দুষ্টু মিষ্টি প্রেম পর্ব-০১

0
515

#দুষ্টু_মিষ্টি_প্রেম
#নিঝুম_জামান
#সূচনাপর্ব

টিউশনিতে যাওয়ার সময় রাস্তায় কুকুরের দৌড়ানি খেয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে স্টুডেন্টের বাসার সামনে গিয়ে হঠাৎ একটা ছেলের সাথে ধাক্কা খেলাম। আমি ধাক্কা খেয়ে সরাসরি মাটিতে গিয়ে ধপাস করে পড়লাম, আর কুকুরগুলোও ঘেউঘেউ করে চলে গেল। কুকুরগুলোর ওপর ভীষণ রাগ হলো। যার সাথে ধাক্কা খেলাম তার হাতের ফোনটাও পড়ে গেছে,মনে হয় ভেঙেও গেছে।যাক গে,সেদিকে খেয়াল না করে তাড়াতাড়ি জামাকাপড় ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালাম।লোকজন দেখার আগে আগে। হাতের কনুইয়ের দিকটাও ছিলে গেছে,ভীষণ জ্বলছে।

–এই যে মিস,চোখ কি আকাশে তুলে হাঁটেন।আর এভাবে দৌড়াচ্ছিলেন কেন?দিলেন তো আমার ফোনটা ভেঙে। ( হালকা রাগ দেখিয়ে)

ছেলেটার কথায় আমার খেয়াল আসল। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম ছেলেটা ভীষণ সুন্দর। এরকম একটা সুন্দর ছেলের সাথে ধাক্কা খাওয়াটা মন্দ না। সিনেমায় তো নায়িকারা নায়কের সাথে ধাক্কা খায়,তারপর প্রেম হয়।আমার হয় কি না কে জানে!
যাইহোক, এসব ভাবনা ছেড়ে মুখটা করুন করে ছেলেটার কথার উত্তর দিলাম,

— আসলে কুকুরগুলো আমাকে তাড়া করছিল,সেটা তো আপনি দেখলেনই।ওদের ভয়েই আমি দৌড় দিয়েছি।দুঃখিত আমি বুঝতে পারি নি।
ওনার ফোনের দিকে তাকিয়ে বললাম, মোবাইলের গ্লাস প্রটেকটর-টাই ভেঙেছে, আর তো তেমন ক্ষতি হয় নি।

— এটা কি কোনো ক্ষতির আওতায় পড়ে না?

–হ্যাঁ,সেইজন্যই তো সরি বললাম। আর আমি তো ইচ্ছে করেও করি নি।ওই কুকুরগুলো…

পুরো কথা শেষ করার আগেই ওনি মুচকি হেসে বললেন,
–আপনি নিশ্চিত কুকুরগুলোকে জ্বালাতন করছিলেন,না হয় বিনা কারনে আপনাকে ওরা তাড়া করবে কেন? আমাকে তো আজ পর্যন্ত কোন কুকুর তাড়া করলো না।(মুচকি হাসি দিয়ে)

ছেলেটার প্যাঁচানো মার্কা কথা শুনে আমার রাগ উঠে গেল। কিন্তু রাগটাকে দমন করে রাখলাম। তার কারন ফোনটা ভেঙেছে আমার জন্য, এখন যদি আবার রাগ দেখাই ব্যাপারটা একটু বেশিই হয়ে যায়। ছেলেটার জায়গায় অবশ্য আমি হলে এতোক্ষণে হাজারটা কথা শুনিয়ে দিতাম। হালকা মেজাজ দেখিয়ে বললাম,

–কি আজব কথাবার্তা আপনার! সরুন দেখি…আমার টিউশনিতে দেরী হয়ে যাচ্ছে। আর শুনুন ক্ষতি আপনার একারই হয় নি,আমারও হয়েছে। এই দেখুন(কনুইয়ের নিচে ছিলে যাওয়া অংশটা দেখিয়ে) আমি ব্যাথা পেয়েছি বলে চলে আসতে নিলে ছেলেটা আমাকে ইশারায় থামতে বললো। তারপর কাঁধে ঝুলিয়ে রাখা ব্যাগ থেকে কি যেন খুঁজে বের করতে লাগলো।আমি হাঁ করে দেখছি ওনি কি বের করছেন? ব্যাগ থেকে একটা ওয়ানটাইম ব্যান্ডেজ বের করে আমার হাতটা এক ঝলক দেখে তারপর হাতে লাগিয়ে দিলো।দেখে মনে হচ্ছে যেনো প্রফেশনাল ডাক্তার। আমার আমি ছেলেটার ব্যবহারে রীতিমতো মুগ্ধ এবং আরো একবার ক্রাশ খেয়ে গেলাম।ছেলেটার নামটা জানতে বড্ড ইচ্ছে করছিল,কিন্তু জিজ্ঞেস করতে লজ্জা করছিল। ছেলেটা আমাকে কিছু একটা বলে চলে গেল। আমি তখনো মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছি।ভালো মতন খেয়াল করে দেখলাম ছেলেটার বয়স ২৫/২৬ বেশি নয়, হালকা খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, গায়ের রঙটা উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের হলেও নীল জিন্স, কালোঘড়ি আর হালকা গোলাপি রঙের শার্টটাতে দারুণ মানিয়েছে।তবে চোখে সাদা ফ্রেমের চশমা না হয়ে একটা কালো সানগ্লাস হলে পুরোই সিনেমার হিরো লাগতো। আপাতত এসব চিন্তা বাদ দিলাম,ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি অলরেডি ৯ টা ৪০।
এমনিতেই আজকে ভার্সিটিতে যেতে হবে। দেরী হলে বান্ধবী রিহা আমাকে আস্ত রাখবে না। স্টুডেন্টরা তিনতলায় থাকে,তাই তাড়াতাড়ি সিঁড়ি বেয়ে তিন তলায় পৌঁছালাম। কলিংবেল চেপে রীতিমতো হাঁপাতে লাগলাম। আজকে বেশ ভালোই দৌঁড়ানি খেয়েছি।এক্কেবারে বাড়ি থেকে সোজা স্টুডেন্টের বাসা। এরমাঝেই স্টুডেন্টের মা দরজা খুললেন।

–কি হয়েছে নিঝুম?এভাবে হাঁপাচ্ছো কেন?

–আর বইলেন না ভাবী রাস্তায় কুকুর দৌড়ানী দিয়েছিল।(ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললাম,তবে পড়ে যাওয়ার বিশাল কাহিনিটা স্কিপ করলাম।)

আমার ছাত্রী অর্পাকে তাড়াতাড়ি পড়িয়ে ভার্সিটিতে গেলাম।গিয়ে দেখি রিহা এখনো আসে নি। ওর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। সবসময় আমিই লেট করে যাই রিহা আমার জন্য অপেক্ষা করে।আজ বুঝতে পারছি কারো জন্য অপেক্ষা করাটা যে কি পরিমানের বিরক্তিকর! কিছুক্ষনের মধ্যেই রিহা চলে এলো।আমাকে দেখে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

–আজকে কি সূর্য পশ্চিম দিকে উঠেছে রে নিঝুম ? এ আমি কাকে দেখতে পাচ্ছি।

ওর কথায় আমি একটু লজ্জা পেয়ে গেলাম, এমন ভাবে বলছে যেন আমি কোন সেলিব্রেটি টাইমের আগেই চলে এসেছি।ক্লাস শুরু হতে আরো দশ মিনিট বাকী।আমরা গল্প করতে করতে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম।

–এ মা তোর হাতে কি হয়েছে?

–আর বলিস না,টিউশনিতে যাওয়ার সময় কুকুরের দৌড়ানী খেয়েছি।(পুরো কাহিনিটা ওকে খুলে বললাম)

–তুই টিউশনিতে যাওয়ার সময়ই কি যত অঘটন ঘটে! একদিন পাগলের দৌড়ানি খেলি আবার আজকে কুকুরের দৌড়ানী খেয়ে এক্কেবারে একটা ছেলের গাঁয়ের ওপর পড়লি।বাহ্ বেশ ইন্টারেস্টিং কাহিনি তো! তারপর কি হলো? নিশ্চয় ছেলেটা হাত ধরে তোকে টেনে তুলে তোর ব্যাগের ভিতর ওর ফোন নাম্বারটা দিয়ে দিয়ে গেছে তাই না? দেখিস ওই ছেলের সাথেই তোর প্রেম হবে, এখন রাস্তাঘাটেও তোদের অনেক বেশি দেখা হবে।তুই যেদিকে যাবি তোকে ফলো করে সেদিকেই ওই ছেলেটা যাবে। তারপর তোদের দুজনের একদিন বিয়ে হবে।
(চোখ বন্ধ করে এক নিশ্বাসে কথাগুলো রিহা নিঝুমকে বললো।)

নিঝুম কিছুটা রাগ দেখিয়ে রিহার পিঠে দুইটা থাপ্পড় দিয়ে বলল,

— সিনেমা দেখা বন্ধ কর তুই।সিনেমা দেখতে দেখতে মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোর। সবজায়গায় শুধু সিনেমার কাহিনি নিয়ে আসিস। হতেও তো পারে ছেলেটার গার্লফ্রেন্ড আছে?

–আরে,, রাগ করছিস কেনো? আমি তো মজা করছিলাম। আবার এমনো তো হতে পারে ছেলেটা তোর সাথে ধাক্কা খাওয়ার পর তোর ওপর দিওয়ানা পাগল হয়ে গার্লফ্রেন্ডের সাথে ব্রেকআপ করে নিলো।
(ভ্রু নাচিয়ে)

–তুই তোর আজাইরা গল্প দিবি,নাকি আমার হাতে আরো চড় খাবি।

এসব টপিক বাদ দিয়ে ক্লাসে গিয়ে বসলাম।যদিও ক্লাস করতে বিন্দুমাত্র কোনো ইচ্ছে নাই। রিহার আবদারে ভার্সিটিতে এসেছি।
.
.
.
দুপুরের দিকে ভার্সিটি থেকে ক্লাস শেষে ফিরে আমার রুমে ঢুকতেই দেখি আমার চার বছরের ভাগ্নে অর্ক কান্নাকাটি করছে। পুরো শরীর লাল হয়ে ফুলে গেছে।মনে পড়লো ইলিশ মাছে ওর এলার্জি, কিন্তু সকালে অনেক কান্নাকাটি করে আমার সাথে ইলিশ মাছ খেয়েছে।হাজার বারণ করা সত্ত্বেও কথা শুনে নি। এখন গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদছে। মা থামানোর চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। আপুও বাসায় নেই, অফিসে গেছে। বাবা আর ভাইয়া দোকানে গেছে। কি করব বুঝতে পারছিলাম না চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া।কিন্তু অর্কের কান্নায় নিজেকে আর চুপ করে বসিয়ে রাখতে পারলাম না। আপুকে ফোন দিলাম,আপু ধরল না।দুলাভাইকে ফোন দিলাম ওনিও অফিসের কাজে ব্যস্ত তাই আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে বললো। আমি রিহাকে ফোন দিয়ে রেডি হয়ে বের হতে বললাম। তারপর আমি আর রিহা অর্ককে নিয়ে স্থানীয় সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। হাসপাতালে গিয়ে তাড়াতাড়ি টিকেট কেটে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়লাম। কিন্তু রুমে ডাক্তার নেই,ডাক্তার নাকি জরুরি কাজে গেছে। আস্তে একটু সময় লাগবে। অনেকেই চলে যাচ্ছে ডাক্তার নেই তাই। একদিকে অর্কের কান্না, আরেকদিকে ডাক্তার নেই শুনে মেজাজ আমার খারাপ হয়ে গেছে। রিহাকে বলতে লাগলাম,জরুরি কাজ না ছাই, এখানে রোগি আর জরুরি কাজ কি রুমের বাইরে! দেখ গিয়ে বউ বা গার্লফ্রেন্ডের সাথে কথা বলছে।

–মুখ সামলে কথা বলুন।ডাক্তারদের কত জরুরি কাজ থাকে, সেটা জানেন। আপনি জানবেনই কীভাবে? আপনি তো অন্যের সমালোচনায় ব্যস্ত।

রিহার সাথে বেশ জোরে জোরেই কথাগুলো বলছিলাম কিন্তু আমার কথা শুনে উত্তর যে কেউ এভাবে দিবে ভাবতে পারি নি।পাশে তাকিয়ে দেখিয়ে
সকালে ধাক্কা খাওয়া সেই ছেলেটা। ছেলেটার কথা শুনে আমারও অনেক রাগ লাগলো।সকালেও আমার সাথে কুকুরের দৌড়ানীর কথা নিয়ে কথা প্যাঁচালো এখন আবার আমাদের দু’জনের কথা মুখ থেকে কেড়ে নিয়ে বলছে তার ওপর আবার ডাক্তারের চামচামি করছে।

–আপনাকে এখানে কেউ ডাক্তারের চামচামি করতে আসতে বলে নি। পারলে নিজের চরকায় তেল দেন।দেখে তো ডাক্তারদের কম্পাউন্ডার মনে হচ্ছে, পারলে আপনাদের স্যারকে ডেকে আনুন।(এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে ফেললাম)

–শাট আপ, কে ডাক্তারের চামচামি করছে?আমি নিজে একজন ডাক্তার।ছেলেটা ধমকে বললো। তার ধমক শুনে আমি চুপ রইলাম। তারপর সে তার রাগটাকে দমন করে আবার বলা শুরু করলো,

–একটা বাচ্চা ছেলে হাসপাতালে ভর্তি ছিল,ওর অবস্থা একটু আগে অনেক খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তাই তাড়াতাড়ি ছেলেটাকে দেখতে গিয়েছিলাম।
যাইহোক, আপনাদের কাছে এর জন্য জবাবদিহি করার কোন প্রয়োজন নেই।
দেখি সরুন (একটু ধমক দিয়ে বললো)

কথাগুলো বলেই ওনি ওনার রুমে ঢুকে রোগীদের একজন একজন করে আসতে বললেন। আমি যেহেতু সবার সামনে ছিলাম তাই আমিই আগে গেলাম।

–সরি,আমি আসলে বুঝতে পারি নি।আপনাকে কথাগুলো না জেনেই বলে….
পুরো কথা বলার আগেই ওনি বললেন,

–রোগীর সমস্যা কি সেটা বলুন?

ডাক্তারের ভাব দেখে আমার আবারও রাগ লাগলো।কিন্তু এবারে কিছু বললাম না। অর্কের সমস্যাগুলো বললাম। তিনি প্রেসক্রিপশন লিখে দিলেন। তার হাত থেকে প্রেসক্রিপশন নিয়ে আসার সময় ওনি মুচকি একটা হাসি দিলেন বিনিময়ে আমি মুখ ভেংচে চলে আসলাম। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে ঔষধ কেনার সময় রিহাকে বললাম,

–এই ডাক্তারের সাথেই সকালে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গিয়েছিলাম। তখন ভীষণ অবাক হয়েছিলাম যে ছেলেটা কেনো ওয়ানটাইম ব্যান্ডেজ ব্যাগে নিয়ে ঘোরে,এখন বুঝতে পারলাম আসলে তিনি একজন ডাক্তার।

এরপর রিহা আমাকে যা বলল তা শুনে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল……
★★★

চলবে