আর একটিবার পর্ব-২৮ এবং শেষ পর্ব | গল্পেরমহল ধারাবাহিক গল্প

0
845

#আর_একটিবার
#শোভা_আক্তার(লাভলী)
#পর্ব_২৮ (শেষ পর্ব)

সময়কে যদি ধরে রাখা যেত বা পরিবর্তন করা যেত, তাহলে দুনিয়াতে কষ্ট বলতে কোনো অনুভূতি থাকতো না। সুখদুঃখ মিলে জীবন গঠিত। দেখতে দেখতে ৫ বছর কেটে গেল। সেই সময়টা কেও ভুলতে পারে নি। স্মৃতি হিসেবে সবার মনের কোণায় চুপটি করে বসে আছে। বিশেষ করে সাগরিকার। মানুষটা তো তারই সবচেয়ে কাছের ছিল।

ফজরের আযান ভাসছে চারপাশে। কিছুক্ষণের মধ্যে মোবাইলে এলার্ম বেজে উঠল। সাগরিকা ধীরে ধীরে চোখ খুলল। মোবাইলে এলার্ম বন্ধ করে উঠে বসলো। আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছেড়ে নামলো। জ্বরে ভুগছিল দু’দিন। এখন কিছুটা ভালো লাগছে। বাহির থেকে ঘন্টা বাজার শব্দ আসছে। সাথে সাথে ছোটো ছোটো বাচ্চাদের চিৎকার চেচামেচি শুরু হলো। সাগরিকা মুচকি হেসে এগিয়ে গেল। দরজা খুলে দেখে সবাই উঠে গিয়েছে। সাগরিকাকে দেখে সবাই আম্মু আম্মু বলে দৌড়ে আসলো। সবাই মিলে সাগরিকাকে ঘিরে দাঁড়াল। সাগরিকা হাত আড়াআড়ি ভাবে ভাজ করে বলল,
“কি যেন শিখিয়েছিলাম আপনাদের?”
সবাই একসাথে বলে উঠল,
“আসসালামু আলাইকুম”
সাগরিকা হেসে সালামের জবাব দিলো। সূর্য এসে রাগী কন্ঠে সবাইকে বলল,
“নামাজের সময় হয়ে গিয়েছে। আপনারা নামাজ না পড়ে এখানে কি করছেন?”
সব বাচ্চারা ভয় পেয়ে গেল। সূর্যকে ভীষণ ভয় পায় তারা। সবাই লক্ষী বাচ্চার মতো মাথা নিচু করে নামাজ পড়ার ঘরে চলে গেল। সাগরিকা হেটে এসে সূর্যের কান ধরে টেনে বলল,
“বলেছি না বাচ্চাদের সাথে রুড বিহেভ করবি না?”
“আউচ আপু সরি, দিন দিন দুষ্ট হয়ে যাচ্ছে তারা।”
সাগরিকা সূর্যের কান ছেড়ে বলল,
“নিজেও তো দুষ্ট হচ্ছো সেটা বললে না?”
সূর্য হেসে সাগরিকাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“সরি মাই ডিয়ার সিস্টার। এখন আমি যাই। নামাজ পড়াতে হবে সবাইকে।”
“ঠিক আছে যা।”
সূর্য সাগরিকার গাল টেনে চলে গেল। সাগরিকা লম্বা নিশ্বাস ফেলে হলরুমে গেল। সকল শিক্ষিকাদের বলল বাচ্চাদের নামাজের জন্য তৈরী করতে। ছেলেদের সূর্যের কাছে পাঠাতে আর মেয়েদের নিজেকে সাথে নিয়ে যেতে বলল। সবাই সাগরিকার কথা শুনে চলে গেল। সাগরিকা আশে পাশে চোখ বুলালো। অনাথ আশ্রম তৈরী করেছে ৪ বছর। এই ৪ বছরে শত শত বাচ্চা এসেছে আর গিয়েছে। এখন আশ্রমে মোট ৪০ জন বাচ্চা আছে। প্রতিবার কেও না কেও আসে বাচ্চা এডপ্ট করতে। সাগরিকা তখন ভীষণ খুশি হয়। দুনিয়াতে অনেক এমন মানুষ আছে যাদের সন্তান হয় না। তখন তারা আসে আশ্রমে। ছেলে হোক মেয়ে হোক, এডপ্ট করে নেয়। সাগরিকা আর সূর্য মিলে পরিবারের সম্পর্কে সব ডিটেইলস নিয়ে তারপর বাচ্চা এডপ্ট দেয়। সাগরিকার ভাবনায় ছেদ পরলো একজনের কান্নায়। সাগরিকা নিচে তাকিয়ে দেখে রিয়াদ। সাড়ে ৩ বছরের একটি ছোট্ট ছেলে। সাগরিকাকে ছাড়া কিছু বুঝে না। সাগরিকা হাঁটু গেড়ে বসে রিয়াদকে জড়িয়ে ধরলো।
“কি হয়েছে আমার বাবুর? ক্ষুধা পেয়েছে?”
বলেই সাগরিকা রিয়াদের গালে হাত রাখলো। রিয়াদ ফুপাতে ফুপাতে বলল,
“মামা”
“মামা? মামা বকেছে তোমায়?”
রিয়াদ হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। তখনই সূর্য আসলো।
“ওই ছোটো গু*ন্ডা, আবার আমার নামে বিচার দেয়া হচ্ছে?”
সূর্যকে দেখে রিয়াদ সাগরিকাকে জাপ্টে ধরলো। সাগরিকা রাগী কন্ঠে বলল,
“তোকে কতবার বলেছি ওকে ভয় দেখাবি না? ও অনেক ছোটো সূর্য।”
“আপু আমি ওকে কিছু বলি নি। শুধু চোখ রাঙিয়ে বলেছি ঘুমাতে যেতে। নামাজ তো পড়ে না। সারাদিন শুধু দুষ্টুমি।”
“এটা ভালোবেসেও বলা যায়।”
সূর্য লম্বা নিশ্বাস ফেলল। তার দোষ না থাকলেও সে দোষী সাগরিকার চোখে। সূর্য রিয়াদের দিকে তাকাতেই রিয়াদ দাঁত বের করে হাসলো। সূর্য ইশারায় বলল, “তোকে পরে দেখবো”। রিয়াদ জিহ্বা বের করে সূর্যকে ভেংচি কাটলো। সূর্যও উল্টো ভেংচি কেটে চলে গেল। সাগরিকা রিয়াদকে কোলে তুলে ঘরে নিয়ে গেল। তাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে পাশে বসলো। রিয়াদের মাথায় কিছুক্ষণ হাত বুলাতেই সে ঘুমিয়ে গেল। সাগরিকা মুচকি হেসে ঝুঁকে রিয়াদের কপালে চুমু দিয়ে উঠে দাঁড়াল। তৈরী হয়ে নামাজ পড়তে চলে গেল।

ফজরের নামাজ পড়ে বাচ্চাদের আবার ঘুম পাড়িয়ে দেয় তারা। সকাল ১০ টায় স্কুলের ক্লাস শুরু হয়। সাগরিকা আশ্রমেই তাদের জন্য স্কুল বানিয়েছে। আশ্রমটা বেশ বড়ো। প্রত্যেকটা রুম বেশ বড়ো বড়ো। প্রত্যেক রুমে প্রায় ১৫ জন্য বাচ্চা ঘুমাতে পারে। বাহিরে বেশ বড়ো মাঠ, যেখানে বাচ্চারা খেলাধুলা করে। আশ্রমের হলরুমটা বেশ বড়ো। ইর্তেজা আর সাঈদ তাদের ভীষণ সাহায্য করেছে আশ্রম তৈরী করতে। সাগরিকা সোফায় বসে রেকর্ড বুক দেখছে। যারা বাচ্চা এডপ্ট করে নিয়ে যায় তাদের নাম, নাম্বার, এড্রেস সব লিখে রাখে তারা। আবার অনেকে টাকা ডোনেট করে, তাদেরও ডিটেইলস নিয়ে রাখে। হঠাৎ সূর্য দৌড়ে এসে চিৎকার করে বলে উঠল,
“আপুউউউ গুড নিউজ”
সাগরিকা চমকে গেল। বুকের বা পাশে হাত দিয়ে ঘনঘন নিশ্বাস ফেলছে সূর্যের দিকে। সূর্য জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলল,
“ওপস, রিয়েলি সরি আপু।”
সাগরিকা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল,
“জোকার কোথাকার, তোকে সার্কাসে দিয়ে আসতে মন চাচ্ছে আমার।”
“পরে দিয়ে এসো, আগে আমার সাথে চলো।”
“কোথায়?”
“হসপিটাল, ইরিনা আপুর মেয়ে বাবু হয়েছে।”
সাগরিকা খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলল,
“সত্যি বলছিস?”
“একদম, ইর্তেজা ভাইয়া মাত্র কল দিয়ে বলল।”
“তো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? তারাতাড়ি চল।”
.
.
ইরিনার মাথার পাশে বসে আছে সাঈদ। বাবু নর্মালে হয়েছে তাই ইরিনার জ্ঞান আছে। বাবুকে নিয়ে সাঈদের বাবা মা হৈহল্লা করছে। সাঈদের দৃষ্টি ইরিনার দিকে। কিছুক্ষণ আগে ইরিনার অবস্থা দেখে সে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল, এই বুঝি হারিয়ে ফেলল তাকে। ইরিনা সাঈদের বাবা মায়ের কান্ড দেখে হেসে সাঈদের দিকে তাকাল। নিশ্চয়ই কান্না করেছে সাঈদ তাই তো চেহারার এই হাল। ইরিনা চোখ ছোটো ছোটো করে বলল,
“কান্না করেছো?”
সাঈদ না সূচক মাথা নাড়াল। ইরিনার হাতে হাত রেখে নাক টেনে বলল,
“তুমি ঠিক আছো?”
“তোমার কি মনে হয় না তুমি ওভার-প্রোটেক্টিভ? তুমি একবারো আমাদের মেয়েকে কোলে নিলে না। সেই কখন থেকে আমার পাশে বসে আছো।”
“ও তো খুব ছোটো। আমার ভয় করে।”
ইরিনা লম্বা নিশ্বাস ফেলল। সাঈদ ইরিনার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
“নেবো, ডাক্তার বলেছে আজ রাতেই ডিসচার্জ করে দেবে তোমাদের৷ বাসায় গিয়ে আমাদের বাবুকে আমিই রাখবো। আর তুমি বিশ্রাম নেবে।”
“ঠিক আছে জনাব। যো হুকুম।”
সাঈদ মুচকি হেসে ইরিনার কপালে চুমু দিলো। তখনই দরজা ঠেলে ঝর্ণা ঢুকলো। খুশিতে লাফাতে লাফাতে এগিয়ে আসলো। ইরিনা তাকে দেখে অবাক। ঝর্ণার এখন স্কুলে যাওয়ার সময় আর ও এখানে? ঝর্ণার মা মা*রা গিয়েছে ২ বছর আগে। ঝর্ণা ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়েছিল। পরে আর পড়াশোনা করতে পারেনি। তাই সাঈদ আর ইরিনা ঝর্ণার পড়ার দায়িত্ব নিয়েছে। পড়াশোনা তো আর বয়স দিয়ে হয় না। ঝর্ণা বাচ্চাকে এক নজর দেখে ইরিনার দিকে আসলো। ইরিনাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আপা আমি আজকে অনেক খুশি। খুশির ঠ্যালায় স্কুল যাইবার পারি নাই।”
সাঈদ তার কান ধরে টেনে বলল,
“তোমার বার্ষিক পরীক্ষা সামনে আর তুমি স্কুল মিস দিচ্ছো?”
ঝর্ণা সাঈদের হাত ধরে বলল,
“ভাই ভাই ছাড়েন কান ছিঁড়া গেল আমার।”
সাঈদ ছেড়ে বলল,
“পড়া চোর কোথাকার।”
ঝর্ণা কান ডলতে ডলতে বলল,
“এল্লেগাই আপনেরে আমার ভাল্লাগে না।”
ইরিনা হাসলো তাদের কান্ড দেখে। ঝর্ণা গিয়ে সাঈদের আম্মুর কোল থেকে বাবুকে নিয়ে ইরিনার পাশে বসলো। ফুটফুটে একটি ছোট্ট মেয়ে বাবু। দেখতে পুরো ইরিনার মতোই হয়েছে। ঝর্ণা বাবুর সাথে খেলা করছিল তখনই সূর্য আর সাগরিকা আসলো। সবাইকে সালাম দিয়ে সাগরিকা ইরিনার দিকে হেটে আসলো। সূর্য ঝর্ণার কাছে আসলো বাবুকে দেখতে। সূর্যকে দেখে ঝর্ণা বিরক্ত চেহারা বানালো। সূর্য তার চেহারা দেখে বলল,
“আমি দেখতে এতোই খারাপ? তুমি আমাকে দেখলে চেহারা এমন ক্যাঙ্গারুর মতো বানিয়ে ফেলো কেন?”
ঝর্ণা রাগে গজগজ করতে করতে বলল,
“নিজের চেহারা দেখসেন আয়নায়? দেখতে পুরো বান্দরের মতো।”
“এহ আসছে, মেয়েরা ম*রে আমার এই চেহারার উপর।”
“হ ডরের ঠ্যালায় ম*রে। যে না চেহারা।”
“এইযে কারো চেহারা নিয়ে মন্তব্য করা পাপ জানো না?”
ঝর্ণা ইরিনার দিকে তাকিয়ে ন্যাকামোর কন্ঠে বলল,
“আপা দেহেন আমার লগে ঝগড়া করে।”
“তুমি কোনো অংশে কম? নিজে চুপ থাকতে পারো না?”
ইরিনার কথা শুনে ঝর্ণা চুপসে গেল। সূর্য হাসতে হাসতে শেষ। পেটে খিল ধরে গিয়েছে তার। ঝর্ণা রাগী দৃষ্টিতে তাকাল সূর্যের দিকে। সূর্য তার চাহনি দেখে আরো জোরে হাসতে লাগলো। এই মেয়েকে রাগাতে তার ভীষণ ভালো লাগে। সাগরিকা ঝর্ণার কোল থেকে বাবুকে নিলো। সূর্য হাসি থামিয়ে এদিক সেদিক দেখে বলল,
“ইর্তেজা ভাই আর মাহা ভাবী কোথায়? ভাইয়া আমাকে কল দিয়ে গুড নিউজ শোনালো। এখন দেখি ভাইয়াই নেই।”
সাঈদ বলল,
“ইর্তেজা ফ্যাক্টরিতে ছিল। বলল মাহাকে বাসা থেকে নিয়ে একেবারে আসবে।”
.
.
রিকশা পাচ্ছে না বলে ইর্তেজা মাহাকে দাঁড়াতে বলে কিছুটা এগিয়ে গেল। রাস্তার মোড়ে অনেক রিকশা পাওয়া যায়। মাহা দাঁড়িয়ে ইর্তেজার অপেক্ষা করছে। পরনে বোরখা, হিজাব শুধু চোখ দেখা যাচ্ছে মাহার। একটা বাইক এসে তার সামনে দাঁড়াল। দুটো ছেলে বসে আছে বাইকে। মাহা এক নজর তাদের দেখে মুখ ঘুরিয়ে ফেলল। তাদের মধ্যে একজন বলল,
“কি গো ম্যাডাম যাবেন কোথায়? আপনি বললে আপনাকে ছেড়ে দিয়ে আসতে পারি।”
মাহা জবাব দিলো না। দ্রুত হাটা ধরলো। তারা বাইক এগিয়ে নিয়ে আসলো মাহার দিকে।
“আরে ম্যাডাম যাচ্ছেন কোথায়? আরে আসুন, আমাদের মাঝে বসুন। আমরা থাকতে কিসের ভয়?”
মাহার মাথা গরম হয়ে গেল। দাঁড়িয়ে রাগী দৃষ্টিতে তাকাল তাদের দিকে। তারা হাসলো মাহার চাহনি দেখে।
“এভাবে দেখলে তো প্রেমে পড়ে যাব। চোখগুলো দেখেই ফিদা হয়ে গেলাম। চেহারা দেখলে না জানি কি হয়।”
“ওয়ার্নিং দিচ্ছি, আমাকে ইভটি*জিং না করে চলে যান। নাহলে এরপর যা হবে।”
তাদের মধ্যে একজন বলল,
“কি হবে শুনি?”
“আমি জানি না কি হবে। তারাতাড়ি পালান আপনারা।”
পেছনে যে বসেছিল সে বাইক থেকে নেমে বলল,
“একা পালাবো কেন? তুমিও সাথে চলো।”
“সরি ইন এডভান্স।”
ছেলেটা ভ্রু কুঁচকালো। তখনই পেছনে বাইকে বসা ছেলেটার চিৎকার মেরে উঠল। তার বন্ধু পেছনে ফিরে দেখে একটা ছেলে তার বন্ধুর গলা চেপে ধরে রেখেছে। সে চমকে উঠল। মাহা বলল,
“ইর্তেজা, কি করছিস? ম*রে যাবে তো।”
ইর্তেজা রাগী দৃষ্টিতে সামনে থাকা ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটা দৌড়ে গেল নিজের বন্ধুকে ছাড়ানোর জন্য। ইর্তেজা তাকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিলো। তার মাথা গরম হয়ে গিয়েছে রাগে। ছেলেটার শার্টের কলার ধরে টেনে মাটিতে দাঁড় করালো। বাইক মাটিতে পরতেই ছেলেটার কলিজার পানি শুকিয়ে গেল।
“ভাই আমার বাইক। আমার ভালোবাসা। মাফ করেন ভাই আর কোনো মেয়ের সাথে বেয়াদবি করবো না।”
ইর্তেজা তার মুখ চেপে ধরে বলল,
“বাইকের একটু ক্ষতি হলো বলে তোর এত কষ্ট। তুই তো আমার বউকে ইভটি*জিং করছিলি। তো ভাব আমার কেমন লাগছে?”
“ভাই মাফ করে দেন।”
ছেলেটা মাহার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভাবী মাফ করে দেন প্লিজ।”
মাহা বলল,
“ইর্তেজা ছেড়ে দে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে ওদের বয়স কম।”
মাহা আবার সেই ছেলে গুলোর উদ্দেশ্যে বলল,
“বাচ্চু তোমার বড়ো বোনের বয়সী আমি। আজকের পর থেকে ইভটি*জিং করার আগে একশোবার ভাববে কেমন?”
“জি বড়ো আপু বুঝেছি।”
দুজনই মাহা আর ইর্তেজার কাছ থেকে মাফ চেয়ে বাইক নিয়ে পালালো। ইর্তেজার এখনো মাথা গরম হয়ে আছে। রাগী কন্ঠে বলল,
“ছোটো বলে শুধু গলা ধরেছি। নাহলে নাক মুখ ভেঙ্গে দিতাম।”
মাহা হেসে ইর্তেজার হাত ধরে বলল,
“হয়েছে, এখন চল আমাদের হসপিটাল যেতে হবে।”
ইর্তেজা মাথা নাড়াল।
.
.
বাবুকে নিয়ে সবার আনন্দ এখন সাত নম্বর আকাশে। অনেকদিন পর সবার জীবনে যেন সুখ ফিরে এসেছে। সাঈদ তার বাবুকে কোলে নিয়ে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে। ইরিনাকে বিয়ে করার পর অনেক কিছু শুনতে হয়েছে তার৷ দুনিয়ার পরোয়া করেনি। তখন সহ্য করেছে বলে আজ এত সুখ তার ভাগ্যে এসে ঠাই নিয়েছে। ইরিনা সাঈদ ও তার বাবুর দিকে তাকিয়ে আছে। কেন যেন তার কান্না আসছে। প্রচুর কান্না। সুখের কান্না যেটাকে বলে। কতোই না যুদ্ধ করেছে এই জীবনে। আজ সে জয়ী। ইর্তেজা ইরিনার মাথায় হাত রেখে বলল,
“কি ভাবছো আপু?”
ইরিনা ইর্তেজার দিকে তাকিয়ে জবাবে মুচকি হাসলো। ইর্তেজা ইরিনার পাশে বসে বলল,
“জানো, খুব ভয়ে থাকতাম তোমাকে নিয়ে। সাঈদ যখন বলেছিল ডাক্তার বলেছে ডেলিভারির সময় সমস্যা হতে পারে। বিশ্বাস করো রাতে ঘুম আসতো না।”
“আমি জানি তুই টেনশন করিস। তাই সাঈদকে বলেছিলাম আমার ডেলিভারির পর যাতে তোকে কল দেয়।”
ইর্তেজা ইরিনার কপালে চুমু দিয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো। ইরিনার বেশ শান্তি অনুভব হচ্ছে। একমাত্র ইর্তেজা ও সাঈদের বুকেই ইরিনা নিজেকে নিরাপদ অনুভব করে। ভাই, যে সব বিপদে তার হয়ে সমাজের সাথে লড়েছে। স্বামী, যে সব বিপদে তার পাশে থেকেছে। ইরিনা ইর্তেজাকে বলল,
“নিউ বর্ন মামা, বাবুকে কোলে নিবি না?”
“কিভাবে নিবো? সাঈদ কারোর কোলে দিচ্ছেই না।”
“জানিস, কিছুক্ষণ আগে কোলে নিতে ভয় পাচ্ছিল। আর এখন কোল থেকে নামাচ্ছেই না।”
মাহা এই কথা শুনে হেসে বলল,
“এটাকে বলে বাবার ভালোবাসা।”
ঝর্ণা বলল,
“তা আপনে গুড নিউজ কবে দিবেন?”
মাহা দু’বার চোখের পলক ফেলল ঝর্ণার প্রশ্ন শুনে। ইর্তেজা সাঈদের কাছে চলে গেল। তার কেন জানি লজ্জা অনুভব হচ্ছে। সাগরিকা বলল,
“ঝর্ণা আমার মনের প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করলো।”
মাহা এক নজর ইর্তেজাকে দেখে বলল,
“হয়তো আজই”
ইরিনা, সাগরিকা, ঝর্ণা তিনজনই অবাক হয়ে গেল। মাহা তাদের চাহনি দেখে ফিক করে হেসে দিয়ে বলল,
“ইদানীং শরীর অসুস্থ লাগছে। খাবার খেলে বমি হয়ে যায়৷ পিরিয়াডও হইনি এই মাসে। হসপিটাল যেহেতু এসেছি টেস্ট করাবো ভাবছি।”
ঝর্ণা খুশিতে লাফ দিয়ে এসে মাহাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“ইয়াহু আর একটা বাবু আইবো।”
“আস্তে বলো, এখনো জানি না আমি প্রেগন্যান্ট কি-না।”
“আমার দোয়া আপনের লগে আছে। আমি আবার খালা হমু।”
মাহা হেসে ঝর্ণার গাল ধরে টানলো। সাগরিকা তাদের দেখছে আর নিঃশব্দে হাসছে। কিন্তু বুকের বা পাশে কষ্ট অনুভব হলো তার। যদি সেদিন তার বাবুর কিছু না হতো তাহলে তার বাবু ৪ বছরের হতো। লম্বা নিশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করলো। নিজের সন্তান নেই তো কি হয়েছে। সে সকল অনাথ বাচ্চাদের সে নিজের সন্তান ভাবে।
.
.
মাহা আর ঝর্ণা কেবিন থেকে বেরিয়েছে। মাহা ডাক্তারদের সাথে কথা বলে টেস্ট করাবে। ইরিনা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। তার পাশে বসে আছে সাঈদ। সূর্য বাবুকে নিয়ে খেলা করছে। সাগরিকা জানালার পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। হসপিটালের দরজা দিয়ে শত শত মানুষ আসছে আর যাচ্ছে। দুনিয়াটা বড্ড অসুস্থে ঘেরা। ইর্তেজার দৃষ্টি গেল সাগরিকার দিকে। এগিয়ে গেল তার দিকে। ইর্তেজা এসেছে সাগরিকা টের পায়নি। সে আনমনে বাহিরে তাকিয়ে আছে। ইর্তেজার কথায় হুঁশ ফিরলো,
“মিস করছো?”
সাগরিকা ইর্তেজার দিকে তাকিয়ে বলল,
“কাকে?”
“যেন জানো না কার কথা বলছি।”
সাগরিকা আবার বাহিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
“উত্তরটা তুমি জানো ইর্তেজা।”
“জানো, মনে হচ্ছে আমাদের দ্বারা ভুল হয়ে গিয়েছে।”
“কি ভুল?”
“সেদিন আমরাই পুলিশ নিয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের বললে ভুল হবে। আমি নিয়ে গিয়েছিলাম।”
“এতে ভুলের কি আছে ইর্তেজা? শ্রাবণ তোমার বোন আর মাহাকে আটকে রেখেছিল। যা করেছো একদম ঠিক করেছো।”
“কিন্তু, নিজেকে অপরাধ মনে হয় আমার।”
বলেই ইর্তেজা সাগরিকার দিকে তাকাল। সাগরিকা শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ইর্তেজা দৃষ্টি নামিয়ে নিয়ে বলল,
“ভুল হয়ে গিয়েছে।”
“ভুলে যাও ইর্তেজা। উপরওয়ালা যা করে আমাদের ভালোর জন্য করে।”
“এখানে তোমার ভালো কোথায় সাগরিকা?”
সাগরিকা হেসে বলল,
“তোমার কী মনে হয় আমি ভালো নেই? শ্রাবণ যাওয়ার আগে আমাকে এক টুকরো জান্নাত দিয়ে গিয়েছে। যেখানে শত শত নিষ্পাপ প্রাণ বসবাস করে। জানো, যখন আমি আশ্রমে চোখ বুলাই। শ্রাবণের দেয়া প্রত্যেক কষ্ট ভুলে যাই।”
সাগরিকা দৃষ্টি ঘুরিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আবার বলল,
“আমি জানি ও পাপী, আর এই পাপী মানুষটাকেই আমি সম্মান করি। ইর্তেজা, আমি এই ৫ বছরে একটা বিষয় বুঝেছি। ভালো তো একজনকেই বেসেছি আমি। কিন্তু শ্রাবণের প্রতি মায়া আমার সেই ভালোবাসাকেও হার মানায়।”
ইর্তেজা তাকিয়ে রইল সাগরিকার দিকে। সাগরিকা আবার বলল,
“আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো আফসোস। আমি ইচ্ছে করেই তাকে শেষ দেখা দেখিনি। তুমি ঠিক বলেছিলে ইর্তেজা। আমি সারাজীবন ছটফট করবো তাকে দেখার জন্য। আর সত্যি আমি আজও ছটফট করছি তাকে দেখার জন্য।”
“যদি তার শাস্তি ফাঁ*সির বদলে কিছু বছরের জেল হতো। আর তোমার কাছে ফিরে আসতো। তখন কি করতে তুমি?”
সাগরিকা ইর্তেজার দিকে তাকিয়ে বলল,
“জানি না, তাকে আমি দেখতেও চাই। আবার ভাবি, তাকে দেখলেই আমার মনে পড়ে যাবে আজমাইন নির্দোষ ছিল।”
ইর্তেজা আর কিছু বলল না। সে সাগরিকার মনের অবস্থা বুঝতে পারছে। কিছু কিছু মানুষ ঠিক এইভাবেই নিজের সাথে লড়াই করে জীবন কাটায়। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত। যখন শেষ নিশ্বাস ত্যাগ হয়। তখন সেই মানুষটা জয় লাভ করে আবার সেই মানুষটাই হেরে যায়।
.
.
ইরিনা আর বাবুকে নিয়ে বাসায় আসা হয়েছে। তারা বাসায় আসার আগে সূর্য ও ঝর্ণা মিলে পুরো ঘর বেলুন দিয়ে বাজিয়েছে। ইরিনা আর সাঈদ এসে অবাক। না না, তারা অবাক ঘর দেখে হয়নি। ঘরে প্রবেশ করতেই দেখে সূর্য আর ঝর্ণা ঝগড়া করছে। সাগরিকা আর মাহা মিলে তাদের ঝগড়া থামালো। সূর্য রাগে কটমট করছে। আর ঝর্ণা সূর্যের চোখে চোখ পরতেই ভেংচি কাটছে। সূর্য আর তার দিকে তাকালোই না। রাতের খাবার খেয়ে সবাই যার যার বাসায় চলে গেল। ইরিনা খুব ক্লান্ত। পেটে ব্যাথা অনুভব হচ্ছে বলে শুয়ে রইল। সাঈদ পুরো ঘর পরিষ্কার করে গোসল করে নিলো৷ ঘরে ছোটো বাচ্চা আছে। এখন যত সম্ভব ঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। সাঈদ এসে খাটে হেলান দিয়ে বসলো। তার মেয়ে ঘুম। ইরিনা জেগে আছে। একবার চোখ খুলে আবার বন্ধ করে শুয়ে পড়ে। ইরিনা তার বাবুর দিকে ঘুরে দেখে সাঈদ তার দিকে তাকিয়ে আছে। মুচকি হেসে বলল,
“হয়েছে দেখা?”
সাঈদ না সূচক মাথা নাড়াল। ইরিনা এক নজর বাবুকে দেখে বলল,
“আমার তো ঘুম আসছে না।”
“কেন? খারাপ লাগছে?”
“উঁহু, অভ্যেস খারাপ করে ফেলেছো তুমি আমার।”
“আমি আবার কী করলাম?”
“যত পর্যন্ত তোমার বুকে মাথা না রাখি আমার ঘুম আসে না। বাবু বড়ো না হওয়ার পর্যন্ত কম্প্রোমাইজ করতে হবে।”
সাঈদ মুচকি হেসে সোজা হয়ে বসলো। খাটে থাকা কোলবালিশ গুলো দেয়ালের সাথে দিয়ে ইরিনাকে বলল বাবুকে কিনারায় দিয়ে মাঝখানে ঘুমাতে। ইরিনা তাই করলো। বালিশ আছে বলে দেয়ালের সাথে আঘাত হওয়ার রিস্ক নেই। আর বাবু খুব ছোটো তাই গড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। সাঈদ ইরিনার পাশে আধশোয়া হয়ে ইরিনার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
“যতদিন বেঁচে আছি নো কম্প্রোমাইজ।”
ইরিনা হেসে সাঈদকে জড়িয়ে ধরে বুকে কপাল ঠেকালো। এর থেকে বেশি সুখের অনুভূতি আর কী হতে পারে?
.
.
মাহা খাটে বসে ভাবনার জগতে ডুবে আছে। সকাল ১০ টায় রিপোর্ট দেবে। যদি পজিটিভ হয় রিপোর্ট? ভাবতেই ভালো লাগা অনুভূতি হচ্ছে। মাহা পেটের উপর হাত রাখলো। হয়তো ভেতরে ইর্তেজা ও তার অংশ ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে। ইর্তেজা জানলে অনেক খুশি হবে। মাহার ভাবনায় ছেদ পরলো দরজা খোলার শব্দ শুনে। ইর্তেজা মাথা মুছতে মুছতে ঘরে প্রবেশ করলো। ফ্যাক্টরি থেকে এসে মাহাকে নিয়ে হসপিটাল চলে গিয়েছিল। ফ্রেশ হওয়ার সময় পায়নি। মাহা ইর্তেজাকে দেখে খাট থেকে নামলো। ইর্তেজা মাহার দিকে হেটে এসে তোয়ালে এগিয়ে দিলো। মাহা তোয়ালে নিয়ে জানালার দিকে হেটে গেল। দঁড়িতে শুকাতে শুকাতে বলল,
“ইর্তেজা, আমাদেরও একদিন এমন একটা ছোট্ট বাবু হবে তাই না?”
ইর্তেজা খাটে বসে বলল,
“ইন শাহ আল্লাহ হবে”
মাহা ফিরে এসে ইর্তেজার পাশে বসলো। ইর্তেজার কপালে পানির ছিটেফোঁটা লেগে আছে। মাহা তার ওড়না দিয়ে মুছে দিলো। ইর্তেজা তাকিয়ে আছে মাহার দিকে। মাহা ইর্তেজার হাত ধরে হাতের তালুর দিকে তাকাল। স্টিলের আসবাবপত্র বানানোর ফ্যাক্টরিতে কাজ করে ইর্তেজা গত ৫ বছর ধরে। হাতের তালুতে ক্ষতের অভাব নেই। মাহার মাঝেমাঝে কান্না পায়। এত কষ্ট করে মানুষটা। তার জীবন তো এমন ছিল না। যবে থেকে তার মায়ের মৃ*ত্যু হয়েছে। একদম বদলে গিয়েছে তার জীবন। মাহা ইর্তেজার দু’হাতে নিজের দুগালে দেখে ইর্তেজার দিকে তাকাল। মাহার চোখ দুটোয় অশ্রু টলমল করছে। ইর্তেজা চোখ ছোটো ছোটো করে বলল,
“ইমোশনালফুল কোথাকার।”
“কত কষ্ট করো তুমি সংসার চালানোর জন্য। কতবার বলেছি আমাকে টিউশন করতে দাও। কি হবে আমি টিউশন করলে?”
“গ্রীষ্মকালের গরম দেখেছো? চামড়া পুড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়ে যায় গরমে। তোমার কি মনে হয় আমি তোমাকে কাজ করতে দেবো? আমি এখনো বেঁচে আছি মাহা।”
মাহার গাল গড়িয়ে চোখের পানি পরলো। ইর্তেজা পানি মুছে বলল,
“হয়েছে তো। এত ইমোশনাল হতে হবে না। এসবের অভ্যেস হয়ে গিয়েছে আমার।”
“আমার যে কষ্ট হয় ইর্তেজা।”
“কিন্তু আমার হয় না। আমার আরো খারাপ লাগে। গত ৪ বছর আগে ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে সাগরিকার সাহায্য করেছি। যাতে ও শ্রাবণের ইচ্ছে পূরণ করতে পারে। সেখান থেকে কিছু টাকা দিয়ে যদি তোমার একটা ছোট্ট স্বপ্ন পূরণ করতে পারতাম মনে একটু হলেও শান্তি অনুভব হতো।”
“আমি কখনো অভিযোগ করেছি?”
“উঁহু”
“আমার কোনো স্বপ্ন নেই। আমার সকল স্বপ্ন তোমাকে নিয়ে ঘেরা। তুমি আমার জীবনে আছো। ব্যস সব আছে আমার।”
“আমি জানি আমার মাহা একটা ছোট্টখাট্টো রাজ্যের রাজকন্যা ছিল। যে আমার জন্য সব ছেড়ে দিয়েছে।”
“এইযে আমি রেগে যাব বলে দিচ্ছি। অতিরিক্ত কথা বলিস তুই।”
ইর্তেজা মাহার কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে বলল,
“আমার মন রাখার জন্য কত ড্রামা করতে হয় তোমার। আমি সব বুঝি মাহা।”
“জি না স্যার, আপনি কিছু বুঝেন না। বুঝলে এমন ঢং মার্কা কথাবার্তা বলতেন না।”
ইর্তেজা হেসে সোজা হয়ে বসলো। মাহাও মুচকি হাসলো তার হাসি দেখে। এগিয়ে গিয়ে ইর্তেজার বুক দখল করে বিড়ালের বাচ্চার গুটিশুটি মেরে বসে পরলো। ঘুম না আসার পর্যন্ত নাহয় ভালোবাসার আলাপ করে কাটানো যাক।
.
.
সাগরিকা সব কক্ষ চেক করছে। বাচ্চারা ঘুমিয়ে কি-না প্রতিদিন রাতে সে চেক করে তারপর ঘুমায়। বেশ দুষ্ট তো সবাই। সারাদিন দুষ্টুমি করে। সবাই ঘুমিয়ে গিয়েছে দেখে সাগরিকা হলরুমে গেল। জানালা সব বন্ধ করে পর্দা দিয়ে ঢেকে দিলো। ঘুরে দাঁড়াতেই দেখে রিয়াদ দাঁড়িয়ে আছে। ঘুমু ঘুমু চোখ তার। সাগরিকা কোমড়ে হাত দিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল,
“আমি কি জানতে পারি আপনি এখনো ঘুমান নি কেন?”
“ঘুম আসে না আম্মু”
সাগরিকা মুচকি হেসে এগিয়ে গেল। রিয়াদ কোলে তুলে বলল,
“আম্মুর বাচ্চা, চোখ ভরা ঘুম তোমার।”
রিয়াদ মন খারাপ করে ফেলল। সাগরিকা হেসে বলল,
“কি হয়েছে আমার বাবুর?”
“ইয়াসিন চলে গিয়েছে কেন?”
সাগরিকা লম্বা নিশ্বাস ফেলল। ইয়াসিন রিয়াদের বয়সেরই একটা বাচ্চা। আজ তাকে একটা পরিবার এডপ্ট করেছে। রিয়াদ আর সে শুধু মারামারি করতো। আর এখন ইয়াসিন চলে যাওয়ায় রিয়াদ মন খারাপ করে রেখেছে। সাগরিকা হেসে বলল,
“ওর আব্বু আম্মু এসেছিল তাই চলে গিয়েছে।”
“তুমি তো ওর আম্মু”
সাগরিকা চিন্তায় পরলো। রিয়াদের বয়সের অনুযায়ী সে একটু বেশিই প্রশ্ন করে। একদম ইঁচড়েপাকা। সাগরিকা কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
“উনারাই ইয়াসিনের আসল আম্মু আব্বু। ইয়াসিন আমাদের সাথে কিছুদিনের জন্য ছিল।”
“আমার আসল আম্মু আব্বুও আছে?”
“হয়তো, যদি কেও তোমাকে নিতে আসে। দিয়ে দিবো তোমাকে।”
“না, তুমি আমার আসল আম্মু।”
বলেই সাগরিকার গলা জড়িয়ে ধরলো রিয়াদ। সাগরিকা হাসলো। রিয়াদ আবার বলল,
“আম্মু, আমার আসল আব্বু কোথায়?”
সাগরিকা রিয়াদের চেহারার দিকে তাকিয়ে রইল। এই প্রশ্নের উত্তর সে কিভাবে দেবে। রিয়াদ আবার বলল,
“টিচার আন্টি বলেছে আব্বুর নাম শ্রাবণ। আব্বু কোথায়?”
সাগরিকা জোরপূর্বক হেসে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। শ্রাবণ থাকলে নিশ্চয়ই সবাই তাকে আব্বু ডাকলো। সাগরিকা রিয়াদকে নিয়ে বাহিরে গেল। দরজার সিঁড়ির সামনে রিয়াদকে কোলে নিয়ে বসলো। আকাশে অনেকগুলো তারা। সাগরিকা একবার চোখ বুলিয়ে রিয়াদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আব্বু কোথায় দেখবে?”
রিয়াদ হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। সাগরিকা মুচকি হেসে আকাশের দিকে হাতে ইশারায় বলল,
“ওই দেখো, সেই সব তারা ভীরে তোমার আব্বু আছে। যে তোমাদের সবার জন্য এই বাড়ি বানিয়েছে।”
রিয়াদ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
“আব্বু স্টারে থাকে?”
“হ্যাঁ, আব্বু সেখান থেকে আমাদের সবাইকে দেখে।”
“আমি যাব না আব্বুর কাছে?”
“না, এত তারাতাড়ি না। তোমাকে অনেক বড়ো হতে হবে। অনেক ভালো মানুষ হতে হবে। আমি তোমাদের সবাইকে ভালো ভালো পরিবারের অংশ বানাতে চাই। যাতে বড়ো হয়ে শ্রাবণ আহমেদ হতে না পারো।”
রিয়াদ সাগরিকার কথা কিছু বুঝলো না। চুপচাপ তাকিয়ে রইল। সাগরিকার কান্না আসছে। দ্রুত রিয়াদ নিয়ে তার ঘরে গেল। রিয়াদকে শুইয়ে দিয়ে পাশে বসে মাথায় হাত বুলাতে লাগলো। ঘুম ভরা চোখ বলে রিয়াদ তারাতাড়ি ঘুমিয়ে পরলো। সাগরিকা তাকে ঘুম পাড়িয়ে ঘর থেকে বের হলো। পুরো হলরুমে চোখ বুলালো। কত খালি লাগছে চারপাশ। হেটে গিয়ে আবার দরজার পাশে বসলো। এটাই সঠিক সময়, নিজের কষ্ট কম করার। নিঃশব্দে চোখের জল ফেলতে লাগলো। তার দৃষ্টি আকাশের দিকে। যেমনটা সে রিয়াদকে বলল, শ্রাবণ তাদের দেখছে। সত্যিই কি দেখছে? সাগরিকা তাকিয়ে রইল। হঠাৎ দমকা হাওয়া এসে তার পুরো শরীর ছুঁয়ে দিলো। সাগরিকা চোখ বন্ধ করে অনুভব করলো। ধীরে ধীরে চোখ খুলে বলল,
“মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করে, সব ফেলে চলে আসি তোমার কাছে। কিন্তু হঠাৎ মনে পড়ে, তোমার স্বপ্ন পূরণের দায়িত্ব আমি নিয়েছি। আমার অভিমানের পাল্লা তখন ভারী ছিল। কিন্তু তুমি অভিমান করে থেকো না। আমার দায়িত্ব এখনো শেষ হয়নি শ্রাবণ। শুধু এই দুনিয়াতে না, সেই দুনিয়াতে চাই আমি তোমায়, #আর_একটিবার ।

❤️❤️সমাপ্ত❤️❤️