ওড়না দিয়ে মুখ মুছছে। সাগরিকা কিছু বলল না। শ্রাবণ দ্রুত গিয়ে বিছানা গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করলো। সাগরিকা রান্নাঘরে গিয়ে গ্লাস রেখে ঘরে ফিরে আসলো। নিজের জামা বের করে পরিবর্তন করে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলো। শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে দেখে সে ঘুম। সাগরিকা লাইট বন্ধ করে এসে শুয়ে পরলো। শুয়ে চোখ বন্ধ করতেই গায়ে স্পর্শ পেলো। শ্রাবণ সাগরিকার গলায় মুখ ডুবিয়ে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো। সাগরিকা শ্রাবণকে সরানোর চেষ্টা করলো কিন্তু শ্রাবণ সরলো না। সে সাগরিকাকে আরো শক্ত করে ধরে ঘুমিয়ে রইলো। সাগরিকা মুচকি হেসে শ্রাবণকে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করলো।
.
.
ধীরে ধীরে চোখ খুলল মাহা। মাথা ভার হয়ে আছে তার। চারপাশে চোখ বুলালো কিন্তু কেও নেই। সে তো পার্লারে গিয়েছিল হঠাৎ এখানে আসলো কীভাবে বুঝতে পারছে না। কোথায় আছে এখন সেটাও বুঝতে পারছে না। পুরো কক্ষ আবছা আলোয় ঢাকা। ঠিক মতো দেখাও যাচ্ছে না কিছু। মাহা উঠে দাঁড়াল। কোথায় গেলে বাহিরে যাওয়ার রাস্তা খুঁজে পাবে বুঝতে পারছে না। এক কদম এগিয়ে যেতেই মাথা ঘুরিয়ে দিলো তার। পড়ে যেতে নিলো তার আগেই কেও একজন এসে তাকে ধরে ফেলল। মাহা নিভু নিভু চোখে মানুষটার দিকে তাকাল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। এই আবছা আলোয় সে মানুষটা কে বুঝে গিয়েছে। নিজের চোখে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। সে কি স্বপ্ন দেখছে? এটা বাস্তবতা বুঝতে পারলো। মাহা চোখ বড়ো বড়ো এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। তার হাত পা কাঁপছে। কিছু বলতে চেয়েও পারছে না। তার মনে হচ্ছে কেও তার গলা চেপে ধরে রেখেছে। হঠাৎ অতি পরিচিত কন্ঠ ভেসে আসলো,
“অনেকে বলে দুনিয়া খুব ছোটো। আজ মনে হচ্ছে, সত্যি দুনিয়া খুব ছোটো।”
মাহা আশে পাশে দেখে বলল,
“আ..আপনি আমাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছেন? আমার চাচী কোথায়?”
“চাচী? হুম রোকসানা আন্টি। তাই তো উনার ছবি দেখে মনে হচ্ছিল আমি উনাকে চিনি। কিন্তু কোনোমতেই মনে করতে পারছিলাম না।”
“আমার প্রশ্নের উত্তর দিন। আপনি আমাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছেন?”
তখনই চারপাশের লাইট জ্বলে উঠলো। ইর্তেজা দরজার দিকে তাকাল। বাদশাহ লাইট জ্বালিয়েছে। বাদশাহ বলল,
“হয়তো আপু আপনাকে চিনতে পারে নি।”
“তোমার আপু আমাকে অন্ধকারেও চিনে ফেলতে পারে। এখানে তো তাও আবছা আলো ছিল।”
মাহা একবার বাদশাহ’র দিকে তাকাল। আর একবার ইর্তেজার দিকে। তাদের কথা শুনে উঁচু স্বরে বলল,
“হচ্ছেটা কি এখানে? আপনারা আমাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছেন?”
“শান্ত হও মাহা।”
“কেন শান্ত হবো? আমার চাচী, চাচু, সায়ান সবাই কোথায়?”
ইর্তেজার রাগ হচ্ছে। অগ্নি দৃষ্টিতে মাহার দিকে তাকিয়ে বলল,
“একদম চুপ, তোর সব প্রশ্নের উত্তর দেবো।”
মাহা হাতমুঠো শক্ত করে তাকিয়ে রইল ইর্তেজার দিকে। ইর্তেজা নিজেকে শান্ত করে আবার বলল,
“বসো তুমি” আবার বাদশাহ’র দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি ওর জন্য কিছু খেতে নিয়ে আসো।”
মাহা রাগী কন্ঠে বলল,
“আমাকে এখানে ডিনার করাতে নিয়ে এসেছেন আপনারা? আমাকে আমার বাসায় দিয়ে আসেন এখনই।”
ইর্তেজা ধমকের স্বরে বলল,
“দিয়ে আসবো, দিয়ে আসবো তোমাকে তোমার স্বামীর কাছে এবার আল্লাহর ওয়াস্তে মুখ বন্ধ রাখো।”
মাহা চুপসে গেল। ইর্তেজা ঘনঘন নিশ্বাস ফেলছে। কলিজা ফেটে কান্না আসছে তার। বাদশাহ পরিস্থিতি দেখে চলে গেল। মাহা চেয়ারে বসে কপালে হাত দিয়ে বসে রইল। নিয়তি কেন আবার ইর্তেজা আর তার দেখা করালো বুঝতে পারছে না সে। ইর্তেজা মাহার দিকে এগিয়ে আসলো। মাহা সাথে সাথে মাথা তুলে ইর্তেজার দিকে তাকিয়ে বলল,
“দূর, দূর থাকুন আমার থেকে।”
“দূর-ই আছি। দেখো আমায়। কতটা দূর আছি আমি তোমার থেকে। আমাদের মাঝে এতটা দূরত্ব এসে পরেছে যে দূরত্ব কখনো শেষ হবে না। সময়ের সাথে সাথে আরো বাড়তে থাকবে।”
মাহা মুখ ঘুরিয়ে ফেলল। ইর্তেজা মাহার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“অনেক রাগ আমার উপর তাই না? মাহা সেদিন…”
মাহা দ্রুত ইর্তেজার দিকে তাকিয়ে বলল,
“চুপ, আমি কিছু শুনতে চাই না। অতীতে যা হয়েছে আমি সব ভুলে গিয়েছি। এখন নিজের বর্তমান নিয়ে আমি খুব ভালো আছি, খুব।”
“হ্যাঁ আমি জানি। আমি তো শুধু চাই তুই আমাকে মাফ করে দে। আমি পারি নি তোর কথা রাখতে।”
মাহার চোখের কোণায় অশ্রু জমে গেল। মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকাল। সে ইর্তেজাকে নিজের চোখের পানি দেখাতে চায় না। ইর্তেজা মাহার হাতের দিকে তাকাল। ভেজা কন্ঠে বলল,
“তোর হাতে অন্য কারোর নাম দেখে আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে। ভাবতেই খারাপ লাগছে তোর উপর আমার কোনো অধিকার নেই।”
মাহা ইর্তেজার দিকে তাকিয়ে বলল,
“এখন এসব বলে কি লাভ শুনি? আপনার কি মনে হয় আপনার এসব কথা শুনে আমার খারাপ লাগবে কষ্ট হবে? একদম না। আমার রাগ হচ্ছে অনেক রাগ। আপনাকে যতটা ঘৃণা করতাম এখন তার থেকেও বেশি ঘৃণা হচ্ছে।”
ইর্তেজা চোখ মুছে নিলো। উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“শ্রাবণ আহমেদের জন্য কাজ করি আমি। সে আমাকে রোকসানা আন্টিকে কিড*ন্যাপ করতে বলেছে।”
“চাচীকে? কিন্তু কেন?”
“তোর চাচার কাছ থেকে সে একটা জমি কিনতে চায়। কিন্তু তোর চাচা তাকে না করে দিয়েছিল। তাই সে ভেবেছে তার স্ত্রীকে কিড*ন্যাপ করে জোর করে জমি কিনে নিবে। কিন্তু আমরা ভুল করে তোকে তুলে নিয়েছি।”
মাহা দাঁড়িয়ে ইর্তেজার দিকে এগিয়ে আসলো। রাগে শরীর জ্বলছে তার। ইর্তেজার কলার চেপে ধরে বলল,
“গু*ন্ডামি শুরু করেছিস তুই? এত নিচে কিভাবে নামতে পারলি?”
“তুই বুঝবি না। যেদিন আমার প্রতি রাগ কমবে সেদিন বলবো কেন এই পথ বেছে নিয়েছি আমি।”
মাহা ইর্তেজার কলার এক ঝটকায় ছেড়ে বলল,
“এসবের পর তোর প্রতি আমার রাগ কম হওয়া সম্ভব?”
ইর্তেজা না সূচক মাথা নাড়িয়ে ধীরে ধীরে পিছিয়ে গেল। মাহা এক হাত কোমড়ে রেখে আর এক হাত কপালে রেখে ফুপাচ্ছে। ইর্তেজা মাহার উদ্দেশ্যে বলল,
“শ্রাবণ আহমেদ বললেই তোকে তোর স্থানে পৌঁছে দিয়ে আসবো।”
মাহা কপাল থেকে হাত সরিয়ে ইর্তেজার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আর এটা কবে হবে?”
“সকাল বা রাতের মধ্যে হয়ে যাবে।”
“আর রাত পর্যন্ত আমি এইখানে থাকবো তাই তো?”
“আমি শ্রাবণকে বলে জায়গা পরিবর্তন করে নিবো সমস্যা নেই।”
“আমার ভাবতেই অবাক লাগছে, যে ছেলেটা সবাই বলে বেড়াতো পাপ কাজ কর্ম থেকে দূর থাকতে সে নিজেই এখন পাপ পথের পথচারী?”
ইর্তেজা জবাব দিলো না। বাদশাহ আসলো খাবার নিয়ে। ইর্তেজা বাদশাহ’র কাছ থেকে খাবারের প্যাকেট নিয়ে বলল,
“জায়গা পরিবর্তন করবো। কোথায় যাওয়া যায় বাদশাহ?”
“এটা তো স্যারকে জিজ্ঞেস করতে হবে। আর এটা সকালের আগে সম্ভব না।”
ইর্তেজা লম্বা নিশ্বাস ফেলে মাহার দিকে খাবারের প্যাকেট এগিয়ে দিতেই মাহা নাক মুখ কুঁচকে হেটে গিয়ে চেয়ারে বসলো। ইর্তেজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাদশাহকে ইশারায় বলল চলে যেতে। বাদশাহ তাই করলো। ইর্তেজা প্যাকেট খুলে মাহার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,
“তোর ফেভারিট চিকেন বার্গার। রেস্টুরেন্ট থেকে নিয়ে এসেছে কোনো ফুটপাত থেকে না খেয়ে নে।”
মাহা মুখ ঘুরিয়ে ফেলল। ইর্তেজা আর কিছু বলল না। বার্গার প্যাকেটে রেখে একপাশে রেখে দিলো। এগিয়ে গিয়ে মাটিতে বসে দেয়ালের সাথে হেলান দিলো। মাহা তার বরাবর চেয়ারে বিরক্ত চেহারা বানিয়ে বসে আছে।

————-

সাগরিকার ডাকে শ্রাবণের ঘুম ভাঙলো। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে সাগরিকা তার পাশে বসে আছে। শ্রাবণ হেসে সাগরিকার কোলে মাথা রেখে কোমড় জড়িয়ে ধরলো। সাগরিকা বিরক্ত হয়ে শ্রাবণকে সরিয়ে উঠে দাঁড়াল। শ্রাবণ ধীরে ধীরে উঠে বসলো। সাগরিকা রাগী কন্ঠে বলল,
“কাকে কিড*ন্যাপ করিয়েছো শুনি?”
“তুমি এটা শোনার জন্য আমাকে ঘুম থেকে উঠালে।”
“এমনই কিছু। জবাব দাও।”
শ্রাবণ হেলান দিয়ে বসে বিরক্ত চেহারা বানিয়ে বসলো। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সাগরিকাকে সব বলল। সাগরিকা দ্রুত শ্রাবণের পাশে বসে বলল,
“ইর্তেজা কাকে কিড*ন্যাপ করেছে?”
“হয়তো আয়মান খলিলের বোনকে।”
“ওর নাম মেহরুন্নেসা মাহা?”
“হ্যাঁ, তুমি এত কিউরিয়াস হয়ে গেলে কেন হঠাৎ?”
“এইভাবেই। যাও তুমি ফ্রেশ হয়ে আসো আমি নাশতা বানাতে যাই।”
শ্রাবণ মাথা নাড়াল। খাট থেকে নেমে সাগরিকাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দিয়ে চলে গেল। সাগরিকা বিছানা গুছিয়ে মোবাইল নিয়ে ঘর থেকে বের হলো। রান্নাঘরে গিয়ে ইর্তেজাকে কল করলো।

মোবাইল টনের শব্দ শুনে ইর্তেজার ঘুম ভাঙলো। মাহার দিকে তাকিয়ে দেখে মাহা গুটিশুটি মেরে চেয়ারেই শুয়ে আছে। ইর্তেজা মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে সাগরিকার নাম্বার ভাসছে। রিসিভ করে কানে ধরলো।
“আসসালামু আলাইকুম ম্যাম।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কোথায় তুমি ইর্তেজা?”
“আছি আশে পাশেই। বলুন ম্যাম কোনো কাজ আছে?”
“শ্রাবণের কাছ থেকে সব জেনেছি। একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
“জি ম্যাম করুন”
“তুমি যাকে ভুল করে কিড*ন্যাপ করেছো সে তোমার মাহা তাই না?”
ইর্তেজা দ্রুত উঠে বসলো। তার দৃষ্টি মাহার দিকে। সাগরিকা জবাব না পেয়ে বলল,
“হুম বুঝে গিয়েছি। নিয়তি আবার তোমাকে তোমার ভালোবাসার মানুষটার সামনে দাঁড় করিয়েছে। এবার তাকে হাতছাড়া করো না। জানো ইর্তেজা, সবার ভাগ্যে নিজের ভালোবাসার মানুষ লিখা থাকে না। সে সব মানুষগুলো লাকি যাদের ভাগ্যে লিখা থাকে।”
“ম্যাম, আপনার ভাগ্য খুব ভালো আপনি বসকে পেয়েছেন। উনি আপনাকে অনেক ভালোবাসে।”
“জানি, কিন্তু ইর্তেজা মন যখন অন্য কাওকে চায় আর কাওকে ভালো লাগে না।”
“আপনি কি আজও সেই মানুষটাকে ভালোবাসেন?”
“জানি না, আমি শুধু চাই সে ভালো থাকুক। তার পরিবারের কাছে ফিরে যাক। প্রতিদিন তার কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে তার সাথে কাটানো সময় গুলো। কান্না পায় খুব। দেখতে ইচ্ছে করে তাকে। হয়তো ভালোবাসি তাকে। হুম আমি আজমাইনকে আজও ভালোবাসি।”
হঠাৎ দরজার পাশ থেকে শ্রাবণের কন্ঠ ভেসে আসলো, “সাগরিকা”।

ইর্তেজা মোবাইলের দিকে তাকাল। আবার কানে দিয়ে দেখে কল কেটে গিয়েছে। ইর্তেজা দেয়ালের সাথে মাথা ঠেকালো। সে সাগরিকার অনুভূতি বুঝতে পারছে। কারণ সেও এমন পরিস্থিতির শিকার। ইর্তেজা মাহার দিকে তাকাল। মাহা নড়েচড়ে চোখ খুলল। পুরো শরীর ব্যাথা হয়ে গিয়েছে তার চেয়ারে বসে থেকে। সোজা হয়ে বসে দেখে ইর্তেজা তার দিকে তাকিয়ে আছে। মাহা বিরক্ত হয়ে অন্য দিকে তাকাল। বাদশাহ এসে ইর্তেজাকে বলল,
“নতুন জায়গার ব্যবস্থা করে ফেলেছি ইর্তেজা ভাই।”
ইর্তেজা উঠে দাঁড়াল। মাহার দিকে তাকিয়ে বলল,
“লাগবে না। আমি ওকে ওর বাসায় দিয়ে আসবো এখনই।”
মাহা ইর্তেজার দিকে আড়চোখে তাকাল। বাদশাহ অবাক হয়ে বলল,
“শ্রাবণ স্যার আপনার ১২ টা বাজিয়ে দিবে কাজ পুরো না হলে।”
“যা করার করুক। আমি যেটা বলেছি সেটাই হবে।”
মাহা দাঁড়িয়ে বলল,
“চাচুকে আমি মানাবো। উনি নিশ্চয়ই জমি দিয়ে দেবে আমি বললে।”
“ব্যস, প্রবলেম সল্ভ।”
মাহা ইর্তেজার দিকে তাকাল। ইর্তেজা এদিক সেদিক দেখে মাহার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি তৈরী হয়ে নাও। আমি আসছি কিছুক্ষণের মধ্যে।”

শ্রাবণ সাগরিকার দিকে তাকিয়ে আছে। সাগরিকা হাত আড়াআড়ি ভাবে ভাজ করে জ্বলন্ত চুলার দিকে তাকিয়ে আছে। শ্রাবণ সাগরিকাকে ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
“তুমি এখনো আজমাইনকে ভুলো নি?”
সাগরিকা শ্রাবণের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“কেন ভুলবো? সে তো প্রতারণা করেনি আমার সাথে। বরং আমাকে বাঁচাতে গিয়েই তোমার ফাঁদে পড়েছে। আর তুমি আজও তাকে বন্দী করে রেখেছো।”
শ্রাবণের মুখে অপরাধী ভাব ফুটে উঠলো। সাগরিকা শ্রাবণের হাত সরিয়ে বলল,
“আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না শ্রাবণ। কারণ জানো? তোমার প্রতি আমি দুর্বল হয়ে পড়েছি। হ্যাঁ আমি সত্যি বলছি। যবে থেকে আমার মিসক্যারিজ হয়েছে আমি যেন অন্য রকম হয়ে গিয়েছি। তোমাকে দেখলে আর ঘৃণা হয় না আমার। আবার ভালোও বাসতে ইচ্ছে করে না। শ্রাবণ আমার এই রিকুয়েষ্টটা রাখো প্লিজ। তুমি তো বলেছো তুমি ভালো হয়ে যাবে। তাহলে আজমাইনকে ছেড়ে দাও প্লিজ। আমি সবসময় তোমার হয়ে থাকবো।”
শ্রাবণ অন্য দিকে তাকাল। তার বুকের বা পাশ ব্যাথা করছে খুব। সাগরিকা হঠাৎ শ্রাবণকে জড়িয়ে ধরলো। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,
“তুমি তো জানতে তার অবস্থা। তার মায়ের একমাত্র ছেলে সে। একজন মায়ের জন্য কত কষ্টের বিষয় হতে পারে এটা যে তার ছেলে হঠাৎ করে উধাও হয়ে গিয়েছে। তুমি ওকে ছেড়ে দাও প্লিজ।”
শ্রাবণ সাগরিকার কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে দ্রুত রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে পরলো। সাগরিকা শ্রাবণের যাওয়ার পথে তাকিয়ে থেকে লম্বা নিশ্বাস ফেলল। চোখের পানি মুছে কাজে মন দিলো।

সাঈদ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাথা আছড়াচ্ছে। আজ সে কলেজ যাবে। আগের থেকে অনেকটা সুস্থ হয়ে গিয়েছে। দ্রুত তৈরী হয়ে ঘর থেকে বের হলো। মা বাবার সাথে নাশতা করে বেরিয়ে পরলো। ইরিনাকে কতদিন হলো দেখে না। মন ছটফট করছে তাকে এক নজর দেখার জন্য। ভেবেছে কলেজের ছুটির পর যাবে। কলেজ পৌঁছে সাঈদ পার্কিং প্লেসে বাইক পার্ক করে ঘুরে দাঁড়াল। ঘুরতেই দেখে জেসমিন দাঁড়িয়ে আছে। সাঈদ বিরক্ত হলো কিন্তু চেহারায় প্রকাশ করলো না। হাসিমুখে বলল,
“গুড মর্নিং স্টুডেন্ট।”
জেসমিন জবাব দিলো না। সাঈদ আর কিছু বলল না পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলো। হঠাৎ জেসমিন তার হাত ধরে ফেলল। সাঈদ পেছনে ফিরে দেখে জেসমিন মুখ লটকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সাঈদ দ্রুত নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো।
“কি হয়েছে তোমার?”
জেসমিন এখনো জবাব দিলো না। হঠাৎ সাঈদকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো। সাঈদ থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জেসমিন ফুপাতে ফুপাতে বলল,
“আপনি অসুস্থ ছিলেন। জানেন আমার কত কষ্ট হচ্ছিল?”
সাঈদ নিজেকে ছাড়িয়ে বলল,
“এই কেমন বেয়াদবি জেসমিন? তোমার সাহস কি করে হলো আমাকে জড়িয়ে ধরার।”
“অনেক হয়েছে। আপনি আজ স্পষ্ট শুনে রাখুন। আমি আপনাকে ভালোবাসি। আর আপনাকেও আমাকে ভালোবাসতে হবে।”
সাঈদ রাগে গজগজ করছে। জেসমিন আবার বলল,
“আপনি আমাকে ভালো না বাসলে আমি বি*ষ খেয়ে ম*রে যাব।”
সাঈদ সজোরে জেসমিনের গালে চড় বসিয়ে দিলো। জেসমিন গালে হাত দিয়ে সাঈদের দিকে তাকিয়ে আছে। সাঈদ রাগে কটমট করতে করতে বলল,
“আজকের পর থেকে আমার চোখের সামনে আসবে না তুমি। আমি আজই তোমার বাবাকে বলে কলেজ থেকে রিজাইন নিচ্ছি।”
বলেই সাঈদ হনহন করে হাঁটা ধরলো। রাগে গা জ্বলছে তার। জেসমিন হাতমুঠো শক্ত করে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে তার বাবাকে কল করলো। বাবা কল রিসিভ করতেই কান্না জড়িত কন্ঠে বলল,
“আব্বু”
“কি হলো মামনি কাঁদছো কেন তুমি?”
“আব্বু সাঈদ স্যার আমার সাথে জোরাজুরি করেছে। হি ট্রাইং টু রেই*প মি।”

চলবে…….