আষাঢ়ে প্রণয় সন্ধি পর্ব-০১

0
361

#আষাঢ়ে_প্রণয়_সন্ধি
#লেখিকা:#ইশা_আহমেদ
#সূচনা_পর্ব

“ঘরে মেয়ে বউ নেই আপনার। এই বয়সেও নোংরামি করতে ইচ্ছে করছে।বাবার বয়সি একজন লোক হয়ে আপনি এই ছোট মেয়েটাকে নোংরা স্পর্শ করছেন?মেয়ে দেখলে হুশ থাকে না”

ভরা বাসে চেঁচিয়ে উঠলো চিত্রা।সামনের সিটে বসে থাকা মধ্যবয়স্ক লোকটি হকচকিয়ে উঠলেন। সে বুঝতেই পারিনি কেউ খেয়াল করছে তাকে।তার পাশে থাকা মেয়েটিকে ততক্ষণে চিত্রা হাত টেনে উঠিয়ে নিয়েছে।চিত্রা রাগে থরথর করে কাঁপছে।সব কিছুই সে খেয়াল করছিলো। মেয়েটিও ভয়ে কাঁপছে। নিজেকে নির্দোষ প্রমান করতে চিল্লিয়ে বলল,,
“ আমি কেনো এমন করতে যাবো। মাথা ঠিক আছে? যা মাথায় আসছে বলে যাচ্ছেন”

চিত্রার মন চাইছে লোকটিকে ঠাটিয়ে থা*প্প*ড় মারতে। বয়সে সে অনেক বড় তার। ইচ্ছে থাকলেও কাজটি সে করতে পারবে না। বাসের লোকজন কানাঘু*ষা শুরু করে দিয়েছে। অধিকাংশ লোকই চিত্রাকে দোষ দিচ্ছে। চিত্রা মেয়েটিকে সামনের একটি সিটে বসিয়ে পানি খেতে দেয়। মেয়েটি এখনও কাঁপছে। চিত্রা মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।তখন বাসে থাকা একজন মহিলা বলে উঠেন,,

“কি বাজে মেয়ে রে বাবা,বাবার বয়সী একজন লোককে অপবাদ দিচ্ছে। লজ্জা ও নেই এইসব মেয়েদের”

লোকটির সাথে সেখানে থাকা মহিলারাও কথা শুনাতে লাগলো চিত্রা এবং মেয়েটিকে। মেয়েটি শান্ত হতেই চিত্রা নিজের কাঁধে ঝুলানো ব্যাগ থেকে নিজের মুঠোফোনটি বের করলো।এবং কিছুক্ষণ আগে লোকটির করা কাজটি সবাইকে দেখালো।সে জানতো সে কথাটি বললে কেউ বিশ্বাস করবে না। আগেও সে এমন ঘটনার সম্মুখীন হয়েছে। তাই তো ভিডিও করে নিয়েছে।লোকটির বড় বড় কথা সব বের হয়ে গিয়েছে। সবাই কানাঘু*ষা করছে। কেউ কেউ ঘৃনার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে।

লোকটিকে বাসের লোকজন একদফা মারলো। চিত্রা দাড়িয়ে দেখছে এইসব লোকেদের এরকম শাস্তি হওয়া উচিত।চিত্রা বাস থেকে নেমে পরে মেয়েটিকে নিয়ে।নামার আগে বাসে থাকা সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,,

“নিজেদের শুধরে নিন। দোষ সবসময় নারীদের হয় না। কিছু হলেই সব দোষ নারীকে কেনো দেন আপনারা? মন মানসিকতা বদলান,অন্যায়ের প্রতিবাদ করুন”

জীবনে সে এরকম অনেক কিছুই দেখেছে। সে মেয়েটিকে পাশের পার্কে নিয়ে আসলো। বেঞ্চে বসিয়ে নিজেও পাশে বসলো।মেয়েটি বেশ কিছুক্ষণ পর স্বাভাবিক হলো।চিত্রা খেয়াল করে দেখলো মেয়েটির বয়স চৌদ্দ কি পনেরো হবে।
“ধন্যবাদ আপু। আপনি না থাকলে হয়তো আমার ওভাবেই চুপ করে সহ্য করে যেতে হতো”

চিত্রা ব্যাগ থেকে বোতল বের করে ঢকঢক করে পানি খেলো।মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বলল,,
“সবসময় চুপ থাকবে না। আর কখনো মধ্যবয়স্ক লোকেদের পাশে বসবে না। আমাদের সমাজ পুরুষ মানুষের থেকেও নারীর দোষটাই বেশি দেখে। প্রতিবাদ করতে শিখো মেয়ে”

“ধন্যবাদ আপু আজ আপনার থেকে অনেক কিছু শিখলাম আমি। এখন থেকে আমিও প্রতিবাদ করবো অন্যায়ের”

“কে কি বলবে সেইসব নিয়ে ভাববে না। অন্যায় দেখলেই প্রতিবাদ করার চেষ্টা করবে এবং নিজেকে সব সময় স্ট্রং রাখবে”

“জি আপু চেষ্টা করবো। আপনার নামটাই তো জানা হলো না। আপনার নামটা কি আপু?

“আমি চিত্রা। হ্যাঁ চিত্রা রহমান”

“চিত্রা বাহ বেশ দারুন নাম। আমি অরিহা মেহরোজ। আপনিও যেমন দেখতে নামটিও আপনার তেমন। আপনি কোথায় যাচ্ছিলেন আপু”

“বান্ধবীর বাড়িতে যাচ্ছিলাম। তোমার তো আজ স্কুল যাওয়া হলো না। কোন ক্লাসে পড়ো?”

“আমি তো নবম শ্রেনীতে পরছি। আমার জন্য তো আপনার আজ বান্ধবীর বাড়িতে যাওয়া হলো না। আমি খুবই দুঃখিত আপু”

চিত্রা উঠে দাঁড়ালো। অরিত্রা ও ঝটপট করে দাঁড়িয়ে পরে। আসলে তার চিত্রাকে ভীষণ ভালো লেগেছে। চিত্রাকে হাত ঘড়ির সময় দেখে নিলো দশটা বেজে পনেরো মিনিট।চিত্রা অরিহাকে উদ্দেশ্য করে ক্ষীণ কন্ঠে শুধালো,
“তোমার বাড়ি কোথায় বলো তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি”

অরিহা উত্তেজিত হয়ে পরেছে।একটু আগে তার সাথে ঘটা ঘটনার কথা ভুলতে বসেছে।তার চিত্রাকে এতোটাই ভালো লেগেছে।গড়গড় করে নিজের বাড়ির ঠিকনা বলে দিলো।চিত্রা কিছুটা অবাক হলো।মেয়েটির বাড়ি তার বাড়ির পাশে। চিত্রা একটি রিকশায় চড়ে বসলো অরিহাকে নিয়ে। অরিহা দেখে চলেছে চিত্রাকে। একটা মেয়ে এতোটা সাহসী কি করে হয়। সে এইসবই ভাবছে এবং মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো সে নিজেও এমন হবে একদিন। অরিহাদের বাড়িটা চিত্রাদের বাড়ির পাশে। তবে চিত্রা চিনে না তাদের। এতো বছর ছিলো না কেউ। ভাড়া দেওয়া ছিলো।তবে শুনেছিলো বাড়ির মালিক এসেছে। ভাড়া মিটিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করলো চিত্রা অরিহাকে নিয়ে।

দোতলায় নিয়ে গেলো অরিহা চিত্রা।সদর দরজা খোলাই ছিলো।ভেতরে প্রবেশ করে অরিহা চেচিয়ে উঠে,,
“আম্মু আম্মু কোথায় তুমি?”

অরিহার মা বেলী বেগম রান্নাঘর থেকে ছুটে এলেন। মেয়েকে এই সময় বাড়িতে দেখে কিঞ্চিৎ অবাক হলেন।সাথে আবার অপরিচিত একজন মেয়ে ও আছে। বেলী বেগম মেয়েকে উদ্দেশ্য করে শুধালেন,,,
“কিরে তুই এই সময়ে এখানে। তোর তো স্কুলে থাকার কথা এখন।আর উনিই বা কে?”

চিত্রা এবার বলল,,“আন্টি আমি চিত্রা। ওকে আমিই নিয়ে এসেছি। আপনাকে কিছু কথা বলার ছিলো বলতে পারি?”

“আগে বসো মা তারপর বলো। কি করেছে এই পাজি মেয়ে”

চিত্রা বসলো। বেলী বেগম ও অন্য সোফায় বসলো। অরিহা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।নিশ্চয়ই মা জানলে তাকে ভীষণ বকবে। বাসে তো সে শখ করে উঠেছিলো। বাসে উঠতে তার ভীষণ ভালো লাগে। চিত্রা সব খুলে বলল বেলী বেগমকে। বেলী বেগম শুনে হতভম্ব। তার ছোট মেয়েটির সাথে কি হলো। আজ সবাই ব্যস্ত বিধায় একা ছেড়েছিলো সে অরিহাকে। আর এই মেয়ে বাসে উঠে এতো কাহিনী করলো।
“আন্টি ওকে বকবেন না। ছোট মানুষ ভুল করেছে। তবে চেষ্টা করবেন এরপর থেকে ওকে স্কুলে দিয়ে আসার। একা কোথাও যাওয়া নিরাপদ নয়।”

“ধন্যবাদ মা তোমায় আমার মেয়েটাকে সাহায্য করার জন্য। আসলে আজ আমার ছেলেটা একটু ব্যস্ত তাই একা ছেড়েছিলাম। রিকশা করে যেতে বলেছিলাম তবে ও যে বাসে করে যাবে কে জানতো!”

“আন্টি আপনি ওকে এখানকার স্কুলে ভর্তি করিয়েন। দূরের স্কুলে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।”

“হ্যাঁ মা আমি ভেবেছি এখানের স্কুলেই ওকে ভর্তি করিয়ে দিবো।আজ যেতে দিতে চাইছিলাম না আমরা কেউ। উনি জোর করে গিয়েছেন”

চিত্রা উঠে দাঁড়িয়ে বলল,,,
“আন্টি আজ উঠি। অনেক দেরি হয়েছে।”

বেলী বেগম অনুরোধ করে চিত্রাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,,,“কিছু খেয়ে যাও মা”

“না না আন্টি আজ উঠি অন্য একদিন।আজ দেরি হয়ে গিয়েছে।”
“বাড়ি কোথায় তোমার মা?”

“আন্টি আপনাদের পাশের বাড়িটি আমাদের বাড়ি”

“ওহ তুমিই তাহলে আরমান সাহেবের মেয়ে। গতকাল তোমাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম।তোমার আম্মা অনেক ভালো মনের মানুষ।তুমি কিন্তু আবার আসবে চিত্রা”

“জি আন্টি আসবো”

বেরিয়ে যাওয়ার সময় চিত্রা অরিহাকে বলল,,,“এমন আর করো না। একা বের হওয়া নিরাপদ নয়।এখন গিয়ে বিশ্রাম নাও।আন্টি কিছু বলবেন না তোমায়”

অরিহা প্রতিউত্তরে হাসলো।চিত্রাও বের হলো বাড়ি থেকে।সিড়ি দিয়ে নামার সময় বেখেয়ালিতে কারো সাথে ধাক্কা খেলো।চোখ তুলতেই সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লম্বা চওড়া বলিষ্ঠ এক পুরুষকে।পুরুষটি বিরক্তিকর দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার পানে। তবে মুহুর্তেই তার বিরক্তিভাবটা কেটে গেলো।চিত্রা দুঃখিত বলে পাশ কাটিয়ে বাড়িতে চলে আসে।চিত্রা কলিংবেল বাজাতেই তার মা মরিয়ম সুলতানা এসে দরজা খুলেন।মেয়েকে এতো তাড়াতাড়ি ফিরতে দেখে বেশ অবাক হলেন কারণ চিত্রা আজ বান্ধবীর বিয়েতে গিয়েছিলো।চিত্রা ক্লান্ত শরীরটা সোফায় এলিয়ে দিলো।

“চিত্রা তুই আজ এতো তাড়াতাড়ি এলি যে”

“এখন বলার একটু ও শক্তি নেই আম্মা।তুমি আমাকে খাবার দাও খিদে লেগেছে”

মরিয়ম সুলতানা বুঝলেন মেয়ে আবার কিছু করে এসেছে।মেয়েকে ধমক দিয়ে বললেন,,,“তুই আবার ঝামেলা করে এসেছিস?কবে ঠিক হবি তুই”

“আম্মা আমি সত্যি অনেক ক্লান্ত তুমি খেতে দিবে না যাবো নিজের রুমে”

“তুই আমার একটা কথাও শুনিস না। বাপ মেয়ে দুটোই এক।আমায় জ্বালিয়ে মারলো।আরেকটা তো টো টো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে”

মরিয়ম সুলতানা চলে গেলেন বকতে বকতে।চিত্রা হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে নিজের রুমে চলে আসলো।ব্যাগটা জায়গা মতো রেখে বিছানায় ধপাস করে শুয়ে পরলো।ক্লান্ত সে প্রচন্ড।সকালে দেরি হওয়ায় না খেয়েই বেরিয়ে পরেছিলো।শরীর চলছে না আর। ফোনটাও বেজে উঠলো।হাতড়ে ফোনটা চোখের সামনে ধরলো।স্ক্রিনে সাজিয়া নামটা জ্বলজ্বল করছে।সাজিয়া তার প্রিয় বান্ধবী।

“আজ আসলি না কেনো চিত্রা।আমরা সবাই অপেক্ষা করেছি।বেচারি মিহি মন খারাপ করেছে।অসুস্থ তুই?”

চিত্রা বহু কষ্টে টাইপ করলো,,,“ অসুস্থ হয়ে পরেছি একটু। কাল সব বলবো তোকে।এখন ঘুমাবো বাই”

আজ বান্ধবীর বিয়ে ছিলো। পালিয়ে বিয়ে করবে তারা। পরিবার মানছিলো না। সাক্ষী দিতে বলেছিলো। যদিও সে এসব বিষয় পছন্দ করে না তবুও বান্ধবী হওয়ায় যেতে চেয়েছিলো।তবে সম্ভব হলো না।

“কিরে তুই না স্কুলে গেলি”

অরিহা সোফায় বসে চিপস খাচ্ছিলো আর কার্টুন দেখছিলো।পরনে তার এখনো স্কুল ড্রেস। পরিচিত কন্ঠ শুনে তার দিকে তাকালো।কন্ঠের মালিক তার একমাত্র ভাই।সে এসে ধপাস করে বসে পরে।অরিহার হাত থেকে চিপসের প্যাকেটটা কেড়ে নিয়ে নিজে খেতে থাকে।অরিহা চেঁচিয়ে বেলী বেগমকে ডাকে।বেলী বেগম রান্নাঘর থেকে ছুটে আসেন।
“আম্মু তোমার ছেলে আমার চিপস নিয়ে নিয়েছে”

“আষাঢ় ওকে চিপসের প্যাকেট ফেরত দিয়ে আমার কাছে আয় কথা আছে”

আষাঢ় মায়ের মুখভঙ্গি দেখে বুঝলো মা সিরিয়াস কিছুই বলবে।সে অরিহাকে চিপসের প্যাকেট ধরিয়ে রান্নাঘরে চলে আসে।বেলী বেগম আষাঢ়কে দেখে চুলা বন্ধ করলেন।আষাঢ়কে নিয়ে নিজের রুমে আসলেন। সব খুলে বললেন তিনি।চিত্রা কিভাবে সব সামলেছে সেটাও বললেন। সব শুনে আষাঢ়ের চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেলো। তার আদরের বোনকে কেউ নোংরা স্পর্শ করেছে!

“মা তুমি অরিহাকে আর একা ছাড়বে না। এখন থেকে আমিই ওকে দিয়ে আসবো।আর এখানকার স্কুলে ভর্তির ব্যবস্থা করছি আমি যতদ্রুত সম্ভব”

“তুই মাথা গরম করিস না। আষাঢ় আমি যেনো শুনি না তুমি উল্টো পাল্টা কিছু করেছো।চিত্রা তাকে যথেষ্ট শিক্ষা দিয়েছে।আর প্রয়োজন নেই”

“কিন্তু মা..”

“আর কথা নয় আষাঢ়। তোমার বোনকেও চিত্রা মতো সাহসী হতে হবে।চিত্রা মেয়েটি যথেষ্ট সাহসী এবং ভালো।অরিহাকেও অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শিখতে হবে”

আষাঢ় শুনলো এরপর বেরিয়ে আসলো রুম থেকে। অরিহার দিকে তাকালো এক পলক অতঃপর বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো। আষাঢ় যথেষ্ট শান্ত প্রকৃতির একজন ছেলে। তবে রাগলে সহজে শান্ত হয় না। বোনকে ভালোবাসে। সেই বোনের সাথে কেউ এমন করেছে আর সে চুপ থাকবে। তবে চিত্রাকে তার ভালো লেগেছে। ধারণা করতে পেরেছে তখন যার সাথে সে ধাক্কা খেয়েছে সেই চিত্রা।

#চলবে~