আর একটিবার পর্ব-২০+২১

0
207

#আর_একটিবার
#শোভা_আক্তার(লাভলী)
#পর্ব_২০

সাঈদ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কলেজের প্রত্যেক স্যার ম্যাডামরা তার দিকে তাকিয়ে আছে। সাঈদ চোখ ঘুরিয়ে জেসমিনের দিকে তাকাল। সে তার ক্লাসের এক ম্যামকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। জেসমিনের বাবা অর্থাৎ প্রিন্সিপাল স্যার এখনো আসে নি কলেজ। একজন স্যার ঘৃণিত কন্ঠে বলল,
“আমার লজ্জা করছে। নিজের স্টুডেন্টদের সাথে কেও এমন জঘন্য কাজ করে?”
সাঈদ তার কথা শুনে রাগী কন্ঠে বলল,
“জেসমিন সবাইকে সত্য কথা বলো নাহলে ভালো হবে না বলে দিচ্ছি।”
জেসমিন ম্যামের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“দেখলেন ম্যাম কেমন ব্যবহার করছে আমার সাথে? আমাকে মিথ্যে কথা বলতে বলছে।”
সাঈদ তেড়ে যেতে নিলো। তখনই একজন স্যার এসে সাঈদকে ধাক্কা দিয়ে বলল,
“খবরদার, আমাদের সামনে নোংরামি করার চেষ্টা করলে এখানেই মে*রে মাটিতে পুঁতে ফেলবো।”
সাঈদ চিৎকার করে বলল,
“আমি তার সাথে কিছু করি নি আপনারা কেন বিশ্বাস করছেন না? ও প্রিন্সিপাল স্যারের মেয়ে বলে আপনারা ওর হয়ে কথা বলবেন? অথচ আপনারা জানেন আমি কেমন মানুষ।”
এক শিক্ষিকা বললেন,
“না, আমরা আপনাকে এখনো চিনি নি। চিনলে তো ভালোই হতো। একটা মেয়ের সম্মান নিয়ে খেলা করতে পারতেন না।”
সাঈদ অবাকের উপর অবাক হচ্ছে। এনারাই সেই মানুষ যারা সাঈদের প্রশংসা করে ক্লান্ত হতেন না। জেসমিন কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“আমাকে উনি প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছেন৷ আমি না বলায় আমার সাথে…”
এইটুকু বলে আবার কাঁদতে লাগলো। সাঈদ অবাক হয়ে বলল,
“তুমি এত নিচে নেমে গেলে জেসমিন?”
তখনই এক স্যার সাঈদের কলার ধরে বলল,
“নিচে তো তুই নামলি। তোর ছোটো বোনের বয়সি এক মেয়ে সে। আরে তুই কি বুঝবি এক মেয়ের সম্মানের সম্পর্কে রে*পিস্ট কোথাকার।”
সাঈদ নিজেকে ছাড়িয়ে বলল,
“আমি তার সাথে কিছু করি নি”
সেই স্যার কিছু বলতে যাবে তার আগেই প্রিন্সিপাল স্যার আসলেন।
“থামুন আপনারা”
সবাই স্যারকে দেখে সরে দাঁড়ালেন। জেসমিন দৌড়ে গিয়ে তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। সাঈদ হাতমুঠো শক্ত করে মাথা নিচু করে রেখেছে। তার ঘৃণা লাগছে খুব। জেসমিন বাবার দিকে তাকিয়ে কিছু বলার আগেই বাবা বললেন,
“আপনারা প্লিজ বাহিরে যান আমি সাঈদের সাথে একা কথা বলতে চাই।”
একজন স্যার বললেন,
“ওকে স্যার, প্লিজ ও আপনার প্রিয় ছাত্র ছিল বলে ছেড়ে দেবেন না।”
সবাই এক এক করে চলে গেল অফিস রুম থেকে। জেসমিন যেতে নিলো কিন্তু বাবা তার হাত ধরে বলল,
“তুমিও থাকো। তোমার সাথেও কথা আছে।”
জেসমিন ঢোক গিলল। প্রিন্সিপাল স্যার দরজার বন্ধ করে এগিয়ে গেলেন। নিজের চেয়ারে বসে জেসমিনের উদ্দেশ্যে বললেন,
“সাঈদ কি করেছে তোমার সাথে সব বলো আমায়।”
জেসমিন আমতা আমতা করে বলল,
“উনি..উনি আমায় প্রে..প্রেমের প্রস্তাব দি..দিয়েছিলেন। আমি উ..উনাকে খুব সম..সম্মান করি বলে কাওকে কি..কিছু বলি নি। আজ..আজ আবার প্রপোজ করায় আ..আমি হুমকি দি..দিয়েছি যে আব্বুকে ব..বলে দিবো। এটা বলায় উনি… ”
“হয়েছে, সাঈদ এখন তুমি বলো।”
জেসমিন উঁচু স্বরে বলল,
“উনার কথা শুনতে চাচ্ছো? এখন বানিয়ে বানিয়ে আমার নামে বাজে কথা বলবে।”
“চুপ থাকো তুমি। সাঈদ তুমি বলো।”
সাঈদ মাথা নিচু রেখেই বলল,
“আমি ওর সাথে কিছু করি নি স্যার।”
“আব্বু ও মিথ্যে বলছে।”
প্রিন্সিপাল স্যার উঠে দাঁড়িয়ে জেসমিনের দিকে এগিয়ে গেল। জেসমিন ভয়ে এদিক সেদিক দেখছে। উনি পকেট থেকে মোবাইল বের করে একটা ভিডিও অন করে জেসমিনের হাতে দিলো। পার্কিং প্লেসে যা যা হয়েছে সব মোবাইলের স্ক্রিনে ভাসছে। জেসমিন কাঁপতে শুরু করলো। সাঈদ মাথা উঁচু করে প্রিন্সিপাল স্যারের দিকে তাকাল। প্রিন্সিপাল স্যার জেসমিনের হাত থেকে মোবাইল নিয়ে বলল,
“আমাদের পুরো কলেজে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো। তোমার কি মনে হয় কারো নামে মিথ্যে অপবাদ দেবে আর আমি বিশ্বাস করে নিবো তুমি আমার মেয়ে বলে?”
জেসমিন মাথা নিচু করে ফেলল। সাঈদ চোখ গড়িয়ে পানি পরছে। প্রিন্সিপাল স্যার তার দিকে তাকাতেই সাঈদ চোখ মুছে মাথা নিচু করে ফেলল। স্যার তার দিকে হেটে এসে হাতজোড় করে বললেন,
“মাফ করে দিও সাঈদ।”
সাঈদ দ্রুত স্যারের হাত ধরে বলল,
“স্যার প্লিজ, প্লিজ আমাকে আর লজ্জিত করবেন না। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে যে। জীবনে প্রথম আমার লজ্জা করছে আপনার সামনে দাঁড়িয়ে। আজ যদি আপনি প্রমাণ না পেয়ে জেসমিনের কথায় বিশ্বাস করে নিতেন। আত্ম*হ*ত্যা করতে হতো আমার।”
“আল্লাহ না করুক। তুমি কেমন মানুষ আমি জানি। আমার তো ওকে নিজের মেয়ে বলতে লজ্জা করছে।”
জেসমিন ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। প্রিন্সিপাল স্যার ধমকের স্বরে বললেন,
“একদম চুপ। খবরদার ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করবে না তুমি। আমার ঘৃণা হচ্ছে তোমাকে দেখে। একবারো এটা ভাবলে না সবাই সত্যিটা জেনে গেলে তোমার বাবার মানসম্মান মাটিতে মিশে যাবে?”
জেসমিন ফুপাতে ফুপাতে বলল,
“তো উনি কেন আমার কথায় রাজি হলেন না? আমি উনাকে অনেক ভালোবাসি।”
সাঈদ হাতমুঠো শক্ত করে মুখ ঘুরিয়ে ফেলল। স্যার হনহন করে এগিয়ে গিয়ে জেসমিনের গালে সজোরে থাপ্পড় মেরে বললেন,
“চুপ বেয়াদব মেয়ে। নিজের বয়স দেখেছো একবার? লজ্জা করে না নিজের বাবার সামনে এসব বলতে?”
জেসমিন গালে হাত দিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। সাঈদ জেসমিনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভালোবাসা এভাবে হাসিল করা যায় না। আমাকে তোমার ভালো লাগে বলে ভাবছো তুমি আমাকে ভালোবাসো? এটাকে ভালোলাগা বলে ভালোবাসা না।”
“তাহলে কি আমাকে আপনার ভালো লাগে না?”
“আমার উপর এত বড়ো অপবাদ দেয়ার পর তুমি এটা আমাকে জিজ্ঞেস করছো জেসমিন?”
“মাফ করে দিন আমায়। আপনি আমাকে থাপ্পড় দেয়ায় আমার খুব রাগ হয়েছিল।”
“তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলে। আপনি তোমার শিক্ষক হই জেসমিন। আমি তোমাকে কখনো ওই নজরে দেখি নি।”
জেসমিন কিছুটা এগিয়ে এসে বলল,
“আমাকে ভালোবাসা যায় না?”
প্রিন্সিপাল স্যার চেয়ারে বসে মাথা নিচু করে ফেললেন। নিজের মেয়ের কান্ড দেখে উনার লজ্জা লাগছে। সাঈদ জেসমিনের দিকে নরম স্বরে বলল,
“এক মনে শত জনকে জায়গা দেয়া যায় না জেসমিন। আমি অন্য কাওকে ভালোবাসি।”
জেসমিন নিজের জামা আঁকড়ে ধরলো। সাঈদ প্রিন্সিপাল স্যারের দিকে তাকিয়ে বলল,
“স্যার আমাকে পারমিশন দিন। আমি আর এই কলেজে থাকতে চাই না।”
প্রিন্সিপাল স্যার সাঈদের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আমি এতটাই লজ্জিত যে, তোমাকে থামাতেও পারবো না। পারলে ক্ষমা করে দিও আমায়।”
সাঈদ স্যারের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“আপনি আমাকে যে শিক্ষা দিয়েছেন সেটা কখনো ভুলবো না।”
স্যার সাঈদের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“ঠিক এই শিক্ষা আমার মেয়েও দিয়েছিলাম। কিন্তু সে সেটা অনেক আগেই ভুলে গিয়েছে হয়তো।”
জেসমিন মাথা নিচু করে কাঁদছে। সাঈদ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে জেসমিনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“মানুষ ভুল থেকেই সঠিক কাজ শিখে। আমি ক্ষমা করে দিয়েছিলাম তাকে। জেসমিন ডাক্তার হতে চায় তাই না? দেখবেন ও একদিন আপনার গর্বের কারণ হবে।”
জেসমিন মাথা তুলে সাঈদের দিকে তাকাল। সাঈদ মুচকি হেসে আবার স্যারের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আসি স্যার, আপনাকে ধন্যবাদ।”
বলেই সাঈদ হাঁটা ধরলো। জেসমিনের ডাকায় থেমে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে জেসমিন কান ধরে রেখেছে। মাথা নিচু করে বলল,
“আই এম সরি”
“নারীদের জন্য সম্মান সবচেয়ে বড়ো সম্পদ। এটাকে খেলা মনে করো না কখনো। আসি, ভালো থেকো।”
দরজা খুলে বাহিরে গেল সাঈদ। সবাই একজোট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সাঈদ মাথা নিচু করে হাঁটা ধরলো। তখনই পেছন থেকে কেও একজন ডাকলো তাকে। পেছনে ফিরে দেখে সেই স্যার যে তার কলার ধরেছিল। উনি অপরাধী কন্ঠে বললেন,
“আমরা সিসিটিভি ফুটেজ চেক করেছি। মাফ করে দিও আমাদের।”
“বিষয় যখন একটা মেয়ের সম্মানের ছিল আপনার জায়গা আমি থাকলে ঠিক এমনই রিয়েক্ট করতাম।”
“তুমি সত্যি চলে যাচ্ছো কলেজ থেকে।”
“আজকের দিনটা আমার জীবনের এক কালো অতীত হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি এখানে থাকলে বার বার এদিন মনে পরবে। আমি যত দ্রুত সম্ভব ভুলে যেতে চাই। আসি ভালো থাকবেন আপনারা।”
সাঈদ ঘুরে আবার হাঁটা ধরলো। বুক এখনো ভারী হয়ে আছে তার৷ মন ভরে কাঁদতে পারলে ভালো লাগতো তার।
.
.
ক্ষুধায় পেট ব্যাথা করছে মাহার। ইর্তেজা এখনো আসেনি। চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পায়চারি করতে লাগলো। বাদশাহ দরজার পাশে চেয়ারে বসে মোবাইল টিপছে। মাহাকে দেখে বলল,
“আপু কিছু লাগবে আপনার?”
মাহা বাদশাহ’র কথা শুনে থেমে গেল। এদিক সেদিক দেখে বলল,
“আমার সাথে কথা বলছো?”
“হ্যাঁ, আপনি ছাড়া তো আর কোনো আপু নেই এখানে।”
“বাহ আই এম ইমপ্রেস। কিড*ন্যাপাররা এত ভালো হয় আগে জানা ছিল না।”
“আপনাকে তো অত্যাচার করার জন্য নিয়ে আসি নি আমরা। একটা কাজের জন্য নিয়ে আসা হয়েছে। হয়ে গেলেই আপনাকে আপনার বাসায় আমরা নিজে গিয়ে দিয়ে আসবো।”
“আচ্ছা তোমাদের বস এর মাথায় কি কোনো সমস্যা আছে? মানে কিড*ন্যাপ করিয়ে জায়গা কেনার বিষয়টা মাথার উপর দিয়ে গেল।”
“আয়মান খলিলের কাছ থেকে যখন স্যার জমি কিনতে চেয়েছিল সে না করে দেন। শুধু না করেন না স্যারকে যা তা বলে অপমান করে। স্যার মাথা গরম রাখার মানুষ। রাগের বশে উল্টা পাল্টা চিন্তা ভাবনা করেন। উনি উনার স্ত্রীর জন্য ভালো মানুষ হতে চান। নতুন কাজ শুরু করবে ভেবেছে। তাই উনার এই জায়গাটা দরজার।”
“এই জায়গাই কেন? দুনিয়াতে জায়গার অভাব?”
“কারণ হচ্ছে আয়নার খলিল উনাকে অপমান করেছে। তাই উনার জেদ এই জায়গাই লাগবে।”
“ওওও এখন বুঝলাম। আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করি? প্রমিজ করো ইর্তেজাকে বলবে না।”
“বলেন”
“ইর্তেজা কি বিয়ে করেছে?”
“তা তো জানি না। কিন্তু ইর্তেজা ভাই কার সাথে যেন কথা বলে ফোনে।”
মাহা ভাবলো সেও কয়েকবার খেয়াল করেছে ইর্তেজাকে। তার মানে কি সে ইর্তেজার বউ? আবার প্রেমিকাও হতে পারে। মাহার ভেতরে অস্থিরতা কাজ করছে। তখনই ইর্তেজা আসলো। মাহাকে হারিয়ে থাকতে দেখে চোখের সামনে তুড়ি বাজাল। মাহা চমকে উঠে ইর্তেজার দিকে তাকাল। থমকে গেল কিছুক্ষণের জন্য। ইর্তেজার ঘন দাঁড়ি উঠেছে। খুল গুলো এলোমেলো। আগে থেকে একটু মোটা হয়েছে। মাহার আফসোস হলো সে আর ইর্তেজা শুটকি, কাঁচা মরিচ, লম্বা বাঁশ বলে রাগাতে পারবে না। ইর্তেজা বলল,
“চলো বাসায় যাবে।”
মাহার মন খারাপ হয়ে গেল। চলে যাবে বাসায়? চলে গেলে তো আর দেখা পাবে না ইর্তেজার। ইর্তেজা বাদশাহ’র দিকে তাকিয়ে বলল,
“বস কল দিলে সত্যি কথা বলে দিও।”
“স্যার খুব রাগ করবে কাজ পুরো না হলে।”
“আমি আছি তো। আমি বস’কে যেভাবেই হোক এই জায়গা নিয়ে দেবো।”
ইর্তেজা মাহার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি বাহিরে যাই তুমি আসো।”
বলেই ইর্তেজা বাহিরে গেল। বাদশাহ লম্বা নিশ্বাস ফেলে মাহাকে বলল চলে যেতে। মাহা আশে পাশে চোখ বুলিয়ে দ্রুত গোডাউন থেকে বের হলো। বাহিরে এসে শান্তির নিঃশ্বাস ফেলল। সামনে তাকিয়ে দেখে ইর্তেজা ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে সিগারেট। মাহা দাঁতে দাঁত চেপে ধরলো। এখনো সিগা*রেট খাওয়ার নে*শা যায় নি তার। হনহন করে এগিয়ে গিয়ে বলল,
“আশা করছি তোর কিডনি গুলো ঠিক আছে।”
ইর্তেজা ঘাড় ঘুরিয়ে মাহার দিকে তাকাল। মাহার রাগী দৃষ্টি দেখে মুচকি হাসলো। সিগারেট মাটিতে ফেলে নিভিয়ে বলল,
“হুম ঠিক আছে। আচ্ছা রিকশা নেবো না-কি হেটে যাবি।”
“রিকশা নে আমি হাঁটতে পারবো না।”
ইর্তেজার হাসি উড়ে গেল। বিরক্ত হয়ে বলল,
“ভাবলাম বলবি হেটে যাওয়ার কথা। আমার কাছে টাকা নেই ভাড়া দিতে পারবো না।”
“আজব তো তুই জানিস না যেন আমি হাঁটতে পারি না? একটু মধ্যে ক্লান্ত হয়ে যাই।”
“অলস কোথাকার। হাঁট চুপচাপ।”
বলেই ইর্তেজা হাঁটা ধরলো। মাহা হা হয়ে গেল ইর্তেজার কান্ড দেখে। সেও দৌড়ে গেল তার পেছনে।
.
.
ইরিনা নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। সে তার আঙুল নাড়াতে পারছে। ইর্তেজা থাকলে অনেক খুশি হতো। কিছুক্ষণ আগে তার ইর্তেজার সাথে কথা হয়েছে। সন্ধ্যার পর ফিরবে। ঝর্ণা আসলে ঘরে।
“আপা সাঈদ ভাই আইসে।”
সাঈদ এসেছে শুনে ইরিনার মন আরো ভালো হয়ে গেল। সাঈদ ঝর্ণার পাশ কাটিয়ে ঘরে আসলো। আজ সাঈদ পারমিশনও নেয় নি। মাথা নিচু করে এসে খাটে বসলো। ইরিনা তাকিয়ে আছে তার দিকে। সাঈদকে দেখে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। সাঈদ মাথা নিচু রেখেই ঝর্ণাকে বলল একগ্লাস ঠান্ডা পানি নিয়ে আসতে। ঝর্ণা গেল পানি নিয়ে আসতে। ইরিনা বলল,
“কি ব্যাপার? ঠিক আছো তুমি?”
সাঈদ জবাব দিলো না চুপচাপ বসে আছে। ঝর্ণা পানি নিয়ে আসলো। সাঈদ গ্লাস নিয়ে ঝর্ণাকে বলল চলে যেতে সে কিছু কথা বলতে চায় ইরিনার সাথে। ঝর্ণা চলে গেল। সাঈদ তিন নিশ্বাসে পানি শেষ করে গ্লাস রাখলো। ভেতর থেকে ঠেলে কান্না বের হতে চাচ্ছে। ইরিনার সামনে কান্না করা কি ঠিক হবে তার? ইরিনার ভয় করতে শুরু করলো। সাঈদের হঠাৎ কি হয়েছে সে বুঝতে পারছে না। ইরিনা আবার বলল,
“কি হয়েছে সাঈদ? তুমি চাইলে আমাকে বলতে পারো।”
সাঈদ ইরিনার দিকে তাকাল। চোখ দুটো তার লাল হয়ে আছে। ইরিনার ভয় বাড়লো। সাঈদ লম্বা নিশ্বাস ফেলল। তার চোখের কোনায় পানি জমে চোখ টলমল করছে। চোখ নিচু করে ইরিনাকে সব বলল। ইরিনা থতমত খেয়ে বসে আছে। সাঈদ শেষে হাতমুঠো শক্ত করে বলল,
“আমি বিদেশ থেকে এসেছি। তবুও নিজের চরিত্র খারাপ হতে দেই নি। আর আজ আমার উপর এত বড়ো অপবাদ দিলো একজন।”
সাঈদ নিচের ঠোঁট কামড় দিয়ে ধরে কেঁদে দিলো। ইরিনার কলিজা মোচড় দিয়ে উঠল সাঈদের কান্না দেখে। সাঈদ গালে হাত রেখে কান্না জড়িত কন্ঠে বলল,
“সাঈদ অপবাদ দিলেও তুমি নির্দোষ প্রমাণ হয়েছো। মহান আল্লাহ তায়ালা ভালো মানুষদের সাথে কখনো খারাপ হতে দেন না।”
“যদি নির্দোষ প্রমাণ না হতাম আমার আত্ম*হ*ত্যা করতে হতো।”
ইরিনা সাঈদের হাত জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রেখে কেঁদে উঠে বলল,
“প্লিজ এসব বলো না। তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি..” ইরিনা সাথে সাথে প্রসঙ্গ পাল্টে বলল “তোমার আম্মু আব্বুর কি হবে বলো।”
সাঈদ ইরিনার দিকে তাকাল। তার এখন শান্তি অনুভব হচ্ছে। ইরিনা খেয়াল করলো সে সাঈদকে ধরে রেখেছে। দ্রুত ছেড়ে চোখ মুছে বলল,
“এসব পরিস্থিতিতে আবার পরলে কখনো হার মানবে না বুঝলে? নিজের ও আল্লাহর উপর ভরসা রাখবে সবসময়।”
সাঈদ চোখ মুছে মাথা নাড়াল। লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল,
“আমি আম্মু আব্বুকে কখনো এই কথা বলতে পারবো না। উনারা অনেক কষ্ট পাবেন। খুব অস্থির লাগছিল আমার। আপনার সাথে শেয়ার করে শান্তি লাগছে।”
ইরিনা মাথা নিচু করলো। সাঈদের ইচ্ছে করছে ইরিনাকে নিজের মনের কথা বলতে। কিন্তু তার মনের ভয় তো কাটে নি। ইরিনা যদি রাগ করে। আচ্ছা ইরিনা কি তাকে ভাই ভাবে? সাঈদের খুব বিরক্ত লাগছে। যাকে নিজের জানপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসে সে যদি ভাই মনে করে কেমন লাগে তখন। ইরিনা সাঈদের চেহারা দেখে বলল,
“আবার কি হলো? হঠাৎ রেগে যাচ্ছো মনে হয়।”
সাঈদ ইরিনার দিকে বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে বলল,
“ধরুন আপনি কাওকে ভালোবাসেন কিন্তু সে মানুষটা আপনাকে নিজের বোন মনে করে তখন আপনি কি করবেন?”
ইরিনা সাঈদের প্রশ্ন শুনে মনে মনে বলল, “এটা জিজ্ঞেস করার কি আছে? আমি তো সহ্য করেই যাচ্ছি। যাকে ভালোবাসি সে বড়ো বোন মনে করে আমায়।”
কিন্তু মুখে বলল,
“আমার তো কিছুই করার নেই। হঠাৎ এই প্রশ্ন করলে কেন? নিশ্চয়ই যাকে পছন্দ করো সে তোমাকে ভাইয়া ডাকে।”
“ভাইয়া তো ডাকে না। কিন্তু আমি জানি সে আমাকে ভাই মনে করে।”
ইরিনার মন খারাপ হলো। যদিও সে জানে সাঈদ ও তার কোনো ভবিষ্যত নেই তবুও এই অপরাধী মন মানে না। ইরিনা হাসিমুখে বলল,
“আমি দোয়া করবো তুমি যাতে তাকে পাও।”
সাঈদ ইরিনার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।
.
.
শ্রাবণের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে বাদশাহ। শ্রাবণ রাগে ফুঁসছে। সাগরিকা ট্রে তে করে চা নিয়ে এসে টি টেবিলের উপর রাখলো। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“বাদশাহ চা খাবে?”
বাদশাহ ভয়ে হ্যাঁ না কিছুই বলতে পারছে না। শ্রাবণ রাগে গজগজ করতে করতে বলল,
“ওকে চায়ের সাথে বি*ষ মিশিয়ে দাও।”
“আহা শ্রাবণ। ও ছোটো মানুষ ওকে বকছো কেন?”
“ও ছোটো? বড়ো বড়ো ক্রা*ইম পর্যন্ত করতে পারবে জানো তুমি?”
“নিজের সাথে ওকে রেখে নিজের মতো বানিয়ে ফেলেছো। ও তো সূর্য থেকেও ২/৩ বছর ছোটো হবে। বাদশাহ বসো আমি চা দিচ্ছি।”
শ্রাবণ ধপ সোফায় বসে বলল,
“এখন আমি ভালো মানুষ কিভাবে হবো?”
সাগরিকা চা ঢালছিল কাপে শ্রাবণ কথা শুনে চমকে উঠল। কিছুক্ষণ থমকে থেকে ফিক করে হেসে দিলো। শ্রাবণ বিরক্ত হয়ে বলল,
“হেসো না আমি এখন রেগে আছি।”
সাগরিকা চেষ্টা করেও হাসি বন্ধ করতে পারছে না। শ্রাবণ এক সময় ধমকের স্বরে বলল,
“চুপ থাকো বলছি।”
সাগরিকা উল্টো ধমক দিয়ে বলল,
“তুমি মুখ বন্ধ রাখো। আমি হাসবো তোমার কি?”
“আচ্ছা হাসো সমস্যা নেই।”
শ্রাবণ চুপসে গেল। বাদশাহ’র খুব হাসি আসছে। সাগরিকা ভেংচি কেটে বাদশাহ কে বলল বসতে। কিন্তু বাদশাহ বলল সে চলে যাবে এখন। সাগরিকা অনেক জোড় করলো কিন্তু বাদশাহ শ্রাবণের কাছ থেকে পারমিশন নিলো চলে যাওয়ার। শ্রাবণ অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সাগরিকা তা দেখে বলল,
“খবরদার এভাবে তাকাবে না ওর দিকে। যেতে দাও ওকে। ভালো মানুষরা বাজে ব্যবহার করে না।”
সাগরিকার কথা শুনে শ্রাবণ জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বলল,
“তুমি যেতে পারো বাদশাহ।”
বাদশাহ সুযোগ পেয়ে যত দ্রুত পারলো পালালো। সাগরিকা শ্রাবণের পাশে বসে বলল,
“তোমার ওই জায়গাই কেন লাগবে বলো তো।”
শ্রাবণ সাগরিকার দিকে তাকাল। এক নজর দেখে আবার মাথা নিচু করে ফেলল। সাগরিকা শ্রাবণের শার্টের কলার ঠিক করে বলল,
“আমাকে বলা যাবে না?”
শ্রাবণ সাগরিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি বলেছিলাম তোমাকে যে আমি একটা অনাথ আশ্রমে থাকতাম তাই না?”
“হুম, তারপর?”
“আমি কিছুদিন ধরে ভাবছিলাম সেই অনাথ আশ্রমে ডোনেশন দেবো।”
“এটা তো খুব ভালো কথা। কিন্তু সেই জায়গার সাথে তোমার আশ্রমের কি সম্পর্ক?”
“আয়মান খলিল সেই অনাথ আশ্রম ভেঙ্গে ফেলেছে। সে সেই জায়গা উঁচু দামে বিক্রি করতে চায়। আমি অনেক টাকা অফার করেছি তাকে৷ কিন্তু সে আমাকে অনেক অপমান করেছে। আমি কসম খেয়েছি ওই জায়গা কিনেই ছাড়বো।”
সাগরিকা অবাক হলো ভীষণ। সে তো শ্রাবণের এমন রূপ আগে কখনো দেখেনি। শ্রাবণ মন খারাপ করে বলল,
“আমি আবার সেই অনাথ আশ্রম বানাতে চাই। কিছুদিন আগে প্রথমবার একটা গরীবের সাহায্য করেছি টাকা দিয়ে। তার মুখের হাসিটা দেখে খুব শান্তি লাগছিল। হঠাৎ মনে পড়ে যায় আমিও একসময় কারোর কাছ থেকে সাহায্য পেয়ে এভাবে হাসতাম।”
সাগরিকার মনে হচ্ছে দুনিয়ার সকল সুখ তার মনে এসে ঠাই নিয়েছে। সে শ্রাবণের বুকে মাথা রাখলো। অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করছে তার কিন্তু সুখ তার গলা চেপে ধরেছে। সুখের কান্না আসছে তার। শ্রাবণ সাগরিকার দিকে তাকিয়ে তাকে ডাকলো। সাগরিকা চোখ তুলে শ্রাবণের দিকে তাকাল। শ্রাবণ মুচকি হেসে বলল,
“আজকাল তোমার ব্যবহার দেখে আমি মুগ্ধ হচ্ছি।”
“কেন?”
“হঠাৎ এত ভালোবাসা আমার প্রতি।”
“হয়তো ভালোবেসে ফেলেছি তোমায়।”
শ্রাবণ চমকে তাকাল সাগরিকার দিকে। সাগরিকা সোজা হয়ে বসে বলল,
“চা দেবো?”
শ্রাবণ হেসে দিলো। সাথে সাগরিকাও হাসলো।
.
.
রাস্তা খুব তারাতাড়ি শেষ হয়ে গেল মনে হচ্ছে। বাসার খুব কাছাকাছি এসে পড়েছে মাহা ও ইর্তেজা। মাহার ইচ্ছে করছে ইর্তেজার হাত ধরে আবার সেই জায়গায় ফিরে যেতে। ইর্তেজা আশে-পাশে ছিল বলে তার ভেতর এক প্রকার শান্তি ছিল। এখন গিয়ে এক বিশাল অশান্তির শিকার হতে হবে। ইর্তেজা দাঁড়াল। সাথে মাহাও। ইর্তেজার দিকে তাকিয়ে বলল,
“দাঁড়ালে যে?”
ইর্তেজা চোখের ইশারায় মাহাকে ডান দিকে দেখতে বলল। মাহা তাকিয়ে দেখে তার বাসা এসে পড়েছে। মন খারাপের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেল সে। ইর্তেজা বলল,
“আসি তাহলে।”
মাহা ইর্তেজার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি ভেতরে গিয়ে কি বলবো?”
“তা তো জানি না। আমি ভেতরে যাব তোমার সাথে?”
“তোমাকে দেখে যদি তারা বাজে কিছু ভেবে বসে?”
“আমিও এটা ভাবছিলাম।”
“আচ্ছা আমি সামলে নেবো।”
“তাহলে চলে যাই আমি।”
মাহা ইর্তেজার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ইর্তেজা মাহাকে এক নজর দেখে হাঁটা ধরলো। তার কিছুই বলার নেই মাহাকে। মাহা ইর্তেজার যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। ইর্তেজা চলে গেল। সত্যি চলে গেল। আবার তাকে ছেড়ে চলে গেল। মাহা চোখের পানি মুছে মেইন দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। দারোয়ান মামা তাকে দেখে বলল,
“আম্মাজান, কই ছিলেন আপনে? বড়ো সাহেব পাগলের মতো খুঁজছে আপনেরে।”
“চাচু রেগে আছে তাই না?”
দারোয়ান মামা হ্যাঁ সূযোগ মাথা নাড়াল। মাহা লম্বা নিশ্বাস ফেলে এগিয়ে গেল। ভেতরে গিয়ে দেখে বাড়ির দরজা খোলা। বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে চমকে উঠল। সায়ান বসে আছে। সায়ান চায়ের কাপ রেখে দরজার দিকে তাকাল। মাহা দাঁড়িয়ে আছে। সায়ান উঠে দাঁড়াল। উঁচু স্বরে হেসে বলল,
“বাহ, তুমি দেখি খুব নির্লজ্জ। অন্য কারোর সাথে রাত কাটিয়ে এসে আবার ফিরে আসলে?”
মাহার শরীর ঘিনঘিন করছে সায়ানের কথা শুনে। সায়ানের কথা শুনে মাহার চাচু আর চাচী দ্রুত আসলো। চাচী মাহাকে দেখে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো। মাহা শান্তির নিঃশ্বাস ফেলল। এই মানুষটা আছে বলেই সে সাহস করে এসেছে। চাচী মাহাকে ছেড়ে গালে হাত রেখে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“মামনি কোথায় ছিলি তুই? তুই ঠিক আছিস তো?”
মাহা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। মাহার চাচু রাগে চিল্লিয়ে বলল,
“তোর সাহস কি হলো আমার বাড়িতে পা রাখার? তোর কারণে আমার কত লজ্জিত হতে হয়েছে জানিস? পালাতে হলে আরো আগে পালাতি নিজের বিয়ের দিনই কেন?”
মাহার গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না। চাচী রাগী কন্ঠে বলল,
“চুপ থাকবেন আপনি? আপনারা কেন ওর সাথে এমন করেন বলেন তো? এমনও তো হতে পারে ও কোনো বিপদে ছিল। আমি বলেছিলাম আপনাকে কেও একজন আমাকে মাথায় ভারী কিছু দিয়ে মারায় আমি জ্ঞান হারিয়েছিলাম।”
মাহা চাচীর দিকে তাকাল। চাচী আবার মিথ্যে বলেছে তার জন্য। সায়ান মাহার দিকে এগিয়ে আসলো। মাহা কাঁপছে ভয়ে। সায়ান শান্ত কন্ঠে বলল,
“কোথায় ছিলে মাহা?”
মাহা সায়ানের দিকে তাকাল। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। সায়ান উঁচু স্বরে আবার জিজ্ঞেস করলো। মাহা এবারও জবাব দিলো না। সায়ান রাগে কটমট করতে করতে সজোরে মাহার গালে চড় মেরে দিলো। চাচী কিছু বলার আগেই মাহার চাচু বলল তাদের মাঝে না বলতে। স্বামীর সামনে উনিও বাধ্য। মাহা নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছে। সায়ান মাহার বাহু চেপে ধরে বলল,
“তোর মতো মেয়েকে আমি বিয়ে করতে রাজি হয়েছি এটা তোর সৌভাগ্য।”
মাহা ব্যাথায় ছটফট করছে। তখনই কেও একজন ভেতরে প্রবেশ করলো। সবাই সেখানে তাকাল। চাচী অবাক হয়ে বলল, “ইর্তেজা?”

চলবে…….

#আর_একটিবার
#শোভা_আক্তার(লাভলী)
#পর্ব_২১

চাচীর মুখে ইর্তেজার নাম শুনে মাহাও তাকাল দরজার দিকে। ইর্তেজা শান্ত দৃষ্টিতে সায়ানের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। মাহার বাহু সে চেপে ধরে রেখেছে। নিশ্চয়ই মাহা ব্যাথা পাচ্ছে। হ্যাঁ মাহা ব্যাথা পাচ্ছে। এটা মাহার চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছে। ইর্তেজার মাথা বিগড়ে হয়ে গেল। ধীরপায়ে হেটে এসে সায়ানের কাছ থেকে মাহাকে ছাড়াল। ইর্তেজা সায়ানের বাহু সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে চেপে ধরলো। সায়ান নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। ইর্তেজা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“তোর সাহস কি করে হলো আমার মাহাকে কষ্ট দেয়ার?”
মাহার চাচু দৌড়ে এসে ইর্তেজার কাছ থেকে সায়ানকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলো। সায়ানকে যত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে ইর্তেজা তাকে তত শক্ত করে ধরছে। মাহা চুপচাপ দেখছে। সে এখন কিছুই বলবে না। অনেক সহ্য করেছে আর না। মাহার চাচু কিছু বুঝতে না পেরে ইর্তেজার পেটে সজোরে ঘু*ষি মারলো। ইর্তেজা সায়ানকে ছেড়ে কিছুটা পিছিয়ে গেল। রাগী দৃষ্টিতে তাকাল মাহার চাচুর দিকে। মাহার চাচু ভয় পাচ্ছে। কারণ সে এর আগেও ইর্তেজার হাতে মা*র খেয়েছে মাহাকে থা*প্পড় মারার কারণে। সায়ান রাগী কন্ঠে বলল,
“এই সেই ছেলে যার সাথে মাহা পালিয়েছিল। কি নির্লজ্জ তোর ভাতিজি। যেই ছেলের সাথে নষ্টামি করেছে তাকেই আবার নিয়ে আসলো।”
মাহা হাত মুঠো শক্ত করে ফেলল। এমন বাজে অপবাদ তার উপর দেয়া হবে সে জানতো। ইর্তেজা মাথা আরো বিগড়ে গেল। সায়ান দিকে তাকিয়ে বলল,
“কি বললি তুই? কে নষ্টামি করেছে?”
সায়ান ভয় পেয়ে গেল। ইর্তেজা মাহার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আ..আমার মাহা নষ্টামি করেছে?”
ইর্তেজা মাথা কাজ করছে না। সায়ানের দিকে তাকাল। ইচ্ছে করছে সামনে থাকা মানুষটাকে মে*রে টুকরো করে ফেলতে। ইর্তেজা আয়মান খলিলের দিকে তাকিয়ে বলল,
“যখন আপনি জেনেছিলেন মাহা যাকে ভালোবাসে সে একজন দরিদ্র ছেলেকে ভালোবাসে আপনি তাকে মে*রে ধরে আমার কাছ থেকে কেঁড়ে নিয়েছেন। আর এখন নিজের বয়সী এক বুড়োর সাথে নিজের মেয়ের মতো ভাতিজির বিয়ে দিতে যাচ্ছিলেন? আপনার মতো খারাপ মানুষ আমি কাজ পর্যন্ত দেখিনি।”
সায়ান তেড়ে এসে ইর্তেজার কলার ধরে বলল,
“তুই বুড়ো কাকে বললি রে? যার পকেটে টাকা থাকে তার রূপ কে দেখতে যাবে? আর তোর কি মনে হয় এই চরিত্রহীন মেয়েকে আমি বিয়ে করবো? আমার মানসম্মান মাটিতে মেশানোর জন্য?”
ইর্তেজা আর নিজেকে সামলাতে পারলো না। সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে সায়ানকে সজোরে ধাক্কা মেরে দূর করলো। তেড়ে গিয়ে কলার ধরে ইচ্ছে মতো চেহারা থা*প্পড় মারতে লাগলো।
“তোর সাহস কি করে হলো আমার মাহাকে চরিত্রহীন বলার?”
আয়মান খলিল ভয়ে থামাতে যাচ্ছে না। সে গেলেই মা*র খাবে। এই বয়সে মা*র খাওয়ার ইচ্ছে তার নেই। সায়ানের নাক থেকে রক্ত ঝরছে। ইর্তেজার সেদিকে খেয়াল নেই। সে এলোপাথাড়ি ভাবে মে*রেই যাচ্ছে। মাহা ছুটে গেল। ইর্তেজাকে ধরে সে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু ইর্তেজার কান দিয়ে কথা যাচ্ছে না। তার মাথায় শুধু ঘুরছে মাহার উপর দেয়া অপবাদ গুলো। এক সময় ভুল করে ইর্তেজা মাহাকে ধাক্কা মে*রে দিলো। মাহা গিয়ে পরলো টেবিলের সাথে ধাক্কা লেগে টেবিলের উপর থাকা ফুলদানি পায়ের উপর পড়ে ভেঙ্গে গেল৷ পা কাটে নি। কিন্তু ফুলদানি পায়ে পরায় ব্যাথা পেয়েছে। মাহার চিৎকার করে ইর্তেজার হুঁশ ফিরলো। সে মাহার দিকে তাকাল। সায়ানকে ছেড়ে দৌড়ে গেল মাহার দিকে৷ মাহার চোখ বেয়ে পানি পরছে। ইর্তেজা দ্রুত মাটিতে বসে মাহার পা নিয়ে হাঁটুর উপর রাখলো। মাহার দিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,
“বেশি ব্যাথা লেগেছে পায়ে? মাফ করে দাও আমায় মাহা। আমি..আমি বুঝতে পারি নি।”
মাহা দ্রুত পা সরিয়ে বলল,
“থামো ইর্তেজা। পাগল হয়ে গেলে তুমি? কেন মা*রামা*রি করছো বলো তো।”
ইর্তেজা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সায়ানের দিকে তাকাল। সায়ান নাকে হাত দিয়ে সোফায় বসে ঘনঘন নিশ্বাস ফেলছে। ইর্তেজা মাহার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমার সম্পর্কে আর একটা বাজে কথা বললে ওকে মে*রে ফেলবো।”
“বলবে না, আর কিছু বলবে না। তুমি প্লিজ শান্ত হও।”
ইর্তেজা মাটির দিকে তাকিয়ে ঘনঘন নিশ্বাস ফেলছে। চাচী মাহার চাচুর দিকে তাকিয়ে বলল,
“তখন তোমাকে অনেক রিকুয়েষ্ট করেছিলাম। মেয়েটাকে যেতে দাও ইর্তেজার সাথে। তুমি শুনো নি। তোমার মনে হয়েচ্ছিল মাহা একটা গরীব ছেলেকে বিয়ে করলে তোমাদের পরিবারের খুব বদনাম হবে। আর এখন? তুমি তোমার বন্ধুর সাথে মাহার বিয়ে দিতে চেয়েছিলে। তোমার কি মনে হয় লোকে তোমার সম্পর্কে মন্দ কথা বলে নি? তোমার মুখের উপর না বললেও তোমার পিঠ পিছে বলেছে। তোমার প্রত্যেক পাপের শাস্তি আমাকে ভোগ করতে হয়েছে। আমার ১ বছরের সন্তানকে আমি হারিয়েছি তোমার পাপের কারণে।”
ইর্তেজা অবাক হয়ে চাচীর দিকে তাকাল। তারপর মাহার দিকে তাকাতেই মাহা বলল,
“রাইসা, আমার চাচাতো বোন। আমজাদ আর রাইসা জমজ হয়েছিল। অনেক ভালোবাসতাম রাইসাকে। ওদের এক বছরের জন্মদিন পালন করছিলাম আমরা। সেদিন অন্যান্য বাচ্চাদের সাথে খেলা করতে যেয়ে সিঁড়ি দিয়ে পড়ে যায় রাইসা। সাথে সাথে মৃ*ত্যু ঘটে ওর।”
বলেই মাহা মাথা করে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। চাচী চোখ মুছে বলল,
“আমার এক মেয়েকে তো হারিয়েছি। আমার আর এক মেয়ের জীবন নষ্ট করো না। তোমার সামনে হাতজোর করছি। ওকে এখন যেতে দাও।”
আয়মান খলিল কি বলছে ভেবে পাচ্ছে না। ইর্তেজা মাহার দিকে তাকিয়ে আছে। মাহা কি সত্যি যাবে তার সাথে? সে কি সত্যি মাহাকে পেতে চলেছে? সায়ান সোজা হয়ে বসে আয়মান খলিলের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোর ব্যবসায় আমি কোটি কোটি টাকা ভাসিয়েছি। যা বলবি ভেবেচিন্তে বলবি।”
আয়মান খলিল সাথে সাথে বলল,
“না, মাহা কোথাও যাবে না।”
ইর্তেজা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“টাকার জন্য নিজের ভাইয়ের মেয়েকে বিসর্জন দিতে চাচ্ছেন। কত টাকা দিয়েছে আপনাকে সে?”
সায়ান হেসে বলল,
“কেন রে ভিখারি! তুই আমাকে টাকা ফেরত দিবি?”
“আমার মাহা বাজারে থাকা কোনো জিনিস না যে, যে কেও এসে কিনে নিয়ে যাবে।”
ইর্তেজা রাগে গজগজ করছে। মাহার চোখ বেয়ে পানি পরলো। ইর্তেজা তাকে আজও এত ভালোবাসে? মাহা তাকাল ইর্তেজার দিকে। ভেবে নিয়েছে ইর্তেজাকে আর হারাতে দেবে না। মাহা চোখ মুছে সবার উদ্দেশ্যে বলল,
“আজ সিদ্ধান্ত নেবো আমি। আসছি এখনই।”
মাহা দ্রুত হেটে নিজের ঘরে গেল। সবাই তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। ইর্তেজা চাচীর দিকে তাকাল। চাচী ইর্তেজাকে এক নজর দেখে চোখের ইশারায় শান্ত থাকতে বলল। ইর্তেজার বুক কাঁপছে। মাহা কি ফিরবে না? মাহা ঘটে গিয়ে দেখে খাটের উপর আমজাদ ঘুমাচ্ছে। তাকে এক নজর দেখে আলমারির দিকে হেটে গেল। আলমারি খুলে সম্পত্তির কাগজ বের করলো। বাবা শেষ কথাগুলো মাথায় ভেসে উঠল। বাবা বলেছিল, “মাহা, যে কোনো বিপদ আসুক জীবনে। এই সম্পত্তির কাওকে দেবে না ওয়াদা করো। যত পর্যন্ত এসব তোমার নামে আছে কেও তোমার ক্ষতি করতে পারবে না।” মাহার চোখ বেয়ে পানি পরলো। পড়ার টেবিলে বসে কলম দিয়ে দলিলের ফাঁকা পৃষ্ঠায় কিছু লিখলো। একবার দলিলে চোখ বুলিয়ে আমজাদের দিকে আসল। আমজাদের মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে চুমু দিয়ে উঠে দাঁড়াল। ফিরে গেল হলরুমে। ইর্তেজা মাহাকে দেখে লম্বা নিশ্বাস ফেলল। মাহা তাদের সামনে গিয়ে দলিলের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি, মেহরুন্নেসা মাহা। মরহুম মনিরুল আলম খলিলের একমাত্র মেয়ে এবং এই সম্পত্তির অংশীদার। আমি নিজ ইচ্ছায় আমার নামের সকল ধন-সম্পদ আমার চাচাতো ভাই আমজাদ খলিলের নামে করলাম। আর আমার শর্তানুযায়ী আজমাদ খলিল যত পর্যন্ত ২৫ বছরের না হবে এই সম্পত্তি সামলানোর দায়িত্ব আমার চাচা আয়মান খলিল এবং চাচী রোকসানা বেগমের থাকবে। আমজাদ ২৫ বছর হওয়ার পর তাকে তার সম্পত্তি বুঝিয়ে দেয়ার শর্ত রইল।”
বলেই মাহা তার চাচুর দিকে তাকাল। চাচু তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। মাহা হেটে গেল সেখানে। কান্নাজড়িত কন্ঠে বলল,
“আব্বু চলে যাওয়ার পর আপনাকেই বাবা মেনেছি। দাদু বেঁচে থাকা পর্যন্ত আপনি সবসময় আমাকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবেসেছেন। দাদু চলে যাওয়ায় যেন আমি আমার চাচুকেও হারিয়ে ফেলেছি। চাচীই ছিল আমার পাশে। ফুপু যা বলতো আপনি তাই করবেন। যাকে ভালোবাসি তার থেকেও আলাদা করেছেন। কিছু বলি নি। উনি বলায় আপনি আমার বিয়ে নিজের বন্ধুর সাথে দিতে চেয়েছিলেন। দাদু চলে যাওয়ার আগে চলেছিল আপনার কথার খেলাফ যদি না হই। তাই চুপচাপ মেনে নিয়েছিলাম। চাচু এবার একটা জিনিস চাই আপনার থেকে। আমাকে মুক্ত করে দিন। আমি আপনাদের সব দিয়ে দিলাম।”
চাচী দ্রুত এসে বলল,
“তোকে চলে যাওয়ার পারমিশন আমি দিলাম। কিন্তু এই সম্পত্তি আমরা চাই না। আমজাদ…”
চাচী পুরো কথা শেষ করার আগেই মাহা বলল,
“সম্পত্তি আমার। আমি যা ইচ্ছে তাই করবো। আপনারা বলার কেও না।”
বলেই মাহা চাচীর হাতে কাগজ দিয়ে দিলো। এক নজর চাচুকে দেখে ঘুরে দাঁড়াল। ইর্তেজা দাঁড়িয়ে আছে। মাহা ইর্তেজার দিকে এগিয়ে গেল। ইর্তেজার বরাবর দাঁড়িয়ে বলল,
“আজ আমার কাছে কিছু নেই। সব ছেড়ে দিলাম।”
মাহা ইর্তেজার দিকে হাত এগিয়ে গিয়ে বলল,
“আমাকে নিয়ে যাবে নিজের দুনিয়ায়?”
ইর্তেজার চোখে পানি টলমল করছে। খুশিতে আজ তার মন নেচে উঠছে। কপালে হাত রেখে হেসে দিলো। চোখ গড়িয়ে পানি পরতেই দ্রুত মুছে ফেলল সাথে সাথে। মাহার হাত ধরে বলল,
“আমি মাহাকে ভালোবাসি। মাহার সম্পত্তিকে না। তখন থেকে এখন পর্যন্ত আমার মনের দুয়ার আর বাড়ির দরজা খোলা তোমার জন্য।”
মাহা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ইর্তেজা মাহার হাত নিজের দু’হাতের দুঠোয় নিয়ে চুমু দিলো। চাচীর দিকে তাকিয়ে বলল,
“আন্টি আপনার পারমিশন লাগবে। নিয়ে যাচ্ছি আপনার মেয়েকে।”
“আমি তো তখনও পারমিশন দিয়েছিলাম। আজ কিভাবে না করি? মাহাকে নিয়ে যাও ইর্তেজা। তুমি ছাড়া আর কারো উপর আমার বিশ্বাস নেই। তুমিই পারবে আমার মেয়েটাকে আগলে রাখতে।”
মাহা দৌড়ে গিয়ে চাচীকে জড়িয়ে ধরলো। চাচী মন ভরে আদর করে দিলো মাহাকে। ইর্তেজা এগিয়ে এসে চাচীর থেকে বিদায় নিলো। সায়ান বিরক্ত হয়ে বলল,
“ছি, একটা অবিবাহিত মেয়েকে একটা ছেলের সাথে যাওয়ার পারমিশন কিভাবে দিলো তোর স্ত্রী?”
আয়মান খলিল সায়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোকে তোর টাকা এবার ফিরিয়ে দেবো। তারপর তোর সাথে আমার সম্পর্ক সারাজীবনের জন্য শেষ। তোর টাকা শোধ করতে পারতাম না বলে মাহাকে তোর সাথে বিয়ে দিতে রাজি হয়েছিলাম।”
“বাহ আয়মান, তুইও পল্টি নিলি? নিবি না কেন? সম্পত্তি তো এখন তোর হাতের মুঠোয়।”
আয়মান খলিল কিছু বলল না। চাচী এসব দেখে ইর্তেজাকে বলল,
“তোমরা এখন যাও। আমি তোমাদের সাথে মাঝেমধ্যে দেখা করতে যাবো।”
“চাচী আমজাদকেও নিয়ে যাবে।”
মাহা কথা শুনে চাচী মুচকি হেসে মাথা নাড়াল। বিদায় নিয়ে মাহা আর ইর্তেজা হাতে হাত রেখে বাড়ি থেকে বের হলো। মাহার মনে হচ্ছে সে এখন মুক্ত পাখি। ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছে তার ভালোবাসার জগতে। ইর্তেজা হাঁটতে হাঁটতে বলল,
“এই কেমন চমৎকার হলো মাহা? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না আমি তোকে পেয়ে গিয়েছি।”
মাহা ইর্তেজার দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হেসে কাঁধে মাথা ঠেকালো।
.
.
শ্রাবণ কপালে হাত দিয়ে বসে আছে। সূর্য আসবে আজ। সাগরিকা সূর্যের জন্য ঘর গুছাচ্ছে। সূর্য আসবে এই নিয়ে শ্রাবণ চিন্তা করছে না। শ্রাবণ চিন্তা করছে ভবিষ্যতের কথা ভেবে। আজমাইনের কথা জানতে পারলে সাগরিকা কি করবে? শ্রাবণ সোজা হয়ে বসলো। অস্থিরতা কাজ করছে তার ভেতর। বাহির থেকে আওয়াজ আসলো। হয়তো সূর্য এসেছে। শ্রাবণ উঠে বাহিরে গেল। সূর্যকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখলো। এসে পরেছে তার শত্রু। প্রতিদিন এখন খোটা শুনতে হবে তার। আর কিছু বলতেও পারবে না। সাগরিকা নাহলে রাগ করবে। সূর্য শ্রাবণকে সালাম দিলো। শ্রাবণ অবাক হয়ে সালামের উত্তর নিলো। তার বিশ্বাস হচ্ছে না সূর্য তাকে সালাম দিয়েছে। সাগরিকা সূর্যকে নিয়ে ঘরে গেল। শ্রাবণ পকেটে হাত রেখে লম্বা নিশ্বাস ফেলল। এখন তো সাগরিকার কাছে সময়ের অভাব হয়ে যাবে তার জন্য। সাগরিকা সূর্যকে ঘরে রেখে বাহিরে আসলো। শ্রাবণ বিরক্ত চেহারা দেখে বলল,
“তুমি পারমিশন দেয়ায় আমি সূর্যকে আসতে বলেছি। আর এখন নিজেই মুখ ফুলিয়ে রেখেছো।”
“কোথায়? না তো! আমার ভীষণ ভালো লাগছে সূর্যকে দেখে। আমি অফিসে থাকলে তুমি সূর্যের সাথে কথা বলে সময় কাটাতে পারবে।”
“হ্যাঁ ঠিক বললে। আচ্ছা তুমি বসো আমি গিয়ে দেখি বিরিয়ানি হয়েছে কি-না। তারপর একসাথে সবাই লাঞ্চ করবো।”
বলেই সাগরিকা চলে গেল। শ্রাবণ লম্বা নিশ্বাস ফেলল।
.
.
সাঈদ ইরিনার দিকে তাকিয়ে আছে। ইরিনা সাঈদকে এলবাম দেখাচ্ছে। সময় গুলো কত মধুর ছিল। ঝর্ণা টিভি দেখছে আর বিস্কুট খাচ্ছে চা দিয়ে। সে আড়চোখে সাঈদের দিকে তাকাল। সাঈদ এলবাম না দেখে ইরিনাকে দেখছে। ঝর্ণা সাঈদকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“দুনিয়াতে বেহাইয়া মাইনষ্যের বড্ড অভাব।”
ইরিনা আর সাঈদ দুজনই ঝর্ণার দিকে তাকাল। সাঈদ ঝর্ণার চাহনি দেখে চোখ ফিরিয়ে নিলো। ঝর্ণাকে দেখে মনে হচ্ছে সে এখনই তাকে কাঁচা চিবিয়ে খাবে। ইরিনা ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কি বলছো আবল তাবল?”
“আপা গো এইযে টিভিতে যে মানুষটা আছে হেইর কথা কইলাম। তুই মাইয়াডারে ভালোবাসোস বইলা দে। তা না কইরা ফিলিমের নায়কগো মতো ঢং করতাসে।”
ইরিনা হেসে বলল,
“ও তো ফিল্মের নায়কই।”
সাঈদ টিভির দিকে তাকিয়ে থতমত খেয়ে বলল,
“কিন্তু এটা তো ডিসকভারি চ্যানেল। একটা বাঘ হরিণ শিকার করছে। তুমি নায়ক নায়িকা কোথায় পেলে?”
ইরিনা টিভি দেখে বলল,
“হ্যাঁ তাই তো।”
“মনে হয় ঝর্ণার মাথা সত্যি সত্যি আউট হয়ে গিয়েছে।”
বলেই সাঈদ শব্দ করে হেসে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু ব্যর্থ হলো। ঝর্ণা এখনো তার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সাঈদ চুপসে গেল। তখনই দরজা ঠকঠক করার শব্দ আসলো। ঝর্ণা উঠে গিয়ে দরজা খুলে খুশি মনে বলল,
“আপা, ইর্তেজা ভাই আইসে।”
সাথে একটা মেয়ে দেখে হাসি উড়ে গেল তার।
“লগে হয়তো আমাগো ভাবীরে নিয়া আইসে।”
সাঈদ আর ইরিনা একে অপরের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে একসাথে বলল, “ভাবী?”
সাঈদ দ্রুত দাঁড়াল। ইর্তেজা ভেতরে ঢুকে ঝর্ণার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমার আজগুবি কথা বার্তা বন্ধ করে না তাই না?”
ইর্তেজা মাহার দিকে তাকিয়ে ভেতরে আসতে বলল। মাহার ভয় করছে। ধীরপায়ে হেটে ভেতরে গেল। মাহাকে দেখে ইরিনা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। সে যেন নিজের চোখে বিশ্বাস করতে পারছে না সে মাহাকে দেখছে। মাহা ইরিনাকে দেখে থমকে গেল। ইরিনা হুইলচেয়ারে কেন বুঝতে পারছে না সে। মাহা দ্রুত হেটে ইরিনার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“আপু তুমি..তুমি হুইলচেয়ারে? কি..কি হয়েছে তোমার?”
মাহা ইর্তেজার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল,
“আপুর কি হয়েছে ইর্তেজা?”
“বলবো, তুমি গিয়ে আশে ফ্রেশ হও।”
মাহা দাঁড়িয়ে বলল,
“না, আগে বলো আপুর কি হয়েছে।”
ইর্তেজা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল,
“যেদিন আমাদের সম্পর্কে তোমার চাচু জানায় আমাকে মা*রধ*র করে বাসা থেকে বের করে। আমি সেদিন রাস্তায় মাথা ঘুরে পড়ে যাই। কয়েকজন আমার মোবাইল দিয়ে আপুকে কল দেয়। আমার অবস্থার সম্পর্কে জানার পর আম্মু আর আপু আসতে নেয়। রাস্তায় উনাদের রিকশার এক্সিডেন্ট হয়। আমার জ্ঞান কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসে। বাড়িতে ফিরে আসার সময় দেখি রাস্তার মাঝে ভিড়। ভিড় ঠেলে ভেতরে গিয়ে দেখি আপু আম্মু দুজনই র*ক্তা*ক্ত অবস্থায়। আমি যত দ্রুত সম্ভব উনাদের হসপিটাল নিয়ে যাই।”
“ওয়েট ওয়েট, আমি তোমাকে সেই রাতেই কল দিয়ে বলেছিলাম আমাকে যেভাবেই হোক নিয়ে যেতে কিন্তু তুমি যাও নি আমাকে নিতে।”
“হ্যাঁ কারণ সকালেই ডাক্তার বলে আম্মু আর বেঁচে নেই। আর আপুর জ্ঞান কবে ফিরবে উনারা জানেন না। আমি এত বিপদের মধ্যে ছিলাম যে সেদিন পারি নি তোমাকে নিয়ে আসতে। কিছুদিন পর তোমাকে কল দিয়েছিলাম কিন্তু নাম্বার বন্ধ ছিল।”
মাহা অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেদিন থেকে সে ইর্তেজাকে কতোই না দোষারোপ করেছিল। সে একবারো ভাবে নি ইর্তেজা হয়তো বিপদে আছে। মাহা ইরিনার দিকে তাকাল। ইরিনা ভেজা চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মাহা হাঁটু গেড়ে বসে ইরিনাকে জড়িয়ে ধরলো। ফুপিয়ে কাঁদছে ইরিনাকে জড়িয়ে ধরে। সাঈদ ইর্তেজার উদ্দেশ্যে বলল,
“তুই মাহাকে কোথায় পেলি?”
“সব বলবো, ঝর্ণা তুমি মাহাকে আপুর ঘরে নিয়ে যাও। আপুর একটা জামা বের করে দিও মাহা ফ্রেশ হবে।”
ইরিনা মাহাকে শান্ত করে বলল গিয়ে ফ্রেশ হতে। বাকি কথাবার্তা পরে হবে। মাহা চোখ মুছে উঠে দাঁড়াল। ঝর্ণার সাথে ইরিনার ঘরে গেল সে। মাহা যেতেই ইরিনা ইর্তেজাকে বলল,
“মাহার এই অবস্থা কেন ইর্তেজা? কি হয়েছে পুরো কথা বল এখনই।”
ইর্তেজা চেয়ারে বসে সব বলবো ইরিনা আর সাঈদকে। ইরিনা রাগে গজগজ করছে। রাগী কন্ঠে চিৎকার করে বলল,
“কিড*ন্যাপ? ইর্তেজা তুই এত বাজে কাজের সাথে কিভাবে জড়িত হলি?”
“আপু, বিশ্বাস করো এর আগে কখনো আমি এত বাজে কাজ করি নি। এই প্রথম ছিল। আর আমি ওয়াদা করছি এটাই শেষ। আমি আজই শ্রাবণ আহমেদকে গিয়ে বলল আমি আর উনার জন্য কাজ করবো না।”
ইরিনা কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। রাগের বশে কান্না আসছে তার। সাঈদ ইরিনার মাথায় হাত রাখলো। ইরিনা সাঈদের দিকে তাকাল। সাঈদ ইরিনাকে চোখের ইশারায় শান্ত থাকতে বলল। ইরিনা ঘনঘন নিশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করলো।

মাহা বাহিরে এসে দেখে ইর্তেজা নেই। সাঈদ কপালে হাত দিয়ে বসে আছে। মাহা ভার্সিটির লাইফে মাত্র একবার সাঈদের সাথে কথা বলেছিল। তাও ভিডিও কলে ইর্তেজার সাথে। ইরিনা চুপচাপ বসে আছে। মাহা গিয়ে ইরিনার সামনে দাঁড়াল। ইরিনা মাহাকে দেখে মুচকি হেসে ইশারায় বলল বসতে। মাহা বসলো ইরিনার কথার মতো। মাহা ইরিনার হাত ধরে বলল,
“আমাকে মাফ করে দিও আপু। সেদিন আমার কারণে হয়েছে এসব।”
“তোমার কারণে কিভাবে?”
“সেদিন যদি আমি সাহস করে ইর্তেজার হয়ে চাচুকে থামাতাম তাহলে সেদিন ইর্তেজা রাস্তায় মাথা ঘুরে পরতো না। আর তোমরাও এক্সিডেন্ট হতে না।”
“মাহা, ভাগ্যে যা লিখা থাকে তাই হয়। আর কখনো নিজেকে দোষারোপ করবে না, বুঝলে?”
সাঈদ বলল,
“হুম ঠিক, ভাগ্যের উপর কারো হাত নেই। তাই আমাদের সাথে যা-ই হোক আমাদের মন খারাপ করতে নেই।”
মাহা সাঈদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“সাঈদ ভাইয়া, মাত্র একবার আলাপ হয়েছিল আপনার সাথে।”
“বাহ, তুমি আমাকে মনে রেখেছো?”
“জি, ইর্তেজা আমাকে শুধু আপনার কথা-ই বলতো। যা আমি কখনো ভুলি নি।”
তখনই ঝর্ণা আসলো। মাহাকে দেখে দাঁত বের করে হেসে বলল,
“আপনে ভাবী? ইর্তেজা ভাইয়ের এত সুন্দর বউ। মাশা আল্লাহ মাশা আল্লাহ।”
মাহা লজ্জা পেলো ঝর্ণার কথা শুনে। সাঈদ হেসে বলল,
“হ্যাঁ ঝর্ণা ঠিক বললে। উনি আমাদের ভাবী। খুব জলদি আমরা ইর্তেজা আর মাহার দিয়ে দেবো।”
“বিয়া? আইজকাই আম্মারে কমু নয়া কাপড় কিনা দিতে।”
তখনই ইর্তেজা আসলো। ঝর্ণা কথা শুনে বলল,
“কেন ঝর্ণা? কার বিয়ে যে তুমি নতুন জামা কিনবে?”
“আপনের”
ইর্তেজা থতমত খেয়ে গেল। ইর্তেজার চেহারা দেখে সাঈদ ফিক করে হেসে দিয়ে বলল,
“দেখুন ইরিনা, ইর্তেজা লজ্জায় লাল হচ্ছে।”
ইর্তেজার সত্যি লজ্জায় হাসি আসছে। হাসি থামানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে বলল,
“আমি কেন লজ্জা পাবো শুনি?”
“তোর মুখে থাকা মুচকি হাসি-ই বলে দিচ্ছে।”
ইর্তেজা সাঈদের মাথায় থাপ্পড় মেরে বলল,
“চুপ থাক বেয়াদব।”
“ওই শা*লা সম্মান দে আমায়।”
“কেন তুই কি আমার দুলাভাই লাগিস যে তোকে সম্মান দেবো?”
সাঈদ আর কিছু বলল না। হেসে বিষয়টা ধামাচাপা দিলো। আড়চোখে ইরিনার দিকে তাকাল। সত্যি যদি ইর্তেজার দুলাভাই হতে পারতো সে কতোই ভালো হতো।

বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে সাঈদ চলে গেল। ইরিনা যত দ্রুত সম্ভব মাহা আর ইর্তেজার বিয়ে দিতে চায়। এক বাড়িতে দুজন অবিবাহিত ছেলে মেয়ে থাকা বিষয়টা বাজে দেখা যায়। যদিও সে তার ভাই আর মাহাকে খুব ভরসা করে। কিন্তু এলাকার মানুষেরা জানতে পারলে বাজে খবর ছড়াবে। মাহা আর ইর্তেজা বসে কথা বলছে। ইরিনা ভাবলো তারা কিছুক্ষণ একা সময় কাটাক। ঝর্ণাকে বলায় ঝর্ণা ইরিনাকে নিয়ে তার ঘরে আসলো। ইরিনাকে ধরে খাটে বসালো। ইরিনা হেলান দিয়ে বসে বলল,
“আমি কিছুক্ষণ বিশ্রাম করি। তুমি গিয়ে দেখো তাদের কিছু লাগবে কি-না।”
ঝর্ণা মাথা নাড়িয়ে চলে গেল। হঠাৎ ইরিনার চোখ গেল খাটের উপর থাকা একটা ওয়ালেটের দিকে। ইরিনা সোজা হয়ে বসে খুব কষ্টের হাত এগিয়ে ওয়ালেটটা নিলো। সে সাঈদের কাছে দেখেছিল এই ওয়ালেট। লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল, “এত কেয়ারলেস এই ছেলেটা? কাল আসবে নিতে জানি।”
ইরিনা ওয়ালেটটা তার বালিশ সরিয়ে নিচে রাখতে নিলো। তার মনে হচ্ছে ওয়ালেটের ভেতরে কারো ছবি দেখেছে সে। তার মনে আকুপাকু শুরু হয়ে গেল। কারো ব্যক্তিগত জিনিস দেখতে নেই। কিন্তু তার মন মানছে না। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে কেও আসছে না। ভাবলো একবার দেখেই রেখে দেবে। ইরিনা ওয়ালেট খুলল। খুলতেই সে চমকে উঠল।

চলবে…….